ইসলাম তথা হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর পয়গাম দুনিয়ার এক বিরাট সংস্কারমূলক আন্দোলন। সৃষ্টির আদিকাল থেকে বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন দেশে খোদা-প্রেরিত নবীগণ এই একই আন্দোলনের পয়গাম নিয়ে এসেছেন। এ কেবল একটি আধ্যাত্নিক আন্দোলনই নয়, বরং এটি মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত এক অভূতপূর্ব সংস্কার আন্দোলন। এটি একাধারে আধ্যাত্নিক, নৈতিক, সামাজিক, অর্থনীতিক ইত্যাদি সকল বৈশিষ্টের অধিকারি একটি ব্যাপক ও সর্বাত্নক আন্দোলন।মানব জীবনের কোন দিকই এ আন্দোলনের গণ্ডী-বহির্ভূত নয়।
ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্ব
দুনিয়ার সংস্কারমূলক বা বিপ্লবাত্নক আন্দোলন বহুবারই দানা বেধে উঠেছে;কিন্তু ইসলামী আন্দোলন তার নিজস্ব ব্যাপকতা এবং অনন্য বৈশিষ্ট্যের দরুণ অন্যান্য সকল আন্দোলনের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।এ আন্দোলনের সাথে কিছুটা প্রাথমিক পরিচয় ঘটলেই লোকদের মনে প্রশ্ন জাগে :কিভাবে এ আন্দোলন উত্থিত হয়েছিল ?এর প্রবর্তক কিভাবে একে পেশ করেছিলেন এবং তার কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?কিন্তু এ প্রশ্নগুলোর সঠিক জবাব পাওয়া গেলে শুধু ঐতিহাসিক কৌতূহলই নিবৃত হয়না, বরং এর ফলে আমাদের মানস পটে এমন একটি ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ সংস্কারমূলক আন্দোলনের ছবি ভেসে উঠে, যা আজকের দিনেও মানব জীবনের প্রতিটি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে সক্ষম।এখানেই ইসলামী আন্দোলনের আসল গুরুত্ব নিহিত।
এ আন্দোলন যেমন মানুষকে তার প্রকৃত লাভ-ক্ষতির সঠিক তাৎপর্য বাতলে দেয়,তেমনি তার মৃত্যু পরবর্তী অনন্ত জীবনের নিগূঢ় তত্ত্বও সবার সামনে উন্মোচন করে দেয়।ফলে প্রতিটি জটিল ও দুঃসমাধেয় সমস্যা থেকেই মানুষ চিরতরে মুক্তি লাভ করতে পারে। বস্তুত ইসলামী আন্দোলনের এসব বৈশিষ্ট্য একে ঘনিষ্ট আলোকে পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি করবার এবং এর সর্ম্পকে উত্থাপিত দাবিগুলোর সত্যতা নিরুপণের জন্যে প্রতিটি কৌতূহলী মনকে অনুপ্রাণিত করে।
ইসলামী আন্দোলনকে জানবার ও বুঝবার জন্যেএ পর্যন্ত অনেক বই-পুস্তকই লেখা হয়েছে এবং আগামীতেও লেখা হতে থাকবে। এসব বই-পুস্তকের সাহায্যে ইসলামী আন্দোলন সর্ম্পকে বেশ পরিষ্কার একটি ধারণাও করা চলে,সন্দেহ নেই।কিন্ত প্রদীপ থেকে যেমন আলোকরশ্মি এবং ফুল থেকে খোশবুকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না, তেমনি এ জন্যেই যখন ইসলামী আন্দোলনের কথা উঠে, তখন মানুষ স্বভাবতই এর আহ্বায়ক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনচরিত এবং এর প্রধান উৎস আল-কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জানবার জন্যে উৎসুক হয়ে উঠে। এ ঔৎসুক্য খুবই স্বাভাবিক।
ইসলামী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
একথা সর্বজনবিদিত যে, মানুষের নৈতিক জীবনের সংশোধন, তার ক্ষতিকর বৃত্তিগুলোর অপনোদন এবং জীবনকে সঠিকভাবে কামিয়াব করে তুলবার উপযোগী একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি উপস্থাপনই হচ্ছে মানবতার প্রতি সবচেয়ে পবিত্র এবং এটাই হচ্ছে তার সবচেয়ে সেরা খেদমত।এই উদ্দেশ্যেই দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ নিজ নিজ পথে কাজ করে গেছেন।কিন্তু এ ধরণের সংস্কারমূলক কাজ যাঁরা করেছেন, তাঁরা মানব জীবনের কয়েকটি মাত্র ক্ষেত্রকেই শুধু বেছে নিয়েছেন এবং তার আওতাধীনে থেকেই যতদূর সম্ভব কাজ করে গেছেন।কেউ আধ্যাত্নিক ও নৈতিক দিককে নিজের কর্মকাণ্ডকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংশোধনের মধ্যে।কিন্তু মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সুষম পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছেন এমন পূর্ণাঙ্গ সংস্কারবাদী একমাত্র খোদা-প্রেরিত নবীগণকেই বলা যেতে পারে।
মানব জাতির প্রতি বিশ্বস্রষ্টার সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ এই যে, তার প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দাওয়াত ও জীবন-চরিত কে তিনি অতুলনীয়ভাবে সুরক্ষিত রেখেছেন।বস্তুত এই মহামানবের জীবনী এমন নির্ভুলভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যে, দুনিয়ার অন্য কোন মহাপুরুষের জীবনী কিংবা কোন ঐতিহাসিক দলিলের লিপিবদ্ধকরণেই এতখানি সতর্কতা অবলম্বনের দাবি করা যেতে পারে না।পরন্ত ব্যাপকতার দিক দিয়ে এর প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে হযরত (সা )-এর কথাবার্তা, কাজ-কর্ম জীবন-ধারা, আকার-আকৃতি, উঠা-বসা চলন-বলন, লেন-দেন, আচার-ব্যবহার, এমনকি খাওয়া পরা, শয়ন-জাগরণ এবং হাসি-তামাসার ন্যায় সামান্য বিষয়গুলো পর্যন্ত সুরক্ষিত রাখা হয়েছে। মোটকথা, আজ থেকে মাত্র কয়েক শো বছর আগেকার বিশিষ্ট লোকদের সম্পর্কেও যে খুঁটিনাটি তথ্য জানা সম্ভবপর নয়, হযরত মুহাম্মদ (স) সম্পর্কে প্রায় দেড় হাজার বছর পরেও সেগুলো নির্ভুলভবে জানা যেতে পারে।
হযরত মুহাম্মদ(স)-এর জীবন-চরিত পর্যালোচনা করার আগে এর আর একটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার।তাহলো এই যে, কোন কাজটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা কেবল সেই কাজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অনুধাবণ করা চলে। কারণ প্রায়শই দেখা যায় যে, অনুকূল পরিবেশে যে সব আন্দোলন দ্রুতবেগে এগিয়ে চলে,প্রতিকূল পরিবেশে সেগুলোই আবার স্তিমিত হয়ে পড়ে।তাই সাধারণ আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে,সেগুলোকে গ্রহণ করার জন্যে আগে থেকেই লোকদের ভেতর যথারীতি প্রস্তুতি চলতে থাকে।অত:পর কোন দিক থেকে হঠাৎ কেউ আন্দোলন শুরু করলেই লোকেরা স্বত:স্ফূর্তভাবে তার প্রতি সহানুভূতি জানাতে থাকে এবং এর ফলে আন্দোলনও স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলে।দৃষ্টান্ত হিসাবে দুনিয়ার আজাদী আন্দোলনগুলোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।মানুষ স্বভাবতই বিদেশী শাসকদের জুলুম-পীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং মনে মনে তার প্রতি ক্ষুব্ধ হতে থাকে।অত:পর কোন সাহসী ব্যক্তি যদি প্রকাশ্যভাবে আজাদীর দাবি উত্থাপন করে,তাহলে বিপদ-মুসিবতের ভয়ে মুষ্টিমেয় লোক তার সহগামী হলেও দেশের সাধারণ মানুষ তার প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে পারে না।অর্থনৈতিক আন্দোলনগুলোর অবস্থাও ঠিক এইরূপ। ক্রমাগত দু:খ-ক্লেশ এবং অর্থগৃধ্নু ব্যক্তিদের শোষণ-পীড়নে লোকেরা স্বভাবই এরূপ আন্দোলনের জন্যে প্রস্তত হতে থাকে।এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক বিধি-ব্যবস্থার সংশোধন এবংমানুষের দুঃখ-দুর্গতি মোচনের নামে দেশের কোথাও যদি কোনো বিপ্লবাত্মক আন্দোলন মাথা তুলে দাঁড়ায়, তাহলে লোকেরা স্বভাবতই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।কিন্তু এর বিপরীত -সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে উত্থিত একটি আন্দোলনের কথা ভেবে দেখা যেতে পারে।দৃষ্টান- হিসাবে বলা যায়, কোনো উগ্র মূর্তিপূজারী জাতির সামনে কোনো ব্যক্তি যদি মূর্তিপূজাকে নেহাত একটি অনর্থক ও বাজে কাজ বলে ঘোষণা করে, তাহলে তার ওপর কী বিপদ-মুসিবত নেমে আসতে পারে, একটু ভেবে দেখা দরকার।
বস্তুত ইসলামী আন্দোলনের আহ্বায়ক হযরত মুহাম্মদ(স) কী প্রতিকূল পরিবেশে তার কাজ শুরু করেছিলেন, তা স্পষ্টত সামনে না থাকলে তার কাজের গুরুত্ব এবং তার বিশালতা উপলব্ধি করা কিছুতেই সম্ভবপর হবে না। এ কারণেই তার জীবনচরিত আলোচনার পূর্বে তৎকালীন আরব জাহান তথা সারা দুনিয়ার সার্বিক অবস্থার ওপর কিছুটা আলোকপাত করা দরকার।
অধ্যায় ০১ : ইসলামী আন্দোলন ও তার অনন্য বৈশিষ্ট্য
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: