অধ্যায় ১৩ : শায়খ আহমদ সরহিন্দি(র)

হিজরী সপ্তম শতকে তাতারী ফিতনা হিন্দুকুশ পর্বতের ওদিকের সমগ্র ভুখণ্ডকে নেস্তনাবুদ করে দেয়, কিন্তু হিন্দুস্তান তার অশুভ ছোবল থেকে রেহাই পায়। ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কারণে এখানকার সুধী ও নেতৃসমাজের মনে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়। দুনিয়ার বাহ্যিক চাকচিক্যে মুগ্ধ ব্যক্তিরা হামেশাই এই ভ্রান্ত ধারণার সম্মুখীন হয়েছে।খোরাসান ও ইরাকের যাবতীয় দুষ্কৃতি এখানে লালিত হতে থাকে। এখানেও চলে বাদশাহের খোদায়ী কর্তৃত্ব। আমির-ওমরাহ ও বিত্তশালীদের বিলাসিতা অন্যায়ভাবে অর্থোপার্জন ও অন্যায় পথে ব্যয় এবং জুলুম নির্যাতনের রাজত্ব অবাধে চলতে থাকে। খোদা সম্পর্কে গাফলতি ও দ্বীনের সহজ-সরল পথ থেকে দূরে অবস্থান করার নীতি এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। ধীরে ধীরে বাদশাহ আকবরের শাসনামলে পৌঁছে গোমরাহী তার শেষ সীমান্তে উপনীত হয়।

আকবরের দরবারে এ ধারণা অত্যান্ত প্রবল ও ব্যাপক ছিল যে, ইসলাম মূর্খ ও অশিক্ষিত বুদ্ধুদের মধ্যে জন্মলাভ করেছিল। তা কোনো সুসভ্য ও সংস্কৃতিবান জাতির উপযোগী নয়। নবুয়্যাত,ওহি, হাশর-নশন, বেহেশত ও দোজখ প্রভৃতি ইসলামের মূল আকিদা-বিশ্বাসসমূহ বিদ্রূপের বস্তুতে পরিণত হয় । কোরআনের খোদার কালাম হবার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা হয়। ওহির অবতরণ বুদ্ধিবিরোধী গণ্য হয়। মৃত্যুর পর শাস্তি ও পুরস্কার অনিশ্চিত বলে বিবেচিত হয় । তবে জন্মান্তরবাদ সকল দিক দিয়েই সম্ভবপর ও সত্য বলে গৃহীত হয়।নবীর মিরাজকে প্রকাশ্যে অসম্ভব গণ্য করা হয়। নবী করীমের (স) ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করা হয়। বিশেষ করে তাঁর সহধর্মিনীদের সংখ্যা ও তাঁর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত জেহাদসমূহের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আপত্তি করা হয়। এমন কি আহমদ ও মুহাম্মদ শব্দও বিরক্তিকর ঠেকে এবং যাদের নামের সাথে ঐ শব্দদ্বয় যুক্ত ছিল, তাদের নাম পরিবর্তন করা হয়। স্বার্থবাদী আলেমগণ নিজেদের বইপত্রের ভূমিকায় নাত লেখা বন্ধ করে। অনেক জালেম গোস্তাখীর চরম সীমানায় উপনীত হয়ে দাজ্জালের চিহ্ন সমূহ মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের মধ্যে আবিষ্কার করে ---------শাহী দেওয়ানখানায় নামাজ পড়ার মতো বুকের পাটা কারুর ছিল না। আবুল ফজল নামায রোজা, হজ্জ ও অন্যান্য ইসলামী ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কঠোর আপত্তি উত্থাপন করে এবং এগুলোকে উপহাস করে। কবিকুল এসব ঐতিহ্যের নিন্দাবাদে কাব্য রচনা করে। এসব কাব্য-কবিতা সাধারণ মানুষের নিকটও পৌঁছায়।

বাহাই মতবাদের ভিত্তি আসলে আকবরের জামানায় স্থাপিত হয় ।এ সময়েই এ মত পেশ করা হয় যে, মুহাম্মদ(স) এর পর এক হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং এ দ্বীনের মেয়াদও ছিল এক হাজার বছর। তাই বর্তমানে এ দ্বীন বাতিল হয়ে গেছে এবং এর স্থলে এখন নতুন দ্বীনের প্রয়োজন । মুদ্রার মাধ্যমে এ মতবাদের প্রচার শুরু হয়।কেননা সেযুগে এইটিই ছিল প্রচারণার সবচাইতে শক্তিশালী মাধ্যম । অতঃপর একটি নয়া দ্বীন ও একটি নয়া শরিয়তের ভিত্তি স্থাপন করা ।এর মূল উদ্দেশ্য ছিল,হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মকে মিলিয়ে একটি মিশ্রিত নতুন ধর্ম তৈরী করা যাতে করে সরকারের শাসন শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। দরবারের তোষামোদকারী হিন্দুরা নিজেদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে ভবিষ্যদ্বাণী শুনাতে থাকে যে, অমুক যুগে একজন গোরক্ষক মহাত্মা বাদশাহ জন্মলাভ করবেন।অনুরূপভাবে অর্থপূজারী আলেমগণও আকবরকে মেহদী, যুগস্রষ্টা,মুজতাহিদ, ইমাম প্রভৃতি প্রমাণ করার চেষ্টা করে। জনৈক তাজুল আরেফিন সাহেব এতদূর অগ্রসর হন যে, তিনি আকবরকে আদর্শ মানব ও যুগনেতা হবার কারণে তাঁকে খোদার প্রতিবিম্ব বলে প্রচার করেন। সাধারণ মাণুষকে বুঝবার জন্যে বলা হয় যে, সত্য ও সততা (বিশ্বজনীন সত্য) দুনিয়ার সকল ধর্মের মধ্যেই আছে। কোনো একটি মাত্র ধর্ম সত্যের ইজারাদার নয়। কাজেই সকল ধর্মে যে সব সত্য আছে সেগুলির সমন্বয়ে একটি পূর্ণাংগ পদ্ধতি প্রণয়ন করা উচিত। জনগণকে ব্যাপকভাবে সেদিকে আহবান করতে হবে, যাতে করে সকল র্ধমের বিরোধের অবসান ঘটে। এই পূর্ণাংগ পদ্ধতির নাম দ্বীনে ইলাহী । লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ আকবর খলিফাতুল্লাহ এই নতুন ধর্মের কলেমা নির্ধারিত হয়। যারা নতুন ধর্মে প্রবেশ করতো, তাদেরকে তাদের পিতা-প্রপিতাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত দ্বীন ইসলাম থেকে তওবা করে দ্বীনে ইলাহী আকবর শাহী এর মধ্যে প্রবেশ করতে হতো। আর দ্বীনে ইলাহীতে প্রবেশ করার পর তাদেরকে ‘চেলা’ আখ্যা দেয়া হতো। সালামের পদ্ধতি পরিবর্তন করে নিয়ম করা হয় যে, সালামকারী ‘আল্লাহু আকবর’ ও জবাবদাতা ‘জাল্লে জালালুহু’ বলবে ।মনে রাখবেন বাদশাহর নাম জালালুদ্দিন ও তাঁর উপাধি ছিল আকবর। চেলাদেরকে বাদশাহর চিত্র দেয়া হতো তারা সেটি পাগড়ির গায়ে লাগিয়ে রাখতো। রাজপূজা এ ধর্মের একটি অংশ ছিল। প্রত্যেক দিন সকালে বাদশাহর দর্শনলাভ করা হতো। বাদশাহকে দর্শন করার সৌভাগ্য লাভ করার পর তাঁকে সিদজা করা হতো। আলেম ও সুফিগণ তাঁদের কামনা -বাসনা পূরণের এই কেবলা ও কাবাকে বেধড়ক সিজদা করতো এবং এই সুস্পষ্ট শের্ককে ‘সম্মানের সিজদা’ ও ‘মৃত্তিকা চুম্বন’ এর ন্যায় শব্দের আবরণে ঢেকে রাখতো। নবী (স) এই অভিশপ্ত বাহানাবাজী সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এমন এক যুগ আসবে যখন লোকেরা হারাম জিনিসের নাম পরিবর্তন করে তাকে হালাল বলে গণ্য করবে।

এই নতুন ধর্মের ভিত্তি স্থাপন করার সময় বলা হয়েছিল যে, পক্ষপাতহীনভাবে সকল ধর্মের ভালো কথাগুলো এতে গ্রহণ করা হবে;কিন্তু আসলে ইসলাম ছাড়া প্রত্যেক ধর্মের এতে স্থান হয় । এবং একমাত্র ইসলাম ও ইসলামী আইন কানুনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হয়। অগ্নি উপাসকদের নিকট থেকে অগ্নি-পুজাকে গ্রহণ করা হয়। আকবরী মহলে চিরস্থায়ী আগুন জ্বালানো হয় এবং বাতি জ্বালাবার সময় সম্মানের সংগে দাঁড়াবার রীতি প্রচলন করা হয়। ঈসায়ীদের নিকট থেকে ঘন্টা বাজানো তিন প্রভুর প্রতিকৃতির পূজা এবং এই ধরণের কতিপয় জিনিস গ্রহণ করা হয় । সবচাইতে বেশী মেহেরবানী করা হয় হিন্দুধর্মের ওপর । কেননা এটি ছিল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম এবং রাজশাসনের ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্যে একে তোয়াজ করার প্রয়োজন ছিল। কাজেই গরুর গোশত হারাম ঘোষণা করা হয়। হিন্দুদের উৎসবসমূহ যেমনঃ দেওয়ালী, দশোহারা, রাখী, পূণম, শিররাত্রি প্রভৃতিকে পূর্ণ হিন্দুরীতি অনুযায়ী পালন করার ব্যবস্থা করা হয়। রাজমহলে প্রতিদিন হাওয়ান অনুষ্ঠিত হতে থাকে। প্রতিদিন চার বার সূর্যোপসনা করা হতো। সূর্যোর একহাজার নাম জপ করা হতো। সূর্যের নাম উচ্চারিত হলে সঙ্গে সঙ্গে বলা হতো তার শক্তি মহান। কপালে তিলক লাগানো হতো। কোমর ও কাঁধে পৈতা বাধা হতো। গরুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় । জন্মান্তরবাদকে স্বীকার করে নেয়া হয় এবং ব্রাহ্মণদের নিকট থেকে তাদের অন্যান্য বহু আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করা হয়। ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মের সাথে এ ব্যবহার করা হয়। আর ইসলামের ব্যাপারে বাদশাহ ও তাঁর দরবারীদের প্রতিটি কার্যই প্রমান করছিল যে, ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের মন বিদ্বেষ পরিপূর্ণ । অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পক্ষ থেকে দরবারের মেজাজ অনুযায়ী দার্শনিক ও সুফিদের ভাষায় ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে যে কথা পেশ করা হতো তাকে আসমানি ওহি মনে করা হতো এবং তার মোকাবিলায় ইসলামী শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করা হতো। মুসলমান আলেমগণ যদি ইসলামের পক্ষ থেকে কোন কথা বলতেন অথবা কোন গোমরাহির বিরোধিতা করতেন তাদেরকে ফকিহ আখ্যা দান করা হতো।তাদের বিশেষ পরিভাষায় এর অর্থ ছিল বির্বোধ ব্যক্তি এবং যে ব্যক্তির কথায় কর্ণপাত করার প্রায়োজন হয় না।ধর্মসমূহ সম্পর্কে অনুসন্ধান করার জন্যে চল্লিশ ব্যক্তির একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি অত্যন্ত উদারতা ও ভক্তির সংগে বিভিন্ন ধর্মসমূহ অধ্যায়ন করে কিন্তু ইসলামের নাম উঠতেই তার প্রতি বিদ্রুপবান নিক্ষেপ করা হতো; আর কোন ইসলাম সমর্থক এর জবাব দিতে চাইলে তার মুখ বন্ধ করে দেয়া হতো। ইসলামের সঙ্গে শুধু এ আচরন করেই ক্ষান্ত থাকা হয়নি বরং কার্যতঃ প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে ইসলামী নির্দেশাবলী পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয় । সূদ, জুয়া ও শরাবকে হালাল করা হয়। নওরোজ উৎসবে রাজসভায় শরাব ব্যবহার অপরিহার্য ছিল। এমন কি কাজী ও মুফতি পর্যন্ত শরাব পান করে ফেলতো। দাঁড়ি চেঁছে ফেলার ফ্যাশান প্রবর্তন করা হয় এবং বৈধতার স্বপক্ষে প্রমাণ পেশ করা হয়। চাচাত ও মামাত বোনদের সঙ্গে বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পুরুষদের জন্যে ১৬বছর ও মেয়েদের জন্যে ১৪বছর বিয়ের বয়স নির্ধারিত হয়। একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। রেশম ও স্বর্ণের ব্যবহার বৈধ গণ্য করা হয়। সিংহ ও বাঘের গোশত হালাল ঘোষণা করা হয় এবং ইসলামের প্রতি জিদের বশর্তী হয়ে শূকরকে শুধু পাকই নয় বরং একটি অতি পবিত্র প্রাণী বলে ঘোষণা করা হয় । এমন কি সকালে বিছানা ছেড়ে সর্বপ্রথম শূকর দর্শনকে বড়ই মোবারক মনে করা হতো। মৃত দেহকে কবরস্থ করার পরিবর্তে পুড়িয়ে ফেলা বা পানিতে ভাসিয়ে দেওয়াকে ভালো গণ্য করা হয়। আর যদি কেউ একান্তই কবরস্থ করতে চাইতো তাহলে পদদ্বয় কেবলার দিকে স্থাপন করার জন্যে তাকে পরিমর্শ দেয়া হতো ।আকবর নিজেও ইসলামের প্রতি জিদের বশবর্তী হয়ে পদদ্বয় কেবলার দিকে রেখে শয়ন করতেন। সরকারের শিক্ষানীতিও পূর্ণ ইসলাম বিরোধী ছিলো। আরবী ভাষা শিক্ষা এবং ফিকাহ ও হাদীস অধ্যায়নকে অপছন্দ করা হতো। যারা এসব বিদ্যা অর্জন করতো তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা হতো। দ্বীনি এলমের পরিবর্তে দর্শন, তর্কশাস্ত্র, অংক, ইতিহাস ও এই ধরণের অন্যান্য বিদ্যাসমূহ সরকারী সাহায্য লাভ করে। ভাষার মধ্যে হিন্দী রীতি সৃষ্টি করার দিকে বিশেষ আগ্রহ ছিল। আরবী শব্দবলীকে ভাষার চৌহদ্দি থেকে বহিষ্কৃত করারও প্রস্তাব ছিলো। এ অবস্থায় দ্বীনি মাদ্রাসাগুলো ছাত্র শূন্য হয়ে যেতে থাকে এবং অধিকাংশ আলেম দেশত্যাগ করতে শুরু করে।

এ ছিল সরকারের অবস্থা। অন্যদিকে জনগণের অবস্থাও এর চাইতে মোটেই উন্নত ছিল না।বিদেশগতরা ইরান ও খোরাসানের নৈতিক ও আকিদাগত ব্যাধি সঙ্গে করে এনেছিল। আর যারা ভারতে মুসলামান হয়ে ছিল তাদের ইসলামী শিক্ষা ও অনুশীলনের কোন বিশেষ ব্যবস্থা ছিল না। তাই তারা পুরাতন জাহেলিয়াতের বহু রীতি-পদ্ধতি তাদের চিন্তা ও বাস্তব জীবনে ধারণ করেছিল। এই দুই ধরনের মুসলমানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এক অদ্ভুত মিশ্রণ তৈরী হয়েছিল। তার নাম দেয়া হয়েছিল ইসলামী তমুদ্দুন।তাতে শের্কের সংমিশ্রণ ছিল, বংশ ও শ্রেণীভেদ ছিল, কাল্পনিক ও পৌঁরাণিক চিন্তা ধারণা ছিল এবং নব আবিষ্কৃত রসম-রেওয়ায়েজ সম্বলিত একটি নতুন শরিয়তও ছিল। দুনিয়াপূজারী ওলামা ও মাশায়েখগণ শুধু এই অদ্ভুত মিশ্রণটির সাথে সহযোগিতা করেই ক্ষান্ত থাকেনি বরং তারা এই নতুন ‘মত’ এর পৌরহিত্যও গ্রহণ করেছিল। জনসাধারণ তাদেরকে নজরানা পেশ করতো আর তারা জনগণকে মযহাবী বিরোধের তোহফা দান করতো।

পীরসাহেবানদের মাধ্যমে আর একটি রোগও বিস্তার লাভ করেছিল। নয়াপ্লেটোবাদ,বৈরাগ্যবাদ (Stoicism),মনুবাদ ও বেদান্তবাদের সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত ধরণের দর্শন ভিত্তিক তাসাউফ জন্মলাভ করে। ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস ও নৈতিক ব্যবস্থায় তাকে স্থান দেয়া হয়। তরিকত ও হকিকতকে ইসলামী শরীয়ত থেকে পৃথক এবং তার থেকে মুখাপেক্ষীহীন গণ্য করা হয়। বাতেনের এলাকা জাহের থেকে পৃথক করে নেয়া হয়। এ এলাকার আইনে হালাল ও হারামের সীমানা বিলুপ্ত ইসলামী বিধিনিষেধসমূহ কার্যতঃ বাতিল এবং সমস্ত ক্ষমতা ইন্দ্রিয় লিপ্সার হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। ইচ্ছা মতো কোনো হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করা ছিল এ আইনের বৈশিষ্ট। এই সাধারণ পীরদের থেকে যার অবস্থা ভালো ছিল সেও কম বেশী ঐ দর্শন ভিত্তিক তাসাউফ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বিশেষ করে সর্বেশ্বরবাদের ভ্রান্ত ধারণা সমস্ত কর্মক্ষমতা হরণ করে নেয়।

এহেন পরিস্থিতিতে আকবরের শাসনামলের প্রথম দিকে শায়খ আহমদ সরহিন্দি জন্মগ্রহন করেন১৬। সেকালের সর্বাধিক উন্নত চরিত্রের লোকদের নিকট তিনি শিক্ষালাভ করেন । তাঁরা নিজেদের চতুষ্পার্শের বিকৃতির মোকাবিলা করার ক্ষমতা না রাখলেও কমপক্ষে নিজেদের ঈমান ও আমলকে সংরক্ষিত রেখেছিলেন এবং যথাসাধ্য অন্যের সংশোধনও করতেন।বিশেষ করে হযরত শায়খ আহমদ সবচাইতে বেশী লাভবান হন হযরত বাকিবিল্লাহর সাহচর্যে । হযরত বাকিবিল্লাহ সে যুগের অন্যতম উন্নত চরিত্র সম্পন্ন বুজর্গ ছিলেন। কিন্তু হযরত শায়খের নিজের যোগ্যতাও ছিল অপরিসীম। হযরত বাকিবিল্লাহর সাথে তাঁর প্রথম সংযোগ স্থাপিত হয় তখনই হযরত বাকিবিল্লাহ তাঁর সম্পর্কে নিজের এক বন্ধুকে নিম্মলিখিত পত্র লেখেনঃ

“সম্প্রতি সরহিন্দ থেকে শায়খ আহমদ নামে এক ব্যক্তি এসেছে। বিপুল দ্বীনি জ্ঞানের অধিকারী।কর্মক্ষমতাও ব্যাপক। ফকিরের সাথে কয়েকদিন তার আলোচনা হয়েছে। এ সময়ে তার যে অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছি তার পরিপ্রক্ষিতে আশা করা যায় যে, পরবর্তীকালে এ ব্যক্তি একটি আলোকবর্তিকার আকারে সমগ্র দুনিয়াকে উজ্জল করবে”।

এ ভবিষ্যদ্বাণী পরাবর্তীকালে সত্য প্রমাণিত হয়। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় তৎকালে বহুসত্যনুসারী ওলামা ও সুফি বর্তমান ছিলেন । কিন্তু তাদের মধ্যে তিনি একাই সমকালীন ফিতনাসমূহের মোকাবিলা ও ইসলামী শরিয়তের সাহায্য করার জন্যে অগ্রসর হন। রাজশক্তির মোকাবিলায় তিনি একাই ইসলামী পুনরুজ্জীবনের সংগ্রাম পরিচালনা করেন। এই নিঃসহায় ও নিঃসম্বল ফকিরটি একাকী প্রকাশ্যে ও খোলাখুলিভাবে সরকারী সাহায্য পুষ্টগোমরাহীর মোকাবিলা করেন। এবং সরকারী রোষানলে পতিত শরিয়তের পক্ষ সমর্থন করেন। সরকার তাকে দমন করার জন্যে যাবতীয় অস্ত্র প্রয়োগ করে, এমনকি তাঁকে কারাগারেও প্রেরণ করে। কিন্তু অবশেষে তিনি ফিতনার গিত পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। ‘সম্মানের সিজদা’ না করার কারণে জাহাংগীর তাঁকে গোয়ালিয়র দুর্গে প্রেরণ করেন। কিন্তু অবশেষে জাহাংগীর নিজেই তাঁর ভক্ত হয়ে পড়েন এবং নিজ পুত্র খুররমকে -যিনি পরবর্তীকালে শাহাজাহান উপাধি লাভ করে তখতনশীন হন -তার ছাত্রের দলে ভর্তি করে দেন। ফলে ইসলামের ব্যাপারে সরকারের বিরোধ ও বিদ্বেষ সম্মানেররূপ লাভ করে। দ্বীনে ইলাহি আকবরশাহী তার দরবারী শরিয়ত প্রণেতাদের সৃষ্ট যাবতীয় বেদআতসহ বিদায় গ্রহণ করে। ইসলামী বিধানাবলীর মধ্যে যে সমস্ত পরিবর্তন -পরিবর্ধন করা হয় তা স্বভাবতই বাতিল হয় যায়। সরকার যদিও রাজানুগত ছিল তবুও এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে এতটুকু পরিবর্তন সাধিত হয় যে, ইসলামী শিক্ষা ও শরিয়তের বিধানাবলীর ব্যাপারে তার মনোভাব কাফেরসুলভ হবার পরিবর্তে হয় ভক্তসূলভ। শায়খের মৃত্যুর তিন-চার বছর পর আলমগীরের জন্ম হয়। সম্ভবতঃ শায়খের পরিব্যাপ্ত সংস্কারমূলক কার্যবলীর প্রভাবেই তৈমুর বংশে এই শাহযাদাটি এমন তত্ত্বগত ঔ নৈতিক শিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হন যার ফলে আকবরের ন্যায় শরিয়ত ধ্বংসকারীর প্রপুত্র শরিয়তের খাদেম পরিণত হন।

শায়খের কার্যাবলী শুধু এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় যে, ভারতের রাষ্ট্র কর্তৃত্বের পূর্ণতঃ কুফরীর দিকে চলে যাবার পথে তিনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন এবং আজ থেকে তিন -চারশো বছন আগে এখানে ইসলামের নাম নিশানা মিটিয়ে দেবার জন্যে যে বিরাট ফিতনার সয়লাব প্রবাহিত হয় তার গতিধারাও পরিবর্তিত করে দেন। বরং এছাড়া আরো দুটো বিরাট কার্যও তিনি সম্পাদন করেন। এক, দার্শনিক ও বৈরাগ্যবাদী ভ্রষ্টতার কারণে তাসাউফের নির্মল ঝরণাধারায় যেসব ময়লা-আবর্জনা মিশ্রিত হয়ে যায়, তা থেকে তাকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে ইসলামের নির্ভেজাল ও আসল তাসাউফ পেশ করেন। দুই, তৎকালে জনসাধারণের মধ্যে যে সব জাহেলি রসম -রোওয়াজ বিস্তার লাভ করে তিনি তার কঠোর বিরোধিতা করেন এবং আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব ও সংস্কার সাধনের মাধ্যমে শরিয়ত অনুসারিতার এক শক্তিশালী আন্দোলন পরিচলনা করেন। এই আন্দোলনের হাজার হাজার সুদক্ষ কর্মী কেবল ভারতের বিভিন্ন এলাকায়ই নয় বরং মধ্য এশিয়ায়ও পৌঁছে যায় এবং সেখানকার জনগণের চরিত্র ও আকিদার সংস্কার সাধনের প্রচেষ্টা চালায়। এই কার্যাবলীর কারণেই হযরত শায়খ সরহিন্দি মুসলিম মুজাদ্দিদগণের মধ্যে স্থানলাভ করেছেন।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম