আমাদের শহীদ ভাইয়েরা নিজেকে চেনার মাধ্যমে আল্লাহকে চিনতে কখনো ভুল করেননি। যার কারণে দুনিয়ার সাফল্যকে উপেক্ষা করে পরকালের সফলতাকে বরণ করে নিতে, তাদের জীবন আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। শহীদ আসগর আলী ছিলেন এমন এক জীবনের প্রতিচ্ছবি- যার আলোকচ্ছটায় অসংখ্য জীবন আলোকিত হয়ে ওঠে। অন্তরে জাগিয়ে তোলে নিজেকে আল্লাহর রঙে রাঙিয়ে তোলার উদগ্র বাসনা।
দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর থানার শাশারপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন আসগর আলী। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেন তিনি। দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপস্ স্কুল থেকে ১৯৭৯ সালে বিজ্ঞানে প্রথম বিভাগে ঝঝঈ পাস করেন। দিনাজপর সরকারি কলেজ থেকে ১৯৮১ সালে বিজ্ঞানে ২য় বিভাগে ঐঝঈ উত্তীর্ণ হন। ১৯৮৪ সালে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে সেখান হতে ১৯৮৮ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে বিএসসি (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। গ্রামের বাড়ির কাছে সঙ্গীত কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানে একজন অস্থায়ী প্রভাষক হিসাবে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি।
আমাকে প্রায় পাঁচ বছর ধরে শহীদ আজগর আলী ভাইয়ের পরিবারের খোঁজখবর রাখার সুযোগ করে দিয়েছেন মহান প্রভু, এ জন্য তাঁর দরবারে জানাই লাখ শুকরিয়া। বিশেষ করে শহীদের স্ত্রী শ্রদ্ধেয়া ভাবীর যিনি শহরেই থাকতেন। যখন ভাবীর খোঁজখবর নেয়ার জন্য যেতাম নতুন এক প্রেরণা খুঁজে পেতাম। কারণ তিনি প্রায় বাইশ বছর ধরে শহীদের স্মৃতি বুকে ধারণ করে আছেন।
এখনকার দিনগুলো অবশ্য তিনি বেশ আনন্দের সাথে অতিবাহিত করার চেষ্টা করছেন। কারণ শহীদ আসগর ভাই শহীদ হওয়ার আগে সর্ব শেষবার বাড়ি থেকে এমএ পরীক্ষা দেয়ার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন যাচ্ছিলেন তখন তিন বছরের ছোট মেয়ে আফিফা বলেছিল, আব্বু, আমি তোমাকে যেতে দেবো না। শহীদ আসগর ভাই মেয়েকে কোলে নিয়ে বলেছিলেন, আম্মু আমাকে যেতে দাও, আমি পরীক্ষা দিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। তোমার জন্য লাল জামা আনবো। শহীদ আসগর ভাই ফিরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু মেয়ের জন্য লাল জামা নিয়ে নয়, নিজে সাদা কাপড় পরে লাশ হয়ে। সেই মেয়ে আফিফা এখন দুই সন্তানের জননী। প্রথম সন্তান সুমাইয়া আঞ্জুম, পাঁচ বছরের মেয়ে, কেজিতে পড়ালোখা করে, ছেলে আজমাইন আনোয়ার অর্নব তিন বছর বয়স। ভাবী তাদেরকে নিয়ে কষ্টগুলো ভুলে থাকতে চেষ্টা করেন।
গত ২৮ জুন সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ আবদুল জব্বার ভাইয়ের দিনাজপুরে সাংগঠনিক সফর ছিল। যথারীতি তিনি ঢাকা থেকে দিনাজপুর পৌঁছলেন। সাংগঠনিক কাজ শেষে সন্ধ্যাবেলা আমাকে বললেন, শহীদ আসগর ভাইয়ের বাসায় ভাবীর খোঁজখবর নিতে যাবেন। ভাবী তো শহরে থাকেন, খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তিনি মেয়ে আফিফার বাসায় গেছেন, জেনে আনন্দিত হলাম। কারণ একসাথে সবার খোঁজ-খবর নেয়া যাবে।
সেক্রেটারি জেনারেলের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে চিরিরবন্দর মেয়ে আফিফার বাসায় দ্রুত পৌঁছে গেলাম। ভাবী, মেয়ে, নাতি-নাতনী সবাই আমাদেরকে পেয়ে মহা খুশি। জামাই অবশ্য সরকারি চাকরি করেন চট্টগ্রামে। এখানে থাকলে তিনিও খুশি হতেন। তাদের খুশিতে মনে হলো না জানি আমরা কত আপন, কত কাছের পরম আত্মীয়। আসলেই তাইতো, এ সম্পর্ক যে রক্তের সম্পর্ককেও হার মানায়। সেক্রেটারি জেনারেল নাতি-নাতনীকে কোলে নিয়ে তাদের অনেক আদর করলেন। তাদের সাথে খেললেন। সেই ফাঁকে ভাবী ও মেয়ের সার্বিক খোঁজখবর নিলেন। বিদায়ের মুহূর্তে ভাবী ব্যথাতুর মনে পানি টলমল চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
প্রায় সাত বছর হতে চলেছে শহীদের গর্বিত পিতা আসগর আলী ভাইয়ের খুনিদের বিচার হবে অপেক্ষা করতে করতে মহান রবের কাছে পারি জমিয়েছেন। আল্লাহ যেন তাকে শহীদের গর্বিত পিতা হিসেবেই কবুল করেন। একবার মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলোম স্থানীয় শিবির নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে। চিরিরবন্দর শাশারপুর গ্রামে পিচঢালা পথ পেরিয়ে গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ বেয়ে চলছিলাম আর ভাবছিলাম, মা কী প্রশ্ন করবেন কী যে জবাব দেব। ভাবতে ভাবতেই শহীদ আসগর ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে গেলাম। বাইরে থেকে খবর পাঠালাম মায়ের কাছে। মায়ের অনুমতি পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ঢুকতেই সেই মহীয়সী মায়ের সাথে সাক্ষাৎ। তাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলাম। সালামের সম্মতি জবাব পেলাম। মুখনিঃসৃত কোনো আওয়াজ পেলাম না। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার দুই চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। মায়ের চোখের পানি দেখে মনের অজান্তেই আমারও চোখজোড়া ভিজে উঠল। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম এবং যদিও মাকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো কোনো ভাষা আমার জানা ছিল না তবুও চেষ্টা করলাম। মা হয়তো ভাবছেন আজ যদি আসগর বেঁচে থাকতো তাহলে এভাবেই কাছে এসে তাকে মা বলে ডাকতো। তিনি নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন। আমাদের রুমে বসতে বললেন। আমরা এর ফাঁকে অজু করে শহীদের ছোট ভাই ইসহাক আলী ভাইকে সাথে নিয়ে জোহরের নামাজ ও শহীদের কবর জেয়ারত করলাম। ইসহাক আলী ভাইও আসগর আলী ভাইয়ের সাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতেন। আসগর ভাই শাহাদাৎ বরণ করার পর মা ও বাবাসহ এলাকার লোকজন আর রাজশাহীতে তাকে যেতে দেননি। পরে তিনি এলাকায় পড়ালেখা করেছেন। এখন একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
এলাকার লোকজনদের কাছে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম শহীদ আসগর ভাই সুযোগ পেলেই সকলের খোঁজখবর নিতেন, সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াতেন। মানুষকে নামাজের জন্য ডাকতেন। মূলত আল্লাহ যাদের শহীদ হিসেবে বাছাই করেন তাদের জীবনচরিত হয় সুন্দর, যা আসগর ভাইয়ের জীবনেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। টিকিট ছাড়া তিনি কখনো ট্রেনে উঠতেন না। একদিন পার্বতীপুর স্টেশনে এক ব্যক্তি টিকিট না কেটে ট্রেনে উঠছিলেন দেখে তিনি সেই ব্যক্তিকে টিকেট না কেটে ট্রেনে উঠতে নিষেধ করলেন। এবং তাকে কিছু টাকা দিয়ে সহযোগিতা করলেন বাড়ি যাওয়ার জন্য। আরেক দিন দিনাজপুর থেকে বাড়ি ফিরছিলেন, এমন সময় রাস্তার পাশে পুকুরের পানিতে একটি শিশুকে ডুবে যেতে দেখে ছুটে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। নিজের টাকা খরচ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পরে শিশুটির বাবা-মা চিকিৎসার টাকা শহীদ আসগর ভাইকে ফেরত দিতে চাইলে তা নিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। এ থেকে বোঝা যায় আসগর ভাইয়ের জীবন ছিল কত প্রেরণাময়।
এবার মায়ের কাছে বিদায় নেয়ার পালা। কিভাবে যে বিদায় নেবো সে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু বিদায় যেহেতু নিতে হবে, তাই অপরাধীর মতো জড়োসড়োভাবে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্নভাবে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাড়ির সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
শহীদ আসগর ভাই মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। জানি তিনি জান্নাতে সবুজ পাখি হয়ে বিচরণ করছেন। আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী তিনি তো মরেননি, তিনি জীবিত। কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারি না। শহীদ আসগর ভাইসহ অন্য শহীদ ভাইয়েরা আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস, চেতনার মূলে তাঁদের জীবন ইতিহাস। আমাদের অন্তরে তাদেরই দেখিয়ে দিয়ে যাওয়া পথ পাড়ি দেয়ার উদগ্র বাসনা। শহীদি কাফেলার প্রিয় সাথীরা তাই সঙ্কল্পে অটুট, লক্ষ্য নির্দিষ্টÑ আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার দৃপ্ত শপথ বুকে ধারণ করে এগিয়ে চলেছে সম্মুখে। জানি, বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। কেননা, শহীদের মায়েদের চোখের পানি ও রাতজেগে মহান রবের দরবারে দু’হাত তুলে করা দোয়া আমাদের প্রেরণাকে শানিত করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
0 comments: