অধ্যায় ০২ : মুজাদ্দিদের কাজ , মুজাদ্দিদ ও নবীর পার্থক্য...

মুজাদ্দিদের কাজ কি ?

মুসলিম জাতির মুজাদ্দিদগণের কার্যাবলী বিশ্লেষণ করার পূর্বে তাঁরা যে তাজদীদ বা সংস্কারমূলক কার্যাবলী সম্পাদন করেন সে সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা উচিত।

অভিনবত্ব ও সংস্কারের মধ্যে পার্থক্য

সাধারণত অভিনব কাজ ও সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে পার্থক্য করা হয় না এবং প্রত্যেক অভিনব কার্য সম্পাদনকারীকে সংস্কারক বা মুজাদ্দিদ আখ্যা দেয়া হয় । মানুষের ধারণা, যে ব্যক্তি কোন একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে জোরেশোরে তার প্রচলন শুরু করে, সেই মুজাদ্দিদ । বিশেষ করে যেসব লোক মুসলিম জাতির অবনতি প্রত্যক্ষ করে তাদেরকে জাগতিক দিক দিয়ে রক্ষা করার জন্যে প্রচেষ্টা চালায় এবং সমকালীন আধিপত্যশালী জাহেলিয়াতের সং গে আপোষ করে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের একটি অভিনব ‘মিশ্রণ’ তৈরী করে অথবা নিছক মুসলিম নামটি বাকী রেখে সমগ্র জাতিকে পূর্ণরূপে জাহেলীয়াতের রঙে রঞ্জিত করে দেয় তাদেরকে মুজাদ্দিদ আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে । অথচ তারা মুজাদ্দিদ নয়, তারা অভিনব কার্য সম্পাদনকারী মুতাজাদ্দিদ । তারা কোনো সংস্কারমূলক কাজ করে না, নতুন কোনো কাজ তাদের দ্বারা সাধিত হয় মাত্র । আর মুজাদ্দিদের কাজ এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির । জাহেলিয়াতের সংগে আপোষ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করার নাম সংস্কার নয়। ইসলাম ও জাহেলিয়াতের অভিনব মিশ্রণ তৈরী করাও কোনো সংষ্কারমূলক কাজ নয়। বরং ইসলামকে জাহেলীয়াতের দূষিত পানি থেকে ছেঁকে পৃথক করে নিয়ে কোনো না কোনো পর্যায়ে তাকে তার সত্যিকার নির্ভেজাল আকৃতিতে পুনর্বার অগ্রসর করার প্রচেষ্টা চালানোই মুজাদ্দিদের কাজ। এদিক দিয়ে মুজাদ্দিদ হন জাহেলিয়াতের ব্যাপারে কঠোর আপোষহীন মনোভাবের অধিকারী । জীবনে নগন্যমত অংশেও তিনি জাহেলিয়াতের অস্তিত্বের সমর্থক নন।

মুজাদ্দিদের সংজ্ঞা

মুজাদ্দিদ নবী নন,কিন্তু তাঁর প্রকৃতি নবুয়াতের প্রকৃতির অনেক নিকটতর । মুজাদ্দিদ হন স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী । সত্য উপলব্ধি করার মতো গভীর দৃষ্টি তার সহজাত । সব রকমের বক্রতা দোষমুক্ত সরল বুদ্ধিরবৃত্তিতে তাঁর মনোজগত পরিপূর্ণ। প্রান্তিকতার বিপদমুক্ত হয়ে মধ্যম পন্থা অবলম্বের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করার বিশেষযোগ্যতা তার বৈশিষ্ট । নিজের পরিবেশ এবং শতাব্দীর পুঞ্জীভূত ও প্রতিষ্ঠিত বিদ্বেষমুক্ত হয়ে চিন্তা করার শক্তি, যুগের বিকৃত গতিধারার সংগে যুদ্ধ করার ক্ষমতা ও সাহস, নেতৃত্বের জন্মগত যোগ্যতা এবং ইজতিহাদ ও পুনর্গঠনের অস্বাভাবিক ক্ষমতা মুজাদ্দিদের স্বকীয় বস্তু। এ ছাড়াও ইসলাম সম্পর্কে তিনি হন দ্বিধামুক্ত পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী। দৃষ্টিভংগী ও বুদ্ধি-জ্ঞানের দিক দিয়ে তিনি হন পুর্ণ মুসলমান ।সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর খুঁটিনাটি ব্যাপারে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে পার্থক্য করা এবং অনুসন্ধান চালিয়ে দীর্ঘকালের জটিল আবর্ত থেকে সত্যকে উঠিয়ে নেয়া মুজাদ্দিদের কাজ। এইসব বিশেষ গুণের অধিকারী না হয়ে কোন ব্যক্তি মুজাদ্দিদ হতে পারে না। আর এইসব গুনাবলীই নবীর মধ্যে থাকে, তবে সেখানে থাকে এর চাইতে অনেক বেশী হারে।

মুজাদ্দিদ ও নবীর মধ্যে পার্থক্য

কিন্তু একটি মৌলিক বিষয় মুজাদ্দিদ ও নবীর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে । নবী ঐশী নির্দেশে তাঁর পথে নিযুক্ত হন। তিনি নিজের নিয়োগ সম্পর্কে অবগত থাকেন। তাঁর নিকট ‘ওহি’ নাযিল হয়। নবুয়াতের দাবীর মাধ্যমেই তিনি নিজের কাজের সূচনা করেন। তিনি মানুষকে নিজের দিকে আহবান করেন। তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করা বা না করার ওপর মানুষের মুমিন ও কাফের হওয়া নির্ভরশীল। বিপরীত পক্ষে মুজাদ্দিদ এর মধ্যে কোন একটিরও অধিকারী নন। মুজাদ্দিদ যদি নিযুক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে হন প্রাকৃতিক আইনের মাধ্যমে -খোদার নির্দেশে নয় ।অনেক সময় নিজের মুজাদ্দিদ হওয়া সম্পর্কেও তিনি অবগত থাকেন না। বরং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জীবনের কার্যাবলী পর্যালোচনা করে মানুষ তাঁর মুজাদ্দিদ হওয়া সম্পর্কে জানতে পারে। তাঁর ওপর ইলহাম (খোদার পক্ষ থেকে মনের মধ্যে তত্ত্বজ্ঞানের উদ্ভব) হওয়া অপরিহার্য নয়। আর ইলহাম হলেও সে সম্পর্কে যে তিনি অবশ্যি সচেতন থাকবেন, এমন কোন কথাও নেই। তিনি কোন দাবীর মাধ্যমে নিজের কাজের সূচনা করেন না এবং এমন করার অধিকারও তাঁর নেই। কেননা তাঁর উপর ঈমান আনা বা না আনার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর যুগের সবল সৎ উন্নত চরিত্র বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ধীরে ধীরে তাঁর চতুর্দিকে একত্রিত হয়্ কেবল সেই সকল লোক তাঁর থেকে পৃথক থাকে, যাদের প্রকৃত কোনো প্রকার বক্রতা দোষে দুষ্ট। কিন্তু তবুও মুসলমান হওয়া তাঁকে স্বীকার করে নেয়ার শর্ত সাপেক্ষ নয়।১ এ সমস্ত পার্থক্যসহ মুজাদ্দিদকে মোটামুটিভাবে নবীর পর্যায়ের কাজই করতে হয়।

মুজাদ্দিদের কাজ

মুজাদ্দিদের কাজের নিম্নলিখিত বিভাগসমূহ উল্লেখযোগ্যঃ

১। নিজের পরিবেশের নির্ভূল চিত্রাংকন। অর্থাৎ পরিস্থিতি পূর্ণরূপে পর্যালোচনা করার পর জাহেলিয়াত কোথায় কতটুকুন অনুপ্রবেশ করেছ, কোন পথে তার আগমন হয়েছে, তার শিকড় কোথায় এবং কতদূর বিস্তৃত, ইসলামের অবস্থা বর্তমানে কোন পর্যায়ে এসব সঠিকভাবে বুঝে নেয়া।

২। সংস্কারের পরিকল্পনা প্রণয়ন। অর্থাৎ বর্তমানে কোথায় আঘাত করলে জাহেলিয়াতের বাঁধন টুটে যাবে এবং ইসলাম পুনর্বার সমাজ জীবনের ওপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ পাবে, তা নির্ধারণ করা।

৩।নিজের সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ । অর্থাৎ নিজে কতটুকুন শক্তির অধিকারী এবং কোন পথে সংস্কার করার শক্ত তাঁর আছে, এ সম্পর্কে নির্ভুল আন্দাজ করা।

(১)অনেকে এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন করেন যে, মুজাদ্দিদগণের মধ্যে কেউ তাঁদের মুজাদ্দিদ হবার দাবী করেছেন। যেমন মুজাদ্দিদে আলফিসানি(রঃ) ও শাহ ওলিউল্লাহ (রঃ)। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন যে, এই শ্রদ্ধেয় মুজাদ্দিদদ্বয় কেবল নিজেদের এস্থানে অধিষ্ঠিত হবার কথাই প্রকাশ করেছেন। তাঁরা কোন দাবী পেশ করেননি। তাদের কোন কাজ থেকে এ কথা প্রমাণ হয় না যে, তাঁরা মানুষকে নিজেদের দিকে আহবান করেছেন। এবং নিজেদেরকে মুজাদ্দিদ বলে মেনে নেবার দাবী জানিয়েছেন। অথবা তাঁরা এ কথাও বলেননি যে, যে তাদেরকে মুজাদ্দিদ বলে মেনে নেবে, কেবল সেই মুমিন হবে এবং নাজাত লাভ করবে।

৪।চিন্তারাজ্যে বিপ্লব সৃষ্টির প্রচেষ্টা । অর্থাৎ মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তন করা, আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা ও নৈতিক দৃষ্টিভংগীকে ইসলামের ছাঁচে গড়ে তোলা, শিক্ষা ও অনুশীলন ব্যবস্থার সংস্কার করা, ইসলামী শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং সামাগ্রিকভাবে ইসলামী মানসিকতাকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করা।

৫।সক্রিয় সংস্কার প্রচেষ্টা।অর্থাৎ জাহেলী রসম-রেওয়াজসমূহ খতম করে দেয়া,নৈতিক চরিত্র ও বৃত্তিসমূহকে পরিচ্ছন্ন করা, মানুষের মধ্যে পুনর্বার শরিয়তের আনুগত্যের প্রবল প্রেরণা সৃষ্টি করা এবং পূর্ণ ইসলামী নেতৃত্ব দানের মতো লোক তৈরী করা।

৬।দ্বীনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইজতিহাদ করার প্রচেষ্টা ।অর্থাৎ দ্বীনের মূলনীতিসমূহ হৃদয়ঙ্গম করা, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সমকালীন তমুদ্দুনিক পরিস্থিতি ও তমুদ্দুনিক উন্নতির নির্ভুল দিক নির্ধারণ করা এবং শরিয়তের মূলনীতির আওতায় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তমুদ্দুনের পুরাতন নকশায় পরিবর্তনের এমন পদ্ধতি নির্ণয় করা যার ফলে শরিয়তের প্রাণবস্তু অবিকৃত থাকে তার উদ্দেশ্যাবলী পূর্ণ হয় এবং তমুদ্দুনের নির্ভুল উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইসলাম দুনিয়াকে নেতৃত্ব দান করতে সক্ষম হয়।

৭। প্রতিরক্ষামূলক প্রচেষ্টা। অর্থাৎ ইসলামকে দাবিয়ে দিতে বা নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যত রাজনৈতিক শক্তির মোকাবিলা করা এবং তার শক্তি নির্মূল করে ইসলামের বিকাশের পথ প্রশস্ত করা।

৮।ইসলামী ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন। অর্থাৎ জাহেলিয়াতের হাত থেকে কর্তৃত্বের চাবিকাঠি ছিনিয়ে নিয়ে পুনর্বার সরকারকে সেই ব্যবস্থার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা, যাকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খিলাফত নামে আখ্যায়িত করেছেন।

৯। বিশ্বজনীন বিপ্লব সৃষ্টি। অর্থাৎ একটি মাত্র দেশে অথবা যে সব দেশে মুসলমান পূর্ব থেকেই আছে কেবল সেখানেই ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেই ক্ষান্ত না হওয়া। বরং এমন একটি শক্তিশালী বিশ্বজনীন আন্দোলন সৃষ্টি করা, যার ফলে ইসলামের সংস্কারমূলক ও বিপ্লব দাওয়াত সাধারণ্যে বিস্তার লাভ করে, ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি সমগ্র দুনিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়, সমগ্র দুনিয়ার তমুদ্দুনিক ব্যবস্থায় এক ইসলামী বিপ্লব সূচিত হয় এবং মানব জাতির নৈতিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ইসলামের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।

এই বিভাগগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, ইসলামী পুনরুজ্জীবনের কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তিদের জন্যে প্রথম বিভাগ তিনটি অপরিহার্য। কিন্তু অবশিষ্ট ছয়টি বিভাগের প্রত্যেকটি মুজাদ্দিদ হবার অপরিহার্য শর্তের মধ্যে গণ্য নয়। বরং এগুলোর মধ্যে থেকে কোন একটি ,দুটি, তিনটি, চারটি বিভাগে উল্লেখ্যযোগ্য কার্য সম্পাদন করলে তাঁকে মুজাদ্দিদ গণ্য করা যেতে পারে। তবে এ ধরনের মুজাদ্দিদ আংশিক মুজাদ্দিদ হবেন। পূর্ণ মুজাদ্দিদ কেবল তিনিই হবেন, যিনি উল্লিখিত বিভাগের প্রত্যেকটিতে পূর্ণ কার্য সম্পাদন করে নবুয়াতের উত্তরাধিকারিত্বের হক আদায় করবেন।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম