ইংরেজ বিরোধী বিপ্লবী ফতওয়া
ঠিক ঐ সময় শাহ ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনের প্রধান এবং ওয়ালিউল্লাহর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহ আবদুল আযীয দেহলভী এক বিপ্লবী ফতওয়া প্রচার করে এই হতোদ্যম জাতিকে পথের সন্ধান দেন এবং তাদেরকে ইসলামের জিহাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হবার আহ্বান জানান। শাহ আবদুল আযীয তাঁর পিতা মহামনীষী ও ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্নদ্রষ্টা হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর তিরোধানের পর (১৭৬৭ খৃস্টাব্দ) থেকে দিল্লীর রহিমিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ওয়ালিউল্লাহ চিন্তাধারার প্রচার, জনসংগঠন প্রভৃতির মাধ্যমে তারগীবে মোহাম্মাদী নামে ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনে নিয়োজিত ছিলেন। এই নির্ভীক মুজাহিদ দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করলেন:
এখানে অবাধে খৃষ্টান অফিসারদের শাসন চলছে আর তাদের শাসন চলার অর্থই হলো তারা দেশরক্ষা, জননিয়ন্ত্রণবিধি, রাজস্ব, খেরাজ, ট্যাক্স, উশর, ব্যবসায়পণ্য, দন্ডবিধি, মোকদ্দমরার বিচার, অপরাধমূলক সাজা প্রভৃতিতে নিরুংকুশ ক্ষমতার অধিকারী। এ সকল ব্যাপারে ভারতীয়দের কোনই অধিকার নেই। অবশ্য জুমার নামায, ঈদের নামায, গরু জবাই এসব ক্ষেত্রে ইসলামের কতিপয় বিধানে তারা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে না। কিন্তু এগুলোতো হচ্ছে শাখা-প্রশাখা যেসব বিষয়ে উল্লেখিত বিষয়সমূহের এবং স্বাধীনতার মূল (যেমন মানবীয় মৌলিক অধিকা, বাক স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার) তার প্রত্যেকটিই ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং পদদলিত করা হয়েছে। মসজিদসমূহ ধ্বংস করা হচ্ছে, কি হিন্দু কি মুসলমান পাসপোর্ট পারমিট ব্যতীত কারও শহরে আগমন-নির্গমনের সুযোগ নেই। সাধারণ প্রবাসী ও ব্যবসায়ীদেরকে শহরে আসা-যাওয়ার অনুমতি দানও দেশের স্বর্থে কিংবা নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে না দিয়ে নিজেরদর স্বার্থে দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য হায়দ্রাবাদ, লাক্ষৌ ও রামপুরের শাসনকর্তাগণ ইংরেজদের আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ার সরাসরি কৃস্টান সরকারের আইন সেখানে চালু হয় নাই। কিন্তু এতেও গোটা দেশের উপরে দারুল হরবেরই হুকুম বর্তাবে।
[ফতওযা এ আযীযী (ফরাসী), পৃষ্ঠা ১৭ মুজতবায়ী প্রেস।] এমনিভাবে তিনি অন্য একটি ফতওয়ার মধ্যেও অবিভক্ত ভারতকে দারুলহরব বলে ষোষণা করেছেন।
এই ফতওয়া যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় কেন্দ্রিক তাতে কোনোই সন্দেহ নাই। যার সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, আইন রচনার যাবতীয় ক্ষমতা খৃষ্টানদের হাতে। তারা ধর্মীয় মূল্যবোধকে হরণ করেছে। কাজেই প্রতিটি দেশপ্রেমিকের কর্তব্য হলো বিদেশী ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে নানাভাবে সংগ্রাম করা এবং লক্ষ্য অর্জনের আগ পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখা।
ইংরেজ বিরোধী ফতওয়ার প্রভাবসাধারণ মুসলমানগণ এ যাবত যেখানে ইংরেজদের প্রতাপের সামনে নিজেদেরকে অসহায় মনে করতেন এবং দ্বিধাদ্বন্দে লিপ্ত ছিলেন, এ ফতওয়া প্রকাশের পর মুসলমানরা কর্মনীতি নির্ধারণের পথ খুঁজে পেলেন। শাহ আবদুল আযীয দেহলভীর আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কর্মী ও তাঁর বিশিস্ট ছাত্রবৃন্দের দ্বারা উপমাদেশের সকল শ্রেণীর মুসলমানের নিকট এই বিপ্লবী ফতওয়ার বাণী প্রচারিত হয়। আর এমনিভাবে মুসলমানদের মনে ক্রমে ক্রমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদীভাব জাগ্রত হতে থাকে পরবর্তীকালে দেখা যায়, তাঁরই শিষ্য সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর নেতৃত্বে এবং তাঁর জামাতা মাওলানা আবদুল হাই ও ভ্রাতৃষ্পুত্র মাওলানা ইসমাইল (শহীদ)-এর সেনাপতিত্বে (আনু ১৮১৭ খৃষ্টাব্দে) বিরাট মুজাহিদ বাহিনী গঠিত হয়। এই মুজাহিদ বাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য ছিল খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী শিখ ও পরে প্রতিষ্ঠা করা এবং তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী শিখ ও পরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। তাঁরা এ উদ্দেশ্যে পূর্ব ভারত কিংবা দক্ষিণ অথবা উত্তর ভারতের কোনো স্থানকে নিরাপদ মনে না করে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাসূহ (কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, মোমেনশাহী, সিলেট প্রভৃতি জেলা) থেকেও মুসলমানরা যোগদান করেছিলেন। এই ইসলামী আন্দোলন শাহ আবদুল আযীযের উক্ত ফতওয়ার প্রভাবে বাংলাদেশেও বিপুল সাড়া জাগিয়েছিলো। যার ফলে ১৮২৫ খৃষ্টাব্দে ফরিদপুরের হাজী শরীয়ত উল্লাহর নেতৃত্বে ফরায়েজী আন্দোলন নামে এক শক্তিশালী ইসলামী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। প্রায় ঐ সময়ই মুজাহিদ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বাংলার মাওলানা হাজী তিতুমীর (নেছার আলী) ও তাঁর সঙ্গীরা এখানে বহু স্থানে ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন।
We are waiting for your response you are kindly requested to visit our webside to make your ideas clear about our organitain.
সাইয়েদ আহমদ শহীদের শিষ্য মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী (রহ) বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আদর্শ প্রচারে বিরাট কাজ করেন। বাংলাদেশে মুসলমানদের জীবন থেকে হিন্দুয়ানী শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাব দূর করেন। এ অঞ্চলের জনগণের মদ্যে ইসলাম প্রচারের মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরীর অসামান্য দান বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে চিরদিন অবিষ্মরণীয় হয়ে থাকবে। যা হোক, মুজাহিদ বাহিনীর নেতা সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী জিহাদের উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চয় ও অনান্য দেশের মুসলিম মনীষি ও ইসলামী শক্তির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ১৮১৯ খৃষ্টাব্দে মক্কা শরীফে হজ্জ করতে যান। ১৮২৩ খৃ: তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। সেখান থেকে এসেই ইসলামী আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তাঁর দলের প্রতিটি মুজাহিদকে তিনি ইসলামের সোনালী যুগের কর্মীদের আদর্শে গঠন করতে চেষ্টা করেন। তাঁদের রাত্র দিনের কর্মসূচীর মধ্যে ছিল ভোরে প্রচার কার্য, দিবাভাগে কঠোর দৈহিক পরিশ্রম ও রাত্রিতে তাহাজ্জুদ ও অন্য ইবাদাত জাগরণ-এসব ছিল এই খোদাভক্তদের দৈনিক সাধারণ কর্মসূচী। অবিভক্ত ভারতের সর্বত্র জিহাদের প্রস্তুতি ও প্রচারণা শেষ করে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে রায়বেরিলী ত্যাগ করেন। তাঁর সঙ্গে সেই সময় মুজাহিদদের সংখ্যা ছিল এক লাখ। তাঁরা গযনী, কাবুল ও পেশোয়ার হয়ে নওশেরায় হাজির হন। শিখরা ইংরেজদের সাথে গোপনে চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। তারা রণজিৎ সিংহের নেতৃত্বে পাঞ্জাবে আধিপত্য বিস্তার করে মুসলমানদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছিল। শিখরা শেলসিংহ ও জনৈক ফরাসী জেনারেলের অধীন প্রায় ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে পনজতারে মুজাহিদ বাহিনীর সঙ্গে মুকাবিলা করে। এ যুদ্ধে শিখেরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করে এবং মুজাহিদ বানিহী পেশোয়ার অধিকার করে- (১৮৩০ খৃষ্টাব্দে)। এভাবে বালাকোট যুদ্ধের আগ পর্যন্ত আরও বহু যুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনী শিখদের সঙ্গে জড়িত হন। শেষ পর্যন্ত আরও বহু যুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনী শিখদের সঙ্গে জড়িত হন। শেষ পর্যায়ে মুজাহিদ বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল তিন লাখে। রণজিৎ সিংহের সুশিক্ষিত খালসা বাহিনীকে পরাজিত করার পর মুজাহিদরা পেশোয়ার অধিকার করে সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন। অধিকৃত এলাকায় মওলানা সাইয়েদ মাযহার আলীকে প্রধান বিপারপতি ও কাবুলের সুলতান মুহাম্মাদকে প্রধান প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন। এ নবগঠিত ক্ষুদে ইসলামী রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে তিনি পরবর্তী পর্যায়ে ইংরেজ কবলিত সাবেক দারুল ইসলাম ভারত পুনরুদ্ধারের জন্য আরও অধিক শক্তি সঞ্চয় করতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক ঐ সময় পরাজিত রণজিৎ সিংহ ইংরেজদের সাহায্যপুষ্ট হয়ে শঠতার আশ্রয় নেয়। অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে সীমান্তের পাঠান ও উপজাতীয়দের তাঁর দলছাড়া করার চেষ্টা করে।
সাইয়েদ আহমদ কুসংস্কার বিরোধী ছিলেন। ফলে অনেক পাঠান ও উপজাতীয় লোক অর্থলোভে বা কুসংস্কারবশত অকপটে এআন্দোলনকে গ্রহণ করতে পারেনি। ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে বালাকোট নামক স্থানে শিখদের সঙ্গে প্রচন্ড সংঘর্ষের সৃষ্টি হলে খুবি খাঁ নামক এক পাঠানের বিশ্বাসঘাতকতায় সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী ও মওলানা ইসমাইল আন্দোলনের বীর সেনানীরা দমেননি। সীমান্তের ইয়াগিস্তানের সিত্তানায় সাইয়েদ সাহেবের বিশ্বস্ত খলীফাদের নেতৃত্বে সমবেত হন। সাইয়েদ সাহেব শাহাদাতের পূর্বে বালাকোটের রণাঙ্গন থেকে তাঁরই বিশিষ্ট খলীফা মওলানা বেলায়েত আলী আজীমাবাদীকে ভারতের অভ্যন্তরে কাজ করতে পাঠিয়েছিলেন। এ ঘটনার পর মাওলানা বেলায়েত আলী তাঁর ভ্রাতা মওলানা এনায়েত আলী ও অপর বিশিষ্ট নেতা মওলানা মুহাম্মদ এনায়েত আলী ও অপর বিশিষ্ট নেতা মওলানা মুহাম্মদ আলী বহু কষ্টে সাংগঠনিক শক্তিকে মজবুত করে ইয়াগিস্তান থেকে শিখ প্রধান গোলাব সিংহের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এ যুদ্ধ সাড়ে চার বছরকাল স্থায়ী থাকে। অতপর ইংরেজ সরকার সরাসরি এতে হস্তক্ষেপ করে অনেক মুজাহিদকে গ্রেফতার করে-কাউকে শহীদ করে, কারুর প্রতি চলে অমানুষিক নির্যাতন। অবশ্য ভারত সীমান্তের বাইরে থেকে মুজাহিদদদের এক দল সব সময়ই সংগ্রাম চালিয়ে যায়। বালাকোটের সাময়িক ব্যর্থতা, নেতৃবৃন্দের শাহাদত ও পরবর্তী পর্যায়ে মুজাহিদ বাহিনীর উপর ইংরেজদের অকথ্য নির্যাতন সত্ত্বেও এই সংগ্রামী বাহিনীর কর্মীরা নিশ্চুপ বসে থাকেননি। তাঁরা বিভিন্নভাবে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের শিক্ষা, আদর্শ প্রচার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে ত্রাস সৃষ্টি করে গেছেন। শাহ আবদুল আযীয কর্তৃক প্রচারিত সেই দারুল হরবের ফতওয়া এবং পরবর্তী পর্যায়ে তারই ফলশ্রুতি হিসেবে তাঁর অনুসারিগণ কর্তৃক স্বল্পকাল স্থায়ী ইসলামী রাষ্ট্র গঠন ও বালাকোটের লড়াই এবং তারপরও বিভিন্ন তৎপরতার মধ্যমে ইংরেজ বিরোধীভাব জাগ্রত করা-এসব কিছুই ঐতিহাসিক ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পটভূমি রচনা করেছে-যার সূচনা করেছিলেন শুকরের চবি মিশ্রিত বন্দুকের টোটা ব্যবহার ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে বেরাকপুরের মুসলিম সৈন্যগণ।
এই বিপ্লবকে ইংরেজরা সিপাহী বিদ্রোহ বলে অখ্যায়িত করলেও মূলত সেটাই ছিল উপ-মহাদেশের প্রথমে বলিষ্ঠ ও ব্যাপক আযাদী আন্দোলন এবং অবিভক্ত ভারত থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করার ব্যাপারে প্রচন্ড আঘাত।
আধুনিক অস্ত্র, পারস্পরিক ঐক্যের অভাব ইত্যাদি কারণে এ বিপ্লব ব্যর্থ হয়। এ বিপ্লবের নায়ক ছিলেন ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনের কর্মবৃন্দ সংগ্রামী আলিমরাই। নানা কৌশলগত কারণে নেতৃত্বদানকারী অনেক আলিমের নাম সেই সময় উহ্য ছিল বিধায় অনেক ঐতিহাসিকের লেখাতে তাঁদের কেউ কেউ বাদ পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে মাওলানা বাহিনীর অন্যতম নেতা হিসেবে ১৮৫৭ সালের ইসলামী বিপ্লবে পরোক্ষভাবে প্রধান নেতার আসনে সমাসীন ছিলেন। ভারতের অভ্যন্তরে ঐ সময়কার এ ইসলামী বিপ্লবের গতিধারা তাঁর দ্বারাই অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হতো। ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনের কর্মীদের এ দান আমাদের দেশের কোনো কোনো লেখক অজ্ঞতা বশত কিংবা ইর্ষাপরায়ণতার কারণে উপেক্ষা করলেও অনেক হিন্দু লেখক এবং বিখ্যাত ইংরেজ লেখক হন্টারও অস্বীকার করতে পারেননি ১৮৫৭ সালের বিপ্লব ব্যর্থ হবার পর উপমহাদেশের মুসলিম জীবনে সবচেয়ে ঘোর দুর্দিন নেমে আসে। হিন্দুরা ইতিপূর্বেই ইংরেজদের সহযোগতিায় লেগে গিয়েছিল। ইংরেজদের আশংকা ছিল-একমাত্র যাদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। ইংরেজদের আশংকা ছিল-একমাত্র যাদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল সেই মুসলমানদের পক্ষ থেকেই। তাই মুসলমানদের রাজনৈতিক জীবনের ন্যায় তাদের শিক্ষা, সাংস্কৃতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনও সংকীর্ণ ও দুর্বিসহ হয়ে উঠে-যাবতীয় অধিকার থেকে হয় বঞ্চিত। ইংরেজরা বিপ্লবের জন্য একমাত্র মুসলমানগণকেই দায়ী করে তাদেরই উপর জুলুম-নির্যাতনের স্টীমরোলার চালাতে থাকে। বিপ্লবের নায়ক ও কর্মী শত শত আলিম ও হাজার হাজার সাধারণ মুসলমানগণ এ জন্য ইংরেজদের রোষানলে পড়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেন, কেউ মান্টা বা আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত হন, কেউ দীর্ঘকাল যাবত কারা অন্তরালে আঁধার কক্ষে তিলে তিলে ক্ষয় হন। এক তথ্যে দেখা যায়, বিপ্লবের পরে একস্থানে ২৮ হাজার মুসলমানকে ফাঁসি দেয়া হয় এবং শত শত আলিম শাহাদত বরণ করেন। এহেন পরিস্থিতিতেও বালাকোট আন্দোলনের মুজাহিদ ও তাঁদের ভাবশিষ্যরা সংগ্রামের পথ ছেড়ে দেননি। তাঁরা একদিকে সীমান্তের ইয়াগিস্তানে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন, অপরদিকে শাহ ওয়ালিউল্লার সুযোগ্য বংশধর সাইয়েদ সাহেবের মন্ত্রশিষ্য মওলানা শা ইসহাক সাহেবের নেতৃত্বে ভারতের অভ্যন্তরে ইংরেজদের চক্ষু এড়িয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জিহাদের অনুকূলে সতর্কতার সঙ্গে কাজ চালেয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধারা স্থানে স্থানে মাদ্রাসা কায়েম এবং ধর্মীয় সভা-সমিতির মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি মূল্যেবোধের প্রচার, জিহাদী প্রচারণা ও জাগরণকে টিকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেস্টা চালান। বস্তুত সে প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনার ফলশ্রুতি হিসাবেই আমরা দারুল উলুম দেওবন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানসমূহ দেখতে পাই। এগুলোকে কেন্দ্র করে পরবর্তী পর্যায়ে আরও অসংখ্য শিক্ষা ও জিহাদী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে এবং উপমহাদেশে ইসলামী পুনর্জাগরণের পথ উন্মুক্ত হয়।
উত্তরকালে অসহযোগ আন্দোলন ও খিলাফত আন্দোলনকে উপলক্ষ করে মুসলমানদের মধ্যে আযাদী আন্দোলনের যে সাড়া জাগে এবং ১৯৪৭ ইং সালে ইসলামের নামে আমরা যে পাকিস্তান অর্জন করি এর প্রত্যেকটি সকল কাজেরই অনির্বায ফল বৈ কিছু নয়। পরবর্তী পর্যায়ে ইসলামী খিলাফত ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকল্পে অবিভক্তে পাকিস্তানে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বিভিন্নভাবে যে প্রচন্ড আন্দোলন চলে, সেটাকেও শাহ ওয়ালিউল্লাহর প্রদর্শিত ইসলামী রেনেসাঁরই অংশ এবং বালাকোট ও ১৮৫৭ সালের মুজাহিদদেরেই ভাবশিষ্যদের দ্বারা পরিচালিত বলতে হবে। মোটকথা, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে তাঁর সুযোগ্য পুত্র আবদুল আযীয দেহলভী, সাইয়েদ আহমদ শহীদ, মওলানা ইসমাইল শহীদ দেহলভী ও মওলানা আবদুল হাই প্রমুখ ইসলামী আন্দোলনের অগণিত বীর সিপাহী যে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে ছিলেন, উপমহাদেশের সমকালীন প্রতিটি ইসলামী আন্দোলন ও কর্মতৎপরতা তারই পরিশিষ্ট।
0 comments: