দার্শনিক শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ) ও তাঁর চিন্তাধারা
হিজরী পঞ্চম শতক পর্যন্ত মুসলমানগণ সাহিত্য, সংস্কৃতি, কাব্য, ইতিহাস, দর্শন, আইনশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্র, স্থাপত্যশিল্প, রাজ্য জয় তথা বৈষায়িক দিক থেকে সমগ্র বিশ্বে উন্নতির উত্তুঙ্গ চূড়ায় সমাসীন থাকলেও তার পরবর্তীকালে সারা মুসলিম জাহানে চিন্তার বন্ধ্যান্ত্ব দেখা যায়। বিশেষ করে ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে এমন স্থবিরতা পরিলক্ষিত হয় যে, ইসলামী জ্ঞান-গবেষণা ও স্বাধীন চিন্তার দ্বার এক রকম বন্ধ হয়ে যায়। এমন কি কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা ও তার ব্যাখ্যার ব্যাপারে কেবল চোখ বুঁজে পুর্ববর্তীদের অনুসরণই করা হতো না বরং অনেক জটিল সমস্যার ও সুন্নাহর গবেষণার যুগ হিজরী চতুর্থ শতক পর্যন্তই শেষ হয়ে গেছে এবং পরবর্তী লোকদের এ সম্পর্কে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার কোন অধিকার নেই।
এছাড়া এমনিতেও দেখা যায়, খুলাফায়ে রাশেদীনের পর থেকে চতুর্থ হিজরী পর্যন্ত ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ ইমাম-মুজতাহিগণ এক দিকে বেসরকারী পর্যায়ে ইসলামী চিন্তা-গবেষণায় রত রয়েছেন, অপরদিকে ক্ষমতালোভীগণ ইসলামী মূল্যবোধকে নানাভাবে ব্যাহত করে আসছে। বনী উমাইয়া ও আব্বাসিয়াদের শাসনামলে (উমর ইবনে আবদুল আযীয ছাড়া) ইসলামের সাংস্কৃতিক জীবন এক ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন হয় গ্রীক সাহিত্য-দর্শনের নির্বিচারে তরজমা ও প্রচার মুসলমানদের চিন্তা জগতে এক নৈরাজ্যের সূচনা করে। শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সাহায্য সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি ও তমদ্দুনের ক্ষেত্রে জাহেলী যুগের চিন্তাধারার প্রসারের ব্যবস্থা করে। হিজরী পাঁচ শতকের শেষার্ধে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় যে, গ্রীক সাহিত্যানুরাগ ও দর্শন-প্রীতির প্রবণতা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যায়। মুসলিম শাসক ও জনগণের আকীদা-বিশ্বাস ও নৈতিক চরিত্রের মারাত্মক অবনতি ঘটে। এক শ্রেণীর আলিম, ফকীহ, মুফতী বিজাতীয় দর্শনের মাপকাঠি দিয়ে ইসলামী জীবন দর্শনের মূল্যায়নের সচেষ্ট হয়। তার পরবর্তী পর্যায়েও দেখা যায় মুসলিম জাহানের বিভিন্ন অংশে আরও নানাবিধ কুসংস্কার ও বাতিল চিন্তাধারা গজেয় উঠেছে। মানুষ এ সময় দমননীতি মূরক রাজতান্ত্রিক পরিবেশে থেকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সঠিক রূপরেখা সম্পর্কেই অপরিচিত হয়ে পড়ছিল। মানবজীবনে বিভিন্ন বিভাগের জন্য নির্ধারিত কুরআন ও সুন্নাহর অনুশাসনসমূহ তথা ইসলামের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল। ইসলাম যে একটি পরিপূর্ণ বিজয়ী-বিধান, সাধারণ ভাবে মুসলিম সমাজ থেকে এ ধারণা বিদায় গ্রহণ করছিল। আর তার স্থান দখল করছিল সুফীবাদ তথা ইসলামের আংশিক রূপ-রং-ক্ষেত্রে বিশেষ বিকৃত রূপ-যার জের এখনও চলছে এবং এখনও কেউ কেউ আনুষ্ঠানিক কতিপয় ইবাদাতকেই পূর্ণ ইসলাম বলে মনে করছে। দোর্দন্ড প্রতাপশালী রাজশক্তির অধীনে ইসলামের বৈপ্লবিক ভাবধারা নিয়ে মাঝে মধ্যে কেউ কেউ এগিয়ে এলেও সমগ্র সমাজের সামগ্রিক নিস্পৃহতা ও নিরাশক্তির সম্মুখে তা সহজেই স্তিমিত হয়ে পড়ে। ঐ ভাবাধারা মূলক কোনো কিছু বলা ও লেখাও ছিল জীবনের পক্ষে বিরাট ঝুঁকির ব্যাপার। এ ছাড়া ঐ পরিবেশে ইসলামে টিকিয়ে রাখারা ব্যাপারে অনুসৃত কৌশলগত নীতিরও ছিল তা পরিপন্থী। এসব কারণে মহানবী (সা) ও তাঁর ত্যাগী সাহাবীগণ প্রাণান্তকর সংগ্রাম সাধনার দ্বারা জাহিলিয়াতের সকল দুর্ভেদ্য প্রাচীর চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মানব জাতির সামনে যে আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধান পেশ করেছিলেন, ক্রমে তা থেকে মুসলমানদের বিচ্যুতি ঘটতে থাকে।
উপমহাদেশের অবস্থা
একদিকে ইসলামের ব্যাপারে সুষ্ঠু জ্ঞান-গবেষণার অভাব, অপরদিকে নিত্য নতুন ভ্রান্ত চিন্তাধারার উদ্ভব-এ উভয় অবস্থার মধ্যে দিয়ে যখন ইসলাম গতিশীলতা হারিয়ে দ্বাদশ হিজরীতে পদার্পণ করে, তখন এই চিন্তার দিক থেকে গোটা মুসলিম সমাজ বিশেষ করে পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। এখানে স্বার্থদুষ্ট মুসলিম শাসকদের হাতে ইসলাম যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল, তা আর কোথাও হয়নি। কেননা, দুই একজন ছাড়া দিল্লীর মুসলিম রাজা-বাদশাহরা পাক-ভারতে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু করা তো দূরের কথা বরং ইসলামী আদর্শের খেলাপ নানারূপ কাজ করে এ দেশের সাধারণ মানুষের সামনে ইসলামের এক বিভ্রান্তিকর চিত্র তুলে ধরে। মোগলদের আমলে বিশেষ করে হিজরী দশম শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে পরিস্থিতির আশংকাজনক অবনিত ঘটে। ইসলামের সঙ্গে সম্রাট আকবরের (৯৬৪-১০৬৪ (হি:) সীমাহীন ধৃষ্টতা মুসলিম সমাজ জীবনে বিরাট বিষফোঁড়ার সৃষ্টি করে। সম্রাট আকবর যে কোন মূল্যে হিন্দুদের মন রক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন। আকবরের ধারণা ছিল এই যে, প্রয়োজনে হিন্দুদের সক্রিয় সমর্থন ভিন্ন কেবল মাত্র সংখ্যালুঘু মুসলমানদের শক্তির ওপর মোগল শাসন ভারতে দীর্ঘ স্থায়ী হতে পারে না। তাই পূর্বপুরুষদের সিংহাসন সংরক্ষণের জন্য আকবর নিজস্ব জাতীয় তাহযীব-তমদ্দুন এবং ঈমান-আকীদাকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন, উপরোক্ত চিন্তাধারয় উদ্বুদ্ধ হয়ে আকবর বহু হিন্দু রীতিনীতি গ্রহণ করেন এবং অমুসলিমদের উপর থেকে জিযিরা কর প্রত্যাহার করেন। তিনি এ সবকিছুই বহু নিন্দিত সেই দীনে ইলাহী নামক নিজের উদ্ভাবিত প্রহসনমূলক ধর্মের নামেই করতেন। উল্লেখ্য যে, ৯৮৩ হিজরী থেকে আকবরের মনে এ দুষ্টামি চেপে বসে এবং এ উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা স্থির করার জন্য এক শ্রেণীর আলিম, পীর ও হিন্দু পন্ডিত ছাড়াও শিয়া, খৃষ্টান, ইয়াহুদী, অগ্নিপূজক প্রভৃতি ধর্মের পন্ডিতদেরও দরবারে হাযির করেন। পরে প্রত্যেকের বক্তব্যের আলোকে নিজ স্বার্থ বুদ্ধিকে কার্যকরী করেন এবং ৯৯০ হিজরীতে দীনে-ইলাহী প্রতিষ্ঠার সরকারী ঘোষণা করেন। আকবরের এই গোমরাহীর পশ্চাতে ইসলাম সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতার সাথে সাথে তাঁর অমুসলিম বেগমদের গভীর প্রভাবও কাজ করেছিল। হেরেমে হিন্দু রমণীদের অস্তিত্ব গোটা পরিবেশকে হিন্দু বানানার জন্য যথেষ্ট ছিল। প্রাসাদের অভ্যন্তরে নানা ধর্মের উপাসনালয় নির্মাণ করা হয়। হিন্দু মেলা-তেহারের সময় সম্রাটের প্রাসাদে সাধারণ উৎসব পালন করা হতো। সন্ধ্যা বাতির সময় আকবর দাঁড়িয়ে সম্মান গ্রহণ করতেন। আযান ও গরু যবাই
নিষিদ্ধ ছিল। দরবারের লোকদের পোশাক-পরচ্ছিদ সম্পূর্ণ হিন্দুয়ানী ছিল। মুসলিমদের মুখ থেকে দাড়ি বিলুপ্ত হতে শুরু করলো। এক কথার সারাটি পরিবেশ, প্রাসাদের যাবতীয় কাজকর্ম, রীতিনীতি, অনুষ্ঠান একান্তভাবেই হিন্দু সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিল। ঐ যুগের পোশাক, স্থাপত্য, চিত্রনির্মাণ সকল কিছুর মধ্যেই হিন্দু সংস্কৃতির ছাপ লক্ষ্য করা যেতো। ফতেহপুর সিক্রির মসজিদ ও শায়খ সলীম চিশতীর সমাধি একইভাবে হিন্দু স্থাপত্যের প্রতীক হিসেবে নির্মাণ করা হয়। শায়খ সলীম চিশতীর সমাধি সম্পর্কে বিখ্যাত ইংরেজ লেখক উইনস্টন স্মিথ মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন : মুসলমান সমাজের একজন তেজস্বী মহান আধ্যাত্মিক সাধকের সমাধিগাত্রে হিন্দু সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের প্রতীক লক্ষ্য করে আমি বিষ্মিত হয়েছি। গোটা সমাধি সৌধটিতেই হিন্দু ভাবধারার অভিব্যক্তি সুস্পষ্ট। (Akbar the Great Mughal, P.P. 442-443)
এমনিভাবে Henell এর মন্তব্যেও লক্ষণীয়। তিনি বলেন: ফতেহপুরের মসজিদটিকে অপেক্ষা বৈষ্ণব মন্দির বলে মনে হয়। (A Hand Book of Indian Art. P 65)
এক শ্রেণীর আলিমের ভূমিকা:
আকবরের এই পথভ্রষ্টতার জন্য তৎকালীন সরকারের এক শ্রেণীর তল্লিবাহক আলিম এবং পীরও কম দায়ী নন। তাদের পারষ্পরিক দ্বন্দ্ব, কলহ, হিংসা-দ্বেষ, বিরুদ্ধতা এবং দীন ইসলামের মূল দাবীর ব্যাপারে জ্ঞানের স্বল্পতা বা অজ্ঞতা আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করছে, ক্ষমতাসীনদের প্রতি তাদের দুর্বলতা, কাপুরুষতা এবং দীনের ব্যাপারে তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণেই তারা ৯৮৭ হিজরী সনে আকবরকে যিল্লুল্লাহ (আল্লাহর ছায়া বা রহমত), ন্যায়পরায়নতা নেতা, যুগ ইসলাম, তিনি সকল আনুগত্যের উর্ধে তাঁর হুকুমই সকলের উপর প্রযোজ্য প্রভৃতি আল্লাহর গুণে অভিহিত করে ফতোয়া জারি করতে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করেননি। তাঁর প্রতি সম্মানসূচক সিজদা করারও ফতোয়া তাঁরা দিয়েছিলেন। মরহুম মাওলানা আবুল কালাম আযাদ এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন : আকবরের শাসনামলে মখদুমুল মুলক ও আবদুন নবীর মতো ওলামায়ে ছু-অসৎ আলিমরা১. উক্ত ফতোয়ায় দস্তখত করে নিজেদেরকে যে কঠোর শাস্তির যোগ্য করেছে, তাদের প্রতি আল্লাহ কি ধরনের ব্যবহার করবেন সেটা তিনিই ভালো জানেন। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ঐ সকল আলিম এহেন নিন্দনীয় কাজের মাধ্যমে যে চরম অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে, তার দৃষ্টান্ত অতি বিরল। সত্য কথা বলতে কি, বিভিন্ন যুগে ইসলামের ওপর যত আঘাত এসেছে এহেন ওলামায়ে-ছু- এর কারণেই এসেছে। আমি বলবো যে, আকবরের এই গোমরাহী সৃষ্টির জন্য সব চাইতে যারা বেশী দায়ী তারা আবুল ফজল ও ফয়েজী নয় বরং এসব দুনিয়ার কুকুর’রাই অধিক দায়ী। দুর্ভাগ্য, ঐ সময় এই স্বার্থপর ব্যক্তিরাই আলিমের আবরণ পরে রেখেছিল।
যা হোক, আকবর কর্তৃক সৃষ্ট এই ঘোর তমসার বুকে পরবর্তী পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা মুজাদ্দিদে আলফেসানীর ন্যায় এক প্রচন্ড সূর্যের উদয় ঘটান এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে তাঁর দুর্বার আন্দোলন, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও প্রতিরক্ষামূলক বলিষ্ঠ পদক্ষেপের ফলে তার অবসান ঘটে। কিন্তু আলফোসানী (রহ) এই গোমরাহী ও তার সঙ্গে সঙ্গে বিদআত-শিরকের অপরাপর বেগবান স্রোতের গতি প্রশমিত করতে সক্ষম হলেও উক্ত দুষ্ট ক্ষতের দাগ সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। তার কিছু কিছু জীবাণূ পরবর্তী পর্যায়েও অবশিষ্ট ছিল। কেননা, দেখা
১. ইসলামী ইতিহাসে বিভিন্ন যুগের বিকৃত ঈমান ও বিকৃত আমলের আলিমদেরকে ওলামায়ে ছু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শব্দটি বর্তমানে একটি পরিভাষা হিসেবে প্রচলিত- তাযকিরা, পৃষ্ঠা :২১
গেছে, আকবরের দীনে ইলাহীর অনুসারীর সংখ্যা নিতান্ত কম হলেও এর সাধারণ প্রভাব ব্যাপকভাবে সংক্রমিত ছিল। তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে যেমন, মুসলিম লেখকগণ যেখানে সাধারণত নিজ নিজ লেখা বিশেষ করে গ্রন্থাবলী হামদ ও নাত দ্বারা শুরু করতেন, সে ক্ষেত্রে বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন সরকারী লোক ও শাহী দরবারের মুসলমান লেখকগণ নিজেদের হিন্দু সংস্কৃত ভাষার গ্রন্থাদি সূচনা করতেন গণেশ বা স্বরসতী প্রভৃতি হিন্দু দেব-দেবীর নামে। এ ছাড়া দীনে ইলাহীর ধারণা ও প্রভাব আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীরের আমলেই কেবল নয় তার প্রপৌত্রের আমলেও যে কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান ছিল, তার প্রমাণ হচ্ছে দারাশিকো। শাহজাহানের পুত্র দারাশিকো প্রথম দিকে সুফী ভাবধারায় প্রভাবান্বিত থাকলেও পরবর্তী সময়ে তিনি ক্রমশ হিন্দু ধর্মমতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতার পরিভাষার সাথে স্বমতের পরিভাষা সম্পর্কে আলোচনা করে তিনি নিবন্ধ রচনা করেন। তিনি হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের সমন্বয় সাধনের সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর এই চিন্তাধারা লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে অনেক নিষ্ঠাবান সুফীদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়ে পড়ে। দারাশিকো এভাবে সুফীদের দ্বারা ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে সাধারণ ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন। (Islam the Straigth Path) । সম্রাট আওরাঙ্গজেব (১০৬৮-১১১৮ হিজরী) ও দারাশিকোর বিরোধ এবং পরিণামে দারাশিকের পরাজয় ও নিহত হবার পেছনে মূলত এ কারণই কার্যকর ছিল। উভয়ের বিরোধকে দুই ভাইয়ের রাজক্ষমতা দখলের ঝগড়া মনে করা কিছুতেই ঠিক হবে না। বরং তা বিরোধ ছিল দুটি চিন্তাধারার এবং দুটি আদর্শের। আবুল মুযাফফর মুহিউদ্দিন আলমগীর আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন উপমহাদেশে মহানবীর আদর্শ তথা ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করতে এবং দারশিকো চেয়েছিলেন এখানে প্রপিতামহ আকবরের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে। কারো কারো মতে দারাশিকো ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হলে মোগল সাম্রাজ্য আজো টিকে থাকতো এবং টিকে না থাকলেও উপমহাদেশে থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো।
এসব কারণেই আওরঙ্গজেবের মতো ইসলামী আদর্শের পুর্ণ অনুসারী একজন মুসলিম শাসকের যুগ অতিক্রান্ত হবার পরও দেখা গেছে যে, পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত শাসকের অযোগ্যতায় সেই হিন্দুয়ানী ভাবধারা এবং এরই সঙ্গে শিয়া মতবাদ ও নানাবিধ অনৈসালামিক ভাবধারাপুষ্ট ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ ছিল পাক-ভারতের সাধারণ অবস্থা। তার পাশাপাশি সমাজের শিক্ষার অঙ্গন এবং সুধীমহল তথা ওলামা ও পীর-মাশায়েখদের কার্যকলাপ ছিল আরও অধ:পতিত। এক ধরনের সুফী ও ফকীর দরবেশে নামধারী ব্যক্তি ফকীরী মারেফতীর ছদ্মাবরণে সাধারণ মানুষের ধন-সম্পদ লুট করে যেতো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তখনো এরিস্টটলের প্রচারিত মতবাদের পচা লাশের ওপর অস্ত্রোপচার চলছিল। মাদ্রাসাগুলোতে শামসে বাজেগা ও কাযী মুবারক বিশেষ গুরুত্ব সহকারে গঠিত হলেও কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে চিন্তা গবেষণার প্রতি কারুরই ভ্রূক্ষেপ ছিল না। মূলত উলূমে ইলাহিয়ার মধ্যে তাঁরা এতই নিমগ্ন থাকতেন যে, কালামে ইলাহীর প্রতি ভ্রূক্ষেপ করার সময়ই তাদের হাতে থাকতো না। তৎকালীন সাধারণ শিক্ষা তথা দারসে নিজামী১ থেকে যদি কোন বিষয় পাঠ্যের বহির্ভূত থেকে থাকে তো তা ছিল কুরআন মজীদ। বড় বড় আলিমদের শিক্ষাচক্রেও একমাত্র মিশকাত শরীফ ও মাশারেকুল আনওয়ার পড়ানোকেই যথেষ্ট মনে করা হতো। অবস্থা এই ছিল যে, মুজাদ্দিদ (রা) ও তাঁর সমকালীন শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (র) এর (৯৫৮-১০৫২ হিজরী) চিন্তাধারা থেকে যারা অধিক বঞ্চিত ছিল তারা হলো তদানীন্তন মাদ্রাসার পরিবেশের আলিমগণ। মুফতিগণের অবস্থা ছিল এই যে, তাঁরা মুতায়াখিরীন অর্থাৎ ৫ম হিজরীর পরবর্তী ফকীহ মুজতাহিদদের ফতোয়াকেই চূড়ান্ত বলে মনে করতেন। ইবনে নাজীম (৯৭০ হিজরী) এবং মোল্লা আলী ক্বারীর (১০১৪ হি) কোন ফিকহী
১. বর্তমান সময়ের প্রচলিত মাদ্রাসার শিক্ষানীতি।
মতের বিরুদ্ধাচরণ করা অসম্ভব ছিল। কেউ এ ব্যাপারে ঔদ্ধতা (?) দেখাতে গেলে হয়তো তাকে ওহাবী নতুবা মুবতাদি (বিদআতী) কিংবা লা-মাযহাবী ও অন্যান্য ধর্মীয় তিরষ্কারবাণে জর্জরিত হতে হতো।
ওলামা ও শিক্ষারতীদের এ অবস্থার পাশাপাশি সাধারণ মুসলমান ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আরও নৈরাশ্যজনক ছিল। জনৈক অমুসলিম লেখকের মতে সাধারণভাবে উপমহাদেশে ইসলাম তার প্রাণসত্তা হারিয়ে ফেলেছিল। কেবল ইসলামের আনুষ্ঠানিক রীতিনীতি ও কল্পনা প্রসূত অলৌকিকতার প্রতি আসক্তিই প্রধান ছিল। যদি হযরত মুহাম্মাদ (সা) দ্বিতীয়বার দুনিয়ায় আগমন করতেন, তাহলে তিনি তাঁর এসব অনুসারীদের মধ্যে ধর্মবিমুখতা ও প্রতিমা পূজা দেখে অত্যন্ত অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন।১
ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ)
পাক-ভারতের মুসলমানদের এই বিশেষ অবস্থা এবং সাধারণভাবে মুসলিম বিশ্বের দীনি চিন্তার এই বন্ধ্যাত্বের মুহূর্তে একান্ত প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল। এক আলোর দিশারীর-যিনি তত্ত্ব ও দর্শনগত দিক থেকে মুসলিম মিল্লাতের সামনে কুরআন ও সুন্নাহর অনুশাসনগুলোর সঠিক তাৎপর্য স্পষ্টরূপে তুলে ধরবেন। যার চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে ইসলামী পুনর্জাগরণের পথ উন্মুক্ত হয়ে উঠবে এবং মুসলিম মিল্লাত ইসলামকে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা ও খানকার চার দেয়ালের অন্তর্ভূক্ত তথাকথিত ধর্মীই মনে করবেনা; বরং একে একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান রূপে মেনে নিয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে একমাত্র তারই প্রাধন্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘবদ্ধ ভাবে সংগ্রাম করে যাবে, ইসলামের মধ্যে তারা খোঁজ করবে নিজেদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক,
১. স্টুয়ার্ড তাঁর গ্রন্থ অষ্টাদশ খৃষ্টাব্দে মুসলিম দুনিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং অত্যন্ত বেদনাদায়ক চিত্র তুলে ধরেছেন। আমীর শাকীব আরসালানের মতে স্টুয়ার্ডই একমাত্র লেখকের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। সীরাতে সাইয়েদ আহমদ পৃষ্ঠা ৫৮০-৫১ তে স্টুয়ার্ডের পূর্ণ উদ্ধৃতিটি রয়েছে।
সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক সমস্যাবলীর সমাধান। আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে ঠিক ঐ সময়ই এ মহান দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার জন্য দিল্লীর এক সম্ভ্রান্ত আল্লাহভীরু পরিবারে এক শিশুর জন্ম হয়। উত্তরকালে ইনিই মুসলিম মিল্লাতের বিশেষ করে পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশে ইসলামী চিন্তার দিক থেকে মুসলিম পুনর্জাগরণের অগ্রদূত হিসাবে সারা দুনিয়ায় ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
তাঁর পিতার নাম হচ্ছে শাহ আবদুর রহীম (রহ)। ইসলামী জ্ঞান-গবেষণার জন্য আবদুর রহীম পরিবার পূর্ব থেকেই দিল্লীতে অধিক মশহুর ছিল। এ পরিবারে বহু খ্যাতনামা আলিম রয়েছেন। বংশ পরিচয়ের দিক থেকে ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারুক (র) এর সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁর পিতামহ শাহ ওয়াজীহুদ্দীন (র) অত্যন্ত সাহসী পুরুষ ছিলেন। তিনি সম্রাট আলমগীরের শাসনামলে কয়েকটি লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। মারাঠাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধেও তিনি মোগল সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিলেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহর পিতা শাহ আবদুর রহীম সম্রাট আলমগীরের শাসনামলেই ইসলামী জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর মধ্যে বিভিন্নমুখী জ্ঞানের সমাবেশ ছিল। তিনি আধ্যাত্মিক বিষয় ও ধর্মীয় তথ্য-জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও আল্লাহভীরু। সম্রাট আলমগীর যখন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় উদ্দেশ্যে ইসলামী আইনশাস্ত্র ফতওয়ায়ে আলমগীরী সংকলনের উদ্দেশ্যে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ আলিমদের উচ্চ পরিষদ গঠন করেন, তখন তাতে তাঁর নামও ছিল। কিন্তু স্বভাবগত ভাবে তিনি রাজদরবারে চাকরির প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন বলে তা প্রত্যাখ্যান করলেও বরাবর তিনি এ ব্যাপারে পরিষদকে সাহায্য করে যান।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ সম্রাট আলমগীরের ইনতিকালের চার বছর পূর্বে ১১১৪ হিজরীতে জন্মগ্রহণ এবং ১১৭৬ হিজরীতে ইনতিকাল করেন। এদিক থেকে তিনি আলমগীরসহ মোট দশজন মোগল সম্রাটের যুগ প্রত্যক্ষ করেন। তাঁরা হচ্ছেন : (১) আলমগীর (আওরাঙ্গজেব), (২) বাহাদুর শাহ (৩) মুয়েযযুদ্বীন জাঁহাদার শাহ, (৪) ফররুখ শিয়ার, (৫) রফিউদ্দারাজাত (৬) রফিউদ্দৌলা, (৭) মুহাম্মাদ শাহ রঙ্গিলা, (৮) আবু নসর আহমদ শাহ, (৯) দ্বিতীয় আলমগীর, (১০) সম্রাট-শাহ আলম।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ বাল্য বয়স থেকেই অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন। তিনি সাত বছর বয়সের থেকেই অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন। তিনি সাত বছর বয়সের সময় কুরআন মজিদ কণ্ঠস্থ করেন এবং পনর বছর শেষ হবার আগেই যোগ্য পিতার তত্ত্বাবধানে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সকল বিষয়ে ব্যুৎপুত্তি লাভ করেন। বস্তুত এ কারণে ১১৩১ হিজরীতে যখন শাহ আবদুর রহীমের ইনেতিকাল হয়, তখন সতর বছর বয়সেই তিনি পিতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞান বিতরণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ একাদিক্রমে বার বছর পর্যন্ত দিল্লীর রহিমীয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপনার কাজে লিপ্ত ছিলেন। এ সময় ইসলামী জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ট উৎকর্ষতা সাধিত হয়। কিন্তু মুসলিম সমাজের চিন্তাগত, নৈতিক ও রাজনৈতিক অধপতিত সাক্ষাৎ-অসাক্ষাৎ অবস্থা তাঁকে এ সময়ে বসে থাকতে দিল না, বিশেষ করে তৎকালীন ভারতের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সমূহের গতিধারা লক্ষ্য করে তিনি গভীর ভাবে চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েন। কেননা, সম্রাট আলমগীরের জীবদ্দশাতেই ভারতে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য ভয়াবহ দুটি আন্দোলন মথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটি দক্ষিণ ভারত থেকে শিবাজীর নেতৃত্ব মারাঠা আন্দোলন, অপরটি শিখ আন্দোলন। এছাড়া অন্যান্য বিষয় তো আছেই। ভারতে হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিরুংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই ছিল মারাঠা আন্দোলনের লক্ষ্য। শিখদের যাবতীয় ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চলতো পাঞ্জাবকে কেন্দ্র করেই। প্রথম দিক থেকে এটি ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলন হলেও পরে শুরু গোবিন্দের নেতৃত্বে রাজনৈতিক রূপ লাভ করে।
মুসলমানদের সঙ্গে তাদের দুশমনির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে গিয়ে সিয়ারুল মুতায়াখখিরীন গ্রন্থের লেখক উল্লেখ করেন যে, তাঁরা যেখানেই মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করতো সেখানেই তাদের বিষয় সম্পত্তিই কেবল লুটতরাজ করে নিয়ে যেতো না, বরং মুসলমানদের রক্তে হোলি খেলতো। এমনকি তাদের হাত থেকে শিশু-সন্তান পর্যন্ত রক্ষা পেতো না। গর্ভবতী রমণীদের পেট চিরে সন্তান বের করে মা বাপের সামনেই তাদের হত্যা করতো। (সি, মু, ৪২ পৃ:)। জনৈক হিন্দু লেখক বলেন :মুসলমানদেরকে শিখেরা নিজেদের চরম শত্রু মনে করতো। নিজেদের প্রভাবিত এলাকায় মুসলমানদেরকে আযান দিতে দিত না। মসজিদের নাম বদলিয়ে একে মস্তগড় বলে অভিহিত করতো। তারা মুসলমানদের ব্যবহৃত পাত্রকে অপবিত্র মনে করতো। প্রয়োজনবোধে তাতে পায়ের জুতো দিয়ে পাঁচটি আঘাত করার পর উক্ত পাত্র ব্যবহার করতো।
মারাঠা আন্দোলনের হোতা শিবাজী মারাঠাদেরকে উদয়পুরের রাণাদের বংশোদ্ভুত বলে পরিচয় দিত বলে এ আন্দোলন সহজেই অভিজাত হিন্দু এবং ব্রাহ্মণদের সহযোগিতা লাভ করে। পরবর্তী পর্যায়ে সারা ভারতে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। মারাঠা দস্যুদের হাতে মুসলমানদের জান-মালের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা ইতিহাস খ্যাত। খাযানায়ে আমেরা ও তাবাতা বায়ী গ্রন্থে বলা হয়েছে, মারাঠা কর্তৃক দিল্লীতে লুটতরাজ এবং মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতি যেরূপ অবমাননাকর আচরণ করা হয়, তা যে কোন মুসলমানের জন্য বেদনার উদ্রেক করে।
মক্কায় গমন
এসব আন্দোলন শাহ সাহেবের মনে গভীর রেখাপাত করে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর খোদাদাদ চিন্তাশক্তি দ্বারা উপলব্ধি করলেন যে, বর্তমান মুসলিম সমাজকে বহুমুখী সমস্যার রাহুগ্রাস থেকে রক্ষা করতে হলে শুধু মাদ্রাসায় বসে গতানুগতিক শিক্ষাদান করলেই চলবে না বা সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কিছু বক্তৃাতাও এ জাতির মধ্যে জাগরণ আনয়নে সক্ষম হবে না। তিনি চিন্তিত মনে এ জন্য সঠিক পথ নির্দেশের উদ্দেশ্যে আল্লাহর সাহায্যপ্রার্থী হন। তিনি চিন্তিত মনে এ জন্য সঠিক পথ নির্দেশের উদ্দেশ্যে আল্লাহর সাহায্যপ্রার্থী হন। এ উদ্দেশ্যেই তিনি বার বৎসরের কাজে বিরতি দিয়ে ২৯ বছর বয়সে কিংবা ১১৪৪ হিজরীতে পবিত্র মক্কা-মদীনা সফরে গমন করেন। উল্লেখ্য যে, পবিত্র মক্কা গমনও ঐ সময় সহজ ব্যাপার ছিল না। ঠিক ঐ সময়ই পর্তুগীজ ও অন্যান্য পাশ্চাত্য জাতি কেউ শাসকের ভূমিকায়, কেউ বণিকের বেশে লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে মুসলিম জাহানের দিকে এগিয়ে আসছিল। শাহ ওয়ালিউল্লাহ ১১৪৪-১১৪৫ হিজরী পর্যন্ত সফরে ছিলেন (অন্যমতে ১১৪৪-১১৪৬ হিজরী)। তন্মধ্যে মক্কা-মদীনায় চৌদ্দ মাস ও বাকী সময় যাতায়াতে অতিবাহিত হয়েছে। এতে তিনি দুই বার হজ্ব করার সুযোগ পেয়েছেন। পবিত্র হারামাইন শরীফাইনের সান্নিধ্যে গিয়ে ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের জন্য কান্নাটির মাধ্যমে এ জাতির মুক্তির উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাকের তরফ থেকে তিনি কিরূপ প্রজ্ঞাশক্তি অর্জন করেছিলেন পরবর্তী ইতিহাস তার প্রামাণ। উক্ত জ্ঞানের মাধ্যমেই তিনি তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যের পথে এগিয়ে যাবার সন্ধান পেয়েছিলেন। ঐ সময় তিনি যে আধ্যাত্মিক শক্তি ও সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন, ফয়যুল হারামাইন নামক তাঁর উচ্চাঙ্গের গ্রন্থটি পাঠে তা সহজেই অনুমেয়। তিনি উক্ত গ্রন্থের ৮৯-৯০ পৃষ্ঠায় ১১৪৪ হিজরীর ২০শে যিলকদের জুমা রাত্রির একটি দীর্ঘ স্বপ্নের বর্ণনা দান প্রসঙ্গে তাঁর প্রতি আল্লাহর একটি নির্দেশের কথা উল্লেখ করেছেন। নিছক বৈষয়িক ও জড়বাদী দৃষ্টিকোন থেকে প্রতিটি বিষয়কে যারা বিচার করে তাদের নিকট ঐ বিষয়টি ভিন্নরূপে ঠেকলেও যেহেতু শাহ সাহেব নিজেই এক বিক্ষুদ্ধ জনতার মধ্যে দেখতে পান। তাতে আরব-অনারব প্রায় সকল মুসলিম দেশের লোকই রয়েছে। প্রত্যেকেই মুসলমানদের ওপর ক্রমবর্ধমান বিজাতীয় প্রভাবে ক্রোধে ফেটে পড়ছে। সকলে তাঁর দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করছে যে, এ মুহূর্তে আল্লাহর কি নির্দেশ? তার মুখ দিয়ে তখন বের হচ্ছে-ফুক্কা কুলা নিজাম সকল (বাতিল) ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দাও। অর্থাৎ বর্তমান মাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। বস্তত শাহ সাহেব পরবর্তীকালে তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি ও লেখনীর আঘাতে তাই করেছিলেন।
ঠিক অনুরূপভাবে তিনি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা গ্রন্থের মুখবন্ধে একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্বপ্ন-বৃত্তান্তের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, আমি একদা আসরের নামাযান্তে আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন রয়েছি। হঠাৎ অনুভব করি যে, প্রিয় নবীর পবিত্র আত্মা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। মনে হচ্ছিল যে, আমার ওপর কোন চাদর রাখা হয়েছে। ঐ অবস্থায় আমার অন্তরে একথা ঢেলে দেওয়া হয় যে, দীনের ব্যাখ্যার ব্যাপারে এক বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করো। তার পরক্ষণেই আমি আমার অন্তরে এমন এক (জ্ঞানের) জ্যোতি অনুভব করতে থাকি যা ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে থাকে।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও গবেষণাকার্য আত্মনিয়োগ:
শাহ ওয়ালিউল্লাহ ১১৪৬ হিজরীতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে ইনতিকাল পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ বছর যাবত শুধু গ্রন্থ রচনার কাজে নিমগ্ন ছিলেন। মক্কা মুয়াজ্জামা থেকে তিনি যে পরিকল্পনা নিয়ে ভারত-ভূমিতে পা রাখেন, তাঁর মন-মস্তিষ্ককে যে ভাবধারা অস্থির করে তুলেছিল, সে অবস্থার মধ্যে বহু বছরের পুরুষানুক্রমিক শিক্ষাদান রীতির রুচিই তাঁর থেকে বিদায় নেয়। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করার কোন অবকাশই তাঁর আর রইল না। তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আযীযের ভাষায় শ্রদ্ধেয় পিতা সকল বিষয়ের জন্য এক এক জন শিক্ষক তৈরী করে গিয়েছিলেন, যে বিষয়ের যে ছাত্র তিনি ঐ বিষয়ের শিক্ষকের নিকট যেতেন। তাঁর কাজ ছিল শুধু তথ্য জ্ঞান দান, লেখা ও হাদীস বর্ণনা। তিনি ঐ সময়ের মধ্যে আরবী, ফারসী ভাষায় ন্যূনাধিক পঞ্চাশখানা গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলো অধিকাংশই ইসলামী জ্ঞান-গবেষণা, দর্শন ও তথ্যের দিক থেকে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। মানব জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইসলামের এমন কোন দিক নেই যেদিকে তিনি কলম ধরেননি। তাঁর গবেষণার সবচাইতে বিষ্ময়কর দিক হচ্ছে এই যে, তিনি দুশো বছর আগের পরিবেশে বসেও বিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে লালিত-পালিত ব্যক্তির ন্যায় সম্পূর্ণ আধুনিক পদ্ধতিতে ইসলামী জীবনবিধানের ব্যাখ্যাদান করে গেছেন। ফররুখ সিয়ার, মুহাম্মদ শাহ রঙ্গীলা ও শাহ আলমের শাসনকালীন ভারতের অশান্ত পরিবেশ সম্পর্কে ইতিহাস পাঠক মাত্রই পরিচিত। শাহ সাহেবই এমন একজন গবেষক যিনি চতুর্দিকের বিলাসিতা, ইন্দ্রিয় পূজা,হত্যা, লুটতরাজ, জুলুম নির্যাতন, অশান্তি ও বিশৃংখলার অবাধ রাজত্বের মধ্যে বসে একজন মুক্ত বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন ভাষ্যকাররূপে যুগপরিবেশের সকল বন্ধন ও প্রভাবমুক্ত হয়ে প্রতিটি সমস্যার ওপর গভীর অনুসন্ধানকারী ও মুজতাহিদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। শাহ সাহেব যেভাবে তাঁর গ্রন্থাবলীতে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ভঙ্গিতে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য জ্ঞান পরিবেশন করেছেন, তার আলোকে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকের মূলনীতি এবং ইসলামী অনুশাননসমূহের দার্শনিক দিক সহজেই পরিষ্ফুট হয়ে ওঠে। তিনি যে ব্যাপারেই লেখনী ধারণ করেছেন, মনে হয় তৎসংক্রান্ত সকল বিষয়ের আলোচনাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তাঁর আরবী কিংবা ফারসী উভয় ভাষায় লিখিত গ্রন্থাবলীই ভাবের গভীরতা, ভাষার প্রাঞ্জলতা, প্রমাণ-পদ্ধতির দার্শনিক রীতি ও আবেদনশীলতার দিক থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বস্তুত তিনি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এমন যুক্তিগ্রাহ্যভাবে ঢেলে সাজাতে প্রয়াসী ছিলেন যার মাধ্যমে অনাগত বংশধরদের নিকট ইসলামী বিধিব্যবস্থার মূল রহস্য, তথ্য ও দার্শনিক দিক সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এরই ভিত্তিতে মুসলিম জাহানে, বিশেষ করে উপমহাদেশে মুসলিম পুনর্জাগরণ ও ইসলামী রাজনীতির অভ্যুদ্বয় ঘটে। এদিক থেকে চিন্তা করলে অনেকের যে কোন বৈপ্লবিক ভাবধারাপুষ্ট লেখার চাইতে তাঁর লেখনীকে অধিক বিপ্লবাত্মক বলতে হবে। শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারা ইসলামের স্বপক্ষে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। তাঁর উপস্থাপিত ইসলামী সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সমৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নয়নের যাবতীয় উপকরণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট পথনির্দেশ রয়েছে। এগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, যে কোন রাষ্ট্রে তা কার্যকরী করার উপযোগী। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রা) যুক্তি কষ্টিপাথরে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, যে কোন দেশ, যে কোন জাতির জন্য ইসলামই একটি শাশ্বত জীবন-বিধান।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ইতিহাসের ঐ সকল মহামনীষী মহাত্মদের অন্তর্ভূক্ত, যাঁরা যুগে যুগে মতবাদের বিভ্রান্তিজাল ছিন্ন করে চিন্তা ও গবেষণার একটি পরিচ্ছন্ন সরল রাজপথ তৈরী করেন এবং মানস জগতে সমকালীন পরিস্থিতির বিরুদ্ধে অস্থিরতা সৃষ্টি করে নতুন সৃষ্টির এমন এক হৃদয়গ্রাহী চিত্র তৈরী করেন, যার ফলে অনিবার্যরূপে অন্যায় ও অসুন্দরের ধ্বংস সাধন এবং ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে একটি আন্দোলন জন্মলাভ করে। এ ধরনের চিন্তানায়কের পক্ষে নিজের চিন্তা ও মতাদর্শ অনুযায়ী একটি আন্দোন গড়ে তোলা খুব কমই সম্ভব হয় কিংবা বিকৃত পৃথিবীকে ভেঙ্গেচুরে স্বহস্তে একটি নতুন পৃথিবী তৈরীর জন্য ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার অবকাশও থাকে তাদের কম। এহেন চিন্তানায়কদের আসল কাজ হয়, তাঁরা সমালোচনার ছুরি চালিয়ে শত শত বছরের বিভ্রান্তির জাল ছিন্ন-ভিন্ন করে বুদ্ধি ও চিন্তাজগতে নতুন দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত করেন। জীবনের বিকৃত অথচ শক্তিশালী কাঠামোকে ভেঙ্গে তার ধব্বংসাবশেষ থেকে প্রকৃত ও দীর্ঘস্থায়ী সত্যকে আলাদা করে দুনিয়ার সম্মুখে উপস্থাপিত করেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও দেখা যায়, তাঁর তাফহীমাতে ইলাহিয়া গ্রন্থের ১০১ পৃষ্ঠায় তিনি এ অভিপ্রায় প্রকাশ করেছেন যে, ঐ যুগে যুদ্ধ করে মানুষের সংশোধন সম্ভব হলে এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ লাভ করতে পারলে এ ব্যক্তিও (শাহ ওয়ালিউল্লাহ) রীতিমতো যুদ্ধ ক্ষেত্রের অগ্রভাগে থেকে যুদ্ধ করত। কিন্তু চিন্তার পুনর্গঠনের ব্যাপারেই তাঁর সকল সময় ব্যয়িত হয়েছে। এ বিরাট কাজ থেকে তিনি এতটুকুও অবসর পাননি। তিনি যে পথের সন্ধান দিয়ে গিয়েছিলেন, তার ভিত্তিতে সক্রিয় প্রচেষ্টা চালাবার জন্য অন্য একদল লোকের প্রয়োজন ছিল এবং মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই তারা স্বয়ং শাহ ওয়ালিউল্লাহর শিক্ষা ও অনুশীলনাগারের মধ্যে থেকে শক্তি ও পরিপুষ্টি লাভ করে কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করেন।
ওয়ালিউল্লাহর কর্মী দল:
এখানে সেই দল ও ব্যক্তিদের আলোচনা ও তাদের কর্মতৎপরতা সংক্ষেপে আলোচনা করা আবশ্যক। এ আলোচনার মধ্যে দিয়ে এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, আজকে এদেশে বা উপমহাদেশের অন্যান্য অংশে পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের সেতুবন্ধন হিসাবে তাঁরাই প্রধান ভূমিকা পালন করে গেছেন। ১৮০৫ খৃষ্টাব্দে ইংরেজরা দিল্লী শাসক সম্রাট শাহ আলমকে লালকেল্লা, এলাহাবাদ ও গাজীপুরের জায়গীর ছেড়ে দিলেও এগুলোর উপর থেকে তাঁর কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নিয়ে উপমহাদেশে মুসলিম শাসন ক্ষমতার শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত মুছে দেবার পূর্বেই ইংরেজরা সমগ্র ভারতে নিরংকুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিল। সারা উপমহাদেশে আলিম ও গায়ের আলিম সুধী সমাজের মধ্যে এমন কারও প্রকাশ্যে এ ঘোষণা করার সাহস ছিল না যে, বিধেশীর শাসনাধীন ভারত হচ্ছে দারুল হরব যেখানে জিহাদ করা প্রতিটি খাঁটি মুসলমানের কর্তব্য। সর্বত্র নৈরাশ্যের ছায়া ঘনীভূত হয়ে এসেছিল। সকল শ্রেণীর মুসলমান কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছিলেন। ইংরেজগণ উপমহাদেশে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দৃঢ়তর করার জন্য এবং পাশ্চত্য শিক্ষা, সভ্যতা, ধ্যান-ধারণা, কৃষ্টি-সংস্কৃতির প্রসার দান ও এদেশের ঐতিহ্যবাহী শাসক জাতি মুসলমানদেরকে পশ্চাত্যমুখী করে গড়ে তোলার জন্য গভীর পরিকল্পনায় নিয়োজিত ছিল। মুসলমানদের ঐ সময়টি এক কঠিন পরীক্ষা।
0 comments: