পড়ার টেবিলে ক্লাসের বই-খাতা ছাড়াও রয়েছে আরো বেশ কয়েকটি পুস্তক, যা মঞ্জুর নিজ হাতে সাজিয়ে রাখা। |
চারদিকে বাংলা বর্ষবরণ তথা নববর্ষ উদযাপনে উৎসব আনন্দের আমেজ। ১৪১৯ বঙ্গাব্দ বরণে সকলেই যখন ব্যস্ত, ঠিক তখনই মাঝ বয়সী পিতা আব্দুর রশীদ মেকার, মা আমেনা বেগমসহ ১০/১৫ জন নিকট আত্মীয়-স্বজনের গগনবিদারী কান্নার আওয়াজ, শোকের মাতম বাতাসকে ভারি করে তুলেছে।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পান্টি গোরস্থান পাড়ায় গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের ক্যাডারবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে শিবিরকর্মী আব্দুল্লাহ আল মঞ্জুর বিভিন্ন স্মৃতি ধরে পিতা-মাতার সাথে বিলাপ করছে সবাই। তাদের কান্নার আহাজারিতে শত শত দর্শনার্থী-শুভাকাঙ্ক্ষীসহ সাধারণ মানুষের চোখের কোণাতেও অশ্রুর ফোটা। সকলের মুখে একই উক্তি- ‘আহারে ! এত ভাল ছেলেটাকে মেরে ফেললো নরপিচাশরা, মঞ্জুর মতো সৎ নামাযী, পরোপকারী, সদালাপি, নম্র, ভদ্র, মেধাবী ছেলে এ এলাকায় পাওয়াই যায় না। জীবনে কাউকে কটুকথা পর্যন্তও মঞ্জুর মুখে কেও শোনেনি। অথচ কি অপরাধ ছিল ওর? আল্লাহ তুমি ঐ খুনী নরপশুদের বিচার কর, যারা দায়িত্বপরায়ণ সম্ভামনাময় তরতাজা প্রাণকে কুপিয়ে হত্যা করেছে ।
মঞ্জুর শরীরের থেকে ঝরে পড়া রক্তের দাগ, লেখা-পড়া করার টেবিল, বই-পুস্তক সবই এখন স্মৃতি, দর্শনীর বস্তু।
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল মঞ্জুর বন্ধু ইমারত আলী (২২)। সে চোখের পানি মুছতে মুছতে জানালো, ‘মঞ্জুর বড় গুণ ছিল বড়দের সম্মান-শ্রদ্ধা আর ছোটদের স্নেহ-আদর করা। বন্ধুমহলে ওর ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমি আচরণ। ওর গুণের তুলনা হয় না'। প্রতিবেশী গোলাম মোস্তফা (৪০) ব্যক্ত করলেন, ‘ইসলামী আন্দোলন তথা ধর্মীয় জীবন-যাপন ছিল মঞ্জুর ব্রত, আর এই ব্রতই শত্রুপক্ষের চোখে পড়ে। শত্রুরা সহ্য করতে পারেনি ওকে। তাই শেষ পর্যন্ত খুন করল এলাকায় ইসলামী মাহফিল বাস্তবায়ন কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা মঞ্জুকে'।
নিহত মঞ্জুর দরিদ্র পিতা আব্দুর রশীদের একমাত্র ছেলে, মায়ের বুকের মানিক। মঞ্জুর ছোট্ট চার বছর বয়সী বোন কানিজ ফাতেমা। ফুটফুটে শিশুটির ভায়ের মৃত্যুতে কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে। সে জানায়, ‘ভাইয়া খু-উ-ব ভাল ছিল, ভাইয়াকে যারা মেরেছে তাদেরকে আল্লাহ মারবে'। সাইকেল মেকার পিতা আব্দুর রশীদ ও মা আমেনা বেগম বিলাপ করতে করতে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছিল। এর মাঝেই তারা বুকের ধন মঞ্জু হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি করে বলেন, ‘আমরা অশিক্ষিত, মঞ্জুকে শিক্ষিত করে আদর্শবান মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ঐ মানুষরূপি পশুরা আমাদের সেই আশা পূরণ করতে দিল না'।
ঘটনার দিন মঞ্জু বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ছিল। সে সময় ২০/২৫ জন সশস্ত্র আওয়ামী লীগের ক্যাডার ঐ পাড়ায় ঢুকে জামায়াত, শিবির ও বিএনপিকর্মীদের বাড়িতে হামলা চালায়। মঞ্জু শোরগোল শুনে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুবলীগ ক্যাডার রফিকের ছুঁড়ে মারা ফালা মঞ্জুর পিঠ দিয়ে ঢুকে বুকের বামপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। মাটিতে লুটে পড়ে মঞ্জু, ফিনকি দিয়ে বেরুতে থাকে রক্ত, যে রক্তের দাগ ঘটনাস্থল এক প্রতিবেশীর ঘরের দেয়ালে এখন দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
ছোপ ছোপ রক্ত আব্দুল্লাহ আল মঞ্জুর শহীদি দৃষ্টান্তের যেন এক মাইলফলক। ওর পড়ার টেবিলে ক্লাসের বই-খাতা ছাড়াও রয়েছে আরো বেশ কয়েকটি পুস্তক, যা মঞ্জুর নিজ হাতে সাজিয়ে রাখা। ছিমছাম পরিপাটি রুমে রুচিপূর্ণ ক্যালেন্ডার শোভা পাচ্ছে, যা শুধুই স্মৃতি চিহ্ন।
তিস্তারচড়
0 comments: