কেউ জানে কেউ জানে না জাসদ গণবাহিনীসহ বামপন্থীরা আওয়ামী লীগের ১০ এমপিসহ বহু নেতাকর্মীকে হত্যা করে
বর্তমান মহাজোট সরকারের শরীক দল জাসদের অঙ্গ সংগঠন গণবাহিনীসহ সশস্ত্র বামপন্থীরা ১৯৭২-৭৫ সালে আওয়ামী লীগের ১০ জন এমপিকে হত্যা করে। এ সময় এরাসহ আরো বহু নেতাকর্মীকে হত্যা করে গণবাহিনীর সদস্যরা। এই গণবাহিনীর অন্যতম তাত্ত্বিক ও কর্ণধার ছিলেন সিরাজুল আলম খান, কর্নেল (অব) তাহের, মোহাম্মদ সাজাহান, ড. আনোয়ার হোসেন (বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি) এবং বর্তমান তথ্যমন্ত্রী জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু।
রক্ষীবাহিনীর তৎকালীন সহকারী পরিচালক এবং এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম আনোয়ার উল আলম তাঁর ‘রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ নামক গ্রন্থে আওয়ামী এমপিদের এই হত্যাকা-ের বিবরণ প্রদান করেছেন। সে সময় রক্ষীবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন মেজর এএনএম নুরুজ্জামান এবং দু’জন সহকারী পরিচালক আনোয়ার উল আলম ও সারোয়ার হোসেন। এর মধ্যে আনোয়ার উল আলম এবছর তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ প্রকাশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘এসব হত্যাকা-ের পেছনে সমাজের দুষ্কৃতকারী, চরম বামপন্থী, নকশাল বাহিনী, সর্বহারা ও জাসদের গণবাহিনীর হাত ছিল।’
আনোয়ার উল আলম তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পুনর্গঠনের কাজ অব্যাহত রাখা সরকারের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। দেশে শুরু হয় নানামুখী অরাজকতা। চীনপন্থী বাম উগ্রপন্থী, নকশাল বাহিনী, সর্বহারারা রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা, পুলিশের থানা ও ফাঁড়ি লুট এবং হাটবাজারে হামলা করে জনমনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে থাকে। জনগণের নির্বাচিত স্থানীয় নেতারা ছাড়াও অনেক নির্বাচিত সাংসদ তাদের হাতে নিহত হন। ১৯৭২ সালের ৬ জুন সংসদ সদস্য আবদুল গফুর নিহত হন। তাঁর সঙ্গে ছিল কামাল ও রিয়াজ নামের দুজন। তারাও নিহত হয়। আবদুল গফুর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে খুলনা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি নিহত হন সংসদ সদস্য সওগাতুল আলম সগির। তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে মঠবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৩ মে সংসদ সদস্য নুরুল হক নিহত হন। তিনি ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে নড়িয়া থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১০ জানুয়ারি নিহত হন সংসদ সদস্য মোতাহার উদ্দিন আহমদ। তিনি ১৯৭০ সালে ভোলা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সংসদ সদস্য গাজী ফজলুর রহমান নিহত হন ১৯৭৪ সালের ১৬ মার্চ। তিনি ছিলেন নরসিংদীর মনোহরদী এলাকা থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। ১ আগস্ট ১৯৭৪ সংসদ সদস্য এডভোকেট ইমান আলী নিহত হন। তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭৪ কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ঈদের নামায পড়ার সময় নিহত হন সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া। তিনি ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংসদ সদস্য আবুল খালেক নিহত হন। তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন নেত্রকোনা থেকে। এছাড়া সংসদ সদস্য আবদুল মুকিম, আমিন উদ্দিনসহ (ফরিদপুর) আওয়ামী লীগের আরও অনেক নেতাকর্মী বিভিন্ন সময়ে নিহত হন। এসব হত্যাকা-ের পেছনে সমাজের দুষ্কৃতকারী, চরম বামপন্থী, নকশাল বাহিনী, সর্বহারা ও জাসদের গণবাহিনীর হাত ছিল।’
কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে আনোয়ার উল আলম জানান, ‘১৯৭২ সালে ২৯ জন, ১৯৭৩ সালে ৭৭ জন, ১৯৭৪ সালে ৫২ জন এবং ১৯৭৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ৪৪ জন প্রতিনিধি, ছাত্রনেতা, শ্রমিকনেতা, মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সদস্যকে হত্যা করা হয়। এছাড়া দেশে অনেক অরাজনৈতিক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। ১৯৭৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলীর তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৭৩ সালেই দেশে ১ হাজার ৮৯৬টি হত্যাকা- ঘটেছিল। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা দেশে ৫৪টি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি লুট করে বহু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবরুদ নিয়ে যায়। পুলিশের পক্ষে থানা ও ফাঁড়ি রক্ষা করাই তখন অসম্ভব ছিল, জনগণের জানমাল তারা কীভাবে রক্ষা করবে। ১৯৭৩ সালের ২০ আগস্ট বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজংয়ে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর প্রায় তিন ঘন্টা গুলী বিনিময় হয়। দুর্বৃত্তরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। আহত অবস্থায় কয়েকজন ধরা পড়ে। ২ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জের আরিচায় ফেরিতে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়। বেশির ভাগ থানায় ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য ২৪ সেপ্টেম্বর ১৫০টি থানায় জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। ৩ অক্টোবর পাবনার শাহজাদপুরে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর গুলী বিনিময় হয়। এ সংঘর্ষে নিহত হয় ৮ জন।’
জাসদের তত্ত্ব-গুরু কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা মে. জে. খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দারকে হত্যারও অভিযোগ করা হয় একটি ওয়েবসাইটে। উল্লেখ্য, কর্নেল তাহের ১৯৭৪ সালের জুন মাসে গোপন ও সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’ গঠন করেন- যা আজো দেশের কোন কোন এলাকায় ‘জাসদের গণবাহিনী’ নামে সক্রিয় রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান চৌধুরী তার ‘রাজনীতির তিনকাল’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ১৯৭৪ সালের মার্চে জাসদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেলে গোপন অবস্থায় থেকে এরা গঠন করে ‘গণবাহিনী’ নামের সশস্ত্র সংগঠন। জাসদের নেতৃস্থানীয় অধিকাংশই ছিলেন সাবেক মুজিব বাহিনীর সদস্য। যাদের অনেকেই স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এসে অস্ত্র জমা না দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল সময়ের অপেক্ষায়। গণবাহিনী গঠনের পর তাদের সেই সময় এসে যায়। ফলে সশস্ত্র তৎপরতা চালাতে তাদের আর অস্ত্রের অভাব হয়নি।’ (পৃঃ ১৪৯)। বিশিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ ২.০৬.২০১৩ তারিখের ‘প্রথম আলো’তে লেখেন, ‘জাসদ এ দেশে বুঝে হোক কিংবা না বুঝে, সোভিয়েত বিপ্লবের আদলে সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিল। পুরো প্রক্রিয়াটির তত্ত্বাবধানে ছিলেন সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় পর্ষদ। জাসদের সামরিক শাখা ছিল বিপ্লবী গণবাহিনী। …এর প্রধান ছিলেন শ্রমিকনেতা মোহাম্মদ সাজাহান। তিনি ছিলেন ‘রাজনৈতিক কমিশনার’। গণবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন লে. ক. আবু তাহের, আর সহকারী অধিনায়ক ছিলেন হাসানুল হক ইনু। পুরো বাহিনীটি ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে। ঢাকা নগর গণবাহিনীর ‘রাজনৈতিক কমিশনার’ ছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক আর বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন আনোয়ার হোসেন (তাহেরের অনুজ ও বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি)।’ মহিউদ্দিন আহমদ আরো জানান, ‘২৬ নভেম্বর ঢাকা নগর গণবাহিনীর প্রধান আনোয়ার হোসেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের একটা মিশন চালানো হয় গণবাহিনীর ছয়জন তরুণকে দিয়ে। তাদের সবার বয়স ১৮ থেকে ২২। চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন, দুজন আহত অবস্থায় ধরা পড়েন।’
আনোয়ারুল আলম, মিজানুর রহমান চৌধুরী ও মহিউদ্দীন আহমদের এই বর্ণনা থেকে বাংলাদেশে স্বাধীনতাপরবর্তী হত্যা, সন্ত্রাস ও অরাজক পরিস্থিতির যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, এসব কর্মকা-ে জাসদের গণবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হত্যা করার পেছনে এদের বড় অবদান ছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে, এসব হত্যাকান্ডের কোন বিচার হয়নি, আওয়ামী লীগ এর কোন বিচারও দাবি করেনি। বরং জাসদ এখন আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত শরীক।
0 comments: