২৮ অক্টোবর-২০০৬ : সংঘর্ষের দুটো পক্ষ : কী তাদের বৈশিষ্ট্য

ভিডিও ডকুমেন্টারী : ২৮ অক্টোবর-২০০৬ - রক্তাক্ত বাংলাদেশ




২৮ অক্টোবর ২০০৬ ! স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম এর চেয়ে ভয়াল হিংস্রতার দিন আর একটিও দেখেনি । হয়তোবা এদেশে এরকম দিন এসেছে আরো..এবং ২০০৬ এর পরেও হয়তোবা এসেছে.. কিন্তু সেদিনের বিভৎস নারকীয়তার টিভি চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচার মানুষের হায়েনাত্বকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলো ।

মানুষ সৃষ্টির পরিকল্পনা করার সময়ে মহান আল্লাহর কাছে ফেরেসেতাদের সেই আশঙ্কা ..এরা তো পৃথিবীতে রক্তপাত - হানাহানিতে লিপ্ত হবে !... ফেরেশতারা সেদিন আশ্বস্ত হয়েছিলো এমন জবাবে , যুগে যুগে এই মানুষেরা আল্লাহর নিকট হতে জীবন বিধান পাবে , পাবে নবী ও রাসুলগণকে যারা শিখিয়ে দেবেন জীবনের প্রতিটি কর্মকান্ড ও চিন্তাধারা ঠিক কিভাবে হলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করা যাবে ...

শয়তান তার কিছুকাল পরে অহংকারের সুরে বলেছিলো, হে আল্লাহ, যেই আদমের জন্য আমাকে তোমার আশ্রয় হতে বিতারিত হতে হলো সেই আদম ও তার সন্তানদের অধিকাংশকেই তুমি তোমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হিসেবে পাবে !



কঠোর সতর্কবানী ছিলো মহান স্রষ্টার..সেই সময়ে... .."তুমি ও তোমার অনুসারীদেরকে দিয়ে আমি জাহান্নাম পূর্ণ করবো"..

নবুওয়্যাতের ধারার সমাপ্তকারী , রাসুল মুহাম্মাদ সা: এর মাধ্যমে আল্লাহ তার ওয়াদা পূর্ণ করলেন । মানুষের জন্য এলো সবশেষ ও পূর্বে আগত সকল আসমানী বইয়ের পরিপূর্ণতা দানকারী বই , আল-কুরআনুল কারীম । যে বইটি এসেছিলো পৃথিবীর শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত পৃথিবী তথা মহাবিশ্ব ও মানবজাতিকে সব ধরনের অন্ধতা, অজ্ঞতা ও অন্ধকার হতে মুক্তি দিয়ে শান্তিময় জীবনব্যবস্থার পরিপূর্ণ ফর্মুলা নিয়ে ।

শেষ নবীর মৃত্যুর পরে, তার অনুসারীগন পেলেন এক অনন্য মর্যাদা । যে মর্যাদা পান নি মানবজাতির আর কোন সময়ে বিচরণকারী সদস্যগণ । যে সুমহান দায়িত্ব অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশাবলী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে মানবজাতি ও সৃষ্টিকে সু-শৃংখল রাখার কাজ...যা এতদিন ধরে করতেন শুধুমাত্র আল্লাহর নবী ও রাসুলগণ... সেই দায়িত্বের দায়িত্বশীল হলেন একেবারে সাধারণ মানুষেরা - যারা মুহাম্মদ সা: এর উম্মাত ! কেননা, আর কোন নবী আসবেন না...


এককালের মর্যাদাশীল জ্বীন-জাতি সদস্য ইবলিশ, যে তার অহমের আতিশয্যে বিদ্রোহী হয়ে গিয়ে চিড় অভিশপ্ত হয়ে গেলো , তাকে সুষ্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছিলো, এই মানবজাতির জন্য এক চিড়ন্তন পরীক্ষা হিসেবে । মানবজাতি যখন ই আল্লাহর বিধি-বিধানকে প্রতিস্ঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানেই বাগড়া দিয়েছে ইবলিশ.. আল্লাহর ই দেয়া কিছু বিশেষ গুণাবলী ব্যবহার করে সে যুগে যুগে তার অনুসারী বানিয়ে নিয়েছে স্বাধীন চেতনা ও বিবেকের অধিকারী অথচ অজ্ঞ কিছু মানুষকে । কাজে লাগিয়েছে তাদেরকে সর্বশক্তি দিয়ে... বাঁধা দিয়েছে, বিঘ্নিত করেছে আল্লাহর নির্দেশাবলী মেনে চলা ও সবাইকে মেনে নেবার আহবানকারী সম্মানিত মানুষদেরকে !

ইসলামী আন্দোলনের এর কন্টকময় পথচলার , এই প্রাগৈতিহাসিক রক্তাক্ত ঘটনাপন্জীর , আল্লাহর নির্দেশাবলীকে সবচেয়ে সুউচ্চে তুলে রাখার জীবনবাজী প্রতিজ্ঞার চিড়ায়ত ধারাবাহিকতার একটিমাত্র দিন হলো ২৮ শে অক্টোবর, ২০০৬ ইশায়ী সন । এ দিনটি নতুন কিছু না.. এ দিনের আত্মত্যাগ আর শাহাদাতের নজরানার ঘটনাও বিচ্ছিন্ন কোন ঐকিকতার পরিচায়ক না !

কিছু সহজ কথা ....

আক্রান্ত মজলুম পক্ষ: 

১. ওরা প্রত্যেকে ছিলো শিক্ষিত..
২. ওদের আচরণ ছিলো ভদ্রতা, নম্রতা আর সম্ভ্রমে পূর্ণ..
৩. ওরা ভালোবাসতো ওদের সহপাঠীদের , ওদের সহপাঠীরা ভালোবাসতো ওদেরকে..
৪. ওদেরকে কোন ব্যাপারে দোষারোপ করতে পারতো না পরিচিত কেউ !
৫. ওরা অন্যায় করতো না এবং কাউকে করতে দেখলেও নিষেধ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতো..
৬. ওরা মিথ্যা কথা বলতো না..ওরা নোংরা-বাজে কথা বলতো না.. শুনতো ও না..
৭. ওদের পোশাক থাকতো পরিচ্ছন্ন আর মার্জিত..
৮. ওরা ছিলো নামাজী .. ফজরের ওয়াক্তে আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম এদেশের যে ১৫ থেকে ২০ ভাগ তরুন শুনতে পায়, ওরা তাদের অন্তর্ভক্ত ছিলো..
৯. ওরা কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতো শুদ্ধভাবে , কুরআনের অর্থ পড়তো..এবং বিস্তারিত তাফসীর ও পড়তো..
১০. ওরা জানতো.. নবীদের জীবনী, মুহাম্মাদ সা: এর জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত, সাহাবীগণের অসাধারণ জীবনগাঁথা..
১১. ওরা পড়তো ওদের পাঠ্যবই, আরো পড়তো শতশত বই যা ইশকুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে ছিলোনা.. অথচ পৃথিবীকে গড়তে হলে যেগুলো পড়া খুব বেশি দরকার !
১২. ওরা সঙ্ঘবদ্ধ আর সুশৃংখল জীবনে অভ্যস্থ ছিলো, কেননা আল্লাহ বলেছেন এটা করতে..
১৩. ওরা রাতের গভীরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে চোখের পানি ফেলতো..
১৪. ওরা চাইতো মনে প্রাণে, চারপাশে একজন ও অভাবী মানুষ না থাকে.. না থাকে একজন ও বঞ্চিত অসহায়..
১৫. ওদের আত্মীয়-স্বজন, বাবা মা, ভাই-বোন ও বন্ধুদের কাছে ওরা খুব প্রিয় ছিলো..


আরো কিছু সহজ কথা..

আক্রমণকারী পক্ষ

(..অধিকাংশ অথবা কেউকেউ..)

১. এরা ছিলো কেউ শিক্ষিত, কেউ অশিক্ষিত.. বেশিরভাগ ই ছিলো প্রায় মুর্খ..
২. এরা বেশিরভাগ সময়েই থাকে উগ্র ও বদমেজাজী অবস্থায়..
৩. এরা সিগারেট খায়, নেশা করে, মাদকের রাজ্যে নিয়মিত বিচরণকারী..
৪. এরা গালি দেয়, গালি শুনে এমনকি সাধারণ আড্ডাতেও নোংরা কথা বলা ও শোনাতে এদের যাবতীয় আনন্দ..
৫. এরা নামাজী নয় , নামাজী হলেও নিয়মিত নামাজী নয়.. 
৬. এদের পরিবারের সদস্যরা ও আত্মীয় স্বজনেরাও বেশিরভাগ সময়ে এদেরকে অভিযুক্ত করে নানান ধরনের অপছন্দনীয় অনিয়মের কারনে..
৭. এরা জানেনা বিধাতার দেয়া কুরআন শরীফ কিভাবে পড়তে হয়.. জানেনা ঐ কুরআনে কি লেখা আছে..
৮. এরা মিথ্যাচার করে , মানুষকে ঠকানোর সামান্যতম সুযোগ ও ছেড়ে দেয়না..
৯. এরা জানেনা, আল্লাহর দেয়া বিধান ও নির্দেশনা না মানলে কি কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে মৃত্যুর পরে এমনকি অশান্তিময় এই পার্থব জীবনেও..
১০. এরা ধর্মনিরপেক্ষতা নামের জীবনব্যবস্থার সমর্থণ করে বসে, যা আল্লাহর দেয়া একমাত্র গ্রহণযোগ্য আদর্শ ইসলামের সাথে বিদ্রোহের সামিল..
১১. এরা কখনো পড়েনি এমন একটা বা দুটা বই, যাতে লেখা আছে মুহাম্মাদ সা: এর জীবনেতিহাস, লেখা আছে সাহাবাগনের কাজের বর্ণনা.. অজ্ঞতার অন্ধকার-মাদকে বেহুশ জীবনযাপন করে..
১২. এরা অত্যাচারী ও পেশীশক্তির অহংকারে অহংকারী.. চাঁদাবাজী আর হুমকি ধমকি দিয়ে এরা একেকটা দিন পার করে..
১৩. এদের নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধি, বিচার-বিবেচনার কোনই অবশিষ্ট নেই । সব বিকিয়ে দিয়েছে অনেক ধরনের প্রভুর প্রভুত্বের কাছে..
১৪. এরা সংকীর্ণ মানসিকতা আর খুব ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়ে পৃথিবীকে দেখে.. ইসলামী জীবনব্যবস্থার মহাবিশ্বব্যাপী প্রশস্ততা এদের ধারনাতেও নেই..
১৫. ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হোক, তা এরা কিছুতেই চায়না, যার সহজতম অর্থ হলো, আল্লাহর নির্দেশ- ইসলাম তথা তার আদেশ নির্দেশ প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামের এরা স্পষ্ট বিরোধীপক্ষ!

 লেখক : ব্লগার ভালো


শহীদের আম্মুরা : !!!! 



শহীদ মুজাহিদুল ইসলামের আম্মু : -মাহমুদা দেলোয়ার
“মহান আল্লাহ মুজাহিদের শাহাদাত কবুল করুন এবং যে উদ্দেশ্যে মুজাহিদ তার জীবন উৎসর্গ করলো আল্লাহ যেন এই জমিনে তাঁর দীন প্রতিষ্ঠা করে সে উদ্দেশ্যকে পূর্ণ করেন। যেসব কর্মী ভাইয়েরা ইসলামী আন্দোলনে আছেন, তাদের উপযুক্ত দীনি শিক্ষার মাধ্যমে এমনভাবে গড়ে তোলা হোক, যাতে তারা যেকোন পরিস্থিতি ধৈর্য এবং সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারে।”


শহীদ হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপনের আম্মু: - মাহফুজা খাতুন


“ আল্লাহর দরবারে আমার স্বপ্ন ছিল আমি শহীদের মা হবো, আল্লাহ যেন আমাকে একজন শহীদের মা হিসেবে কবুল করেন। শিপন সবসময় সত্যকে সত্য জানতো মিথ্যাকে মিথ্যা জানতো। এই দীনের আন্দোলন করতে গিয়ে সে শহীদ হয়েছে। এখন আমার বাবা শিপনের মতো যেন হাজার হাজার শিপন এই বাংলার জমিনে সৃষ্টি হয়ে শিপনের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে। আমার বাবা গোলাম কিবরিয়ার সদকা যেন কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকে। যাদের হাতে আমার বাবা শহীদ হয়েছে তাদের বিচার হিসেবে আল্লাহপাক তাদেরকে যেন হেদায়াত করেন। আল্লাহপাক তাদের অন্তরের খবর জানেন; যদি তাদের তকদিরে হেদায়াত না থাকে তাহলে তিনি যেন তাদের অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করে দেন। আল্লাহপাক যেন সব শহীদকে কবুল করেন আমিন।”


শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুমের আম্মু:

“আমি আমার ছেলের নাম রেখেছিলাম সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ। তার প্রিয় নানুমণি নাম দিয়েছিলেন মাসুম। সব মিলে তার নাম হয়েছিল সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুম। সাইফুল্লাহ মানে আল্লাহর তরবারি, মাসুম মানে নিষ্পাপ।

আমার জীবনের আশা ছিল আমার ছেলে খালিদ বিন ওয়ালিদ হবে, উমর হবে, অসত্যকে পরাজিত করবে। সমাজের আদর্শ ছেলে হবে, নিষ্পাপ হবে। আমার ছেলে হাসান-হুসাইন এর মত হবে। আমার আর এক ছেলে শামসুল আলম মাহবুব। সব সময় দোয়া করতাম সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তারা যেন গাজী অথবা শহীদ হয়। সত্যি আমার প্রার্থনা আল্লাহপাক কবুল করেছেন। আমি মনে-প্রাণে সর্বদা আশা পোষণ করতাম মাসুম যেন ময়দানে সবার আগে থাকে। আল্লাহপাক আমার দোয়া কবুল করেছেন। আমি আমার সাইফুল্লাহর রক্তের বিনিময়ে এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক এই প্রার্থনা সব সময় করি।


আমার কলিজার টুকরা শিবিরের আব্বুদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ- মাসুম যেমন করে জীবনের মায়া, পরিবারের মায়াকে দূরে ঠেলে দিয়ে বাতিলকে পরাজিত করার জন্য বীরের বেশে লড়েছে, ঠিক সেইভাবে মাসুমের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজগুলো তারা যেন বীরের বেশে সমাপ্ত করে। বাতিলের বৈঠা ও লগির ভয়ে তারা যেন কাপুরুষের মতো পিছু হটে না যায়। এ রকম সাহসী শিবির যদি সবাই হতে পারে তাহলেই দীন কায়েম দ্রুত সম্ভব হবে। আল্লাহপাক সবাইকে কবুল করে নিন- আমীন।”


শহীদ ফয়সলের এর আম্মু : - সাইয়েদা হাসনাবানু

“আলহামদুলিল্লাহ। আমি আশা করি ইনশাআল্লাহ আমার এই সুশিক্ষিত বিনয়ী ভদ্র, শান্ত, অমায়িক ও সুন্দর আচরণবিশিষ্ট সন্তানকে আল্লাহ শাহাদাতের মর্যাদা দান করবেন। আমার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন সেজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আমি আল্লাহর কাছে এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। আল্লাহ আহকামুল হাকিমীন। অন্য ছেলেদের উদ্দেশে আমার অনুরোধ তারা যেন এই শহীদদের রক্তকে বৃথা যেতে না দেয়। তারাও যেন ইসলামী আন্দোলনকে উজ্জীবিত করার জন্য পিছ পা না হয়। আমার মুখে ভাষা নেই কলমে লেখা নেই- এখানেই ক্ষান্ত করছি।”

লেখক : ব্লগার স্বর্ণলতা

রক্তের সে স্রোতধারা হোক সুন্দরের অগ্রপথিক


চিরুনীর আচড় এখনও যখন মাথার সেলাই দেওয়া অংশে ভুলক্রমে উঠে যায়, কেঁপে উঠি ব্যাথায়, বাজারের ব্যাগটি তুলতে গিয়ে যখন ভাঙ্গা আঙ্গুলটি চিন চিন করে ওঠে, ঝাকুনি দিয়ে ওঠে শরীর। সেদিনের কথা স্মরণ হয়।

দিবস মেনে আমাকে ২৮শে অক্টোবর স্মরণ করতে হয়না, প্রতিদিনের ছোটছোট ব্যাথাগুলো আমাকে প্রতিদিনই ২৮শে অক্টোবরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

মনে পড়ে সেদিনটির কথা। কিচ্ছু ছিলনা আমাদের হাতে। জীবনে এমন পরিস্থিতির মোকাবেলা করিনি কোনদিন। সাত সকালে ফ্রিজ থেকে বের করে দেয়া মায়ের হাতের গরম করা পোলাউ খেয়ে বের হয়েছি পল্টনের উদ্দেশ্যে। সব মিলে মোটে প্রায় ২৫জন ছিলাম পল্টন মসজিদ গলিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্লোগান। দেখি সবার হাতে লগি বৈঠা। কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই দেখি বৃষ্টির মত ইট এসে পড়ছে। কি করবো বুঝতে পারছিলামনা। অন্যদের দেখাদেখি আমিও ওদের ছোড়া ইটগুলো পাল্টা ছুড়তে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ধাওয়া দিয়ে কাকরাইলের দিকে তাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু কাকরাইলের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। শত শত মানুষের বিশাল এক মিছিল এগিয়ে আসছে, প্রত্যেকের হাতে উদ্ধত লগি বৈঠা।

জীবনে মঞ্চে বহু গান গেয়েছি। শহীদি গান, কাশ্মির কি ফিলিস্তিনের প্রতি সহমর্মীতা নিয়ে গান। কিন্তু সত্যিকারের ময়দানে দাঁড়িয়ে মনে হলো মঞ্চে গান গাওয়া আর বাস্তবে মৃত্যুকে ময়দানে মোকাবেলা করা- আকাশ পাতাল তফাৎ। এগিয়ে আসছে আকাশ কাঁপানো মিছিল, আমি আতঙ্কে ফ্রিজ হয়ে আছি। ভাবছি, আমাদের এ কয়জনের উপর দিয়ে ওরা যদি শুধু হেঁটে যায়, তাতেই চলবে, স্রেফ পিষে যাব। এক মুহুর্তে কত ভাবনা ঘুড়ে ঘুড়ে এলো মাথায়, আজকের সংঘাত হয়তো এখানেই শেষ, দিন শেষে ফিরে যাব যার যার গৃহে, কিন্তু এমন আতঙ্ক নিয়েই তো প্রতিটি দিন পার করে ফিলিস্তিন, কাশ্মিরের জনগণ। কেন যেন ভাবনাগুলো মুহুর্তের মধ্যে ঘুরে গেল মাথা থেকে।

মাথায় চিন্তা এলো- যা হয় হোক, পালাবোনা। গলির মধ্যে ঢুকে আগের জায়গায় দাঁড়ালাম সবাই । এগিয়ে আসা মিছিল আমাদের গলিমুখে থমকে দাঁড়ালো। শুরু করলো বৃষ্টির মত ইট নিক্ষেপ। আমরাও যথাসাধ্য ফিরিয়ে দিলাম। কিন্তু কতক্ষণ? একটি ইট এসে লাগলো মাথায়। পৃথিবীটা দুলে উঠলো যেন। মাথাটা হাত দিয়ে চেপে পিছু হটতে লাগলাম। আরেকটি ইট এসে পড়লো সেই চেপে ধরা হাতে। মধ্যমা আঙ্গুলটি ভেঙ্গে গেল। একটু নিরাপদে এসে দাঁড়াতেই টের পেলাম রক্তের স্রোতে ভিজে যাচ্ছে শার্ট। কে একজন একটি টিস্যু দিল। চেপে ধরে দাঁড়াতেই একজন জোড় করে মহানগরী অফিসের দিকে ধরে নিয়ে চললো। পথে দেখলাম একের পর এক রক্তাক্ত ভাইদেরকে পল্টনের দিক থেকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে তাদের সাথীরা। সে এক বিভৎস দৃশ্য।
মাথায় সেলাই ও ব্যান্ডেজ বেধে দুপুরের পরে যখন ফিরেছি আবার, ততক্ষণে আমার পাশে থাকা মুজাহিদ ভাইয়ের শাহাদাতের খবর পেলাম। চলেই গেলেন তিনি চীরতরে। আজ বিকেলে যখন শহীদ মুজাহিদ ভাইয়ের বাবার সাথে দুই বছর পর পিরিচিত হলাম। বললাম, সেদিন আমি আর মুজাহিদ ভাই এক সাথেই ছিলাম। তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। শুধু কষ্ট ঠেলে জিজ্ঞেস করলেন- তোমার কি নাম?

দীর্ঘদিন ভাঙ্গা আঙ্গুলটি নিয়ে আমি একপ্রকার অসহায় ছিলাম। মা সতর্ক ছিলেন সর্বক্ষণ। ছোট বোনকে কড়া নির্দেশ দিলেন, যেন প্রতিদিন ঘুমানোর আগে আমার মশারী টানিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন গোসলের পরের ভেজা কাপড় মা নিজের হাতে ধুয়ে দিয়েছেন। কম্পিউটারের কী বোর্ডে বহুদিন হাত দিতে পারিনি। আমার সে ভাঙ্গা আঙ্গুলটি আজো এক প্রকার অকর্মণ্য। জানিনা আদৌ ঠিক হবে কিনা।

কি হবে এসব স্মৃতি কথা বলে। আমি তো মাতৃক্রোড়ে ফিরে এসেছিলাম মাতৃস্নেহ জয় করে। ১৪ জন ভাইতো সেদিন চিরতরে চলে গেলেন এক অন্ধ রাজনীতির কবলে পড়ে। আমার চেয়ে অনেকগুণে আহত হয়ে আজো কাতড়াচ্ছেন শত শত ভাই।

কি দোষ করেছিলাম? ঢাকা শহরের এক বাড়িওয়ালার সন্তান হয়ে নিরাপদে, সুখেই তো কাটাতে পারতাম জীবন। কুরআন-হাদিস পড়ে জানলাম পৃথিবীতে আল্লাহর বান্দাহদের দায়িত্ব শুধু ভোগ আর জীবন পার করা নয়। বরং যে আল্লাহ আমাকে খলিফা হিসেবে পাঠিয়েছেন, তার দেয়া দায়িত্ব পালন করা। তার দেয়া জীবন ব্যবস্থাকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো। সে চেষ্টা করতেই তো একটি ইসলামী ছাত্র সংগঠনে যোগ দিয়েছিলাম। সেটাই কি আমার অপরাধ? কই, যারা আমার সংগঠনের বিরোধিতা করেন, তারা তো নিজেরা আল্লাহর দ্বীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি নিয়ে আমার নিকট আসেননি কোনদিন। আমি তো প্রস্তুত, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি ঘোষণা করে, সবার আগে আমি সেখানে যাব ইনশাআল্লাহ। কিংবা বিএনপি যদি করে, আমি বৃহৎ দল হিসেবে তাদের সাথে যোগ দেব। কিন্তু, কেউ তো আসেনা। শুধুই বিরোধিতা, শুধুই ত্রুটি অনুসন্ধান।

জানি, নবীদের ইতিহাস বলে, কোন নবীর সত্য দাওয়াতই বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। সমাজের কুলিন শ্রেণীর লোকেরাই সে দাওয়াতকে সবার আগে প্রত্যাখ্যান করেছে। এটাই ইতিহাস। রাসুল সা. এর ক্ষেত্রেও সে ঘটনাই ঘটেছে। একই উদ্দেশ্য নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত যারই কথা বলবে, কর্মসূচি ঘোষণা করবে, তাদের বিরুদ্ধেই কায়েমী স্বার্থবাদিরা হিংস্র হয়ে উঠবে। কোথাও 'স্বাধীনতা বিরোধিতা' ইস্যু, কোথাও সন্ত্রাসবাদ, কোথাও অন্য কিছু। স্বাধীনতা বিরোধিতাই যদি আমাদের বিরুদ্ধে একমাত্র ইস্যু হয়, তবে ১৯৬৯ এ সোহরাওয়ার্দী ময়দানে মালেক ভাইকে এভাবে নির্মমভাবে জীবন দিতে হতোনা। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের কল্যাণময় সমাজের বিপক্ষে আওয়াজ যুগে যুগে উঠেছিল, ভাবিষ্যতেও উঠবে।

তবে 'আতঙ্কের' কথা হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যও প্রতিটি জনপদে একদল মানুষ থাকবে। মাথা উচু করবে। শত বিরোধিতা সত্বেও জনগণের মন জয় করে সুন্দরের পথে এগিয়ে যাবে। ২৮শে অক্টোবরে আমার কয়েকফোটা রক্ত যদি আল্লাহ কবুল করেন, আমি তাতেই তৃপ্ত। যে শত শত ভাই আহত হয়েছেন, সকলেরই একই দোয়া।

যারা চলে গেছেন, তাদের আত্মীয় স্বজনরা আমৃত্যু চোখের পানি ফেলবেন। সে চোখের পানির বদৌলতে যদি আল্লাহ এ জমিন থেকে হিংসাত্মক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিষদাত উপড়ে ফেলেন, তবেই সে চোখের পানি স্বার্থক, সে রক্ত স্বার্থক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে হিংসা আর রক্তধারা ঘুচে আদর্শিক প্রতিযোগিতা আসুক। আজকের দিনে এটিই প্রত্যাশা।

লেখক : ব্লগার হলদে ডানা

2 comments:

মোহাম্মদ ফয়সল বলেছেন...

যখন এই কথা মনে পড়ে তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনা.... মহান আল্লাহ যেন আমাদের শাহাদাতদের কবুল করেন...আমিন।

নামহীন বলেছেন...

But who told you to start politics in the name of Islam? Isn't the violance the Shibir do, prohibited in Islam? And by which dream, you found yourself "Khalifa". You need a level of wisdom before that declaration. But what you are doing in the name of Jihad? I've seen chittagong college, Rajshahi/sylhet medical cases? Do you think you bring justice there? I doubt. Those who failed to cope the regular path, finds the alternate path of terrorism so that they can gain power.

Whenever you start doing rotten politics, in whatever name: BNP, AL, JP, JAMAT -- all are crap. We clap to hear your mishaps. All of you are fighting for power.

Be a good person, be kind to orphans, do some good to the country and mankind -- Allah will bring you happiness in eternal life.

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম