ইয়াসরিবে ইসলাম
ইসলাম প্রচারের দশম বছর। হাজ উপলক্ষে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের লোক এসেছে মক্কায়। ইয়াসরিব থেকেও এসেছে একদল লোক। মুহাম্মাদ (সা) মিনার আকাবা নামক স্থানে ইয়াসরিবাসীদের সাথে মিলিত হন। তাদের নিকট তিনি ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। ছয়জন ইয়াসরিববাসী সেখানে ছিলেন। তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করে ইয়াসরিবে ফেরেন। ইসলাম প্রচারের একাদশ বছর। ইয়াসরিব থেক হাজে এলো বারোজন লোক। তারা আকাবায় রাসূলের (সা) সংগে মিলিত হন। ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা রাসূলের (সা) হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করেন।
১। আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করবো না।
২। চুরি করবো না।
৩। যিন করবো না।
৪। সন্তান হত্যা করবো না।
৫। মিথ্যা অপবাদ দেবো না ও গীবত করবো না।
৬।রাসূললুল্লাহ (রা) যেই সব নির্দেশ দেবেন, সেইগুলো অমান্য করবো না।
এই শপথ গ্রহণ করাকেই বলা হয় প্রথম বাইয়াতে আকাবা।
এই নওমুসলিমদেরকে ইসলামের প্রশিক্ষণ দানের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) মুসয়াব ইবনু উমাইরকে (রা) ইয়াসরিবে পাঠান।
ইসলমা প্রচারের দ্বাদশ বছর। ইয়াসরিব থেকে হাজে এলো ৭৫ জন লোক। পূর্ববর্তীদের মতোই রাসূলের (সা) হাতে হাত রেখে ৬টি বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। একে বলা দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবা। ইয়াসরিবে ব্যাপকভাবে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটাবার জন্যে আল্লাহর রাসূল বারোজন ব্যক্তিকে নাকীব নিযুক্ত করেন। তাঁরা হচ্ছেন, উসাইদ ইবনু হুদাইর (রা), আবুল হাইছাম ইবনু তাইয়িহান(রা), সাদ ইবনু খাইছামা(রা), আসওয়াদ ইবনু যুরারাহ (রা), সাদ ইবনু যুরারাহ(রা), আবদুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা(রা), আবদুল্লাহ ইবনু আমরা(রা), উবাদাহ ইবনুস সামিত(রা), রাফে ইবনু মালিক(রা)।
ইয়াসরিবের আমন্ত্রণ
দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবায় অংশগ্রহণকারী মুসলিমগণ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (সা) ইয়াসরিবে স্থানান্তরিত হবার আমন্ত্রণ জানান। এই সময় সাদ ইবনু যুবরাহ (রা), দাঁড়িয়ে বলেন, ভাইসব, তোমরা কি জান কি কথার উপর তোমরা আজ শপথ নিয়োছো? জেনে নাও, এ হচ্ছে সমগ্র আরব ও অনারবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। ইয়াসরিবাসী সকল মুসলিম ঘোষণা করলেন, আমরা সব কিছু বুঝে শুনেই শপথ নিয়েছি।
অতপর স্থির হলো, মুহাম্মাদ (সা) ইয়াসরিবে হিজরাত করলে সেখানকার মুসলিমরা সর্বশক্তি নিয়োজিত করে তার সহযোগিতা করবেন।
মিরাজ বা ঊর্ধে গমন
ইসলাম প্রচারের দ্বাদশ বছর। ২৬শে রজবের দিবাগত রাতে মিরাজ সঘটিত হয়। জিবরাইল (আ) বুরাকে চড়িয়ে মুহাম্মাদে (সা) মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসায় নিয়ে যান।
রাসূল্লাহ (সা) দুরাকাআত ছালাত আদায় করেন। এরপর শুরু হলো আকাশ ভ্রমণ। বিভিন্ন আকাশে অতীতের নবীদের সঙ্গে মুহাম্মাদুর রাসুলল্লাহ (সা) সাক্ষাৎ ঘটে। আল্লাহর রাসূল (রা) জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করেন। এই ভ্রমণকালেই উম্মাহর জন্য প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াকত ও পরে পাঁচ ওয়াকত ছালাত ফরয করা হয়।
মিরাজের সত্যতা ঘোষণা করে নাযিল হয় সূরা বনী ইসরাইল। এই সূরাতে ইসলামী সমাজ গঠনের জন্যে নীতিমালা পরিবেশিত হয়।
সে নীতিমালা হচ্ছে:
o আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করবে না।
o আব্বা-আম্মার প্রতি সদাচরণ করবে।
o আত্মীয়-স্বজন, মিসকিন ও মুসাফিরের হক আদায় করবে।
o অপচয় ও অপব্যয় করবে না।
o মিতব্যয়ী হবে।
o অভাবের ভয়ে সন্তান হত্যা করবে না।
o যিনার নিকটবর্তী হবে না।
o কাউকে হত্যা করবে না।
o ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না।
o ওয়াদা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।
o মাপ ও ওজনে ফাঁকি দেবে না।
o যেই বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই (গুজব) তার পেছনে ছুটবে না।
o গর্বভরে চলাফেরা করবে না।
রাসূলকে (সা) হত্যার ষড়যন্ত্র
ইসলাম প্রচারের ত্রয়োদশ বছর।
মুশরিকদের অত্যচার চরমে উঠে। মুসলিমরা গোপনে একে একে ইয়াসরিবে হিজরাত করেন। কয়েকজন অক্ষম মুসলিম মক্কায় রয়ে গেলেন। রাসূলের (সা) সাথে থেকে গেলেন আবু বকর (রা) ও আলী (রা)।
মুসলিমরা ইয়াসরিবে গিয়ে নিরাপদ হচ্ছে। শক্তিশালী হচ্ছে। এই অবস্থা দেখে মুশরিকরা মুহাম্মাদকে (সা) হত্যা করার উদ্যোগ নেয়। দারুণ নাদওয়া ছিলো কুরাইশদের মিলনায়তন। মুশরিকরা যেখানে মিলিত হয়।
অনেক সলা-পরামর্শের পর সিদ্ধান্ত হয় যে মুহাম্মাদকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। গোত্রীয় বিবাদ এড়ানোর জন্যে স্থির হয় যে প্রত্যেক গ্রোত্র থেকে এক একজন যুবক অংশ নেবে ও মিলিতভাবে মুহাম্মাদের (সা) উপর হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করবে। এই কাজের জন্য একটি রাতও নির্দিষ্ট করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে সেই রাতে সকলে গিয়ে মুহাম্মাদের (সা) বাসগৃহ ঘেরাও করবে এবং ভোরবেলা তিনি যখন ঘর থেকে বেরোবেন তখন তারা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই অবস্থাতেই রাসূলুল্লাহ (সা) ইয়াসরিবে হিজরাত করার নির্দেশ পান।
ইয়াসরিবের পথে
ইসলাম প্রচারের ত্রয়োদশ বছর।
নির্দিষ্ট রাতে ১২ জন যুবক রাসূলের (সা) বাসগৃহ ঘেরাও করে। আল্লাহর রাসূল (সা)
ফাআগশাইনাহুম ফাহুম লা ইউবসিরুন...
আয়াতটি বার বার পড়ছিলেন। আল্লাহর কুদরাতে দুশমনদের তন্দ্রাভাবে এসে যায়। আল্লাহর নবী (সা) তাদের সম্মুখে দিয়ে ধীর পদে বেরিয়ে মক্কার নিকটবর্তী সাওর পাহাড়ের এক গুহায় আশ্রয় নেন। ভোরবেলা মুশরিকগণ টের পেলো মুহাম্মাদ (সা) ঘরে নেই। সকলে চিন্তায় পড়ে গেলো। মক্কার চারদিকে লোক পাঠানো হলো।
সাওর পাহাড়ের গুহার নিকটেও সন্ধানীরা এসে পড়ে। রাসূলের (সা) নিরাপত্তার কথা ভেবে আবু বকর (রা) অস্থির হয়ে পড়েন। আল্লাহর রাসূল (সা) বলে উঠেন
ঘাবড়াবেনা, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। সূরা আত তাওবা: ৪০
গুহার মুখে কবুতরের বাসা ও মাকড়সার জাল দেখে মুশরিকরা গুহার দিকে অগ্রসর হয়নি। আল্লাহর রাসূল (সা) তিন দিন এই গুহাতে অবস্থান করেন। চতুর্থ দিনে তিনি ইয়াসরিবের দিকে রওয়ানা হন। তবে তিনি সচারচর ব্যবহৃত পথ না ধরে ভিন্নপথে অগ্রসর হন।
কুবায় মুহাম্মাদ (সা)
ইয়াসরিব থেকে তিন মাইল দূরে কুবা পল্লী। ইয়াসরিববাসীদের কিছু পরিবার এখানে বসবাস করতো। আল্লাহর রাসূল (সা) কুবায় এসে পৌঁছেন। তিনি কুলসুম ইবনুর হিদমের মেহমান হন। এখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এটাই প্রসিদ্ধ কুবা মসজিদ।
ইয়াসরিবে মুহাম্মাদ (সা)
দুই সপ্তাহ কুবাতে থাকার পর আল্লাহর রাসূল (সা) ইয়াসরিবের দিকে অগ্রসর হন। ইয়াসরিবের ঘরে ঘরে আনন্দ। ছোট-বড়ো সবাই জড়ো হয়েছে পথে। উটে চড়ে মুহাম্মাদ (সা) এলেন ইয়াসরিবে- মেয়রা ঘরের ছাদে উঠে গেয়ে চললো।
পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে আমাদের উপর
বিদা পাহাড়ের চূড়া থেকে
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের জন্য ওয়াজিব
আহবানকারীর আল্লাহর প্রতি আহবানের বিনিময়ে
তাঁকে মেহমান হিসেবে পেতে চাইলেন সবাই। তিনি কার আবদার রক্ষা করবেন, এ ছিলো এক সমস্যা। তিনি জানালেন, তাঁর উট যেই ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সেই ঘর তিনি উঠবেন। অবশেষে উট গিয়ে দাঁড়ালো এক ঘরের সামনে। সৌভাগ্য অর্জন করলেন ঘরের মালিক। সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তির নাম আবু আইয়ুব খালিদ আল আনসারী (রা)।
নবীকে (সা) পেয়ে ইয়াসরিববাসীরা আনন্দে আত্মহারা। তিনি হলেন তাঁদের সবচেয়ে বেশী প্রিয়জন। তাঁরা তাঁদের শহরের নাম পরিবর্তন করলেন। ইয়াসরিবের নাম হলো মাদীনা।
মাদীনা মসজিদ
আল্লাহর রাসূল (সা) একটি মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। এই উদ্দেশ্যে একখন্ড জমি কেনা হয়। কাঁচা ইটের দেয়াল তৈরী হলো। খেজুর গাছের খুঁটির উপর তৈরী হলো খেজুর পাতার ছাদ। প্রথমে মেঝে ছিলো কাঁচা। কিছুকাল পর পাথর বিছিয়ে মেঝে পাকা করে নেয়া হয়। এই মসজিদ নির্মাণ কাজে অন্যান্য মুসলিমদের সাথে রাসূল (সা) অংশ নেন। তিনিও ইট পাথর বহন করেন।
এই মসজিদটি মসজিদে নববী নামে প্রসিদ্ধ।
রাসূলের (সা) বাসগৃহ
মুহাম্মাদ (সা) আবু আইউব খালিদ আল আনসারীর (রা) বাড়ীতে ছিলেন সাত মাস। অতপর মসজিদে নববীর পাশে তাঁর জন্য একটি কক্ষ তৈরী হলে তিনি তাতে বসবাস করতে থাকেন। মসজিদের গাঁ ঘেঁষে আল্লাহর রাসূলের (সা) স্ত্রীদের বাসগৃহ তৈরী হয়। এই ঘরগুলো ছয়-সাত চওড়া ও দশ হাত লম্বা ছিলো। ছাদ ছিলো খুবই নীচু। দরজায় কম্বলের পর্দা ঝুলানো থাকতো।
অধ্যায় ০৮ : মদীনায় হিজরত ও রাসুল সা: কে হত্যার ষড়যন্ত্র
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: