১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি পদদলিত করে মাত্র পাঁচ দিনে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুসলিম দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদ গ্রাস করে। হায়দরাবাদ দখলের সামরিক অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল অপারেশন পলো। সর্বাত্মক সামরিক অপারেশন হলেও ভারতের কাছে এ অভিযান ‘পুলিশি অভিযান’ হিসেবে পরিচিত। ভারতীয় সৈন্যদের স্বাগত জানাতে ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর থেকে ভয়ার্ত জনতা রাজধানী সিকান্দারাবাদ মাঠে সমবেত হয়। বুটের তলায় পিষ্ট হওয়ার ভয়ে জনতা ভারতীয় সাঁজোয়া যানে ফুল ছিটিয়ে দেয়। জনতা স্লোগান দেয়, জয় হিন্দ, মহাত্মা গান্ধী কি জয়, পণ্ডিত নেহরু জিন্দাবাদ, সরদার প্যাটেল জিন্দাবাদ, জেনারেল চৌধুরী জিন্দাবাদ, হিন্দুস্তানি ফৌজ জিন্দাবাদ, ভারত মাতা কি জয়। সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন ভোর ৬টা নাগাদ কারফিউ জারি করা হয়। জনতা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়িঘরে ছুটে যায়। চার দিকে নেমে আসে কবরের নিস্তব্ধতা। শুরু হয় একটি জাতির পরাধীনতার ইতিহাস। শক্তি প্রয়োগ করা না হলে হায়দরাবাদ আজো স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে থাকত। ভারত এ দেশীয় রাজ্যে শুধু অন্যায় আগ্রাসন চালিয়েছে তাই নয়, ভারতীয় সৈন্যরা সেখানে নির্মম গণহত্যা চালায় এবং ধর্ষণে লিপ্ত হয়। প্রচারণার জোরে একটি কালো দিনকে মুক্তি ও স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় পৃথিবীর ইতিহাসের নির্মম গণহত্যার একটি উপাখ্যান। বিশ্ববাসী কথায় কথায় বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, সাবেক যুগোস্লাভিয়া, সিয়েরালিয়ন ও রুয়ান্ডায় সংঘটিত গণহত্যা এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি হলোকাস্টের ট্রাজেডি স্মরণ করে, স্মরণ করে না কেবল হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের গণহত্যা। আজ পর্যন্ত কোথাও কেউ হায়দরাবাদে গণহত্যার জন্য ভারতের বিচার দাবি করেনি। কাউকে ভারতের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতেও দেখা যায় না। কী বিচিত্র পৃথিবী!
হায়দরাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় এজেন্ট জেনারেল কে এম মুন্সী ছিলেন সব ঘটনার সাী। কিন্তু ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ দ্য এন্ড অব অ্যান অ্যারাতে সব সত্য চাপা দিয়েছেন। ভারতীয়রা নিজেদের কৃত অপরাধ চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও সত্য তার নিজের শক্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে। আমেরিকান পর্যটক উইলিয়াম ডালরিম্পল হায়দরাবাদ সফরে গিয়ে সেখানে বিজয়ী ভারতীয় সৈন্য ও তাদের স্থানীয় হিন্দু দোসরদের গণহত্যার সুস্পষ্ট প্রমাণ খুঁজে পান। তিনি তার দ্য এজ অব কলি শিরোনামে গ্রন্থের ২০৯-১০ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘পুলিশি অভিযানে নিহতদের আনুমানিক একটি সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব বলে আমি উপলব্ধি করি। দিল্লিতে গণহত্যার রিপোর্ট এসে পৌঁছতে শুরু করলে নেহরু ‘তার ব্যক্তিগত মতাবলে’ নিজামের শাসনের কট্টর বিরোধিতাকারী ও কংগ্রেসের প্রবীণ সদস্য হায়দরাবাদের দু’জন মুসলমান এবং হিন্দু পণ্ডিত সুন্দরলালের নেতৃত্বে একটি বেসরকারি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। এ টিম হায়দরাবাদে ব্যাপকভাবে সফর করে এবং ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে নেহরু ও সরদার প্যাটেলের কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা থাকায় এ তদন্ত রিপোর্ট কখনো প্রকাশ করা হয়নি। রিপোর্টের একটি অংশ ভারতের বাইরে পাচার হওয়া নাগাদ তা ছিল অপ্রকাশিত। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ‘হায়দ্রাবাদ : আফটার দ্য ফল’ শিরোনামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থে এ উপাখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। এ গ্রন্থে ‘অপারেশন পলো-পরবর্তী হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ এবং হায়দরাবাদ রাজ্যে সম্পত্তি দখল’ শিরোনামে একটি রিপোর্টে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। এ রিপোর্টে হায়দরাবাদ রাজ্যে গ্রামের পর গ্রামে ভারতীয় সৈন্যদের হত্যা, গণধর্ষণ এবং নিরস্ত্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিধনে স্থানীয় হিন্দু গুণ্ডাদের পরিকল্পিত অপরাধের নির্মোহ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। একটি ছোট্ট ঘটনার বর্ণনা থেকে গোটা পরিস্থিতি আঁচ করা সম্ভব:
গাঞ্জোটি পায়গাঁও, ওসমানাবাদ জেলা : এখানে মুসলমানদের ৫০০ বাড়ি ছিল। গুণ্ডারা ২০০ মুসলমানকে হত্যা করে। সেনাবাহিনী মুসলমানদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়। মুসলমানেরা অরতি হয়ে গেলে গুণ্ডারা হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে। সৈন্যরা মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণ করে। গাঞ্জোটির পাশা বাঈ বলেছেন, সেনাবাহিনী এসে পৌঁছানোর পর গাঞ্জোটিতে গোলযোগ শুরু হয়। এখানকার সব যুবতী মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। ওসমান সাহেবের পাঁচ কন্যা এবং কাজী সাহেবের ছয় কন্যাকে ধর্ষণ করা হয়। সাইবা চামারের বাড়িতে ইসমাইল সাহেব সওদাগরের কন্যাকে এক সপ্তাহ ধর্ষণ করা হয়। ওমরগাঁও থেকে সৈন্যরা প্রতি সপ্তাহে আসত এবং সারা রাত ধর্ষণের পর যুবতী মুসলিম মহিলাদের সকালে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হতো। মাহতাব তাম্বুলির কন্যাদের হিন্দুদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়া হয়। বুর্গা জুলাহার বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল একজনকে।
রিপোর্টের প্রতিটি পৃষ্ঠার বর্ণনা অভিন্ন। তাতে বলা হয়, ‘পুলিশি অভিযানে’ হায়দরাবাদে মোট দুই লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। নিহতদের এ সংখ্যা অবিশ্বাস্য। রিপোর্টের বর্ণনা সত্যি হয়ে থাকলে উপমহাদেশ বিভক্তিকালে পাঞ্জাবে সংঘটিত গণহত্যার সাথে হায়দরাবাদে ‘পুলিশি অভিযানের’ রক্তগঙ্গাকে তুলনা করা যায়। কেউ হয়তো দুই লাখকে অতিরঞ্জিত মনে করতে পারেন। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, এ হত্যাকাণ্ড ছিল ভয়াবহ। জাতিসঙ্ঘে ভারতীয় প্রতিনিধি দাবি করেছিলেন, নিজামের সৈন্যরা তাদের চৌকি পরিত্যাগ করার পর কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। এ বিশৃঙ্খলাকালে হিন্দুরা নিজামের স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে কথিত তাদের দুর্ভোগের প্রতিশোধ গ্রহণ করে। নেহরু প্রকাশ্যে হায়দরাবাদে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করলেও একান্তভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে সরদার প্যাটেলের মন্ত্রণালয়ে নেহরুর পাঠানো একটি চিঠিতে তার প্রতিফলন ঘটেছে। চিঠিতে নেহরু উল্লেখ করেছিলেন, ‘তিনি শিউরে ওঠার মতো বিপুল মুসলিম হত্যাকাণ্ড এবং অবিশ্বাস্য মাত্রায় মুসলমানদের সম্পত্তি লুণ্ঠনের রিপোর্ট পেয়েছেন। এসব ঘটনা পণ্ডিত সুন্দরলালের রিপোর্টের সার্বিক ধারণাকে সত্যি বলে প্রমাণ করছে।’
ইসলামি ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক উইলফ্রেড কার্টওয়েল স্মিথও হায়দরাবাদে মুসলিম গণহত্যা সম্পর্কে আমেরিকান পর্যটক উইলিয়াম ডালরিম্পলের অনুরূপ মতামত দিয়েছেন। ১৯৪৯ সালে হায়দরাবাদ সফর শেষে তিনি লিখেছেন, ‘রণাঙ্গনের বাইরে মুসলিম সম্প্রদায় ব্যাপক ও নৃশংস দুর্ভাগ্যের শিকার হয়। হাজার হাজার লোককে হত্যা এবং লাখ লাখ লোককে গৃহহীন করা হয়। অবশ্যই প্রতিহিংসা তাদের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বিশেষ করে এ রাজ্যের মারাঠারা এবং অন্যান্য এলাকায় এখনো প্রতিহিংসার নিষ্ঠুর স্বার বিদ্যমান। ‘পুলিশি অভিযানের’ পরবর্তী দিনগুলোর উপাখ্যান খুবই করুণ।’
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসতার রিপোর্ট প্রণয়নে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। এ তদন্ত কমিটি নেহরুর কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টটি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু ফাঁক ফোকর দিয়ে এ রিপোর্ট ফাঁস হয়ে যায়। মুসলিম দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসতার বিবরণ সংবলিত অতি গোপনীয় এ রিপোর্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো :
প্রতি,
০১. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ভারত সরকার, নয়াদিল্লি।
০২. মাননীয় রাজ্যমন্ত্রী, ভারত সরকার, নয়াদিল্লি।
মহোদয়,
ভারত সরকার আমাদেরকে হায়দরাবাদ রাজ্যে একটি শুভেচ্ছা সফরে যাবার জন্য অনুরোধ করে। আমাদের কাজ শেষ করে এখন আমরা আমাদের রিপোর্ট পেশ করছি।
০১. পণ্ডিত সুন্দরলাল, কাজী আবদুল গফুর ও মাওলানা আবদুল্লাহ মিসরির সমন্বয়ে গঠিত এই প্রতিনিধিদল ২৯ নভেম্বর হায়দরাবাদে গিয়ে পৌঁছে এবং ১৯৪৮ সালের ২১ ডিসেম্বর নয়া দিল্লিতে ফিরে আসে। এ সময় আমরা রাজ্যের ১৬টির মধ্যে ৯টি জেলা, সাতটি জেলা সদর, ২১টি শহর ও ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম সফর করেছি। এ ছাড়া আমরা এ ধরনের ১০৯টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক লোকের সাাৎকার গ্রহণ করেছি।
প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ৩১টি জনসমাবেশ এবং হিন্দু, মুসলিম, কংগ্রেস সদস্য, জমিয়ত উলেমা ও ইত্তেহাদুল মুসলিমীনের কর্মকর্তা, কয়েকটি শিাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও ছাত্র, প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এবং হিন্দুস্তানি প্রচার সভার ২৭টি ঘরোয়া সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন।
আমরা যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও কর্মকর্তার সাাৎকার গ্রহণ করেছি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হায়দরাবাদের মহামান্য নিজাম, বেরারের মহামান্য প্রিন্স, মেজর জেনারেল চৌধুরী, মি. বাখলু, মুখ্য বেসামরিক প্রশাসক, স্বামী রমানন্দ তীর্থ, ড. মালকোত, রামচন্দ্র রাও, রামাচার্য, কে. বৈদ্য, ভেঙ্কট রাও, আবুল হাসান সৈয়দ আলী, নওয়াব আলী ইয়ার জং, নবাব জৈন ইয়ার জং, রাজা ধোন্দি রাজ, মাওলানা আবু ইউসূফ, মৌলভী আবদুল খায়ের ও মৌলভী হামিদউদ্দিন কামার ফারুকী।
এসব সমাবেশ ও সাাৎকারে আমরা দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বজায় রাখার মূল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। নিজেদের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করার এবং অতীতের তিক্ততা ভুলে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছি। তাদের কাছে ভারত সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছি এবং হায়দরাবাদের জনগণের জন্য একটি ধর্মনিরপে সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছি। আমরা তাদের সামনে ব্যাখ্যা করেছি যে, ধর্মনিরপে সরকারে ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণী নির্বিশেষে তাদের সবাই সমান অধিকার ও নাগরিক সুবিধা ভোগ করবে এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সবার সমান সুযোগ-সুবিধা থাকবে। তাদেরকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ নীতি বাস্তবায়ন করা হলো সামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব। সুযোগ পাওয়া মাত্র আমরা আমাদের অবস্থানের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছি যে, পুলিশি অভিযানের আগে বা পরের ঘটনাবলি তদন্ত বা অনুসন্ধান করার জন্য কোনো কমিশন হিসেবে আমরা কাজ করছি না। আমরা এসেছি একটি শুভেচ্ছা মিশনে এবং আমাদের দায়িত্ব হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করা। একই সঙ্গে আমরা যা প্রত্য করেছি এবং আমাদের সফরকালে যেসব তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি সেসব তথ্য আপনার নজরে আনা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। আমাদের মতে, এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ।
০২. ১৬টি জেলা এবং আনুমানিক ২২ হাজার গ্রাম নিয়ে হায়দরাবাদ রাজ্য গঠিত। এসব জেলার মধ্যে মাত্র তিনটি পুরোপুরি না হলেও বাস্তবে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ থেকে মুক্ত ছিল। রাজাকারদের তৎপরতাকালে এবং এ মিলিশিয়া সংগঠনের পতন ঘটার পর প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়ার সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রাজ্যটি আক্রান্ত হয়। অন্য চারটি জেলায় সাম্প্রদায়িক গোলাযোগ ছিল আরো মারাত্মক। তবে এ চারটি জেলার গোলযোগ অবশিষ্ট আটটি জেলার মতো এত শোচনীয় ছিল না। এই আটটি জেলার মধ্যে আবার সবচেয়ে তিগ্রস্ত জেলাগুলো হচ্ছে ওসমানাবাদ, গুলবার্গ, বিদার ও নান্দেন। এ চারটি জেলায় পুলিশি অভিযানকালে এবং পরে ১৮ হাজারের কম লোক নিহত হয়নি। অন্য চারটি জেলা আওরঙ্গাবাদ, বীর, নলগুন্দা ও মিদাকে কমপে পাঁচ হাজার লোক জীবন হারিয়েছে। আমরা অত্যন্ত রণশীল হিসেবে বলতে পারি যে, পুলিশি অভিযানকালে এবং পরে গোটা রাজ্যে কমপে ২৭ থেকে ৪০ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। কর্তৃপ আমাদেরকে অবহিত করেছে যে, ওই আটটি জেলা সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত হয়েছে এবং আমাদের প্রতিনিধিদলের সেখানে সফর খুবই জরুরি। অতএব আমরা ওই সব জেলায় আমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করি এবং আমরা বলতে পারি যে, পারস্পরিক শত্র“তা ও অবিশ্বাস প্রশমনে আমরা সফল হয়েছি। এটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ সত্য যে, এই আটটি জেলার সবচেয়ে তিগ্রস্ত চারটি জেলা ছিল (ওসমানাবাদ, গুলবার্গ, বিদার ও নান্দেন) নেজামের স্বেচ্ছাসেবকদের মূল ঘাঁটি লাতুর হচ্ছে কাসিম রিজভির নিজ শহর। এখানে ধনাঢ্য কুচ্চি মুসলিম বণিকেরা বসবাস করত। এই বিরাট বাণিজ্যিক কেন্দ্রে ২০ দিনের বেশি হত্যাকাণ্ড অব্যাহত ছিল। ১০ হাজার মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে আমরা সেখানে বড়জোড় তিন হাজার লোককে এখনো শহরে অবস্থান করতে দেখেছি। এক হাজারের বেশি লোককে হত্যা করা হয়েছে এবং বাদবাকিরা কোনো রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছে এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
০৩. প্রায় প্রতিটি তিগ্রস্ত এলাকায় সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা কেবলমাত্র হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, কোনো কোনো জায়গায় মহিলা ও শিশুরাও রা পায়নি। হত্যাকাণ্ডের পরে মহিলাদের ধর্ষণ ও অপহরণ (কখনো কখনো শোলাপুর ও নাগপুরের মতো রাজ্যের বাইরে ভারতীয় শহরে), লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, মসজিদের প্রতি অসম্মান, বলপূর্বক ধর্মান্তর, বাড়িঘর ও জমিজমা দখল করা হয়। শত শত কোটি রুপি মূল্যের সম্পদ লুট ও ধ্বংস করা হয়েছে। তিগ্রস্তরা ছিল মুসলমান। এসব অসহায় মুসলমান ছিল গ্রামাঞ্চলের সংখ্যালঘু। নৃশংসতার জন্য দায়ী অপরাধীরা শুধু স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে নিগৃহীত ব্যক্তিরা ছিল তা নয়, হায়দরবাদের অমুসলিমরাও নয়। সীমান্তের বাইরের নিরস্ত্র ও অস্ত্রধারী ব্যক্তি ও দুর্বৃত্তরা হায়দরাবাদের অমুসলিমদের এ দুষ্কর্মে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের পর এসব দুর্বৃত্ত অনুপ্রবেশ করেছিল। আমরা সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি যে, শোলাপুর ও ভারতের অন্য শহরের একটি সুপরিচিত হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনের বেশ কিছু সশস্ত্র ও প্রশিণপ্রাপ্ত ব্যক্তি, কতিপয় স্থানীয় লোক এবং বাইরের কমিউনিস্টরা এসব দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করেছে এবং কোনো কোনো েেত্র তারা দাঙ্গাকারীদের নেতৃত্ব দিয়েছে।
০৪. কর্তব্য আমাদেরকে এ কথাও বলতে বাধ্য করছে যে, আমাদের কাছে এ মর্মে নিঃসন্দেহে অকাট্য প্রমাণ আছে, বহু ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয় পুলিশ লুটতরাজ এবং অন্যান্য অপরাধে অংশগ্রহণ করেছে। আমাদের সফরকালে আমরা এমন তথ্য সংগ্রহ করেছি যে, সৈন্যরা মুসলমানদের দোকানপাট ও বাড়িঘরে লুটপাট চালাতে হিন্দু জনতাকে উৎসাহিত এমনকি কোনো কোনো ঘটনায় বাধ্য করেছে। একটি জেলা শহরে বর্তমান প্রশাসনের হিন্দু প্রধান আমাদের জানিয়েছেন, সশস্ত্রবাহিনী মুসলমানদের দোকানপাটে নির্বিচারে লুণ্ঠন চালিয়েছে। আরেকটি জেলায় সৈন্যরা একজন মুন্সেফসহ অন্যদের বাড়িঘর লুট করেছে এবং একজন তহসিলদারের স্ত্রীর সম্ভ্রমহানি ঘটানো হয়েছে। বিশেষ করে শিখ সৈন্যদের বিরুদ্ধে মহিলাদের সম্ভ্রমহানি ঘটানোর এবং অপহরণ করার অভিযোগ কোনোক্রমেই নগণ্য ছিল না। আমাদেরকে অবহিত করা হয়েছে যে, বহু জায়গায় সশস্ত্রবাহিনী লুণ্ঠিত সম্পদ, নগদ অর্থ, স্বর্ণ ও রৌপ্য নিয়ে গেছে এবং অবশিষ্ট লুণ্ঠিত মালামাল জনতার হাতে পড়ে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন কিছু সদস্য ছিল যারা সাম্প্রদায়িক আবেগ মুক্ত ছিল না। কেননা তাদের কেউ কেউ অন্যত্র তাদের আত্মীয়স্বজনদের ওপর নৃশংসতার কথা ভুলতে পারেনি।
পাছে আমাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর কলঙ্ক আরোপ করার জন্য যাতে অভিযুক্ত করা না হয় সে জন্য আমরা আমাদের সুচিন্তিত মতামত রেকর্ড করেছি যে, হায়দরাবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও এ বাহিনীর অফিসাররা উঁচু মানের শৃঙ্খলা ও কর্তব্য জ্ঞান বজায় রেখেছেন। আমরা জেনারেল চৌধুরীকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখেছি যার মধ্যে সাম্প্রদায়িক পপাতিত্ব ছিল না। তিনি হলেন কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ ও আগাগোড়া একজন ভদ্রলোক।
মুসলমানদের রায় এমন উদাহরণ আমাদের কাছে দেয়া হয়েছে যেখানে হিন্দুরা তাদের প্রতিবেশী মুসলিম নর-নারীকে তাদের জীবনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে রা করেছে। কোনো কোনো পেশাজীবীদের মধ্যে সহমর্মিতা ছিল অত্যন্ত লণীয়। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু তাঁতীরা হিন্দুদের আক্রমণ থেকে মুসলিম তাঁতিদের রা করেছে এবং কখনো কখনো নিজেরা অনেক চড়া মূল্য দিয়ে (প্রাণহানিসহ) তাদের আশ্রয় দিয়েছে। বহু হিন্দু অপহৃত মুসলিম মহিলাদের উদ্ধারে সহায়তা করেছে।
০৫. পুলিশি অভিযানের পরে এবং স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের পতনের পরিণামে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ বেধে যায়। নেজামের স্বেচ্ছাসেবকেরা ছিল সরকার প্রতিষ্ঠার পথে কার্যকর অন্তরায়। হায়দরাবাদের মুসলমানদের কাছে একটি দায়িত্বশীল সরকার ছিল হিন্দু রাজের সমার্থক। কেননা এ সরকার প্রতিষ্ঠা করা হতো সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ইচ্ছার ভিত্তিতে। এ সত্য অনুধাবনে মুসলমানদের বিলম্ব হয় যে, তাদের দুর্ভোগ হচ্ছে মাত্র কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। স্বেচ্ছাসেবকদের আন্দোলনের প্রতি হায়দরাবাদের বিপুলসংখ্যক মুসলমানের সহানুভূতি ছিল। কেউ কেউ উন্মত্ততার প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে গিয়ে তাদের গোঁয়ার্তুমির জন্য চরম মূল্য দিয়েছে। তাদের গোঁয়ার্তুমি এমন ছিল যে, তাদের একজন আততায়ীর বুলেটে প্রাণ দেয়। তাদের মতো মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিরা এমন একটি বিশ্বাসে উৎসাহ বোধ করেছিল যে, তাদের পেছনে কর্তৃপরে সমর্থন আছে।
শেষ করার আগে আমাদেরকে মূল্যবান সহায়তা এবং স্বপ্রণোদিত সহযোগিতা করার জন্য হায়দরাবাদের সামরিক প্রশাসন, আমরা যেসব জেলা সফর করেছি সেসব জেলার সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি কর্মচারী, বিশিষ্ট নাগরিক এবং সবশেষে আমাদের দু’জন সচিব মি. ফারুক সায়ার ও পিপি আম্বুলকারের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।
********
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর দক্ষিন ভারতের স্বাধীন রাজ্য হায়দারবাদ ভারত পাকিস্তান কোন দেশেই যোগদান করে নাই। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল যখন হায়দারবাদের নিজাম কে ভারতে যোগদানের কথা বলে তখন হায়দারবাদের নিজাম বলেন ১৫ আগস্ট থেকেই এই হায়দারবাদ হল একটা স্বাধীন দেশ। মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের দ্বারপ্রান্তে ১৭২৪ সালে Nizam-ul-Mulk Asaf Jah দক্ষিন ভারতের এই স্বাধীন হায়দারবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৯৮ সালে First Duke of wellington Arthur Wellesley এর আমন্ত্রণে এই হায়দারবাদ রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে যোগদান করে। ৭ম নিজাম মীর উসমান আলীর সময়ে এই হায়দারবাদ রাজ্য ভারতের সবচেয়ে বড় স্বাধীন রাজ্যে রূপলাভ করে। 82,698 square miles 214,190 km2 ২ লাখ ১৪ হাজার ১৯০ বর্গ কিলোমিটারের এই হায়দারবাদ রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি। এদের মাঝে শতকরা ৮৫ ভাগই ছিল হিন্দু। এই হায়দারবাদ অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব সেনাবাহিনী, নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা, নিজস্ব রেল যোগাযোগ ও ডাক বিভাগ ছিল। অর্থাৎ একটি স্বাধীন দেশে যা যা থাকে তার সবকিছুই ছিল এই হায়দারবাদে। হায়দারবাদ যখন ভারতে যোগদান করতে চাচ্ছিল না তখন ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত এই এই হায়দারবাদ অঙ্গরাজ্যে তার সেনাবাহিনী প্রেরন করে। এই অপারেশনের নাম দেয়া হয় Operation Polo, উইকিপিডিয়ায় এই Operation Polo নামে একটি নিবন্ধ আছে।
১৩ September থেকে 18 September, মাত্র ৫ দিনের এই ভারতের সেনাবাহিনীর আক্রমনে প্রায় ৪০০০০ এর মত মুসলিম মারা যায়। Operation Polo নিয়ে উইকিপিডিয়ার ঐ নিবন্ধটা এই লিংকে তাছাড়া Google এ operation polo লিখে search দিলেও এই হায়দারবাদের মুসলিম হত্যা নিয়ে অনেক ভাল ভাল লেখা আসে। ভারত হায়দরাবাদে শুধু অন্যায় আগ্রাসন চালিয়েছে তাই নয়, ভারতীয় সৈন্যরা সেখানে নির্মম গণহত্যা চালায় এবং ধর্ষণে লিপ্ত হয়। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় পৃথিবীর ইতিহাসের নির্মম গণহত্যার একটি উপাখ্যান। বিশ্ববাসী কথায় কথায় কম্বোডিয়া, সাবেক যুগোশ্লাভিয়া, সিয়েরা লিয়ন ও রুয়ান্ডায় সংঘটিত গণহত্যা এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদী হলোকাস্টের ট্রাজেডি স্মরণ করে, স্মরণ করে না কেবল হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের গণহত্যা। আজ পর্যন্ত কোথাও কেউ হায়দরাবাদে গণহত্যার জন্য ভারতের বিচার দাবি করেনি। কাউকে ভারতের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতেও দেখা যায় না। কত পিতা তার আদরের সন্তান, কত স্বামী তার প্রিয়তম স্ত্রী, কত স্ত্রী তার চিরদিনের সাথী স্বামীকে হারিয়েছে তার হিসাব নেই। স্বজনহারাদের একজন হলেন সৈয়দ কুতুবউদ্দিন। ১৯৯৫ সালে কবি আবদুল হাই সিকদার লন্ডনে তার সঙ্গে দেখা করেন। হায়দরাবাদে ভারতের সামরিক অভিযানে তিনি তার পিতামাতা, দুই ভাই ও প্রিয়তম স্ত্রী জেবুন্নিসাকে হারান। জেবুন্নিসাকে তিনি হাসপাতাল, মর্গ, কারাগার, পতিতাপল্লীসহ সব জায়গায় খুঁজেছেন। কিন্তু তিনি তাকে আর কখনো খুঁজে পাননি। কান্না তার আজীবনের সঙ্গী। তার মতো আজো অনেকে তাদের প্রিয়জনের জন্য বুক ভাসিয়ে কাঁদেন। হায়দরাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় এজেন্ট জেনারেল কেএম মুন্সী ছিলেন সব ঘটনার সাক্ষী। কিন্তু ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তিনি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘দ্য এন্ড অব অ্যান অ্যারা’তে সব সত্য চাপা দিয়েছেন। ভারতীয়রা নিজেদের কৃত অপরাধ চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও সত্য তার নিজের শক্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে। আমেরিকান পর্যটক উইলিয়াম ডালরিম্পল হায়দরাবাদ সফরে গিয়ে সেখানে ভারতীয় সৈন্য ও তাদের স্থানীয় হিন্দু দোসরদের গণহত্যার সুস্পষ্ট প্রমাণ খুঁজে পায়। সে তার ‘দ্য এজ অব কলি’ শিরোনামে গ্রন্থের ২০৯-১০ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছে:
“I discovered later that it is in fact possible to make an informed estimate of the numbers killed in the aftermath of the `police action’. For when reports of atrocities began to reach Delhi, Nehru `in his private capacity’ commissioned an unofficial inquiry commission with a group of veteran Congressmen made up of two Hyderabadi Muslims who had prominantly opposed the Nizam’s rule and chaired by a Hindu Pandit Sundarlal. The team made an extensive tour of the State and submitted their report to Nehru and Sardar Patel in January 1949. The report’s findings were never made public, however, presumably because of its damning criticism of the conduct of the Indian army. It remained unpublished until a portion of it, smuggled out of India, recently appeared in America in an obscure volume of scholarly essays entitled `Hyderabad: After the Fall.’ The report, entitled On the Post-Operation Polo Massacres, Rape and Destruction or seizure of Property in Hyderabad State, makes grim reading. In village after village across the state, it meticuiously and unemotionally catalogued incidents of murder and mass rape, sometimes committed by troops, in other cases committed by local Hindu hooligans after the troops had disarmed the Muslim population. A short extract, chosen at random, gives the general flavour: `Ganjoti Paygah, District Osmanabad: There are 500 homes belonging to Muslims here. Two hundred Muslims were murdered by the goondas. The army had seized weapons from the Muslims. As the Muslims became defenceless, the goondas began the massacre. Muslim women were raped by the troops. Statement of Pasha Bi, resident of Ganjoti: the trouble in Ganjoti began after the army’s arrival. All the young Muslim women here were raped. Five daughters of Osman Sahib were raped and six daughters of Qazi were raped. Ismail Sahib Sawdagar’s daughter was raped in Saiba Chamar’s home for a week. Soldiers from Umarga came every week and after all night rape young Muslim women were sent back to their homes in the morning. Mahtab Tamboli’s daughters were divided among Hindus, one is in Burga Julaha’s home. And so on, for page after page. In all, the report estimates that as many as 200,000 Hyderabadi Muslims were slaughtered in the aftermath of the `police action:’ an astonishing figure which, if true, would turn the `police action’ into a bloodbath comparable to parts of the Punjab during Partition. Even if one regards the figure of 200,000 dead as an impossible exaggeration, it is still clear that the scale of the killing was horrific. Although publicly Nehru played down the disorder in Hyderabad, claiming to the Indian representative at the United Nations that following the Nizam’s officials deserting their posts there had been some disorder in which Hindus had retaliated for their sufferings under the (Muslim) Razakars (militia), privately he was much more alarmed. This is indicated by a note of Nehru sent to Sardar Patel’s ministry of States on the 26th of November 1948, saying that he had received reports killings of Muslims so large in number `as to stagger the imagination’ and looting of Muslim property `on a tremendous scale’-all of which would seem to confirm the general tone of Pandit Sunderlal’s report.
” অর্থাৎ হায়দরাবাদে ‘পুলিশী অভিযানে’ নিহতদের আনুমানিক একটি সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব বলে আমি উপলদ্ধি করি। দিল্লিতে গণহত্যার রিপোর্ট এসে পৌঁছতে শুরু করলে নেহরু ‘তার ব্যক্তিগত ক্ষমতা বলে’ নিজামের শাসনের কট্টর বিরোধিতাকারী ও কংগ্রেসের প্রবীণ সদস্য হায়দরাবাদের দু’জন মুসলমান এবং হিন্দু পণ্ডিত সুন্দরলালের নেতৃত্বে একটি বেসরকারি তদন্ত কমিশন গঠন করে। এ টীম হায়দরাবাদে ব্যাপকভাবে সফর করে এবং ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে নেহরু ও সরদার প্যাটেলের কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা থাকায় এ তদন্ত রিপোর্ট কখনো প্রকাশ করা হয়নি। রিপোর্টের একটি অংশ ভারতের বাইরে পাচার হওয়া নাগাদ তা ছিল অপ্রকাশিত। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ‘হায়দরাবাদ: আফটার দ্য ফল’ শিরোনামে একটি গবেষণামূলক নিবন্ধে এ উপাখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। এ নিবন্ধে ‘অপারেশন পলো-পরবর্তী হত্যাকান্ড, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ এবং হায়দরাবাদ রাজ্যে সম্পত্তি দখল’ শিরোনামে একটি রিপোর্টে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। এ রিপোর্টে হায়দরাবাদ রাজ্যে গ্রামের পর গ্রামে ভারতীয় সৈন্যদের হত্যা, গণধর্ষণ এবং নিরস্ত্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিধনে স্থানীয় হিন্দু গুন্ডাদের পরিকল্পিত অপরাধের নির্মোহ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। একটি ছোট্ট ঘটনার বর্ণনা থেকে গোটা পরিস্থিতি আঁচ করা সম্ভব: ‘গাঞ্জোটি পায়গাঁও, ওসমানাবাদ জেলা: এখানে মুসলমানদের ৫০০টি বাড়ি ছিল। গুন্ডারা ২০০ মুসলমানকে হত্যা করে।
সেনাবাহিনী মুসলমানদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়। মুসলমানরা অরক্ষিত হয়ে গেলে গুন্ডারা হত্যাকান্ডে মেতে উঠে। সৈন্যরা মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণ করে। Youtube এও অপারেশন পলো নামে একটা ভিডিও আছে http://youtu.be/itPihtVAbXc গাঞ্জোটির পাশা বাঈ বলেছে, সেনাবাহিনী এসে পৌঁছানোর পর গাঞ্জোটিতে গোলযোগ শুরু হয়। এখানকার সব যুবতী মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। ওসমান সাহেবের পাঁচ কন্যা এবং কাজী সাহেবের ছয় কন্যাকে ধর্ষণ করা হয়। সাইবা চামারের বাড়িতে ইসমাইল সাহেব সওদাগরের কন্যাকে এক সপ্তাহ ধর্ষণ করা হয়। ওমরগাঁও থেকে সৈন্যরা প্রতি সপ্তাহে আসতো এবং সারারাত ধর্ষণের পর যুবতী মুসলিম মহিলাদের সকালে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হতো। মাহতাব তাম্বুলির কন্যাদের হিন্দুদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়া হয়। বুর্গা জুলাহার বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল একজনকে। রিপোর্টের প্রতিটি পৃষ্ঠার বর্ণনা অভিন্ন। তাতে বলা হয়, ‘পুলিশী অভিযানে’ হায়দরাবাদে মোট ২ লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। নিহতদের এ সংখ্যা অবিশ্বাস্য। রিপোর্টের বর্ণনা সত্যি হয়ে থাকলে উপমহাদেশ বিভক্তিকালে পাঞ্জাবে সংঘটিত গণহত্যার সঙ্গে হায়দরাবাদে ‘পুলিশী অভিযানের’ রক্তগঙ্গাকে তুলনা করা যায়। কেউ হয়তো ২ লাখকে অতিরঞ্জিত মনে করতে পারেন। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, এ হত্যাকান্ড ছিল ভয়াবহ। জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধি দাবি করেছিল, নিজামের সৈন্যরা তাদের চৌকি পরিত্যাগ করার পর কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। এ বিশৃঙ্খলাকালে হিন্দুরা রাজাকারদের হাতে তাদের দুর্ভোগের প্রতিশোধ গ্রহণ করে। নেহরু প্রকাশ্যে হায়দরাবাদে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করলেও একান্তভাবে ছিল উদ্বিগ্ন।
১৯৪৮ সালের নভেম্বরে সরদার প্যাটেলের মন্ত্রণালয়ে নেহরুর পাঠানো একটি চিঠিতে তার প্রতিফলন ঘটেছে। চিঠিতে নেহরু উল্লেখ করেছিল, সে শিউরে উঠার মতো বিপুল সংখ্যক মুসলিম হত্যাকান্ড এবং অবিশ্বাস্য মাত্রায় মুসলমানদের সম্পত্তি লুণ্ঠনের রিপোর্ট পেয়েছে। এসব ঘটনা পন্ডিত সুন্দরলালের রিপোর্টের সার্বিক ধারণাকে সত্যি বলে প্রমাণ করছে। ইসলামী ইতিহাস বিশেষজ্ঞ এবং জিন্নাহ ও নিজামের কট্টর সমালোচক অধ্যাপক উইলফ্রেড কার্টওয়েল স্মিথও হায়দরাবাদে মুসলিম গণহত্যা সম্পর্কে আমেরিকান পর্যটক উইলিয়াম ডালরিম্পলের অনুরূপ মতামত দিয়েছে। ১৯৪৯ সালে হায়দরাবাদ সফর শেষে সে ‘হায়দরাবাদ: এ মুসলিম ট্রাজেডি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে লিখেছে:
“Off the battlefield, however, the Muslim community fell before a massive and brutal blow, the devastation of which left those who did survive reeling in bewildered fear. Thousands upon thousands were slaughtered, many hundred of thousands uprooted. The instrument of their disaster was, of course, vengeance. Particularly in the Marathwara section of the state and to a less but still terrible extent in most other areas, the story of the days after ‘police action’ is grim.”
অর্থাৎ রণাঙ্গনের বাইরে মুসলিম সম্প্রদায় ব্যাপক ও নৃশংস দুর্ভাগ্যের শিকার হয়। হাজার হাজার লোককে হত্যা এবং লাখ লাখ লোককে গৃহহীন করা হয়। অবশ্যই প্রতিহিংসা তাদের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বিশেষ করে এ রাজ্যের মারাঠাবারা এবং অন্যান্য এলাকায় এখনো প্রতিহিংসার নিষ্ঠুর স্বাক্ষর বিদ্যমান। ‘পুলিশী অভিযানের’ পরবর্তী দিনগুলোর উপাখ্যান খুবই করুণ। শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদের তাগিদে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসতার রিপোর্ট প্রণয়নে হিন্দু পন্ডিত সুন্দরলালের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। এ তদন্ত কমিটি নেহরুর কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টটি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। নেহরুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সুন্দরলাল রিপোর্ট প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। বহু বিলম্বে হলেও এ রিপোর্ট ফাঁস হয়ে যায়। মুসলিম দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসতার বিবরণ সম্বলিত অতি গোপনীয় এ রিপোর্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
(1) The Honourable Prime Minister, Government of India, New Delhi. (2) The Honourable States Minister, Government of India, New Delhi. Sir, We were asked by the Government of India to proceed to Hyderabad State on a goodwill mission. After completing our task there we now beg to submit our report. (1) The delegation consisting of Pandit Sundarlal, Kazi Abdul Ghaffar and Moulana Abdullah Misri arrived at Hyderabad on the 29th November and returned to Delhi on the 21st of December 1948. During this period we toured through 9 out of the 16 districts of the state, visiting 7 district headquarters, 21 towns and 23 important villages. In addition we interviewed over 500 people from 109 such villages as we did not visit. Further 31 public meetings at various places and 27 private gatherings of Hindu, Muslims, Congress men, official Members of Jamiat Ullema and of the Ittehadul Muslimeen, the staffs and students of some Educational Institutions, Members of the Progressive Writers Association and of the Hindustani Prachar Sabha etc. were addressed by members of the delegation. Amongst important men and officials interviewed by us may be mentioned H.E.H. the Nizam, H.E. the Prince of Berar, Major General Choudhri, Mr. Bakhlo, the Chief Civil Administrator, Swami Ramanand Tirtha, Dr. Malkote, Messers Ramchander Rao, Ramachari, K. Vadya, Venkat Rao and Abul Hassan Sayed Ali, Nawab Ali Yawar Jung, Nawab Zain Yar Jung, Raja Dhonde Raj, Moulana Abu Yousuf, Moulvi Abdul Khair and Moulvi Hameed uddin Qamar Farooqi. At all these meetings and interviews the main problems discussed was that of the creation and maintenance of cordial relations between the communities. Appeals were made to the people to forget the past and to work unremittingly for the establishment of peace and harmony amongst themselves. The aim and policy of the Indian Union was also explained and special emphasis was laid on the objective which was the establishment of a secular government for the people of Hyderabad, in which all of them irrespective of religion, caste or creed will enjoy equal freedom and civil rights and will have equal opportunities for development and progress. It was made perfectly clear that the military administration had been charged with the duty of implementing that policy. We clarified our position, whenever opportunity presented itself saying that ours was not a Commission of investigation or Inquiry into events proceeding or following the police action and that ours was merely a goodwill mission charged with the task of restoring better communal relations. All the same, we feel it our duty to bring to your notice what we saw and gathered in our tourings, as it has, in our opinion, an importance all its own. (2) Hyderabad State has 16 districts, comprising nearly 22,000 villages. Out of them only three districts remained practically, though not wholly, free of communal trouble which affected the state first during the activities of the Razakars and then during the reprisals that followed the collapse of that organisation. In another four districts the trouble had been more serious but nothing like the havoc that overtook the remaining eight. Out of these again the worst sufferers have been the district of Osmanabad, Gulburga, Bidar and Nanded, in which four the number of people killed during and after the police action was not less, if not more than 18,000. In the other four districts viz, Aurangabad, Bir, Nalgunda and Medak those who lost their lives numbered at least 5 thousand. We can say at a very conservative estimate that in the whole state at least 27 thousand to 40 thousand people lost their lives during and after the police action. We were informed by the authorities that those eight were the most affected districts and needed most the good offices of our delegation. We, therefore, concentrated on these and succeeded, we might say, to some extent at least, in dispelling the atmosphere of mutual hostility and distrust. It is a significant fact that out of of these eight the four worst affected districts (Osmanabad, Gulburga, Bidar and Nanded) had been the main strongholds of Razakars and the people of these four districts had been the worst sufferers at the hands of the Razakars. In the town of Latur, the home of Kasim Rizvi- which had been a big business centre, with rich Kuchhi Muslim merchants, the killing continued for over twenty days. Out of a population of about ten thousand Muslims there we found barely three thousand still in the town. Over a thousand had been killed and the rest had run away with little else besides their lives and completely ruined financially. (3) Almost everywhere in the affected areas communal frenzy did not exhaust itself in murder, alone in which at some places even women and children were not spared. Rape, abduction of women (sometimes out of the state to Indian towns such as Sholapur and Nagpur) loot, arson, desecration of mosques, forcible conversions, seizure of houses and lands, followed or accompanied the killing. Tens of crores worth of property was looted or destroyed. The sufferers were Muslims who formed a hopeless minority in rural areas. The perpetrators of these atrocities were not limited to those who suffered at the hands of Razakars, not to the non-Muslims of Hyderabad state. These latter were aided and abetted by individuals and bands of people, with arms and without arms, from across the border, who had infiltrated through in the wake of the Indian army. We found definite indications that a number of armed and trained men belonging to a well known Hindu communal organisation from Sholapur and other Indian towns as also some local and outside communists participated in these riots and in some cases actually led the rioters. (4) Duty also compels us to add that we had absolutely unimpeachable evidence to the effect that there were instances in which men belonging to the Indian Army and also to the local police took part in looting and even other crimes. During our tour we gathered, at not a few places, that soldiers encouraged, persuaded and in a few cases even compelled the Hindu mob to loot Muslim shops and houses. At one district town the present Hindu head of the administration told us that there was a general loot of Muslim shops by the military. In another district a Munsif house, among others was looted by soldiers and a Tahsilder’s wife molested. Complaints of molestation and abduction of girls, against Sikh soldiers particularly, were by no means rare. We were generally told that at many places out of the looted property cash, gold and silver was taken away by military while other articles fell to the share of the mob. Unfortunately there was a certain element in the army which was not free from communal feelings probably because some of them could not forget the atrocities committed elsewhere on their own kith and kin. Lest we might be understood to imply a slur on the Indian army we hasten to record our considered opinion that the Indian Army and its officers in Hyderabad generally maintained a high standered of discipline and sense of duty. In General Choudhri we found a man without any tinge of communal prejudice, a firm disciplinarian and thorough gentleman. We were given by Muslims instances in which Hindus had defended and given protection to their Muslim neighbours, men and women even at the cost of their own lives. In some professions the fellow feeling was particularly marked. For instance at places Hindu weavers defended Muslim weavers against Hindu and protected them often at a very heavy cost (including loss of life) to themselves. Many Hindus helped in the recovery of abducted Muslim women. (5) This communal trouble followed close upon the heels of the police action and the consequent collapse of the Razakar organisation, which had stood in the Muslim mind, acted as an effective barrier against the establishment of responsible government which was synonymous, to the average Hyderabadi Muslim, with Hindu Raj, because it would be based on the will of the Hindu majority. Muslim masses were generally slow to realise that their sufferings were the inevitable repurcussions of the atrocities committed on the Hindus only, a few days before, by the Razakars. The Razakars movement had the sympathy of a good number of Muslims in Hyderabad. Such of them as dared publicly to oppose that madness paid heavily for their temerity, so much so that one of them fell before the bullet of an assassin. Like the Razakars the perpetrators of crimes against the Muslims encouraged the belief that they had the backing of the authorities. Before closing we must gratefully acknowledge the valuable help and willing cooperation given to us by the Military Administration in Hyderabad, by Government officials in the districts we visited, by public workers and prominent citizens and lastly by our two Secretaries Messers Furrukh Sayer and P.P. Ambulkar.
প্রতি, (১) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ভারত সরকার, নয়াদিল্লি। (২) মাননীয় রাজ্যমন্ত্রী, ভারত সরকার, নয়াদিল্লি। মহোদয়, ভারত সরকার আমাদেরকে হায়দরাবাদ রাজ্যে একটি শুভেচ্ছা সফরে যাবার জন্য অনুরোধ করে। আমাদের কাজ শেষ করে এখন আমরা আমাদের রিপোর্ট পেশ করছি। (১) পন্ডিত সুন্দরলাল, কাজী আবদুল গফুর ও মাওলানা আবদুল্লাহ মিসরির সমন্বয়ে গঠিত এই প্রতিনিধি দল ২৯ নভেম্বর হায়দরাবাদে গিয়ে পৌঁছে এবং ১৯৪৮ সালের ২১ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে ফিরে আসে। এসময় আমরা রাজ্যের ১৬টির মধ্যে ৯টি জেলা, ৭টি জেলা সদর, ২১টি শহর ও ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম সফর করেছি। এছাড়া আমরা এ ধরনের ১০৯টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক লোকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ৩১টি জনসমাবেশ এবং হিন্দু, মুসলিম, কংগ্রেস সদস্য, জমিয়ত-ই-উলেমা ও ইত্তেহাদুল মুসলিমীনের কর্মকর্তা, কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারি ও ছাত্র, প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনের সদস্য এবং হিন্দুস্তানি প্রচার সভার ২৭টি ঘরোয়া সমাবেশে ভাষণ দিয়েছে। আমরা যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- হায়দরাবাদের মহামান্য নিজাম, বেরারের মহামান্য প্রিন্স, মেজর জেনারেল চৌধুরী, মি. বাখলু, মুখ্য বেসামরিক প্রশাসক, স্বামী রমানন্দ তীর্থ, ড. মালকোত, রামচন্দ্র রাও, রামাচার্য, কে. বৈদ্য, ভেঙ্কট রাও, আবুল হাসান সৈয়দ আলী, নওয়াব আলী ইয়ার জং, নবাব জৈন ইয়ার জং, রাজা ধোন্দি রাজ, মাওলানা আবু ইউসূফ, মৌলভী আবদুল খায়ের ও মৌলভী হামিদউদ্দিন কামার ফারুকী।
এসব সমাবেশ ও সাক্ষাৎকারে আমরা দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বজায় রাখার মূল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। নিজেদের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করার এবং অতীতের তিক্ততা ভুলে যাবার জন্য জনগণের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছি। তাদের কাছে ভারত সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছি এবং হায়দরাবাদের জনগণের জন্য একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছি। আমরা তাদের সামনে ব্যাখ্যা করেছি যে, ধর্মনিরপেক্ষ সরকারে ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণী নির্বিশেষে তাদের সকলে সমান অধিকার ও নাগরিক সুবিধা ভোগ করবে এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সকলের সমান সুযোগ সুবিধা থাকবে। তাদেরকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ নীতি বাস্তবায়ন করা হলো সামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব। সুযোগ পাওয়া মাত্র আমরা আমাদের অবস্থানের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছি যে, পুলিশী অভিযানের আগে বা পরের ঘটনাবলী তদন্ত বা অনুসন্ধান করার জন্য কোনো কমিশন হিসাবে আমরা কাজ করছি না। আমরা এসেছি একটি শুভেচ্ছা মিশনে এবং আমাদের দায়িত্ব হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করা। একইসঙ্গে আমরা যা প্রত্যক্ষ করেছি এবং আমাদের সফরকালে যেসব তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি সেসব তথ্য আপনার নজরে আনা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। আমাদের মতে, এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। (২) ১৬টি জেলা এবং আনুমানিক ২২ হাজার গ্রাম নিয়ে হায়দরাবাদ রাজ্য গঠিত। এসব জেলার মধ্যে মাত্র তিনটি পুরোপুরি না হলেও বাস্তবে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ থেকে মুক্ত ছিল।
রাজাকারদের তৎপরতাকালে এবং এ মিলিশিয়া সংগঠনের পতন ঘটার পর প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়ার সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রাজ্যটি আক্রান্ত হয়। অন্য চারটি জেলায় সাম্প্রদায়িক গোলাযোগ ছিল আরো মারাত্মক। তবে এ চারটি জেলার গোলযোগ অবশিষ্ট ৮টি জেলার মতো এত শোচনীয় ছিল না। এই ৮টি জেলার মধ্যে আবার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হচ্ছে ওসমানাবাদ, গুলবার্গ, বিদার ও নান্দেন। এ চারটি জেলায় পুলিশী অভিযানকালে এবং পরে ১৮ হাজারের কম লোক নিহত হয়নি। অন্য চারটি জেলা আওরঙ্গাবাদ, বীর, নলগুন্দা ও মিদাকে কমপক্ষে ৫ হাজার লোক জীবন হারিয়েছে। আমরা অত্যন্ত রক্ষণশীল হিসাবে বলতে পারি যে, পুলিশী অভিযানকালে এবং পরবর্তীতে গোটা রাজ্যে কমপক্ষে ২৭ থেকে ৪০ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে অবহিত করেছে যে, ঐ ৮টি জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং আমাদের প্রতিনিধি দলের সেখানে সফর খুবই জরুরি। অতএব আমরা ঐসব জেলায় আমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করি এবং আমরা বলতে পারি যে, পারস্পরিক শত্রুতা ও অবিশ্বাস প্রশমনে আমরা সফল হয়েছি। এটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ সত্য যে, এই ৮টি জেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চারটি জেলা ছিল (ওসমানাবাদ, গুলবার্গ, বিদার ও নান্দেন) রাজাকারদের মূল ঘাঁটি এবং এ চারটি জেলার লোক রাজাকারদের হাতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। লাতুর হচ্ছে কাসিম রিজভির নিজ শহর। এখানে ধনাঢ্য কুচ্চি মুসলিম বণিকরা বসবাস করতো। এই বিরাট বাণিজ্যিক কেন্দ্রে ২০ দিনের বেশি হত্যাকান্ড অব্যাহত ছিল।
১০ হাজার মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে আমরা সেখানে বড়জোড় তিন হাজার লোককে এখনো শহরে অবস্থান করতে দেখেছি। এক হাজারের বেশি লোককে হত্যা করা হয়েছে এবং বাদবাকিরা কোনো রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছে এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। (৩) প্রায় প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা কেবলমাত্র হত্যাকান্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, কোনো কোনো জায়গায় মহিলা ও শিশুরাও রক্ষা পায়নি। হত্যাকান্ডের পরবর্তীতে মহিলাদের ধর্ষণ ও অপহরণ (কখনো কখনো শোলাপুর ও নাগপুরের মতো রাজ্যের বাইরে ভারতীয় শহরে), লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, মসজিদের প্রতি অসম্মান, বলপূর্বক ধর্মান্তর, বাড়িঘর ও জমিজমা দখল করা হয়।
শত শত কোটি রুপি মূল্যের সম্পদ লুট ও ধ্বংস করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা ছিল মুসলমান। এসব অসহায় মুসলমান ছিল গ্রামাঞ্চলের সংখ্যালঘু। নৃশংসতার জন্য দায়ী অপরাধীরা শুধু রাজাকারদের হাতে নিগৃহীত ব্যক্তিরা ছিল তা নয়, হায়দরাবাদের অমুসলিমরাও নয়। সীমান্তের বাইরের নিরস্ত্র ও অস্ত্রধারী ব্যক্তি ও দুর্বৃত্তরা হায়দরাবাদের অমুসলিমদের এ দুষ্কর্মে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের পর এসব দুর্বৃত্ত অনুপ্রবেশ করেছিল। আমরা সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি যে, শোলাপুর ও ভারতের অন্যান্য শহরের একটি সুপরিচিত হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনের বেশ কিছু সশস্ত্র ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি, কতিপয় স্থানীয় লোক এবং বাইরের কমিউনিস্টরা এসব দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা দাঙ্গাকারীদের নেতৃত্ব দিয়েছে। (৪) কর্তব্য আমাদেরকে একথাও বলতে বাধ্য করছে যে, আমাদের কাছে এ মর্মে নিঃসন্দেহে অকাট্য প্রমাণ আছে যে, বহু ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয় পুলিশ লুটতরাজ এবং অন্যান্য অপরাধে অংশগ্রহণ করেছে। আমাদের সফরকালে আমরা এমন তথ্য সংগ্রহ করেছি যে, সৈন্যরা মুসলমানদের দোকানপাট ও বাড়িঘরে লুটপাট চালাতে হিন্দু জনতাকে উৎসাহিত এমনকি কোনো কোনো ঘটনায় বাধ্য করেছে।
একটি জেলা শহরে বর্তমান প্রশাসনের হিন্দু প্রধান আমাদের জানিয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী মুসলমানদের দোকানপাটে নির্বিচারে লুণ্ঠন চালিয়েছে। আরেকটি জেলায় সৈন্যরা একজন মুন্সেফসহ অন্যদের বাড়িঘর লুট করেছে এবং একজন তহসিলদারের স্ত্রীর সম্ভ্রমহানি ঘটানো হয়েছে। বিশেষ করে শিখ সৈন্যদের বিরুদ্ধে মহিলাদের সম্ভ্রমহানি ঘটানোর এবং অপহরণ করার অভিযোগ কোনোক্রমেই নগণ্য ছিল না। আমাদেরকে অবহিত করা হয়েছে যে, বহু জায়গায় সশস্ত্র বাহিনী লুণ্ঠিত সম্পদ, নগদ অর্থ, স্বর্ণ ও রৌপ্য নিয়ে গেছে এবং অবশিষ্ট লুণ্ঠিত মালামাল জনতার হাতে পড়ে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন কিছু সদস্য ছিল যারা সাম্প্রদায়িক আবেগ মুক্ত ছিল না। কেননা তাদের কেউ কেউ অন্যত্র তাদের আত্মীয় স্বজনদের ওপর নৃশংসতার কথা ভুলতে পারেনি। পাছে আমাদেরকে না জানি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর কলঙ্ক আরোপের জন্য অভিযুক্ত করা হয় সেজন্য আমরা সুচিন্তিত অভিমত দিচ্ছি যে, হায়দরাবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং এ বাহিনীর অফিসাররা উঁচু মানের শৃঙ্খলা ও কর্তব্য জ্ঞান বজায় রেখেছে। আমরা জেনারেল চৌধুরীকে এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে দেখেছি যার মধ্যে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব ছিল না। সে হলো কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ ও আগাগোড়া একজন ভদ্রলোক। মুসলমানদের রক্ষায় এমন উদাহরণ আমরা পেয়েছি যে, যেখানে হিন্দুরা তাদের প্রতিবেশি মুসলিম নর-নারীকে জীবনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে রক্ষা করেছে। কোনো কোনো পেশাজীবীদের মধ্যে সহমর্মিতা ছিল অত্যন্ত লক্ষ্যণীয়। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু তাঁতীরা হিন্দুদের আক্রমণ থেকে মুসলিম তাঁতীদের রক্ষা করেছে এবং কখনো কখনো নিজেরা অনেক চড়া মূল্য দিয়ে (প্রাণহানিসহ) তাদের আশ্রয় দিয়েছে।
বহু হিন্দু অপহৃত মুসলিম মহিলাদের উদ্ধারে সহায়তা করেছে। (৫) পুলিশী অভিযানের পরে এবং মুসলমানদের সমর্থনপুষ্ট রাজাকার সংগঠনের পতনের পরিণামে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ একটি দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কার্যকর অন্তরায় হিসাবে কাজ করেছে। হায়দরাবাদের মুসলমানদের কাছে একটি দায়িত্বশীল সরকার ছিল হিন্দু রাজের সমার্থক। কেননা এ সরকার প্রতিষ্ঠা করা হতো সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ইচ্ছার ভিত্তিতে। এ সত্য অনুধাবনে মুসলমানদের বিলম্ব হয় যে, তাদের দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে মাত্র কয়েকদিন আগে রাজাকারদের নৃশংসতার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া।
রাজাকার আন্দোলনের প্রতি হায়দরাবাদের বিপুলসংখ্যক মুসলমানের সহানুভূতি ছিল। কেউ কেউ তাদের উন্মত্ততার প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে গিয়ে চরম মূল্য দিয়েছে। তাদের একজন আততায়ীর বুলেটে প্রাণ দিয়েছে। রাজাকারদের মতো মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিরা এমন একটি বিশ্বাসে উৎসাহ বোধ করেছিল যে, তাদের পেছনে কর্তৃপক্ষের সমর্থন আছে। শেষ করার আগে আমাদেরকে মূল্যবান সহায়তা এবং স্বপ্রণোদিত সহযোগিতা করার জন্য হায়দরাবাদের সামরিক প্রশাসন, আমরা যেসব জেলা সফর করেছি সেসব জেলার সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি কর্মচারি, বিশিষ্ট নাগরিক এবং সবশেষে আমাদের দু’জন সচিব মি. ফারুক সায়ার ও পিপি আম্বুলকারের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। ভারতের কোনো পাঠ্যপুস্তকে হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসতার ছিঁটেফোটা খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু হায়দরাবাদ নয়, ভারতের অন্যত্র আরো ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকান্ডের বদলা নিতে তার পুত্র রাজিবের আমলে শিখদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। একইভাবে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম হত্যাকান্ড চালানো হয়। তবে হায়দরাবাদে সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপকতার তুলনায় এসব হত্যাকান্ড নস্যি। কথিত পন্ডিত জওহরলাল নেহরুকে ভারতীয়রা দেবতার মর্যাদা দিলেও তার আমলেই ভারতে স্মরণকালের ভয়াবহ গণহত্যা চালানো হয়। ভারতের দু’একজন লেখক ও বুদ্ধিজীবী নিঃসংকোচে সত্য প্রকাশে এগিয়ে এসেছে। ইকনোমিক টাইমসের সম্পাদক স্বামীনাথ এস. আঙ্কেলসারিয়া আয়ার হল তাদের অন্যতম।
২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ‘ডিক্লাসিফাইড রিপোর্ট অব দ্য ১৯৪৮ হায়দরাবাদ ম্যাসাকার’ শিরোনামে এক নিবন্ধে সে লিখেছে: “I was astounded to find that the greatest communal slaughter occurred under neither Modi nor Rajib but Nehru. His takeover of Hyderabad in 1948 caused may be 50,000-200,000 death. This was the largest single massacre in the history of Indian Union, dwarfing the killing by the Pathan raiders en route to Srinagar which India has ever since used as the casus belli for its annexation of Kashmir.” অর্থাৎ আমি একথা খুঁজে পেয়ে বিস্মিত হয়ে যাই যে, মোদি (গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি) অথবা রাজিবের (প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী) আমলে নয়, নেহরুর আমলে বৃহত্তম সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে সে (নেহরু) হায়দরাবাদের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ লোকের মৃত্যু হয়। এ হত্যাযজ্ঞ ছিল ভারত ইউনিয়নের ইতিহাসে একক বৃহত্তম। শ্রীনগরে এগিয়ে আসার পথে পাঠান আক্রমণকারীদের পরিচালিত হত্যাকান্ডকে তখন থেকে কাশ্মীর একীভূতকরণের যৌক্তিকতা হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু হায়দরাবাদ হত্যাযজ্ঞের তুলনায় এ হত্যাকান্ড ছিল নগণ্য। আর একটি কথা- বাংলাদেশ ঐ সময় পাকিস্তান ফেডারেশনে যোগ ন দিলে বাংলাদেশেরও একই পরিণতি হইত। পাকিস্তানে যোগ দেওয়াতে এখন আমরা স্বাধীন হয়েছি, আর তা না হইলে আমরা এখন ভারতের পেটের ভিতর থাকতাম।
হায়দরাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় এজেন্ট জেনারেল কে এম মুন্সী ছিলেন সব ঘটনার সাী। কিন্তু ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ দ্য এন্ড অব অ্যান অ্যারাতে সব সত্য চাপা দিয়েছেন। ভারতীয়রা নিজেদের কৃত অপরাধ চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও সত্য তার নিজের শক্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে। আমেরিকান পর্যটক উইলিয়াম ডালরিম্পল হায়দরাবাদ সফরে গিয়ে সেখানে বিজয়ী ভারতীয় সৈন্য ও তাদের স্থানীয় হিন্দু দোসরদের গণহত্যার সুস্পষ্ট প্রমাণ খুঁজে পান। তিনি তার দ্য এজ অব কলি শিরোনামে গ্রন্থের ২০৯-১০ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘পুলিশি অভিযানে নিহতদের আনুমানিক একটি সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব বলে আমি উপলব্ধি করি। দিল্লিতে গণহত্যার রিপোর্ট এসে পৌঁছতে শুরু করলে নেহরু ‘তার ব্যক্তিগত মতাবলে’ নিজামের শাসনের কট্টর বিরোধিতাকারী ও কংগ্রেসের প্রবীণ সদস্য হায়দরাবাদের দু’জন মুসলমান এবং হিন্দু পণ্ডিত সুন্দরলালের নেতৃত্বে একটি বেসরকারি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। এ টিম হায়দরাবাদে ব্যাপকভাবে সফর করে এবং ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে নেহরু ও সরদার প্যাটেলের কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা থাকায় এ তদন্ত রিপোর্ট কখনো প্রকাশ করা হয়নি। রিপোর্টের একটি অংশ ভারতের বাইরে পাচার হওয়া নাগাদ তা ছিল অপ্রকাশিত। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ‘হায়দ্রাবাদ : আফটার দ্য ফল’ শিরোনামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থে এ উপাখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। এ গ্রন্থে ‘অপারেশন পলো-পরবর্তী হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ এবং হায়দরাবাদ রাজ্যে সম্পত্তি দখল’ শিরোনামে একটি রিপোর্টে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। এ রিপোর্টে হায়দরাবাদ রাজ্যে গ্রামের পর গ্রামে ভারতীয় সৈন্যদের হত্যা, গণধর্ষণ এবং নিরস্ত্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিধনে স্থানীয় হিন্দু গুণ্ডাদের পরিকল্পিত অপরাধের নির্মোহ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। একটি ছোট্ট ঘটনার বর্ণনা থেকে গোটা পরিস্থিতি আঁচ করা সম্ভব:
গাঞ্জোটি পায়গাঁও, ওসমানাবাদ জেলা : এখানে মুসলমানদের ৫০০ বাড়ি ছিল। গুণ্ডারা ২০০ মুসলমানকে হত্যা করে। সেনাবাহিনী মুসলমানদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়। মুসলমানেরা অরতি হয়ে গেলে গুণ্ডারা হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে। সৈন্যরা মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণ করে। গাঞ্জোটির পাশা বাঈ বলেছেন, সেনাবাহিনী এসে পৌঁছানোর পর গাঞ্জোটিতে গোলযোগ শুরু হয়। এখানকার সব যুবতী মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। ওসমান সাহেবের পাঁচ কন্যা এবং কাজী সাহেবের ছয় কন্যাকে ধর্ষণ করা হয়। সাইবা চামারের বাড়িতে ইসমাইল সাহেব সওদাগরের কন্যাকে এক সপ্তাহ ধর্ষণ করা হয়। ওমরগাঁও থেকে সৈন্যরা প্রতি সপ্তাহে আসত এবং সারা রাত ধর্ষণের পর যুবতী মুসলিম মহিলাদের সকালে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হতো। মাহতাব তাম্বুলির কন্যাদের হিন্দুদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়া হয়। বুর্গা জুলাহার বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল একজনকে।
রিপোর্টের প্রতিটি পৃষ্ঠার বর্ণনা অভিন্ন। তাতে বলা হয়, ‘পুলিশি অভিযানে’ হায়দরাবাদে মোট দুই লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। নিহতদের এ সংখ্যা অবিশ্বাস্য। রিপোর্টের বর্ণনা সত্যি হয়ে থাকলে উপমহাদেশ বিভক্তিকালে পাঞ্জাবে সংঘটিত গণহত্যার সাথে হায়দরাবাদে ‘পুলিশি অভিযানের’ রক্তগঙ্গাকে তুলনা করা যায়। কেউ হয়তো দুই লাখকে অতিরঞ্জিত মনে করতে পারেন। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, এ হত্যাকাণ্ড ছিল ভয়াবহ। জাতিসঙ্ঘে ভারতীয় প্রতিনিধি দাবি করেছিলেন, নিজামের সৈন্যরা তাদের চৌকি পরিত্যাগ করার পর কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। এ বিশৃঙ্খলাকালে হিন্দুরা নিজামের স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে কথিত তাদের দুর্ভোগের প্রতিশোধ গ্রহণ করে। নেহরু প্রকাশ্যে হায়দরাবাদে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করলেও একান্তভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে সরদার প্যাটেলের মন্ত্রণালয়ে নেহরুর পাঠানো একটি চিঠিতে তার প্রতিফলন ঘটেছে। চিঠিতে নেহরু উল্লেখ করেছিলেন, ‘তিনি শিউরে ওঠার মতো বিপুল মুসলিম হত্যাকাণ্ড এবং অবিশ্বাস্য মাত্রায় মুসলমানদের সম্পত্তি লুণ্ঠনের রিপোর্ট পেয়েছেন। এসব ঘটনা পণ্ডিত সুন্দরলালের রিপোর্টের সার্বিক ধারণাকে সত্যি বলে প্রমাণ করছে।’
ইসলামি ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক উইলফ্রেড কার্টওয়েল স্মিথও হায়দরাবাদে মুসলিম গণহত্যা সম্পর্কে আমেরিকান পর্যটক উইলিয়াম ডালরিম্পলের অনুরূপ মতামত দিয়েছেন। ১৯৪৯ সালে হায়দরাবাদ সফর শেষে তিনি লিখেছেন, ‘রণাঙ্গনের বাইরে মুসলিম সম্প্রদায় ব্যাপক ও নৃশংস দুর্ভাগ্যের শিকার হয়। হাজার হাজার লোককে হত্যা এবং লাখ লাখ লোককে গৃহহীন করা হয়। অবশ্যই প্রতিহিংসা তাদের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বিশেষ করে এ রাজ্যের মারাঠারা এবং অন্যান্য এলাকায় এখনো প্রতিহিংসার নিষ্ঠুর স্বার বিদ্যমান। ‘পুলিশি অভিযানের’ পরবর্তী দিনগুলোর উপাখ্যান খুবই করুণ।’
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসতার রিপোর্ট প্রণয়নে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। এ তদন্ত কমিটি নেহরুর কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টটি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু ফাঁক ফোকর দিয়ে এ রিপোর্ট ফাঁস হয়ে যায়। মুসলিম দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসতার বিবরণ সংবলিত অতি গোপনীয় এ রিপোর্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো :
প্রতি,
০১. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ভারত সরকার, নয়াদিল্লি।
০২. মাননীয় রাজ্যমন্ত্রী, ভারত সরকার, নয়াদিল্লি।
মহোদয়,
ভারত সরকার আমাদেরকে হায়দরাবাদ রাজ্যে একটি শুভেচ্ছা সফরে যাবার জন্য অনুরোধ করে। আমাদের কাজ শেষ করে এখন আমরা আমাদের রিপোর্ট পেশ করছি।
০১. পণ্ডিত সুন্দরলাল, কাজী আবদুল গফুর ও মাওলানা আবদুল্লাহ মিসরির সমন্বয়ে গঠিত এই প্রতিনিধিদল ২৯ নভেম্বর হায়দরাবাদে গিয়ে পৌঁছে এবং ১৯৪৮ সালের ২১ ডিসেম্বর নয়া দিল্লিতে ফিরে আসে। এ সময় আমরা রাজ্যের ১৬টির মধ্যে ৯টি জেলা, সাতটি জেলা সদর, ২১টি শহর ও ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম সফর করেছি। এ ছাড়া আমরা এ ধরনের ১০৯টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক লোকের সাাৎকার গ্রহণ করেছি।
প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ৩১টি জনসমাবেশ এবং হিন্দু, মুসলিম, কংগ্রেস সদস্য, জমিয়ত উলেমা ও ইত্তেহাদুল মুসলিমীনের কর্মকর্তা, কয়েকটি শিাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও ছাত্র, প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এবং হিন্দুস্তানি প্রচার সভার ২৭টি ঘরোয়া সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন।
আমরা যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও কর্মকর্তার সাাৎকার গ্রহণ করেছি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হায়দরাবাদের মহামান্য নিজাম, বেরারের মহামান্য প্রিন্স, মেজর জেনারেল চৌধুরী, মি. বাখলু, মুখ্য বেসামরিক প্রশাসক, স্বামী রমানন্দ তীর্থ, ড. মালকোত, রামচন্দ্র রাও, রামাচার্য, কে. বৈদ্য, ভেঙ্কট রাও, আবুল হাসান সৈয়দ আলী, নওয়াব আলী ইয়ার জং, নবাব জৈন ইয়ার জং, রাজা ধোন্দি রাজ, মাওলানা আবু ইউসূফ, মৌলভী আবদুল খায়ের ও মৌলভী হামিদউদ্দিন কামার ফারুকী।
এসব সমাবেশ ও সাাৎকারে আমরা দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বজায় রাখার মূল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। নিজেদের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করার এবং অতীতের তিক্ততা ভুলে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছি। তাদের কাছে ভারত সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছি এবং হায়দরাবাদের জনগণের জন্য একটি ধর্মনিরপে সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছি। আমরা তাদের সামনে ব্যাখ্যা করেছি যে, ধর্মনিরপে সরকারে ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণী নির্বিশেষে তাদের সবাই সমান অধিকার ও নাগরিক সুবিধা ভোগ করবে এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সবার সমান সুযোগ-সুবিধা থাকবে। তাদেরকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ নীতি বাস্তবায়ন করা হলো সামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব। সুযোগ পাওয়া মাত্র আমরা আমাদের অবস্থানের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছি যে, পুলিশি অভিযানের আগে বা পরের ঘটনাবলি তদন্ত বা অনুসন্ধান করার জন্য কোনো কমিশন হিসেবে আমরা কাজ করছি না। আমরা এসেছি একটি শুভেচ্ছা মিশনে এবং আমাদের দায়িত্ব হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করা। একই সঙ্গে আমরা যা প্রত্য করেছি এবং আমাদের সফরকালে যেসব তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি সেসব তথ্য আপনার নজরে আনা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। আমাদের মতে, এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ।
০২. ১৬টি জেলা এবং আনুমানিক ২২ হাজার গ্রাম নিয়ে হায়দরাবাদ রাজ্য গঠিত। এসব জেলার মধ্যে মাত্র তিনটি পুরোপুরি না হলেও বাস্তবে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ থেকে মুক্ত ছিল। রাজাকারদের তৎপরতাকালে এবং এ মিলিশিয়া সংগঠনের পতন ঘটার পর প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়ার সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রাজ্যটি আক্রান্ত হয়। অন্য চারটি জেলায় সাম্প্রদায়িক গোলাযোগ ছিল আরো মারাত্মক। তবে এ চারটি জেলার গোলযোগ অবশিষ্ট আটটি জেলার মতো এত শোচনীয় ছিল না। এই আটটি জেলার মধ্যে আবার সবচেয়ে তিগ্রস্ত জেলাগুলো হচ্ছে ওসমানাবাদ, গুলবার্গ, বিদার ও নান্দেন। এ চারটি জেলায় পুলিশি অভিযানকালে এবং পরে ১৮ হাজারের কম লোক নিহত হয়নি। অন্য চারটি জেলা আওরঙ্গাবাদ, বীর, নলগুন্দা ও মিদাকে কমপে পাঁচ হাজার লোক জীবন হারিয়েছে। আমরা অত্যন্ত রণশীল হিসেবে বলতে পারি যে, পুলিশি অভিযানকালে এবং পরে গোটা রাজ্যে কমপে ২৭ থেকে ৪০ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। কর্তৃপ আমাদেরকে অবহিত করেছে যে, ওই আটটি জেলা সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত হয়েছে এবং আমাদের প্রতিনিধিদলের সেখানে সফর খুবই জরুরি। অতএব আমরা ওই সব জেলায় আমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করি এবং আমরা বলতে পারি যে, পারস্পরিক শত্র“তা ও অবিশ্বাস প্রশমনে আমরা সফল হয়েছি। এটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ সত্য যে, এই আটটি জেলার সবচেয়ে তিগ্রস্ত চারটি জেলা ছিল (ওসমানাবাদ, গুলবার্গ, বিদার ও নান্দেন) নেজামের স্বেচ্ছাসেবকদের মূল ঘাঁটি লাতুর হচ্ছে কাসিম রিজভির নিজ শহর। এখানে ধনাঢ্য কুচ্চি মুসলিম বণিকেরা বসবাস করত। এই বিরাট বাণিজ্যিক কেন্দ্রে ২০ দিনের বেশি হত্যাকাণ্ড অব্যাহত ছিল। ১০ হাজার মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে আমরা সেখানে বড়জোড় তিন হাজার লোককে এখনো শহরে অবস্থান করতে দেখেছি। এক হাজারের বেশি লোককে হত্যা করা হয়েছে এবং বাদবাকিরা কোনো রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছে এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
০৩. প্রায় প্রতিটি তিগ্রস্ত এলাকায় সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা কেবলমাত্র হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, কোনো কোনো জায়গায় মহিলা ও শিশুরাও রা পায়নি। হত্যাকাণ্ডের পরে মহিলাদের ধর্ষণ ও অপহরণ (কখনো কখনো শোলাপুর ও নাগপুরের মতো রাজ্যের বাইরে ভারতীয় শহরে), লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, মসজিদের প্রতি অসম্মান, বলপূর্বক ধর্মান্তর, বাড়িঘর ও জমিজমা দখল করা হয়। শত শত কোটি রুপি মূল্যের সম্পদ লুট ও ধ্বংস করা হয়েছে। তিগ্রস্তরা ছিল মুসলমান। এসব অসহায় মুসলমান ছিল গ্রামাঞ্চলের সংখ্যালঘু। নৃশংসতার জন্য দায়ী অপরাধীরা শুধু স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে নিগৃহীত ব্যক্তিরা ছিল তা নয়, হায়দরবাদের অমুসলিমরাও নয়। সীমান্তের বাইরের নিরস্ত্র ও অস্ত্রধারী ব্যক্তি ও দুর্বৃত্তরা হায়দরাবাদের অমুসলিমদের এ দুষ্কর্মে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের পর এসব দুর্বৃত্ত অনুপ্রবেশ করেছিল। আমরা সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি যে, শোলাপুর ও ভারতের অন্য শহরের একটি সুপরিচিত হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনের বেশ কিছু সশস্ত্র ও প্রশিণপ্রাপ্ত ব্যক্তি, কতিপয় স্থানীয় লোক এবং বাইরের কমিউনিস্টরা এসব দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করেছে এবং কোনো কোনো েেত্র তারা দাঙ্গাকারীদের নেতৃত্ব দিয়েছে।
০৪. কর্তব্য আমাদেরকে এ কথাও বলতে বাধ্য করছে যে, আমাদের কাছে এ মর্মে নিঃসন্দেহে অকাট্য প্রমাণ আছে, বহু ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয় পুলিশ লুটতরাজ এবং অন্যান্য অপরাধে অংশগ্রহণ করেছে। আমাদের সফরকালে আমরা এমন তথ্য সংগ্রহ করেছি যে, সৈন্যরা মুসলমানদের দোকানপাট ও বাড়িঘরে লুটপাট চালাতে হিন্দু জনতাকে উৎসাহিত এমনকি কোনো কোনো ঘটনায় বাধ্য করেছে। একটি জেলা শহরে বর্তমান প্রশাসনের হিন্দু প্রধান আমাদের জানিয়েছেন, সশস্ত্রবাহিনী মুসলমানদের দোকানপাটে নির্বিচারে লুণ্ঠন চালিয়েছে। আরেকটি জেলায় সৈন্যরা একজন মুন্সেফসহ অন্যদের বাড়িঘর লুট করেছে এবং একজন তহসিলদারের স্ত্রীর সম্ভ্রমহানি ঘটানো হয়েছে। বিশেষ করে শিখ সৈন্যদের বিরুদ্ধে মহিলাদের সম্ভ্রমহানি ঘটানোর এবং অপহরণ করার অভিযোগ কোনোক্রমেই নগণ্য ছিল না। আমাদেরকে অবহিত করা হয়েছে যে, বহু জায়গায় সশস্ত্রবাহিনী লুণ্ঠিত সম্পদ, নগদ অর্থ, স্বর্ণ ও রৌপ্য নিয়ে গেছে এবং অবশিষ্ট লুণ্ঠিত মালামাল জনতার হাতে পড়ে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন কিছু সদস্য ছিল যারা সাম্প্রদায়িক আবেগ মুক্ত ছিল না। কেননা তাদের কেউ কেউ অন্যত্র তাদের আত্মীয়স্বজনদের ওপর নৃশংসতার কথা ভুলতে পারেনি।
পাছে আমাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর কলঙ্ক আরোপ করার জন্য যাতে অভিযুক্ত করা না হয় সে জন্য আমরা আমাদের সুচিন্তিত মতামত রেকর্ড করেছি যে, হায়দরাবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও এ বাহিনীর অফিসাররা উঁচু মানের শৃঙ্খলা ও কর্তব্য জ্ঞান বজায় রেখেছেন। আমরা জেনারেল চৌধুরীকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখেছি যার মধ্যে সাম্প্রদায়িক পপাতিত্ব ছিল না। তিনি হলেন কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ ও আগাগোড়া একজন ভদ্রলোক।
মুসলমানদের রায় এমন উদাহরণ আমাদের কাছে দেয়া হয়েছে যেখানে হিন্দুরা তাদের প্রতিবেশী মুসলিম নর-নারীকে তাদের জীবনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে রা করেছে। কোনো কোনো পেশাজীবীদের মধ্যে সহমর্মিতা ছিল অত্যন্ত লণীয়। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু তাঁতীরা হিন্দুদের আক্রমণ থেকে মুসলিম তাঁতিদের রা করেছে এবং কখনো কখনো নিজেরা অনেক চড়া মূল্য দিয়ে (প্রাণহানিসহ) তাদের আশ্রয় দিয়েছে। বহু হিন্দু অপহৃত মুসলিম মহিলাদের উদ্ধারে সহায়তা করেছে।
০৫. পুলিশি অভিযানের পরে এবং স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের পতনের পরিণামে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ বেধে যায়। নেজামের স্বেচ্ছাসেবকেরা ছিল সরকার প্রতিষ্ঠার পথে কার্যকর অন্তরায়। হায়দরাবাদের মুসলমানদের কাছে একটি দায়িত্বশীল সরকার ছিল হিন্দু রাজের সমার্থক। কেননা এ সরকার প্রতিষ্ঠা করা হতো সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ইচ্ছার ভিত্তিতে। এ সত্য অনুধাবনে মুসলমানদের বিলম্ব হয় যে, তাদের দুর্ভোগ হচ্ছে মাত্র কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। স্বেচ্ছাসেবকদের আন্দোলনের প্রতি হায়দরাবাদের বিপুলসংখ্যক মুসলমানের সহানুভূতি ছিল। কেউ কেউ উন্মত্ততার প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে গিয়ে তাদের গোঁয়ার্তুমির জন্য চরম মূল্য দিয়েছে। তাদের গোঁয়ার্তুমি এমন ছিল যে, তাদের একজন আততায়ীর বুলেটে প্রাণ দেয়। তাদের মতো মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিরা এমন একটি বিশ্বাসে উৎসাহ বোধ করেছিল যে, তাদের পেছনে কর্তৃপরে সমর্থন আছে।
শেষ করার আগে আমাদেরকে মূল্যবান সহায়তা এবং স্বপ্রণোদিত সহযোগিতা করার জন্য হায়দরাবাদের সামরিক প্রশাসন, আমরা যেসব জেলা সফর করেছি সেসব জেলার সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি কর্মচারী, বিশিষ্ট নাগরিক এবং সবশেষে আমাদের দু’জন সচিব মি. ফারুক সায়ার ও পিপি আম্বুলকারের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।
********
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর দক্ষিন ভারতের স্বাধীন রাজ্য হায়দারবাদ ভারত পাকিস্তান কোন দেশেই যোগদান করে নাই। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল যখন হায়দারবাদের নিজাম কে ভারতে যোগদানের কথা বলে তখন হায়দারবাদের নিজাম বলেন ১৫ আগস্ট থেকেই এই হায়দারবাদ হল একটা স্বাধীন দেশ। মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের দ্বারপ্রান্তে ১৭২৪ সালে Nizam-ul-Mulk Asaf Jah দক্ষিন ভারতের এই স্বাধীন হায়দারবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৯৮ সালে First Duke of wellington Arthur Wellesley এর আমন্ত্রণে এই হায়দারবাদ রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে যোগদান করে। ৭ম নিজাম মীর উসমান আলীর সময়ে এই হায়দারবাদ রাজ্য ভারতের সবচেয়ে বড় স্বাধীন রাজ্যে রূপলাভ করে। 82,698 square miles 214,190 km2 ২ লাখ ১৪ হাজার ১৯০ বর্গ কিলোমিটারের এই হায়দারবাদ রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি। এদের মাঝে শতকরা ৮৫ ভাগই ছিল হিন্দু। এই হায়দারবাদ অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব সেনাবাহিনী, নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা, নিজস্ব রেল যোগাযোগ ও ডাক বিভাগ ছিল। অর্থাৎ একটি স্বাধীন দেশে যা যা থাকে তার সবকিছুই ছিল এই হায়দারবাদে। হায়দারবাদ যখন ভারতে যোগদান করতে চাচ্ছিল না তখন ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত এই এই হায়দারবাদ অঙ্গরাজ্যে তার সেনাবাহিনী প্রেরন করে। এই অপারেশনের নাম দেয়া হয় Operation Polo, উইকিপিডিয়ায় এই Operation Polo নামে একটি নিবন্ধ আছে।
১৩ September থেকে 18 September, মাত্র ৫ দিনের এই ভারতের সেনাবাহিনীর আক্রমনে প্রায় ৪০০০০ এর মত মুসলিম মারা যায়। Operation Polo নিয়ে উইকিপিডিয়ার ঐ নিবন্ধটা এই লিংকে তাছাড়া Google এ operation polo লিখে search দিলেও এই হায়দারবাদের মুসলিম হত্যা নিয়ে অনেক ভাল ভাল লেখা আসে। ভারত হায়দরাবাদে শুধু অন্যায় আগ্রাসন চালিয়েছে তাই নয়, ভারতীয় সৈন্যরা সেখানে নির্মম গণহত্যা চালায় এবং ধর্ষণে লিপ্ত হয়। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় পৃথিবীর ইতিহাসের নির্মম গণহত্যার একটি উপাখ্যান। বিশ্ববাসী কথায় কথায় কম্বোডিয়া, সাবেক যুগোশ্লাভিয়া, সিয়েরা লিয়ন ও রুয়ান্ডায় সংঘটিত গণহত্যা এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদী হলোকাস্টের ট্রাজেডি স্মরণ করে, স্মরণ করে না কেবল হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের গণহত্যা। আজ পর্যন্ত কোথাও কেউ হায়দরাবাদে গণহত্যার জন্য ভারতের বিচার দাবি করেনি। কাউকে ভারতের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতেও দেখা যায় না। কত পিতা তার আদরের সন্তান, কত স্বামী তার প্রিয়তম স্ত্রী, কত স্ত্রী তার চিরদিনের সাথী স্বামীকে হারিয়েছে তার হিসাব নেই। স্বজনহারাদের একজন হলেন সৈয়দ কুতুবউদ্দিন। ১৯৯৫ সালে কবি আবদুল হাই সিকদার লন্ডনে তার সঙ্গে দেখা করেন। হায়দরাবাদে ভারতের সামরিক অভিযানে তিনি তার পিতামাতা, দুই ভাই ও প্রিয়তম স্ত্রী জেবুন্নিসাকে হারান। জেবুন্নিসাকে তিনি হাসপাতাল, মর্গ, কারাগার, পতিতাপল্লীসহ সব জায়গায় খুঁজেছেন। কিন্তু তিনি তাকে আর কখনো খুঁজে পাননি। কান্না তার আজীবনের সঙ্গী। তার মতো আজো অনেকে তাদের প্রিয়জনের জন্য বুক ভাসিয়ে কাঁদেন। হায়দরাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় এজেন্ট জেনারেল কেএম মুন্সী ছিলেন সব ঘটনার সাক্ষী। কিন্তু ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তিনি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘দ্য এন্ড অব অ্যান অ্যারা’তে সব সত্য চাপা দিয়েছেন। ভারতীয়রা নিজেদের কৃত অপরাধ চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও সত্য তার নিজের শক্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে। আমেরিকান পর্যটক উইলিয়াম ডালরিম্পল হায়দরাবাদ সফরে গিয়ে সেখানে ভারতীয় সৈন্য ও তাদের স্থানীয় হিন্দু দোসরদের গণহত্যার সুস্পষ্ট প্রমাণ খুঁজে পায়। সে তার ‘দ্য এজ অব কলি’ শিরোনামে গ্রন্থের ২০৯-১০ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছে:
“I discovered later that it is in fact possible to make an informed estimate of the numbers killed in the aftermath of the `police action’. For when reports of atrocities began to reach Delhi, Nehru `in his private capacity’ commissioned an unofficial inquiry commission with a group of veteran Congressmen made up of two Hyderabadi Muslims who had prominantly opposed the Nizam’s rule and chaired by a Hindu Pandit Sundarlal. The team made an extensive tour of the State and submitted their report to Nehru and Sardar Patel in January 1949. The report’s findings were never made public, however, presumably because of its damning criticism of the conduct of the Indian army. It remained unpublished until a portion of it, smuggled out of India, recently appeared in America in an obscure volume of scholarly essays entitled `Hyderabad: After the Fall.’ The report, entitled On the Post-Operation Polo Massacres, Rape and Destruction or seizure of Property in Hyderabad State, makes grim reading. In village after village across the state, it meticuiously and unemotionally catalogued incidents of murder and mass rape, sometimes committed by troops, in other cases committed by local Hindu hooligans after the troops had disarmed the Muslim population. A short extract, chosen at random, gives the general flavour: `Ganjoti Paygah, District Osmanabad: There are 500 homes belonging to Muslims here. Two hundred Muslims were murdered by the goondas. The army had seized weapons from the Muslims. As the Muslims became defenceless, the goondas began the massacre. Muslim women were raped by the troops. Statement of Pasha Bi, resident of Ganjoti: the trouble in Ganjoti began after the army’s arrival. All the young Muslim women here were raped. Five daughters of Osman Sahib were raped and six daughters of Qazi were raped. Ismail Sahib Sawdagar’s daughter was raped in Saiba Chamar’s home for a week. Soldiers from Umarga came every week and after all night rape young Muslim women were sent back to their homes in the morning. Mahtab Tamboli’s daughters were divided among Hindus, one is in Burga Julaha’s home. And so on, for page after page. In all, the report estimates that as many as 200,000 Hyderabadi Muslims were slaughtered in the aftermath of the `police action:’ an astonishing figure which, if true, would turn the `police action’ into a bloodbath comparable to parts of the Punjab during Partition. Even if one regards the figure of 200,000 dead as an impossible exaggeration, it is still clear that the scale of the killing was horrific. Although publicly Nehru played down the disorder in Hyderabad, claiming to the Indian representative at the United Nations that following the Nizam’s officials deserting their posts there had been some disorder in which Hindus had retaliated for their sufferings under the (Muslim) Razakars (militia), privately he was much more alarmed. This is indicated by a note of Nehru sent to Sardar Patel’s ministry of States on the 26th of November 1948, saying that he had received reports killings of Muslims so large in number `as to stagger the imagination’ and looting of Muslim property `on a tremendous scale’-all of which would seem to confirm the general tone of Pandit Sunderlal’s report.
” অর্থাৎ হায়দরাবাদে ‘পুলিশী অভিযানে’ নিহতদের আনুমানিক একটি সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব বলে আমি উপলদ্ধি করি। দিল্লিতে গণহত্যার রিপোর্ট এসে পৌঁছতে শুরু করলে নেহরু ‘তার ব্যক্তিগত ক্ষমতা বলে’ নিজামের শাসনের কট্টর বিরোধিতাকারী ও কংগ্রেসের প্রবীণ সদস্য হায়দরাবাদের দু’জন মুসলমান এবং হিন্দু পণ্ডিত সুন্দরলালের নেতৃত্বে একটি বেসরকারি তদন্ত কমিশন গঠন করে। এ টীম হায়দরাবাদে ব্যাপকভাবে সফর করে এবং ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে নেহরু ও সরদার প্যাটেলের কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা থাকায় এ তদন্ত রিপোর্ট কখনো প্রকাশ করা হয়নি। রিপোর্টের একটি অংশ ভারতের বাইরে পাচার হওয়া নাগাদ তা ছিল অপ্রকাশিত। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ‘হায়দরাবাদ: আফটার দ্য ফল’ শিরোনামে একটি গবেষণামূলক নিবন্ধে এ উপাখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। এ নিবন্ধে ‘অপারেশন পলো-পরবর্তী হত্যাকান্ড, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ এবং হায়দরাবাদ রাজ্যে সম্পত্তি দখল’ শিরোনামে একটি রিপোর্টে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। এ রিপোর্টে হায়দরাবাদ রাজ্যে গ্রামের পর গ্রামে ভারতীয় সৈন্যদের হত্যা, গণধর্ষণ এবং নিরস্ত্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিধনে স্থানীয় হিন্দু গুন্ডাদের পরিকল্পিত অপরাধের নির্মোহ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। একটি ছোট্ট ঘটনার বর্ণনা থেকে গোটা পরিস্থিতি আঁচ করা সম্ভব: ‘গাঞ্জোটি পায়গাঁও, ওসমানাবাদ জেলা: এখানে মুসলমানদের ৫০০টি বাড়ি ছিল। গুন্ডারা ২০০ মুসলমানকে হত্যা করে।
সেনাবাহিনী মুসলমানদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়। মুসলমানরা অরক্ষিত হয়ে গেলে গুন্ডারা হত্যাকান্ডে মেতে উঠে। সৈন্যরা মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণ করে। Youtube এও অপারেশন পলো নামে একটা ভিডিও আছে http://youtu.be/itPihtVAbXc গাঞ্জোটির পাশা বাঈ বলেছে, সেনাবাহিনী এসে পৌঁছানোর পর গাঞ্জোটিতে গোলযোগ শুরু হয়। এখানকার সব যুবতী মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। ওসমান সাহেবের পাঁচ কন্যা এবং কাজী সাহেবের ছয় কন্যাকে ধর্ষণ করা হয়। সাইবা চামারের বাড়িতে ইসমাইল সাহেব সওদাগরের কন্যাকে এক সপ্তাহ ধর্ষণ করা হয়। ওমরগাঁও থেকে সৈন্যরা প্রতি সপ্তাহে আসতো এবং সারারাত ধর্ষণের পর যুবতী মুসলিম মহিলাদের সকালে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হতো। মাহতাব তাম্বুলির কন্যাদের হিন্দুদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়া হয়। বুর্গা জুলাহার বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল একজনকে। রিপোর্টের প্রতিটি পৃষ্ঠার বর্ণনা অভিন্ন। তাতে বলা হয়, ‘পুলিশী অভিযানে’ হায়দরাবাদে মোট ২ লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। নিহতদের এ সংখ্যা অবিশ্বাস্য। রিপোর্টের বর্ণনা সত্যি হয়ে থাকলে উপমহাদেশ বিভক্তিকালে পাঞ্জাবে সংঘটিত গণহত্যার সঙ্গে হায়দরাবাদে ‘পুলিশী অভিযানের’ রক্তগঙ্গাকে তুলনা করা যায়। কেউ হয়তো ২ লাখকে অতিরঞ্জিত মনে করতে পারেন। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, এ হত্যাকান্ড ছিল ভয়াবহ। জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধি দাবি করেছিল, নিজামের সৈন্যরা তাদের চৌকি পরিত্যাগ করার পর কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। এ বিশৃঙ্খলাকালে হিন্দুরা রাজাকারদের হাতে তাদের দুর্ভোগের প্রতিশোধ গ্রহণ করে। নেহরু প্রকাশ্যে হায়দরাবাদে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করলেও একান্তভাবে ছিল উদ্বিগ্ন।
১৯৪৮ সালের নভেম্বরে সরদার প্যাটেলের মন্ত্রণালয়ে নেহরুর পাঠানো একটি চিঠিতে তার প্রতিফলন ঘটেছে। চিঠিতে নেহরু উল্লেখ করেছিল, সে শিউরে উঠার মতো বিপুল সংখ্যক মুসলিম হত্যাকান্ড এবং অবিশ্বাস্য মাত্রায় মুসলমানদের সম্পত্তি লুণ্ঠনের রিপোর্ট পেয়েছে। এসব ঘটনা পন্ডিত সুন্দরলালের রিপোর্টের সার্বিক ধারণাকে সত্যি বলে প্রমাণ করছে। ইসলামী ইতিহাস বিশেষজ্ঞ এবং জিন্নাহ ও নিজামের কট্টর সমালোচক অধ্যাপক উইলফ্রেড কার্টওয়েল স্মিথও হায়দরাবাদে মুসলিম গণহত্যা সম্পর্কে আমেরিকান পর্যটক উইলিয়াম ডালরিম্পলের অনুরূপ মতামত দিয়েছে। ১৯৪৯ সালে হায়দরাবাদ সফর শেষে সে ‘হায়দরাবাদ: এ মুসলিম ট্রাজেডি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে লিখেছে:
“Off the battlefield, however, the Muslim community fell before a massive and brutal blow, the devastation of which left those who did survive reeling in bewildered fear. Thousands upon thousands were slaughtered, many hundred of thousands uprooted. The instrument of their disaster was, of course, vengeance. Particularly in the Marathwara section of the state and to a less but still terrible extent in most other areas, the story of the days after ‘police action’ is grim.”
অর্থাৎ রণাঙ্গনের বাইরে মুসলিম সম্প্রদায় ব্যাপক ও নৃশংস দুর্ভাগ্যের শিকার হয়। হাজার হাজার লোককে হত্যা এবং লাখ লাখ লোককে গৃহহীন করা হয়। অবশ্যই প্রতিহিংসা তাদের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বিশেষ করে এ রাজ্যের মারাঠাবারা এবং অন্যান্য এলাকায় এখনো প্রতিহিংসার নিষ্ঠুর স্বাক্ষর বিদ্যমান। ‘পুলিশী অভিযানের’ পরবর্তী দিনগুলোর উপাখ্যান খুবই করুণ। শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদের তাগিদে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসতার রিপোর্ট প্রণয়নে হিন্দু পন্ডিত সুন্দরলালের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। এ তদন্ত কমিটি নেহরুর কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টটি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। নেহরুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সুন্দরলাল রিপোর্ট প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। বহু বিলম্বে হলেও এ রিপোর্ট ফাঁস হয়ে যায়। মুসলিম দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসতার বিবরণ সম্বলিত অতি গোপনীয় এ রিপোর্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
(1) The Honourable Prime Minister, Government of India, New Delhi. (2) The Honourable States Minister, Government of India, New Delhi. Sir, We were asked by the Government of India to proceed to Hyderabad State on a goodwill mission. After completing our task there we now beg to submit our report. (1) The delegation consisting of Pandit Sundarlal, Kazi Abdul Ghaffar and Moulana Abdullah Misri arrived at Hyderabad on the 29th November and returned to Delhi on the 21st of December 1948. During this period we toured through 9 out of the 16 districts of the state, visiting 7 district headquarters, 21 towns and 23 important villages. In addition we interviewed over 500 people from 109 such villages as we did not visit. Further 31 public meetings at various places and 27 private gatherings of Hindu, Muslims, Congress men, official Members of Jamiat Ullema and of the Ittehadul Muslimeen, the staffs and students of some Educational Institutions, Members of the Progressive Writers Association and of the Hindustani Prachar Sabha etc. were addressed by members of the delegation. Amongst important men and officials interviewed by us may be mentioned H.E.H. the Nizam, H.E. the Prince of Berar, Major General Choudhri, Mr. Bakhlo, the Chief Civil Administrator, Swami Ramanand Tirtha, Dr. Malkote, Messers Ramchander Rao, Ramachari, K. Vadya, Venkat Rao and Abul Hassan Sayed Ali, Nawab Ali Yawar Jung, Nawab Zain Yar Jung, Raja Dhonde Raj, Moulana Abu Yousuf, Moulvi Abdul Khair and Moulvi Hameed uddin Qamar Farooqi. At all these meetings and interviews the main problems discussed was that of the creation and maintenance of cordial relations between the communities. Appeals were made to the people to forget the past and to work unremittingly for the establishment of peace and harmony amongst themselves. The aim and policy of the Indian Union was also explained and special emphasis was laid on the objective which was the establishment of a secular government for the people of Hyderabad, in which all of them irrespective of religion, caste or creed will enjoy equal freedom and civil rights and will have equal opportunities for development and progress. It was made perfectly clear that the military administration had been charged with the duty of implementing that policy. We clarified our position, whenever opportunity presented itself saying that ours was not a Commission of investigation or Inquiry into events proceeding or following the police action and that ours was merely a goodwill mission charged with the task of restoring better communal relations. All the same, we feel it our duty to bring to your notice what we saw and gathered in our tourings, as it has, in our opinion, an importance all its own. (2) Hyderabad State has 16 districts, comprising nearly 22,000 villages. Out of them only three districts remained practically, though not wholly, free of communal trouble which affected the state first during the activities of the Razakars and then during the reprisals that followed the collapse of that organisation. In another four districts the trouble had been more serious but nothing like the havoc that overtook the remaining eight. Out of these again the worst sufferers have been the district of Osmanabad, Gulburga, Bidar and Nanded, in which four the number of people killed during and after the police action was not less, if not more than 18,000. In the other four districts viz, Aurangabad, Bir, Nalgunda and Medak those who lost their lives numbered at least 5 thousand. We can say at a very conservative estimate that in the whole state at least 27 thousand to 40 thousand people lost their lives during and after the police action. We were informed by the authorities that those eight were the most affected districts and needed most the good offices of our delegation. We, therefore, concentrated on these and succeeded, we might say, to some extent at least, in dispelling the atmosphere of mutual hostility and distrust. It is a significant fact that out of of these eight the four worst affected districts (Osmanabad, Gulburga, Bidar and Nanded) had been the main strongholds of Razakars and the people of these four districts had been the worst sufferers at the hands of the Razakars. In the town of Latur, the home of Kasim Rizvi- which had been a big business centre, with rich Kuchhi Muslim merchants, the killing continued for over twenty days. Out of a population of about ten thousand Muslims there we found barely three thousand still in the town. Over a thousand had been killed and the rest had run away with little else besides their lives and completely ruined financially. (3) Almost everywhere in the affected areas communal frenzy did not exhaust itself in murder, alone in which at some places even women and children were not spared. Rape, abduction of women (sometimes out of the state to Indian towns such as Sholapur and Nagpur) loot, arson, desecration of mosques, forcible conversions, seizure of houses and lands, followed or accompanied the killing. Tens of crores worth of property was looted or destroyed. The sufferers were Muslims who formed a hopeless minority in rural areas. The perpetrators of these atrocities were not limited to those who suffered at the hands of Razakars, not to the non-Muslims of Hyderabad state. These latter were aided and abetted by individuals and bands of people, with arms and without arms, from across the border, who had infiltrated through in the wake of the Indian army. We found definite indications that a number of armed and trained men belonging to a well known Hindu communal organisation from Sholapur and other Indian towns as also some local and outside communists participated in these riots and in some cases actually led the rioters. (4) Duty also compels us to add that we had absolutely unimpeachable evidence to the effect that there were instances in which men belonging to the Indian Army and also to the local police took part in looting and even other crimes. During our tour we gathered, at not a few places, that soldiers encouraged, persuaded and in a few cases even compelled the Hindu mob to loot Muslim shops and houses. At one district town the present Hindu head of the administration told us that there was a general loot of Muslim shops by the military. In another district a Munsif house, among others was looted by soldiers and a Tahsilder’s wife molested. Complaints of molestation and abduction of girls, against Sikh soldiers particularly, were by no means rare. We were generally told that at many places out of the looted property cash, gold and silver was taken away by military while other articles fell to the share of the mob. Unfortunately there was a certain element in the army which was not free from communal feelings probably because some of them could not forget the atrocities committed elsewhere on their own kith and kin. Lest we might be understood to imply a slur on the Indian army we hasten to record our considered opinion that the Indian Army and its officers in Hyderabad generally maintained a high standered of discipline and sense of duty. In General Choudhri we found a man without any tinge of communal prejudice, a firm disciplinarian and thorough gentleman. We were given by Muslims instances in which Hindus had defended and given protection to their Muslim neighbours, men and women even at the cost of their own lives. In some professions the fellow feeling was particularly marked. For instance at places Hindu weavers defended Muslim weavers against Hindu and protected them often at a very heavy cost (including loss of life) to themselves. Many Hindus helped in the recovery of abducted Muslim women. (5) This communal trouble followed close upon the heels of the police action and the consequent collapse of the Razakar organisation, which had stood in the Muslim mind, acted as an effective barrier against the establishment of responsible government which was synonymous, to the average Hyderabadi Muslim, with Hindu Raj, because it would be based on the will of the Hindu majority. Muslim masses were generally slow to realise that their sufferings were the inevitable repurcussions of the atrocities committed on the Hindus only, a few days before, by the Razakars. The Razakars movement had the sympathy of a good number of Muslims in Hyderabad. Such of them as dared publicly to oppose that madness paid heavily for their temerity, so much so that one of them fell before the bullet of an assassin. Like the Razakars the perpetrators of crimes against the Muslims encouraged the belief that they had the backing of the authorities. Before closing we must gratefully acknowledge the valuable help and willing cooperation given to us by the Military Administration in Hyderabad, by Government officials in the districts we visited, by public workers and prominent citizens and lastly by our two Secretaries Messers Furrukh Sayer and P.P. Ambulkar.
প্রতি, (১) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ভারত সরকার, নয়াদিল্লি। (২) মাননীয় রাজ্যমন্ত্রী, ভারত সরকার, নয়াদিল্লি। মহোদয়, ভারত সরকার আমাদেরকে হায়দরাবাদ রাজ্যে একটি শুভেচ্ছা সফরে যাবার জন্য অনুরোধ করে। আমাদের কাজ শেষ করে এখন আমরা আমাদের রিপোর্ট পেশ করছি। (১) পন্ডিত সুন্দরলাল, কাজী আবদুল গফুর ও মাওলানা আবদুল্লাহ মিসরির সমন্বয়ে গঠিত এই প্রতিনিধি দল ২৯ নভেম্বর হায়দরাবাদে গিয়ে পৌঁছে এবং ১৯৪৮ সালের ২১ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে ফিরে আসে। এসময় আমরা রাজ্যের ১৬টির মধ্যে ৯টি জেলা, ৭টি জেলা সদর, ২১টি শহর ও ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম সফর করেছি। এছাড়া আমরা এ ধরনের ১০৯টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক লোকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ৩১টি জনসমাবেশ এবং হিন্দু, মুসলিম, কংগ্রেস সদস্য, জমিয়ত-ই-উলেমা ও ইত্তেহাদুল মুসলিমীনের কর্মকর্তা, কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারি ও ছাত্র, প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনের সদস্য এবং হিন্দুস্তানি প্রচার সভার ২৭টি ঘরোয়া সমাবেশে ভাষণ দিয়েছে। আমরা যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- হায়দরাবাদের মহামান্য নিজাম, বেরারের মহামান্য প্রিন্স, মেজর জেনারেল চৌধুরী, মি. বাখলু, মুখ্য বেসামরিক প্রশাসক, স্বামী রমানন্দ তীর্থ, ড. মালকোত, রামচন্দ্র রাও, রামাচার্য, কে. বৈদ্য, ভেঙ্কট রাও, আবুল হাসান সৈয়দ আলী, নওয়াব আলী ইয়ার জং, নবাব জৈন ইয়ার জং, রাজা ধোন্দি রাজ, মাওলানা আবু ইউসূফ, মৌলভী আবদুল খায়ের ও মৌলভী হামিদউদ্দিন কামার ফারুকী।
এসব সমাবেশ ও সাক্ষাৎকারে আমরা দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বজায় রাখার মূল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। নিজেদের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করার এবং অতীতের তিক্ততা ভুলে যাবার জন্য জনগণের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছি। তাদের কাছে ভারত সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছি এবং হায়দরাবাদের জনগণের জন্য একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছি। আমরা তাদের সামনে ব্যাখ্যা করেছি যে, ধর্মনিরপেক্ষ সরকারে ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণী নির্বিশেষে তাদের সকলে সমান অধিকার ও নাগরিক সুবিধা ভোগ করবে এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সকলের সমান সুযোগ সুবিধা থাকবে। তাদেরকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ নীতি বাস্তবায়ন করা হলো সামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব। সুযোগ পাওয়া মাত্র আমরা আমাদের অবস্থানের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছি যে, পুলিশী অভিযানের আগে বা পরের ঘটনাবলী তদন্ত বা অনুসন্ধান করার জন্য কোনো কমিশন হিসাবে আমরা কাজ করছি না। আমরা এসেছি একটি শুভেচ্ছা মিশনে এবং আমাদের দায়িত্ব হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করা। একইসঙ্গে আমরা যা প্রত্যক্ষ করেছি এবং আমাদের সফরকালে যেসব তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি সেসব তথ্য আপনার নজরে আনা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। আমাদের মতে, এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। (২) ১৬টি জেলা এবং আনুমানিক ২২ হাজার গ্রাম নিয়ে হায়দরাবাদ রাজ্য গঠিত। এসব জেলার মধ্যে মাত্র তিনটি পুরোপুরি না হলেও বাস্তবে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ থেকে মুক্ত ছিল।
রাজাকারদের তৎপরতাকালে এবং এ মিলিশিয়া সংগঠনের পতন ঘটার পর প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়ার সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রাজ্যটি আক্রান্ত হয়। অন্য চারটি জেলায় সাম্প্রদায়িক গোলাযোগ ছিল আরো মারাত্মক। তবে এ চারটি জেলার গোলযোগ অবশিষ্ট ৮টি জেলার মতো এত শোচনীয় ছিল না। এই ৮টি জেলার মধ্যে আবার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হচ্ছে ওসমানাবাদ, গুলবার্গ, বিদার ও নান্দেন। এ চারটি জেলায় পুলিশী অভিযানকালে এবং পরে ১৮ হাজারের কম লোক নিহত হয়নি। অন্য চারটি জেলা আওরঙ্গাবাদ, বীর, নলগুন্দা ও মিদাকে কমপক্ষে ৫ হাজার লোক জীবন হারিয়েছে। আমরা অত্যন্ত রক্ষণশীল হিসাবে বলতে পারি যে, পুলিশী অভিযানকালে এবং পরবর্তীতে গোটা রাজ্যে কমপক্ষে ২৭ থেকে ৪০ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে অবহিত করেছে যে, ঐ ৮টি জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং আমাদের প্রতিনিধি দলের সেখানে সফর খুবই জরুরি। অতএব আমরা ঐসব জেলায় আমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করি এবং আমরা বলতে পারি যে, পারস্পরিক শত্রুতা ও অবিশ্বাস প্রশমনে আমরা সফল হয়েছি। এটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ সত্য যে, এই ৮টি জেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চারটি জেলা ছিল (ওসমানাবাদ, গুলবার্গ, বিদার ও নান্দেন) রাজাকারদের মূল ঘাঁটি এবং এ চারটি জেলার লোক রাজাকারদের হাতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। লাতুর হচ্ছে কাসিম রিজভির নিজ শহর। এখানে ধনাঢ্য কুচ্চি মুসলিম বণিকরা বসবাস করতো। এই বিরাট বাণিজ্যিক কেন্দ্রে ২০ দিনের বেশি হত্যাকান্ড অব্যাহত ছিল।
১০ হাজার মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে আমরা সেখানে বড়জোড় তিন হাজার লোককে এখনো শহরে অবস্থান করতে দেখেছি। এক হাজারের বেশি লোককে হত্যা করা হয়েছে এবং বাদবাকিরা কোনো রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছে এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। (৩) প্রায় প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা কেবলমাত্র হত্যাকান্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, কোনো কোনো জায়গায় মহিলা ও শিশুরাও রক্ষা পায়নি। হত্যাকান্ডের পরবর্তীতে মহিলাদের ধর্ষণ ও অপহরণ (কখনো কখনো শোলাপুর ও নাগপুরের মতো রাজ্যের বাইরে ভারতীয় শহরে), লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, মসজিদের প্রতি অসম্মান, বলপূর্বক ধর্মান্তর, বাড়িঘর ও জমিজমা দখল করা হয়।
শত শত কোটি রুপি মূল্যের সম্পদ লুট ও ধ্বংস করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা ছিল মুসলমান। এসব অসহায় মুসলমান ছিল গ্রামাঞ্চলের সংখ্যালঘু। নৃশংসতার জন্য দায়ী অপরাধীরা শুধু রাজাকারদের হাতে নিগৃহীত ব্যক্তিরা ছিল তা নয়, হায়দরাবাদের অমুসলিমরাও নয়। সীমান্তের বাইরের নিরস্ত্র ও অস্ত্রধারী ব্যক্তি ও দুর্বৃত্তরা হায়দরাবাদের অমুসলিমদের এ দুষ্কর্মে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের পর এসব দুর্বৃত্ত অনুপ্রবেশ করেছিল। আমরা সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি যে, শোলাপুর ও ভারতের অন্যান্য শহরের একটি সুপরিচিত হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনের বেশ কিছু সশস্ত্র ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি, কতিপয় স্থানীয় লোক এবং বাইরের কমিউনিস্টরা এসব দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা দাঙ্গাকারীদের নেতৃত্ব দিয়েছে। (৪) কর্তব্য আমাদেরকে একথাও বলতে বাধ্য করছে যে, আমাদের কাছে এ মর্মে নিঃসন্দেহে অকাট্য প্রমাণ আছে যে, বহু ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয় পুলিশ লুটতরাজ এবং অন্যান্য অপরাধে অংশগ্রহণ করেছে। আমাদের সফরকালে আমরা এমন তথ্য সংগ্রহ করেছি যে, সৈন্যরা মুসলমানদের দোকানপাট ও বাড়িঘরে লুটপাট চালাতে হিন্দু জনতাকে উৎসাহিত এমনকি কোনো কোনো ঘটনায় বাধ্য করেছে।
একটি জেলা শহরে বর্তমান প্রশাসনের হিন্দু প্রধান আমাদের জানিয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী মুসলমানদের দোকানপাটে নির্বিচারে লুণ্ঠন চালিয়েছে। আরেকটি জেলায় সৈন্যরা একজন মুন্সেফসহ অন্যদের বাড়িঘর লুট করেছে এবং একজন তহসিলদারের স্ত্রীর সম্ভ্রমহানি ঘটানো হয়েছে। বিশেষ করে শিখ সৈন্যদের বিরুদ্ধে মহিলাদের সম্ভ্রমহানি ঘটানোর এবং অপহরণ করার অভিযোগ কোনোক্রমেই নগণ্য ছিল না। আমাদেরকে অবহিত করা হয়েছে যে, বহু জায়গায় সশস্ত্র বাহিনী লুণ্ঠিত সম্পদ, নগদ অর্থ, স্বর্ণ ও রৌপ্য নিয়ে গেছে এবং অবশিষ্ট লুণ্ঠিত মালামাল জনতার হাতে পড়ে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন কিছু সদস্য ছিল যারা সাম্প্রদায়িক আবেগ মুক্ত ছিল না। কেননা তাদের কেউ কেউ অন্যত্র তাদের আত্মীয় স্বজনদের ওপর নৃশংসতার কথা ভুলতে পারেনি। পাছে আমাদেরকে না জানি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর কলঙ্ক আরোপের জন্য অভিযুক্ত করা হয় সেজন্য আমরা সুচিন্তিত অভিমত দিচ্ছি যে, হায়দরাবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং এ বাহিনীর অফিসাররা উঁচু মানের শৃঙ্খলা ও কর্তব্য জ্ঞান বজায় রেখেছে। আমরা জেনারেল চৌধুরীকে এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে দেখেছি যার মধ্যে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব ছিল না। সে হলো কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ ও আগাগোড়া একজন ভদ্রলোক। মুসলমানদের রক্ষায় এমন উদাহরণ আমরা পেয়েছি যে, যেখানে হিন্দুরা তাদের প্রতিবেশি মুসলিম নর-নারীকে জীবনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে রক্ষা করেছে। কোনো কোনো পেশাজীবীদের মধ্যে সহমর্মিতা ছিল অত্যন্ত লক্ষ্যণীয়। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু তাঁতীরা হিন্দুদের আক্রমণ থেকে মুসলিম তাঁতীদের রক্ষা করেছে এবং কখনো কখনো নিজেরা অনেক চড়া মূল্য দিয়ে (প্রাণহানিসহ) তাদের আশ্রয় দিয়েছে।
বহু হিন্দু অপহৃত মুসলিম মহিলাদের উদ্ধারে সহায়তা করেছে। (৫) পুলিশী অভিযানের পরে এবং মুসলমানদের সমর্থনপুষ্ট রাজাকার সংগঠনের পতনের পরিণামে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ একটি দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কার্যকর অন্তরায় হিসাবে কাজ করেছে। হায়দরাবাদের মুসলমানদের কাছে একটি দায়িত্বশীল সরকার ছিল হিন্দু রাজের সমার্থক। কেননা এ সরকার প্রতিষ্ঠা করা হতো সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ইচ্ছার ভিত্তিতে। এ সত্য অনুধাবনে মুসলমানদের বিলম্ব হয় যে, তাদের দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে মাত্র কয়েকদিন আগে রাজাকারদের নৃশংসতার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া।
রাজাকার আন্দোলনের প্রতি হায়দরাবাদের বিপুলসংখ্যক মুসলমানের সহানুভূতি ছিল। কেউ কেউ তাদের উন্মত্ততার প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে গিয়ে চরম মূল্য দিয়েছে। তাদের একজন আততায়ীর বুলেটে প্রাণ দিয়েছে। রাজাকারদের মতো মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিরা এমন একটি বিশ্বাসে উৎসাহ বোধ করেছিল যে, তাদের পেছনে কর্তৃপক্ষের সমর্থন আছে। শেষ করার আগে আমাদেরকে মূল্যবান সহায়তা এবং স্বপ্রণোদিত সহযোগিতা করার জন্য হায়দরাবাদের সামরিক প্রশাসন, আমরা যেসব জেলা সফর করেছি সেসব জেলার সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি কর্মচারি, বিশিষ্ট নাগরিক এবং সবশেষে আমাদের দু’জন সচিব মি. ফারুক সায়ার ও পিপি আম্বুলকারের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। ভারতের কোনো পাঠ্যপুস্তকে হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসতার ছিঁটেফোটা খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু হায়দরাবাদ নয়, ভারতের অন্যত্র আরো ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকান্ডের বদলা নিতে তার পুত্র রাজিবের আমলে শিখদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। একইভাবে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম হত্যাকান্ড চালানো হয়। তবে হায়দরাবাদে সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপকতার তুলনায় এসব হত্যাকান্ড নস্যি। কথিত পন্ডিত জওহরলাল নেহরুকে ভারতীয়রা দেবতার মর্যাদা দিলেও তার আমলেই ভারতে স্মরণকালের ভয়াবহ গণহত্যা চালানো হয়। ভারতের দু’একজন লেখক ও বুদ্ধিজীবী নিঃসংকোচে সত্য প্রকাশে এগিয়ে এসেছে। ইকনোমিক টাইমসের সম্পাদক স্বামীনাথ এস. আঙ্কেলসারিয়া আয়ার হল তাদের অন্যতম।
২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ‘ডিক্লাসিফাইড রিপোর্ট অব দ্য ১৯৪৮ হায়দরাবাদ ম্যাসাকার’ শিরোনামে এক নিবন্ধে সে লিখেছে: “I was astounded to find that the greatest communal slaughter occurred under neither Modi nor Rajib but Nehru. His takeover of Hyderabad in 1948 caused may be 50,000-200,000 death. This was the largest single massacre in the history of Indian Union, dwarfing the killing by the Pathan raiders en route to Srinagar which India has ever since used as the casus belli for its annexation of Kashmir.” অর্থাৎ আমি একথা খুঁজে পেয়ে বিস্মিত হয়ে যাই যে, মোদি (গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি) অথবা রাজিবের (প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী) আমলে নয়, নেহরুর আমলে বৃহত্তম সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে সে (নেহরু) হায়দরাবাদের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ লোকের মৃত্যু হয়। এ হত্যাযজ্ঞ ছিল ভারত ইউনিয়নের ইতিহাসে একক বৃহত্তম। শ্রীনগরে এগিয়ে আসার পথে পাঠান আক্রমণকারীদের পরিচালিত হত্যাকান্ডকে তখন থেকে কাশ্মীর একীভূতকরণের যৌক্তিকতা হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু হায়দরাবাদ হত্যাযজ্ঞের তুলনায় এ হত্যাকান্ড ছিল নগণ্য। আর একটি কথা- বাংলাদেশ ঐ সময় পাকিস্তান ফেডারেশনে যোগ ন দিলে বাংলাদেশেরও একই পরিণতি হইত। পাকিস্তানে যোগ দেওয়াতে এখন আমরা স্বাধীন হয়েছি, আর তা না হইলে আমরা এখন ভারতের পেটের ভিতর থাকতাম।
0 comments: