চতুর্থ অধ্যায় : বাংলাদেশে শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারার প্রভাব

ওয়ালিউল্লাহ চিন্তাধারার ফসল

ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা এহেন যুক্তিগ্রাহ্য ও সুসংগঠিত খসড়া পেশ হবার অর্থই হলো এই যে, তা সকল সুস্থ প্রকৃতি ও বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তির জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হবে, আর তাদের মধ্যে যারা অধিকতর ক্ষমতার অধিকারী তাঁরা এ লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে আসবে। শাহ সাহেব জাহেলী রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেই ক্ষান্ত হননি, এ ব্যাপারটাকে বার বার এমনভাবে বর্ণনা করেছেন, যাতে ঈমানদারদের পক্ষে জাহেলী রাষ্ট্র খতম করে সে স্থলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচেষ্টা না চালিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ও ইযালাতুল খফিাতে এ বিষয়টির উপর সর্বাধিক জোর দেয়া হয়েছে। এ গ্রন্থটিতে তিনি হাদীসের সাহায্যে প্রমাণ করেন যে, ইসলামী ফেলাফত ও রাজতন্ত্র দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস অতপর একদিকে রাজতন্ত্র এবং সে সব বিপর্যয়কে স্থাপন করেন, যেগুলো ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে রাজতন্ত্রের পথে মুসলমানদের সামাষ্টিক জীবনে অনুপ্রবেশ করে এবং অন্যদিকে ইসলামী খিলাফতের বৈশিষ্ট্য ও শর্তাবলী এবং সে সব অবদান পেশ করেন, যা ইসলামী খিলাফত আমলে প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের মধ্যে অনুসৃত হয়।  এরপরও মুসলমানদের পক্ষে নিশ্চিন্তে বসে থাকা কি করে সম্ভব হতে পারে? আর পারে না বলেই শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর ইনতিকালের (১৭৮৬-১৮৩১) অর্ধশতক অতিক্রান্ত হবার আগেই ভারতবর্ষে সাইয়েদ আহমদ বেরেলবী ও ইসমাইল শহীদ দেহলভীর নেতৃত্বে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিার আন্দোলনের উদ্ভব হয়। তারা একটি অস্থায়ী রাষ্ট্র গঠন করেন। অবশ্য কতিপয় বৈষায়িক কারণে তা সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও তার প্রভাব উপমহাদেশে এখনও বিদ্যমান। অবিভক্ত পাকিস্তান আন্দোলনের পশ্চাতে সেই আন্দোলনের প্রভাব কাজ করেছে এবং বলতে কি এ অঞ্চলে খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন প্রকট, মূলত এটাও ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারার ও বালাকোটে ইসলামী আন্দোলনের মুজাহিদদের চরম আত্মত্যাগেরই ফল। কেননা, বালাকোটের ব্যর্থতার পর যখন উপমাহাদেশের মুসলমানদের উপর বিজাতীয় কর্তৃত্ব প্রার্ধান্য লাভ করে, তখনও আলিম সমাজ নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকেননি, তাঁরা ঘোর তামসার মধ্যেও ইসলামের নিভু নিভু দীপশিখা জ্বালিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তাঁরা পরিকল্পনার মাধ্যমে উপমহাদেশে জালের ন্যায় দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-মাদ্রাসা সমূহ কায়েম করে এগুলোর মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখেছেন। এ পরিকল্পনাধীন মাদ্রাসা সমূহের মধ্যে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দই ছিল প্রধান। আযাদী ও ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্টিত দারুল উলুম দেওবন্দ ও এ জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হয়, পরবর্তী পর্যায়ে খিলাফত আন্দোলনের মধ্যে তারই অভিব্যক্তি ঘটে। তাই উপমহাদেশের মুসলিম জাগরণ ও পরবর্তীকালে পাকিস্তান আন্দোলন ও বর্তমানে এদেশসহ সারা মুসলিম দুনিয়ায় যে ইসলামের নবজাগরণের পূর্বাভাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে এটাকে নির্দ্বিধায় ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারা ও তাঁর বংশধর ও অনুসারীদের আন্দোলনেরই ফলশ্রুতি বলতে হয়।

উল্লেখযোগ্য যে, শাহ ওয়ালিউল্লাহর আকাংখিত ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টির উদ্দেশ্য উপমহাদেশে প্রথম ইসলামী আন্দোলন (বালাকোট) এবং পরবর্তী পর্যায়ে সিপাহী বিপ্লব, বাংলাদেশে ফরায়েযী আন্দোলন, হাজী তিতুমীর মুন্সী মেহেরুল্লাহর আন্দোলন প্রভৃতি সকল জাতীয় জাগরণের পটভূমি রচনায় যে মহাপ্রাণ ব্যক্তির মাধ্যমে শাহ সাহেবের চিন্তাধারা কাজ করেছিল তিনি ছিলেন তাঁরই সুযোগ্য জ্যেষ্ঠপুত্র শাহ আবদুল আযীয (রহ) (১৭৪৭-১৮২৪ খৃষ্টাব্দ)। পিতার ইনতিকালের পর সমসাময়িক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে উক্ত মহান লক্ষ্যের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি পিতৃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের১ মাধ্যমে প্রথমে দীনী শিক্ষার ব্যাপক প্রচারের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। আজকের উপমহাদেশে অগণিত ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর প্রত্যেকটি প্রত্যক্ষা বা পরোক্ষভাবে উক্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত। শাহ আবদুল আযীযের মাধ্যমে অসংখ্য লোক বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তন্মোধ্যে তাঁর চার ভ্রাতা, উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত সাইয়েদ আহমদ শহীদ ও ইসলামঈল শহীদ দেহলভীসহ কতিপয় প্রখ্যাত শিষ্যের নাম নিন্মে প্রদত্ত হলো: (১) মওলানা শাহ রফীউদ্দিন, (২) মওলানা শাহ আবদুল কাদের, (৩) মওলানা শাহ আবদুল গনী, (৪) মওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসহাক, (৫) শাহ মুহাম্মদ ইয়াকুব, (৬) মওলানা শাহ মুহাম্মদ আবদুল হাই, (৭) মওলানা শাহ মুহাম্মদ ইয়াকুব, (৮) সাইয়েদ আহমদ শহীদ, (৯) মওলানা রশীদুদ্দীন, (১০) মওলানা মুফতী সদরুদ্দীন, (১১) মুফতী এলাহী বখশ, (১২) হযরত শাহ গোলাম আলী, (১৩) মওলানা মাখসুল্লাহ, (১৪) মওলানা করীমুল্লাহ, (১৫) মওলানা মীর মাহবুব আলী, (১৬) মওলানা আবদুল খালেক, (১৭) মওলানা হাসান আলী লক্ষৌভী, (১৮) মওলানা হোসাইন আহমদ মলীহাবাদী প্রমুখ।

শাহ আবদুল আযীয (রহ) এর শিক্ষাদানেরবিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল-

(১) ইমাম শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারাকে মন-মস্তিষ্ক দিয়ে উপলিব্ধি করা, (২) আল্লাহভীতি ও আদর্শ জীবন গঠনের প্রেরণা লাভ, (৩) রাজতন্ত্র ও

১. উল্লেখ্যযোগ্য যে, ইমাম সাহেব হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর পুরাতন রহীমিয়া মাদ্রাসায় ছাত্র সংখ্যার আধিক্য হেতু সম্রাট মুহাম্মাদ শাহ কর্তৃক মাদ্রাসার জন্য যে বিশাল অট্টালিকাটি প্রদত্ত হয়েছিলো সেটি ১৮৫৭ সালের হাঙ্গামায় ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।

সরকার তোষণ মনোভাব মন-মস্তিষ্ক থেকে দূর করা, (৪) ইসলামী বিপ্লবকে পরিপূর্ণ জয়যুক্ত করণার্থে ত্যাগের স্পৃহা সৃষ্টি করা, (৫) সমাজসেবা ও দু:স্থ মানবতার প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করা, (৬) রাজকীয় বিলাসিতা পরিহার করে সহজ-সরল জীবন-যাপন করা, (৭) জিহাদী ভাবধারা সৃষ্টি করা এবং যে কোন দুর্যোগ মুহূর্তে ধৈর্য ও সহনশীলতার অনুশীলন করা, (৮) সমাজ বিধ্বংসী সকল প্রকার অনাচার, কুসংস্কার ও রীতিনীতি উৎখাতের চেষ্টা করা, (৯) বিলাসিতার আড্ডাখানাসমূহের অবসান করা, যা সমাজকে আরাম প্রিয় ও দুর্বল করে তোলে। এ ছাড়া, শাহ আবদুল আযীয (রহ) রীতিমতো সপ্তাহে দু’বার মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী আদর্শ, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও উপরিউক্ত বিষয়সমূহের ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্যে জনসভায় বক্তৃতা করতেন।

বাংলাদেশে শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারার প্রভাব

শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারা ও রচনাবলীর ফলে, সার্বিকভাবে সমস্ত উপমহাদেশে উপকৃত হলেও বাংলাদেশে তাঁর চিন্তাধারার বিস্তার লাভের যে সব কারণ দেখা যায়, তন্মধ্যে দেওবন্দে শিক্ষাপ্রাপ্ত আলিমরা ছাড়াও তার পূর্বে ১৭৮১ সালে শাহ ওয়ালিউল্লাহর শাগরিদ মওলবী মজদুদ্দীন ওরফে মোল্লা মদনের ব্যক্তিত্ব ও অধ্যাপনাও কম কাজ করেনি।তিনি ১৭৬৪ সালে দিল্লী থেকে কলকাতা আসেন। এখানে তিনি একান্ত অজ্ঞাত জীবন-যাপন করতেন। কিন্তু আগুন কখনও কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় থাকে না। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হলো না। তাঁর জ্ঞান-গরিমা ও আল্লাহভীরুতার সঙ্গে পরিচিত স্থানীয় মুসলমান সুধীবৃন্দ তাঁকে কাজে লাগাবার কথা চিন্তা করলেন। তাঁরা একটি ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা ভাবলেন। তাঁরা এ ব্যাপারে তদানীন্তন বড়লার্ট লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসকে অনুরোধ করলে তিনি তাঁদের কথায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে সায় দেন তিনি মন্তব্য করলেন “হ্যাঁ, সরকারী কাজে সাহায্য করতে পারে এরূপ এক শ্রেণীর কর্মচারী তৈরীর জন্যও সরকারের এ প্রকার একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। অতপর ১৭৮১ সালেরর অক্টোবরে কলকাতা শহরের বৈঠকখানা অঞ্চলে একটি মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। আর মোল্লা মদন তারই প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন।

বস্তুত ঐ মাদ্রসারই পরে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা হিসাবে পরিচিত হয়। অবশ্য ঐ পরিবেশে কলকাতার উক্ত মাদ্রাসা ঐ মাদ্রসা থেকে ওয়ালিউল্লহ’র চিন্তাধারার আশানুরূপ বিকাশ ঘটা কতদূর সম্ভব ছিল তা স্বতন্ত্র কথা। তবে আমরা বর্তমানে যতদূর দেখতে পাই, পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয় যে, একালে শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারা ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলন ও আযাদী আন্দোলনের কর্মীদের দ্বারা যে দেওবন্দ দারুল উলুম প্রিতষ্ঠিত হয়েছিল এবং কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার কাজ প্রথম যে মহান ব্যক্তির দায়িত্বে শুরু হয়েছিল পরবর্তীকালে সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছুরিত আলোর ফলশ্রুতি হিসাবেই উপমহাদেশে পাকিস্তানের ন্যায় একটি ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সৃষ্টি হলো: আজ ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের শাখা-প্রশাখা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত আলিম-উলামাদের কিছু সংখ্যক ছাড়া অনেকের মধ্যেই উক্ত বিপ্লবী ভবধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায় না? যুগ সমস্যার, যুগ জিজ্ঞাসা ও আধুনিক নানাবিধ বাতিল মতবাদ ও চিন্তাধারার চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করার মতো যে ধরনের এবং যে পরিমাণ যোগ্য আলিমের প্রয়োজন ছিল, ঐ সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান তা প্ররিবেশন করতে সমর্থ হচ্ছে না, তারই পরিণতিতেই হয়তো যোগ্য ইসলামী নেতৃত্বের অভাব ঘটায় ইসলামের নামে এদেশ অর্জিত হলেও আজও এখানে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়ে উঠছে না বরং দিনের পর দিন পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। সম্ভবত দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষা-পদ্ধতি ও এ শিক্ষার মূল লক্ষ্য নির্ধারণের ব্যাপারে কোনরূপ ব্যতিক্রম অথবা দীনী চিন্তার গরমিলের দরুনই এমনটি হতে চলেছে। এ ব্যাপারে উলামা নেতৃবৃন্দের আজ নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম