শিক্ষাসংক্রান্ত ধারনা
যেহেতু শিক্ষা মানুষের জন্য অতএব, শিক্ষা বিষয়ে ধারণা পেশ করার পূর্বে মানুষের গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। মানুষ মূলত: দুটি মৌলিক উপাদানে তৈরী। দেহ ও আত্মা (Body and soul)। অতএব এ কারণে মানুষকে দৈহিক, আধ্যাত্বিক এবং বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জীব (Physical, Spiritual and rational being) জীব বলা হয়- যা অপরাপর যে কোন সৃষ্ট জীব থেকে সম্পূর্ণ পৃথক মানুষকে তার আধ্যাত্বিকতা ও নৈতিকতার পরিচয় নিয়ে বাস করতে হলে তাকে তার কিছু মৌলিক প্রয়োজন সম্পর্কে জানতে হবে, অর্জন করতে হবে এবং পালন করতে হবে। তবে সকল মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যে শিক্ষাই হচ্ছে প্রধান প্রয়োজন। মানব জাতির ইতিহাসে এটাই প্রমাণিত সত্য। এজন্যই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মোহাম্মদ (সা:) এর প্রতি অবতীর্ণ কোরআনের প্রথম শব্দটিই ছিল শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়। ঐ সময়ে সারা দুনিয়া বিশেষ করে আরব বিশ্বে বিদ্যমান অসংখ্য ধ্বংসাতœক ও মানবতাবিরোধী সমস্যা বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তায়ালা ৬১০ সালে কোরআন নাজিলের সূত্রপাতই করেন শিক্ষা বা জ্ঞানার্জন সংক্রান্ত বিষয় দিয়ে। এর অর্থ হচ্ছে সীমাহীন সংকটের মূল কারণই ছিল এবং আছে শিক্ষার সমস্যা এবং শিক্ষাই যাবতীয় সংকট দূরীকরণে শুধু মৌলিক ভূমিকাই রাখেনা বরং তা চালিকা শক্তি (Motivating factor) হিসেবেও কাজ করে। বিশ্ব স্বীকৃত ও বিশ্ব নন্দিত এবং অনুসরণীয় যে সুশিক্ষিত এবং সুসভ্য জাতি মহানবীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল আরব বিশ্বকে কেন্দ্র করে তা মূলত: শিক্ষা সমস্যা দূরীকরণের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল- সে শিক্ষা আজও একই ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। অতএব, যোগ্যতাসম্পন্ন দায়িত্ববান এবং জবাবদিহিতামূলক ব্যক্তি, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে শিক্ষার কোনই বিকল্প নেই। আর এ শিক্ষা হতে হবে উপস্থাপিত শিক্ষা ব্যবস্থা। যেহেতু ইসলাম প্রদত্ত শিক্ষাই ব্যক্তি ও জাতি গঠনের একমাত্র পরিচালিকা শক্তি- অতএব, শিক্ষার অর্থ, গুরুত্ব, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং চূড়ান্ত অর্জন সম্পর্কে জানা একান্ত প্রয়োজন।
শিক্ষার গুরুত্ব
জ্ঞান বা শিক্ষার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কিছু জানা, এটি হচ্ছে কোন প্রকার তথ্য, দক্ষতা, বা উপলব্ধি যা চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করা হয়ে থাকে। জ্ঞানের রয়েছে তার নিজস্ব উৎস। এ উৎস বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন ও জাতিতে ভিন্নতর। ইসলাম ছাড়া অপরাপর সকল ধর্ম ও দর্শনে জ্ঞান বা শিক্ষার উৎস হচ্ছে শুধুমাত্র মানবীয় চিন্তা চেতনা, অর্ন্তজ্ঞান (intuition) অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান (empirical experimental knowledge)- এর অর্থ হচ্ছে অভিজ্ঞতালব্ধ না হলে গবেষণালব্ধ না হলে কোন জানা জিনিস বা দক্ষতা জ্ঞান বা শিক্ষা হিসেবে গণ্য হবে। এ প্রত্যয় ইসলামে সমর্থিত নয়। কারণ ইসলামী দর্শনে আল্লাহ তায়ালা, নিজেই জ্ঞানের উৎস- যার উপস্থিতি বিদ্যমান আল কোরআন ও আল হাদিসে। তবে অভিজ্ঞতা এবং গবেষণালব্ধ তথ্যকে ইসলাম বর্জন করেনি বরং এগুলোকে গৌন উৎস (Secondary Source) হিসেবে গ্রহণ করেছে। অতএব, ইসলামী দর্শন বা ইসলামী আইনে আসমানী তথ্য এবং মানবীয় অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্যের সমন্বিত যোগফলই হচ্ছে শিক্ষার উৎস। শিক্ষা মূলত একটি মৌলিক দাবী এবং মৌলিক চাহিদা এর অভাব মূলত: মানবতার প্রধান সমস্যা। পবিত্র কোরআনের যাত্রা শিক্ষাগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ের মাধ্যমে শুরু হওয়াই এর সত্যতা বহন করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে:
“পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন- সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাটবাধা রক্ত থেকে। পড়, তোমার প্রভু বড়ই দয়ালু।। তিনি শিখায়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না এবং তিনি কলমের সাহায্যে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। ” ( আল কোরআন, আল আলাক, ৯৬:১-৫)
অজানা জিনিস যিনি মানুষকে শিখিয়েছেন- তিনি হলেন মানুষের মনিব আল্লাহ তায়ালা। জ্ঞানের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যে যিনি কলম দ্বারা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন তিনিই হচ্ছেন জ্ঞান বা শিক্ষার উৎস। নবীদের তিনি প্রেরণ করেছেন শিক্ষকের ভূমিকায়। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মোহাম্মদ (সা:) বলেছেন, “শিক্ষা অর্জন সকল মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক।” (মুসলিম কিতাব: ইলম)
শিক্ষার উদ্দেশ্য
শিক্ষা অর্জনের বিভিন্নমূখী উদ্দেশ্য রয়েছে। আর এসব হচ্ছে শিক্ষার্থীর প্রয়োজন, চাহিদা ও কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে নিবেদিত। তবে মৌলিকভাবে এবং সাধারণ অর্থে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব হচ্ছে আত্মার পরিশুদ্ধি করে একজন শিক্ষার্থীকে অনুগতশীল ও জবাবদিহীমূলক শিক্ষার্থী গঠন করা। এ উদ্দেশ্যকেই পবিত্র কোরআনের ভাষায় বলা হয়েছে: “আমি মানুষ ও জ্বীনকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার এবাদত করার জন্য।”- (আল কোরআন, আল যারিয়াত ৫১:৫৬), এ প্রসঙ্গে মহানবীর (সা:) নিদের্শনা হচ্ছে: আমাকে পাঠানো হয়েছে যাতে আমি (মানব) চরিত্রকে এর উন্নত শিখরে পৌঁছে দেই।” (সহীহ বোখারী)।
অতএব, মানবজাতি সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যই যেখানে আল্লাহর এবাদত করা অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া বিধানকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও বিভাগে অনুসরণ করা- সেক্ষেত্রে শিক্ষার মূল টার্গেটই হবে আল্লাহর অনুগতশীল মানবমন্ডলী সৃষ্টি করা। আর মহানবীর (সা:) প্রধান কাজ হচ্ছে মানবচরিত্রকে এর উন্নত আসনে পৌছে দেয়া। চরিত্র উন্নয়নের অর্থ হলো মানবাতœাকে পাক-পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে এমন নির্মল করা, যে আতœায় থাকবেনা কালিমার চিহ- যে আতœা তৃপ্তি ও প্রশান্ত লাভ করবে- তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর স্মরণে ও আনুগত্যে। আর এমন পরিশুদ্ধ আত্মাই জন্ম দেবেও অনুশীলন করবে নির্মল, ত্র“টিমুক্ত অপরাধমুক্ত, দুণীর্তিমুক্ত কর্ম আর এমন আত্মার অধিকারীর ললাটেই লিপিবদ্ধ আছে সাফল্য। অনুগত মানব মন্ডলী গঠনের লক্ষ্য মহানবীর (সা:) প্রতি প্রদত্ত কয়টি মৌলিক দায়িত্বের কথা পবিত্র কোরআনের ভাষায় বলা হচ্ছে এভাবে: (ইব্রাহীম (আ:) বললেন)- “হে প্রভূ! এদের মধ্য স্বয়ং এদের জাতি থেকে এমন একজনকে নবী হিসেবে পাঠাও যিনি এদেরকে তোমার আয়াত পাঠ করে শুনাবেন, এদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেবেন এবং এদেরকে পবিত্র-পরিশুদ্ধ করবেন।” (আল-কোরআন, আল বাক্বারাহ: ২:১২৯, ১৫১)। মূলত: কোরআন ও হিকমাতের জ্ঞানসম্পন্ন একজন ব্যক্তিই হবে পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী। আর এ পরিশুদ্ধ (Purified Man)মানুষই হবে সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ন, আমানতদার, ধর্মভীরু, ধৈর্যশীল, সংযমশীল, মিতব্যয়ী, কঠোর পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী, নির্ভরযোগ্য, মধ্যমপন্থী সর্বোপরী জবাবদিহী (answerable) , স্বচ্ছ ও নির্মল-যার উপর ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্ভর করতে পারে। এ জাতীয় শিক্ষার্থী হবে সৎপথে স্বয়ং চালিত- সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা না হয়ে এরা হবে জাতীয় সম্পদ। আর এটাই হচ্ছে ইসলামের মূল লক্ষ্য।
শিক্ষার স্তরবিন্যাস ও ব্যয়ভার
প্রচলিত পদ্ধতি ও কারিকুলামের আলোকে শিক্ষা শুরু হয় ৪-৫ বছর বয়স থেকে এবং বিভিন্ন স্তরে এসে এর সমাপ্তি ঘটে। ইসলামী আইনের বা শরীয়া’র এটা একটা মৌলিক কর্ম। আর এ জন্য ইসলামে ৪-৫ বছর অপেক্ষা নয় বরং গর্ভ ধারণের সময় থেকে, জন্মগ্রহণের পরপরই আজান ও ইকামত দানের মধ্য দিয়ে শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়ে যায়। গর্ভ ধারণের ক্ষেত্রে পিতা- মাতার কর্তব্য, মায়ের স্বাস্থ্য ও চরিত্র রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করে। সুস্থদেহী সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে তা একান্ত উপাদেয়। যেহেতু সুশিক্ষাই মানব জীবনের শুরু ও শেষ- অতএব,্ ইসলাম শিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করে। শিক্ষার্থীর বয়স, মেধা ও পরিবেশ অনুসারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে শিশু, প্রাক প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, উচ্চ শিক্ষা, পরবর্তী উচ্চ শিক্ষা (Post Higher) এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার স্তর বিন্যাস করা যেতে পারে। জনম-মৃত্যু পর্যায় শিক্ষা সম্পর্কে আল্লাহর নবী (সা:) বলেন, “শিক্ষাগ্রহণ কর দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত।” নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্যই শিক্ষা গ্রহণ হবে বাধ্যতামূলক। তবে অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষার দুটো পর্যায় রয়েছে-যার একটি অর্জন সকলের জন্য বাধ্যতামূলক (Individual obligation) এবং সমাজের কতিপয় লোকের জন্য বাধ্যতামূলক (Social obligation) . বাধ্যতামূলক শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত থাকবে ঈমান, ইসলাম, তাওহীদ, রেসালাত, আখেরাত, আখলাক, হারাম-হালাল, কোরআন, সুন্নাহ এবং শান্তিপূর্ণ জীবন পরিচালনার সংক্রান্ত বিষয়াবলী। আর সামাজিক বা দলগত (Social Collective obligation) শিক্ষা হচ্ছে বিশেষায়িত (Specialized education) শিক্ষা। যেমন বিজ্ঞান, মেডিসীন, ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যবসায় প্রশাসন, আইন, হিসাববিজ্ঞান প্রভৃতি। মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও একই স্তর কার্যকর করা যেতে পারে। শিক্ষাব্যয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বাধ্যতামূলক শিক্ষাকে ফ্রি করা যেতে পারে। উচ্চ ও জীবনভর শিক্ষাকেও ফ্রি করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারী বেসরকারী স্কলারশীপ অথবা শিক্ষা অনুদান ও ঋণ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
শিক্ষার্জনের চূড়ান্ত অর্জন (End Result of Education)
চূড়ান্ত ও প্রত্যাশিত অর্জনের বিষয়ে বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনের রয়েছে ভিন্নতা। সেকুলার, স্যোসালইজম, কম্যুনিজম, ক্যাপিটালইজম, জড়বাদ (Matenalism) এর লক্ষ্য হচ্ছে এর স্ব স্ব আদর্শের স্বার্থক অনুসারী তৈরী করা- যে অনুসারীরা হবে জড়বাদী, প্রগতিশীল, ধর্মহীন এবং বাধাধরা নৈতিকতার শৃংখলমুক্ত- তথা মুক্ত চিন্তার অধিকারী। এ ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষার টার্গেট গ্র“প হচ্ছে সকল মানবসমাজ। কেননা ইসলাম হচ্ছে সার্বজনীন মতাদর্শ (Universal Ideology) এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে একজন ভাল আইনমান্যকারী নাগরিক সৃষ্টি করা। ইসলাম প্রদত্ত শিক্ষার মাধ্যমে একজন মুসলিম তার প্রভূ আল্লাহর অর্থবহ আনুগত্য করতে শিখবে এবং অমুসলিমগণ করবে তাদের স্বস্ব দেবতার আনুগত্য। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলেই সক্ষম হবে- তাদের আতœশুদ্ধি অর্জন করতে তাদের স্ব স্ব ধর্ম কর্তৃক প্রদত্ত নিয়ম-নীতির মাধ্যমে। মুসলিমের আতœশুদ্ধি অনুশীলন তাকে নিয়ে যাবে তার প্রভূর আরও সান্নিধ্যে। তেমনি হবে তা অমুসলিমদের জন্য তার দেবতার দিকে। আতœশুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকই পারে অপরাধমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে। তবে অমুসলিমদের কোনভাবেই ইসলাম গ্রহণ বা ইসলামী পদ্ধতিতে আতœশুদ্ধিকরণে বাধ্য করা হবে না।
অতএব, চূড়ান্ত অজর্ন হিসেবে ইসলামের শিক্ষা ও কর্মে যাতে শিক্ষার্থীগণ নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোতে দক্ষতা অর্জন করে এবং আতœস্থ করতে পারে যেমন- প্রতিটি শিক্ষার্থী যাতে পরিচিত হয়-
* তাওহীদী দর্শন অর্থ্যাৎ আল্লাহর একত্ববাদে যেন বিশ্বাস করতে পারে।
* নবুয়্যাতের প্রতি সাধারণভাবে এবং মুহাম্মদ (সা:) এর ব্যাপারে যেন বিশেষভাবে জানতে পারে।
* আল্লাহ প্রদত্ত কিতাবের সাথে বিশেষ করে আল কোরআনের সাথে পরিচিত হতে পারে।
* পরকালের প্রয়োজন, এর অস্তিত্ব ও বাস্তবতা সম্পর্কে পরিচিত হওয়া।
* ইসলামের বাহ্যিক ও ব্যবহারিক দিকের সাথে পরিচিত হওয়া এবং মুসলিমের ক্ষেত্রে একজন প্রাকটিসিং মুসলিম হওয়া।
* যাবতীয় অনৈতিক কর্ম ও সংস্কৃতির মোকাবেলায় ইসলামী আদর্শ ও নৈতিকতা সম্পন্ন সংস্কৃতি চর্চা ও অর্জনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা এবং তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা।
* আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান এবং অর্জিত জ্ঞানের সাথে পরিচিত হওয়া।
* শিক্ষাসহ সকল দর্শনের সর্বশেষ উন্নয়নের অবস্থা সম্পর্কে জানা।
* বিশ্ব পরিস্থিতি এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া।
* ইসলাম ও তুলনামূলক বিষয়ে জ্ঞানের সকল শাখায় সাফল্যজনক বিচরণ করা।
* স্মরণ অতীতকাল থেকে নিয়ে অদ্যাবধি পর্যন্ত চলে আসা জ্ঞানের সকল বিষয় সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা।
* অতীত ও বর্তমান সময়ের উদ্ভূত সকল প্রশ্নের ইসলামিক জবাব দানে সক্ষম হওয়া।
* যাবতীয় কর্মে জবাবদিহিতার মানসিকতা ও যোগ্যতা অর্জন করা ।
* আল্লাহ ভীতি অর্জন করার মত যোগ্যতা সম্পন্ন হওয়া এবং অমুসলিমদের ক্ষেত্রে স্ব-স্ব দেবতা পুজনীয় শিক্ষার্থী হওয়া।
* দোষ, ত্র“টিমুক্ত আত্মার অধিকারী, মধ্যমপন্থী, বিনয়ী ও অনুগত আচরণের অধিকারী হওয়া। এটা এ জন্য যে, নির্মল ও নিষ্কন্টক আতœাই হচ্ছে যাবতীয় সুকর্ম সম্পাদনের মাধ্যম এবং দুষ্কর্ম মুক্ত থাকার উপায়। অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনে প্রয়োজন ত্র“টিমুক্ত আতœা (Spirit/ Soul) আর অনুরূপ আতœা গঠনের কাজই হলো ইসলামের শিক্ষা ব্যবস্থার মূলকাজ।
বাস্তবায়ন পদ্ধতি
যে কোন নীতি বা আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন একটা বৈধকর্তৃত্বশীল সত্ত্বা। আর সরকারই হলো সেই কর্তৃপক্ষ। ইসলামের কিছু সীমিত দিক ব্যক্তি ও ব্যক্তি সমষ্টি কর্তৃক বাস্তবায়ন করা যায় বটে তবে এ বাস্তবায়নের সঠিক ও চূড়ান্ত দায়িত্ব হলো প্রতিষ্ঠিত ও বৈধ সরকারের শিক্ষা বাস্তবায়নের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে শিক্ষানীতি প্রণয়ন, শিক্ষাক্রম (Syllabus / Curricular) তৈরী, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, পরীক্ষা গ্রহণ ও পরীক্ষাপত্র মূল্যায়ন ও ফল প্রকাশ, শিক্ষক-কর্মচারী কর্মকর্তার বেতন ভাতা, পদায়ন, গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, ছাত্র ভর্তি সবকিছুর জন্যই প্রয়োজন সরকারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা। যে কোন সরকারই এজন্য দায়িত্ববান। তবে ইসলামের শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ইসলামী সরকারের।
নির্বাচনী ইশতেহারে ইসলাম বর্জন
যে সরকারের দলীয় ও রাষ্ট্রীয় দর্শনই ইসলামমুক্ত এবং নির্বাচনী ইশতেহারে ইসলাম অনুপস্থিত সে সরকার ইসলামের শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে যাবে কেন? অতএব, খুঁটি নাটি নয় পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে ইসলামে আদর্শে বিশ্বাসী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ইসলামের শিক্ষার কতিপয় মৌলিক বৈশিষ্ট্য
ইসলামের শিক্ষা ব্যবস্থাটাই একটা ভিন্নতর বিষয়। এর প্রতিটি দিকই বিশেষ বৈশিষ্ট্্েযর দাবিদার। এর কয়েকটি হলো:
১.ইসলামের শিক্ষায় ও জ্ঞান ব্যবস্থায় আল্লাহ-তায়ালাই হচ্ছেন শিক্ষাসহ সকল বিষয়ের উদগাতা (Originator).
২.ইসলামের শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত (Revealed source) উৎস এবং মানবীয় গবেষণা লব্ধ উৎসের সমন্বয়ক / সমাহার।
৩.আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন এর প্রধান ও অদ্বিতীয় উৎস (Originator)| কারণ মানবীয় উৎস ও মূলত আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও অনুশীলনের ফল।
৪.জ্ঞান বা শিক্ষা অর্জন একটি মৌলিক ও বাধ্যতামূলক কর্তব্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য।
৫.বাধ্যতামূলক শিক্ষা সরকারী খরচে অবৈতনিক হতে হবে।
৬.শিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে প্রধান মন্ত্রণালয়ের মর্যাদাপ্রাপ্ত থাকবে।
‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ ইসলাম প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক দল বিধায়- এই দল ইসলামের আলোকে প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থাকেই একমাত্র গ্রহণযোগ্য শিক্ষা ব্যবস্থা বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। জামায়াতে ইসলামী গণমানুষকে নিয়ে ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করতে সক্ষম হলে- এর প্রথম এবং প্রধান কাজই হবে ইসলামের দেয়া শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা। যেমনটি করেছিলেন আল্লাহর নির্দেশে মহানবী মুহাম্মদ মোস্তফা (সা:) তার প্রতিষ্ঠিত মদীনাভিত্তিক রাষ্ট্রে।
বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
০১. বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ, গবেষণা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
০২. উক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটান হবে।০৩. সু-শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক গভার্ন্যান্স চালু করা হবে।
রেডিও, টেলিভিশন ও গণমাধ্যম
০১. সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং গণমাধ্যমে সুস্থ ও সৃজনশীল চিন্তার প্রসার ঘটানো হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
০২. রেডিও, টেলিভিশনসহ সকল গণমাধ্যমে জনগণের চিন্তা-চেতনা ও মনুষ্যত্ব বিকাশে সহায়ক নৈতিকতাধর্মী অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে।
০৩. রেডিও টেলিভিশনসহ সরকারী প্রচার মাধ্যমকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া হবে।
০৪. সংসদে আসন অনুযায়ী দলীয় প্রচার নিশ্চিত করা হবে।
অর্থনীতি
০১. বিদেশ নির্ভরতা যথাসাধ্য কমিয়ে দেশীয় ও কৃষিজ কাঁচামাল ভিত্তিক শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটানো এবং অর্থনীতির সকল সেক্টরে স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভরতামুখী নীতি অনুসরণ করা হবে।
০২. সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে শুল্ক ও আয়কর বিভাগের আইনসমূহ সংশোধন করে যুগোপযোগী ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সম্প্রসারণ করা হবে।
০৩. সুদের শোষণ থেকে জনগণকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকসমূহে ঋণের সুদের হার পর্যায়ক্রমে কমানোসহ আমানত ও ঋণের সুদের হারের মধ্যে ব্যবধান হ্রাস করা হবে।
০৪. বেকার যুবকদেরকে কারিগরি প্রশিক্ষণ ও দীর্ঘ মেয়াদী সুদ মুক্ত ঋণদিয়ে ব্যবসা ও শিল্প ক্ষেত্রে উন্নয়নের ধারা ত্বরান্বিত করা হবে।
০৫. দারিদ্র্য সীমা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা হবে।
০৬. দেশের ভূমি, শ্রম, মূলধন, কাঁচামাল ও প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
০৭. বেসরকারী খাতের উন্নয়নের ওপর যথাযথ গুরুত্ব প্রদান, এ সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালাকে আধুনিকীকরণ এবং সরকারী সহযোগিতাকে আরো উদার করা হবে।
০৮. প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থ যথাযথ বিনিয়োগের জন্য সকল প্রকার প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করা হবে। দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য বিশেষভাবে চীন, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান প্রভৃতি প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক রাষ্ট্রসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বাস্তবমুখী অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে।
০৯. দেশের স্বার্থ অক্ষুণ রেখে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির চেষ্টা করা হবে, এ সংক্রান্ত নীতিমালা যুগোপযোগী করা এবং বিনিয়োগ বোর্ডকে শক্তিশালী করা হবে।
১০. দেশের আর্থিক খাতকে গতিশীল ও সুশৃঙ্খল করা হবে এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে।
১১. দেশের সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধীদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা হবে।
১২. সময় ও সরকারী অর্থ অপচয় রোধ এবং উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রকল্প ভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ধারাকে পরিবর্তন করে কর্মসূচী ভিত্তিক ধারা প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সরকারী অর্থে উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প প্রণয়ন না করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারী দপ্তরসমূহকে কর্মসূচী ভিত্তিক অর্থ বরাদ্দ দেয়া হবে।
১৩. প্রদত্ত যাকাত আয়কর মুক্ত করা হবে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ
০১. সংকট কালে জনগণের চাহিদা মিটাতে বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য, জ্বালানি ও সার আমদানি করা হবে। এব্যাপারে সরকারী ক্রয় আইন ও বিধিমালা সংশোধন করা হবে।
০২. বে-সরকারী ডিলারের মাধ্যমে ভর্তুকিমূল্যে চাল বিক্রির জন্য প্রয়োজনানুসারে ওএমএস চালু রাখা হবে।
০৩. টিসিবিকে সম্প্রসারণ অথবা নতুন সরকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে চাল, মুশুর ডাল, সয়াবিন তেল, গুঁড়োদুধসহ ভোগ্যপণ্য ক্রয় ও ভর্তুকিমূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।
০৪. চিনির মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে চিনির উৎপাদন, আমদানি এবং বাজারজাত করণ কার্যক্রম বাংলাদেশ সুগার এন্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের আওতায় আনা হবে।
শিল্প
০১. শিল্পের সম্প্রসারণ, স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং শিল্প পণ্য রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিকল্পিত শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হবে।
০২. তেল, গ্যাসসহ খনিজ সম্পদ বিষয়ে জাতীয় নীতি প্রণয়ন করে দেশীয় উদ্যোগে তেল গ্যাস ও কয়লার অনুসন্ধান ও উত্তোলনকে অগ্রাধিকার এবং বিদেশী উদ্যোগের সাথে চুক্তির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে।
০৩. গার্মেন্টস শিল্প বিকাশে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং এ শিল্প ধ্বংস করার সকল অপচেষ্টা প্রতিহত করা হবে।
০৪. গার্মেন্টসসহ সকল শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী, আর্থিক সুবিধাদি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
০৫. ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় সরকারী সাহায্য প্রদান করা হবে। তাঁত, পাট, চামড়া, চা, চিনি, লবণ শিল্পের সম্প্রসারণ, সংস্কার, উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নেয়া হবে।
০৬. খনিজসম্পদ ও বনজসম্পদকে ব্যবহার করে পেট্রোক্যামিকেল্স ইন্ডাষ্ট্রিজ, সার কারখানা, সিমেন্ট, খাদ্য ও ফলমূল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা হবে।
০৭. শিল্প কারখানায় কম্বাইন্ড বারগেইনিং এজেন্ট (সিবিএ) হিসেবে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যেন অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে না পড়ে এবং নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অবহেলা না করে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
০৮. ঔষধ শিল্পের বিকাশকে উৎসাহিত করা হবে।
বাণিজ্য
০১. দেশীয় শিল্পের বিকাশ, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রপ্তানি বৃদ্ধি অক্ষুণœ রেখে উপযুক্ত আমদানি ও রপ্তানি নীতি ঘোষণা করা হবে যাতে বিভিন্ন দেশের সাথে বিরাজমান বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পায়।
০২. বাণিজ্যনীতিতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও উৎপাদন উপকরণ আমদানির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে।
০৩. অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির বিশেষ উদ্যোগসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিশেষ করে প্রতিবেশী ও মুসলিম বিশ্বের সাথে বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হবে।
০৪. মুসলিম বিশ্বের সাথে বাণিজ্যিক কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
০৫. বিলাসবহুল গাড়ী, প্রসাধনী ও অন্যান্য দ্রব্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হবে এবং এ সব পণ্যের উপর ব্যাপকভাবে করারোপ করা হবে।
০৬. আমদানি নির্ভরতা কমানো ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে আভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা নিরুপণ করে সংশ্লিষ্ট নিত্যব্যবহার্য পণ্য উৎপাদন শিল্প গড়ে তোলা হবে।
০৭. অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমিয়ে এবং মাল্টি ন্যাশনাল পুঁজি ও পণ্যের মোকাবিলায় দেশীয় পুঁজি ও শিল্পকে সার্বিক সহায়তা দান করা হবে।
শ্রম ও শ্রমনীতি
০১. শ্রমিকদের বেতন কাঠামো এবং পুরুষ-নারীর বেতনভাতায় সমতা আনয়ন করা হবে।
০২. ৬৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে শ্রমিকদের অবসর ভাতা দেয়া হবে।
০৩. শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় পেশাগত প্রশিক্ষণ, কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় আহত বা নিহতদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং স্বল্প বেতনভোগী শ্রমিকদের বাসস্থান, চিকিৎসা ও তাদের সন্তান-সন্ততির শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।
০৪. শ্রমিকদের দুর্ঘটনা ভাতা প্রদান করা হবে।
০৫. দেশ থেকে শিশুশ্রম উচ্ছেদ করে তাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন ও সুন্দর পরিবেশের ব্যবস্থা করা হবে।
০৬. গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত মহিলা শ্রমিকদের ব্যক্তিগত, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
০৭. দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের হাত থেকে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা করা হবে।
০৮. মহিলা শ্রমিকদের মাতৃকালীন ছুটি নিশ্চিত করা হবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
০১. দেশের সকল অঞ্চলকে দক্ষ পরিবহন নেটওয়ার্কের আওতায় এনে আন্তঃজেলা, আন্তঃউপজেলা ও আন্তঃ ইউনিয়ন সড়ক যোগাযোগ এবং পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে উন্নতমানের সড়ক, মহাসড়ক, রেলপথ ও সেতু নির্মাণ করা হবে।
০২. পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। পর্যায়ক্রমে মাওয়া ও পাটুরিয়া এ দু’জায়গায়ই সেতু নির্মাণ করা হবে।
০৩. রেলওয়েকে উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
০৪. দেশে নৌ-ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের ব্যবস্থাসহ নৌ-দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
০৫. নদী-বন্দরসমূহের সংস্কার, সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের সাথে সাথে বিরাজমান সংকট দূরীকরণের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
০৬. নগর ও বিভাগীয় শহরসমূহে নারী ও শিশু যাত্রীদের জন্য পৃথক যানবাহন চালু করা হবে।
০৭. চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করে আধুনিক ও বাণিজ্য উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে।
০৮. বাংলাদেশ বিমানকে পুনর্গঠন করা হবে। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরকে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নয়ন করা হবে।
০৯. রাজধানী ঢাকায় পাতাল রেল লাইন ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে।
পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও অন্যান্য শক্তি
দেশের তৈল ও গ্যাস সম্পদ অনুসন্ধান এবং আহরণ প্রচেষ্টা জোরদার করা হবে।
০২. অব্যাহত চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
০৩. গ্রামাঞ্চলে স্বল্পতম সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
০৪. জ্বালানী ও বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলার লক্ষ্যে বন্ধু প্রতীম দেশের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদী অসামরিক পারমাণবিক চুক্তি সম্পাদন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হবে।
০৫. পানি সম্পদের সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেয়া হবে।
০৬. প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল এবং কয়লার সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত আহরণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।
০৭. জাতীয় স্বার্থে বাস্তবসম্মত কয়লানীতি প্রণয়ন করা হবে।
০৮. বিদ্যুতের চাহিদা গ্যাসের পরিবর্তে কয়লা দ্বারা পূরণ করা হবে যেন ইউরিয়া সারের কাঁচামাল হিসেবে গ্যাসের ঘাটতি দেখা না দেয়।
০৯. সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎসহ বিকল্প জ্বালানী উদ্ভাবনের জন্য ব্যক্তিগত/গ্রুপ ভিত্তিক/রাষ্ট্রীয় গবেষণাকে উৎসাহিত করা হবে।
১০. ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করেই জ্বালানী শক্তির ব্যবহার ও রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
সমাজ ও ধর্মীয় জীবন
০১. ইসলামী আকীদা বিশ্বাস, হুকুম-আহকাম ও নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ইসলামী মৌলিক শিক্ষার ব্যবস্থা ও সালাত কায়েম করার যথাসাধ্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
০২. বই, পত্র-পত্রিকা, ইলেকট্রোনিক মিডিয়াতে ধর্মবিরোধী প্রচারণা ও কটূক্তিকারীদের প্রতিরোধ ও শাস্তি বিধানের জন্যে ব্লাসফেমী জাতীয় আইন প্রণয়ন করা হবে।
০৩. সকল ধর্মের লোকদের জন্যে পূর্ণ ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
০৪. মসজিদ-মন্দির-গীর্জা ভিত্তিক শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ উন্নয়নে বাস্তবমুখী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
০৫. রেডিও, টিভি, সংবাদপত্রসহ সকল প্রচার মাধ্যমে ইসলামী আদর্শ প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
০৬. দেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নাগরিকগণ যাতে নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে অনুসরণ এবং পালন করতে পারে তার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
০৭. মদ, জুয়া ও যাবতীয় অসামাজিক কাজ ও পাপাচার প্রভৃতি বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হবে।
০৮. মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিনদের সম্মানী ভাতা দেয়া হবে। অন্যান্য ধর্মের একই মর্যাদার ব্যক্তিগণকেও সম্মানী ভাতা দেয়া হবে।
ইসলামের গবেষণা ও প্রচার
০১. ইসলামের উপর গবেষণা, প্রকাশনা ও প্রচার কল্পে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে।
০২. ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে অধিকতর শক্তিশালীকরণ ও এর আওতায় ইসলামি মিশনের কার্যক্রম জোরদার করা হবে।
০৩. বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিবসহ অন্যান ইমামগণের মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধাদি বৃদ্ধি করা হবে।
০৪. মসজিদ ভিত্তিক সামাজিক কার্যক্রম ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামকে সমাজে সঠিকভাবে উপস্থাপনের জন্য ইমামগণকে প্রশিক্ষিত করা হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণ
০১. পরিবেশ দূষণ রোধ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও উন্নয়নে বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ জীব-বৈচিত্র সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
০২. বন-নিধন কঠোর হস্তে দমন করা হবে এবং পরিকল্পিত নতুন বনায়নে উৎসাহ ও সরকারী আনুকূল্য দেয়া হবে।
০৩. অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দরিদ্র বেকার যুবকদের সম্পৃক্ত করে চলমান সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম জোরদার করা হবে।
০৪. পাহাড়-পর্বত সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। অপরিকল্পিত ও স্বার্থন্বেষী মহলের পাহাড় কাটা বন্ধ করা হবে।
মানব সম্পদ উন্নয়ন ও রপ্তানি এবং কর্মসংস্থান
০১. মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে যুগপৎ নৈতিক ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ব্যাপকতর করা হবে।
০২. প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টিসহ অশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত কর্মক্ষম যুবসমাজের জন্য প্রযুক্তি নির্ভর, কর্মমুখী ও কারিগরি প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সহজশর্তে ব্যাংক ঋণ ও নানাভাবে অর্থায়নসহ সকল প্রকার সহযোগিতা প্রদান করা হবে।
০৩. উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিভিন্ন ট্রেড ও ভোকেশনাল কোর্স চালু করা হবে।
০৪. দক্ষ, আধা দক্ষ ও অদক্ষ লোকদের জন্য বিদেশে ব্যাপক কাজের সুযোগ সৃষ্টি এবং বিদেশে লোক প্রেরণে সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করা হবে।
০৫. প্রতিবন্ধীদেরকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হবে। আত্ম নির্ভরশীলতা অর্জনে ব্যাপক ক্ষুদ্রঋণ সহযোগিতা দেয়া হবে।
০৬. তথ্য প্রযুক্তিকে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের হাতিয়ার হিসেবে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হবে।
০৭. ব্যাংকগুলোকে তাদের বিনিয়োগের একটা অংশ আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করা হবে।
০৮. পর্যটন শিল্পকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিকশিত করা হবে। পর্যটক হিসেবে দেশের জনগণকে আকৃষ্ট করার মত পদক্ষেপ নেয়া হবে। পর্যটন শিল্পে ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বকীয়তা ফুটিয়ে তোলা হবে।
০৯. জেলখানার নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাকে আরও গুরুত্ব দেয়া হবে।
দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা
০১. শিল্প-বাণিজ্য, কৃষি, ব্যাংক ঋণ ইত্যাদির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনমূলক উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সামাজিক নিরাপত্তা ও উন্নয়নের একটা কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে যাকাত ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো হবে।
০২. প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠিকে কাজের আওতায় আনা হবে।
০৩. নারীর ওপর নির্ভরশীল অতিদরিদ্র পরিবারের জন্য বিশেষ আর্থিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
০৪. উত্তর বঙ্গের মঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান কল্পে মঙ্গাপ্রবণ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল লোকদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ এলাকায় কৃষি বহুমুখীকরণ এবং নিশ্চিত বেতনভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার (guaranteed wage employment)ব্যবস্থা নেয়া হবে।
০৫. বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং বিধবা ভাতা কার্যক্রম আরও সম্প্রসারণ করা হবে।
স্থানীয় সরকার ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ এবং পল্লী উন্নয়ন
০১. সরকারের বর্তমান কাঠামো, বিশেষ করে রাজধানী কেন্দ্রীক শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন করে প্রশাসনকে ব্যাপকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে।
০২. সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী শক্তিশালী স্থানীয় সরকার হিসেবে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করা হবে।
০৩. উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা স্থানীয় সরকার পরিষদের ওপর ন্যাস্ত করা হবে।
০৪. গ্রামের জনগণের কথা বিবেচনা করে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন সাধন, জনগণের শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, চিত্তবিনোদন এবং বেকার ও অর্ধবেকার যুবশক্তিকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের আওতায় আনা হবে এবং সরকারী আনুকূল্যে পল্লী গৃহনির্মাণ প্রকল্প চালু ও সুদবিহীন গৃহনির্মাণ-ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।
০৫. পল্লী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে জোরদার ও সমৃদ্ধ করা হবে।
0 comments: