৬৫ সালের যুদ্ধ ও বাংলাদেশের জন্য এর তাৎপর্য

এখন সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। ৩৮ বছর আগে ঠিক এই সময়ে আমাদের দেশ একটা যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত, বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চল ১৭ দিনের সর্বাত্মক সে লড়াইয়ে তেমন ক্ষতির শিকার হয়নি। গত চার দশকে সে যুদ্ধটি নিয়ে কোনো আলোচনা হতে দেখা যায়নি। তাই নবীন প্রজন্মের মনে প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক : এখানে কোন যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে? বলছিলাম ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সূচিত পাক-ভারত যুদ্ধের কথা।



ভূমি, সমুদ্র ও আকাশ সর্বত্রই প্রচণ্ড হামলা-পাল্টাহামলা যুদ্ধটিকে সর্বাত্মক রূপ দিয়েছিল। ইস্যুটি জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদেও উঠেছিল। পাকিস্তান ও ভারতের Apple of Discord বা শত্রুতার মূল কারণ যে কাশ্মির, ’৬৫-এর যুদ্ধ মূলত তাকে কেন্দ্র করেই। যা হোক, আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতায় ১৭ দিন পর যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়েছিল। ওই যুদ্ধ নিছক আঞ্চলিক সঙ্ঘাতই ছিল না। এই যুদ্ধ সোভিয়েত রাশিয়া, আমেরিকা, চীনের মতো বৃহৎ শক্তির দৃষ্টি ও মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল পুরোপুরি। সর্বোপরি, সাবেক পাকিস্তানের দুই অংশেই সে যুদ্ধের রাজনৈতিক প্রভাব পড়েছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে।

বিভিন্ন সেক্টরে দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে কমান্ড করে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের, এম এ জলিল প্রমুখের নাম আসে প্রথমেই। এদের মধ্যে প্রথম তিনজনই স্বাধীনতার পর ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় নাম। তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন দেশ ও জাতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শুধু সেক্টর কমান্ডার নয়, অধিনায়ক ছিলেন ‘জেড’ ফোর্সের। ’৬৫ সালের যুদ্ধে তিনি পাঞ্জাবের খেমকারান সেক্টরে সাহসের পরিচয় দিয়ে Gallantry Award অর্জন করেছিলেন। তার ব্যাটালিয়ন ছিল বাঙালিদের নিয়ে গঠিত প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্ত। জিয়া সে যুদ্ধে একটি কোম্পানির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাদের ব্যাটালিয়ন ’৬৫ সালের যুদ্ধে বীরত্বের জন্য সর্বাধিক পদকে ভূষিত হয়েছিল বলে জানা যায়।

মুক্তিযুদ্ধে ‘কে’ ফোর্সের অধিনায়ক (পরে ব্রিগেডিয়ার) খালেদ মোশাররফ ’৬৫-এর যুদ্ধের সময় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অ্যাডজুন্ট্যান্ট অফিসার ছিলেন। সেপ্টেম্বরের যুদ্ধকালে তিনি রংপুর, লালমনিরহাট এবং সীমান্তবর্তী মোগলহাট ও হিলিতে অবস্থান করছিলেন। এসব স্থানের কোনো কোনোটিতে তখন ভারত প্রতীকী হামলা চালিয়েছিল। ’৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলির কারণে বহুলালোচিত কর্নেল আবু তাহের মুক্তিযুদ্ধে একটি পা হারিয়েছিলেন। বামপন্থী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ আবু তাহের ১৯৬৫ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপে যোগ দেন। এটা ছিল দুর্ধর্ষ কমান্ডোদের বাহিনী।

 সেপ্টেম্বরের যুদ্ধে আবু তাহের প্রথমে কাশ্মির এবং পরে পাঞ্জাবের শিয়ালকোট রণাঙ্গনে অংশগ্রহণ করেন। এসব এলাকায় ভয়াবহ যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল। অনেকেই জানেন না, কর্নেল তাহের মুক্তিযুদ্ধে যেমন মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন, তেমনি ’৬৫-এর যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করতে গিয়ে আহত হন এবং বীরত্বের জন্য অর্জন করেন খেতাব। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী মেজর এম এ জলিল। তিনি স্বাধীন দেশে গঠিত প্রথম বিরোধী দল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তিনি ছিলেন শত্রুবাহিনীর ত্রাস। তবুও রাজনৈতিক কারণে তাকে আওয়ামী লীগ সরকার খেতাব থেকে বঞ্চিত করেছিল নির্লজ্জভাবে। সেই মেজর জলিল ’৬৫ সালের যুদ্ধে বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। এরপরই পদোন্নতি পেয়ে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন।

প্রখ্যাত সাংবাদিক-কলামিস্ট মঈনুল আলম বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক-এর স্বর্ণযুগে এর চট্টগ্রাম প্রতিনিধি ছিলেন একনাগাড়ে তিন দশকেরও বেশি। তার স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘কলমের সৈনিক’-এ তিনি লিখেছেন, ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের তাৎক্ষণিক ফলাফল যা-ই হোক, আমাদের জন্য অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এর ফলাফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। সেপ্টেম্বর যুদ্ধে রাতের অন্ধকারে ভারতই যে, প্রথম পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে আগ্রাসন করে, সে সম্পর্কে সন্দেহ নেই। ...প্রশ্ন আসে, ভারত এভাবে আগ্রাসন করার দুঃসাহস পেল কোথা থেকে?’ এ বিষয়ে বহুদর্শী সাংবাদিক মঈনুল আলম বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, যার সারকথা হলো, ‘ভারত এ দুঃসাহস পেয়েছিল প্রধানত পাকিস্তানের এককালের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক শীতলতম পর্যায়ে নেমে যাওয়া থেকে।’ জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র এর আগেই পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র ও সমরোপকরণ সরবরাহ করা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। অপর দিকে ’৬২ সালের যুদ্ধে চীনের হাতে বেদম মার খেয়ে ভারত মর্যাদা হারিয়ে গ্লানিতে ভুগছিল। শত্রুর বিরুদ্ধে ‘বিজয়’ দেখিয়ে হৃত সম্মান আবার অর্জন তার জন্য জরুরি ছিল।

ভারত-চীন যুদ্ধের আগে ভারত অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছিল পাশ্চাত্য থেকে। আর সে যুদ্ধের পরে রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্রসহ যুদ্ধের উপকরণ সংগ্রহে ভারত মেতে ওঠে। প্রসঙ্গক্রমে মঈনুল আলম লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের উপদেষ্টারা এদের অধিকাংশই সম্ভবত কোনো অদৃশ্য শক্তির অঙ্গুলি হেলনে চলছিল আইয়ুবকে ভারত-অধিকৃত কাশ্মিরে আগ্রাসন করতে প্ররোচিত করে ভারতকে সেই কাক্সিত যুদ্ধের সুযোগ এনে দিয়েছিল। কাশ্মির সীমান্তে পাকিস্তানকে যখন ঠেকানো গেল না এবং পাকিস্তান কাশ্মিরের মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে একটি অঞ্চলকে কাট অফ করে ফেলার মতো অবস্থা করেছে, তখন পাকিস্তানের কঠিন মুঠি আলগা করার জন্য ভারত রাতের অন্ধকারে আকস্মিকভাবে লাহোর সীমান্তে পাকিস্তানকে আক্রমণ করে রাতেই লাহোর নগরী দখলের প্রয়াস পায়। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের ‘ড্যাম কেয়ার’ মনোভাবের সাথে চীনের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা ইঙ্গ-মার্কিন মহলকে ুব্ধ করেছিল তার আগেই। তাই তারা চেয়েছিল, পাকিস্তানকে একটা ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া হোক; কিন্তু ভারত আয়তন, লোকসংখ্যা, সমরশক্তি সব দিকেই প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশ কয়েকগুণ শক্তিশালী হলেও যুদ্ধে তাকে বিপুল ক্ষতি স্বীকার করতে হলো। অন্য দিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতা এবং পূর্ব পাকিস্তানের অসহায়ত্ব (এর প্রতি বৈষম্যের ফল) ফুটে উঠেছিল। ’৬৫ সালের যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভবিষ্যতের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। যেমন (১) এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা অভাবনীয় বীরত্ব ও শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করেছিলেন। বাঙালিরা Martial Race বা যোদ্ধা জাতি নয়, এ কথা সে দিন মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। ইতিহাসের গতি এমনই বিচিত্র যে, ’৬৫ সালে যে বাঙালিরা পাকিস্তানের পক্ষে লড়েছেন জান বাজি রেখে, মাত্র ছয় বছর পরই তারা সে পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অবশ্য, ’৬৫-এর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল।

তখন সবচেয়ে ভয়াবহ লড়াই হয়েছিল লাহোর সীমান্তে। এ প্রসঙ্গে একজন লেখক বলেছেন, “তখন সশস্ত্র বাহিনীর যে ইউনিটগুলো মরিয়া হয়ে ভারতীয় আগ্রাসনকে ঠেকাতে গিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিল, তাতে আমরা বহু বাঙালি সৈনিককে দেখতে পাই। সেই সংগ্রামে বাঙালিরা সর্বপ্রথম তাদের ‘ভেতো বাঙালি’ অপবাদ ঘুচায় এবং অতুলনীয় শৌর্য ও আত্মত্যাগের নজির স্থাপন করে।” ২. পঁয়ষট্টির যুদ্ধ বাস্তবে তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিম ফ্রন্টেই সীমাবদ্ধ ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা, চট্টগ্রাম, লালমনিরহাট, সৈয়দপুরসহ কয়েকটি স্থানের বিমানবন্দরে ও ঘাঁটিতে ভারতীয় হামলার কথা প্রচার করা হলেও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়নি। তবে এ অবস্থায় পাকিস্তানের পূর্বাংশে প্রতিরক্ষার বিরাট দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানুষ ভাবছিল, ভারত যদি সর্বাত্মক হামলা চালাত, তা হলে পূর্ব রণাঙ্গনে কী পরিস্থিতি দাঁড়াত। এই প্রেক্ষাপটে ’৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম থেকেই পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তাহীনতা এবং প্রতিরক্ষাগত দুর্বলতার দিক তুলে ধরা হয়। আওয়ামী লীগের এ প্রচারণা জনমনে প্রভাব ফেলেছিল। ৩. ভারত তার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তখন পুরোদস্তুর হামলা করেনি। ‘টোকেন’ হামলার মাধ্যমে সে দেখাতে চেয়েছিল, ইচ্ছা করলে এ অঞ্চলে পাকিস্তানের ব্যাপক ক্ষতি করা যায়; কিন্তু নয়াদিল্লি তার কৌশলগত কারণে পূর্ব পাকিস্তানকে টার্গেট করেনি। তাদের শত্রুতা আসলে পাকিস্তানের কেন্দ্র ও পশ্চিমাঞ্চলের সাথে এমন একটি ইঙ্গিত ছিল। তাই লাহোরে প্রচণ্ড মার খেয়েও ভারত ঢাকার ওপর প্রতিশোধ নেয়নি। এ যুদ্ধের পর ভারত আমাদের এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য গোয়েন্দা নেটওয়ার্কসহ নানাভাবে তৎপর হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক-কলামিস্ট হামিদ মীর সম্প্রতি দৈনিক জং পত্রিকায় লিখেছেন জম্মু ও কাশ্মিরের মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংগ্রাম এবং তাদের ওপর নির্যাতন প্রসঙ্গে। তিনি লিখেছেন, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ ব্যর্থ হওয়ার ক্ষোভ জম্মুর মুসলমানদের ওপর পতিত হয়। হামিদ মীরের মতে, পরে কারগিল অপারেশনের মতো ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ও কাশ্মিরিদের স্বাধিকার আন্দোলন দুর্বল করে দিয়েছিল।

কাশ্মিরি জনগণের দুর্ভাগ্য, এক দিকে ভারত ছলনা ও প্রতারণার মাধ্যমে কাশ্মিরকে কুক্ষিগত করে নিয়েছে, অন্য দিকে পাকিস্তান এর মোকাবেলায় অকার্যকর, লোকদেখানো কিংবা হঠকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক কর্তাব্যক্তিদের প্রভাবিত শাসকগোষ্ঠী কাশ্মির ইস্যুকে যতটা ব্যবহার করেছে, ততটা ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেয়নি সুরাহার জন্য। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের মূল কারণ কাশ্মির ইস্যু। উত্তরে কাশ্মির আর দক্ষিণে রান অব কচ্ছের (ভারতের গুজরাট প্রদেশে) সীমান্তে কিছু দিন ধরে হামলা, সংঘর্ষ, দখল, হতাহতের ঘটনা ঘটছিল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। এভাবে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার চরমপর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায় ৬ সেপ্টেম্বর। তখন পাকিস্তান সরকারের অভিযোগ ছিল, ভারতই আগে হামলা চালিয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবেই ভারত দেখাতে চেয়েছে যে, যুদ্ধের জন্য পাকিস্তান দায়ী। যুদ্ধের কারণ যা-ই হোক কিংবা যে-ই এটি শুরু করুক না কেন, ১৭ দিনের যুদ্ধ দুই দেশেরই বিরাট ক্ষতি করেছিল। শুধু সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র, সামরিক যান ও স্থাপনার ক্ষতিই নয়, বেসামরিক বহু নারী-পুরুষ-শিশু হতাহত হয়েছেন এ যুদ্ধে। বাড়িঘর, ভবন ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতিও ছিল ব্যাপক। সত্যিকার অর্থে জয়ী বা পরাজিত হয়নি কোনো পক্ষ। দুই দেশেই একে অপরের অনেক ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছিল। আয়তন, সৈন্যসংখ্যা, সমরাস্ত্র প্রভৃতির দিক দিয়ে ভারতের তুলনায় পাকিস্তান অনেক ক্ষুদ্র বা দুর্বল।

সেই বিবেচনায় তুলনামূলকভাবে ক্ষতি বেশি হয়েছিল ভারতের। এ কারণে ভারতের ‘আন্তর্জাতিক বড়ভাই’ সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধের অবসান ও সমঝোতায় ছিল সবিশেষ আগ্রহী। আর পাকিস্তানও সেই যুদ্ধের বিরাট ধকল কাটাতে শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে একই দেশ ভেঙে দু’টি দেশ ভারত ও পাকিস্তান জন্ম নিয়েছিল। এর কিছু দিন পরই কাশ্মির নিয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রথম লড়াই বাধে। সেই যুদ্ধের চেয়ে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ ছিল অনেক ব্যাপক, তীব্র ও ভয়াবহ। ১৯৪৭-৪৮ সালের যুদ্ধটি পশ্চিম পাকিস্তানের শুধু উত্তর-পূর্বাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং কেবল স্থলবাহিনী এতে সম্পৃক্ত ছিল। অন্য দিকে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ ছিল পুরো সীমান্তজুড়ে এবং উভয় রাষ্ট্রের স্থল, বিমান ও নৌ তিন বাহিনীই এতে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের মতো স্মরণীয় হয়ে আছে এর জেরে সম্পাদিত পাক-ভারত চুক্তির ঘটনা। এটি ‘তাসখন্দ চুক্তি’ নামে বহুল পরিচিত। তাসখন্দ উজবেকিস্তানের রাজধানী।

তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৬টি ‘প্রজাতন্ত্রের’ একটি ছিল এই উজবেকিস্তান। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধের যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এই উপমহাদেশে দৃশ্যত শান্তি ও স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে প্রধানত সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পঁয়ষট্টির যুদ্ধের মতো তাসখন্দ চুক্তিও তৎকালীন পাকিস্তানে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। দুই দেশের সৈন্যদের নিজ নিজ আন্তর্জাতিক সীমানায় ফিরিয়ে নেয়া, যুদ্ধে দখল করা ভূমি ছেড়ে দেয়া, যুদ্ধবন্দী বিনিময় প্রভৃতি গতানুগতিক কথা তাসখন্দ চুক্তিতে ছিল স্বাভাবিকভাবেই। এসব চুক্তি কার্যকরও হয়েছিল যথারীতি। তবে তাসখন্দ চুক্তিসম্পর্কিত কিছু বিষয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কিংবা স্মরণীয়। যেমন (ক) যুদ্ধে সম্পৃক্ত দেশ দু’টির বাইরে এবং প্রতিবেশী নয়, এমন একটি তৃতীয় রাষ্ট্রে চুক্তি সম্পাদিত হয়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর কিন্তু পাক-ভারত শান্তিচুক্তি হয়েছিল বিবদমান দুই দেশের একটিতে। ভারতের সিমলায় ১৯৭২-এর ২ জুলাই এটি সম্পাদিত হয়। (খ) তাসখন্দ চুক্তির ক্ষেত্রে পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরাট ভূমিকা রাখে। সোভিয়েত কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের সূচনা থেকেই তার ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং পাকিস্তানের ‘মিত্র’ ছিল সোভিয়েতের প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারক হয়ে উঠেছিল। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর সোভিয়েতের মুরব্বিয়ানা যেন তার দূরবর্তী ইঙ্গিত দিয়েছে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা ছিলেন আলেক্সি কোসিগিন।

১৯৭১ সালে ছিলেন লিওনিদ ব্রেজনেভ। (গ) কাশ্মির নিয়ে ভারতের সাথে পাকিস্তানের বিরোধ, আর একই কারণে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ। অথচ কাশ্মির ইস্যুকে গৌণ করে তাসখন্দ চুক্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের ভূখণ্ড আর সৈন্যরাই মুখ্য হয়ে ওঠে। কাশ্মির সমস্যা সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়াকে ভারতের স্বার্থে সোভিয়েত কূটনীতির ‘অবদান’ মনে করা যায়। অথচ কাশ্মির নিয়ে তর্জন-গর্জনকারী পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বিনা অর্জনেই চুপ থাকতে বাধ্য হলেন। (ঘ) এ পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের মতভেদ বিরোধে পর্যবসিত হয়। কিছু দিনের মধ্যেই ভুট্টো পদত্যাগ করেন এবং তার নেতৃত্বে পিপলস পার্টি নামের রাজনৈতিক দল গঠিত হলো। বাকপটু ভুট্টো তাসখন্দ চুক্তিকে ‘জাতির জন্য অবমাননাকর’ অভিহিত করে এ জন্য ক্ষমতাসীন শাসককে দায়ী করেন। তার দলটি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে সূচিত গণ-আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পূর্ব পাকিস্তানে মওলানা ভাসানী সূচিত আন্দোলন মিলে এতে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। (ঙ) তাসখন্দ চুক্তি হয়েছিল পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর উপস্থিতিতে। চুক্তি স্বাক্ষর করার পরদিনই শাস্ত্রী হৃদরোগে মারা যান। ছোটখাটো দেহের মানুষটি ছিলেন গান্ধীর মতো সাধারণ জীবনযাত্রার অনুসারী। শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে জওয়াহেরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর। শাস্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক দিন পর উত্তরসূরি হলেন নেহরুতনয়া ইন্দিরা গান্ধী।

শাস্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যু ইন্দিরার উত্থান ও সর্বময় কর্তৃত্ব ত্বরান্বিত করেছিল। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময়ে কাশ্মির ইস্যুতে বিশেষ অনুভূতির কারণে জনগণ আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল; কিন্তু তাসখন্দ চুক্তির ফলে তাদের এ ধারণাই হলো যে, যুদ্ধক্ষেত্রে ‘জয়ী’ হয়েও দেশ কূটনৈতিকভাবে হেরে গেছে। এ অবস্থায় তাসখন্দ চুক্তি প্রত্যাখ্যানের লক্ষ্যে লাহোরে সর্বদলীয় সম্মেলন আহূত হয়। অবশ্য তা সফল হয়নি; কারণ সেখানে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হঠাৎ ছয় দফা উত্থাপন করায় সেটিই আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ফলে জাতীয় রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন মোড় নেয়।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম