বর্তমান পৃথিবী যে সব জটিল সমস্যার সম্মুখীন, মজুর-শ্রমিকদের মজুরি সমস্যা তন্মধ্যে অন্যতম। মেহনতী জনতার সঠিক ও সুবিচারপূর্ণ মজুরি ও পারিশ্রমিক কি হইতে পরে-যাহাতে একদিকে শ্রমিকগণ নিশ্চিন্ত ও সচ্ছল জীবন যাপন করিতে পারে-বর্তমানে এই প্রশ্নই মানুষের মনকে অত্যন্ত তীব্রভাবে বিব্রত করিয়া তুলিয়াছে।
মজুরি সমস্যা চিরকালই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসাবে পরিগণিত হইয়া আসিলেও শিল্প-বিপ্লবের পরই এই সমস্যা আইন ও নৈতিকতা উভয় দিক দিয়াই দুনিয়ার রাষ্ট্রসমূহের পক্ষে অত্যন্ত জটিল হইয়া দেখা দিয়াছে। যন্ত্রের সাধারণ প্রচলন হওয়ার পূর্বে এক একটি কাজ যেখানে এক হাজার মজুর সম্পন্ন করিত ও তাহা হইতে নিজেদের জীবিকা অর্জন করিত-যন্ত্র আবিষ্কৃত ও সাধারণভাবে ব্যবহৃত হইতে শুরু হওয়ার পর উহা একটি মাত্র যন্ত্র ও কয়েকজন মানুষের দ্বারাই সম্পন্ন হইতে লাগিল, ফলে ব্যাপকভাবে দেখা দিল বেকার সমস্যা। আর প্রত্যেক দেশে যেহেতু মেহনতী জনতার সংখ্যাই সর্বাধিক ও বিপুল হইয়া থাকে, এই জন্য এই সমস্যার জটিলতা কেবল মজুরদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হইয়া থাকে না; বরং শেষ পর্যন্ত তাহা জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সমস্যায় পরিণত হয়। ১৯৫৬ সনের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক শ্রমিক-সংস্থার পক্ষ হইতে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে দুনিয়ার আড়াইশত কোটি জনতার মধ্যে একশত কোটিই শ্রমজীবি বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ইহার সংখ্য হচ্ছে সাত লক্ষ।
বর্তমান বিশ্ব সমাজের যতগুলো আদর্শ ও সমাজ ব্যবস্থা কার্যকর রহিয়াছে, তন্মধ্যে কোন একটিও এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের মজুরী সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করিতে পারে নাই। যে সব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ও সেই সঙ্গে অবাধ অর্থ শোষণের অবারিত সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান সেইখানে মজুর-শ্রমিকদের ওপর রাষ্ট্র-সরকারের নিরুংকুশ প্রাধান্য ও একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপিত হইয়াছে সেখানে তাহারা বাধ্যতামূলক দাসশ্রম ও সীমাবদ্ধ মজুরীর অভিশাপে জর্জরিত হইতেছে। পার্থক্য এই যে, পুঁজিবাদী দেশে মজুর-শ্রমিকগণ মজুরী সম্পর্কে দর কষাকষি করিতে পারে, দাবি-দাওয়া পেশ করিতে, দাবি আদায়ের জন্য বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতে পারে, ধর্মঘটের হুমকী দিতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত ধর্মঘটের সাহায্যে কর্তৃপক্ষেকে বাধ্য করিয়া নিজেদের দাবি অনুযায়ী মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আদায় করিতে পারে। কিন্তু সেখানে মজুরদের ওপর একমাত্র সরকারের নিরংকুশ কর্তৃত্ব কায়েম হইয়া আছে সেখানে মজুর-শ্রমিকগণ নিজেদের কোন অভাব-অভিযোগ, মজুরী সম্পর্কে আপত্তি কিংবা অতিরিক্তি কোন দাবি পেশ করিতে পারে না। অন্যথায় নিষ্পেষণ ও শুদ্ধির আঘাতে নিশ্চিহ্ন হইয়া যাওয়া অবধারিত। কিন্তু উভয় প্রকারের সমাজেই যে ব্যাপকভাবে শ্রমিক অসন্তোষ বিদ্যমান রহিয়াছে এবং কোনমতেই তাহার কোন প্রতিকার ব্যবস্থা করা হইতেছে না, তা সর্বজনবিদিত।
বিগত ১৯৫৪ সনের জানুয়ারী হইতে আগষ্ট পর্যন্ত আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স, জাপান ও ভারতে যেসব ধর্মঘট সঙ্ঘটিত হইয়াছে তাহা হইতে বর্তমান ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ সম্পর্কে সুস্পষ্ট অনুমান করা যাইতে পারে। ১৯৫৪ সনের নভেম্বর মাসে বৃটেনের ডক শ্রমিকগণ যে ধর্মঘট করিয়াছিল তাহা কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হইয়াছিল। এই ধর্মঘট শেষ হওয়ার পূর্বে ২০ হাজার ডাক শ্রমিকের সঙ্গে ৭০ হাজার রেল শ্রমিকও ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। ইহার ফলে বৃটিশ সরকারকে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি স্বীকার করিতে হয় ও কয়েক মাস পর্যন্ত আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হইয়া যায়। আমেরিকায়ও অনুরূপ ধর্মঘটের কোন সীমা সংখ্য নাই। ১৯৫৫ সনের মার্কিন দূতাবাস হইতে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা গিয়াছে যে, কয়েক বৎসর পূর্বে আমেরিকায় ১৪ বৎসর কিংবা তদুর্ধ বয়সের বেকারদের সংখ্যা হচ্ছে ২৮, ৩২, ২০৬। আর তাহারা যে মজুর-শ্রমিক ছাড়া অন্য কোন লোক নয় তাহা বুঝিতে কোন কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ভারতের অবস্থা আরও মারাত্মক। সেখানে সম্ভবত একটি মাস এমন যায় না যখন সেখানে কোন-না কোন ক্ষেত্রে ধর্মঘট বা দাবি আদায়ের জন্য বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয় না। ১৯৫৫ সনে কানপুরে সমস্ত বস্ত্রমিলের মজুরগণ Rationalisation এর বিরুদ্ধে কয়েক মাস পর্যন্ত ধর্মঘট করিয়াছিল, যার ফলে ভারতের বস্ত্র-শিল্প কয়েক কোটি টাকার লোকসান স্বীকার করিতে বাধ্য হয়। এই বিরাট লোকসান দেখিয়া তথাকার সরকার সম্পূর্ণ নীরব ও নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বন করিয়াছিল। অর্থাৎ মজুর-শ্রমিকদের দুরাবস্থা দূরীকরণ এবং তাহা দূর করিবার জন্য মজুরদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে ভারত সরকার কোনই দায়িত্ব বোধ করে নাই। বরং অসহায় ও অভুক্ত-অর্ধভুক্ত মজুর শ্রমিকদেরকে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির বজ্র মুষ্ঠিতে সোপর্দ করিয়া দিয়া জাতীয় সরকার সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত ভূমিকা অবলম্বন করে। একটি ধর্মহীন পুজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মজুরদের যে কি দুরাবস্থা ভারত সরকারের নিষ্ক্রীয় ভূমিকা ও ভারতের মজুরদের অবস্থা হইতেই সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারা যায়।
১৯৬৪ সনে অক্টোবরে-নভেম্বর মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে চটকল সমূহে যে ব্যাপক ও একটানা দেড় মাসাধিকালের ধর্মঘট চলে এবং এ ব্যাপারে তৎকালীন সরকার যে নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বন করে, তাহাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
রাশিয়া, চীন ও পূর্ব ইউরোপের যে সব দেশের মজুরদের রাজত্ব কায়েম রয়েছে, রাষ্ট্রের নির্মম ও নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণের দরুন সে সব দেশের মজুরদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আমরা খুব বেশি কিছু জানিতে পারি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও শাসকদের অনুবীক্ষণ হইতে বাঁচিয়ে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয় কিংবা বৈদেশিক পর্যটকদের মারফতে বহির্বিশ্ব যাহা কিছু জানিতে পারে তাহা হইতে এতটুকু অনুমান করা কিছুমাত্র কঠিন নয় যে, এই সব মজুর-রাষ্ট্রে শ্রমিক মজুরদের অবস্থা পুজিবাদী দেশ বিশেষত: আমেরিকা, বৃটেন ও ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের মজুরদের অপেক্ষা কিছুমাত্র উন্নত নহে। মেহনতী জনতাকে শ্রান্ত ও দমন করিবার জন্য সেখানে কর্মীদের নির্মম হস্তে ধোলাই করা হয়, অপরদিকে কঠোর বাধ্যতামূলক শ্রম ও সীমাবদ্ধ মজুরির নিপীড়নে তাহাদিগকে জর্জরিত হইয়া থাকিতে হয়।
যেসব দেশে বাক-স্বাধীনতা রহিয়াছে এবং যেসব দেশের সরকার বর্ষিক রিপোর্ট ইত্যাদি প্রকাশ করিয়া থাকেন, সে সব দেশের মজুর-শ্রমিকদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানিতে কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু যেখানে কেবল মুখ ও লেখনীর উপরই নহে মানুষের চিন্তা ও কল্পনা শক্তির উপর পর্যন্ত কঠোর পাহারা বসানো হইয়াছে, সেখানকার মজুরদের অবস্থা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা বড়ই কঠিন ব্যাপার। কিন্তু তবুও যতটুকু বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে তা-ই এখানে পেশ করা যাইতেছে।
রাশিয়ার সরকারী সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান তাস-এর পাক্ষিক মুখপত্র ‘সোভিয়েত দেশ’ সোভিয়েট রাশিয়ায় কি সাম্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে শীর্ষক প্রবন্ধে মজুরদের অবস্থা লিখিতে গিয়া বলা হইয়াছে: তাহাদের বাস্তব প্রয়োজন পূরণ করিবার ব্যাপারে এখানো পুরোপুরি সাম্য কায়েম করা হয় নাই। কেননা তাহারা সমাজ হইতে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী নহে; বরং শ্রম মেহনত অনুযায়ী অংশ পাইয়া থাকে। ইহা শ্রমিকদের প্রয়োজন পূরণের ব্যর্থতা সম্পর্কে এমন একটি রাষ্ট্রের স্পস্ট স্বীকৃতি যা বিগত ৩৮ বৎসর পর্যন্ত দুনিয়ার অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার শ্লোগান দিয়া আসিতেছে।
মজুরগণ তাহাদের প্রয়োজন অনুযায়ী কবে ও কোন দিন উৎপাদনের অংশ পাবে, কিংবা আদৌ কোনদিনই পাবে কিনা তাহা নিশ্চিত করিয়া বলা মুশকিল। কিন্তু পরিশ্রম অনুযায়ী তাহারা কত এবং কিভাবে মজুরি পাইয়া থাকে এবং তাহাদের শ্রমের সঠিক মূল্য নির্ধারণ কারা করিয়া থাকে, তাহা অবশ্যই আলোচিত হইবে। উপরুন্ত সরকারী সাধারণ কর্মচারী ও মজুর-শ্রমিকদের মজুরির ক্ষেত্রে যে পার্থক্য রহিয়াছে তাহাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভারতের প্রখ্যাত সমাজতান্ত্রিক নেতা মিসেস সূচেতা কৃপালনী ১৯৫৪ সনের মধ্যভাগে রাশিয়া সফরান্তে যে বিবৃতি দিয়াছিলেন তাহার একাংশ এখানে উদ্ধৃত করা যাইতেছে; তিনি বিবৃতিতে বলিয়াছিলেন:
শ্রমিকদের সঠিক মজুরি কত, তাহা জানিতে পারা আমাদের পক্ষে কঠিন ছিল। যখনি আমরা বিশেষ কোন শিল্পক্ষেত্রে সেখানকার মজুরদের উচ্চ ও নিম্ন বেতনের পরিমাণ জানিতে চাহিয়াছি তখনি আমাদিগকে মাঝামাঝি পরিমাণই বলা হইয়াছে। তাহারা পরও খুটিয়া খুটিয়া জিজ্ঞাসা করিলে পরে জানা গেল যে, নিম্নতম মজুরি হইতেছে পাঁচশত রুবল, অথচ কারখানার ডাইরেক্টর পাঁচ হাজার হইতে সাত হাজার রুবল পর্যন্ত বেতন পাইয়া থাকেন। অর্ধ সপ্তাহিক ‘দাওয়াত’ ২৫ জুলাই ১৯৫৪।
লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, খুটিয়া খুটিয়া জিজ্ঞাসা করিবার পরই এই নিম্নতম মজুরি জানিতে পারা সম্ভব হইয়াছে। দ্বিতীয়ত: ইহাও অসম্ভব নয় যে, ইহা সেই কারখানার অবস্থাও হইতে পারে, যাহা কমিউনিষ্ট রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বোত্তম ও যা বিদেশী পর্যটকদের দেখাইবার জন্য ও বহির্বিশ্বে সুনাম অর্জন করিবার উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করিয়া রাখা হইয়াছে।
তদুপরি পাক-ভারতের লোকদের নিকট পাঁচ শত রুবল খুব বিরাট কিছু মনে হইবে এবং তাহারা মনে করিবে যে, সেখানকার নিম্ন বেতোনভোগী সাধারণ মজুরদেরও জীবন মান বুঝি কতই না উন্নত! কিন্তু রাশিয়ার দ্রব্যমূল্যের উচ্চতা ও বেতনের মধ্যে যে ৫০-১ পার্থক্য রয়েছে সেই দৃষ্টিতে যাচাই করিলে পাঁচ শত রুবলের কোন ধোকাই টিকিয়া থাকিবে না। মজুরি কম কিংবা বেশি তাহা নির্ধারণের জন্য দ্রব্যমূল্যই হইতেছে সঠিক মাপকাঠি।এই জন্য এইখানে তাহার একটি চার্ট দেওয়া যাইতেছে।
১৯৫৪ সনের আগস্ট মাসে ভারতীয় পার্লামেন্টের প্রভাবশালী সদস্য জ্ঞানী গৌরমুখ সিংহ রাশিয়া সফর করিয়া যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়াছেন, এখানে তাহার কিছুটা উল্লেখ করা যাইতেছে। তিনি বলিয়াছেন:
“রাশিয়ার সাধারণ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য দেখিলে পাঁচশত রুবল মজুরির রহস্য বুঝিতে পারা যায়। মনে রাখা দরকার যে, একটি রুবলের মূল্য আমাদের দেশী টাকা অনুসারে ১,০৯ টাকা মাত্র; কিন্তু সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদীর মূল্য নিম্নরূপ:
একটি ডিমের মূল্য ৩ রুবল, একটি মোরগের মূল্য ২৫ রুবল, টামটোর প্রতি কেজি মূল্য ২ রুবল, দুগ্ধ প্রতি কেজি মূল্য ২০ রুবল, আলুর প্রতি সের মূল ৬ রুবল, মূলার প্রতি কেজি মূল্য ৫ রুবল, গাজর প্রতি কেজি মূল্য ৮ রুবল শালগমের প্রতি কেজি মূল্য ৭ রুবল, ডবল রুটির প্রত্যেকটির মূল্য ২ রুবল, বকরীর গোশত প্রতি সের মূল্য ১৮ রুবল, ৬ সিট কাগজের মূল্য ৪ রুবল, একটি শীতল কোর্তার মূল্য ৪ রুবল, একটি শীতল কোর্তার মূল্য ২০০ রুবল, গমের এক মণ মূল্য ৮৫ রুবল, মেয়েদের ছোট ব্যাগ প্রতিটি ৯০ রুবল, এইখানে শুধুমাত্র কয়েকটি জিনিসের মূল্যের উল্লেখ করা হইল। ইহা হইতে সহজেই বুঝিতে পারা যায় যে, সেখানে একজন মজুর পাঁচশত রুবল বেতন পাইলেও তাহার জীবন মাত্রা কোটেই সচ্ছল হইতে পারে না। আর কেবল রাশিয়ায়ই নহে, প্রতিটি কমিউনিস্ট দেশেরই এই অবস্থা। আন্তর্জাতিক শ্রমিক-প্রতিষ্ঠানের তরফ হইতে সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক ইশতেহার হইতে এই সব দেশের শ্রমিকদের মর্মান্তিক অবস্থা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। তাহাতে স্পষ্ট স্বীকার করা হইয়াছে যে, “চেকোস্নোভাকিয়ার মজদুরদের দ্বারা ক্রীতদাসেদের ন্যায় কাজ সম্পন্ন করা অত্যন্ত ভয়ানক পদ্ধতি। রাশিয়ার আইনে রাজনৈতিক সন্দেহসূত্রে শ্রমিকদিগকে বাধ্যতামূল দাস শ্রমিকদের ক্যাম্পে বন্দী করিয়া রাখার সুযোগ রহিয়াছে।
অত:পর চীনের মজুর শ্রমিদের অবস্থা সম্পর্কেও খানিকটা আলোচনা করিতে চেষ্টা করিব। কেননা। আমাদের দেশের এক শ্রেণীর কমিউনিস্ট প্রচারক আজকাল কথায় কথায় চীন দেশের দোহাই দিয়া থাকেন।
১৯৫৩ সনে এপ্রিল মাসে ‘ইন্ডিয়ান ওযার্কার্স ডেলিগেশন’ এর সদস্য হিসাবে ব্রজকিশোর শাস্ত্র সরকারী আমন্ত্রণক্রমে চীন গমন করে। সেখানে তিনি মজুর-শ্রমিকদের অবস্থা জানিবার জন্য বিশেষ কৌতুহল প্রকাশ করেন। প্রায় ছয় সপ্তাহ কাল পর্যন্ত চীন ভ্রমণ করিয়া তিনি সেখানকার মজুর-শ্রমিকদের সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা নিম্নরূপ:
“এখানে আমরা হালের সঙ্গে বলদের পরিবর্তে মেয়েলোককে বাঁধা দেখিয়াছি। সে কত মর্মান্তিক ও অমানুষিক দৃশ্য। মেয়েলোক-তাহাকে হালের সঙ্গে বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছে।
চীনের ইংয়াংস্টেরি ভারপ্রোজেক্ট-এ সব মজুর শ্রমিককে তিনি কাজ করিতে দেখিয়াছেন, তাহাদের সম্পর্কে তিনি বলেন:
“এই প্রোজেক্ট-এর নিকটে অফিসারদের থাকিবার বাংলা নির্মাণ করা হইয়াছে। প্রায় পাঁচ হাজার মজুর এখানে কাজ করে। সকল প্রকার পাথর ভাঙ্গা হইতে শুরু করিয়া সুড়ঙ্গ খোদাই করা কিংবা পাথরে চটান স্থানারিত করা। প্রভৃতি যাবতীয় কাজই অনাবৃত হাতে করা হইয়াছে। মজুরগণ যে সব হাতিয়ার ব্যবহার করিতেছিল, তাহা ছিল খুবই দুর্বল ও প্রায় অকেজো এবং নিকৃষ্ট ধরণের। মনে হইতেছিল যে, তাহা কোন যাদুঘর হইতে আনা হইয়াছে।
তিনি বলেন, “আমি এই দৃশ্য দেখিয়া মুহূর্তের জন্য হতচেতন হইয়া পড়িলাম। চীন দেশেল মেহনতী লোকদের দ্বারা যেভাবে কাজ করানো হইতেছে তাহা দেখিয়া তাহার অনুকরণ করা যা তাহা হইতে কোন প্রকার প্রেরণা লাভ তো দূরের কথা; বরং বড়ই দু:খ ও বেদনা পাইলাম। আমি ভীত বিহ্বল হইয়া পড়িলাম। মানুষ আর যাহাই হউক জন্ত নয়। কোন দেশের উন্নয়নের ব্যাপারে জন্তুদের স্থানে মানুষকে ব্যবহার করা মানবতার উপর নির্মম জুলুম ও চরম অমানুষিকতা ভিন্ন আর কি হইতে পারে।
ইহার প্রতিবাদ করারও ভাষা নাই। মজুরদের বেশির ভাগ বহু দূর-দুরাঞ্চল হইতে আনা হইয়াছে। বর্তমান চাকুরী ছাড়িয়া অন্যত্র যাওয়ার তাহাদের কোন পথ নাই। মূলত চীনা কমিউনিষ্ট পার্টি ও প্রেসিডেন্ট মাও সেতুং এখানে বাধ্যতামূলক অমানুষিক শ্রমের রাশিয়া-পরীক্ষিত ‘কার্যপদ্ধতি’ প্রয়োগ করিয়াছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী শাস্ত্রী মহাদয়ের এই বিবরণের পর চীনা মজুরদের অবস্থা সম্পর্কে আর বেশি কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই। অবশ্য উল্লেখযোগ্য এই যে, এইরূপ বাধ্যতামূলক অমানুষিক প্ররিশ্রমের পর তাহারা মজুরী বাবদ যাহা কিছু পায় তাহা পাক-ভারতের সরকারী অফিস ও কারখানার মজুরদের বেতন অপেক্ষা অনেক কম।
একজন চীনা শ্রমিক এক হাজার পনেরো শত ‘ইয়ান’ কিংবা পঞ্চাশ ইউনিট পারিশ্রমিক পাইয়া থাকে। (এক ‘ইয়ান’ তৎকালীন পাকিস্তানের এক পয়সার একটু বেশি ও এক ইউনিট আট আনা কিংবা তাহার একটু বেশির সমান’ আর পঞ্চাশ ইউনিটে আমাদের ২৫/২৬ টাকার সমান হয়)। এই সামান্য ও সংক্ষিপ্ত পারিশ্রমিক নিয়ে একজন শ্রমিক যখন বাজারে যায় তখন চেতনা হরণকারী দ্রব্যমূল্যের সম্মুখীন হইতে হয়। এই প্রসঙ্গে শাস্ত্রী মহোদয় বলেন:
“নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য ভারত অপেক্ষা চীনদেশে অনেক বেশি। চাউল, কাপড়, তৈল, লবণের মূল্য অপেক্ষা পঞ্চাশ ভাগ বেশি। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য জিনিসের মূল্য সম্পর্কে ধারণা করাও কঠিন।”
প্রত্যক্ষদর্শীর এই বর্ণনার ভিত্তিতে অনায়াসেই এই প্রশ্ন করা যাইতে পারে যে, বৃটেন ফ্রান্স আর স্বয়ং আমাদের দেশে অন্তত: সরকারী মজুর ও কারখানার কুশলীরাও কি এই অপেক্ষা অনেক বেশি বেতন বা মজুরি পায় না? আর চীন অপেক্ষা এই সব দেশের দ্রব্যমূল্যও কি অনেক কম নয়? এতৎসত্ত্বেও আজ এদেশের এক শ্রেণীর কমিউনিস্ট চীন ও রাশিয়াকে ‘স্বর্গরাজ্য বলিয়া মনে করে এবং অবুঝ যুবক-যুবতীদের সাহায্যে বিভ্রান্ত করিতে চেষ্টা করে। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সঠিক জ্ঞানের আলোকে এই সব অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তির অন্ধকার যতশীঘ্র দূর হইয়া যায় মানবতার পক্ষে ততই মংগল-তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।
সাপ্তাহিক ‘জাহানেও নও’ পত্রিকার শ্রমিক উন্নয়ন সংখ্যায় প্রকাশিত।
অধ্যায় ০৫ : পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক সমাজে মজুরদের অবস্থা
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: