১৯৭৪ সালে পাকিস্তান সফর শেষে শেখ মুজিব কুলদীপ নায়ার সাক্ষাৎকারে কি ছিল সেটা কেউ খুজবেন কি ?
শিমলা চুক্তি করে ভারত পাকিস্তান এর পিছনে কারা?
১৯৭৪ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী দ্যা অবজারভার
The Observer পত্রিকায় ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মরহুম শেখ মুজিবের।
কলকাতার ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যানে সাক্ষাত্কারটি ছাপা হয়েছিল।
কুলদীপ নায়ার লিখেন -
শেখ
সাহেব এবারে বললেন, “আমি ভুট্টোর আন্তরিকতায় মুগ্ধ”। “আমার প্রতি প্রদত্ত
পাকিস্তানের জনগণের স্নেহ এবং ভালোবাসায় আমি অভিভুত। বিমান বন্দর থেকে
ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন স্থল পর্যন্ত হাজার হাজার জনতা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে
ছিলেন। আমার নাম মুজিব উচ্চারণ করে তারা ধ্বনি দিচ্ছিলেন। যখন পরিচিত
কোর্তা পায়জামা পরা আমাকে তাদের মধ্যে দেখলো তখন ছেলেমেয়েরা উচ্চকণ্ঠ
হর্ষধ্বনি দিল”।
ভুট্টোর প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন; “আমি তাঁকে সাহায্য করতে চাই। তিনি একজন পুরনো বন্ধু”।
তখন
শেখ মুজিব বললেন; “আমি সে সব কিছু ভুলে যেতে চাই। আমি চাই আমার জনগণও সে
সব কিছু ভুলে যাক। আমাদেরকে সব কিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে”। একটু
থেমে শেখ মুজিব আবার যুক্ত করেন; “আপনি জানেন যে জনগণের স্মরণশক্তি
দুর্বল”।
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসি সম্মেলন থেকে ফিরে এসে মার্চ মাসে ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব বলেছিলেন দেশের জনগণের উচিত একাত্তরের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়া। এই কথা আনুষ্ঠানিকভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে ঐ বছরেরই ৯ এপ্রিল ভারতে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিদেশীয় চুক্তিতে যেখানে ১৪ নম্বর দফায় আছে: " ... the Prime Minister of Bangladesh had declared with regard to the atrocities and destruction committed in Bangladesh in 1971, that he wanted the people to forget the past and to make a fresh start, stating that the people of Bangladesh knew how to forgive."
জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের আমন্ত্রণে ১৯৭৪ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশে এসেছিলেন সরকারি সফরে। তখন লাল গালিচা শুভেচ্ছা জানান স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ২৯ জুন ঢাকা ত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে তিনি শেখ মুজিবকে পাকিস্তানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। শেখ মুজিব তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এই স্বীকৃতির পর ১৯৭৪ সালের ৫-৯ এপ্রিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমদ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং অংশ নেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাকে দেয়া হয় রাজকীয় সম্মান। ১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি পাকিস্তানের লাহোরে গিয়েছিলেন ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সম্মেলনে যোগ দিতে। লাহোর বিমানবন্দরে তার সঙ্গে আলিঙ্গন করেন ভুট্টো। তাকে জানানো হয় সামরিক অভিবাদন। মুজিব তাদের সঙ্গে করমর্দন করেন। ওআইসি সম্মেলন শুরুর দিন সম্মেলন মঞ্চে শেখ মুজিব ভুট্টোর গালে প্রকাশ্যে চুমু খান।
লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে এসে ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে দেয়া সাক্ষাত্কারে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালে যা হয়েছিল তা ভুলে যাওয়া দরকার।’ কলকাতার ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যানে সাক্ষাত্কারটি ছাপা হয়েছিল। মূলত এভাবেই শেখ মুজিব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর করলেন না।
১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের একটি বিশেষ বিমানে করে যাত্রা করেন লন্ডনে। সাংবাদিক মাসকারেনহাস তার লিখিত Bangladesh : A Legacy of Blood বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে লিখেছেন, শেখ মুজিব তাকে লন্ডনে ৮ জানুয়ারি বলেন যে, তিনি পাকিস্তানের সাথে সব সম্পর্কচ্ছেদ করতে যাচ্ছেন না। রাখতে যাচ্ছেন একটা বিশেষ সম্পর্ক (Link)।
ইন্দিরা ও ভুট্টো একটি সমঝোতা চুক্তিতে সই করেন যার নাম হয়ে যায় ‘সিমলা চু্ক্তি।’
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৬ মাস পর ১৯৭২ সালের জুনে ভারতের সিমলায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৮ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত এ বৈঠক চলে। এর পূর্বেই আরো অনেক কাহিনী ঘটে যায়।
৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর একটি চিঠি পাঠায় ইন্দিরা সরকার। এতে যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বিনা শর্তে ভারত রাজী বলে জানানো হয়। চিঠিটির একটি অনুলিপি সুইজারল্যান্ড সরকারের মাধ্যমে পাকিস্তানকেও দেওয়া হয়।
এ সময় সচিব ও মন্ত্রী পর্যায়ের অনেকগুলো বৈঠক হয়, ইন্দিরা-ভু্ট্টো আলোচনায় বসেন চার দফা। এর মধ্যে ডি. পি ধর দ্বিতীয় দিনেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার জায়গা নেন পি এন হাকসার।
তারা সকল যুদ্ধবন্দীকে ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধপরবর্তী সীমানায় দুদেশের সেনাবাহিনীকে অবস্থানের ওপর জোর দেয়। ভারত গুরুত্ব দেয় দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে চলা সংঘাতের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানের যার মধ্যে কাশ্মীর অন্যতম। অবশেষে একটা ঐক্যমতে পৌছে পাকিস্তান ও ভারত । ২৯ এপ্রিল প্রাক-বৈঠক এক সমঝোতায় সাক্ষর করে তারা। ফলশ্রুতিতে সিমলায় বৈঠকের স্থান ঠিক হয়। সেইসঙ্গে প্রস্তাবিত তারিখ ঠিক হয় মে মাসের শেষ অথবা জুনের প্রথম সপ্তাহ।
অবশেষে ১২ জুলাই মূলত ইন্দিরা ও ভুট্টো একটি সমঝোতা চুক্তিতে সই করেন যার নাম হয়ে যায় ‘সিমলা চু্ক্তি।’ মূলত দু ধরণের ইস্যুকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এই চুক্তিতে। প্রথমটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের লাভ ক্ষতি , পাকিস্থানী সেনা ফিরিয়ে নেয়া সমস্যা এবং অন্যটি হচ্ছে ভারত পাকিস্তানের দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংঘাতের মৌলিক কারণগুলো। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ছিল কাশ্মীর ইস্যুই। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে সব উদ্ধার করে ভারত। তাছাড়া বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানের ৯০ হাজার সৈন্য নিজের হাতে রেখে দিয়ে কাশ্মীরের ওপর পাকিস্তানের দাবি প্রত্যাহার করার চাপ প্রয়োগও ছিল ইন্দিরা গান্ধীর একটি কৌশল।
বাংলাদেশ সরকার আটকে পড়া বাঙালীদের বিনিময়ের জন্য এদেশে আটকে পড়া বিহারী ও অবাঙালীদেরকেই আলোচনায় অগ্রাধিকার যেন হাসি তামাশার বিষয় , খুব তুচ্ছ। যার খেসারত বাংলাদেশকে দিতে হচ্ছে। একদিকে সীমান্তে আন্তর্জাতিক সীমানা আইন লঙ্গন করে পাখির মত বাংলাদেশিকে হত্যা অন্যদিকে বাংলাদেশকে পরিণত করা হয়েছে কোনঠাসা রাষ্ট্র।
- মাহফুজ মুহন
শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলি ভুট্ট এর মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ ছবি। এটি ১৯৭১ সালের আগেরকার নয় বরং এরপরের ১৯৭৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী তোলা। ছবিটি যে কোনো ফোটোশপের কাজ নয় তা খুব সহজেই বুঝা যাচ্ছে। জাপানের নেতৃস্থানীয় ফটোসাংবাদিক রিকিও ইমাজো ইউপিআইয়ের ফটোগ্রাফার হিসেবে ১৯৭৪ সালে লাহোরে গিয়েছিলেন ওআইসি শীর্ষ সম্মেলন কাভার করতে। তার তোলা এ বিরল ছবিতে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব এবং পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর গলাগলি আর বিজয়ের হাত তোলা। এই সেই ভুট্টো যার জন্য পাক সেনারা লাখ লাখ বাঙ্গালী হত্যা করেছিলো, অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত লুটেছিলো, অন্তত এক কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু করেছিলো। সকল বিচারে ভুট্টো ছিলো ১ নম্বর যুদ্ধাপরাধী। শুধু কি তাই! ব্লগ থেকে জানা যায়, এই জুলফিকার আলি ভুট্ট বাংলাদেশীদের কে ‘শুয়র কি বাচ্চা’ বলছিল প্রকাশ্যে (দেখুনঃ http://bit.ly/
যাই হোক, আমাদের সমাজে অনেকেই আছেন যারা নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেই অপরকে ‘রাজাকার’, ‘যুদ্ধপরাধী’, 'জামাত-শিবির', 'বিএনপি' ইত্যাদি নানা খেতাবে ভূষিত করে থাকেন। তাদের জন্য ছবিটি একটি উপযুক্ত জবাব। এই বিরল ছবিটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন।
0 comments: