ক্যান্টিনে টিভির ব্রেকিং নিউজ দেখলাম যে, ইস্তাম্বুলের এশিয়া-ইউরোপ সংযোগ ব্রিজ বন্ধ করে সেনাবাহিনী গাড়ী নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তখনো ভাবছিলাম, সম্ববত সন্ত্রাসী হামলা হইছে..! তাই সতর্কতা।
কিন্তু না..! কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থতি পাল্টে যেতে লাগলো। ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক এয়ারপোর্ট বন্ধ করে সেনা ট্যাঙ্ক এয়ারপোর্টের দখল নিল। কিছুক্ষণ পর প্রধনমন্ত্রী বিনালী ইলদিরিম মিডিয়াকে জানালেন, সেনা বাহিনীর একটি অংশ ক্যু করেছে। কিন্তু আমরা তাদেরকে ছাড় দিবনা।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কোন ভরসা পেলাম না। সবকিছু সেনাবাহিনীর দখলে করে নিচ্ছে। একে পার্টির অফিস, প্রেসিডেন্ট অফিস, সরকারী নানা অফিস এমনকি রাষ্ট্রীয় টিভি। রাত ১২ টার কিছু পরে রাষ্ট্রীয় টিভি থেকে ঘোষণা এল যে, "সেনা শাসন জারী করা হয়েছে। কেউ যেন রাস্তায় বের না হয়। এখন থেকে সেনাবাহিনী দেশ চালাবে"।
পুরো হতবম্ব। কী হবে..! আমাদের ডরমেটারীর সবাই ক্যান্টিনে টিভির সামনে।পাশের রাস্তা দিয়ে সেনা ট্যাঙ্ক মুহুর্তে মুহুর্তে টহল দিচ্ছে। সবার মনে ভয় আর আফসোস! দেশটা শেষ!
এদিকে প্রেসিডেন্ট মিডিয়াতে বক্তব্য দিতে পারছেন না। উনি ব্যক্তিগত সফরে অন্য শহরে ছিলেন। রাত আনুমানিক ১২.৩০ এর দিকে একটি মিডিয়াতে স্বাইপিতে প্রেসিডেন্ট ৩/৪ মিনিটের একটি বক্তব্য দিতে সক্ষম হন। এতে তিনি সকলকে রাস্তায় নেমে আসার আহবান জানান এবং ইস্তাম্বুলের এয়ারপোর্টে আসতে বলেন। উনি স্পষ্ট বলেন যে, আমি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, কোন বিপদগামী কাউকে সফল হতে দিবনা। আপনারা এয়ারপোর্টে আসেন, আমি আসতেছি। আপনাদের সাথে রাস্তায় নামব।
এরদোয়ানের এই ঘোষণার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই দেখলাম জনগন রাস্তায় নামা শুরু করল। ক্যান্টিন থেকেই নিজ চোখে দেখলাম কিভাবে সেনা ট্যাঙ্কের সামনে লোকজন শুয়ে পরলো। ট্যাঙ্কের গতিরোধ করার চেষ্টা করল। পুরো তুরস্কের কয়েক মিলিয়ন লোক রাস্তায়। সেনা বাহিনীর সাথে অনেকটা যুদ্ধ হচ্ছে। সেনাবাহিনী কয়েকটি জায়গায় উপর থেকে বোমা বর্ষণ করছে...
সকল রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের পক্ষ নিল এবং ক্যুয়ের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জানালো। তারপরও পরিস্থিতি পুরোই নিয়ন্ত্রনের বাহিরে। তবে ইতিমধ্যে এরদোয়ানকে রিসিভ করতে কয়েক মিলিয়িন লোক ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে অবস্থান নিয়ে সেনা ট্যাঙ্ক দখল করে নিল। জনজোয়ারে সেনাবাহিনী এয়ারপোর্ট থেকে পিছু হটল।
রাত ৪ টার দিকে প্রেসিডেন্ট যখন এয়ারপোর্টে পৌছলেন তখনো ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন জায়গায় গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। এরদোয়ান প্রেস কনফারেন্সে বক্তব্য দিলেন এবং জানালেন তারা ব্যর্থ হয়েছে। এখনো যারা ব্যারাকের বাহিরে আছে তাদেরকে ব্যারাকে ফিরে যেতে আহবান জানান।আর এ ঘটনা ফেতুল্লাহ গুলেনের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে বলে জানান।
আমরা লাইভ দেখতেছিলাম। এরদোয়ানের মাথার উপর আই মিন এয়ারপোর্টের উপর বিদ্রোহী যুদ্ধবিমান তথনো ব্যপক মহড়া দিচ্ছে। যাক, এরমধ্যে পুলিশ, সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ, নৌবাহিনী, স্পেশাল ফোর্স সরকারের পক্ষে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করলো।যদিও সেনাপ্রধান বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি ছিল।
সকাল হতে লাগল। ভোর ৫টা- ৬ টার দিকে ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কয়ার, বসফরাস ব্রিজ, আরকারার প্রেসিডেন্ট প্যালেসসহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ১৫০০ বিদ্রোহী সেনা সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরিস্থতি এখন পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রনে।তবে জনগন এখনো রাস্তায়। তবে সেনবাহিনীর সাথে মোকাবেলা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে ১৭ পুলিশসহ ৬০ জনের মত সাধারণ জনতা। অবশ্য এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। আহত শতশত মানুষ।
এ ক্যুতে সফল হলে তুরস্কে আরেক সিসির জন্ম নিত, হয়ে যেত মিশর। কিন্তু গতকালের ক্যু সফলভাবে মোকাবেলা করতে পারায় তুরস্কের ইসলাম ও গণতন্ত্র মজবুত হল। অবিশ্বাস্যভাবে সকল জনতার মুখে তাকভীর, আল্লাহু আকবরের মুহুর্মুহু স্লোগানে মুখোরিত ছিল পুরো তুরস্ক। রাত ১ টা থেকে টানা তুরস্কের মসজিদগুলো থেকে আযান প্রচারিত হচ্ছিল। মসজিদ থেকে লোকজনকে রাস্তায় নামার জন্য আহবান ও সাহস দেওয়া হচ্ছিল। মানে একটা বিপ্লব।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সাহসী নেতৃত্ব, সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা এবং জনতার আত্মত্যাগের এই বিরল দৃষ্টান্ত সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাসের মাইলফলক হয়ে থাকবে।
-হাফিজুর রহমান
তুরস্কের সেনা অভ্যুত্থান যেভাবে ব্যর্থ হলো
রাজধানী আংকারা আর সবচেয়ে বড় নগরী ইস্তাম্বুলের প্রধান স্থাপনাগুলোতে ছিল তাদের দৃশ্যমান উপস্থিতি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দখল করে নেয় সেনাবাহিনী এবং তাদের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়।
এত ঘটনার মধ্যে কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের।
অভ্যুত্থানকারীদের সেই মুহূর্তে দরকার ছিল সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ অংশের এবং জনগণের সমর্থন।
কিন্তু অভ্যুত্থানের চেষ্টা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলডিরিম তা প্রতিরোধের চেষ্টা শুরু করেছেন। তবে তুরস্কের বেশিরভাগ মানুষ জানে, প্রকৃত ক্ষমতা আসলে প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের হাতে, এবং কিছু করতে হলে তাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।
অভ্যুত্থান সফল হতে হলে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে পুরো রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি।
যেভাবে পরিস্থিতি পাল্টে গেল
শুরুতে বোঝা যাচ্ছিল না প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কোথায় আছেন। কোন কোন খবরে বলা হচ্ছিল তিনি তুরস্কের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিমে এজিয়ান সাগর তীরের অবকাশ কেন্দ্র মারমারিসে আছেন।
কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে দেখা গেল সিএনএন এর তুর্কী ভাষার নিউজ চ্যানেলে। মোবাইল ফোনে ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি জনগণকে রাস্তায় নেমে অভ্যুত্থান প্রতিহত করার ডাক দিলেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যখন ইস্তাম্বুলের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে এসে নামেন, হাওয়া পুরো ঘুরে গেলো।
সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি কড়া ভাষায় অভ্যুত্থানকারীদের দেখে নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিলেন। বললেন, তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই।
অনেকের কাছেই পরিস্কার হয়ে গেল যে, অভ্যুত্থানকারীরা ব্যর্থ হয়েছে, সিনিয়র সেনা অধিনায়করা সরকারের পক্ষেই আছে।
আংকারার নিয়ন্ত্রণ তখনো অভ্যুত্থানকারীদের হাতে। কিন্তু ইস্তাম্বুল তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ তখন ইস্তাম্বুল আর আংকারার রাস্তায় নেমে এসেছে। বিমানবন্দরে যে সেনারা অবস্থান নিয়েছিল, তাদের ঘেরাও করে জনতা, পুরো বিমানবন্দর দখল করে নেয় তারা।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন টিআরটি থেকে অভ্যুত্থানকারীরা বেশ কিছু ঘোষণা প্রচার করেছিল। তারা কারফিউ জারি করেছিল। কিন্তু সেটি কার্যকর করতে তারা ব্যর্থ হয়।
অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল হতে থাকে।
কোন কোন খবরে বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যে হোটেলে ছিলেন সেখানে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান। ফলে সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
অভ্যুত্থানের পক্ষে সমর্থন
অভ্যুত্থান সফল হওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সমর্থনের দরকার ছিল। কয়েকটি বড় শহরে হয়তো অনেক সেনা সদস্য এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে ছিল।
অভ্যুত্থানকারীরা রাস্তায় অনেক ট্যাংক নামাতে পেরেছিল। তারা ইস্তাম্বুলের বসফোরাস প্রণালীর ওপরের ব্রীজ বন্ধ করে দিতে পেরেছিল।
কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল গুল হুলুসি আকার এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে ছিলেন না। সবচেয়ে বড় নগরী ইস্তাম্বুলে ছিল যে সেনা ডিভিশন, তার অধিনায়কও এই অভ্যুত্থান সমর্থন করেননি। নৌবাহিনী প্রধান এবং বিশেষ বাহিনীর প্রধানও অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেন। এফ-সিক্সটিন জঙ্গী বিমান থেকে অভ্যুত্থানকারীদের অবস্থানে বিমান হামলাও চালানো হয়।
যুক্তরাজ্যের একটি থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউজের ফাদি হাকুরা বলেন, এই অভ্যুত্থান আসলে শুরু হওয়ার আগেই ব্যর্থ হয়। এদের পেছনে না ছিল রাজনৈতিক সমর্থন, না ছিল জনগণের সমর্থন।
তুরস্কের প্রধান দলগুলো শুরুতেই জানিয়ে দেয়া তারা এর সঙ্গে নেই। ধর্মনিরপেক্ষ সিএইচপি, জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপি সবাই সরকারকে সমর্থন জানায়।
অভ্যুত্থানের পেছনে কারা
বলা হচ্ছে, সেনাবাহিনীর একটি অংশ এই অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। ইস্তাম্বুলেই মূলত তাদের ঘাঁটি।
ফাদি হাকুরা মনে করেন, এরা সেনাবাহিনীর বিরাট অংশের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাদের ব্যর্থতা এটাও প্রমাণ করে যে তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থানের পক্ষে আর সমাজের বেশিরভাগ অংশের কোন সমর্থন নেই।
রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ান এর আগে বহুবার সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তার সরকার সেনাবাহিনীর মধ্যে অনেক শুদ্ধি অভিযানও চালিয়েছে।
কে এই ফেতুল্লা গুলেন
অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত বলে যার দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে, তিনি হচ্ছে ফেতুল্লা গুলেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র ফেতুল্লা গুলেন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তিনি একজন ধর্মীয় নেতা। তার হিজমেত আন্দোলনের বিরাট সমর্থন আছে তুরস্কে। এরা নানা ধরণের স্কুল, কলেজ, এনজিও এবং ব্যবসা পরিচালনা করে। তাদের আছে অনেক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু ফেতুল্লা গুলেনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে কয়েক বছর আগে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কঠোর সব ব্যবস্থা নেন হিজমেত আন্দোলনের বিরুদ্ধে।
অভ্যুত্থানের পেছনে এদের হাত আছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবং তার দলের নেতারা। তবে ফেতুল্লা গুলেন জোর গলায় তা অস্বীকার করেছেন।
শীর্ষ নিউজ
ছদ্মবেশী তুরস্কের ফেতুল্লা গুলেন জানা অজানা কিছু কথা
বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় আমি লক্ষ্য করেছিলাম মূলত না জানার কারণে ফেতুল্লা গুলেনকে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের একজন সেবক হিসেবেই সবাই মনে করতো। এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকে ইসলামপন্থীদের ফেতুল্লা গুলেনের পলিসির আলোকে কাজ করার পরামর্শ দিতেও শুনেছি এবং তার পক্ষে অনেকে লেখালেখিও হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে প্রাথমিক জীবনে ইসলামের কারণে জনপ্রিয়তা অর্জনকারী এই ব্যক্তিই সময়ের ব্যবধানে ইহুদি এবং পশ্চিমাদের এজেন্ট হিসেবে গোটা দুনিয়ায় মুসলমানদের স্বার্থের বিপরীতে কাজ করতে এতটুকুও দ্বিধা করেনি।
ফেতুল্লা গুলেন ১৯৪১ সালের ২৭ এপ্রিল তুরস্কের এরজুরুম নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি কুরআন শিক্ষা শুরু করেন। এরপর তিনি ১৯৪৬ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে তার বাবা অন্য একটা শহরে বদলি হওয়াই তিনিও সেখানে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি কুরআনে হাফিজ হন ১৯৫১ সালে। এরপর বিভিন্ন শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন ও তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটান। এর পর তিনি ইমাম হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। আবেগঘন ওয়াজ নাসিহতের মাধ্যমে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই তুরস্কের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ইজমিরে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তার আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে সে সময়ে বদিউযযামান সাইদ নুরসির আন্দোলন থেকে ইস্তফা দেন কিন্তু তিনি তার জনপ্রিয়তাকে ধরে রাখার জন্য সাইদ নুরসির লেখা তাফসির ‘রিসালায়ই নুর’কে অবলম্বন করে তার ওয়াজ নসিহত চালিয়ে যেতে থাকেন। ফেতুল্লা গুলেন সেই সময়ের রাজনৈতিক ব্যাপারে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন ও সেনা অভ্যুত্থান এর বিরুদ্ধে তার অভিমত ব্যক্ত করেন। এই সকল কারণে তিনি জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
ফেতুল্লাহ গুলেনের হাত ধরে তুরস্কে ১৯৬০ সালের দিকে শুরু হওয়া আন্দোলন হিজমেত বা স্বেচ্ছাসেবী আন্দোলন নামে পরিচিত। শিক্ষা, গণমাধ্যম, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ইত্যাদি নানা ধরনের সামাজিক কার্যক্রম তারা পরিচালনা করে। এই আন্দোলনের আওতায় সেক্যুলার কারিকুলাম অনুসারে তুরস্কে তিন শতাধিক এবং বিশ্বের ১৮০টি দেশে সহস্রাধিক স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। যদিও গত বছর রাশিয়ান সরকার ফেতুল্লা গুলেনের সকল কর্মকান্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাদের রাশিয়া থেকে বিতাড়িত করেন। তুরস্কের প্রভাবশালী কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েরও তিনি মালিক। এছাড়া তুর্কি ও ইংরেজি ভাষায় বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়া প্রতিষ্ঠান এই আন্দোলনের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে ঈরযধহ ঘবংি অমবহপু-এর মতো প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মিডিয়া গ্রুপও রয়েছে। ’৯০-এর দশকে গুলেনের ‘আন্তঃধর্মীয় সংলাপ’ এই আন্দোলনকে বেশ জনপ্রিয় করে তোলে। ১৯৯৮ সালে ফেতুল্লা গুলেনের আয়োজনে দেশের সেক্যুলার ও ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। যা দেশে-বিদেশে সবার নজর কাড়ে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তার ওয়াজ নসিহত ইসলামের আলোকে হওয়াই তিনি জনগণের ভালোবাসা ও সহানুভূতি অর্জন করেন।
তুরস্কে নাজিমুদ্দিন এরবাকানের নেতৃত্বে রেফাহ পার্টির জনপ্রিয়তা ও পরবর্তীতে ক্ষমতা গ্রহণ তুরস্কের মুসলিমদের মনে এক আশার আলো জ্বলে ওঠে। এরবাকান সেই সময়ে প্রায় সকল ইসলামপন্থীদের সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে সমর্থন লাভ করলেও ফেতুল্লাহ গুলেন থেকে তিনি কোন রকম সাহায্য সহযোগিতা পাননি। এরবাকান ক্ষমতায় আরোহণ করার পর পরই ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জন্য কাজ করা শুরু করেন। যেটা আমেরিকা-ইসরাইলসহ অন্যান্য ইয়াহুদিবাদী শক্তি ভালো ভাবে নেয়নি। এবং এরবাকান কে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তারা ওঠে পড়ে লাগে, এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তাকে পদচ্যুত করে। দুঃখজনক হলেও সত্য এর পেছনে ফেতুল্লা গুলেনেরও হাত ছিল। ১৯৯৭ সালের ১৬ এপ্রিল তিনি এক টেলিভিশন প্রোগ্রামে বলেছিলেন, এরবাকান তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার যোগ্য ছিলেন না। তিনি জনগণের আমানতকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারেননি।’ তার এই মন্তব্যে মুসলিমরা খুবই মর্মাহত হন। একদিকে বাম ও জাতীয়তাবাদীরা অপরদিকে ফেতুল্লা গুলেনের কথা বার্তা ও তাদের বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতি রেফাহ পার্টির জন্য মোকাবেলা করতে খুবই হিমশিম খেতে হয়। নাজিমুদ্দিন এরবাকানের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা বন্ধ করার ব্যাপারে তার প্রকাশ্য সম্মতি ছিল। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হিজাব পরার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সর্বত্র এর বিপক্ষে নতুন করে আন্দোলন গড়ে ওঠে। গুলেন সে সময় এসব মুসলমানদের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং তার সংগঠনের অধীনস্থ মেয়েদেরকে হিজাব খুলে ক্লাস করার জন্য বলেন। ফেতুল্লাহ গুলেন রেফাহ পার্টি যাতে ক্ষমতায় না থাকতে পারে সে জন্য ইয়াহুদিদের সাথে হাত মিলান এবং পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক বাম আন্দোলনের নেতা বুলেন্ত এযেভিতকে সমর্থন করেন। সেই সময়ে টিভি-পত্রপত্রিকাতে এরবাকানকে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং আখিরাতে তিনি বুলেন্ত এযেভিত কে শাফায়াত করবেন বলে ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে তিনি আমেরিকাতে পাড়ি জমান।
২০০০ সালে রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করে দেয়ার পর ফাযিলেত পার্টি খুলা হয়। আর সেখানে যুবক নেতা হিসেবে পরিচিত আবদুল্লাহ গুল; রিজেপ তায়্যিপ এরদগান; বুলেন্ত আরিঞ্ছদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেন। ২০০১ সালে এদের নেতৃত্বে একে পার্টি গঠন করার সময় কৌশলগত কারণে এরদুগান ফেতুল্লাহ গুলেন ও তার সংগঠন গুলেন আন্দোলন যা তুরস্কে ‘হিযমেত’ এর সহযোগিতা নেন। এরদোগান ও তার প্রথম ৯ বছরের শাসনামলে তাদেরকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেন। সরকারি সকল জায়গাতেই তারা স্থান দখল করে সরকার এর ভেতর সরকার গঠন করেন। কিন্তু নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে ফেতুল্লাহ গুলেন এর সাথে এরদোগানের একে পার্টির সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে পরবর্তীতে ২০১৩ সালে একেপি ও গুলেন এর দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয়। সবশেষ গেজে পার্কের আন্দোলনের সময় এরদুগানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য প্রশাসনে তার লোকজন এবং বামদের ঐক্যবদ্ধ করেন ফেতুল্লা গুলেন। কিন্তু এরদুগান অনেকটা সফলতার সাথে সে সমস্যা কাটিয়ে ওঠেন।
উনার লিখিত বই পুস্তকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকিদার বিপরীত কথাবার্তাসমূহ দেখলেই আমরা তার সম্পর্কে ধারণা পাবো। ফাসিল থেকে ফাসিলা (ঋধংহ্নষফধহ ঋধংহ্নষধ) বইয়ের ৩ নব্বর খন্ডের ১৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন যে ‘বিশেষ করে কালেমায়ে শাহাদাত সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে নতুন করে বিবেচনা করা দরকার। এমন কি সেই কালেমার অর্ধেক অর্থাৎ ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ যারা না বলবে তারাও মরহুম ও রহমতের দৃষ্টিতে দেখার যোগ্য। কেননা হাদিসে বলা আছে আল্লাহ তার বিশাল রহমতের দ্বারা আখেরাতে এমনভাবে নুরান্নিত করবেন যে; শয়তান পর্যন্ত বলবে যে, ‘আমিও যদি ফিরে আসি তাহলে মুক্তি পাবো কি?’ এই কথা বলে শয়তানও আশা পোষণ করতে থাকবে। এখন এমন এক দয়াবান রবের দয়ার বিপরীতে আমাদের কৃপণতা এবং সেই কৃপণতার প্রতিনিধিত্ব আমরা কেন করব? সেই সাথে আমাদের কি আসে যায়? সমগ্র সৃষ্টি জগৎ তার; সকল সম্পদের মালিক তিনি সকল বান্দার রবও হলেন তিনি। তাই আমাদের সকলকেই আমাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানা থাকা উচিত। ‘লেখক ও সাংবাদিক সংগঠন এর দ্বারা প্রকাশিত কুরেসেল বারিশা দরু (খুজাদান কেলেবেগে-৩) নামক বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন যে “ইয়াহুদি ও খ্রিষ্টানদের সম্পর্কে নাজিলকৃত আয়াতসমূহ; অথবা হযরত মুহাম্মাদ সা:-এর সময়ে কিংবা তাদের নিজেদের নবীদের সময়ে বসবাস রত ইয়াহুদি ও খ্রিষ্টানদের সম্পর্কে সেই আয়াতগুলো এখন আর প্রযোজ্য নয়।”
সারা দুনিয়ার প্রায় ১৮০টি দেশে স্কুল রয়েছে সেই সকল স্কুল থেকে প্রতিবছর ১৫-১৬ বসরের যুবতী মেয়েদেরকে নিয়ে তার্কিশ অলিম্পিয়াডের নামে নাচগানের অনুষ্ঠান করে থাকে । সে সম্পর্কে তিনি বলছেন যে সেখানে নাকি রাসূলুল্লাহ (সা) স্বয়ং উপস্থিত থাকেন (নাউজুবিল্লাহ)। আর সেই অনুষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করা নাকি ওহুদের ময়দানে জিহাদ করার সমতুল্য।
গুলেন আন্দোলন এদের সর্বনিম্নস্থল হলো বিভিন্ন মেস, কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট স্কুল, হোস্টেল ও তাদের পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল। তাদের এই সকল মেসে ও বাসার ছাত্রদেরকে তাদের মন মানসিকতার আলোকে গড়ে তুলা হয়। তাদের বাসা ও মেসে থাকা অধিকাংশ ছাত্র নিজেদের পরিচয়কে গোপন করে চলে। তারা এতটায় গোপনীয় যে একই বিল্ডিংয়ে ২টা অ্যাপার্টমেন্টে এ থাকলেও তারা একজন আরেকজন সম্পর্কে বেখবর। তাদের তৈরি করা এই সকল যুবক শ্রেণী তাদের বড়দের পরিকল্পনা মত কেউ সেনাবাহিনীতে কেউবা আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানে অর্থাৎ তাদের হর্তাকর্তাদের মন মত তারা নিজেদেরকে গঠন করে থাকে।
এই ভাবে লোক তৈরি করার ফলে ও তাদের জানা অজানা সকল সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় সরকারি বাজেটের কাছাকাছি। তাদের প্রচারিত পত্রিকার গ্রাহকসংখা প্রায় ১ মিলিয়ন ও তাদের টিভি মিডিয়া হল সামানইয়ল টিভি পাশাপাশি তাদের ৩৯টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর পাশাপাশি দুনিয়ার প্রায় ১৮০টি দেশে এদের স্কুল রয়েছে। এগুলোতে ইসলামী শিক্ষা দেয়ার এ কথা বলা হলেও মূলত পাশ্চাত্য ধাঁচেই শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে।
সিআইএ এবং এফবিআইয়ের সাথে গুলেনের গভীর সম্পর্কের কথা সেই ৯০ দশক থেকে ওপেন সিক্রেট। ২০০৫ সালে এফবিআই নিজেদের ওয়েবসাইটে তাদের সহযোগী সংস্থাদের নাম প্রকাশ করেন যাতে চার নাম্বারে ছিল ‘দি গুলেন ইনস্টিটিউট’ তথা গুলেন মুভমেন্ট। প্রথমদিকে রজব তায়েফ এরদোগানের ক্ষমতায় আসার জন্য একটি বড় গোষ্ঠীর ভোটের প্রয়োজন ছিল। কারণ তুর্কিবাসীর বিশাল একটা অংশের ওপর গুলেনের অনেক প্রভাব রয়েছে। তাই গুলেন মুভমেন্টের সাথে গভীর একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেন এবং পার্টি গঠনের এক বছরের মাথায় ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় আসার পর ফেতুল্লাহ গুলেন যেন অদৃশ্য প্রধানমন্ত্রী বনে গেলেন। তিনি আমেরিকার পেনসিলভানিয়াতে বসে যাকে যে পোস্টে দিতে বলেন তাকে সে পোস্টে দেয়া হয় এক পর্যায়ে দেখা যায় পুলিশ-সেনাবাহিনী থেকে শুরু অফিস-আদালত পর্যন্ত সব জায়গায় গুলেন মুভমেন্টের লোকের ব্যাপক এবং ভয়ঙ্কর উপস্থিতি। গুলেন মুভমেন্টের লোক হলেই পদ দেয়া হয়েছে। যা জেনেশুনে পায়ে কুড়াল মারারই শামিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যার ফলাফল হিসেবে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ট্র্যাজেডির উৎপত্তি। দেশজুড়ে রয়েছে গুলেন মুভমেন্টের হাজার হাজার কোচিং সেন্টার। সেসব কোচিং সেন্টারের গোপনে গুলেন মুভমেন্ট সম্পর্কে ব্রেইন ওয়াশ করা হয়। সেটা ছিল ওপেন সিক্রেট একটা ব্যাপার। এবং কোচিং সেন্টার গুলোর ফিও ছিল গরিবদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরদোগান তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ক্রমান্বয়ে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির কাজটা করে যাচ্ছিলেন এবং গত বছর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সব ধরনের কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দিয়ে তদস্থলে ফ্রি কোর্সের ব্যবস্থা করা হবে। এরকম একটা সিদ্ধান্ত গুলেন মুভমেন্ট সহজভাবে নিতে পারেনি। তারা এর পর থেকে এরদোগানের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে। এর মধ্যে এরদোগানের বিরুদ্ধে ফেতুল্লাহ গুলেনের করা একটা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার শিকার হয়েছে। এবং গত ১৭ ডিসেম্বর তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ এনে এরদোগানসহ মন্ত্রিপরিষদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে গ্রেফতারের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। যেটা চলে ২৫ ডিসেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত। কিছু মন্ত্রীর রদবদলের মাধ্যমে কোন রকম কাটিয়ে ওঠেন এ বিপদ থেকে। ঐ দিকে গুলেন মিডিয়াতে এরদোগানের বিরুদ্ধে চলছে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা। কয়েক মাস আগে ইসরাইলি হামলায় সাত ফিলিস্তিনি শহীদ হলে গুলেনের মুখপাত্র সামানিয়ল টিভি বলে, ‘ইসরাইলি হামলায় ফিলিস্তিনের সাত সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে।’ আল কুদসের রক্ষার সংগ্রামে অবিরাম যুদ্ধরত ফিলিস্তিনি মোজাহিদদেরকে সন্ত্রাসী বলতে দ্বিধা করেনি এ তথাকথিত ইসলামিস্ট জামাত গুলেন মুভমেন্টের মিডিয়া। ১৭ ডিসেম্বরের ঘটনার পর থেকে এরদুগান বলে আসছেন, আমি তোমাদেরকে (গুলেন মুভমেন্ট) বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু তোমরা আমার এতবড় ক্ষতি করলে।’
২০১১ সালে তুরস্কের একটা এনজিও আইএইচএস মাভি মারমারা নামের জাহাজে করে ফিলিস্তিনের দুর্গত অঞ্চলে খাবার নিয়ে যাচ্ছিল, ভুমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার সময় ইসরাইল সেখানে বিমান হামলা চালায়, ফলে ৯ জন নিহত হয়। সমগ্র দুনিয়ায় বিষয়টি আলোড়ন তৈরি করে এবং সবাই ইসরাইলকে আইনের মুখোমুখি করানোর দাবি জানায়। কিন্তু ফেতুল্লা গুলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি বলেন মাভি মারমারার উচিত ছিল ইসরাইলের অনুমতি নেয়া। এ ছাড়াও মিয়ানমারে মুসলিম গণহত্যা চালানোর সময় তিনি বৌদ্ধদের পক্ষ অবলম্বন করে বলেন, ‘বৌদ্ধ একটা হক ধর্ম।’
এভাবেই বিভিন্ন সময়ে ফেতুল্লা গুলেন মুসলমানদের স্বার্থের চেয়ে অন্যদের বড় করে দেখেন। মূলত তার পেছনে ইহুদি এবং পশ্চিমাদের কোটি কোটি মিলিয়ন ডলার খরচের মাধ্যমে এভাবেই তাকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেন। কিন্তু মুসলমানদের স্বার্থ বিরোধী এই ব্যক্তিকে পশ্চিমারা তাদের মিডিয়ার মাধ্যমে মুসলমানদের ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করার মিথ্যা প্রয়াস চালান।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, গাজি ইউনিভার্সিটি, আনকারা, তুরস্ক
বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ
তুরস্কে গণঅভ্যুত্থানে ভেসে গেছে সামরিক অভ্যুত্থান
তুরস্কে গত শুক্রবার রাতে সামরিক বাহিনীর একটি গ্রুপের এরদোগান সরকার উৎখাতে অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে ভেসে গেছে গুলেনিজপন্থীদের সামরিক অভ্যুত্থান। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৬৫ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। নিহতদের অধকাংশই বেসামরিক লোক। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর অধিকাংশ বিদ্রোহী সেনা সদস্য আত্মসমর্পণ করেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত ও এরদোগান সরকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এদিকে অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে এরদোগান সরকারের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামাসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
তুর্কি টেলিভিশন এনটিভি শনিবার সকালে দেশটির জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এমআইটির মুখপাত্রের বরাত দিয়ে অভ্যুত্থান নস্যাতের খবর দিয়েছে।
টেলিভিশনটি বলছে, ‘রাজধানী আঙ্কারায় অভ্যুত্থান চেষ্টার পক্ষে সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার গুলি করে ভূপাতিত করেছে সরকারি ফাইটার বিমান। সরকারি বাহিনী অভ্যুত্থানকারীদের হাত থেকে আঙ্কারার রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা টিআরটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে।’
তুর্কি সরকারি সূত্র জানায়, অভ্যুত্থানে জড়িত এ পর্যন্ত উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তাসহ ২৮৩৯ জনকে আটক করা হয়েছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান শনিবার বলেছেন, সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের চড়া মূল্য দিতে হবে। ইস্তাম্বুল থেকে দেয়া সরাসরি ভাষণে এ কথা বলেছেন তিনি।
দেশের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বলেছেন, পরিস্থিতি এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং রাজধানী আঙ্কারার আকাশে বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এর আগে, রাষ্ট্রীয় একটি টেলিভিশন থেকে তুরস্কের সেনাবাহিনীর একটি অংশ দাবি করেছিল যে, তারা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে’ সশস্ত্র বাহিনী তুরস্কের ক্ষমতা দখল করেছে বলে খবরে বলা হয়।
অভ্যুত্থানকারী সেনাদের বিবৃতিতে বলা হয়, এখন থেকে একটি ‘পিস কাউন্সিল’ দেশ পরিচালনা করবে। দেশে কারফিউ এবং মার্শাল ল’ জারি করা হয়েছে। রয়টার্স, সিএনএন, আলজাজিরা, গার্ডিয়ান, এএফপি।
জড়িতদের চড়া মূল্য দিতে হবে-এরদোগান
আতার্তুক বিমান বন্দরে প্রেসিডেন্ট এরদোগান
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান গতকাল (শনিবার) বলেছেন, সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের চড়া মূল্য দিতে হবে। ইস্তাম্বুল থেকে দেয়া সরাসরি ভাষণে এ কথা বলেছেন তিনি।
তুর্কি সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার কয়েক ঘণ্টা পরে এরদোগানকে বহনকারী বিমান ইস্তাম্বুলের আতার্তুক আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করে। নামার আগে বিমানটি প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে ইস্তাম্বুলের আকাশে চক্কর দিয়েছে।
বিমানবন্দর থেকে দেয়া সরাসরি ভাষণে তিনি বলেন, যা ঘটেছে তা বিশ্বাসঘাতকতা এবং বিদ্রোহ। বিদ্রোহের জন্য তাদেরকে চড়া মূল্য দিতে হবে। তিনি তুরস্কের মানুষদের ছেড়ে কোথাও যাবেন না বলেও এ সময় জানান।
সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী এ অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা করেছে উল্লেখ করে এরদোগান বলেন, সামরিক বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে।
আত্মসমর্পণ
তুরস্কে অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারী সেনাদের একটি অংশ ইস্তাম্বুলে আত্মসমর্পণ করেছে।শনিবার ইস্তাম্বুলের বসফরাস সেতুতে তারা আত্মসমর্পণ করেন।
শুক্রবার দিবাগত রাতে অভ্যুত্থানের চেষ্টার পর থেকেই রাতভর সেতুটিতে অবস্থান করছিলেন ওই সেনারা।বার্তা সংস্থা এফপি জানায়, সামরিক পোশাক পরা সেনাদের ট্যাংকের পেছনে দুই হাত ওপরে তুলে আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায়।তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আন্দালু জানায়, ৫০ সেনা আত্মসমর্পণ করেছে।তুরস্কের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ছবিতে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের সমর্থকরা সেনাদের ফেলে যাওয়া একটি ট্যাংকের ওপর উঠে উল্লাস করছে। এ সময় ওই সমর্থকরা তুরস্কের পতাকা ওড়ায় এবং বিজয় চিহ্ন দেখায়। অনেকে আবার ব্রিজের এদিক ওদিকে ছুটে উল্লাস প্রকাশ করে। তুরস্কের টেলিভিশন চ্যানেলে জানানো হয়েছে, আংকারার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে শনিবার সকালে অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারী সেনাদের লক্ষ্য করে বিমান থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। ওই এলাকা থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়।তুরস্কের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এএফপি জানায়, দেশটির সামরিক বাহিনীর এফ-১৬ বিমান থেকে অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে।তিনি আরো জানান, অভ্যুত্থানের চেষ্টায় ব্যবহার করা একটি হেলিকপ্টার ব্যবহার করছিল, যা আংকারার গলবাসি এলাকায় ভূপাতিত করা হয়েছে।
অভ্যুত্থান প্রতিহত করতে রাজপথে জনতা
তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে প্রেসিডেন্ট তায়িব এরদোগানের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার সমর্থক বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বলেছেন, পরিস্থিতি এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং রাজধানী আংকারার আকাশে বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সেনাদের পিটিয়ে পুলিশে দিলো
শেষ পর্যন্ত জনগণের প্রতিরোধের মুখে তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর ট্যাংকের ওপর সাধারণ মানুষের দখল দেখা গেছে। এ ছাড়া ইস্তাম্বুলের সড়কে ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে সেনাসদস্যদের পোশাক, হেলমেটসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক দ্রব্য। কোথাও কোথাও সেনাদের পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের সমর্থকরা।
শুক্রবার রাতে এক বার্তায় প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান অভ্যুত্থানে চেষ্টারত সেনাসদস্যদের প্রতিহত করতে জনগণকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে শুক্রবার রাত থেকেই রাজপথে অবস্থান নেন তার সমর্থকরা। সেনাসদস্যদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন তারা। ইনডিপেনডেন্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কয়ারে জাতীয় পতাকা হাতে জড়ো হন হাজারো সাধারণ মানুষ। তারা সেনাবাহিনী বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। অনেকেই সেনাবাহিনীর ট্যাংকের ওপর উঠে বিক্ষোভ করেন। ইস্তাম্বুল ছাড়াও রাজধানী আঙ্কারাসহ অন্যান্য শহরে বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে।সিএনএনের ফুটেজে দেখা যায়, ইস্তাম্বুলের বসফরাস সেতু এলাকায় সরকারি বাহিনীর কাছে হাত উঁচিয়ে আত্মসমর্পণ করছেন সেনাসদস্যরা। বিভিন্ন ট্যাংক থেকে বেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে আত্মসমর্পণ করেন তারা।
এ ছাড়া ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন স্থান থেকে সেনাসদস্যদের মারধর করে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় জনতা।এরদোগানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে আসা সাধারণ মানুষকে সেনাবাহিনীর ট্যাংকের সামনেই নির্ভীকভাবে হেঁটে যেতে দেখা যায়। সেনাসদস্যদের ছোড়া ফাঁকা গুলির মুখেও তারা এগিয়ে যাচ্ছেন বলে সিএনএনের এক ভিডিওতে দেখা যায়।
ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান উমিত দুন্দার
সেনাবাহিনীর একাংশের অভ্যুত্থান চেষ্টার পর ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান নিয়োগ করেছে তুরস্ক। দেশটির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।ওই কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, তুরস্কের স্থলবাহিনীর একটি অংশ ফার্স্ট আর্মির প্রধান উমিত দুন্দারকে ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এরদোগানকে হত্যা চেষ্টা
শুক্রবার রাতে সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টাকালে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যেপ এরদোগানকে হত্যার জন্য সেনারা বোমা ফেলে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পর্যটন স্থান মারমারিসে অবস্থান করার সময় এই ঘটনা ঘটে বলে জানান এরদোগান।
অভ্যুত্থানের খবর জানার পরপরই মারমারিস থেকে ইস্তাম্বুল রওনা দেন এরদোগান। গতকাল শনিবার সকালে ইস্তাম্বুলে কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দর থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি।
ভাষণের এক পর্যায়ে এরদোগান বলেন, ‘আমি মারমারিস থেকে চলে আসার কিছুক্ষণ পরই তারা (বিদ্রোহী সেনারা) সেখানে বোমা হামলা চালায়। আমার মনে হয়, বোমা ফেলার সময় তারা মনে করেছিল, আমি সেখানে অবস্থান করছি। তারা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।’
সেনাপ্রধান উদ্ধার
তুরস্কের সেনাপ্রধান হুলুসি আকারকে জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারের পর তাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরইমধ্যে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমের টুইটার অ্যাকাউন্টে সেনাপ্রধানকে উদ্ধারের একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান। শুক্রবার রাতে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকারী একটি অংশ হলুসি আকারকে জিম্মি করেছিল।
মাইকিং মসজিদে মসজিদে
তুরস্কের ইজমির শহরে অবস্থানরত বাংলাদেশি একজন শিক্ষার্থী জানান, গভীর রাত থেকেই ইস্তাম্বুলে সংঘর্ষ শুরু হয়। তবে প্রথমে গুজবের মতো ছড়িয়ে পড়ে, ইউরোপ ও এশিয়ার কানেকটিং ব্রিজ দখল করে সেনারা বন্ধ করে দিয়েছে। শুরুতে নানা গুজব সৃষ্টি হলেও এক পর্যায়ে আমরা জেনে যাই, ইস্তাম্বুলে সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাষ্ট্রপতি এরদোগানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। আমার বন্ধুদের (ইস্তাম্বুলে অবস্থারত) কাছে জানতে পারি, শেষরাতে ইস্তাম্বুল হয়ে পড়ে যুদ্ধক্ষেত্র। কারণ ততক্ষণে বিদ্রোহীরা বিমানবাহিনীর প্রধানকে জিম্মি করে হেলিকপ্টার নিয়ে আকাশে উড়তে থাকে।এসব ঘটনার এরদোয়ান ভিডিও বার্তায় জনগণকে রাস্তায় নেমে প্রতিহতের নির্দেশ দেন। সঙ্গে-সঙ্গেই তা দ্রুত সবগুলো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশি ওই শিক্ষার্থী জানান, তিনি ইস্তাম্বুলে তার বন্ধুদের কাছে জানতে পেরেছেন, সেখানে মসজিদে মাইকিং করে এরদোয়ানের বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। তার কিছুক্ষণ পরে তিনি শুনতে পান ইজমিরের মসজিদগুলো থেকেও মাইকে এরদোগানের আহ্বান প্রচার করা হচ্ছে। তিনি আরও যোগ করে বলেন, ইজমিরের মসজিদগুলো কখনোই সরকারের পক্ষে কিছু প্রচার করেনি। এই প্রথম এখানে এমনটা দেখেছি। তার মানে ধরে নেওয়া যায়, সারাদেশেই মসজিদগুলো থেকে মাইকিং করা হয়েছে।
ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ইজমিরে বসে পুরো তুরস্কের বিষয়ে বর্ণনা করা খুব কঠিন। ইজমিরের অধিকাংশ জনগণ এরদোগানকে পছন্দ না করলেও তারা সেনা বিদ্রোহের বিপক্ষে মাঠে নেমে পড়ে। যা অনেকটা এরদোগানের পক্ষেই কাজ করার মতো।
এ আন্দোলনে জনতার জয় হয়েছে বলে তুরস্কের জনগণ মনে করছে বলে জানান বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। কারণ সেনাদের এভাবে সাহসের সঙ্গে রুখে দিয়েছে জনগণই। তার অনেক বন্ধুও মনে করছেন, এই প্রতিরোধ করার সাহস তাদের ভবিষ্যতে নতুন কিছু করার দিশা দেখাতে পারবে।
অভিযোগ অস্বীকার গুলেনের
তুরস্কের বিশেষ এক মতের ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেন সেনা অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে তাঁকে জড়ানোয় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এর আগে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান অভ্যুত্থানের পেছনে গুলেনের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন।গতকাল শুক্রবার মধ্যরাতে গুলেন এক বিবৃতিতে বলেন, এই সেনা অভ্যুত্থানের সঙ্গে তাঁকে জড়িত করার চেষ্টা খুব অপমানজনক। তিনি বলেন, সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভ করতে হবে; শক্তি দিয়ে নয়। গুলেন বলেন, তিনি তুরস্কের জনগণের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছেন। তুরস্ক যাতে শান্তিপূর্ণভাবে ও দ্রুত এই কঠিন সময় পার হতে পারে, এ জন্য প্রার্থনা করছেন। গুলেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের ফোকোনো পাহাড়ি এলাকার ছোট একটি শহরে বাস করেন। ৭৫ বছর বয়সী গুলেন একসময় এরদোগানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
গ্রিসে পালিয়েছে ৮ সেনা
তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া আটজন সামরিক কর্মকর্তা গ্রিসে পালিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে।
একটি সামরিক হেলিকপ্টারে গিয়ে গ্রিসের উত্তরাঞ্চলে অবতরণ করে এসব সেনা কর্মকর্তা।
গ্রিসের পুলিশ জানিয়েছে, উত্তরাঞ্চলীয় শহর আলেকজান্দ্রোপোলিসে তুরস্কের একটি সামরিক হেলিকপ্টার অবতরণ করে। সেখান থেকে আটজন ক্রুকে হেফাজতে নেয়া হয়েছে। এরপর তারা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে।
বিশ্ব নেতাদের সমর্থন
তুরস্কের ওই অভ্যুত্থান নিয়ে ইতিমধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। তারা এরদোগান সরকারের প্রতিও নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট রেসেপ তায়েব এরদোগানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে বলেছেন,তুরস্কের সকল পক্ষের উচিত দেশটির নির্বাচিত সরকারকে সমর্থন করা। একই সঙ্গে তিনি দেশটির সকল পক্ষের প্রতি সরকার পরিবর্তনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রাখারও আহ্বান জানিয়েছেন। একই বক্তব্য করেছেন মস্কো সফররত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও। তারা তুরস্কের নেতাদের প্রতি যে কোনো ধরনের রক্তপাত এড়িয়ে চলারও পরামর্শ দিয়েছেন।
তুরস্কের সকল পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। দেশটির পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানিয়েছে ওই সংস্থাটি।
এরদোগান সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন ইউরোপীয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক। গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি প্রধান অংশীদার। এ কারণে দেশটিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি ইইউ-র পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।’ মঙ্গোলিয়ায় এক আঞ্চলিক সম্মেলনে অংশ নেয়ার সময় ওই নেতা দেশটিতে দ্রুত সাংবিধানিক আইন প্রতিষ্ঠিত করারও আহ্বান জানিয়েছেন।
তুরস্কের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাজ্যের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি সেখানে অবস্থারত ব্রিটিশ নাগরিকদের পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত জনাকীর্ণ স্থানসমূহ এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কমনওয়েল কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এক টুইটার বার্তায় তুরস্কের পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফও। তিনি তুর্কি কর্তৃপক্ষের প্রতি দেশের স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও জনগণের নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টি দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।
তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দেশটিতে অবস্থানরত রুশ নাগরিকদের ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লেভারভ।
এদিকে অভ্যুত্থানের নিন্দা করেছেন তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলও। তিনি মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএন’কে বলেছেন, ‘তুরস্ক কোনো ল্যাটিন আমেরিকার দেশ নয় যে সেনাবাহিনী এভাবে ক্ষমতা দখল করে নেবে।’ তিনি ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় লিপ্ত সেনাদের সেনাছাউনিতে ফিরে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।
তুরস্ক সরকারের প্রতি আরো সমর্থন জানিয়েছেন, স্লোভেকিয়া, কাতার, গ্রিস, বুলগেরিয়া ও মেক্সিকোর নেতারা।
এক- পরশু সারারাত অনেক ঘটনার পর গতকাল সকাল থেকে শুরু হয় বিপথগামী সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পন ও গ্রেপ্তার।কিন্তু বিপথ পুরোপুরি কাটতে সময় লেগে যায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত যখন সর্বশেষ গ্রুপ আত্মসমর্পন করে।কিন্তু গুজবে গুজবে গতরাত পার হয়েছে তার্কিশদের। মুখে মুখে ছিল প্ল্যাণ "বি" বাস্তবায়নের কথা। এমনকি পত্রিকাগুলোও এ নিয়ে নিউজ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিল গুজবের ব্যপক বিস্তর।প্ল্যাণ "বি" মানে হল নতুন ক্যু। অর্থাৎ প্রথম ক্যুতে ব্যর্থ হয়ে তারা দ্বিতীয় ক্যু করতে পারে এমন ধারনা।
তুর্কি টেলিভিশন এনটিভি শনিবার সকালে দেশটির জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এমআইটির মুখপাত্রের বরাত দিয়ে অভ্যুত্থান নস্যাতের খবর দিয়েছে।
টেলিভিশনটি বলছে, ‘রাজধানী আঙ্কারায় অভ্যুত্থান চেষ্টার পক্ষে সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার গুলি করে ভূপাতিত করেছে সরকারি ফাইটার বিমান। সরকারি বাহিনী অভ্যুত্থানকারীদের হাত থেকে আঙ্কারার রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা টিআরটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে।’
তুর্কি সরকারি সূত্র জানায়, অভ্যুত্থানে জড়িত এ পর্যন্ত উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তাসহ ২৮৩৯ জনকে আটক করা হয়েছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান শনিবার বলেছেন, সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের চড়া মূল্য দিতে হবে। ইস্তাম্বুল থেকে দেয়া সরাসরি ভাষণে এ কথা বলেছেন তিনি।
দেশের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বলেছেন, পরিস্থিতি এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং রাজধানী আঙ্কারার আকাশে বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এর আগে, রাষ্ট্রীয় একটি টেলিভিশন থেকে তুরস্কের সেনাবাহিনীর একটি অংশ দাবি করেছিল যে, তারা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে’ সশস্ত্র বাহিনী তুরস্কের ক্ষমতা দখল করেছে বলে খবরে বলা হয়।
অভ্যুত্থানকারী সেনাদের বিবৃতিতে বলা হয়, এখন থেকে একটি ‘পিস কাউন্সিল’ দেশ পরিচালনা করবে। দেশে কারফিউ এবং মার্শাল ল’ জারি করা হয়েছে। রয়টার্স, সিএনএন, আলজাজিরা, গার্ডিয়ান, এএফপি।
জড়িতদের চড়া মূল্য দিতে হবে-এরদোগান
আতার্তুক বিমান বন্দরে প্রেসিডেন্ট এরদোগান
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান গতকাল (শনিবার) বলেছেন, সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের চড়া মূল্য দিতে হবে। ইস্তাম্বুল থেকে দেয়া সরাসরি ভাষণে এ কথা বলেছেন তিনি।
তুর্কি সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার কয়েক ঘণ্টা পরে এরদোগানকে বহনকারী বিমান ইস্তাম্বুলের আতার্তুক আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করে। নামার আগে বিমানটি প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে ইস্তাম্বুলের আকাশে চক্কর দিয়েছে।
বিমানবন্দর থেকে দেয়া সরাসরি ভাষণে তিনি বলেন, যা ঘটেছে তা বিশ্বাসঘাতকতা এবং বিদ্রোহ। বিদ্রোহের জন্য তাদেরকে চড়া মূল্য দিতে হবে। তিনি তুরস্কের মানুষদের ছেড়ে কোথাও যাবেন না বলেও এ সময় জানান।
সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী এ অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা করেছে উল্লেখ করে এরদোগান বলেন, সামরিক বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে।
আত্মসমর্পণ
তুরস্কে অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারী সেনাদের একটি অংশ ইস্তাম্বুলে আত্মসমর্পণ করেছে।শনিবার ইস্তাম্বুলের বসফরাস সেতুতে তারা আত্মসমর্পণ করেন।
শুক্রবার দিবাগত রাতে অভ্যুত্থানের চেষ্টার পর থেকেই রাতভর সেতুটিতে অবস্থান করছিলেন ওই সেনারা।বার্তা সংস্থা এফপি জানায়, সামরিক পোশাক পরা সেনাদের ট্যাংকের পেছনে দুই হাত ওপরে তুলে আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায়।তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আন্দালু জানায়, ৫০ সেনা আত্মসমর্পণ করেছে।তুরস্কের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ছবিতে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের সমর্থকরা সেনাদের ফেলে যাওয়া একটি ট্যাংকের ওপর উঠে উল্লাস করছে। এ সময় ওই সমর্থকরা তুরস্কের পতাকা ওড়ায় এবং বিজয় চিহ্ন দেখায়। অনেকে আবার ব্রিজের এদিক ওদিকে ছুটে উল্লাস প্রকাশ করে। তুরস্কের টেলিভিশন চ্যানেলে জানানো হয়েছে, আংকারার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে শনিবার সকালে অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারী সেনাদের লক্ষ্য করে বিমান থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। ওই এলাকা থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়।তুরস্কের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এএফপি জানায়, দেশটির সামরিক বাহিনীর এফ-১৬ বিমান থেকে অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে।তিনি আরো জানান, অভ্যুত্থানের চেষ্টায় ব্যবহার করা একটি হেলিকপ্টার ব্যবহার করছিল, যা আংকারার গলবাসি এলাকায় ভূপাতিত করা হয়েছে।
অভ্যুত্থান প্রতিহত করতে রাজপথে জনতা
তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে প্রেসিডেন্ট তায়িব এরদোগানের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার সমর্থক বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বলেছেন, পরিস্থিতি এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং রাজধানী আংকারার আকাশে বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সেনাদের পিটিয়ে পুলিশে দিলো
শেষ পর্যন্ত জনগণের প্রতিরোধের মুখে তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর ট্যাংকের ওপর সাধারণ মানুষের দখল দেখা গেছে। এ ছাড়া ইস্তাম্বুলের সড়কে ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে সেনাসদস্যদের পোশাক, হেলমেটসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক দ্রব্য। কোথাও কোথাও সেনাদের পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের সমর্থকরা।
শুক্রবার রাতে এক বার্তায় প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান অভ্যুত্থানে চেষ্টারত সেনাসদস্যদের প্রতিহত করতে জনগণকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে শুক্রবার রাত থেকেই রাজপথে অবস্থান নেন তার সমর্থকরা। সেনাসদস্যদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন তারা। ইনডিপেনডেন্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কয়ারে জাতীয় পতাকা হাতে জড়ো হন হাজারো সাধারণ মানুষ। তারা সেনাবাহিনী বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। অনেকেই সেনাবাহিনীর ট্যাংকের ওপর উঠে বিক্ষোভ করেন। ইস্তাম্বুল ছাড়াও রাজধানী আঙ্কারাসহ অন্যান্য শহরে বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে।সিএনএনের ফুটেজে দেখা যায়, ইস্তাম্বুলের বসফরাস সেতু এলাকায় সরকারি বাহিনীর কাছে হাত উঁচিয়ে আত্মসমর্পণ করছেন সেনাসদস্যরা। বিভিন্ন ট্যাংক থেকে বেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে আত্মসমর্পণ করেন তারা।
এ ছাড়া ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন স্থান থেকে সেনাসদস্যদের মারধর করে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় জনতা।এরদোগানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে আসা সাধারণ মানুষকে সেনাবাহিনীর ট্যাংকের সামনেই নির্ভীকভাবে হেঁটে যেতে দেখা যায়। সেনাসদস্যদের ছোড়া ফাঁকা গুলির মুখেও তারা এগিয়ে যাচ্ছেন বলে সিএনএনের এক ভিডিওতে দেখা যায়।
ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান উমিত দুন্দার
সেনাবাহিনীর একাংশের অভ্যুত্থান চেষ্টার পর ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান নিয়োগ করেছে তুরস্ক। দেশটির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।ওই কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, তুরস্কের স্থলবাহিনীর একটি অংশ ফার্স্ট আর্মির প্রধান উমিত দুন্দারকে ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এরদোগানকে হত্যা চেষ্টা
শুক্রবার রাতে সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টাকালে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যেপ এরদোগানকে হত্যার জন্য সেনারা বোমা ফেলে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পর্যটন স্থান মারমারিসে অবস্থান করার সময় এই ঘটনা ঘটে বলে জানান এরদোগান।
অভ্যুত্থানের খবর জানার পরপরই মারমারিস থেকে ইস্তাম্বুল রওনা দেন এরদোগান। গতকাল শনিবার সকালে ইস্তাম্বুলে কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দর থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি।
ভাষণের এক পর্যায়ে এরদোগান বলেন, ‘আমি মারমারিস থেকে চলে আসার কিছুক্ষণ পরই তারা (বিদ্রোহী সেনারা) সেখানে বোমা হামলা চালায়। আমার মনে হয়, বোমা ফেলার সময় তারা মনে করেছিল, আমি সেখানে অবস্থান করছি। তারা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।’
সেনাপ্রধান উদ্ধার
তুরস্কের সেনাপ্রধান হুলুসি আকারকে জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারের পর তাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরইমধ্যে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমের টুইটার অ্যাকাউন্টে সেনাপ্রধানকে উদ্ধারের একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান। শুক্রবার রাতে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকারী একটি অংশ হলুসি আকারকে জিম্মি করেছিল।
মাইকিং মসজিদে মসজিদে
তুরস্কের ইজমির শহরে অবস্থানরত বাংলাদেশি একজন শিক্ষার্থী জানান, গভীর রাত থেকেই ইস্তাম্বুলে সংঘর্ষ শুরু হয়। তবে প্রথমে গুজবের মতো ছড়িয়ে পড়ে, ইউরোপ ও এশিয়ার কানেকটিং ব্রিজ দখল করে সেনারা বন্ধ করে দিয়েছে। শুরুতে নানা গুজব সৃষ্টি হলেও এক পর্যায়ে আমরা জেনে যাই, ইস্তাম্বুলে সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাষ্ট্রপতি এরদোগানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। আমার বন্ধুদের (ইস্তাম্বুলে অবস্থারত) কাছে জানতে পারি, শেষরাতে ইস্তাম্বুল হয়ে পড়ে যুদ্ধক্ষেত্র। কারণ ততক্ষণে বিদ্রোহীরা বিমানবাহিনীর প্রধানকে জিম্মি করে হেলিকপ্টার নিয়ে আকাশে উড়তে থাকে।এসব ঘটনার এরদোয়ান ভিডিও বার্তায় জনগণকে রাস্তায় নেমে প্রতিহতের নির্দেশ দেন। সঙ্গে-সঙ্গেই তা দ্রুত সবগুলো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশি ওই শিক্ষার্থী জানান, তিনি ইস্তাম্বুলে তার বন্ধুদের কাছে জানতে পেরেছেন, সেখানে মসজিদে মাইকিং করে এরদোয়ানের বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। তার কিছুক্ষণ পরে তিনি শুনতে পান ইজমিরের মসজিদগুলো থেকেও মাইকে এরদোগানের আহ্বান প্রচার করা হচ্ছে। তিনি আরও যোগ করে বলেন, ইজমিরের মসজিদগুলো কখনোই সরকারের পক্ষে কিছু প্রচার করেনি। এই প্রথম এখানে এমনটা দেখেছি। তার মানে ধরে নেওয়া যায়, সারাদেশেই মসজিদগুলো থেকে মাইকিং করা হয়েছে।
ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ইজমিরে বসে পুরো তুরস্কের বিষয়ে বর্ণনা করা খুব কঠিন। ইজমিরের অধিকাংশ জনগণ এরদোগানকে পছন্দ না করলেও তারা সেনা বিদ্রোহের বিপক্ষে মাঠে নেমে পড়ে। যা অনেকটা এরদোগানের পক্ষেই কাজ করার মতো।
এ আন্দোলনে জনতার জয় হয়েছে বলে তুরস্কের জনগণ মনে করছে বলে জানান বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। কারণ সেনাদের এভাবে সাহসের সঙ্গে রুখে দিয়েছে জনগণই। তার অনেক বন্ধুও মনে করছেন, এই প্রতিরোধ করার সাহস তাদের ভবিষ্যতে নতুন কিছু করার দিশা দেখাতে পারবে।
অভিযোগ অস্বীকার গুলেনের
তুরস্কের বিশেষ এক মতের ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেন সেনা অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে তাঁকে জড়ানোয় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এর আগে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান অভ্যুত্থানের পেছনে গুলেনের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন।গতকাল শুক্রবার মধ্যরাতে গুলেন এক বিবৃতিতে বলেন, এই সেনা অভ্যুত্থানের সঙ্গে তাঁকে জড়িত করার চেষ্টা খুব অপমানজনক। তিনি বলেন, সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভ করতে হবে; শক্তি দিয়ে নয়। গুলেন বলেন, তিনি তুরস্কের জনগণের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছেন। তুরস্ক যাতে শান্তিপূর্ণভাবে ও দ্রুত এই কঠিন সময় পার হতে পারে, এ জন্য প্রার্থনা করছেন। গুলেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের ফোকোনো পাহাড়ি এলাকার ছোট একটি শহরে বাস করেন। ৭৫ বছর বয়সী গুলেন একসময় এরদোগানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
গ্রিসে পালিয়েছে ৮ সেনা
তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া আটজন সামরিক কর্মকর্তা গ্রিসে পালিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে।
একটি সামরিক হেলিকপ্টারে গিয়ে গ্রিসের উত্তরাঞ্চলে অবতরণ করে এসব সেনা কর্মকর্তা।
গ্রিসের পুলিশ জানিয়েছে, উত্তরাঞ্চলীয় শহর আলেকজান্দ্রোপোলিসে তুরস্কের একটি সামরিক হেলিকপ্টার অবতরণ করে। সেখান থেকে আটজন ক্রুকে হেফাজতে নেয়া হয়েছে। এরপর তারা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে।
বিশ্ব নেতাদের সমর্থন
তুরস্কের ওই অভ্যুত্থান নিয়ে ইতিমধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। তারা এরদোগান সরকারের প্রতিও নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট রেসেপ তায়েব এরদোগানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে বলেছেন,তুরস্কের সকল পক্ষের উচিত দেশটির নির্বাচিত সরকারকে সমর্থন করা। একই সঙ্গে তিনি দেশটির সকল পক্ষের প্রতি সরকার পরিবর্তনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রাখারও আহ্বান জানিয়েছেন। একই বক্তব্য করেছেন মস্কো সফররত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও। তারা তুরস্কের নেতাদের প্রতি যে কোনো ধরনের রক্তপাত এড়িয়ে চলারও পরামর্শ দিয়েছেন।
তুরস্কের সকল পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। দেশটির পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানিয়েছে ওই সংস্থাটি।
এরদোগান সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন ইউরোপীয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক। গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি প্রধান অংশীদার। এ কারণে দেশটিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি ইইউ-র পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।’ মঙ্গোলিয়ায় এক আঞ্চলিক সম্মেলনে অংশ নেয়ার সময় ওই নেতা দেশটিতে দ্রুত সাংবিধানিক আইন প্রতিষ্ঠিত করারও আহ্বান জানিয়েছেন।
তুরস্কের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাজ্যের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি সেখানে অবস্থারত ব্রিটিশ নাগরিকদের পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত জনাকীর্ণ স্থানসমূহ এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কমনওয়েল কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এক টুইটার বার্তায় তুরস্কের পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফও। তিনি তুর্কি কর্তৃপক্ষের প্রতি দেশের স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও জনগণের নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টি দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।
তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দেশটিতে অবস্থানরত রুশ নাগরিকদের ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লেভারভ।
এদিকে অভ্যুত্থানের নিন্দা করেছেন তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলও। তিনি মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএন’কে বলেছেন, ‘তুরস্ক কোনো ল্যাটিন আমেরিকার দেশ নয় যে সেনাবাহিনী এভাবে ক্ষমতা দখল করে নেবে।’ তিনি ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় লিপ্ত সেনাদের সেনাছাউনিতে ফিরে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।
তুরস্ক সরকারের প্রতি আরো সমর্থন জানিয়েছেন, স্লোভেকিয়া, কাতার, গ্রিস, বুলগেরিয়া ও মেক্সিকোর নেতারা।
বিফল ক্যু পরবর্তী তুরস্কের সর্বশেষ হালচাল!
দুই- সকল রাজনৈতিক দল একসঙ্গে বিকাল ৫ টায় সংসদে বসে। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী চার দলের প্রধানরা বক্তব্য রাখেন। যাতে সম্মিলিতভাবে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সকলে একই সুরে কথা বলেন। অধিবেশন শেষে সম্মিলিত প্রেসব্রিফিং এ প্রধানমন্ত্রী সম্মিলিতভাবে এ ঘটনা কাটিয়ে উঠার কথা বলেন।
তিন- প্রেসিডেন্ট রেপেজ তায়্যিপ এরদোয়ান ও প্রধানমন্ত্রী বিনালী ইলদিরিমের আহবানে রাজপথে অবস্থান করতে থাকে জনতা। গতকাল সারারাত কোটি জনতা রাজপথেই ছিল। এ অবস্থান পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত চলবে। প্রধানমন্ত্রীর আহবানে আনকারার খিজিলাই স্কয়ারে সমবেত হয় লাখো জনতা।
চার- ক্যুতে পরিকল্পনায় সহযোগীতা ও গুলেনের নিয়োগ করা প্রায় তিনহাজার বিচারক বরখাস্ত করা হয়। যারা সকলে গুলেনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিল। গ্রেপ্তার করা হয় দ্বিতীয় বিচারপতিকে (অাই মিনি প্রধান বিচারপতির পরেই যার স্থান)।
পাঁচ- বিদ্রোহী জেনারেলদেরকে নজরদারীতে আনা ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। সর্বশেষ টিভির ব্রেকিং এ দেখে আসলাম, সামরিক বাহিনীর ৪২ জেনারেলের নাম প্রচার করা হচ্ছে যারা নজরধারীতে আছেন।
ছয়- রাজধানীর অনেক জায়গায় এখনো সিটি কর্পোরেশনের ট্রাক দিয়ে গলিগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। বোমা হামলায় কোথাও কোথাও পানির লাইন, বিদ্যুত লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হযেছে যেগুলো এখনো মেরামত সম্বব হয়নি।
সাত- তার্কিশ লিরার বিপরীতে ডলার ও ইউরোর দাম বেড়েছে। অর্থনীতিতে ক্যুয়ের বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
আট- তুরস্কে দুপুর এখন বারটা আট মিনিট বাজে। মসজিদগুলো থেকে একযুগে বিশেষ আযান ও দোয়া প্রচারিত হচ্ছে। যা শহীদদের স্বরণে করা হচ্ছে। আজ শহীদদের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
নয়- পরশু রাতের বিমান হামলায় সরকারী অনেক ভবনরে ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে সংসদ ভবন, রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থার ভবন ও পুলিশের ভবন অন্যতম। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সংসদ ভবন। সেটা আধূনিক তুরস্কে প্রথমবারের মত ঘটনা।
দশ- এবারের ক্যু সফল হলে বিশাল ক্ষতি হত তুরস্কের এমনকি পুরো মুসলিম বিশ্বের। তুরস্কে গণতন্ত্র হয়তোবা অনেক বছরের জন্য হারিয়ে যেত।ইসলাম হয়তোবা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কিন্তু ক্যু ব্যর্থ হওয়ার অটোমেটিক এক বিপ্লব সংঘঠিত হয়ে গেছে। আর হে, এ বিপ্লব ইসলামের বিপ্লব, "তাকভীর-আল্লাহু আকবর", "ইয়া আল্লাহ, বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবর" এর বিপ্লব। যেটা হয়তো এমনিতে অসম্বব ছিল। মানুষের মুখে মুখে এই তাকভীর ধ্বনি তুর্কিশরা সম্ববত বিগত অনেক বছরে দেখেনী।
তিন- প্রেসিডেন্ট রেপেজ তায়্যিপ এরদোয়ান ও প্রধানমন্ত্রী বিনালী ইলদিরিমের আহবানে রাজপথে অবস্থান করতে থাকে জনতা। গতকাল সারারাত কোটি জনতা রাজপথেই ছিল। এ অবস্থান পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত চলবে। প্রধানমন্ত্রীর আহবানে আনকারার খিজিলাই স্কয়ারে সমবেত হয় লাখো জনতা।
চার- ক্যুতে পরিকল্পনায় সহযোগীতা ও গুলেনের নিয়োগ করা প্রায় তিনহাজার বিচারক বরখাস্ত করা হয়। যারা সকলে গুলেনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিল। গ্রেপ্তার করা হয় দ্বিতীয় বিচারপতিকে (অাই মিনি প্রধান বিচারপতির পরেই যার স্থান)।
পাঁচ- বিদ্রোহী জেনারেলদেরকে নজরদারীতে আনা ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। সর্বশেষ টিভির ব্রেকিং এ দেখে আসলাম, সামরিক বাহিনীর ৪২ জেনারেলের নাম প্রচার করা হচ্ছে যারা নজরধারীতে আছেন।
ছয়- রাজধানীর অনেক জায়গায় এখনো সিটি কর্পোরেশনের ট্রাক দিয়ে গলিগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। বোমা হামলায় কোথাও কোথাও পানির লাইন, বিদ্যুত লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হযেছে যেগুলো এখনো মেরামত সম্বব হয়নি।
সাত- তার্কিশ লিরার বিপরীতে ডলার ও ইউরোর দাম বেড়েছে। অর্থনীতিতে ক্যুয়ের বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
আট- তুরস্কে দুপুর এখন বারটা আট মিনিট বাজে। মসজিদগুলো থেকে একযুগে বিশেষ আযান ও দোয়া প্রচারিত হচ্ছে। যা শহীদদের স্বরণে করা হচ্ছে। আজ শহীদদের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
নয়- পরশু রাতের বিমান হামলায় সরকারী অনেক ভবনরে ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে সংসদ ভবন, রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থার ভবন ও পুলিশের ভবন অন্যতম। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সংসদ ভবন। সেটা আধূনিক তুরস্কে প্রথমবারের মত ঘটনা।
দশ- এবারের ক্যু সফল হলে বিশাল ক্ষতি হত তুরস্কের এমনকি পুরো মুসলিম বিশ্বের। তুরস্কে গণতন্ত্র হয়তোবা অনেক বছরের জন্য হারিয়ে যেত।ইসলাম হয়তোবা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কিন্তু ক্যু ব্যর্থ হওয়ার অটোমেটিক এক বিপ্লব সংঘঠিত হয়ে গেছে। আর হে, এ বিপ্লব ইসলামের বিপ্লব, "তাকভীর-আল্লাহু আকবর", "ইয়া আল্লাহ, বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবর" এর বিপ্লব। যেটা হয়তো এমনিতে অসম্বব ছিল। মানুষের মুখে মুখে এই তাকভীর ধ্বনি তুর্কিশরা সম্ববত বিগত অনেক বছরে দেখেনী।
আরবাকান ও আরদোয়ান
প্রত্যেক প্রজন্ম পরম্পরার সামনে ইতিহাসের এক একটা ভিন্ন অধ্যায় থাকে। সে অধ্যায়গুলোর নায়কগণও হন ভিন্ন ভিন্ন। আমরা যারা গত শতকের ৮০ এর দশকের শুরুতে কৈশোরে পদার্পণের পর পরই ইসলামী আন্দোলনের দা‘ওআত পেয়েছিলাম তাদের সামনে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসের অধ্যায়গুলো ৯০ দশকের মাঝামাঝি এসে যাঁরা ইসলামী আন্দোলনে শরীক হয়েছে তাদের চেয়ে ভিন্নভাবে প্রতিভাত হয়েছে।
আমি ইসলামী আন্দোলনের দা‘ওয়াত পাই ১৯৮০ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে মাত্র ১১ বছর বয়সে। তার মাত্র এক বছর আগে ইরানে বিপ্লব হয়ে হয়ে গেছে। শত বছরের রাজতান্ত্রিক সরকার যা আমেরিকার পুতুল হিসেবে কাজ করছিল তাকে উৎখাত করে ইসলামী-প্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আর একই বছর আরব-জাতীয়তাবাদী-সমাজতন্ত্রী সাদ্দাম হোসেন ইরানের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। সেই একই বছর আফগানিস্তানে মুহাম্মদ দাঊদ খান ও নূর মহাম্মদ তারাকীদের হাত ধরে কমিউনিস্ট হাফিজ়ুল্লাহ আমীনরা ক্ষমতা দখল করলে তাদের রক্ষা করতে সেনা পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। শুরু হয় আফগান জিহাদ। সে সময়ে আরো আমাদের সামনে যা ছিল তা হল ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার আন্দোলন, কাশ্মীরের স্বাধিকার আন্দোলন, আরাকান, মিন্দানাও, ও দক্ষিণ থাইল্যাণ্ড [পাত্তানী] এর মালয়ী মুসলমানদের স্বাধীনতা আদায়ের সশস্ত্র সংগ্রাম। আমরা স্বপ্ন দেখতাম বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবের, খিলাফত আলা মিনহাজিন-নুবুয়্যত প্রতিষ্ঠার। আর এই স্বপ্নের ক্ষুদ্র একটি অংশ হিসেবে ছিল বাংলাদেশের জমীনের আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা। (তাই খালি খিলাফতের নামে ইসলামী আন্দোলনের কাজ বাংলাদেশে দেখে আমার কাছে অবাকই লেগেছিল। সংবিধানের নিচের কথাগুলো আমাদেরকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিলঃ
===========
আমরা ইসলামী বিপ্লব সাধনের প্রচেষ্টায় তৎপর ছাত্রগণ নিজেদেরকে একটি সংগঠনে সংঘবদ্ধ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে-
একঃ আল্লাহর আনুগত্য এবং রাসূল (রা) এর অনুসরণই আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে। আমরা সকল প্রকার আনুগত্য ও দাসত্ব পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্ব অবলম্বন করব। সর্বপ্রকার মত, পথ ও বিধান ত্যাগ করে একমাত্র রাসূল (স) এর আদর্শ জীবন ও পদাঙ্ক অনুসরণ করব। আমাদের এ আনুগত্য ও অনুসরণ জীবনের কোন একটি বিভাগের জন্য হবে না,বরং জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত হবে।
দুইঃ আমরা আমাদের জীবনকে ইসলামের আলোকে উদ্ভাসিত করে তুলব এবং মানবসমাজকে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূল (সা) এর অনুসরণের দিকে ডাকব। আমাদের সংগ্রাম, সার্বিক প্রচেষ্টা-একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই নিয়োজিত থাকবে, যেন পৃথিবীর বুকে আল্লাহর বাণী সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করে,রাসূল (সা) এর প্রদর্শিত বিধান পৃথিবীর বুকে সঠিক অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানব জাতি ইসলামের ভিত্তিতে তাদের সামগ্রিক জীবন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
এবং তিনঃ বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবের পদক্ষেপ হিসেবে আমরা সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সমস্ত শক্তি ও সামর্থ্য নিয়োজিত করব।
============
জাতীয়তাবাদী বিষবাষ্প মুক্ত নিখাদ কিছু কথা। এজন্য দুনিয়ার দিকে দিকে মুসলমানদের প্রতিটি সংগ্রামকে আমরা একান্তই আমাদের নিজস্ব করে চিন্তা করেছি। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ইসলামী জাগরণের অগ্রদূতদের খবরও আমরা রাখতাম। তুরস্কে মুস্তফা কামাল দীন-ইসলাম এর প্রভাবকে ধুলোয় মিটিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেই তুরস্কের শহরগুলোতে এবং সরকারী অফিস আদালত ও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কারো দ্বারা ইসলামের প্রভাব প্রকাশিত হওয়া ছিল নিতান্তই অকল্পনীয় অপরাধ। কিন্তু সে দুঃসাহসী অপরাধই করে বসেছিলেন ইস্তানবুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র নাজমুদ্দীন আরবাকান। উসমানী আমলের বিচারক [কাজ়ী] মুহাম্মদ সবরীর পুত্র নাজমুদ্দীন ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে নামাজ আদায় করতে শুরু করেন এবং তাঁর দেখাদেখি আরো কিছু তরুণ তাঁর নেতৃত্বে নামাজ় আদায় করতে শুরু করেন। ফলে তিনি হয়ে যান তাদের হোজ্জা [খোয়াজা বা খাজার তুর্কী উচ্চারণ] বা ইমাম/মোল্লা। নাজমুদ্দীন পরে জার্মানীতে মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং এ পি-এইচ, ডি, করেন এবং আরো একটা মাস্টারস ও পি-এইচ,ডি, করেন সউদী আরবের কিং সঊদ ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে। তিনি সে সময় পর্যন্ত তুরস্কের সব চেয়ে কম বয়সে (মাত্র ২৭ বছর) ইস্তাম্বুল টেকলনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে এসোসিয়েট প্রফেসর হন।
১৯৬৯ সালে নাজমুদ্দীন সেক্যুলার জীবন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন। সে বছর তিনি মিল্লী গুরুশ নামক দর্শন প্রকাশ করেন। মিল্লী গুরুশ মানে “জাতীয় দর্শন/দৃষ্টিভঙ্গী”। এখানে মিল্লী/জাতীয় বলতে তিনি তুর্কী জাতীয়তাকে বুঝাননি, বরং ইবরাহীমী মিল্লাতকে বুঝিয়েছেন। আর এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি গড়ে তোলেন “মিল্লী নিজ়াম পার্টি”। এটাকে ব্যান করা হলে তিনি গড়ে তোলেন "মিল্লী সালামত পার্টি"। তিনি "রিপাব্লিকান পিপলস পার্টি" এর বুলন্দ আজেবিদ এর সাথে কোয়ালিশন সরকারেও অংশ নেন। ১৯৭৪ এর সাইপ্রাস সংকটে আরবাকানই তুর্কী সেনা [সাধারপণ তুর্কিরা এদেরকে মুজাহিদীন আখ্যা দেয়, যা সেক্যুলার তুর্কিতে অকল্পনীয় ছিল] পাঠিয়ে গ্রীকদের দাপট থেকে সাইপ্রাসের তুর্কী মুসলমানদের রক্ষা করেন যার ফলে টার্কিশ-সাইপ্রাস আলাদা হয় এবং এখনও আছে। ১৯৮০ এর সামরিক অভ্যুত্থান কোয়ালিশন সরকারকে উৎখাত করে এবং আরবাকান ও তাঁর মিল্লি সালামত পার্টিকে নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯৮৭ সালে তাঁর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে তিনি রেফাহ পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৯৫ এর সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। ফলে তিনি ১৯৯৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের প্রধান হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর স্বল্প সময়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে তিনি তুরস্ককে মুসলিম বিশ্বের কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। তিনি গড়ে তোলেন D-8 (ডেভেলপিং-৮) নামে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৮টি দেশের উন্নয়ন জোট, বাংলাদেশও যার অংশ ছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অবশ্যই মুসলমানদের অগ্রগতিকে ভাল চোখে দেখে না। ফলে আবারও আর্মি অপ্রকাশ্য ক্যু এর মাধ্যমে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। তারপর সাংবিধানিক আদালত সেক্যুলারিজমকে অবদমন করার অভিযোগ এনে তাঁর পার্টি ও তাঁকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করে। তার তত্ত্বাবধানেই আবার গড়ে উঠে ফজ়িলত পার্টি। পরে সাংবিধানিক আদালত ফজ়িলত পার্টিকে নিষিদ্ধ করে তখন এর সদস্যরা ভাগ হয়ে যায় এবং নতুন করে আদালত ওয়া কালকিমনা পার্টি [AK Party] গঠন করা হয় আরদোয়ান ও আব্দুল্লাহ গুলদের নেতৃত্বে এবং সা’আদত পার্টি গঠন করা হয় রেজাই কুতানদের নেতৃত্বে। আরবাকান সা’আদত পার্টির উপদেষ্টা থেকে যান। তিনি ২০১১ সালে ইন্তিকাল করেন।
আরদোয়ানরা মূলত আরবাকানের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। আরদোয়ানরা ময়দানে নেমেই একটা উর্বর জমি পেয়ে যাননি, বরং হোজ্জা যে সংগ্রামী জীবন যাপন করেছেন তা তুরস্কের মুসলমানদের ইসলামী জ়িন্দেগী যাপনের আকংখাকে জাগিয়ে দিয়েছে, আর তারই ধারাবাহিকতায় সাফল্য লাভ করেছেন আরদোয়ানরা। তিনি ছিলেন একাধারে একজন রাজনৈতিক, সমাজ বিজ্ঞানী ও যন্ত্রকৌশল বিজ্ঞানী [মেকানিক্যাল সায়েন্টিস্ট]। জ্ঞান অর্জনকে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি যখন মালয়েশিয়া সফর করছিলেন তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে [IIUM] এসেছিলেন ভাষণ দিতে। মালিক ফয়সল হলে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন - তুর্কি ভাষায়, ইংরেজীতে নয়। তাঁর ভাষণ সাথে সাথে অনুবাদ করা হচ্ছিল। কিন্তু তাঁর বক্তৃতার অধিকাংশ অংশ জুড়ে থাকা “আলিম ও ইলিম” [বিজ্ঞানী ও জ্ঞান] শব্দগুলো অনুবাদ ছাড়াই আমরা বুঝতে পারছিলাম।
এই হচ্ছেন হোজ্জা, আরদোয়ানের চেয়েও তাই আমাদের স্মৃতিতে আরবাকান অনেক বেশি প্রভাবশালী। ২০১১ সালে তিনি যখন মারা যান তখন তিনি মূলত তাঁর দেশের অবিসংবাদিত পিতৃপুরুষে [Virtual Father of His Nation] রূপান্তরিত হন। এজন্যই হয়তো তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর আগে আধুনিক তুরস্কের ২য় প্রেসিডেন্ট (কামাল আতাতুর্কের পর) ইসমত ইনুনো নাজমুদ্দীন আরবাকান সম্পর্কে বলেছেন যে তুরস্ক তাঁর আধুনিক ইতিহাসে একজনই সাহসী সন্তানের জন্য দিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় দাফন করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি ওসিয়্যত করে যান তাঁকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়। তারপরও তাঁর জানাজ়ায় তুরস্কের সব রাজনৈতিক নেতারা অংশগ্রহণ করেছেন। আরদোয়ান ও আব্দুল্লাহ গুল তাঁর লাশের খাটিয়া বহন করেছেন। সুলতান ফাতিহ মসজিদ থেকে গোরস্তান পর্যন্ত যেতে তাঁর জানাজ়ায় অংশগ্রহণকারী মানুষের মিছিল প্রায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ হয়ে যায়। ইসলামের ইতিহাসের একজন সত্যিকার সাহসী মানুষ হচ্ছেন হোজ্জা ডক্টর নাজমুদ্দীন আরবাকান। আর আমাদের সময়ে তিনিই ছিলেন তরুস্কের ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। (আবু-সামীহা সিরাজুল ইসলাম)
আমি ইসলামী আন্দোলনের দা‘ওয়াত পাই ১৯৮০ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে মাত্র ১১ বছর বয়সে। তার মাত্র এক বছর আগে ইরানে বিপ্লব হয়ে হয়ে গেছে। শত বছরের রাজতান্ত্রিক সরকার যা আমেরিকার পুতুল হিসেবে কাজ করছিল তাকে উৎখাত করে ইসলামী-প্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আর একই বছর আরব-জাতীয়তাবাদী-সমাজতন্ত্রী সাদ্দাম হোসেন ইরানের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। সেই একই বছর আফগানিস্তানে মুহাম্মদ দাঊদ খান ও নূর মহাম্মদ তারাকীদের হাত ধরে কমিউনিস্ট হাফিজ়ুল্লাহ আমীনরা ক্ষমতা দখল করলে তাদের রক্ষা করতে সেনা পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। শুরু হয় আফগান জিহাদ। সে সময়ে আরো আমাদের সামনে যা ছিল তা হল ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার আন্দোলন, কাশ্মীরের স্বাধিকার আন্দোলন, আরাকান, মিন্দানাও, ও দক্ষিণ থাইল্যাণ্ড [পাত্তানী] এর মালয়ী মুসলমানদের স্বাধীনতা আদায়ের সশস্ত্র সংগ্রাম। আমরা স্বপ্ন দেখতাম বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবের, খিলাফত আলা মিনহাজিন-নুবুয়্যত প্রতিষ্ঠার। আর এই স্বপ্নের ক্ষুদ্র একটি অংশ হিসেবে ছিল বাংলাদেশের জমীনের আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা। (তাই খালি খিলাফতের নামে ইসলামী আন্দোলনের কাজ বাংলাদেশে দেখে আমার কাছে অবাকই লেগেছিল। সংবিধানের নিচের কথাগুলো আমাদেরকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিলঃ
===========
আমরা ইসলামী বিপ্লব সাধনের প্রচেষ্টায় তৎপর ছাত্রগণ নিজেদেরকে একটি সংগঠনে সংঘবদ্ধ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে-
একঃ আল্লাহর আনুগত্য এবং রাসূল (রা) এর অনুসরণই আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে। আমরা সকল প্রকার আনুগত্য ও দাসত্ব পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্ব অবলম্বন করব। সর্বপ্রকার মত, পথ ও বিধান ত্যাগ করে একমাত্র রাসূল (স) এর আদর্শ জীবন ও পদাঙ্ক অনুসরণ করব। আমাদের এ আনুগত্য ও অনুসরণ জীবনের কোন একটি বিভাগের জন্য হবে না,বরং জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত হবে।
দুইঃ আমরা আমাদের জীবনকে ইসলামের আলোকে উদ্ভাসিত করে তুলব এবং মানবসমাজকে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূল (সা) এর অনুসরণের দিকে ডাকব। আমাদের সংগ্রাম, সার্বিক প্রচেষ্টা-একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই নিয়োজিত থাকবে, যেন পৃথিবীর বুকে আল্লাহর বাণী সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করে,রাসূল (সা) এর প্রদর্শিত বিধান পৃথিবীর বুকে সঠিক অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানব জাতি ইসলামের ভিত্তিতে তাদের সামগ্রিক জীবন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
এবং তিনঃ বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবের পদক্ষেপ হিসেবে আমরা সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সমস্ত শক্তি ও সামর্থ্য নিয়োজিত করব।
============
জাতীয়তাবাদী বিষবাষ্প মুক্ত নিখাদ কিছু কথা। এজন্য দুনিয়ার দিকে দিকে মুসলমানদের প্রতিটি সংগ্রামকে আমরা একান্তই আমাদের নিজস্ব করে চিন্তা করেছি। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ইসলামী জাগরণের অগ্রদূতদের খবরও আমরা রাখতাম। তুরস্কে মুস্তফা কামাল দীন-ইসলাম এর প্রভাবকে ধুলোয় মিটিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেই তুরস্কের শহরগুলোতে এবং সরকারী অফিস আদালত ও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কারো দ্বারা ইসলামের প্রভাব প্রকাশিত হওয়া ছিল নিতান্তই অকল্পনীয় অপরাধ। কিন্তু সে দুঃসাহসী অপরাধই করে বসেছিলেন ইস্তানবুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র নাজমুদ্দীন আরবাকান। উসমানী আমলের বিচারক [কাজ়ী] মুহাম্মদ সবরীর পুত্র নাজমুদ্দীন ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে নামাজ আদায় করতে শুরু করেন এবং তাঁর দেখাদেখি আরো কিছু তরুণ তাঁর নেতৃত্বে নামাজ় আদায় করতে শুরু করেন। ফলে তিনি হয়ে যান তাদের হোজ্জা [খোয়াজা বা খাজার তুর্কী উচ্চারণ] বা ইমাম/মোল্লা। নাজমুদ্দীন পরে জার্মানীতে মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং এ পি-এইচ, ডি, করেন এবং আরো একটা মাস্টারস ও পি-এইচ,ডি, করেন সউদী আরবের কিং সঊদ ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে। তিনি সে সময় পর্যন্ত তুরস্কের সব চেয়ে কম বয়সে (মাত্র ২৭ বছর) ইস্তাম্বুল টেকলনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে এসোসিয়েট প্রফেসর হন।
১৯৬৯ সালে নাজমুদ্দীন সেক্যুলার জীবন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন। সে বছর তিনি মিল্লী গুরুশ নামক দর্শন প্রকাশ করেন। মিল্লী গুরুশ মানে “জাতীয় দর্শন/দৃষ্টিভঙ্গী”। এখানে মিল্লী/জাতীয় বলতে তিনি তুর্কী জাতীয়তাকে বুঝাননি, বরং ইবরাহীমী মিল্লাতকে বুঝিয়েছেন। আর এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি গড়ে তোলেন “মিল্লী নিজ়াম পার্টি”। এটাকে ব্যান করা হলে তিনি গড়ে তোলেন "মিল্লী সালামত পার্টি"। তিনি "রিপাব্লিকান পিপলস পার্টি" এর বুলন্দ আজেবিদ এর সাথে কোয়ালিশন সরকারেও অংশ নেন। ১৯৭৪ এর সাইপ্রাস সংকটে আরবাকানই তুর্কী সেনা [সাধারপণ তুর্কিরা এদেরকে মুজাহিদীন আখ্যা দেয়, যা সেক্যুলার তুর্কিতে অকল্পনীয় ছিল] পাঠিয়ে গ্রীকদের দাপট থেকে সাইপ্রাসের তুর্কী মুসলমানদের রক্ষা করেন যার ফলে টার্কিশ-সাইপ্রাস আলাদা হয় এবং এখনও আছে। ১৯৮০ এর সামরিক অভ্যুত্থান কোয়ালিশন সরকারকে উৎখাত করে এবং আরবাকান ও তাঁর মিল্লি সালামত পার্টিকে নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯৮৭ সালে তাঁর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে তিনি রেফাহ পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৯৫ এর সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। ফলে তিনি ১৯৯৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের প্রধান হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর স্বল্প সময়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে তিনি তুরস্ককে মুসলিম বিশ্বের কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। তিনি গড়ে তোলেন D-8 (ডেভেলপিং-৮) নামে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৮টি দেশের উন্নয়ন জোট, বাংলাদেশও যার অংশ ছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অবশ্যই মুসলমানদের অগ্রগতিকে ভাল চোখে দেখে না। ফলে আবারও আর্মি অপ্রকাশ্য ক্যু এর মাধ্যমে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। তারপর সাংবিধানিক আদালত সেক্যুলারিজমকে অবদমন করার অভিযোগ এনে তাঁর পার্টি ও তাঁকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করে। তার তত্ত্বাবধানেই আবার গড়ে উঠে ফজ়িলত পার্টি। পরে সাংবিধানিক আদালত ফজ়িলত পার্টিকে নিষিদ্ধ করে তখন এর সদস্যরা ভাগ হয়ে যায় এবং নতুন করে আদালত ওয়া কালকিমনা পার্টি [AK Party] গঠন করা হয় আরদোয়ান ও আব্দুল্লাহ গুলদের নেতৃত্বে এবং সা’আদত পার্টি গঠন করা হয় রেজাই কুতানদের নেতৃত্বে। আরবাকান সা’আদত পার্টির উপদেষ্টা থেকে যান। তিনি ২০১১ সালে ইন্তিকাল করেন।
আরদোয়ানরা মূলত আরবাকানের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। আরদোয়ানরা ময়দানে নেমেই একটা উর্বর জমি পেয়ে যাননি, বরং হোজ্জা যে সংগ্রামী জীবন যাপন করেছেন তা তুরস্কের মুসলমানদের ইসলামী জ়িন্দেগী যাপনের আকংখাকে জাগিয়ে দিয়েছে, আর তারই ধারাবাহিকতায় সাফল্য লাভ করেছেন আরদোয়ানরা। তিনি ছিলেন একাধারে একজন রাজনৈতিক, সমাজ বিজ্ঞানী ও যন্ত্রকৌশল বিজ্ঞানী [মেকানিক্যাল সায়েন্টিস্ট]। জ্ঞান অর্জনকে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি যখন মালয়েশিয়া সফর করছিলেন তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে [IIUM] এসেছিলেন ভাষণ দিতে। মালিক ফয়সল হলে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন - তুর্কি ভাষায়, ইংরেজীতে নয়। তাঁর ভাষণ সাথে সাথে অনুবাদ করা হচ্ছিল। কিন্তু তাঁর বক্তৃতার অধিকাংশ অংশ জুড়ে থাকা “আলিম ও ইলিম” [বিজ্ঞানী ও জ্ঞান] শব্দগুলো অনুবাদ ছাড়াই আমরা বুঝতে পারছিলাম।
এই হচ্ছেন হোজ্জা, আরদোয়ানের চেয়েও তাই আমাদের স্মৃতিতে আরবাকান অনেক বেশি প্রভাবশালী। ২০১১ সালে তিনি যখন মারা যান তখন তিনি মূলত তাঁর দেশের অবিসংবাদিত পিতৃপুরুষে [Virtual Father of His Nation] রূপান্তরিত হন। এজন্যই হয়তো তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর আগে আধুনিক তুরস্কের ২য় প্রেসিডেন্ট (কামাল আতাতুর্কের পর) ইসমত ইনুনো নাজমুদ্দীন আরবাকান সম্পর্কে বলেছেন যে তুরস্ক তাঁর আধুনিক ইতিহাসে একজনই সাহসী সন্তানের জন্য দিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় দাফন করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি ওসিয়্যত করে যান তাঁকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়। তারপরও তাঁর জানাজ়ায় তুরস্কের সব রাজনৈতিক নেতারা অংশগ্রহণ করেছেন। আরদোয়ান ও আব্দুল্লাহ গুল তাঁর লাশের খাটিয়া বহন করেছেন। সুলতান ফাতিহ মসজিদ থেকে গোরস্তান পর্যন্ত যেতে তাঁর জানাজ়ায় অংশগ্রহণকারী মানুষের মিছিল প্রায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ হয়ে যায়। ইসলামের ইতিহাসের একজন সত্যিকার সাহসী মানুষ হচ্ছেন হোজ্জা ডক্টর নাজমুদ্দীন আরবাকান। আর আমাদের সময়ে তিনিই ছিলেন তরুস্কের ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। (আবু-সামীহা সিরাজুল ইসলাম)
1 comments:
জাজাখাললাহ