অধ্যায় ০৪ : সম্পর্ক দৃঢ়তর করার পন্থা

সম্পর্কের বিকৃতি ও অনিষ্টসাধনকারী এ জিনিসগুলো থেকে বারণ করার সঙ্গে সঙ্গে যেগুলো গ্রহণ ও অনুসরণ করার ফলে সম্পর্ক দৃঢ়তর ও স্থিতিশীল হয়, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় এবং যার ফলে দুটো হৃদয়ের মধ্যে এক হাতের দু’টি অংগুলির মতোই ঘনিষ্ঠতার সৃষ্টি হয়, আল্লাহ্ ও রাসূল (সঃ) সেগুলোও আমাদেরকে সুনির্দিষ্টরূপে বলে দিয়েছেন। এর ভেতর কতকগুলো জিনিসকে অত্যাবশকীয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অথবা বলা যায়, সেগুলোকে অধিকার (হক) হিসেবে পেশ করা হয়েছে। আবার কতকগুলো জিনিসের জন্যে করা হয়েছে নচিহত। এগুলো হচ্ছে শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের পর্যায়ভূক্ত। ইতিপূর্বে চরিত্রের যে বুনিয়াদী গুণরাজির কথা বিবৃত করা হয়েছে, প্রকৃতপে তাই হচ্ছে অধিকার ও মহত্বের প্রাণবস্তু স্বরূপ, তবে তার প্রতিটি জিনিসকেই আলাদাভাবে সামনে রাখা দরকার। কারণ, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ককে বিকশিত এবং ফুলে-ফলে সুশোভিত করার জন্যে এর প্রতিটি জিনিসই অতীব গুরুত্বপূর্ণ।


১.মান-ইজ্জতের নিরাপত্তা


একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সিজনিস হচ্ছে তার মান-ইজ্জত। নিজের মান-ইজ্জতকে বরবাদ করতে সে কিছুতেই সম্মত হয় না। তাই একদিকে যেমন মুসলমানকে তার ভাইয়ের ইজ্জতের ওপর হামলা করতে নিষেধ করা হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি আপন ভাইয়ের ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান করার জন্যেও বিশেষভাবে তাকিদ করা হয়েছে এবং একে একটি পরম কর্তব্য বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। যদি ভাইতে কোথাও গালাগাল করা হয়, তার ওপর মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে তাকে নিজের ইজ্জতের ওপর হামলা মনে করে তার মোকাবেলা করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। নিজের ইজ্জত বরবাদ হলে তার যতোখানি মনোকষ্ট হয়, এেেত্রও তার ততোটাই হওয়া উচিত। একজন মুসলমানের যদি একথা নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস হয় যে, তার মান-ইজ্জত তার মুসলমান ভাইয়ের হাতে নিরাপদ, তবে তার ভাইয়ের সঙ্গে অবশ্যই এক আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কিন্তু এ কথাও যদি তার নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস হয় যে, সে তার সামনে অথবা পেছনে নিজের ইজ্জতের মতোই তার ইজ্জতের সংরণ করে তবে তার দিলে কতোখানি প্রগাঢ় ভালোবাসার সৃষ্টি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এজন্যেই নবী কারীম (সঃ) বেশুমার হাদীসে এ বিষয়টির নির্দেশ দিয়েছেন । তিনি বলেছেন ঃ

ما من امرء مُّسلم يخذل امرأ مسلما فى موضع ينتهك فيه حرمته وينتقص فيه من عرضه الا خذله الله فى موطن يحب فيه نصرته وما من امرى ينصر مسلما فى موضع ينتقص فيه من عرضه وينتهك فيه من حرمته الا نصره الله فى موطن يحب نصرته –

‘যদি কোথাও কোন মুসলমানের অমর্যাদা বা ইজ্জতহানি করা হয় এবং সেখানে তার সাহায্য ও সহায়তা করতে কোন মুসলমান বিরত থাকে, তবে এমনিতরো নাজুক পরিস্থিতিতে আল্লাহও তার সাহায্যকে সংকুচিত করে দেন। অথচ তিনি চান যে, কেউ তার সাহায্য ও সহয়তার জন্যে এগিয়ে আসুক। আর কোথাও কোন মুসলমানের অবমাননা ও মর্যাদাহানি হলে কোন মুসলমান যদি তার সাহায্যের জন্যে দন্ডায়মান হয় তো আল্লাহ্ও এমনি অবস্থায় তার সাহায্য ও সহায়তা করে থাকেন। কেননা তিনি চান যে, কেউ তার সাহায্য করুক। (আবু দাউদ-জাবির রাঃ)

আল্লাহর সবচেয়ে বড় সাহায্য হচ্ছে এই যে, তিনি দোযখের আগুন থেকে রা করবেন। তাই রাসূল (সঃ) বলেছেন ঃ

ما من مسلم يردُّ عن عرض اخيه الا كان حقا على الله ان يَّردُّ عنه نار جهنَّم ثمَّ تلا هذه الاية وكان حقا علينا نصر المؤمنين –

“যে মুসলমান তার মুসলিম ভাইয়ের ইজ্জতহানি থেতে কাউকে বিরত রাখবে, আল্লাহর প্রতি তার অধিকার এই যে, তিনি জাহান্নামের আগুনকে তার থেকে বিরত রাখবেন। অতঃপর রাসূল (সঃ) এ আয়াত পড়লেন ঃ ‘মুসলমামদের সাহায্য করা আমাদের প্রতি এক কর্তব্য বিশেষ’।” (শরহুস সুন্নাহ-আবু দারদা)

মর্যাদাহানির একটি সাধারণ রূপ হচ্ছে গীবত। এর পরিচয় ইতিপূর্বেই বর্ণিত হয়েছে।

এ সম্পর্কে রাসূল (সঃ) বলেনঃ

من اغضب عنده اخوه المسلم وهو يقدر على نصره فنصره نصر الله فى الدنيا والاخرة فان لم ينصره وهو يقدر على نصره اخذه الله به فى الدنيا والاخرة –

“যে ব্যক্তির সামনে তার মুসলমান ভাইয়ের গীবত করা হবে, সে যদি তার সাহায্য করার মতো সামর্থবান হয় এবং তার সাহায্য করে, তবে দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ্ তার সাহায্য করবেন। আর যদি সাহায্য করার মতা থাকা সত্ত্বেও তার সাহায্য না করে, তো দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ্ তাকে পাকড়াও করবেন। (শরহুস সুন্নাহ্-আনাস রাঃ)

আপন ভাইকে অন্যের অনিষ্ট থেকে রা করা সম্পর্কে রাসূল (সঃ) বলেছেন ঃ

من حمى مؤمنا من منافقٍ ازاه قال بعث الله ملكا يحمى لحمه يوم القيامة من نَّار جهنَّم –

‘যে ব্যক্তি কোন মু’মিনকে মুনাফিক (এর অনিষ্ট) থেকে রা করবে, তার জন্যে আল্লাহ্ তায়ালা এমন একজন ফিরিশ্তা নিযুক্ত করবেন, যে তার গোশতকে কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপদ থাকবে।’ (আবু দাউদ)

একজন মুসলমানের প্রতি তার ভাইয়ের সাহায্যের ব্যাপারে বহু রকমের কর্তব্য আরোপিত হয়। যেমন-আর্থিক সাহায্য, অসুবিধা দূর করা, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা, এছাড়াও অসংখ্য প্রকারের দ্বীনি ও দুনিয়াবী প্রয়োজন পূর্ণ করা। এ জিনিসগুলো আইনের চৌহদ্দীর বাইরে ইহ্সানের সাথে সম্পৃক্ত। তবু এগুলো জরুরী জিনিস এবং আখিরাতে এ সম্পর্কে জবাবাদিহিও করতে হবে-যদিও এগুলো সম্পর্কে কোন আইন প্রণয়ন করা সম্ভবপর নয়। একজন মুসলমান যদি অপর মুসলমানের পেট ভরাতে পারে, তার নগ্ন দেহ ঢাকতে পারে, তার বিপদ-মছিবত দূর করার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে, তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে, তার আর্থিক অনটন দূর করতে পারে-তবে এগুলো করাই হচ্ছে তার প্রতি তার ভাইয়ের অধিকার। নচেৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা এর প্রতিটি জিনিসকেই নিজের হক বলে উল্লেখ করে এ মর্মে জবাব চাইবেন যে, এ হকটি তুমি কেন আদায় করো নি। নবী কারীম (সঃ) এ কথাটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ভাষায় বিবৃত করেছেন ঃ ‘আল্লাহ্ বলবেন, হে বান্দাহ্ আমি ুধার্ত ছিলাম, তুমি কেন আমাকে আহার করাও নি? আমি উলংগ ছিলাম, তুমি কেন আমাকে কাপড় দাও নি? আমি রুগ্ন ছিলাম, তুমি কেন আমাকে পরিচর্যা (ইয়াদত) করো নি? কিন্তু বান্দাহর কাছে এর কোনই জবাব থাকবে না। (মুসলিম- আবু হুরায়রা রাঃ)

বস্তুত আল্লাহ্র কোন বান্দাহ্ এবং কোন মুসলমান ভাইয়ের সাহায্য বা প্রয়োজন পূরণ এতো বড় পূণ্যের কাজ যে, অন্য কোন নেকীই এর সমক হতে পারে না। এর আসল ¯িপ্রট হচ্ছে এই যে, একজন মুসলমান ভাইকে আরাম দেয়া বা তার হৃদয়কে খুশী করার মতো যে কোন উপায়ই পাওয়া যাক না কেন, তাতে মোটেই বিলম্ব করা উচিত নয়।

একব্যক্তি যতোণ তার ভাইয়ের সাহায্যে লিপ্ত থাকে, ততোণ সে আল্লাহর সাহায্যের উপযোগী থাকে। রাসূলে কারীম (সঃ) বলেছেন ঃ

والله فى عون عبده ما كان العبد فى عون اَخِيْهِ –

‘আল্লাহ্ ততোণ তার বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতোন সেই বান্দাহ্ তার ভাইয়ের সাহায্যে লিপ্ত থাকে।’ (মুসলিম, তিরমিযি- আবু হুরায়রা রাঃ)

এ হাদীসে নবী কারীম (সঃ) সাহায্যের বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করে তার প্রত্যেকটি পুরস্কার সম্পর্কে বলেন ঃ

من نفس عن مؤمن كربة من من كرب الدنيا نفس الله عنه كربة من كرب يوم القيامة من يَّسَّر على معسر يسَّر الله عليه فى الدنيا والاخرة ومن يستر مسلما ستره الله فى الدنيا والاخرة –

‘যে ব্যক্তি কোন মু’মিনের কোন দুনিয়াবী অসুবিধা দূর করলো, আল্লাহ্ তার কিয়ামত দিবসের একটি অসুবিধা দূর করে তিবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবী লোককে সুবিধা দান করলো, আল্লাহ্ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সুবিধা দান করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ গোপন রাখলো, আল্লাহ্ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবের।’ (মুসলিম-আবু হুরায়রা)

এ প্রসঙ্গেই অন্য একটি হাদীসে তিনি বলেন ঃ

المسلم اخو المسلم لا يظلمه ولا يسلمه ومن كان فى حاجة اخيه كان الله فى حاجته ومن فرج عن مسلم كربة فرج الله عنه كربة من كربات يوم القيامة –

‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। না সে তার ওপর জুলুম করবে, আর না আপন সাহায্য থেকে হাত গুটিয়ে তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবে। যে ব্যক্তি আপন ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করলো, আল্লাহ্ তার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দুঃখ-মুছিবত দূর করে দিবে, আল্লাহা তার কিয়ামত-দিবসের অসুবিধা দূর করে দিবেন।’ (বুখারী ও মুসলিম-ইবনে ওমর রাঃ)

সাহায্য ও সদাচরণের একটি বিরাট অংশ ধন-মালের ওপর আরোপিত হয়। আল্লাহ্ যাকে এ নিয়ামত দান করেছেন, প্রত্যেক বঞ্চিত ব্যক্তিই তার কাছ থেকে সাহায্য পাবার অধিকারী ঃ

وفى اموالهم حق للسَّائل والمحروم –

রাসূল (সঃ) এ জিনিসিটিকে অত্যন্ত উচ্চাংগের বর্ণনাভংগীর মাধ্যমে পেশ করেছেন ঃ

الخلق عيال الله فاحبُّ الخلق الى الله من احسن الى عياله –

‘মাখলুক হচ্ছে আল্লাহর পরিবার বিশেষ, সুতরাং যে ব্যক্তি তাঁর এ ব্যক্তি পরিবারের সংগে সদাচরণ করলো, আল্লাহর কাছে তাঁর মাখলুকের মধ্যে সেই হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয়।’ (বায়হাকী)

ক্ষুধার্তকে আহার করানোর ব্যাপারে কুরআন খুব তাকিদ করেছে। প্রাথমিক মক্কী সূরাগুলোতে এর বহু নজীর রয়েছে। রাসূলে কারীম (সঃ) মদীনায় এসে তাঁর প্রথম খুতবায় মুসলমানদেরকে চারটি বিষয়ের নির্দেশ দান করেন এবং বলেন যে, এরপর তোমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারো। তার ভেতর একটি নির্দেশ ছিলো এই ঃ واطعموا الطعام ‘এবং আহার করাও’

তিনি আরো বলেন ঃ

ليس المؤمن بالذى يشبع وجاره جائع الى جنيه –

‘যে ব্যক্তি নিজে পেট ভরে খেলো এবং তার নিকটস্থ প্রতিবেশী অনাহারে রইলো, সে মু’মিন নয়।’ (বায়হাকী- ইবনে আব্বাস রাঃ)

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম