রবীন্দ্রনাথের প্রতি
এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি,
প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি,
এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি,
নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রূকুটি;
এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে,
তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে।
এখনো স্বগত ভাবাবেগে
মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে।
তবুও ক্ষুধিত দিন ক্রমশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে,
গোপনে লাঞ্ছিত হই হানাদারী মৃত্যুর কবলে;
যদিও রক্তাক্ত দিন, তবু দৃপ্ত তোমার সৃষ্টিকে
এখনো প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে দিকে।
তবুও নিশ্চিত উপবাস,
আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস-
আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি,
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়,
আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়,
আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে,
আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে।
তাই আজ আমারো বিশ্বাস,
“শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।”
তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে,
দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে।।
লেনিন
লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।
আজকেও রুশিয়ার গ্রামে ও নগরে
হাজার লেনিন যুদ্ধ করে,
মুক্তির সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে।
বিদ্যুৎ-ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন
ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন,–
বিপর্যস্ত ধনতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ, বুকে আর্তনাদ;
–আসে শত্রুজয়ের সংবাদ।
সযত্ন মুখোশধরী ধনিকেরও বন্ধ আস্ফালন,
কাঁপে হৃৎযন্ত্র তার, চোখে মুখে চিহ্নিত মরণ।
বিপ্লব হয়েছে শুরু, পদানত জনতার ব্যগ্র গাত্রোত্থানে,
দেশে দেশে বিস্ফোরণ অতর্কিতে অগ্ন্যুৎপাত হানে।
দিকে দিকে কোণে কোণে লেনিনের পদধ্বনি
আজো যায় শোনা,
দলিত হাজার কণ্ঠে বিপ্লবের আজো সম্বর্ধনা।
পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে,
লেনিন সমৃদ্ধ হয় সম্ভাবিত উর্বর জঠরে।
আশ্চর্য উদ্দাম বেগে বিপ্লবের প্রত্যেক আকাশে
লেনিনের সূর্যদীপ্তি রক্তের তরঙ্গে ভেসে আসে;
ইতালী, জার্মান, জাপান, ইংলন্ড, আমেরিকা, চীন,
যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন।
অন্ধকার ভারতবর্ষ: বুভুক্ষায় পথে মৃতদেহ
অনৈক্যের চোরাবালি; পরস্পর অযথা সন্দেহ;
দরজায় চিহ্নিত নিত্য শত্রুর উদ্ধত পদাঘাত,
অদৃষ্ট র্ভৎসনা-ক্লান্ত কাটে দিন, বিমর্ষ রাত
বিদেশী শৃঙ্খলে পিষ্ট, শ্বাস তার ক্রমাগত ক্ষীণ–
এখানেও আয়োজন পূর্ণ করে নিঃশব্দে লেনিন।
লেনিন ভেঙেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন জানায় প্রতিবাদ।
মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস
মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।
লেনিন ভুমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।।
শত্রু এক
এদেশ বিপন্ন আজ; জানি আজ নিরন্ন জীবন–
মৃত্যুরা প্রত্যহ সঙ্গী, নিয়ত শত্রুর আক্রমণ
রক্তের আল্পনা আঁকে, কানে বাজে আর্তনাদ সুর;
তবুও সুদৃঢ় আমি, আমি এক ক্ষুধিত মজুর
আমার সম্মুখে আজ এক শত্রুঃ এক লাল পথ,
শত্রুর আঘাত আর বুভুক্ষায় উদ্দীপ্ত শপথ।
কঠিন প্রতিজ্ঞা-স্তব্ধ আমাদের দৃপ্ত কারখানায়,
প্রত্যেক নির্বাক যন্ত্র প্রতিরোধ সংকল্প জানায়।
আমার হাতের স্পর্শে প্রতিদিন যন্ত্রের গর্জন
স্মরণ করায় পণ; অবসাদ দিই বিসর্জন।
বিক্ষুব্ধ যন্ত্রের বুকে প্রতিদিন যে যুদ্ধ ঘোষণা,
সে যুদ্ধ আমার যুদ্ধ, তারই পথে স্তব্ধ দিন গোনা।
অদূর দিগন্ত আসে ক্ষিপ্র দিন, জয়োন্মত্ত পাখা–
আমার দৃষ্টিতে লাল প্রতিবিম্ব মুক্তির পতাকা।
আমার বেগান্ধ হাত, অবিরাম যন্ত্রের প্রসব
প্রচুর সৃষ্টি, শেষ বজ্র সৃষ্টির উৎসব।।
মজুরদের ঝড়
(ল্যাংস্টন হিউজ)
এখন এই তো সময়–
কই? কোথায়? বেরিয়ে এসো ধর্মঘটভাঙা দালালরা;
সেই সব দালালরা-
ছেলেদের চোখের মতো যাদের ভোল বদলায়,
বেরিয়ে এসো!
জাহান্নামে যাওয়া মূর্খের দল,
বিচ্ছিন্ন, তিক্ত, দুর্বোধ্য
পরাজয় আর মৃত্যুর দূত–
বেরিয়ে এসো!
বেরিয়ে এসো শক্তিমান আর অর্থলোভীর দল
সংকীর্ণ গলির বিষাক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে।
গর্তের পোকারা!
এই তো তোমাদের শুভক্ষণ,
গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো
আর বেরিয়ে পড়ো ছোট ছোট সাপেরা
বড় আর মোটা সাপেদের যারা ঘিরে থাকো।
সময় হয়েছে,
আসরফি আর পুরনো অপমানের বদলে
সাদা যাদের পেট–
বংশগত সরীসৃপ দাঁত তারা বের করুক,
এই তো তাদের সুযোগ।
মানুষ ভালো করেই জানে
অনেক মানুষের বিরুদ্ধে একজনকে লাগানোর সেই
পুরনো কায়দা।
সামান্য কয়েকজন লোভী
অনেক অভাবীর বিরুদ্ধে–
আর স্বাস্থ্যবানদের বিরুদ্ধে
ক্ষয়ে-যাওয়ার দল।
সূর্যালোকের পথে যাদের যাত্রা
তাদের বিরুদ্ধে তাই সাপেরা।
অতীতে অবশ্য এই সাপেরা জিতেছে বহুবার।
কিন্তু এখন সেই সময়,
সচেতন মানুষ! এখন আর ভুল ক’রো না–
বিশ্বাস ক’রো না সেই সব সাপেদের
জমকালো চামড়ায় যারা নিজেদের ঢেকে রাখে,
বিপদে পড়লে যারা ডাকে
তাদের চেয়ে কম চটকদার বিষাক্ত অনুচরদের।
এতটুকু লজ্জা হয় না তাদের ধর্মঘট ভাঙতে
যে ধর্মঘট বেআব্রু ক্ষুদার চূড়ান্ত চিহ্ন।
–অবশ্য, এখনো কোনো সম্মানিত প্রতিষ্ঠান হয় নি
যার অজ্ঞাত নামঃ
“দর্মঘট ভাঙার দল”
অন্তত দরজায় সে নাম লেখা থাকে না।
ঝড় আসছে–সেই ঝড়ঃ
যে ঝড় পৃথিবীর বুক থেকে জঞ্জালদের টেনে তুলবে।
আর হুঁশিয়ার মজুরঃ
সে ঝড় প্রায় মুখোমুখি।।
মধ্যবিত্ত `৪২
পৃথিবীময় যে সংক্রামক রোগে,
আজকে সকলে ভুগছে একযোগে,
এখানে খানিক তারই পূর্বাভাস
পাচ্ছি, এখন বইছে পুব-বাতাস।
উপায় নেই যে সামলে ধরব হাল,
হিংস্র বাতাসে ছিঁড়ল আজকে পাল,
গোপনে আগুন বাড়ছে ধানক্ষেতে,
বিদেশী খবরে রেখেছি কান পেতে।
সভয়ে এদেশে কাটছে রাত্রিদিন,
লুব্ধ বাজারে রুগ্ন স্বপ্নহীন।
সহসা নেতারা রুদ্ধ–দেশ জুড়ে
‘দেশপ্রেমিক’ উদিত ভুঁই ফুঁড়ে।
প্রথমে তাদের অন্ধ বীর মদে
মেতেছি এবং ঠকেছি প্রতিপদে;
দেখেছি সুবিধা নেই এ কাজ করায়
একক চেষ্টা কেবলই ভুল ধরায়।
এদিকে দেশের পূর্ব প্রান্তরে
আবার বোমারু রক্ত পান করে,
ক্ষুব্ধ জনতা আসামে, চাটগাঁয়ে,
শাণিত-দ্বৈত-নগ্ন অন্যায়ে;
তাদের স্বার্থ আমার স্বার্থকে,
দেখছে চেতনা আজকে এক চোখে।।
মৃত্যুজয়ী গান
নিয়ত দক্ষিণ হাওয়া স্তব্ধ হল একদা সন্ধ্যায়
অজ্ঞাতবাসের শেষে নিদ্রাভঙ্গে নির্বীর্য জনতা
সহসা আরণ্য রাজ্যে স্তম্ভিত সভয়ে;
নির্বায়ুমণ্ডল ক্রমে দুর্ভাবনা দৃঢ়তর করে।
দুরাগত স্বপ্নের কী দুর্দিন! মহামারী অন্তরে বিক্ষোভ,
সঞ্চারিত রক্তবেগ পৃথিবীর প্রতি ধমনীতেঃ
অবসন্ন বিলাসের সঙ্কুচিত প্রাণ।
বণিকের চোখে আজ কী দুরন্ত লোভ ঝ’রে পড়েঃ
মুহুর্মুহু রক্তপাতে স্বধর্ম সূচনা;
ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা কাঁদে অনর্থক প্রসব ব্যথায়।
নশ্বর পৌষদিন, চারিদিকে ধূর্তের সমতা
জটিল আবর্তে শুধু নৈমিত্তিক প্রাণের স্পন্দন;
শোকচ্ছন্ন আমাদের সনাতন মন
পৃথিবীর সম্ভাবিত অকাল মৃত্যুতেঃ
দুর্দিনের সমন্বয়, সম্মুখেতে অনন্ত প্রহর–
দৃষ্টিপথ অন্ধকার, সন্দিহান আগামী দিনেরা।
গলিত উদ্যম তাই বৈরাগ্যের ভান,
কণ্টকিত প্রতীক্ষায় আমাদের অরণ্যবাসর।
সহসা জানালায় দেখি দুর্ভিক্ষের স্রোতে
জনতা মিছিলে আসে সংঘবদ্ধ প্রাণ–
অদ্ভুত রোমাঞ্চ লাগে সমুদ্র পর্বতে;
সে মিছিলে শোনা গেল
জনতার মৃত্যুজয়ী গান।।
এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি,
প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি,
এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি,
নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রূকুটি;
এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে,
তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে।
এখনো স্বগত ভাবাবেগে
মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে।
তবুও ক্ষুধিত দিন ক্রমশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে,
গোপনে লাঞ্ছিত হই হানাদারী মৃত্যুর কবলে;
যদিও রক্তাক্ত দিন, তবু দৃপ্ত তোমার সৃষ্টিকে
এখনো প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে দিকে।
তবুও নিশ্চিত উপবাস,
আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস-
আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি,
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়,
আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়,
আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে,
আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে।
তাই আজ আমারো বিশ্বাস,
“শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।”
তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে,
দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে।।
লেনিন
লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।
আজকেও রুশিয়ার গ্রামে ও নগরে
হাজার লেনিন যুদ্ধ করে,
মুক্তির সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে।
বিদ্যুৎ-ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন
ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন,–
বিপর্যস্ত ধনতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ, বুকে আর্তনাদ;
–আসে শত্রুজয়ের সংবাদ।
সযত্ন মুখোশধরী ধনিকেরও বন্ধ আস্ফালন,
কাঁপে হৃৎযন্ত্র তার, চোখে মুখে চিহ্নিত মরণ।
বিপ্লব হয়েছে শুরু, পদানত জনতার ব্যগ্র গাত্রোত্থানে,
দেশে দেশে বিস্ফোরণ অতর্কিতে অগ্ন্যুৎপাত হানে।
দিকে দিকে কোণে কোণে লেনিনের পদধ্বনি
আজো যায় শোনা,
দলিত হাজার কণ্ঠে বিপ্লবের আজো সম্বর্ধনা।
পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে,
লেনিন সমৃদ্ধ হয় সম্ভাবিত উর্বর জঠরে।
আশ্চর্য উদ্দাম বেগে বিপ্লবের প্রত্যেক আকাশে
লেনিনের সূর্যদীপ্তি রক্তের তরঙ্গে ভেসে আসে;
ইতালী, জার্মান, জাপান, ইংলন্ড, আমেরিকা, চীন,
যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন।
অন্ধকার ভারতবর্ষ: বুভুক্ষায় পথে মৃতদেহ
অনৈক্যের চোরাবালি; পরস্পর অযথা সন্দেহ;
দরজায় চিহ্নিত নিত্য শত্রুর উদ্ধত পদাঘাত,
অদৃষ্ট র্ভৎসনা-ক্লান্ত কাটে দিন, বিমর্ষ রাত
বিদেশী শৃঙ্খলে পিষ্ট, শ্বাস তার ক্রমাগত ক্ষীণ–
এখানেও আয়োজন পূর্ণ করে নিঃশব্দে লেনিন।
লেনিন ভেঙেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন জানায় প্রতিবাদ।
মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস
মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।
লেনিন ভুমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।।
শত্রু এক
এদেশ বিপন্ন আজ; জানি আজ নিরন্ন জীবন–
মৃত্যুরা প্রত্যহ সঙ্গী, নিয়ত শত্রুর আক্রমণ
রক্তের আল্পনা আঁকে, কানে বাজে আর্তনাদ সুর;
তবুও সুদৃঢ় আমি, আমি এক ক্ষুধিত মজুর
আমার সম্মুখে আজ এক শত্রুঃ এক লাল পথ,
শত্রুর আঘাত আর বুভুক্ষায় উদ্দীপ্ত শপথ।
কঠিন প্রতিজ্ঞা-স্তব্ধ আমাদের দৃপ্ত কারখানায়,
প্রত্যেক নির্বাক যন্ত্র প্রতিরোধ সংকল্প জানায়।
আমার হাতের স্পর্শে প্রতিদিন যন্ত্রের গর্জন
স্মরণ করায় পণ; অবসাদ দিই বিসর্জন।
বিক্ষুব্ধ যন্ত্রের বুকে প্রতিদিন যে যুদ্ধ ঘোষণা,
সে যুদ্ধ আমার যুদ্ধ, তারই পথে স্তব্ধ দিন গোনা।
অদূর দিগন্ত আসে ক্ষিপ্র দিন, জয়োন্মত্ত পাখা–
আমার দৃষ্টিতে লাল প্রতিবিম্ব মুক্তির পতাকা।
আমার বেগান্ধ হাত, অবিরাম যন্ত্রের প্রসব
প্রচুর সৃষ্টি, শেষ বজ্র সৃষ্টির উৎসব।।
মজুরদের ঝড়
(ল্যাংস্টন হিউজ)
এখন এই তো সময়–
কই? কোথায়? বেরিয়ে এসো ধর্মঘটভাঙা দালালরা;
সেই সব দালালরা-
ছেলেদের চোখের মতো যাদের ভোল বদলায়,
বেরিয়ে এসো!
জাহান্নামে যাওয়া মূর্খের দল,
বিচ্ছিন্ন, তিক্ত, দুর্বোধ্য
পরাজয় আর মৃত্যুর দূত–
বেরিয়ে এসো!
বেরিয়ে এসো শক্তিমান আর অর্থলোভীর দল
সংকীর্ণ গলির বিষাক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে।
গর্তের পোকারা!
এই তো তোমাদের শুভক্ষণ,
গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো
আর বেরিয়ে পড়ো ছোট ছোট সাপেরা
বড় আর মোটা সাপেদের যারা ঘিরে থাকো।
সময় হয়েছে,
আসরফি আর পুরনো অপমানের বদলে
সাদা যাদের পেট–
বংশগত সরীসৃপ দাঁত তারা বের করুক,
এই তো তাদের সুযোগ।
মানুষ ভালো করেই জানে
অনেক মানুষের বিরুদ্ধে একজনকে লাগানোর সেই
পুরনো কায়দা।
সামান্য কয়েকজন লোভী
অনেক অভাবীর বিরুদ্ধে–
আর স্বাস্থ্যবানদের বিরুদ্ধে
ক্ষয়ে-যাওয়ার দল।
সূর্যালোকের পথে যাদের যাত্রা
তাদের বিরুদ্ধে তাই সাপেরা।
অতীতে অবশ্য এই সাপেরা জিতেছে বহুবার।
কিন্তু এখন সেই সময়,
সচেতন মানুষ! এখন আর ভুল ক’রো না–
বিশ্বাস ক’রো না সেই সব সাপেদের
জমকালো চামড়ায় যারা নিজেদের ঢেকে রাখে,
বিপদে পড়লে যারা ডাকে
তাদের চেয়ে কম চটকদার বিষাক্ত অনুচরদের।
এতটুকু লজ্জা হয় না তাদের ধর্মঘট ভাঙতে
যে ধর্মঘট বেআব্রু ক্ষুদার চূড়ান্ত চিহ্ন।
–অবশ্য, এখনো কোনো সম্মানিত প্রতিষ্ঠান হয় নি
যার অজ্ঞাত নামঃ
“দর্মঘট ভাঙার দল”
অন্তত দরজায় সে নাম লেখা থাকে না।
ঝড় আসছে–সেই ঝড়ঃ
যে ঝড় পৃথিবীর বুক থেকে জঞ্জালদের টেনে তুলবে।
আর হুঁশিয়ার মজুরঃ
সে ঝড় প্রায় মুখোমুখি।।
মধ্যবিত্ত `৪২
পৃথিবীময় যে সংক্রামক রোগে,
আজকে সকলে ভুগছে একযোগে,
এখানে খানিক তারই পূর্বাভাস
পাচ্ছি, এখন বইছে পুব-বাতাস।
উপায় নেই যে সামলে ধরব হাল,
হিংস্র বাতাসে ছিঁড়ল আজকে পাল,
গোপনে আগুন বাড়ছে ধানক্ষেতে,
বিদেশী খবরে রেখেছি কান পেতে।
সভয়ে এদেশে কাটছে রাত্রিদিন,
লুব্ধ বাজারে রুগ্ন স্বপ্নহীন।
সহসা নেতারা রুদ্ধ–দেশ জুড়ে
‘দেশপ্রেমিক’ উদিত ভুঁই ফুঁড়ে।
প্রথমে তাদের অন্ধ বীর মদে
মেতেছি এবং ঠকেছি প্রতিপদে;
দেখেছি সুবিধা নেই এ কাজ করায়
একক চেষ্টা কেবলই ভুল ধরায়।
এদিকে দেশের পূর্ব প্রান্তরে
আবার বোমারু রক্ত পান করে,
ক্ষুব্ধ জনতা আসামে, চাটগাঁয়ে,
শাণিত-দ্বৈত-নগ্ন অন্যায়ে;
তাদের স্বার্থ আমার স্বার্থকে,
দেখছে চেতনা আজকে এক চোখে।।
মৃত্যুজয়ী গান
নিয়ত দক্ষিণ হাওয়া স্তব্ধ হল একদা সন্ধ্যায়
অজ্ঞাতবাসের শেষে নিদ্রাভঙ্গে নির্বীর্য জনতা
সহসা আরণ্য রাজ্যে স্তম্ভিত সভয়ে;
নির্বায়ুমণ্ডল ক্রমে দুর্ভাবনা দৃঢ়তর করে।
দুরাগত স্বপ্নের কী দুর্দিন! মহামারী অন্তরে বিক্ষোভ,
সঞ্চারিত রক্তবেগ পৃথিবীর প্রতি ধমনীতেঃ
অবসন্ন বিলাসের সঙ্কুচিত প্রাণ।
বণিকের চোখে আজ কী দুরন্ত লোভ ঝ’রে পড়েঃ
মুহুর্মুহু রক্তপাতে স্বধর্ম সূচনা;
ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা কাঁদে অনর্থক প্রসব ব্যথায়।
নশ্বর পৌষদিন, চারিদিকে ধূর্তের সমতা
জটিল আবর্তে শুধু নৈমিত্তিক প্রাণের স্পন্দন;
শোকচ্ছন্ন আমাদের সনাতন মন
পৃথিবীর সম্ভাবিত অকাল মৃত্যুতেঃ
দুর্দিনের সমন্বয়, সম্মুখেতে অনন্ত প্রহর–
দৃষ্টিপথ অন্ধকার, সন্দিহান আগামী দিনেরা।
গলিত উদ্যম তাই বৈরাগ্যের ভান,
কণ্টকিত প্রতীক্ষায় আমাদের অরণ্যবাসর।
সহসা জানালায় দেখি দুর্ভিক্ষের স্রোতে
জনতা মিছিলে আসে সংঘবদ্ধ প্রাণ–
অদ্ভুত রোমাঞ্চ লাগে সমুদ্র পর্বতে;
সে মিছিলে শোনা গেল
জনতার মৃত্যুজয়ী গান।।
0 comments: