সম্রাটদের নামে পত্রাবলী
হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে হযরত (স) ইসলামের দাওয়াত প্রচারের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। একদিন তিনি সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন : ‘হে জনমণ্ডলী! আল্লাহ তা’আলা আমাকে তামাম দুনিয়ার জন্যে রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছেন (আমার বাণী সারা দুনিয়ার জন্যে প্রযোজ্য এবং এটা সবার জন্যে রহমত স্বরূপ)। দেখো, ঈসার হাওয়ারীদের (সঙ্গী-সাথী) ন্যায় তোমরা মতানৈক্য করো না। যাও, আমার পক্ষ থেকে সবার কাছে সত্যের আহবান পৌঁছিয়ে দাও।’
এ সময়, অর্থাৎ ষষ্ঠ হিজরীর শেষ কিংবা সপ্তম হিজরীর শুরুতে তিনি বড়ো বড়ো রাজা-বাদশার নামে আমন্ত্রণ-পত্র লেখেন।৪৬ এসব পত্র নিয়ে বিনন্ন সাহাবীকে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। ইতিহাসে যে সব আমন্ত্রণ-পত্রের কথা উল্লেখিত হয়েছে, তার কয়েকটি নিম্নরূপঃ
১. রোম সম্রাট (কাইসার) হিরাক্লিয়াসের নামে পত্র - ওহিয়া কালবী (রা) নিয়ে যান।
২. পারস্য সম্রাট (কিসরা) খসরু পারভেজের নামে পত্র-হযরত আবদুল্লাহ বিন্ খাজাফা সাহমী (রা) নিয়ে যান।
৩. মিশরের শাসক আজীজের নামে পত্র-হযরত হাতিম বিন্ আবী বালতায়া (রা) নিয়ে যান।
৪. আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর নামে পত্র- হযরত উমর বিন্ উমাইয়া (রা) নিয়ে যান।
রোম সম্রাটের নামে
রোম সম্রাটের কাছে যে পত্র প্রেরিত হয়, তা নিম্নরূপঃ
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর বান্দাহ এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে রোমের প্রধান শাসক হিরাক্লিয়াসের নামে।
‘যে ব্যক্তি সত্যাপথ (হেদায়েত) অনুসরণ করে, তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর আমি তোমাকে ইসলামের দিকে আহবান জানাচ্ছি।’
‘আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য ও ফর্মাবর্দারী কবুল করো, তুমি শান্তিতে থাকবে। আল্লাহ তোমাকে দ্বিগুণ প্রতিফল দান করবেন। কিন্তু তুমি যদি আল্লাহর ফর্মবর্দারী থেকে বিমুখ হও তাহলে তোমার দেশবাসীর (অপরাধের) জন্যে তুমি দায়ী হবে। (কারণ তোমার অস্বীকৃতির কারণেই তাদের কাছে ইসলামের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছতে পারবে না।’
‘হে আহলি কিতাব ! এসো এমন একটি কথার দিকে, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান; তা এই যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবো না, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করবো না এবং আমাদের মধ্যেও কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে নিজের প্রভু বানাবো না। কিন্তু তোমরা যদি এ কথা মানতে অস্বীকৃত হও, তাহলে (আমরা স্পষ্টত বলে দিচ্ছি যে,) তোমরা সাক্ষী থাক, আমরা মুসলিম (অর্থাৎ আমরা শুধু খোদারই আনুগত্য ও বন্দেগী করে যাবে।’
আবু সুফিয়ানের সাথে কথাবার্তা
হযরত ওহিয়া কালবী (রা) এই পত্রগুলি বসরায় অবস্থানরত কাইসারের প্রতিনিধি হারি গাস্সালীর নিকট পৌঁছিয়ে দিলেন। গাস্সালী তখন কাইসারের অধীনে সিরিয়া শাসন করতো। সে পত্রখানি কাইসারের কাছে পাঠিয়ে দিলো। কাইসাস পত্র পেয়েই আরবের কোনো অধিবাসীকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। ঐ সময় বাণিজ্য উপলক্ষে আবু সুফিয়ান উক্ত এলাকায় অবস্থান করছিলো। কাইসারের কর্মচারীরা তাকেই দরবারে উপস্থিত করলো। তার সঙ্গে কাইসারের নিম্নরূপ কথাবার্তা হলো :
কাইসার ; নবুয়্যাতের দাবিদার লোকটির খান্দান কিরূপ?
আবু সুফি : সে শরীফ খান্দানের লোক।
কাইসার : এ খান্দানের কেউ আর কেউ নবুয়্যতের দাবি করেছিলো?
আবু সুফি : কক্ষনো নয়।
কাইসার : এই খান্দানে কেউ কখনো বাদশাহ ছিলো কি?
আবু সুফি : না।
কাইসার : যারা নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছে, তারা কি গরীব না ধনবান?
আবু সুফি : গরীব শ্রেণীর লোক।
কাইসার : তার অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে না হ্রাস পাচ্ছেঃ
আবু সুফি : ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
কাইসার : তোমরা কি তাকে কখনো মিথ্যা বলতে দেখেছো?
আবু সুফি : কক্ষনো নয়।
কাইসার : সে কি চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে থাকে?
আবু সুফি : এ পর্যন্ত সে কোনো চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেনি। তবে তার সাথে একটি নতুন চুক্তি (হুদাইবিয়া সন্ধি) সম্পাদিত হয়েছে। এখন সে চুক্তির উপর অটল থাকে কিনা , দেখা যাবে।
কাইসার : তোমরা তার সঙ্গে কখনো যুদ্ধ করেছো?
আবু সুফি : হ্যাঁ, করেছি।
কাইসার : যুদ্ধের ফলাফল কি হয়েছে?
আবু সুফি : কখনো আমরা জিতেছি, কখনো তার জয় হয়েছে।
কাইসার : সে লোকদের কি শিক্ষা দিয়ে থাকে?
আবু সুফি : সে বলে, কেবল এক খোদার ব্ন্দেগী করো। অপর কাউকে তার সঙ্গে শরীক করো না। নামায পড়ো। পুত-পবিত্র থাকো। সত্য কথা বলো। একে অপরের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করো ইত্যাদি।
এই কথাবার্তার পর কাইসার বললোঃ ‘পয়গাম্বর হামেশাই ভালো খান্দানে জন্মগ্রহণ করেন। যদি এ লোকটির খান্দানের প্রভাব বলে বিবেচনা করা যেতো-বলা যেতো, রাজত্বের লিপ্সায়ই হয়তো সে এই কৌশল অবলম্বন করেছে। কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়। আর যখন প্রমাণিত হয়েছে যে, লোকদের ব্যাপারে সে কখনো মিথ্যা কথা বলেনি, তখন সে খোদার ব্যাপারে এতো বড় মিথ্যা খাড়া করেছে (যে খোদা তাঁকে রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন), এটা কি করে বলা যায়? তাছাড়া পয়গাম্বরদের প্রথম দিককার অনুসারীরা স্বভাবতঃই গরীব শ্রেণীর লোক হয়ে থাকে। সত্য ধর্মও হামেশা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরন্ত এ-ও সত্য যে, পয়গাম্বররা কখনো কাউকে ধোঁকা দেন না, কারো সঙ্গে ফেরেববাজীও করেন না। সর্বোপরি, তোমরা এও বলছো যে, সে নামায-রোযা, পাক-পবিত্রতা, খোদা-নির্ভরতা ইত্যাদির উপদেশ দিয়ে থাকে। এ সব যদি সত্য হয়, তাহলে তাঁর আধিপত্য একদিন নিশ্চিত রূপে আমার রাজত্য পর্যন্ত পৌঁছবেই। আমি জানতাম যে, একজন পয়গাম্বর আসবেন; কিন্তু তিনি যে আরবেই জন্ম নেবেন, এটা আমার ধারণা ছিলো না। আমি যদি সেখানে যেতে পারতাম তো নিজেই তাঁর পা ধুয়ে দিতাম।’
কাইসারের এসব অভিমত শুনে তাঁর দরবারের পাদ্রী ও আলেমরা ভীষণ খাপ্পা হলো। এমন কি তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আশংকা পর্যন্ত দেখা দিলো। এই আশংকার ফলেই কাইসারের হৃদয়ে যে সত্যের আলো জ্বলে উঠেছিলো, তা আবার নিভে গেলো। বাস্তবিকই সত্যকে গ্রহণ করার পথে ধন-মাল ও ক্ষমতার মোহই সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
পারস্য সম্রাটের নামে
পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের নামে নিম্নোক্ত পত্র লেখা হলো :
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের তরফ থেকে পারস্যের প্রধান শাসক কিসরা সমীপে।
‘যে ব্যক্তি সত্যপথ (হেদায়েত) অনুসরণ করে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান পোষণ করে এবং এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি সমস্ত মানুষের জন্যে আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত পয়গাম্বর, যেনো প্রত্যেক জীবিত ব্যক্তিকে (আল্লাহর নাফরমানীর) মন্দ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করতে পারি। তুমিও আল্লাহর আনুগত্য ও ফর্মাবর্দারী কবুল করো। তোমার প্রতি শান্তি বর্ষিত হবে। নচেত অগ্নিপূজকদের পাপের জন্যে তুমি দায়ী হবে।’
খসরু পারভেজ ছিলো প্রবল প্রতাবান্বিত সম্রাট। তার কাছে প্রথম খোদার নাম, তারপর পত্র-প্রেরকের নাম এবং তারপর সম্রাটের নাম লেখা, তাও আবার নিতান্ত সাদাসিধা ভাবে,তদুপরি দরবারে প্রচলিত কায়দা-কানুন, লিখন-পদ্ধতি ও সম্বোধন রীতির ছাপ পর্যন্ত নেই- পত্র লেখার এ ধরণটাই ছিলো অসহ্য। খসরু পারভেজ এই পত্র দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো এবং বললো : ‘আমার গোলাম হয়ে আমায় এমনিভাবে পত্র লেখার স্পর্ধা! একথা বলেই সে পত্রখানি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো এবং এই নবুয়্যাতের দাবিদারকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে তার সামনে হাযির করার জন্যে তার ইয়েমেনস' গভর্নরকে নির্দেশ পাঠালো।
ইয়েমেনের গভর্নর হযরত (স)-কে ডেকে নেবার জন্যে তাঁর খেদমতে দুজন কর্মচারী পাঠিয়ে দিলো। এরই মধ্যে খসরু পারভেজের পুত্র তাকে হত্যা করে নিজেই সিংহাসন দখল করে বসলো। গভর্নর কর্তৃক প্রেরিত কর্মচারীদ্বয় যখন হযরত (স)-এর খেদমতে পৌঁছলো,তখর এ সম্পর্কে তারা কিছুতেই অবহিত ছিলো না। হযরত (স) আল্লাহর নির্দেশক্রমে এ কথা জানতে পারলেন। তিনি কর্মচারীদ্বয়কে এ ঘটনা অবহিত করে বললেন : “তোমরা ফিরে যাও এবং গভর্নরকে গিয়ে বলো, ইসলামের কর্তৃত্ব শীগগীরই খসরু পারভেজের রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছবে।’ কর্মচারীদ্বয় ইয়েমেনে ফিরে গিয়ে জানতে পারলো, খসরু পারভেজ সত্য সত্যই নিহত হয়েছে।
আবিসিনিয়ার নাজ্জাশী ও মিসরের আজীজের নামে
আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর কাছেও প্রায় অনুরূপ বিষয়-সম্বলিত পত্র প্রেরণ করা হলো। তার জবাবে তিনি লিখলেন : ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি খোদার সাচ্চা পয়গাম্বর।’ নাজ্জাশী হযরত জাফরের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, একথা ইতঃপূর্বে ‘আবিসিনিয়ায় হিজরত’ প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে।
মিশরের আজীজ যদিও চিঠি পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেন নি।, কিন্তু তিনি পত্র-বাহককে খুব সম্মান করেন এবং উপঢৌকন দিয়ে ফেরত পাঠান।
অধ্যায় ১১ : সম্রাটদের নামে পত্রাবলী
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: