এতোক্ষণ ইসলামী রাষ্ট্রের যে রূপরেখা অংকন করা হলো, তার পুরো চিত্র স্মরণ রেখে চিন্তা করে দেখুন, এই লক্ষ্যে পৌঁছুবার সত্যিকার কর্মপন্থা কি হতে পারে? আগেই বলেছি, কোনো একটি সমাজের মধ্যকার নৈতিক চরিত্র, চিন্তা চেতনা, মন মানসিকতা, সভ্যতা সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ঐতিহ্যগত কার্যকারণের সমন্বিত কর্ম প্রক্রিয়ার ফল স্বরূপ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে ঠিক সে ধরণের একটি রাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করে। একটি গাছ অংকুরিত হওয়া থেকে আরম্ভ করে পূর্ণাঙ্গ গাছে পরিণত হওয়া পর্যন্ত যদি তা লেবু গাছ হিসাবে পরিগঠিত হয়ে থাকে, তবে ফল ফলানোর সময় হঠাৎ করে সে গাছে কিছুতেই আম ফলাতে পারেনা। ঠিক তেমনি, ইসলামী রাষ্ট্রেরও অলৌকিকভাবে আবির্ভাব ঘটেনা।
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে প্রথমে এমন একটি আন্দোলনের প্রয়োজন, যার বুনিয়াদ নির্মিত হবে সেই জীবন দর্শন, সেই জীবনোদ্দেশ্য, সেই নৈতিক মানদন্ড এবং সেই চারিত্রিক আদর্শের উপর, যা হবে ইসলামের প্রাণশক্তির সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। কেবল সেসব লোকেরাই ঐ আন্দোলনের নেতা ও কর্মী হবার যোগ্যতা রাখবে, যারা মানবতার এ বিশেষ ছাঁচে ঢেলে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে প্রস্তুত হবে। সেই সাথে যারা সমাজে অনুরূপ মনমানসিকতা ও নৈতিক প্রাণশক্তি প্রচারের জন্যে প্রাণান্তকর চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যাবে।
অতঃপর এই একই ভিত্তির উপর এমন এক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা ঐ বিশেষ টাইপের লোক তৈরি করবে। যা থেকে সৃষ্টি হবে এমন সব মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, মোটকথা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় এমন সব বিশেষজ্ঞ তৈরি হবে, যারা নিজেদের মনমানসিকতা, ধ্যানধারণা ও চিন্তা দর্শনের দিক থেকে হবে পূর্ণ মুসলিম। যাদের ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে বাস্তবধর্মী এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নীল নকশা তৈরি করার থাকবে পূর্ণাঙ্গ যোগ্যতা। যারা খোদাদ্রোহী চিন্তানায়কদের মোকাবেলায় নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব (Intellectual leadership) -কে বিজয়ী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার পূর্ণ যোগ্যতা রাখবে।
এই চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতেই ইসলামী আন্দোলনকে সমাজের বুকে ছড়িয়ে থাকা ভ্রান্ত জীবন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এই সংগ্রামে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে বিপদ মুসীবত ও অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে, ত্যাগ ও কুরবানীর নজরানা পেশ করে, মার খেয়ে খেয়ে এবং জীবন দিয়ে দিয়ে নিজেদের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও মজবুত সংকল্পের প্রমাণ পেশ করতে হবে। যেনো কোনো প্রকার লোক তাদের নিখাঁদ খাঁটি (Finest standard) সোনাই দেখতে পায়। সংগ্রামের ময়দানে যে আদর্শের পতাকাবাহী হিসেবে তারা অবতীর্ণ হয়েছে, তাদের প্রতিটি কথা ও কাজে সে আদর্শ প্রতিফলিত হতে হবে। তাদের প্রতিটি কথা দ্বারা যেনো দুনিয়ার সামনে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এমন নিষ্কলুষ, নিঃস্বার্থ, সত্যবাদী, পূতঃ চরিত্র, ত্যাগী, নীতিবান ও খোদাভীরু লোকেরা মানবতার কল্যাণের জন্যে যে আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাচ্ছে, তাতে অবশ্যি মানুষের জন্যে সুবিচার, শান্তি ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
এ ধরণের চেষ্টা সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজের এমন সব লোকই ধীরে ধীরে এই আন্দোলনে শরীক হয়ে যাবে, যাদের প্রকৃতিতে সত্য ও সততার কিছু না কিছু উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। এর মোকাবেলায় হীন চরিত্র ও নিকৃষ্ট পথের অনুসারীদের প্রভাব ধীরে ধীরে সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যেতে থাকবে। জনগণের চিন্তা চেতনায় সৃষ্টি হবে এক প্রচন্ড বিপ্লব। সমাজ জীবনে উত্থিত হবে সেই বিশেষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার তীব্র দাবী। তখন এই পরিবর্তিত মানসিকতার সমাজে অপর কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু থাকার পথ হয়ে যাবে সম্পূর্ণ রুদ্ধ।
অবশেষে, এক অবশ্যম্ভাবী ও স্বাভাবিক পরিণতির ফলে সেই কাংখিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, যার জন্যে দীর্ঘদিন থেকে জমীনকে তৈরি করা হয়েছে। এভাবে সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থার বদৌলতে, তা পরিচালনার জন্যে একেবারে নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী থেকে নিয়ে মন্ত্রী ও গভর্ণর পর্যায় পর্যন্ত সকল শ্রেণীর কর্মচারী ও কর্মকর্তা সেখানে মজুদ পাওয়া যাবে।
এ হলো সেই বিপ্লবের চিত্র ও সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বাভাবিক পদ্ধতি, যাকে ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী রাষ্ট্র বলা হয়। পৃথিবীর সব বিপ্লবের ইতিহাস আপনাদের সামনে রয়েছে। একথা আপনাদের অজানা থাকার কথা নয় যে, একটি বিশেষ ধরণের বিপ্লব ঠিক সেই ধরণের আন্দোলন, অনুরূপ নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী, অনুরূপ সামষ্টিক ও সামাজিক চেতনা এবং অনুরূপ সাংস্কৃতিক ও নৈতিক পরিবেশই দাবী করে।
ফরাসী বিপ্লবের জন্যে সেই বিশেষ ধরণের নৈতিকও মানসিক ভিত রচনারই প্রয়োজন ছিলো, যা তৈরি করেছিলেন রুশো, ভল্টেয়ার ও মন্টেস্কোর মতো দার্শনিক। কার্ল মার্ক্সের দর্শন এবং লেলিন ও ট্রটক্সির নেতৃত্ব আর হাজার হাজার সমাজতান্ত্রিক কর্মীর ত্যাগের বদৌলতেই রুশ বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল, যারা নিজেদের জীবনকে সমাজতন্ত্রের ছাঁচে ঢেলে গঠন করেছিলো। জার্মানীর জাতীয় সমাজতন্ত্রের পক্ষে সেই বিশেষ নৈতিক, মনস্তাত্বিক ও সাংস্কৃতিক মাটিতেই শিকড় গাড়া সম্ভব হয়েছিল, যা সৃষ্টি করেছিল হেগেল, ফিস্টে, গ্যেটে এবং নিটশের মতো অসংখ্য চিন্তাবিদদের দর্শন ও মতাদর্শ, আর হিটলারের দুর্ধর্ষ নেতৃত্ব। ঠিক তেমনি, ইসলামী বিপ্লবও কেবল তখনি সংঘটিত হতে পারবে, যখন কুরআনী দর্শন ও মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সঃ) আদর্শের ভিত্তিতে একটি প্রচন্ড গণআন্দোলন উত্থিত হবে এবং সামাজিক জীবনের মানসিক, নৈতিক, মনস্তাত্বিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিসমূহকে সংগ্রামের প্রচন্ডতায় আমূল পরিবর্তিত করে দেয়া সম্ভব হবে।
একথা অন্তত আমার বুঝে আসেনা যে, কোনো জাতিপূজা ধরণের আন্দোলন দ্বারা কি করে ইসলামী বিপব সংগঠিত হতে পারে? কারণ, এর পটভূমিতে তো রয়েছে সেই ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা, যা বর্তমানে আমাদের দেশে চালু রয়েছে। আর এই শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি তো সুবিধাবাদী নৈতিকতা (Utilitarian Morals) এবং প্রয়োগবাদী (Pragmatism) মানসিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত। সাবেক ফরাসী প্রধানমন্ত্রী মসিয়ে রোনোর মতো অলৌকিক পন্থায় আমি বিশ্বাস করিনা। আমি এই নীতিতে বিশ্বাসী যে, চেষ্টা সংগ্রাম যেমন হবে, ফলও ঠিক সে রকমই হবে।
অধ্যায় ০৫ : ইসলামের বিপ্লবের পদ্ধতি
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: