অধ্যায় ১০ : উহুদ যুদ্ধ, উত্তরাধিকার আইন, আহযাব যুদ্ধ, বনু কুরাইজা

উহুদ যুদ্ধ
হিজরী তৃতীয় সন। শাওয়াল মাস। কুরাইশ মুশরিকরা বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে মদীনার দিকে অগ্রসর হয়। মদীনার প্রায় চার মাইল দূরে উহুদ পাহাড়। কুরাইশ বাহিনী উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাদের ছাউনী ফেলে। তাদের যোদ্ধার একটি বাহিনী উহুদের দিকে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই তার অনুগত তিনশত লোক নিয়ে মুসলিম বাহিনী থেকে সরে পড়ে। মাত্র সাত শত যোদ্ধা নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা) তিন হাজার যোদ্ধার সম্মুখীন হন। এই অসম যুদ্ধে মুসলিমরা বীর বিক্রমে লড়াই করেন। সত্তর জন মুসলিম শহীদ হন। আল্লাহর রাসূল (সা) গুরুতর আহত হন। এই যুদ্ধে কারোই চূড়ান্ত বিজয় হয়নি। তবে কুরাইশরা মদীনায় প্রবেশ না করেই ফিরে যায়। উহুদের যুদ্ধের পর মুমিনদের প্রশিক্ষণের জন্যে আল্লাহ যেই বাণী পাঠান তার একাংশে বলা হয়.
মন ভাংগা হয়ো না, চিন্তা ক্লিষ্ট হয়ো না। তোমারই বিজয়ী থাকবে যদি তোমরা সত্যিকার মুমিন হও। এখন যদি তোমাদের উপর কোন আঘাত এসে থাকে, ইতি পূর্বে অন্য দলের উপরও অনুরূপ আঘাত এসেছে। এটা তো কালের পরিবর্তন যা আমি মানুষের মধ্যে আবর্তিত করে থাকি।
এটা এজন্য এসেছে যে আল্লাহ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে কারা খাঁটি মুমিন এবং তোমাদের মধ্যে থেকে কিছু শহীদ তিনি গ্রহণ করতে চান। যালিমদেরকে আল্লাহ মোটেই পছন্দ করেন না। এই পরীক্ষার মাধ্যমে খাঁটি মুমিনদেরকে আলাদা করে কাফিরদেরকে ধ্বংস করতে চান। তোমরা কি ভেবেছো যে তোমরা একনিতেই জান্নাতে চলে যাবে অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি যে তোমাদের মধ্যে এমন কারা আল্লাহর পথে লড়াই করতে প্রস্তুত এবং কারা ছবর অবলম্বন কারী। আলে ইমরান : ১৩৯-১৪২
উত্তরাধিকার আইন প্রবর্তন
উহুদ যুদ্ধে ৭০ জন মুসলিম শহীদ হন। ফলে তাদের পরিত্যক্ত জমিজমা ও অন্যান্য সম্পদ বন্টন সম্পর্কে ইসলামের পথ নির্দেশ জানার প্রয়োজন দেখা দেয়। সেই সময়টিতে আল্লাহ উত্তরাধিকার আইন নাযিল করেন-
তোমরাদের সন্তান সম্পর্কে আল্লাহ এই বিধান দিচ্ছেন-
পুরুষের অংশ দুইজন মেয়েলোদকের সমান হবে। যদি দুইজনের অধিক কন্যা হয় তবে তাদেরকে পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ দেয়া হবে। আর একজন কন্যা হলে তার জন্য অর্ধেক। মুত ব্যক্তির সন্তান থাকলে তার আব্বা-আম্মা প্রত্যেকেই সম্পত্তির ষষ্ঠ অংশ পাবে। আর মৃত ব্যক্তি যদি নি:সন্তান হয় এবং আব্বা-আম্মাই তার উত্তরাধিকারী হয় তবে আম্মাকে দেয়া হবে তিন ভাগের এক ভাগ। আর মৃত ব্যক্তির যদি ভাই-বোন থাকে তবে আম্মা ষষ্ঠ ভাগের হকদার হবে। এইসব অংশ বন্টন করে দেয়া হবে মৃতের ওয়াসিয়াত পূর্ণ করা ও তার সব ঋণ আদায় করার পর। সূরা আন নিসা: ১১
আল্লাহ আরো বলেন,
আর তোমাদের স্ত্রীরা যা কিছু রেখে গেছে অর্ধেক তোমরা পাবে যদি তারা নি:সন্তান হয়। আর সন্তানশীলা হলে রেখে যাওয়া সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ তোমরা পাবে তখন যখন তাদের ওয়াসিয়াত পূরণ করা হবে ও তাদের ঋণ আদায় করে দেয়া হবে। আর তারা তোমাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির এক চুতুর্থাংশের অধিকারিণী হবে যদি তোমরা নি:সন্তান হও। আর তোমাদের সন্তান থাকলে তারা পাবে আট ভাগের একভাগ। তাও কার্যকর হবে যখন তোমাদের ওয়াসিয়াত পূর্ণ করা হবে। ও যেই ঋণ তোমারা রেখে গেছো তা আদায় করা হবে।
সেই পুরুষ কিংবা স্ত্রী যদি নি:সন্তান হয় এবং তার আব্বা-আম্মা যদি জীবিত না থাকে, কিন্তু তার এক ভাই কিংবা এক বোন যদি জীবিত থাকে তবে ভাই-বোনদের প্রত্যেক ছয় ভাগের একভাগ পাবে। আর যদি ভাই-বোন এর বেশী হয় তাহলে সমস্ত পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশে তারা সকলে শরীক হবে তখন যখন ওয়াসিয়াত পূরণ করা হবে ও মৃত ব্যক্তির ঋণ আদায় করে দেয়া হবে। অবশ্য শর্ত এই যে তা যেন ক্ষতিকর না হয়। এই আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও পরম ধৈর্যশীল। সূরা আন নিসা : ১২
আল্লাহর রাসূল (সা) মাদীনা রাষ্ট্রে এই উত্তরাধিকার আইন প্রবর্তন করেন।
বানু নুদাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযান
ইয়াহুদীদের আরেকটি গোত্র ছিলো বানু নুদাইর।
এরা চুক্তি শর্ত উপেক্ষা করে মক্কার মুশরিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতো। তারা রাসূলকে (সা) গোপনে হত্যা করার চেষ্টাও করে কয়েকবার। তাদের বিরুদ্ধে একটি বাহিনী প্রেরণ করা হয়। তারা তাদের দুর্গে আশ্রয় নেয়। প্রচুর রসদ নিয়ে ঢুকে ছিলো তারা দুর্গে। ১৫৫ দিন তারা অবরুদ্ধ ছিলো। অবশেষে অবস্থা বেগতিক দেখে তারা সন্ধি করতে প্রস্তুত হয়। এই মর্মে সন্ধি হয় যে উটের চাপিয়ে যেই পরিমাণ সম্পদ নেয়া যায় তা নিয়ে তারা মদীনা ছেড়ে চলে যাবে। বানী নুদাইর মদীনা ছেড়ে খাইবার এসে অন্যান্য ইয়াহুদীদের সাথে মিলিত হয়।
আহযাব যুদ্ধ
খাইবার বসে ইয়াহুদীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে। তারা নিকটবর্তী অঞ্চলের লোকদেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। তাদের প্রতিনিধিদল মক্কায় গিয়ে মুশরিকদেকে যুদ্ধের উস্কানি দেয়। অবশেষে ইয়াহুদী ও কুরাইশদের প্রচেষ্টায় দশ হাজার লোকের একটি বিরাট বাহিনী গঠিত হয়। যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর পৌঁছে মদীনায়। আল্লাহর রাসূল (সা) এবার মদীনাতে থেকেই শত্রুর মুকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বসেন যুদ্ধ বিশারদরা। সিদ্ধান্ত হলো শত্রুর গতিরোধ করার জন্যে শহরের বাইরে গভীর ও প্রশস্ত খাল কাটা হবে।
মদীনার খোলা দিকটায় খাল খনন শুরু হয়। তিন হাজার মুসলিম খাল খনন কাজে অংশ নেন। আল্লাহর রাসূল (সা) এতে অংশ নেন। পাঁচ গজ চওড়া ও পাঁচ গভীর খালটি তৈরী হলো বিশ দিনে। দশ হাজার শত্রুসেনা তিন দিক থেকে মদীনা আক্রমণ করে। অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন মুসলিমরা।প্রধানত তীরের লড়াই চলতে থাকে। খাল পার হবার বহু চেষ্টা করেছে শত্রুসেনারা। মুসলিম তীরন্দাজরা তাদের সব চেষ্টা প্রতিহত করেন। মুসলিমদের রসদ ছিলো সীমিত। খাদ্য গ্রহণের সুযোগ পর্যন্ত তাঁরা বড্ড একটা পাননি। প্রায় একমাস স্থায়ী হয় অবরোধ। একদিন প্রচন্ড ঝড় নামে। ঝড়ে কাফিরদের ছাউনী উড়ে যায়। যোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াহুদীরা আগেই কেটে পড়েছিলো। বাকী ছিলো কুরাইশরা। তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। অবরোধ তুলে নিয়ে মক্কার দিকে রওয়ানা হয়। আল্লাহর অনুগ্রহে মুসলিমরা বিজয় লাভ করেন। এটি হিজরী পঞ্চম সনের ঘটনা। এই যুদ্ধের পর মুমিনদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ যেই বাণী নাযিল করেন তার একাংশে বলা হয়-
ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহর সেই অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর যখন তোমাদের উপর মিলিত বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং আমি তাদের উপর প্রচন্ড ঝড় বইয়ে দিলাম ও এমন সৈন্য পাঠালাম যা তোমরা দেখতে পাওনি। সূরা আল আহযাব : ৯
বানু কুরাইজার বিরুদ্ধে অভিযান
বানু নুদাইর মাদীনা থেকে চলে যাবার কালে বানু কুরাইজার ইয়াহুদীরা নতুন ভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মদীনায় থাকাই পছন্দ করে। আল্লাহর রাসূল (সা) তাদেরকে সেই সুযোগ দেন।
আহযাব যুদ্ধের সময় বাইরের ইয়াহুদী গোত্রগুলোর পরামর্শে বানু কুরাইজা কুরাইশদের সাথে মিলিত হয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তারা মুসলিমদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির কোন তোয়াক্কাই করলো না।
আহযাব যুদ্ধ শেষে এই বিশ্বাসঘাতকতাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য মুসলিমরা বানু কুরাইজার দুর্গ অবরোধ করেন। এই অবরোধ প্রায় একমাস স্থায়ী হয়। অবশেষে মুসলিমরা ইয়াহুদীদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভাংগতে সক্ষম হন। এই গোত্রের অপরাধী যোদ্ধাদেরকে হত্যা করা হয় ও বাকীদেরকে বন্দী করে রাখা হয়। এই ভাবে ষড়যন্ত্রকারী ইয়াহুদী চক্র খতম হয়।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম