হযরত আয়েশা (রা:) এর বয়স

রাসুল (সাঃ) এর সম্বন্ধে বলা হয় তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ) কে আয়েশার ৬ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। অথচ আমি অনুসন্ধান করে দেখতে পেলাম রাসূল (সাঃ) এর সাথে বিয়ের সময় হযরত আয়শা (রাঃ) র বয়স মাত্র ৬ বছর ছিল এটা মস্তবড় এক ঐতিহাসিক ভ্রান্তি।

সহীহ বুখারী, মুসলিম সহ অনেক হাদীস গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রাঃ) র বয়স নিয়ে যে রেফারেন্স এসেছে তা হাইসাম (বা হিসাম) বিন উরওয়াহ কর্তক বর্নিত একটি হাদিসেরই উৎস এবং এটা সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করবার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

তার মধ্যে প্রথম কারণ হলো হাদীসের কোন বিষয়বা রাসুল (সাঃ) এর জীনযাপন পদ্ধতি কোনভাবেই আল কোরআনের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারেনা। কাজেই বিবাহযোগ্য বয়সের বিষয়ে আল কোরআনের যে নির্দেশ, এই ঘটনা তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাহলে? উত্তর একটাই, এই হাদীসটা সঠিক নয়, সঠিক হতেই পারেনা।

যা হোক, এবারে আসি ঐতিহাসিক সত্যগুলো নিয়েঃ

রাসুল (সাঃ) এর সাথে আয়েশা (রাঃ) র বিয়ে হয় ৩য় হিজরী সনের সাওয়াল মাসে যা ইংরেজী ৬২৩-৬২৪ সাল।

যদিও বলা হয় হযরত আয়েশা (রাঃ)র জন্ম ৬১৪ খৃষ্টাব্দে কিন্তু সহীহ বুখারীতে এসেছে আল কোরআনের ৫৪ তম অধ্যায় নাজিল কালে আয়েশা (রাঃ) একজন কিশোরী (Jariyah) বয়স্কা ছিলেন। উল্লেখ্য ৫৪তম উক্ত অধ্যায় নাযিল হয় ৬১২ খৃষ্টাব্দের দিকে। সে হিসাবে হযরত আয়েশার বয়স তখন ১০ বছর হলেও ৬২৩-৬২৪ খৃষ্টাব্দ সালে তাঁর বয়স কোনভাবেই ২০ বছরের নিচে নয়।

(Sahih Bukhari, kitabu'l-tafsir, Arabic, Bab Qaulihi Bal al-sa`atu Maw`iduhum wa'l-sa`atu adha' wa amarr)

অধিকাংশ বর্ণনাকারির মতে হযরত আয়েশা (রাঃ) বদরের যুদ্ধ (৬২৪ খৃষ্টাব্দে) ও ওহুদের যুদ্ধে (৬২৫ খৃষ্টাব্দে) অংশগ্রহন করেছেন। উল্লেখ্য যে রাসুল (সাঃ) এর বাহিনীতে ১৫ বছর এর কম বয়স্ক কেউ গ্রহনযোগ্য ছিলনা এবং তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সুতরাং সেসময় যে হযরত আয়েশার বয়স ৬ বা ৯ ছিলনা তা বলাই বাহুল্য।

A narrative regarding Ayesha's participation in the battle of `Uhud is given in Bukhari, (Kitabu'l-jihad wa'l-siyar, Arabic, Bab Ghazwi'l-nisa' wa qitalihinna ma`a'lrijal; that all boys under 15 were sent back is given in Bukhari, Kitabu'l-maghazi, Bab ghazwati'l-khandaq wa hiya'l-ahza'b, Arabic).

অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মতে হযরত আয়েশার বোন আসমা ছিলেন তাঁর চেয়ে দশ বছরের বড়। ইতিহাস থেকে জানা যায় আসমা ৭৩ হিজরী সনে যখন মৃত্যুবরণ করেন তাঁর বয়স ছিল ১০০ বছর। সে হিসাবে ১লা হিজরীতে তাঁর বয়স হয় ২৭ বছর। তাহলে সে হিসেবে হযরত আয়েশার বয়স যে তখন ১৭ র কম ছিলনা তা বোঝা যায়। তাহলে ৬২৩-৬২৪ খৃষ্টাব্দ তাঁর বয়স ১৮/১৯ বছর।
(For Asma being 10 years older than Ayesha, see A`la'ma'l-nubala', Al-Zahabi, Vol 2, Pg 289, Arabic, Mu'assasatu'l-risalah, Beirut, 1992. Ibn Kathir confirms this fact, [Asma] was elder to her sister [Ayesha] by ten years" (Al-Bidayah wa'l-nihayah, Ibn Kathir, Vol 8, Pg 371, Arabic, Dar al-fikr al-`arabi, Al-jizah, 1933). For Asma being 100 years old, see Al-Bidayah wa'l-nihayah, Ibn Kathir, Vol 8, Pg 372, Arabic, Dar al-fikr al-`arabi, Al-jizah, 1933). Ibn Hajar al-Asqalani also has the same information: "She [Asma (ra)] lived a hundred years and died in 73 or 74 AH." Taqribu'l-tehzib, Ibn Hajar Al-Asqalani, Pg 654, Arabic, Bab fi'l-nisa', al-harfu'l-alif, Lucknow).

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল তাবারী র বই থেকে পাওয়া যায় হযরত আবু বকর (রাঃ) র চার সন্তান ছিলেন যাঁরা সকলেই ইসলামপূর্ব যুগে জন্মগ্রহন করেন। (ইসলামপূর্ব যুগ ৬১০ খৃষ্টাব্দ শেষ হয়)। তাহলে নিশ্চয়ই হযরত আয়েশা (রাঃ) র জন্ম ৬১০ খৃষ্টাব্দ এর পূর্বে। সে হিসাবেও তিনি বিবাহের সময় ৬/৯ বছর বয়স্কা ছিলেন না।

Tarikhu'l-umam wa'l-mamlu'k, Al-Tabari, Vol 4, Pg 50, Arabic, Dara'l-fikr, Beirut, 1979).

আরেক প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে হাইসাম থেকে জানা যায় হযরত আয়েশা (রাঃ) হযরত উমর ইবন আল খাত্তাব (রাঃ) এর বেশ আগে ইসলাম গ্রহন করেন। (উমর ইবন আল খাত্তাব (রাঃ) ৬১৬ খৃষ্টাব্দে ইসলাম গ্রহন করেন)। আবার হযরত আবু বকর (রাঃ) ইসলাম গ্রহন করেন ৬১০ খৃষ্টাব্দে। সুতরাং হযরত আয়েশা (রাঃ) ও ৬১০ এর কাছাকাছি সময়েই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। তার অর্থ আবারো দাঁড়ায় যে তিনি ৬১০ খৃষ্টাব্দের আগেই জন্মগ্রহন করেছিলেন এবং কোন ধর্ম গ্রহন করবার নূন্যতম বয়স (৬/৭ হলেও) তাঁর ছিল। তাহলে ৬২৩-৬২৪ সালে তার বয়স প্রায় ১৮-২০ হয়।
(Al-Sirah al-Nabawiyyah, Ibn Hisham, vol 1, Pg 227 – 234 and 295, Arabic, Maktabah al-Riyadh al-hadithah, Al-Riyadh)

হাম্বলি মাযহাবের ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন বিবি খাদিযাহ (রাঃ) র মৃত্যুর পরে (৬২০ খৃষ্টাব্দ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্য খাউলাহ নামের একজন ২টা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। যার মধ্যে হযরত আয়েশার (রাঃ) র কথা উল্লেখ করবার সময় একজন পূর্ণবয়স্ক যুবতী হিসেবেই উল্লেখ করেন কোন ছোট্ট শিশু হিসেবে নয়।

(Musnad, Ahmad ibn Hanbal, Vol 6, Pg 210, Arabic, Dar Ihya al-turath al-`arabi, Beirut).

আবার ইবনে হাযর আল আসকালানি র মতে হযরত ফাতেমা (রাঃ) আয়েশা (রাঃ) র থেকে ৫ বছর বড় ছিলেন। আর ফাতেম (রাঃ) র জন্মের সময় রাসুল (সাঃ) এর বয়স ছিল ৩৫ বছর। সে হিসেবে আয়েষা (রাঃ) র জন্মের সময় মুহাম্মদ (সাঃ) এর বয়স ৪০ হবার কথা। আর তাঁদের বিয়ের সময় আয়েশা (রাঃ) ৬/৯ না বরং ১৪-১৫ বছর বয়স হবার কথা।

(Al-isabah fi tamyizi'l-sahabah, Ibn Hajar al-Asqalani, Vol 4, Pg 377, Arabic, Maktabatu'l-Riyadh al-haditha, al-Riyadh,1978)

ওপরের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হলো হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে বিয়ের সময় যে ৬/৯ বছরের শিশু ছিলেননা সেটাই দেখানো। আর কোন হাদীস যদি আল কোরআনের নির্দেশনার সাথে অসামন্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই সেই হাদীসের ওপর ভরসা রাখা যুক্তিযুক্ত না। তা সে বুখারী মুসলিম বা সমস্ত সিহাহ সিত্তাহতেই থাকুকনা কেন। আর এই বৈপরিত্য ধরবার জন্য নিজেদের বিবেককেও ব্যাবহার করা উচিত সকল মুসলমানের।


 বিখ্যাত স্কলারদের মতে আয়েশা (রা.) এর বিয়ের সময় বয়স ৯ বছর ছিলনা বরং তার বয়স কিছুতেই ১৭ বছরের কম হতে পারেনা এবং সম্ভবত তখন তার বয়স ১৯ বছর ছিল। আসলে এ বিষয়ে আমরা কম জেনেই অনুমানের আশ্রয় নিই। বিখ্যাত স্কলার আদিল সালাহি এ ব্যপারে কি বলছেন পড়ুন:

বিশিষ্ট স্কলার আদিল সালাহি এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাব দেন, যেটি প্রকাশিত হয় আরব নিউজে ৭ মার্চ ২০০৩ তারিখে। তিনি বলেন
"এ প্রশ্নটি ইসলাম এবং রাসুল (সা.)-এর ব্যক্তি চরিত্রের প্রতি আক্রমণ বৃদ্ধির সংগে সংগে বার বার উঠে আসছে। কিন্তু ইসলাম অথবা রাসুল (সা.)-এর চরিত্র এবং ব্যবহারে এমন কিছু নাই যার জন্য আমাদের ক্ষমা চাওয়ার বা বিব্রত বোধ করার প্রয়োজন আছে। তারপরও রাসুল (সা.)-এর সাথে আয়েশা (রা.)-এর বিয়ে এবং সে সময় তার বয়স প্রসংঙ্গে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে যাতে প্রমাণ হয় এব্যপারে আদৌ অভিযোগ করার মত কিছুই নাই। এ ব্যপারে যে বর্ণনাটি সবচেয়ে বেশী উদ্ধৃত হয় তা হচেছ, রাসুল (সা.) যখন বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন আয়েশা (রা.)-এর বয়স ছিল ছয় এবং তিনি যখন তাকে বিয়ে করেন তখন তার বয়স ছিল নয়। মানুষ এটাকে প্রতিষ্ঠিত সত্য বলে গ্রহন করে থাকে। কিন্তু যখন আমরা এসব বর্ণনা এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত বিষয়গুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করি, তখন আমরা দেখতে পাই, এসব বর্ণনা এমনকি প্রাথমিক নিরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হতে পারেনা।
সর্বপ্রথম আমাদের যে বিষয়টি বুঝতে হবে তা হচ্ছে, রাসুল (সা.)-এর সময় আরব সমাজের অধিকাংশই ছিল নিরক্ষর এবং খুব কম লোকই লিখতে বা পড়তে পারত। বড় বড় ঘটনাগুলোর সন তারিখ হিসেব রাখার জন্য যেখানে কোন নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হত না, সেখানে মানুষের জন্ম মৃত্যুর তারিখ হিসেব রাখার কথাতো বাদই দেয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমরা পড়ি - রাসূল (সা.) জন্মগ্রহন করেছেন ‘হাতির বছরে’। হাতির বছর বলতে বোঝায় সেই বছর যেবার আবিসিনিয়ার সেনাপতি ইয়েমেন থেকে মক্কা এসেছিল এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে কাবা ঘর ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। একটি বড় হাতি সৈন্য বাহিনীর সামনে মার্চ করে আসছিল - আর তাই ঘটনাটি এবং বছরটি হাতির নামে পরিচিত হয়।
রাসূল (সা.)-এর সময় আরবে মানুষের বয়স সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো বিভ্রান্তিকর এবং অনির্দিষ্ট ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সাধারণ ধারণা হচ্ছে, খাদিজা (রা.)-এর সাথে রাসূল (সা.)-এর বিয়ের সময় রাসুল (সা.)-এর বয়স ছিল ২৫ অন্যদিকে খাদিজা (রা.)-এর বয়স ছিল ৪০। ইবনে হিশাম রচিত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সিরাত গ্রন্থে এরকম উল্লেখ থাকলেও সে সময় রাসুল (সা.)-এর বয়স সম্পর্কে আরো দু’টি ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে খাদিজা (রা.)-এর সাথে বিয়ের সময় রাসূল (সা.)-এর বয়স ছিল ৩০, অন্যটিতে বলা হয়েছে ২৯। সে সময় খাদিজা (রা.) বয়স কত ছিল সে সম্পর্কেও বর্ণনার বিভিন্নতা আছে - কোথাও বলা হয়েছে সে সময় তার বয়স ছিল ৩৫ কোথাও বলা হয়েছে ২৫। রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্যদের একজন ছিলেন রাসূল (সা.)-এর চাচাতো ভাই ইবনে আব্বাস (রা.)। তার থেকে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, যেখানে তিনি বলেছেন, বিয়ের সময় রাসূল (সা.) ও তার স্ত্রী উভয়ের বয়সই ছিল ২৮ বছর। খাদিজা (রা.)-এর গর্ভে রাসূল (সা.)-এর ছয়টি সন্তান জন্মগ্রহন করেছে। এদিক থেকে বিচার করলে বিয়ের সময় তার বয়স চল্লিশ ছিল এমন ধারণা করার উপায় নেই, অথচ এটাই হচ্ছে সবচেয়ে প্রচলিত বর্ণনা। প্রকৃতপক্ষে তার বয়স এর চেয়ে অনেক কম হবার কথা। তার বয়স ২৮ অথবা ২৫ ছিল এমন বর্ণনাই অনেক বেশী যুক্তিসঙ্গত মনে করা যেতে পারে।
খাদিজা (রা.)-এর জীবদ্দশায় রাসূল (সা.) আর কাউকে বিয়ে করেননি এবং তিনি খাদিজার (রা.) সাথে ২৫ বছর কাটিয়েছেন। তার ইন্তেকালের পর যখন তিনি খুবই চাপের মুখে ছিলেন, তখন একজন মহিলা সাহাবী তাকে পরামর্শ দিয়ে বল্লেন, তার বিয়ে করা উচিৎ যাতে তিনি দিনের দীর্ঘ প্রচারকাজ শেষে বাড়িতে একজন সঙ্গিনী পান এবং স্বস্তি লাভ করতে পারেন। সেই মহিলা তাকে দু’জনের কথা বল্লেন, একজন কুমারী আয়েশা অন্যজন বিধবা সাওদা। রাসূল (সা.) তাকে দুজনের কাছেই প্রস্তাব নিয়ে যেতে বল্লেন।
রাসূল (সা.)-কে নতুন বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল তার জন্য একজন সঙ্গীনি এবং স্বস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু যারা বলতে চান যে আয়েশা (রা.)-এর বয়স সে সময় ছয় ছিল তারা এটা বিশ্বাস করতে বলেন যে ঐ মহিলা সাহাবীটি রাসূল (সা.)-কে মাত্র ছয় বছরের একটি বালিকার সাথে বিয়ের তথা সঙ্গ লাভের প্রস্তাব করেছিলেন। আর বয়স সংক্রান্ত ঐসব বর্ণনা যদি গ্রহন করা হয় তাহলে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক যে, ঐ মহিলা সাহাবীটি কি তাহলে রাসূল (সা.)-কে সঙ্গ দেয়ার কথা বলছিলেন নাকি সঙ্গ দেয়া কথা বলছিলেন তার মেয়েকে, যার বয়স তখন ছয় বছরের চেয়ে বেশী ছিল ?
বর্ণনাগুলো শুধু যৌক্তিকতার আলোকে বিচার না করে একে কিছু দালিলীক ভিত্তি প্রমাণ স্বাপেক্ষে বিবেচনা করা উচিৎ। এজন্য আমরা ইবনে ইসহাক রচিত সিরাত গ্রন্থ দেখব। আর ইবনে ইসহাক রচিত সিরাত গ্রন্থ হচেছ সমস্ত সিরাত গ্রন্থগুলোর ভিত্তি এবং সবচেয়ে নির্ভুল। সেখানে সেসব মুসলিমদের একটি তালিকা আছে, যারা ইসলামী দাওয়াতের শুরুর বছরগুলোতে ইসলাম গ্রহন করেছিলেন। সেই তালিকাটিতে প্রায় পঞ্চাশ জন মুসলিমের নাম আছে। যার মধ্যে আবু বকরের দুই কন্যা আসমা এবং আয়েশার নামও অন্তর্ভুক্ত আছে। সেখানে এটাও যোগ করা আছে যে তিনি সে সময় ছোট ছিলেন। এই তালিকায় আয়েশার নাম এসেছে বিশ নম্বরে। কিন্তু আমরা এই ক্রমের উপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করবনা। আমরা যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেব তা হচ্ছে, এই তালিকার সমস্ত মুসলিমই ইসলাম গ্রহন করেছিলেন নবুয়্যতের পঞ্চম বছরের আগে। কেননা ঐ বছরই আবিসিনিয়ায় মুসলমানদের প্রথম হিজরত সংঘঠিত হয় এবং ঐ তালিকায় এমন অনেকের নাম ছিল যারা এই হিজরতে অংশগ্রহন করেছিলেন। তাই বলা যায় পঞ্চম বছরে বা তার পূর্বে আয়েশা (রা.) ছোট ছিলেন, কিন্তু নিশ্চয় ততটা বড় ছিলেন যাতে তার নাম একটি নতুন দাওয়াতে বিশ্বাস স্থাপনকারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তার বয়স কত ধরে নিতে পারি আমরা ? নিশ্চয় মনে করা ঠিক হবে না যে তার বয়স ২ অথবা ৪ অথবা ৫ ছিল আর তারপরও তাকে কীর্তিমানদের নামের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাই যদি হত তাহলে তালিকার পঞ্চাশজনের অন্যান্য সকলেরই যত বাচ্চা কাচ্চা ছিল সকলেরই নাম সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হত। আসলে তিনি নিশ্চয় এতটা বড় ছিলেন যাতে তাকে ধর্ম পরিবর্তন করা বা নতুন ধর্ম গ্রহন করা - এই মাত্রার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে উল্লেখ করা যায়। এই হিসেবে লোকে যদি তাকে অনেক ছোট বলার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে চায়, তাহলেও তার বয়স ১০ অথবা ৮ এর কম হবার কথা না।
এখন আমাদের দেখতে হবে এর কত বছর পর তার বিয়ে হয়েছিল। আমরা জানি তার বিয়ে হয়েছিল রাসূল (সা.) এবং সাহবীদের মদিনায় স্থায়ী হবার পর, অর্থাৎ, নবুয়্যতের ১৩ কিংবা ১৪ তম বছরে। সাধারণ অংক কষলে দেখা যাবে যখন রাসূল (সা.)-এর সম্ভাব্য স্ত্রী হিসেবে তার নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল তখন তার বয়স ১৪-এর কম হতে পারেনা বা অন্যভাবে বলা যায় রাসূল (সা.)-এর সাথে বিয়ের সময় তার বয়স ১৭-এর কম হতে পারেনা। এমনকি প্রবল সম্ভাবনা আছে যে তার বয়স আসলে আরও বেশী ছিল, সম্ভবত ১৯।
এখন কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে রাসূল (সা.) ৫৩ অথবা ৫৪ বছর বয়সে ১৭ বা ১৯ বছরের এক তরুণীকে বিয়ে করলেন কেন ? এটা বুঝতে হলে আমাদের একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে আমরা সামাজিক রীতি নীতিকে অপর একটি ভিন্ন সমাজের জন্য প্রযোজ্য করতে পারিনা - এমনকি যদি দু’টি সমাজ একই সময়েরও হয়। তাই আমেরিকার সামাজিক রীতি নীতি আফ্রিকা, মালয়েশিয়া বা জাপানে প্রযোজ্য নয়। আবার এদের কোন দেশেরটিই অন্য আর একটি দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। সেসময়ের আরবের লোকেরা একজন লোক ও তার স্ত্রীর মধ্যে বয়সের পার্থক্যের তেমন কোন গুরুত্ব আছে বলে মনে করতনা। এখানে উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ও তার মেয়ে হাফসার কথা তুলে ধরা যেতে পারে। যখন তার মেয়ের তালাক হয়ে গেল তখন উমর (রা.) আবু বকর (রা.)-কে তার মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, যেখানে উমর (রা.) নিজেই আবু বকরের (রা.) চেয়ে ১০ বছরের ছোট ছিল। যদি বিয়েটি হত তাহলে স্বামী স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য ত্রিশের কম হতনা। তারপরও উমর ভাবছিলেন এটি একটি চমৎকার এবং প্রীতিকর জুটি হতে পারে। যখন আবু বকর এ প্রস্তাবের জবাব দিতে দেরী করছিলেন তখন তিনি উসমানকে (রা.) প্রস্তাব দেন, যে উমরের (রা.) চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের ছোট ছিল। কিন্তু উসমানের (রা.) বিয়ে না করার একটি কারণ ছিল, ফলে শেষে রাসূল (সা.)-এর সাথে উমরের কন্যা হাফসার বিয়ে হল। রাসূল (সা.) আবু বকরের সমবয়সী বা তার কিছূটা বড় ছিলেন। আসল কথা হল তখন বয়সের পার্থক্যকে গণনায় ধরা হত না।"
একজন বড় স্কলার এবং বর্তমান কালে লিখিত অন্যতম ও বিশাল সিরাত গ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে আদিল সালাহির কথা অবশ্যই বিবেচনার দাবী রাখে। তদুপরি তিনি যে যুক্তিগুলো উপস্থাপন করেছেন তা খুবই শক্তিশালী। অনেক সময় আমাদের মধ্যে দুর্বল ধারণাগুলো প্রচলন পায় বেশী। আশা করি আদিল সালাহির লেখাটি আমাদের ধারণাকে পূনুর্বিন্যস্ত করতে সহায়তা করবে এবং বিপথগামী কিছু লোকের মনগড়া অভিযোগের পথ বন্ধ করবে। যদিও তারা তাদের মুখ বন্ধ করবে কিনা জানা নেই। কারণ মিথ্যা অভিযোগকারীরা সাধারণত যুক্তি দিয়ে পরিচালিত হয়না। তারা যুক্তি দিয়ে পরিচালিত হোক এটুকুই আমরা কামনা করতে পারি মাত্র।


0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম