১৯৭২ সালের যে কোন জাতীয় সংবাদপত্র খুললে প্রথমেই চোখে পড়বে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানী, আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির খবর। প্রতিদিন দেশের শহরগুলোতে ঘটছিল প্রকাশ্য খুন, ডাকাতি ও রাহাজানীর ঘটনা। গ্রামে-গঞ্জেও চলছিল ত্রাসের রাজত্ব। ক্রমবর্ধমান এ ত্রাসের নাগপাশে জনগণ এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় কাল অতিবাহিত করছিল। যখন জনগণের পরনে কাপড় নেই তখনই ঘটেছিল সুতা নিয়ে কেলেংকারী। পেটে যখন ভাত নেই তখন লাখ লাখ টন বিদেশী সাহায্যে প্রাপ্ত খাদ্য নির্বিবাদে পাচাঁর হয়ে গিয়েছিল সীমান্তের ওপারে।
মজলুম নেতা ভাসানী অবাধে চোরাচালানের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেন। তিনি আওয়াজ তোলেন সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারনবাদের বিরুদ্ধে। জবাবে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে চীন ও পাকিস্তানের দালাল, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক প্রভৃতি বলে আখ্যায়িত করে। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে ১৯৬৮-১৯৬৯ এর সাড়া জাগানো আন্দোলনকালে বরফের উপর আঘাত করেছিলেন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি তার নাম মাওলানা ভাসানী। মাওলানার সার্বজনীন আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতেই ছাত্ররা দিলেন ১১ দফা। তারই নির্দেশে ন্যাপ তার নিজস্ব ১৪ দফা বাদ দিয়ে ১১ দফাকেই তাদের দাবি হিসাবে গ্রহণ করে। ঊনসত্তোরের কারাবন্দী মুজিবর রহমানকে মুক্ত করার দুর্বার গণ আন্দোলনও গড়ে তুলেছিলেন এই মাওলানা ভাসানীই। ১৬ই ফেব্রুয়ারী পল্টনের বিশাল জনসভায় তিনি বজ্রকন্ঠে হুশিঁয়ারী উচ্চারণ করেন, “প্রয়োজন হলে ফরাসী বিপ্লবের মত জেলখানা ভেঙ্গে মুজিবকে বের করে আনব।” তার মতো একজন অভিজ্ঞ প্রবীণ রাজনৈতিক উদারপন্থী নেতাকে সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা বলে গালাগালি দিতেও কুন্ঠাবোধ করেনি শাসক দল। এই গালাগাল পর্ব শুরু করেন তরুণ নেতারা। পরে প্রবীণরাও ক্রমে তাদের সাথে যোগদান করেন। মার্চের শুরু থেকেই খবর আসতে থাকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে- মানুষ মরছে অনাহারে, না খেয়ে। বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, টাঙ্গাইলে বিরাজ করছে দুর্ভিক্ষ অবস্থা। আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের হতে থাকে স্থানে স্থানে। এ অবস্থায় ভারতীয় দূতাবাসের মুখপাত্রও স্বীকার করেন যে, চোরাচালান হচ্ছে ব্যাপক হারে। তারা বলেন, “সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি হয়ে গেলেই এই চোরাচালান বন্ধ হবে।” এ বক্তব্য দূতাবাস থেকে দেয়া হয় ২৩-৩-১৯৭২ তারিখে। দুর্নীতি ছড়িয়ে পরে দেশের সব জায়গায়, সর্বস্তরে।
১৯৭২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব তার সংসদ সদস্যদের প্রতি এক নির্দেশ জারি করে বলেন, “চাকুরি, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির জন্য কেউ সুপারিশ করবেন না। প্রশাসনকে চলতে দিন।” ১১ই মার্চ দৈনিক বাংলায় এক খবর বের হয় সিগারেটের পারমিট নিয়ে, “বাংলাদেশ ট্যোবাকো কোম্পানীর ২৫জন ডিষ্ট্রিবিউটর নিয়োগের জন্য কর্তৃপক্ষ তিন হাজার সুপারিশপত্র পেয়েছেন। সুপারিশকারীরা প্রত্যেকেই এমন প্রভাবশালী যে, কোম্পানী কাকে ছেড়ে কাকে ডিলারশীপ দেবেন সে সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারছেন না।” ৬ই জুন চোরাচালানের স্বর্গ সিলেট থেকে দৈনিক বাংলার প্রতিনিধি খবর পাঠান যে, গ্রেফতারকৃত চোরাচালানীরা প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন নেতাদের চাপে ছাড়া পাচ্ছে। একইভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য নেমে আসে সরকারের পারমিটবাজী নীতির সূচনায়। সুতার পারমিট যে পাচ্ছে তার তাঁত নেই, কেরসিনের পারমিট যে পেল সে কোন ডিলার নয়। পারমিট দেয়া হল অব্যবসায়ী রাজনৈতিক টাউটবাজদের খুশি করার জন্য। ফলে র্দুভোগ গিয়ে বর্তাল জনগণের উপর। পারমিট হাত বদল প্রথায় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেল কয়েকগুন। কাপড়ের অভাবে মা-বোনেরা দিনের বেলায় ঘর থেকে বেরুতে পারতেন না। মেয়ে-মা একখানি কাপড় গোসল করে পালা বদলিয়ে পরছে। এ সমস্ত খবরও প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক পত্রিকায়। ঠিক সেই সময় সরকার টিসিবি’র মাধ্যমে ভারত থেকে আনল ‘সুন্দরী শাড়ী’। যে শাড়ীতে হাঁটু ঢাকে না, পর্দাও হয় না। ভারতীয় দূতাবাস বলল টিসিবি দেখেই এনেছে এই শাড়ী। টিসিবি কোন জবাব দিতে পারল না।
আগষ্ট মাসে দেশে বন্যা শুরু হয়। আসে বিস্তর রিলিফ। রিলিফ নিয়ে লুটপাটের কাহিনী পাওয়া যাবে ১৯৭৪ সালের আগষ্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসের সংবাদপত্রসমূহে। অবাধ লুটপাট চলে বাশঁ, টিন, খাদ্যসামগ্রী, রিলিফের ঔষধপত্র এবং কম্বল নিয়ে। প্রতিদিনের সংবাদপত্রে ছাপা হয় ক্ষুধাতুর মানুষের ছবি। অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, মাথা গোজাঁর ঠাই নেই। কোটি কোটি লোক হয় ক্ষতিগ্রস্ত ও বাস্তুহারা। ৩রা আগষ্ট ইত্তেফাকে ছাপা হয় এসব ছবি। দৈনিক বাংলায় খবর বের হয়, বমি খাচ্ছে মানুষ। বাংলাদেশ রেডক্রস সর্ম্পকে প্রকাশিত হয় চুরি, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অসংখ্য অভিযোগ। গ্রামে-গঞ্জে রেডক্রস প্রধান গাজী গোলাম মোস্তফার নামে ছড়া বের হয়। আতাউর রহমান খান রেডক্রসের অসাধু তৎপরতার প্রতিবাদ করেন। দুর্নীতির অভিযোগ করেন। ১০ই আগষ্টের ইত্তেফাকে সে বিবৃতি ছাপা হয়। ১৩ তারিখ সংবাদপত্রের রিপোর্টে দেখা যায় যে, সারাদেশের মানুষ কচু-ঘেচু খেয়ে জীবনধারণ করছে। আতাউর রহমান খান অভিযোগ করেন যে, বিরোধী দলীয় সদস্যদের ত্রান সাহায্য সংগ্রহের চেষ্টায় পুলিশ বাধা দিচ্ছে। তাদের গ্রেফতার করছে। জনাব খান ১১ই আগষ্ট কাগজে বিবৃতি দেন যে, দুনিয়ায় এমন কোন নজির নেই যে রেডক্রস সমিতির চেয়ারম্যান কোন দলীয় লোক হয়। তিনি একজন বিচারপতি অথবা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে এ সমিতির দায়িত্ব দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
গ্রাম থেকে, উপদ্রুত এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ শহরে আসতে থাকে। ঢাকা শহরে ১৩৫টি রিলিফ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ১২ই আগষ্ট যাত্রাবাড়ির রিলিফ ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণকারীরা বলেন যে, তিনদিনে তাদের জন্য একমুঠো খাবারও বরাদ্দ করা হয়নি। ১৬ই আগষ্ট আইসিআরসির সদস্য মিঃ এলভিন কাজ পরিদর্শনের জন্য আদমজী রিলিফ ক্যাম্পে গেলে লোকেরা কমিটির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চুরি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করে। এলভিন চলে এলে কমিটির চেয়ারম্যান তার গুন্ডা বাহিনী দ্বারা অভিযোগকারীদের উপর হামলা চালায়। এতে ছুরিকাহত দুই ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খাওয়ার অনুপযুক্ত পচাঁ বিস্কুট সরবরাহ করা হয়। তা থেকে ক্যাম্পগুলোতে কলেরা মহামারী আকারে দেখা দেয়। মরতে থাকে মানুষ।
মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। সে সময়কার পত্রিকার পাতা উল্টালে গা শিউরে উঠে। মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ কেড়ে নেয় লাখ লাখ মানুষের প্রাণ। হাজার হাজার চাষী যারা একদা কষে ধরতো লাঙ্গল, মাঠ ভরে তুলত সবুজ শস্যের সমারোহে, তারা ভিক্ষার জন্য শহরের মানুষের কাছে হাত পাতে। ফিরে যায় ভিক্ষা না পেয়ে। তারপর বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকে। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম প্রতিদিন ঢাকা শহর থেকেই তিরিশ থেকে চল্লিশটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছিল। সে কাহিনী ও ছবি আছে সেই সময়কার দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর পাতায় পাতায়। ঢাকায় প্রতি ঘন্টায় ৩-৪ জন লোক মারা যেতে থাকে অনাহারে। এর এক পর্যায়ে আঞ্জুমানের লাশ দাফনের কথা খবরের কাগজে প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়া হয় সরকারি আদেশে। আগষ্ট থেকে ডিসেম্বর মাস অব্দি প্রতিটি জেলা থেকে খবর আসতে থাকে যে, শত শত লোক অনাহারে মারা যাচ্ছে। ভাত নেই, কাপড় নেই, বাসস্থান নেই। ১০ই সেপ্টেম্বর ইত্তেফাক ছবি ছাপে- মাছ ধরার জাল পরে লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করছে গ্রামের কোন কুল বধু। চট পরে ভিক্ষার আশায় সন্তান কোলে ঘুরে ফিরছে অসহায় জননী। গৃহবধুরা ক্ষুধার জালায় হচ্ছে প্রমোদবালা। রিলিফের কেলেঙ্কারীর খবর ছাপা হচ্ছিল খবরের কাগজে। কিন্তু অপরাধী ব্যক্তিদের একজনেরও বিচার হয়েছে এমন কথা শোনা যায়নি কখনো। কেন হয়নি সে খবরও সংবাদপত্রের পাতায় আসেনি। উত্তরাঞ্চলে পানির দামে বিক্রি হতে থাকে জমি। অসংখ্য সম্ভ্রান্ত কৃষক ভিক্ষুকে পরিণত হন। সে সময়ের ২২শে সেপ্টেম্বর বায়তুল মোকাররমে দুই শতাধিক উলঙ্গ, অর্ধউলঙ্গ নারী পুরুষ অন্নবস্ত্রের দাবিতে মিছিল করে। গ্রাম থেকে আসা অসহায় মানুষের আর্তনাদ একটুও কম্পিত করতে পারেনি আওয়ামী লীগের শাসককুলের হৃদয়। আর সেই সময়েই শেখ মুজিবের ৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ৫৫ পাউন্ড ওজনের কেক কাটেন শেখ মুজিব নিজেই!!!
২৩শে সেপ্টেম্বর সারাদেশে ৪৩০০ লঙ্গরখানা খোলার কথা ঘোষণা করা হয়। সে সমস্ত লঙ্গরখানার ইতিহাস আর এক করুণ কেলেঙ্কারীর ইতিহাস। নওগাঁর আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য ২৪শে সেপ্টেম্বর এক বিবৃতি দিয়ে জানান যে, সারা জেলার মানুষ গত ৩-৪ দিন ধরে না খেয়ে আছে। চালের সের সাত টাকা। তার ক’দিন পরেই ৬ই অক্টেবর ইত্তেফাক খবর দেয় যে, ২১ লাখ টাকার বিদেশী মদ ও সিগারেট আমদানি করা হয়েছে সরকারি টাকায়। ঐ দিনই খাদ্যমন্ত্রী বললেন, “তখন পর্যন্ত অনাহারে কতলোক মরেছে সরকারের তা জানা নেই। প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর খবর অতিরঞ্জিত।” তবে তিনি স্বীকার করেন চোরাচালান কিছুটা হয়েছে।
৮ই অক্টোবর অধ্যাপক আবুল ফজলসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ জন শিক্ষক এক বিবৃতিতে বলেন, “জাতির জীবনে দুর্যোগ মোকাবেলার প্রতি এত অনাসক্তি, এত অবজ্ঞা, এত অদ্ভুত রকম ঔদাসীন্য কখনও দেখা গেছে বলে মনে হয় না। নিজের প্রতি আস্থাহীন জাতি যে কী রকম জড় পদার্থে পরিণত হতে পারে বর্তমান বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই একাত্মতা, ত্যাগের মহৎ শক্তির সেই প্রচন্ডতা পরবর্তিকালে সিদ্ধান্তহীনতায়, ভুল সিদ্ধান্তে, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় আর গুটিকতক লোকের লাগামহীন দুর্নীতির সয়লাবে সব ধুয়ে গেছে। দেশের নেতৃত্বের প্রতি এই জাতীয় দুর্দিনে আমাদের আকুল প্রার্থনা, জাতি হিসেবে আমাদের শক্তিতে আস্থাবান হওয়ার পরিবেশ ফিরিয়ে দিন।”
৮ই অক্টোবর ১৯৭৪ শ্রমিক লীগের আব্দুল মান্নান এমপি জানান, “লবনের দুঃপ্রাপ্যতা সম্পর্কে সম্ভাব্য সকল প্রকার খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে যে, মজুতদার উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে ২টাকা মন দরে লবন কিনে থাকে। সরকারিভাবে মজুতদারদের জন্য অশোধিত লবনের দাম ১৫ টাকা আর শোধিত লবনের দাম ৫৫ টাকা নির্ধারিত করা হয়েছে।” তিনি আরো বলেন, “অশোধিত লবনের দাম ৪০ টাকা করা হলে বাজারে প্রচুর লবন পাওয়া যাবে। প্রকাশ, এ ব্যাপারে নাকি আমাদের দলীয় কোন কোন সংসদ সদস্য জড়িত রয়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে।”
১৩ই অক্টোবর ঢাকার সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায় যে, প্রতিদিন গড়ে ৮৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন হচ্ছে। ২৭শে অক্টোবর খবর আসে জামালপুরে প্রতিদিন অনাহারে শতাধিক লোক মারা যাচ্ছে। সরকার এই মৃত্যুকে পুষ্টিহীনতা বলে অভিহিত করে। অনাহারে মানুষ মরছে সরকার সেটা অস্বীকার করে। ২৫শে অক্টোবর ঢাকার সংবাদপত্রে বের হয় ট্রাক বোঝাই ধানচাল ভারতে পাচাঁর হচ্ছে। দিনাজপুরে চালের সের ৮ টাকা। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য মানিকগঞ্জের এক পরিবারের ৭জন আত্মহত্যা করেছে। এসময়ে ২৫শে অক্টোবর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি জনাব কামরুজ্জামান দাবি করেন, “দেশের প্রচলিত আইনে চোরাচালানীদের দমন করা হচ্ছে না। কয়েক মাস আগে সংসদে চোরাচালানীদের গুলি করে হত্যা করার বিধান পাশ হয়। কিন্তু কাউকে কোন দিন ঐ বিধানে হত্যা করা হয়নি।” একই সঙ্গে কামরুজ্জামান অবশ্য বলেন, “দলের ভেতর থেকে দলের সমালোচনা চলবে না।” তখন থেকে আওয়ামী লীগের ভেতরেও কোন্দল দানা বেঁধে উঠে। সেই ক্রান্তিলগ্নে ২৬শে অক্টোবর ’৭৪ স্বাধীনতা সংগ্রামকালের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের নির্দেশে মন্ত্রীত্ব হারান। জনাব তাজুদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেন, “জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তিনি কোন বিতর্ক সৃষ্টি করতে চান না।” ঢাকার এবং বিদেশী সাংবাদিকদের মতে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করায় জনাব তাজুদ্দিন আহমদের যে ইমেজ গড়ে উঠে তা পাকিস্তানে আটক শেখ মুজিবর রহমান সহ্য করতে পারছিলেন না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটক শেখ মুজিবের চেয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নকে বড় করে দেখার জন্য বেগম মুজিবও তাজুদ্দিনকে সহ্য করতে পারতেন না বলে জানা যায়। তাজুদ্দিন সম্পর্কে সরকার পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হয় যে, তিনি অর্থমন্ত্রী থাকাকালে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের পথে চলে যায়। তাজুদ্দিন আহমদ বাকশালের কেন্দ্রিয় কমিটি থেকেও পরবর্তিতে বাদ পড়েন।
২৯শে অক্টোবর সারাদেশে ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। একই দিন মজুতদারী আর কালোবাজারীর দায়ে আওয়ামী লীগের আর একজন সংসদ সদস্য গ্রেফতার হন। ৩০ তারিখে লবন মজুতের জন্য আওয়ামী লীগের এমপি ডঃ শামসুদ্দিন আহমদকে গ্রেফতার করা হয়।
এ অবস্থায় মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির উদ্যোগে ১লা নভেম্বর ১৯৭৪ বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে শিক্ষক, আইনজীবি, চিকিৎসক, লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, চিত্রশিল্পী ও ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিরা বাংলাদেশের বর্তমান মন্বন্তর প্রতিরোধের জন্য আন্দোলন গঠনের উদ্দেশ্যে এক বিরাট সমাবেশে যোগদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবিদের এত বিরাট সমাবেশ ইতিপূর্বে আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ‘মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির’ সভাপতি সিকান্দার আবু জাফরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দুই ঘন্টার উপর এ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন এডভোকেট মির্জা গোলাম হাফিজ, ডঃ আহমদ শরীফ, মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক জয়নাল আবেদীন, ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ, এনায়েত উল্লাহ খান, কামরুন্নাহার লাইলী, নিজামুদ্দিন আহমদ, মহিউদ্দিন আলমগীর, মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির মুহাম্মদ জাকারিয়া এবং বদরুদ্দিন উমর। সমাবেশে বিদ্যমান মন্বন্তর পরিস্থিতি ও মৌলিক আধিকার সম্পর্কে ১৭টি প্রস্তাব গৃহিত হয়। সমাবেশের পর বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গন থেকে একটি মিছিল বের হয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত যায় এবং সেখানেই সমাবেশের কর্মসূচী শেষ হয়। সমাবেশে গৃহিত প্রস্তাববলীর বিবরণbr />
১৯৭৪ সালের ১লা নভেম্বর বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত মন্বন্তরের গৃহিত প্রস্তাবে বলা হয় যে, এই মন্বন্তরের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতাকেও অতিক্রম করেছে এবং এই মম্বন্তর, বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্টি হয়নি বরং শাসকশ্রেণী ও তাদের সহযোগীদের গণবিরোধী নীতি ও কর্মকান্ডেরই প্রত্যক্ষ পরিণতি। সমাবেশের প্রস্তাবে এই মন্বন্তরকে ‘প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থা’ বলে বর্ণনা না করে একে মন্বন্তর বলে ঘোষণার জোর দাবি জানানো হয়। প্রস্তাবে বৈদেশিক সাহায্যের একটি শ্বেতপত্র ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।
সমাবেশের প্রস্তাবে সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠনে সরকারের বিরোধিতার নিন্দা করে অবিলম্বে একটি সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠন করার দাবি জানানো হয় এবং এ ব্যাপারে বিরোধী দলসমূহের প্রতি উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। এছাড়াও রেশনিং এলাকা সম্প্রসারন ও টেষ্ট রিলিফ চালু করার দাবি জানানো হয়। সমাবেশের প্রস্তাবে লঙ্গরখানার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেখানে নির্যাতন বন্ধ করার দাবি জানানো হয়। মন্বন্তর প্রতিরোধ আন্দোলন সমাবেশে রেডক্রসের চেয়ারম্যান হিসাবে সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতিকে নিয়োগ করার দাবি জানানো হয়। রাজনৈতিক নির্যাতন বন্ধ ও মিথ্যা মামলায় আটক ও বিনা বিচারে আটক রাজনৈতিক বন্দীসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবি জানানো হয়।
পরবর্তিকালে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় আওয়ামী লীগ সরকার ও সরকারি দলের নেতা-সদস্যদের রিলিফ চুরির ও চোরাচালানের বিবরণ দিতে গিয়ে ১৩ই আগষ্ট ১৯৯২ সালে সংসদে বলেছিলেন, “রিলিফ চুরি ও চোরাচালানের মাত্রা এতটা বৃদ্ধি পেয়েছিল আওয়ামী শাসনামলে যে তদানীন্তন রাষ্ট্রপ্রধানকে বলতে হয়েছিল, ‘আমার কম্বলটা কোথায়??’ ”(২১শে আগষ্ট ১৯৯২ বিচিত্রায় প্রকাশিত)।
সেই সময় বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত ছিলেন কিন্তু ঐ বক্তব্যের বিরোধিতা করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিক্ত সত্যকে গলঃধরণ করে তাকে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে অসহায়ের মত।
0 comments: