প্রস্তুত
কালো মৃত্যুরা ডেকেছে আজকে স্বয়ম্বরায়,
নানাদিকে নানা হাতছানি দেখি বিপুল ধরায়।
ভীত মন খোঁজে সহজ পন্থা, নিষ্ঠুর চোখ;
তাই বিষাক্ত আস্বাদময় এ মর্তলোক,
কেবলি এখানে মনের দ্বন্দ আগুন ছড়ায়।
অবশেষে ভুল ভেঙেছে, জোয়ার মনের কোণে,
তীব্র ভ্রূকুটি হেনেছি কুটিল ফুলের বনে;
আভিশাপময় যে সব আত্মা আজো অধীর,
তাদের সকাশে রেখেছি প্রাণের দৃঢ় শিবির;
নিজেকে মুক্ত করেছি আত্মসমর্পণে।
চাঁদের স্বপ্নে ধুয়ে গেছে মন যে-সব দিনে,
তাদের আজকে শত্রু বলেই নিয়েছি চিনে,
হীন র্স্পধারা ধূর্তের মতো শক্তিশেলে
ছিনিয়ে আমায় নিতে পারে আজো সুযোগ পেলে
তাই সতর্ক হয়েছি মনকে রাখি নি ঋণে।
অসংখ্য দিন কেটেছে প্রাণের বৃথা রোদনে
নরম সোফায় বিপ্লবী মন উদ্ধোধনে;
আজকে কিন্তু জনতা-জোয়ারে দোলে প্লাবন,
নিরন্ন মনে রক্তিম পথ অনুধাবন,
করছে পৃথিবী পূর্ব-পন্থা সংশোধনে।
অস্ত্র ধরেছি এখন সমুখে শত্রু চাই,
মহামরণের নিষ্ঠুর ব্রত নিয়েছি তাই;
পৃথিবী জটিল, জটিল মনের সম্ভাষণ
তাদের প্রভাবে রাখিনি মনেতে কোনো আসন,
ভুল হবে জানি তাদের আজকে মনে করাই।।
বিবৃতি
আমার সোনার দেশে অবশেষে মন্বন্তর নামে,
জমে ভিড় ভ্রষ্টনীড় নগরে ও গ্রামে,
দুর্ভিক্ষের জীবন্ত মিছিল,
প্রত্যেক নিরন্ন প্রাণে বয়ে আনে অনিবার্য মিল।
আহার্যের অন্বেষণে প্রতি মনে আদিম আগ্রহ
রাস্তায় রাস্তায় আনে প্রতিদিন নগ্ন সমারোহ;
বুভুক্ষা বেঁধেছে বাসা পথের দু’পাশে,
প্রত্যহ বিষাক্ত বায়ু ইতস্তত ব্যর্থ দীর্ঘশ্বাসে।
মধ্যবিত্ত ধূর্ত সুখ ক্রমে ক্রমে আবরণহীন
নিঃশব্দে ঘোষণা করে দারুণ দুর্দিন,
পথে পথে দলে দলে কঙ্কালের শোভাযাত্রা চলে,
দুর্ভিক্ষ গুঞ্জন তোলে আতঙ্কিত অন্দরমহলে!
দুয়ারে দুয়ারে ব্যগ্র উপবাসী প্রত্যাশীর দল,
নিষ্ফল প্রার্থনা-ক্লান্ত, তীব্র ক্ষুধা অন্তিম সম্বল;
রাজপথে মৃতদেহ উগ্র দিবালোকে,
বিস্ময় নিক্ষেপ করে অনভ্যস্ত চোখে।
পরন্তু এদেশে আজ হিংস্র শত্রু আক্রমণ করে,
বিপুল মৃত্যুর স্রোত টান দেয় প্রাণের শিকড়ে,
নিয়ত অন্যায় হানে জরাগ্রস্ত বিদেশী শাসন,
ক্ষীণায়ু কোষ্ঠীতে নেই ধ্বংস-গর্ভ সংকটনাশন।
সহসা অনেক রাত্রে দেশদ্রোহী ঘাতকের হাতে
দেশপ্রেমে দৃপ্তপ্রাণ রক্ত ঢালে সূর্যের সাক্ষাতে।
তবুও প্রতিজ্ঞা ফেরে বাতাসে নিভৃত,
এখানে চল্লিশ কোটি এখনো জীবিত,
ভারতবর্ষের ‘পরে গলিত সূর্য ঝরে আজ–
দিগ্বিদিকে উঠেছে আওয়াজ,
রক্তে আনো লাল,
রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল।
উদ্ধত প্রাণের বেগে উন্মুখর আমার এ দেশ,
আমার বিধ্বস্ত প্রাণে দৃঢ়তার এসেছে নির্দেশ।
আজকে মজুর ভাই দেশময় তুচ্ছ করে প্রাণ,
কারখানায় কারখানায় তোলে ঐক্যতান।
অভুক্ত কৃষক আজ সূচীমুখ লাঙলের মুখে
নির্ভয়ে রচনা করে জঙ্গী কাব্য এ মাটির বুকে।
আজকে আসন্ন মুক্তি দূর থেকে দৃষ্টি দেয় শ্যেন,
এদেশে ভাণ্ডার ভ’রে দেবে জানি নতুন য়ূক্রেন।
নিরন্ন আমার দেশে আজ তাই উদ্ধত জেহাদ,
টলোমলো এ দুর্দিন, থরোথরো জীর্ণ বনিয়াদ।
তাইতো রক্তের স্রোতে শুনি পদধ্বনি
বিক্ষুব্ধ টাইফুন-মত্ত চঞ্চল ধমনী:
বিপন্ন পৃথ্বীর আজ শুনি শেষ মুহুর্মুহু ডাক
আমাদের দৃপ্ত মুঠি আজ তার উত্তর পাঠাক।
ফিরুক দুয়ার থেকে সন্ধানী মৃত্যুর পরোয়ানা,
ব্যর্থ হোক কুচক্রান্ত, অবিরাম বিপক্ষের হানা।।
বোধন
হে মহামানব, একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে,
এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার;
লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার।
এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি;
কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল,
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল,
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো,
হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।
ব্যাহত জীবনযাত্রা, চুপি চুপি কান্না বও বুকে,
হে নীড়-বিহারী সঙ্গী! আজ শুধু মনে মনে ধুঁকে
ভেবেছ সংসারসিন্ধু কোনোমতে হয়ে যাবে পার
পায়ে পায়ে বাধা ঠেলে। তবু আজো বিস্ময় আমার–
ধূর্ত, প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষ গ্রাস
তাদের করেছ মা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ।
তোমার ক্ষেতের শস্য
চুরি ক’রে যারা গুপ্তকক্ষতে জমায়
তাদেরি দু’পায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায়;
লোভের পাপের দুর্গ গম্বুজ ও প্রাসাদে মিনারে
তুমি যে পেতেছ হাত; আজ মাথা ঠুকে বারে বারে
অভিশাপ দাও যদি, বারংবার হবে তা নিস্ফল–
তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল।
তুমি তো প্রহর গোনো,
তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি,
তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি
তোমাকে বিদ্রূপ করে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে–
কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফেরো দুর্বিপাকে।
পৃথিবী উদাস, শোনো হে দুনিয়াদার!
সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু-কালো পাহাড়
দগ্ধ হৃদয়ে যদিও ফেরাও ঘাড়
সামনে পেছনে কোথাও পাবে না পার:
কি করে খুলবে মৃত্যু-ঠেকানো দ্বার-
এই মুহূর্তে জবাব দেবে কি তার?
লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম
অনেক দিয়েছি; উজাড় গ্রাম।
সুদ ও আসলে আজকে তাই
যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই।
কৃপণ পৃথিবী, লোভের অস্ত্র
দিয়ে কেড়ে নেয় অন্নবস্ত্র,
লোলুপ রসনা মেলা পৃথিবীতে
বাড়াও ও-হাত তাকে ছিঁড়ে নিতে।
লোভের মাথায় পদাঘাত হানো–
আনো, রক্তের ভাগীরথী আনো।
দৈত্যরাজের যত অনুচর
মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পর পর;
মেলো চোখ আজ ভাঙো সে ফাঁদ-
হাঁকো দিকে দিকে সিংহনাদ।
তোমার ফসল, তোমার মাটি
তাদের জীয়ন ও মরণকাঠি
তোমার চেতনা চালিত হাতে।
এখনও কাঁপবে আশঙ্কাতে?
স্বদেশপ্রেমের ব্যাঙ্গমা পাখি
মারণমন্ত্র বলে, শোনো তা কি?
এখনো কি তুমি আমি স্বতন্ত্র?
করো আবৃত্তি, হাঁকো সে মন্ত্রঃ
শোন্ রে মালিক, শোন্ রে মজুতদার!
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়–
হিসাব কি দিবি তার?
প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
ভেঙেছিস ঘরবাড়ি,
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে
কখনো ভুলতে পারি?
আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই।
শোন্ রে মজুতদার,
ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ
করব তোকে এবার।
তারপর বহুশত যুগ পরে
ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে
নৃতত্ত্ববিদ্ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার,
মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার।
তেরোশো সালের মধ্যবর্তী মালিক, মজুতদার
মানুষ ছিল কি? জবাব মেলে না তার।
আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়,
দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড়;
আজকের নৈঃশব্দ হোক যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি।
দুহাতে বাজাও প্রতিশোদের উন্মত্ত দামামা,
প্রার্থনা করোঃ
হে জীবন, যে যুগ-সন্ধিকালের চেতনা-
আজকে শক্তি দাও, যুগ যুগ বাঞ্ছিত দুর্দমনীয় শক্তি,
প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের
তুষার-গলানো উত্তাপ।
টুকরে টুকরো ক’রে ছেঁড়ো তোমার
অন্যায় আর ভীরুতার কলঙ্কিত কাহিনী।
শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে
একত্রিত হোক আমাদের সংহতি।
তা যদি না হয় মাথার উপরে ভয়ঙ্কর
বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর;
তা যদি না হয়, বুঝবো তুমি মানুষ নও-
গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও।
ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয় নি জল
দেয় নি তোমার মুখেতে অন্ন, বাহুতে বল
পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই
ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই।।
ঠিকানা
ঠিকানা আমার চেয়েছ বন্ধু–
ঠিকানার সন্ধান,
আজও পাও নি? দুঃখ যে দিলে করব না অভিমান?
ঠিকানা না হয় না নিলে বন্ধু,
পথে পথে বাস করি,
কখনো গাছের তলাতে
কখনো পর্ণকুটির গড়ি।
আমি যাযাবর, কুড়াই পথের নুড়ি,
হাজার জনতা যেখানে, সেখানে
আমি প্রতিদিন ঘুরি।
বন্ধু, ঘরের খুঁজে পাই নাকো পথ,
তাইতো পথের নুড়িতে গড়ব
মজবুত ইমারত।
বন্ধু, আজকে আঘাত দিও না
তোমাদের দেওয়া ক্ষতে,
আমার ঠিকানা খোঁজ ক’রো শুধু
সূর্যোদয়ের পথে।
ইন্দোনেশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া,
রুশ ও চীনের কাছে,
আমার ঠিকানা বহুকাল ধ’রে
জেনো গচ্ছিত আছে।
আমাকে কি তুমি খুঁজেছ কখনো
সমস্ত দেশ জুড়ে?
তবুও পাও নি? তাহলে ফিরেছ
ভুল পথে ঘুরে ঘুরে।
আমার হদিশ জীবনের পথে
মন্বন্তর থেকে
ঘুরে গিয়েছে যে কিছু দূর গিয়ে
মুক্তির পথে বেঁকে।
বন্ধু, কুয়াশা, সাবধান এই
সূর্যোদয়ের ভোরে;
পথ হারিও না আলোর আশায়
তুমি একা ভুল ক’রে।
বন্ধু, আজকে জানি অস্থির
রক্ত, নদীর জল,
নীড়ে পাখি আর সমুদ্র চঞ্চল।
বন্ধু, সময় হয়েছে এখনো
ঠিকানা অবজ্ঞাত
বন্ধু, তোমার ভুল হয় কেন এত?
আর কতদিন দুচক্ষু কচ্লাবে,
জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু
সে পথে আমাকে পাবে,
জালালাবাদের পথ ধ’রে ভাই
ধর্মতলার পরে,
দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে
ক্ষুব্ধ এদেশে রক্তের অক্ষরে।
বন্ধু, আজকে বিদায়!
দেখেছ উঠল যে হাওয়া ঝোড়ো,
ঠিকানা রইল,
এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা ক’রো।।
ডাক
মুখে-মৃদু-হাসি অহিংস বুদ্ধের
ভূমিকা চাই না। ডাক ওঠে যুদ্ধের।
গুলি বেঁধে বুকে উদ্ধত তবু মাথা–
হাতে হাতে ফেরে দেনা-পাওনার খাতা,
শোনো হুঙ্কার কোটি অবরুদ্ধের।
দুর্ভিক্ষকে তাড়াও, ওদেরও তাড়াও–
সন্ধিপত্র মাড়াও, দু’পায়ে মাড়াও।
তিন-পতাকার মিনতিঃ দেবে না সাড়াও?
অসহ্য জ্বালা কোটি কোটি ক্রুদ্ধের!
ক্ষতবিক্ষত নতুন সকাল বেলা,
শেষ করব এ রক্তের হোলিখেলা,
ওঠো সোজা হয়ে, পায়ে পায়ে লাগে ঠেলা
দেখ, ভিড় দেখ স্বাদীনতালুব্ধের।
ফাল্গুন মাস, ঝরুক জীর্ণ পাতা।
গজাক নতুন পাতারা, তুলুক মাথা,
নতুন দেয়াল দিকে দিকে হোক গাঁথা–
জাগে বিক্ষোভে চারিপাশে ক্ষুব্ধের।
হ্রদে তৃষ্ণার জল পাবে কত কাল?
সম্মুখে টানে সমুদ্র উত্তালঃ
তুমি কোন্ দলে? জিজ্ঞাসা উদ্দামঃ
‘গুণ্ডা’র দলে আজো লেখাও নি নাম?
দুরাশার মৃত্যু
দ্বারে মৃত্যু,
বনে বনে লেগেছে জোয়ার,
পিছনে কি পথ নেই আর?
আমাদের এই পলায়ন
জেনেছে মরণ,
অনুগামী ধূর্ত পিছে পিছে,
প্রস্থানের চেষ্টা হল মিছে।
দাবানল!
ব্যর্থ হল শুষ্ক অশ্রুজল,
বেনামী কৌশল
জেনেছে যে আরণ্যক প্রাণী
তাই শেষে নির্মূল বনানী।।
কালো মৃত্যুরা ডেকেছে আজকে স্বয়ম্বরায়,
নানাদিকে নানা হাতছানি দেখি বিপুল ধরায়।
ভীত মন খোঁজে সহজ পন্থা, নিষ্ঠুর চোখ;
তাই বিষাক্ত আস্বাদময় এ মর্তলোক,
কেবলি এখানে মনের দ্বন্দ আগুন ছড়ায়।
অবশেষে ভুল ভেঙেছে, জোয়ার মনের কোণে,
তীব্র ভ্রূকুটি হেনেছি কুটিল ফুলের বনে;
আভিশাপময় যে সব আত্মা আজো অধীর,
তাদের সকাশে রেখেছি প্রাণের দৃঢ় শিবির;
নিজেকে মুক্ত করেছি আত্মসমর্পণে।
চাঁদের স্বপ্নে ধুয়ে গেছে মন যে-সব দিনে,
তাদের আজকে শত্রু বলেই নিয়েছি চিনে,
হীন র্স্পধারা ধূর্তের মতো শক্তিশেলে
ছিনিয়ে আমায় নিতে পারে আজো সুযোগ পেলে
তাই সতর্ক হয়েছি মনকে রাখি নি ঋণে।
অসংখ্য দিন কেটেছে প্রাণের বৃথা রোদনে
নরম সোফায় বিপ্লবী মন উদ্ধোধনে;
আজকে কিন্তু জনতা-জোয়ারে দোলে প্লাবন,
নিরন্ন মনে রক্তিম পথ অনুধাবন,
করছে পৃথিবী পূর্ব-পন্থা সংশোধনে।
অস্ত্র ধরেছি এখন সমুখে শত্রু চাই,
মহামরণের নিষ্ঠুর ব্রত নিয়েছি তাই;
পৃথিবী জটিল, জটিল মনের সম্ভাষণ
তাদের প্রভাবে রাখিনি মনেতে কোনো আসন,
ভুল হবে জানি তাদের আজকে মনে করাই।।
বিবৃতি
আমার সোনার দেশে অবশেষে মন্বন্তর নামে,
জমে ভিড় ভ্রষ্টনীড় নগরে ও গ্রামে,
দুর্ভিক্ষের জীবন্ত মিছিল,
প্রত্যেক নিরন্ন প্রাণে বয়ে আনে অনিবার্য মিল।
আহার্যের অন্বেষণে প্রতি মনে আদিম আগ্রহ
রাস্তায় রাস্তায় আনে প্রতিদিন নগ্ন সমারোহ;
বুভুক্ষা বেঁধেছে বাসা পথের দু’পাশে,
প্রত্যহ বিষাক্ত বায়ু ইতস্তত ব্যর্থ দীর্ঘশ্বাসে।
মধ্যবিত্ত ধূর্ত সুখ ক্রমে ক্রমে আবরণহীন
নিঃশব্দে ঘোষণা করে দারুণ দুর্দিন,
পথে পথে দলে দলে কঙ্কালের শোভাযাত্রা চলে,
দুর্ভিক্ষ গুঞ্জন তোলে আতঙ্কিত অন্দরমহলে!
দুয়ারে দুয়ারে ব্যগ্র উপবাসী প্রত্যাশীর দল,
নিষ্ফল প্রার্থনা-ক্লান্ত, তীব্র ক্ষুধা অন্তিম সম্বল;
রাজপথে মৃতদেহ উগ্র দিবালোকে,
বিস্ময় নিক্ষেপ করে অনভ্যস্ত চোখে।
পরন্তু এদেশে আজ হিংস্র শত্রু আক্রমণ করে,
বিপুল মৃত্যুর স্রোত টান দেয় প্রাণের শিকড়ে,
নিয়ত অন্যায় হানে জরাগ্রস্ত বিদেশী শাসন,
ক্ষীণায়ু কোষ্ঠীতে নেই ধ্বংস-গর্ভ সংকটনাশন।
সহসা অনেক রাত্রে দেশদ্রোহী ঘাতকের হাতে
দেশপ্রেমে দৃপ্তপ্রাণ রক্ত ঢালে সূর্যের সাক্ষাতে।
তবুও প্রতিজ্ঞা ফেরে বাতাসে নিভৃত,
এখানে চল্লিশ কোটি এখনো জীবিত,
ভারতবর্ষের ‘পরে গলিত সূর্য ঝরে আজ–
দিগ্বিদিকে উঠেছে আওয়াজ,
রক্তে আনো লাল,
রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল।
উদ্ধত প্রাণের বেগে উন্মুখর আমার এ দেশ,
আমার বিধ্বস্ত প্রাণে দৃঢ়তার এসেছে নির্দেশ।
আজকে মজুর ভাই দেশময় তুচ্ছ করে প্রাণ,
কারখানায় কারখানায় তোলে ঐক্যতান।
অভুক্ত কৃষক আজ সূচীমুখ লাঙলের মুখে
নির্ভয়ে রচনা করে জঙ্গী কাব্য এ মাটির বুকে।
আজকে আসন্ন মুক্তি দূর থেকে দৃষ্টি দেয় শ্যেন,
এদেশে ভাণ্ডার ভ’রে দেবে জানি নতুন য়ূক্রেন।
নিরন্ন আমার দেশে আজ তাই উদ্ধত জেহাদ,
টলোমলো এ দুর্দিন, থরোথরো জীর্ণ বনিয়াদ।
তাইতো রক্তের স্রোতে শুনি পদধ্বনি
বিক্ষুব্ধ টাইফুন-মত্ত চঞ্চল ধমনী:
বিপন্ন পৃথ্বীর আজ শুনি শেষ মুহুর্মুহু ডাক
আমাদের দৃপ্ত মুঠি আজ তার উত্তর পাঠাক।
ফিরুক দুয়ার থেকে সন্ধানী মৃত্যুর পরোয়ানা,
ব্যর্থ হোক কুচক্রান্ত, অবিরাম বিপক্ষের হানা।।
বোধন
হে মহামানব, একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে,
এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার;
লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার।
এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি;
কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল,
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল,
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো,
হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।
ব্যাহত জীবনযাত্রা, চুপি চুপি কান্না বও বুকে,
হে নীড়-বিহারী সঙ্গী! আজ শুধু মনে মনে ধুঁকে
ভেবেছ সংসারসিন্ধু কোনোমতে হয়ে যাবে পার
পায়ে পায়ে বাধা ঠেলে। তবু আজো বিস্ময় আমার–
ধূর্ত, প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষ গ্রাস
তাদের করেছ মা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ।
তোমার ক্ষেতের শস্য
চুরি ক’রে যারা গুপ্তকক্ষতে জমায়
তাদেরি দু’পায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায়;
লোভের পাপের দুর্গ গম্বুজ ও প্রাসাদে মিনারে
তুমি যে পেতেছ হাত; আজ মাথা ঠুকে বারে বারে
অভিশাপ দাও যদি, বারংবার হবে তা নিস্ফল–
তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল।
তুমি তো প্রহর গোনো,
তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি,
তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি
তোমাকে বিদ্রূপ করে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে–
কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফেরো দুর্বিপাকে।
পৃথিবী উদাস, শোনো হে দুনিয়াদার!
সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু-কালো পাহাড়
দগ্ধ হৃদয়ে যদিও ফেরাও ঘাড়
সামনে পেছনে কোথাও পাবে না পার:
কি করে খুলবে মৃত্যু-ঠেকানো দ্বার-
এই মুহূর্তে জবাব দেবে কি তার?
লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম
অনেক দিয়েছি; উজাড় গ্রাম।
সুদ ও আসলে আজকে তাই
যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই।
কৃপণ পৃথিবী, লোভের অস্ত্র
দিয়ে কেড়ে নেয় অন্নবস্ত্র,
লোলুপ রসনা মেলা পৃথিবীতে
বাড়াও ও-হাত তাকে ছিঁড়ে নিতে।
লোভের মাথায় পদাঘাত হানো–
আনো, রক্তের ভাগীরথী আনো।
দৈত্যরাজের যত অনুচর
মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পর পর;
মেলো চোখ আজ ভাঙো সে ফাঁদ-
হাঁকো দিকে দিকে সিংহনাদ।
তোমার ফসল, তোমার মাটি
তাদের জীয়ন ও মরণকাঠি
তোমার চেতনা চালিত হাতে।
এখনও কাঁপবে আশঙ্কাতে?
স্বদেশপ্রেমের ব্যাঙ্গমা পাখি
মারণমন্ত্র বলে, শোনো তা কি?
এখনো কি তুমি আমি স্বতন্ত্র?
করো আবৃত্তি, হাঁকো সে মন্ত্রঃ
শোন্ রে মালিক, শোন্ রে মজুতদার!
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়–
হিসাব কি দিবি তার?
প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
ভেঙেছিস ঘরবাড়ি,
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে
কখনো ভুলতে পারি?
আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই।
শোন্ রে মজুতদার,
ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ
করব তোকে এবার।
তারপর বহুশত যুগ পরে
ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে
নৃতত্ত্ববিদ্ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার,
মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার।
তেরোশো সালের মধ্যবর্তী মালিক, মজুতদার
মানুষ ছিল কি? জবাব মেলে না তার।
আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়,
দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড়;
আজকের নৈঃশব্দ হোক যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি।
দুহাতে বাজাও প্রতিশোদের উন্মত্ত দামামা,
প্রার্থনা করোঃ
হে জীবন, যে যুগ-সন্ধিকালের চেতনা-
আজকে শক্তি দাও, যুগ যুগ বাঞ্ছিত দুর্দমনীয় শক্তি,
প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের
তুষার-গলানো উত্তাপ।
টুকরে টুকরো ক’রে ছেঁড়ো তোমার
অন্যায় আর ভীরুতার কলঙ্কিত কাহিনী।
শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে
একত্রিত হোক আমাদের সংহতি।
তা যদি না হয় মাথার উপরে ভয়ঙ্কর
বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর;
তা যদি না হয়, বুঝবো তুমি মানুষ নও-
গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও।
ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয় নি জল
দেয় নি তোমার মুখেতে অন্ন, বাহুতে বল
পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই
ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই।।
ঠিকানা
ঠিকানা আমার চেয়েছ বন্ধু–
ঠিকানার সন্ধান,
আজও পাও নি? দুঃখ যে দিলে করব না অভিমান?
ঠিকানা না হয় না নিলে বন্ধু,
পথে পথে বাস করি,
কখনো গাছের তলাতে
কখনো পর্ণকুটির গড়ি।
আমি যাযাবর, কুড়াই পথের নুড়ি,
হাজার জনতা যেখানে, সেখানে
আমি প্রতিদিন ঘুরি।
বন্ধু, ঘরের খুঁজে পাই নাকো পথ,
তাইতো পথের নুড়িতে গড়ব
মজবুত ইমারত।
বন্ধু, আজকে আঘাত দিও না
তোমাদের দেওয়া ক্ষতে,
আমার ঠিকানা খোঁজ ক’রো শুধু
সূর্যোদয়ের পথে।
ইন্দোনেশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া,
রুশ ও চীনের কাছে,
আমার ঠিকানা বহুকাল ধ’রে
জেনো গচ্ছিত আছে।
আমাকে কি তুমি খুঁজেছ কখনো
সমস্ত দেশ জুড়ে?
তবুও পাও নি? তাহলে ফিরেছ
ভুল পথে ঘুরে ঘুরে।
আমার হদিশ জীবনের পথে
মন্বন্তর থেকে
ঘুরে গিয়েছে যে কিছু দূর গিয়ে
মুক্তির পথে বেঁকে।
বন্ধু, কুয়াশা, সাবধান এই
সূর্যোদয়ের ভোরে;
পথ হারিও না আলোর আশায়
তুমি একা ভুল ক’রে।
বন্ধু, আজকে জানি অস্থির
রক্ত, নদীর জল,
নীড়ে পাখি আর সমুদ্র চঞ্চল।
বন্ধু, সময় হয়েছে এখনো
ঠিকানা অবজ্ঞাত
বন্ধু, তোমার ভুল হয় কেন এত?
আর কতদিন দুচক্ষু কচ্লাবে,
জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু
সে পথে আমাকে পাবে,
জালালাবাদের পথ ধ’রে ভাই
ধর্মতলার পরে,
দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে
ক্ষুব্ধ এদেশে রক্তের অক্ষরে।
বন্ধু, আজকে বিদায়!
দেখেছ উঠল যে হাওয়া ঝোড়ো,
ঠিকানা রইল,
এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা ক’রো।।
ডাক
মুখে-মৃদু-হাসি অহিংস বুদ্ধের
ভূমিকা চাই না। ডাক ওঠে যুদ্ধের।
গুলি বেঁধে বুকে উদ্ধত তবু মাথা–
হাতে হাতে ফেরে দেনা-পাওনার খাতা,
শোনো হুঙ্কার কোটি অবরুদ্ধের।
দুর্ভিক্ষকে তাড়াও, ওদেরও তাড়াও–
সন্ধিপত্র মাড়াও, দু’পায়ে মাড়াও।
তিন-পতাকার মিনতিঃ দেবে না সাড়াও?
অসহ্য জ্বালা কোটি কোটি ক্রুদ্ধের!
ক্ষতবিক্ষত নতুন সকাল বেলা,
শেষ করব এ রক্তের হোলিখেলা,
ওঠো সোজা হয়ে, পায়ে পায়ে লাগে ঠেলা
দেখ, ভিড় দেখ স্বাদীনতালুব্ধের।
ফাল্গুন মাস, ঝরুক জীর্ণ পাতা।
গজাক নতুন পাতারা, তুলুক মাথা,
নতুন দেয়াল দিকে দিকে হোক গাঁথা–
জাগে বিক্ষোভে চারিপাশে ক্ষুব্ধের।
হ্রদে তৃষ্ণার জল পাবে কত কাল?
সম্মুখে টানে সমুদ্র উত্তালঃ
তুমি কোন্ দলে? জিজ্ঞাসা উদ্দামঃ
‘গুণ্ডা’র দলে আজো লেখাও নি নাম?
দুরাশার মৃত্যু
দ্বারে মৃত্যু,
বনে বনে লেগেছে জোয়ার,
পিছনে কি পথ নেই আর?
আমাদের এই পলায়ন
জেনেছে মরণ,
অনুগামী ধূর্ত পিছে পিছে,
প্রস্থানের চেষ্টা হল মিছে।
দাবানল!
ব্যর্থ হল শুষ্ক অশ্রুজল,
বেনামী কৌশল
জেনেছে যে আরণ্যক প্রাণী
তাই শেষে নির্মূল বনানী।।
0 comments: