ইসলাম এই প্রশ্নের জওয়াব দিয়াছে এবং সে জওয়াব অতীব সুষ্ঠ ও বিজ্ঞাসম্মত।ইসলাম বলে, পুঁজি বা সম্পত্তির প্রকৃত মালিক ব্যক্তিও নয় সমাজও নয়। ইহার কারণ এই যে, পুঁজি বা সম্পত্তির প্রকৃত মালিক ও সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী সে-ই হইতে পারে, যে তাহা নিজ শক্তির বলে সৃষ্টি করিয়াছে অথবা উৎপাদন করিয়াছে সেই সব শক্তি যোগ্যতা ও সামর্থের যাহা পুঁজি সৃষ্টি করিয়াছে। আর ইহা সর্বজনবিদিত যে, কোন মানুষই দুনিয়ার কোন বস্তু বা শক্তি বা যোগ্যতার সৃষ্টি করে নাই কোন ব্যক্তি তাহা সৃষ্টি করিয়াছে আর না কোন মানবগোষ্ঠি বা কোন সমাজ। অতীব সুস্পষ্ট কথা-ইহা প্রমাণ করিবার জন্য কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি আবশ্যক করে না।
এই বিশাল দুনিয়ার যাহা কিছু পাওয়া যায় তাহার সৃষ্টিকর্তা ব্যক্তি বা সমাজের ঊর্ধ্বের কোন সত্তা যাহাকে আমাদের জড়চক্ষু যদিও দেখতে পায় না-কিন্তু মন তাঁহাকে অনুভব করে।মানব-বুদ্ধি তাঁহাকে বিশ্বস্রষ্টা বলিয়া স্বীকার করিতে আমাদেরকে বাধ্য করে। কারণ সৃষ্টিকর্তা যখন ব্যক্তিও নয়, সমাজও নয়, তখন একজন সাধারণ মানুষও এই কথা স্বীকার করিতে বাধ্য যে, প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা এই মানুষ ও জড়ের অতীত কোন সত্তা। ইসলাম এই সত্তার নাম রাখিয়াছে আল্লাহ। ইসলামের দৃষ্টিতে এই আল্লাহ তা’আলাই সকল বস্তু এবং জীব ও জন্তুকে সৃষ্টি করিয়াছেন। সৃষ্টি করিয়াছেন সকল শক্তি ও যোগ্যতা-কাজেই তিনিই সকল বস্তু এবং জন্তু, সকল সম্পদ এবং সম্পত্তি তথা সকল ব্যক্তি এবং সমাজের সৃষ্টিকর্তা ও একচ্ছত্র মালিক। মানুষের হাতে ধন-সম্পত্তি যাহা কিছু আছে তাহা কোন ব্যক্তি বা সমাজেরই উপার্জিত হউক না কেন, তাহার সব কিছুরই প্রকৃত মালিক আল্লাহ। তিনি দুনিয়ার সুষ্ঠু পরিচালনা ও শৃংখলা বিধানের জন্য মানুষের জন্য নয়; বরং একটি সুনির্দিষ্ট কালের জন্য মাত্র। এই আমানত রাখার মূলে আল্লাহর আর একটি বিরাট উদ্দেশ্য নিহিত রহিয়াছে, তাহা হচ্ছে মানুষের পরীক্ষা। আল্লাহ তা’আলা এই সম্পদ এবং সম্পত্তি মানুষের ভোগ ব্যবহারের জন্য দিয়াছেন আর সেই সঙ্গে দিয়াছেন সেই সব ভোগ-ব্যবহার করিবার-তথা ব্যক্তি-মানুষ ও সমাজ-মানুষের সুনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের জন্য একটি পূর্ণ ও সার্বজনীন জীবন বিধান। আল্লাহ তা’আলা ইহার সাহায্যে মানুষকে এই দিক দিয়া পরীক্ষা করিতে চান যে, মানুষ কি এইগুলি নিয়ে ইচ্ছামত ভোগ ব্যবহার করে, না আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুযায়ী করে। আর এগুলিকে আল্লাহর দেওয়া বিধান মুতাবিক কোটি কোটি মানুষের মধ্যে বন্টন করে, না তিল তিল করিয়া সঞ্চিত ও নিজস্ব ভোগের সামগ্রী করিয়া রাখে। সম্পদ সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কে ইসলামের এ-ই গোড়ার কথা।
এই খানের সমগ্র ব্যাপারটি শেষ হইয়া যায় নাই; বরং আল্লাহ তা’আলা পরিস্কার করিয়া বলিয়া দিয়াছেন যে, আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুসারে যার নিকট যত পরিমাণ সম্পদ যা সম্পত্তি থাকুক না কেন তাহাক যে সুষ্ঠুভাবে আল্লাহর বিধান মতো ব্যয় করিবে, তাহাকে তিল তিল করিয়া জমা করিয়া রাখবে না-এহেন পরীক্ষায় সেই ব্যক্তি সাফল্য লাভ করিতে পারিবে। আর যে এরূপ করিবে না তাহার জীবন এই পরীক্ষায় ব্যর্থ প্রমাণিত হইবে মালিকানা সম্পর্কে এই নীতি উপস্থাপিত করিয়া ইসলাম মানবীয় মালিকানার মূলে চিরতরে কুঠারাঘাতে করিয়াছে। এবং ব্যক্তি মালিকানা আর জাতীয় মালিকানা এই উভয় প্রকার ধ্বংসাত্মক মত হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র এক নতূন মত-আল্লাহর মালিকানা-পেশ করিয়াছে। দৃষ্টিতে মানুষ ধন-সম্পত্তির মালিক নহে, আমানতদার মাত্র। এই মতের ভিত্তিতে ইসলাম তাহার পরিপূর্ণ সমাজ-ব্যবস্থার কাঠামো রচনা করিয়াছে। এহেন সমাজ ও অর্থব্যবস্থা যে বাস্তব প্রয়োগযোগ্য, এবেং তা যে মানবতার সকল দু:খ-দারিদ্র, শোষণ-নিষ্পেষণ এবং লাঞ্চনা ও অবমাননার একমাত্র একমাত্র প্রতিষেধক তাহার প্রমাণ বিশ্ব-ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায় তাহার বাস্তব পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে। সেই অধ্যায়ের বিশিষ্টতা, সৌন্দর্য এবং সার্বজনীন কল্যাণকারিতা স্মরণ করিয়া আজও মানুষ শ্রদ্ধায় মস্তক অবনমিত করে।
বর্তমান দুনিয়া যে অস্বাভাবিক, অসমান ও ভুল ত্রুটিপূর্ণ সমাজ-ব্যবস্থার তলে পড়িয়া নিষ্পেষিত হইতেছে এবং অসংখ্য ও বিরাট সমস্যা মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়া দুনিয়াকে ধ্বংসের সুখে নিক্ষেপ করিয়াছে, তাহার সমাধান এবং নিখুঁত কল্যাণ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা একমাত্র এই আল্লাহর মালিকানার ভিত্তিতে গড়া ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থায়ই হউক, কিংবা সামাজিক মালিকানার সমাজতন্ত্রই হউক-উভয় ব্যবস্থাই অবৈজ্ঞানিক, ধ্বংসকরী এবং মানব প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিরোধী। তাহা কোনদিনই নির্বিশেষে সমগ্র মানুষের কল্যাণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিবে না।
১. ১৯৫১ সালে ১২ই মে দৈনিক ‘আজাদ’ পত্রিকার ‘সাহিত্য মজলিস’ প্রকাশিত।
অধ্যায় ০৪ : মালিকানা স্বত্ব ও ইসলাম
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: