পাকিস্তান বিপ্লবের প্রথম দিনই খন্দোকার মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। যে সৌদি আরব মুজিব সরকারকে দীর্ঘ সাড়ে চার বছর স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত ছিল সেই সৌদি আরবও বিপ্লবের দ্বিতীয় দিনে মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। গণচীন শুধু মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতিই দান করেনি বরং পিকিং বেতার ও ভয়েস অব আমেরিকা অভুত্থানের সমর্থনে একই সাথে হুঁশিয়ারী বাণী প্রচার করে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন একটি আভ্যন্তরীন ব্যাপার। সে দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে বিদেশী কোন প্রকার হস্তক্ষেপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীন সহ্য করবে না। এ ধরণের হস্তক্ষেপে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হতে পারে বিধায় গণচীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ধরণের হস্তক্ষেপে নিশ্চুপ থাকবে না। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই তারা গ্রহণ করবে। শুধু হুশিঁয়ারীই নয়; গণচীনের সেনাবাহিনীকে ভারতের যে কোন আগ্রাসী হামলার মোকাবেলায় সীমান্তে অবস্থান জোরদার করে তোলার হুকুম দিয়েছিল গণচীনের সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীনের হুশিঁয়ারী এবং দেশের জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সরকার ১৭ই আগষ্ট বাংলাদেশে আগ্রাসী সামরিক অভিযান চালাবার পূর্ব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। শুধু তাই নয়; অভ্যুত্থানের ১২দিনের মাথায় জাপান, ইরান, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আরো ৩৯টি দেশের সাথে ভারতও মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
রেডক্রসের চেয়্যারম্যান পদ থেকে কুখ্যাত গাজী গোলাম মোস্তফাকে অপসারিত করে বিচারপতি বি.এ সিদ্দিককে তার পদে নিযুক্ত করা হয়। রাষ্ট্রপতির ৯নং আদেশ বাতিল করা হয়। রাষ্ট্রপতি মোশতাক এক অধ্যাদেশ জারি করে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘোষণা করে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। মুজিব কর্তৃক দেশকে ৬১টি জেলায় বিভক্ত করে গভর্ণর নিয়োগের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। দেশের ১৯টি জেলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে জেলা প্রশাসকদের হাতে প্রশাসনের দায়িত্ব দেয়া হয়। দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি, মুজিব সরকারের ৬জন মন্ত্রী, ১০জন সংসদ সদস্য, ৪জন আমলা এবং ১২জন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিচারের জন্য দু’টো বিশেষ আদালত গঠিত হয়। সামরিক বাহিনীর ৩৬ জন দুর্নীতিপরায়ন অফিসারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়। রাজবন্দীদের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য বিলুপ্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সহযোগিতার আবেদন জানানো হয়। সরকারি আদেশে মশিউর রহমান এবং অলি আহাদকে বিনাশর্তে মুক্তি দান করা হয় ২৫শে আগষ্ট। একই দিনে বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানীকে রাষ্ট্রপতির নয়া সামরিক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করা হয়। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে জয়েন্ট চীফ অব ডিফেন্স ষ্টাফ হিসাবে এবং মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর স্থানে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে আর্মি চীফ অফ ষ্টাফ হিসাবে নিয়োগ করা হয়। বিমান বাহিনীর চীফ অফ ষ্টাফ হিসাবে নিযুক্ত হন এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব।
দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকা দুইটি মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। ১৬ই আগষ্ট মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানী নয়া সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে এক বার্তা পাঠান। দেশের প্রায় সমস্ত জাতীয়তাবাদী এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, নেতা এবং গণসংগঠনেরও সমর্থন লাভ করতে সমর্থ হয় নতুন সরকার। তারা সবাই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে তাদের সাহসী পদক্ষেপের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানান। ৩রা অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মোশতাক ঘোষণা করেন, ১৯৭৬ সালের ১৫ই আগষ্ট হতে দেশে বহুদলীয় অবাধ রাজনীতি পুনরায় চালু করা হবে এবং ১৯৭৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী দেশে সাধারণ নির্বাচন সংগঠিত করা হবে।
এভাবেই উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো নেবার ফলে দেশের সার্বিক অবস্থা অতি অল্প সময়ে শুধুমাত্র স্বাভাবিকই হয়ে উঠেছিল তাই নয়; দেশের আইন শৃঙ্খলা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং কল কারখানার উৎপাদনেও অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমে যায়। দেশে চুরি ডাকাতি ও চোরাচালানের মাত্রা কমে যায় বহুলাংশে। দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে পূর্ণমাত্রায়। দেশে বিদেশে অস্থায়ী সরকারের নীতিসমূহ ও পদক্ষেপগুলো প্রশংসিত হয়।
১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের উপরে বর্ণিত বিশদ বিবরনের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ কোন যুক্তিতে শেখ মুজিবের স্বৈরশাসনের অবসানকে শুধুমাত্র একটি মামুলি ‘হত্যাকান্ড’ হিসেবে জোর গলায় প্রলাপ বকে চলেছেন? তাদের মতে ঐ ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন এর সাথে জড়িত ছিল কিছু সংখ্যক ‘ উচ্ছৃংখল-বিপথগামী ’ তরুণ সামরিক অফিসার! যদি তাই হয়ে থাকতো তবে এই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে দেশের সামরিক বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, অন্যান্য আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সংগঠন, আইন বিভাগ, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এমনকি জাতীয় রক্ষীবাহিনী প্রধানগণ জাতির উদ্দেশ্যে প্রচারিত তাদের ভাষণে ১৫ই আগষ্ট বিপ্লবকে সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান করেছিলেন কেন? শুধু কি তাই? আওয়ামী-বাকশালীদের নেতা ও সাংসদদের অনেকেই কি করে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন? কেনই বা সেদিন কারফিউ জারি করা সত্ত্বেও ঢাকাসহ দেশের সর্বপ্রান্তে বিপ্লবের সমর্থনে বাধভাঙ্গা আনন্দ-উচ্ছাসে রাস্তায় নেমেছিল জনতার ঢল? এতেই প্রমাণিত হয় ১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক বিপ্লবের অগ্রণী হিসেবে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর তরুন সদস্যরা দয়িত্ব পালন করলেও এই বিপ্লবের মূল শক্তি ছিল দেশের জাগ্রত জনতা।
বস্তুতঃ শেখ মুজিব তার নিজের ও পরিবারের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী একটা ভিত্তি দেয়ার লক্ষ্যেই বাকশালী স্বৈরাচার কায়েম করেছিলেন। এভাবেই যুগযুগ ধরে স্বৈরাচারী শাসকরা আর্বিভুত হন। এরা একই নিয়মে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। জামার্নীর হিটলারের উত্থান ঘটেছিল এভাবেই। নাৎসী পার্টি তাকে মহামানব আখ্যায়িত করেছিল। বাকশালীরাও শ্লোগান তুলেছিল, এক নেতা, এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।
ফলশ্রুতিতে মুজিব নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়কে। ইটালীতে মুসোলিনির আবির্ভাবও ঘটেছিল একই প্রক্রিয়ায়। সব স্বৈরতান্ত্রিক এক নায়কত্বের ভাগ্যে জোটে একই পরিনতি। করুণ এবং মর্মান্তিক পরিসমাপ্তি।
সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিকরণের পর সেনা পরিষদ বিপ্লবের অবশিষ্ট উদ্দেশ্যাবলী বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়। লোকচক্ষুর অন্তরালে রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছিল তাদের লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টায়। পর্বত সমান প্রতিবন্ধকতার মুখে কাজ করতে হচ্ছিল সেনা পরিষদকে। ১৫ই আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর কেটে যায় ঘোর অন্ধকার। নবপ্রভাতের সূচনা ঘটে জাতীয় জীবনে। উম্মোচিত হয় মানবিক অধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার রুদ্ধ দুয়ার। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি হয় এক নতুন ধারার। ফলে প্রাণ ফিরে পায় নির্জীব, অসহায় দেশবাসী।
0 comments: