রেডিওতে মুজিবের সরকার পতন ও শেখ মুজিবের নিহত হবার খবর ঘোষিত হয়েছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্নেল (অবঃ) তাহের, কর্নেল (অবঃ) আকবর হোসেন, মেজর (অবঃ) শাহজাহান ওমর, মেজর (অবঃ) জিয়াউদ্দিন, মেজর (অবঃ) রহমতউল্লাহ, ক্যাপ্টেন (অবঃ) মাজেদ এবং এক্স পিএমএ ক্যাডেট মোস্তাক ও সরাফত এসে হাজির হল রেডিও বাংলাদেশে। ঘোষণা শুনেই এসেছেন তারা বিপ্লবের প্রতি তাদের সমর্থন ও অভিনন্দন জানাতে। খবর এল পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর আমিন আহমদ চৌধুরী ইতিমধ্যেই সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পকে নিরস্ত্র করে তাদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। লেঃ কর্নেল রশিদ চলে গেছে জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদকে নিয়ে আসার জন্য আর মেজর (অবঃ) ডালিম গেল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও বাহিনী প্রধানদের নিয়ে আসতে। ঘটনাগুলো ঘটছিল অতি তরিৎ গতিতে। ঢাকা সেনানিবাস তখন সম্পুর্ণভাবে সেনাদের নিয়ন্ত্রণে। খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে সারা ক্যান্টনমেন্টে। ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল বিপ্লবকে প্রতিহত করার জন্য চেষটা করে । কিন্তু ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের পক্ষে তখন কিছুই করা সম্ভব ছিল না। তিনি ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন বটে কিন্তু তার অধীনস্থ রেজিমেন্ট ও ব্যাটালিয়নগুলো সবই তখন সেনা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে, বৈপ্লবিক অভুত্থানের স্বপক্ষে। শাফায়াত জামিলের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে জেনারেল শফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ (চীফ অফ জেনারেল ষ্টাফ) কে অনুরোধ জানান কিছু করার জন্য। ব্রিগেডিয়ার খালেদ জবাবে তাকে জানান, “Bangabandhu is dead. The army has revolted and whole army has celebrated.”এ পরিস্থিতিতে কারো কিছু করার নেই।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মেজর (অবঃ) ডালিম জেনারেল শফিউল্লাহ, জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দোকার, নৌবাহিনী প্রধান এমএইচ খানকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল রেডিও বাংলাদেশে। রশিদ ফিরে এল জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমেদকে নিয়ে। আমিন ফিরে এল তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রক্ষীবাহিনী প্রধান কর্নেল আবুল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে। বিডিআর প্রধান এবং পুলিশ প্রধানকেও ডেকে আনা হল। রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমদ রেডিও-তে জাতির প্রতি তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানরা সবাই রাষ্ট্রপ্রধান খন্দোকার মোশতাক আহমদের আনুগত্য প্রকাশ করে বৈপ্লবিক অভুত্থানের স্বপক্ষে ভাষণ দিলেন রেডিওতে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে আওয়ামী-বাকশালী নেতারা অনেকেই গ্রেফতার হন। ঐ দিনই জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ এক অনাড়ম্ভর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করেন। অস্থায়ী বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। একই দিন উপ-রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন জনাব মোহাম্মদুল্লাহ। মন্ত্রী পরিষদও গঠিত হয় সেদিনই। মূলত এরা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ ওবাকশালের সদস্য এবং নির্বাচিত সাংসদ।
মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ:
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ আলী
ফনিভূষণ মজুমদার
মোঃ সোহরাব হোসেন
আব্দুল মান্নান
মনরঞ্জন ধর
আব্দুল মোমেন
আসাদুজ্জামান খান
ডঃ এ আর মল্লিক
ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী
প্রতিমন্ত্রীঃ
শাহ মোয়াজ্জম হোসেন
দেওয়ান ফরিদ গাজী
তাহের উদ্দিন ঠাকুর
অধ্যাপক নূরুল ইসলাম
নূরুল ইসলাম মঞ্জুর
কে এম ওবায়দুর রহমান
মোসলেম উদ্দিন খান
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ
ক্ষিতিশচন্দ্র মন্ডল
সৈয়দ আলতাফ হোসেন
মোমিন উদ্দিন আহমদ
খন্দোকার মোশতাক আহমেদ ধারনার চেয়েও নিজেকে বড় প্রমাণিত করলেন। বাকশাল সরকারের ১৮জন মন্ত্রীর ১০জন এবং ৯জন প্রতিমন্ত্রীর ৮জনই মোশতাক সরকারে যোগদান করেছিলেন ১৫ই আগষ্ট বৈপ্লবকে অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়ে। ১৫ই আগষ্ট বিপ্লবের দিন বাকশালের একজন শীর্ষ নেতা জনাব আবদুল মালেক উকিল লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। সাংবাদিকরা শেখ মুজিবের মৃত্যুতে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “বাংলাদেশে ফেরাউনের পতন ঘটেছে।”
জনাব মহিউদ্দিন আহমদ আর একজন শীর্ষ স্থানীয় বাকশালী নেতা প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমদের বিশেষ দূত হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন ক্রেমলিনের নেতৃবর্গকে ১৫ই আগষ্টের যৈাক্তিকতা বোঝানোর জন্য। অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাইদ চৌধুরী সেচ্ছায় প্রথমত প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমদের ভ্রাম্যমান দূত পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ গ্রহন করে জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর নেতাদের ১৫ই আগষ্টের বিপ্লব ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের যৌক্তিকতা সর্ম্পকে অবগত করার দায়িত্ব পালন করেন।
পাকিস্তান বিপ্লবের প্রথম দিনই খন্দোকার মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। যে সৌদি আরব মুজিব সরকারকে দীর্ঘ সাড়ে চার বছর স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত ছিল সেই সৌদি আরবও বিপ্লবের দ্বিতীয় দিনে মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। গণচীন শুধু মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতিই দান করেনি বরং পিকিং বেতার ও ভয়েস অব আমেরিকা অভুত্থানের সমর্থনে একই সাথে হুঁশিয়ারী বাণী প্রচার করে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন একটি আভ্যন্তরীন ব্যাপার। সে দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে বিদেশী কোন প্রকার হস্তক্ষেপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীন সহ্য করবে না। এ ধরণের হস্তক্ষেপে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হতে পারে বিধায় গণচীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ধরণের হস্তক্ষেপে নিশ্চুপ থাকবে না। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই তারা গ্রহণ করবে। শুধু হুশিঁয়ারীই নয়; গণচীনের সেনাবাহিনীকে ভারতের যে কোন আগ্রাসী হামলার মোকাবেলায় সীমান্তে অবস্থান জোরদার করে তোলার হুকুম দিয়েছিল গণচীনের সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীনের হুশিঁয়ারী এবং দেশের জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সরকার ১৭ই আগষ্ট বাংলাদেশে আগ্রাসী সামরিক অভিযান চালাবার পূর্ব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। শুধু তাই নয়; অভ্যুত্থানের ১২দিনের মাথায় জাপান, ইরান, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আরো ৩৯টি দেশের সাথে ভারতও মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
রেডক্রসের চেয়্যারম্যান পদ থেকে কুখ্যাত গাজী গোলাম মোস্তফাকে অপসারিত করে বিচারপতি বি.এ সিদ্দিককে তার পদে নিযুক্ত করা হয়। রাষ্ট্রপতির ৯নং আদেশ বাতিল করা হয়। রাষ্ট্রপতি মোশতাক এক অধ্যাদেশ জারি করে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘোষণা করে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। মুজিব কর্তৃক দেশকে ৬১টি জেলায় বিভক্ত করে গভর্ণর নিয়োগের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। দেশের ১৯টি জেলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে জেলা প্রশাসকদের হাতে প্রশাসনের দায়িত্ব দেয়া হয়। দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি, মুজিব সরকারের ৬জন মন্ত্রী, ১০জন সংসদ সদস্য, ৪জন আমলা এবং ১২জন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিচারের জন্য দু’টো বিশেষ আদালত গঠিত হয়। সামরিক বাহিনীর ৩৬ জন দুর্নীতিপরায়ন অফিসারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়। রাজবন্দীদের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য বিলুপ্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সহযোগিতার আবেদন জানানো হয়। সরকারি আদেশে মশিউর রহমান এবং অলি আহাদকে বিনাশর্তে মুক্তি দান করা হয় ২৫শে আগষ্ট। একই দিনে বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানীকে রাষ্ট্রপতির নয়া সামরিক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করা হয়। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে জয়েন্ট চীফ অব ডিফেন্স ষ্টাফ হিসাবে এবং মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর স্থানে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে আর্মি চীফ অফ ষ্টাফ হিসাবে নিয়োগ করা হয়। বিমান বাহিনীর চীফ অফ ষ্টাফ হিসাবে নিযুক্ত হন এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব।
দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকা দুইটি মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। ১৬ই আগষ্ট মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানী নয়া সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে এক বার্তা পাঠান। দেশের প্রায় সমস্ত জাতীয়তাবাদী এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, নেতা এবং গণসংগঠনেরও সমর্থন লাভ করতে সমর্থ হয় নতুন সরকার। তারা সবাই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে তাদের সাহসী পদক্ষেপের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানান। ৩রা অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মোশতাক ঘোষণা করেন, ১৯৭৬ সালের ১৫ই আগষ্ট হতে দেশে বহুদলীয় অবাধ রাজনীতি পুনরায় চালু করা হবে এবং ১৯৭৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী দেশে সাধারণ নির্বাচন সংগঠিত করা হবে।
এভাবেই উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো নেবার ফলে দেশের সার্বিক অবস্থা অতি অল্প সময়ে শুধুমাত্র স্বাভাবিকই হয়ে উঠেছিল তাই নয়; দেশের আইন শৃঙ্খলা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং কল কারখানার উৎপাদনেও অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমে যায়। দেশে চুরি ডাকাতি ও চোরাচালানের মাত্রা কমে যায় বহুলাংশে। দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে পূর্ণমাত্রায়। দেশে বিদেশে অস্থায়ী সরকারের নীতিসমূহ ও পদক্ষেপগুলো প্রশংসিত হয়।
১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের উপরে বর্ণিত বিশদ বিবরনের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ কোন যুক্তিতে শেখ মুজিবের স্বৈরশাসনের অবসানকে শুধুমাত্র একটি মামুলি ‘হত্যাকান্ড’ হিসেবে জোর গলায় প্রলাপ বকে চলেছেন? তাদের মতে ঐ ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন এর সাথে জড়িত ছিল কিছু সংখ্যক ‘ উচ্ছৃংখল-বিপথগামী ’ তরুণ সামরিক অফিসার! যদি তাই হয়ে থাকতো তবে এই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে দেশের সামরিক বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, অন্যান্য আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সংগঠন, আইন বিভাগ, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এমনকি জাতীয় রক্ষীবাহিনী প্রধানগণ জাতির উদ্দেশ্যে প্রচারিত তাদের ভাষণে ১৫ই আগষ্ট বিপ্লবকে সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান করেছিলেন কেন? শুধু কি তাই? আওয়ামী-বাকশালীদের নেতা ও সাংসদদের অনেকেই কি করে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন? কেনই বা সেদিন কারফিউ জারি করা সত্ত্বেও ঢাকাসহ দেশের সর্বপ্রান্তে বিপ্লবের সমর্থনে বাধভাঙ্গা আনন্দ-উচ্ছাসে রাস্তায় নেমেছিল জনতার ঢল? এতেই প্রমাণিত হয় ১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক বিপ্লবের অগ্রণী হিসেবে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর তরুন সদস্যরা দয়িত্ব পালন করলেও এই বিপ্লবের মূল শক্তি ছিল দেশের জাগ্রত জনতা।
বস্তুতঃ শেখ মুজিব তার নিজের ও পরিবারের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী একটা ভিত্তি দেয়ার লক্ষ্যেই বাকশালী স্বৈরাচার কায়েম করেছিলেন। এভাবেই যুগযুগ ধরে স্বৈরাচারী শাসকরা আর্বিভুত হন। এরা একই নিয়মে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। জামার্নীর হিটলারের উত্থান ঘটেছিল এভাবেই। নাৎসী পার্টি তাকে মহামানব আখ্যায়িত করেছিল। বাকশালীরাও শ্লোগান তুলেছিল, এক নেতা, এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।
ফলশ্রুতিতে মুজিব নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়কে। ইটালীতে মুসোলিনির আবির্ভাবও ঘটেছিল একই প্রক্রিয়ায়। সব স্বৈরতান্ত্রিক এক নায়কত্বের ভাগ্যে জোটে একই পরিনতি। করুণ এবং মর্মান্তিক পরিসমাপ্তি।
সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিকরণের পর সেনা পরিষদ বিপ্লবের অবশিষ্ট উদ্দেশ্যাবলী বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়। লোকচক্ষুর অন্তরালে রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছিল তাদের লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টায়। পর্বত সমান প্রতিবন্ধকতার মুখে কাজ করতে হচ্ছিল সেনা পরিষদকে। ১৫ই আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর কেটে যায় ঘোর অন্ধকার। নবপ্রভাতের সূচনা ঘটে জাতীয় জীবনে। উম্মোচিত হয় মানবিক অধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার রুদ্ধ দুয়ার। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি হয় এক নতুন ধারার। ফলে প্রাণ ফিরে পায় নির্জীব, অসহায় দেশবাসী।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন, ৩রা নভেম্বরের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবে অগ্রণীর ভুমিকায় ছিলো দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী। ঘটনাগুলো তাই একই সূত্রে গাথা। বিশেষ করে ১৫ই আগষ্ট ও ৭ই নভেম্বরের মধ্যে রয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য যোগসুত্র। এই দুটি যুগান্তকারী অভ্যুত্থানের পেছনে কাজ করেছে একই চেতনা, একই শক্তি। ব্যতিক্রম শুধু ৭ই নভেম্বরে সেনা পরিষদ ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক দল এবং গ্রুপের সাথে যোগ দিয়েছিল কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন গণবাহিনী। বিচ্ছিন্নভাবে ১৫ই আগষ্ট ও ৭ই নভেম্বরের কোন একটি বিশেষ ঘটনার একক মূল্যায়ন এবং স্বীকৃতি ‘জাতীয় বিপ্লব এবং সংহতি দিবস’ এর মহাত্ম, তাৎপর্য্য এবং চেতনা অনুধাবন এবং এর মূল্যবোধ জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়। জাতিয় বৃহত্তর স্বার্থে আত্মত্যাগে নবীন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করতে হলে এই দুটি সফল অভ্যুত্থানকে জাতীয় পর্যায়ে সমমর্যাদা ও স্বীকৃতি অবশ্যই দিতে হবে। এই যুক্তির বাস্তবতা বুঝার জন্য প্রয়োজন ১৫ই আগষ্টের সফল পট পরিবর্তনের পর লোকচক্ষুর অন্তরালে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত কি ঘটেছিল সে সর্ম্পকে সত্যকে জানা। এই লক্ষ্যেই দেশবাসীর বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের অবগতির জন্য সেই সময়ের প্রাসঙ্গিক ঘটনাপ্রবাহের ধারা বিবরনী নিচে তুলে ধরা হল।
১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বিজয়কে আপামর দেশবাসী স্বতঃস্ফুর্তভাবে অভিনন্দন জানালেও পরাজিত বাকশালী চক্র ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী মহল সহজে এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারছিল না। তারা জনসমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যক্ষভাবে এই বিপ্লবের বিরোধিতা করতে না পেরে গোপনে তাদের হারানো স্বর্গ ফিরে পাবার আশায় তাদের বিদেশী প্রভুদের যোগসাজসে চক্রান্তের জাল বুনতে শুরু করে বিপ্লবের পরমুহূর্ত থেকেই। তাদের এ ধরণের তৎপরতা সম্পর্কে আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হচ্ছিল। বিপ্লবের পর পরাজিত শক্তিকে সমূলে বাংলাদেশের মাটি থেকে উপড়ে ফেলার জন্য আমরা সচেষ্ট ছিলাম।
সর্বদলীয় সরকার কায়েম করে তার তত্ত্বাবধানে যতশীঘ্র সম্ভব নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। একই সাথে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে proper screening এর পর সেনাবাহিনীর সাথে একত্রীভূত করে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর পুর্নগঠন করে বিপ্লবের স্বপক্ষ শক্তিকে সুসঙ্গবদ্ধ করার। সেনা পরিষদের পক্ষ থেকে এই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। বিপ্লবের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দানকারী জেনারেল ওসমানীর মূল দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের উপেক্ষিত সামরিক বাহিনীর সার্বিক কাঠামো নতুন করে জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ধাঁচে গড়ে তোলা। সেনা বাহিনীর পুর্নগঠনের কাজটি তখনকার প্রেক্ষাপটে ছিল খুবই জটিল এবং দূরহ্ একটি কাজ। রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বাছাই করে তাদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করার কাজটি ছিল বিশেষভাবে জটিল। সেনাবাহিনী থেকে বাকশালীমনা, দুনীতিপরায়ন এবং উচ্চাভিলাসীদের বের করে দিতে হবে। প্রয়োজনমত ইউনিটগুলোর পুনর্বিন্যাস করতে হবে। কমান্ড স্ট্রাকচারে প্রচুর রদবদল করতে হবে। সর্বোপরি সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈনিককে বিপ্লবের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। এ সমস্ত কাজে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের সেনা পরিষদের সদস্যরাই ছিল জেনারেল জিয়ার মূল শক্তি।
শেখ মুজিবের মৃত্যু একটি সাধারণ হত্যাকান্ড নয়। শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যু হয়েছিল রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের প্রক্রিয়ায়। একই দিনে শেখ মুজিবের পতনের রাজনৈতিক দিকটি খুব পরিষ্কার ও স্বচ্ছ করে ব্যাখ্যা করে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। তিনি বলেছিলেন, “১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে যে কুখ্যাত কালা-কানুন পাস করে বাকশাল নামক একদলীয় স্বৈরাচারী জগদ্দল পাথর দেশের তৎকালীন ৮ কোটি লোকের বুকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল; সেটা ছিল একটা সংসদীয় ক্যু’দাতা (অভ্যুত্থান)। ঐ একদলীয় স্বৈরাচারী অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট সংগঠিত হয় বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান।” একই অধিবেশনে পরে তিনি ইনডেমনিটি বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। বিলটি ২৪১ ভোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ হয়। ফলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পঞ্চম সংশোধনী হিসেবে সংবিধানে সংযোজিত হয় এবং দেশের শাসনতন্ত্রের অংশে পরিণত হয়।
১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ এর বৈপ্লবিক সফল অভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। অম্লান হয়ে থাকবে নিজ মহিমায়। সেদিন আগষ্ট বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের মাটি থেকে স্বৈরশাসনের একনায়কত্ব ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটেছিল এবং উম্মোচিত হয়েছিল বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দ্বার। আগষ্ট বিপ্লব বাকশালী কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে রাজনীতিতে গতিশীলতার সৃষ্টি করে সূচনা করে এক নতুন দিগন্তের।
১৫ই আগষ্ট বৈপ্লবিক অভুত্থান ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির উন্মেষ ঘটেছিল জাতীয় জীবনের প্রতিক্ষেত্রে তারই ধারা আজও দুর্বার গতিতে বয়ে চলেছে। নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম ও জাতীয় মুক্তির প্রতীক ১৫ই আগষ্টের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ও তার চেতনা সর্বকালে সর্বযুগে এদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক ও সচেতন নাগরিক ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে প্রেরণা যোগাবে নব্য সৃষ্ট মীরজাফর ও জাতীয় বেঈমানদের উৎখাত করতে। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করার জ্বলন্ত নিদর্শন ১৫ই আগষ্টের মহান বিপ্লব।
-আপনাদের অবগতির জননো:
:ঢাকা জজকোটের সাবজজ গোলাম রসুলের রায়ের কিয়দংশ যোগ করিলাম: এমন অনেক স্বাক্ষী (শফিউল্লাহ) আছেন যাহারা আসামীর সমতুল্য। এমন অনেক আছেন (তোফায়েল,শফিউল্লাহ ও এ.কে. খোন্দকার) যাহাদের স্বাক্ষীও করা হয়নি|
-হাইকোটের বিচারপতি মুজিব হত্যাকান্ড বিচারের আপিলের রায়ঘোষনার সময় বলেন ওদের (তোফায়েল,শফিউল্লাহ ও খোন্দকার)'কে কেন আসামী করা হয় নাই। তাহাকে (শফিউল্লাহ)'কে কে স্বাক্ষী বানাইয়াছে? আজ তাই বিচারের পরিপূর্ণ রায় দিতে পারিলামনা| মুজিব হত্যাকান্ড বিচারের জন্য তাহার মেয়েরা ও দল কতটুকু চায় তাহা জজ/বিচারপতিদের আক্ষেপেই বুঝা যায়, তাদের কুকীততি জজকোটে-হাইকোটে ও পৌছে গেছে ,আমরা এখন সত্যি বুঝতে পাচিছ ! এখন ঐ বিচারের ঐ রায়ে কিছু অর্বাচিনের সাজা হলো , ইতিহাসের খাতায় ঐ রায় হবে এক তামাশা। আসল খুনীরা জয় বাংলা, জয় হাসিনা বলেই পার পেয়ে গেল। আর শেখ সেলিমরা বলিতে থাকবে হাসিনা খুনীরা বসে আছে তোমার পাশে, হাসিনা বলিবে ওরা বংগবন্ধুর সৈনিক!!
0 comments: