অধ্যায় ০৩ : সম্পত্তির জাতীয়করণ

ব্যক্তিগত মালিকানার পরে দ্বিতীয় মত হচ্ছে জাতীয় মালিকানা। ইহার অর্থ এই যে, দেশের কোন জিনিসের মালিক হইবে না; বরং দেশের ও জাতির যাবতীয় ধন-সম্পত্তির মালিক হইবে নির্বিশেষে ও সম্মিলিতভাবে দেশের সমগ্র জাতি। সাধারণভাবে কমিউনিজম ও মার্কসবাদের ধ্বজাধারিগণই এ মত পোষণ ও প্রচার করিয়া থাকে। এই মতের দৃষ্টিতে সমাজক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বতন্ত্র সত্তার কোনই গুরুত্ব নাই, সকল গুরুত্ব এবং সর্বময় কর্তৃত্ব একান্তভাবে সমাজের হাতে ন্যস্ত করা হয়। ব্যক্তি সেখানে খাটে, মেহনত করিয়া উপার্জন করো, কিন্তু উপার্জিত সম্পদের মালিক সে ইইতে পারে না, সমাজ তাহাকে তাহা হইতে বঞ্চিত রাখিয়া নিজেই একচ্ছত্র মালিক হইয়া বসে। ব্যক্তি তাহার মেহনত, যোগ্যতা ও মননশক্তি ব্যয় করিয়া তাহার বিনিময়ে সমাজের নিকট হইতে পেটভরা খাবার, পরিধানের বস্ত্র আর সম্ভব হইলে বাসস্থান লাভ করে। ফলত সে সমাজের চাকর, এই চাকরী হইতে সে মৃত্যু পর্যন্ত কখনও মুক্তি পাইতে পারে না। উপরুন্ত তাহার এই নিরংকুশ ও একচ্ছত্র মনিব ও প্রভু তাহাকে এতটুকু সুযোগ দেয় না যে, সে নিজের দাবি অনুযায়ী নিজের পরিশ্রমের সঠিক মূল্য আদায় করিতে চেষ্টা করিবে।

ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থার অধীন প্রতিটি শ্রমিক মজুর নিজের শ্রম-মেহনত বিক্রয় করিয়া পুঁজিদারের নিকট উপযুক্ত মূল্য সে অনায়াসেই দাবি করিতে পারে, সে সুযোগ তাহাতে পূর্ণরূপে লাভ করা যায়। এমনকি একজন পুঁজিদার তাহার দাবি অনুসারে মূল্য দিতে প্রস্তুত না হইলে সে অন্যত্র তাহার ভাগ্য পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারে। কিন্তু শ্রেণীহীন সমাজ তথা এই জাতীয় মালিকানা ব্যবস্থায় সমাজ মজুর শ্রেণীর শ্রম-মেহনতের মূল্য যা-ইচ্ছা তা-ই নির্দিষ্ট করিয়া দিতে পারে, সে সম্পর্কে মজুরের কোন কিছু বলিবার অধিকার মাত্রই নাই। এবং সমাজ কর্তৃক কোন মূল্যবান নির্দিষ্ট হইয়া গেলে তাহার প্রতিবাদ করিবার বা তাহার বিরুদ্ধে একক কিংবা সংঘবদ্ধ আওয়াজ বুলন্দ করিবার কোন সুযোগই সে পাইতে পারে না। এমন কি এই অত্যাচারী ও শোষক মনিবের দাসত্ব হইতে মুক্তি পাইবার জন্য অন্য কোথায়াও ভাগ্য পরীক্ষা করিয়া দেখতেও সে সক্ষম হয় না। কেননা এখানে সে জন্মগত মজুর, সমাজ তাহার স্বাভাবিক প্রভু। পরিশ্রমের মূল্য সে যা ইচ্ছা বাঁধিয়া দিতে পারে, কিংবা একেবারে না দিবার সিদ্ধান্ত করিলেও তাহার প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়-মজুর তাহার গোলামী হইতে কিছুতেই নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারে না।

সমাজবাদে যত গালভরা দাবিই করা হউক না কেন, ব্যক্তির রক্ত পানি করিয়া উপার্জন করা সম্পদকে তাহার নিকট হইতে তাহার মর্জির বিরুদ্ধে কাড়িয়া লওয়ার সমাজের কি অধিকার থাকিতে পারে, সমাজবাদের এই ধ্বজাধারিগণ তাহার কোন যুক্তিই আজও পর্যন্ত উপস্থাপিত করিতে পারে নাই। শ্রমিক-মজুর বা কৃষকের শ্রম-লব্ধ সম্পদ ভোগ করিবার অধিকার যদি পুঁজিদার বা জমিদারের না থাকে তবে সেই মজুরের হাড়াভাংগা পরিশ্রমের ফল হরণ করিবার অধিকার সমাজ কি করিয়া লাভ করিতে পারে?
সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কে এই দুইটি মত সাধারণভাবে বর্তমান দুনিয়ার প্রচলিত আছে। ব্যক্তি মালিকানা অধিকার যদি অবাঞ্চিত ও শোষণমূলক হয়, তবে সমাজের নিরুংকুশ মালিকানাও ঠিক তদ্রুপ অস্বাভাবিক, অত্যাচারমূলক এবং মানবতা-বিরোধী, তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকিতে পারে না। উল্লিখিত মতদ্বয়ের প্রথমটি শোষণ পীড়নের চরম ব্যবস্থা আর দ্বিতীয়টি বর্বরতা ও জুলুমেরশেষ সীমা। এক্ষণে স্বাভাবত:ই প্রশ্ন জাগিবে যে, ব্যক্তিগত মালিকানা যদি বাতিল ও ধ্বংসাত্মক হয় আর জাতীয় মালিকানার ধারণাও যদি অস্বাভাবিক জালিম ও মানবতা বিরোধী হয়, তাহা হইলে মানুষের উপায় কি? পৃথিবীর এই বিপুল ধন-সম্পদ ও মানুষের পরিশ্রম লব্ধ এই অপর্যাপ্ত ধন ঐশ্বর্যের মালিক কাকে স্বীকার করিতে হইবে, আর কাকে এ সবের মালিক বলিয়া সমর্থন করিলে এই দুনিয়া ও গোটা মানুষ সর্বপ্রকার জুলুম, শোষণ, নিষ্পেষণ ও বর্বরতার অবাঞ্চিত পরিণতি হইতে চিরতরে মুক্তি লাভ করিতে পারিবে?

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম