কী লিখবো ভেবে পাচ্ছি না। কয়েকদিন ধরে অবসাদ আর উদ্যমহীনতায় মন ভারাক্রান্ত; চিন্তাশক্তি আড়ষ্ট। চেষ্টা করেও কলমের গতি বাড়ানো কষ্টকর হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন একটা অদৃশ্য শক্তি বারবার আমাকে বাধা দিচ্ছে। অতীত সামনে আসছে আর বলছে, এ জাতির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অন্ধকার। মনে পড়ছে ১৯৬৩ সালের কথা। মাসের কথা মনে নেই। মরহুম মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর মৃত্যু দিবস উপলক্ষে তমদ্দুন মজলিস বায়তুল মোকাররম মার্কেটের ৩২নং কক্ষে (১৬নং ছিল ইসলামী পাবলিকেশন্সের শো রুম) একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। প্রধান আয়োজক ছিলেন ব্যরিস্টার মোস্তফা কামাল (পরে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত), তার সহযোগী ছিলেন কবি ফারুক মাহমুদ। প্রধান অতিথি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। খ্যাতনামা সাহিত্যিক-সাংবাদিক (তখন জাহানে নাও পত্রিকার সম্পাদক) জনাব আবদুল মান্নান তালিবসহ এই আলোচনা সভায় যোগদানের লক্ষ্যে সেখানে হাজির হয়েছিলাম।
বিকাল ৩টায় সভা শুরু হবার কথা ছিল। প্রধান অতিথি যথাসময়ে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু শ্রোতা ছিল না। বিকাল ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে যখন অনুষ্ঠান শুরু হলো তখন উদ্যোক্তা-শ্রোতা-বক্তা মিলিয়ে সেখানে আমরা মাত্র ১১ জন। কুরআন তেলাওয়াত ও ব্যরিস্টার মোস্তফা কামালের সূচনা বক্তব্যের পর প্রধান অতিথি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন এবং অত্যন্ত রাগত স্বরে বললেন, ‘মোস্তফা কামাল, তুমি আমাকে কোথায়, কেন নিয়ে এসেছ? তুমি কি আমাকে দেখাতে চেয়েছ আমার মৃত্যুর পর তোমরা যখন শোক সভা করবে তখন কত লোক হাজির হবে?’ তিনি দুঃখ করে বললেন, মাওলানা ইসলামাবাদী একজন প্রতিভাবান আলেম ও রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিক ছিলেন। উপমহাদেশের মুসলমানদের সমস্যার সমাধান ও দুঃখ-কষ্ট নিবারণে তার অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। তার সাথে অনেকের মতবিরোধ থাকতে পারে কিন্তু তাই বলে আল্লাহ তাকে যে প্রতিভা ও সামর্থ্য দিয়েছেন এবং তিনি মানুষের যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন তা তো অস্বীকার করা যায় না। তিনি উদাহরণ দিয়ে বললেন যে, ভারতবর্ষে যখন হিন্দুদের ১৯টি প্রভাবশালী দৈনিক মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন খবর প্রচার ও তাদের স্বার্থবিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল, তখন মাত্র ১৩ পয়সার সম্বল নিয়ে তিনি তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার জন্য দৈনিক সুলতান প্রকাশ করেছিলেন। তার উদ্যোগ বিত্তশালী মুসলমানদের উজ্জীবিত করে তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল। আজ তার স্মরণ সভায় শ্রোতা-উদ্যোক্তা-বক্তা মিলে ১১ জনের উপস্থিতি কিসের আলামত? ড. শহীদুল্লাহ আক্ষেপ করে বললেন, যে দেশে গুণী লোকের কদর নেই সেই দেশে গুণী লোকের জন্ম হয় না; আল্লাহ তাদের পাঠান না। যেমন, যে বাজারে ভাল জিনিস বা পণ্য বিক্রি হয় না সে বাজারে ভাল জিনিস উঠে না। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য।
ড. শহীদুল্লাহর কথাগুলো বারবার আমার কানে প্রতিধ্বনিত হয়। দুর্ভাগ্যবশত দেশের বিদ্যমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের দেশ থেকে গুণের কদর সম্পূর্ণভাবে উঠে গেছে। গুণের সার্বজনীন সংজ্ঞা আমরা হারিয়ে ফেলেছি, সর্বজনগ্রাহ্য এমন কোনও ব্যক্তিও নেই যাকে গুণী বলা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রা. এর একটি মূল্যবান উক্তি আছে। উক্তিটি হচ্ছে- “যখন দেখবে দরিদ্ররা ধৈর্য্যহারা হয়ে পড়েছে, ধনীরা কৃপণ হয়ে গেছে, মূর্খরা মঞ্চে ও ক্ষমতার মসনদে বসে আছে, জ্ঞানীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে এবং শাসকরা মিথ্যা কথা বলছে; তখন বুঝবে একটি দেশ ও সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে।” আমাদের বর্তমান সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে পাঠকরা কি বলতে পারেন যে আমরা এখনো ভাল আছি এবং নষ্ট হয়ে যাইনি?
Anthony Storr একজন নামকরা চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উইনচেস্টার কলেজ ও ক্রাইস্ট কলেজে তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা শেষ করে মানসিক চিকিৎসায় (Psychiatry) বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে দীর্ঘকাল Runwell Mental Hospital এবং মডসলি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। তার লিখিত Human Aggression বইটি পাঠক মহলে অত্যন্ত সমাদৃত। মনোবিজ্ঞানের এই খ্যাতনামা চিকিৎসকের মতে, দুনিয়াতে এ যাবত বিচরণকারী নৃশংস আচরণ ও নিষ্ঠুর-নির্মম প্রাণীদের মধ্যে আমরাই হচ্ছি সর্ব নিকৃষ্ট। তার ভাষায়, “The Sombre fact is that we are the cruellest and most ruthless species that has even walked the earth.” মানুষ বিপদে পড়লে, অত্যাচারিত হলে, কাউকে গুম বা খুন করলে অথবা বিনা দোষে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হলে এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে যে উল্লাস পরিলক্ষিত হয়, পশুর মধ্যেও তা দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে ড. এন্থনি স্টর মানুষের তুলনায় পশুকে অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তবে সকল মানুষ নয়, কিছু মানুষ যাদের তিনি Psychopath হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং যারা Psychosis বা মানসিক বিকৃতিতে ভোগেন। এরা মানুষকে কষ্ট দিয়ে, তাদের দুঃখ-দুর্দশা উপভোগ করেন। আবার এরা যদি ক্ষমতার মসনদে থাকেন তাহলে গোটা জাতিই তাদের নির্মমতার শিকার হয়।
একটি পশু আরেকটি পশুর উপর নিষ্ঠুরতা চালিয়ে তার দুঃখ দেখে আনন্দ উপভোগ করে না- এই কথাটি বলতে গিয়ে তিনি বিড়ালের ইঁদুর শিকারের প্রসঙ্গটি তুলে এনেছেন। তার পুস্তকের দশম অধ্যায়ে Paranoid Hostility শীর্ষক নিবন্ধে তিনি বলেছেন- “In our brief review of agression in other species we concluded that even animals which prey upon one another do not rejoice in cruelty for its own sake. The cat playing with the mouse before it suddenly kills it, is behaving as it would with any small moving object which gives an opportunity of exercizing its skill in catching and pouncing. It is inconceivable that a cat could so identify itself with a mouse as to enjoy. The latters fear. Yet men, with hatred in their hearts take pleasure in prolonging their agonies of helpless victims and show extreme ingenuity in devising tortures which cause the maximum pain and the minimum risk of a quick ending.”
এখানে তিনি বলতে চেয়েছেন একটি পশু অন্য পশুকে শিকার করে এবং শিকার করতে গিয়ে তার প্রতি কঠোর হয়, তাকে যন্ত্রণা দেয় এবং ভীত সন্ত্রস্ত্র করে। কিন্তু পরাজিত পশুর ভীতি ও যন্ত্রণা কিংবা তার মৃত্যুতে সে উল্লসিত হয় না। কিন্তু মানুষ মানুষের উপর নির্যাতন করে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে এবং অসহায় ব্যক্তির উপর নৃশংসতা প্রলম্বিত করে আনন্দ পায়। যেমন আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধীদের উপর আঘাত করে, তাদের পরিবার সদস্য ছেলেমেয়েদের গুম ও হত্যা করে আনন্দ পাই।
শুরুতেই বলেছি মানসিক অস্থিরতা ও অবসাদের কারণে লেখার সাবলীলতা হারিয়ে ফেলেছি এবং যা লিখছি তা অনেকের কাছেই অসংলগ্ন প্রলাপের মতো মনে হবে। সমাজে যখন মানবিক মূল্যবোধের দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে তখন কোন কোন ক্ষেত্রে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম নেতা ও ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তা ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জনাব মীর কাসেম আলীকে প্রদত্ত মৃত্যুদ- গত শনিবার রাত সাড়ে দশটায় কাশিমপুর কারাগারে আদালতের রায় অনুযায়ী ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয়। জনাব মীর কাসেম আলী অনন্য প্রতিভার অধিকারী চির সবুজ, জনদরদী, সর্বাবস্থায় একজন হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তি ছিলেন। প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের অধিকারী তার মতো দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি কিনা আমার মনে পড়ে না। স্বাধীনতা-পূর্বকালে সাংবাদিকতার পাশাপাশি ঢাকার তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজে (বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) আমি অধ্যাপনা করতাম। ঐ সময়ে অধ্যাপক নূরুদ্দীন নামে কুমিল্লা জেলার কোনও একটি কলেজের একজন অধ্যাপকের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দফতরে আমার পরিচয় হয় এবং কালক্রমে এই পরিচয় গভীরতর হয়। স্বাধীনতা-উত্তর কালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়ার পর ১৯৭২ সালের শেষের দিকে কুমিল্লা একাডেমিতে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণকালে অধ্যাপক নূরুদ্দীনের সাথে কুমিল্লা শহরে আমার যোগাযোগ হয় এবং তিনি একদিন তার শ্বশুর বাড়ি আমাকে নিয়ে যান। তার শ্বশুর ছিলেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তার বাসাতেই জনাব মীর কাসেম আলীর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় এবং জানতে পারি যে তিনি জনাব নূরুদ্দীনের শ্যালক। তিনি তখন সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অথবা ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার সাথে কথাবার্তা বলে তার মেধা, আদব-কায়দা ও বুদ্ধিমত্তার যে পরিচয় পেয়েছি তাতে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। এরপর দীর্ঘকাল জনাব মীর কাসেমের সাথে আমার দেখা হয়নি। চাকরি উপলক্ষে নোয়াখালী ও সিলেট ঘুরে ১৯৮১ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেচ প্রকল্পে আমি ডেপুটেশনে নিয়োগ পাই এবং গহিরা শান্তির দ্বীপে ছিল আমার আবাসিক দফতর; নিচে অফিস, উপরে বাসভবন। ঐ সময়ে একদিন হঠাৎ করে মীর কাসেম আলী কয়েকজন সহকর্মীসহ আমার অফিসে উপস্থিত হন। আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি তখন রাবেতার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং ঐ প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চল ও কক্সবাজার এলাকায় হাসপাতাল ও অন্যান্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত ছিলেন। জনপ্রশাসন ও জেলা-উপজেলার জাতি গঠনমূলক বিভাগ ও এজেন্সিগুলোর ব্যাপারে তিনি খুবই উৎসুক ছিলেন এবং কিভাবে সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে জনকল্যাণ ত্বরান্বিত করা যায় এ বিষয়েই তিনি আমার সাথে বেশিরভাগ আলাপ-আলোচনা করতেন। তার সাথে ১৯৮৩ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাবার আগ পর্যন্ত আমি দু-তিনবার রাঙ্গামাটিও গিয়েছিলাম এবং সার্কিট হাউজে অবস্থানকালে জনসেবার ব্যাপারে তার দর্শন, কর্মপরিকল্পনা ও পদ্ধতি প্রভৃতি সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছি। এতে তার শিশুসুলভ মন, মানুষের প্রতি তার দরদ, দায়ী ইলাল্লাহ হিসেবে দায়িত্ববোধের পরিচয় পেয়েছি। যুব সমাজের জন্য তাকে আমার একজন রোল মডেল বলেই মনে হয়েছে। ১৯৮৬ সালে বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর আমার ঢাকাতে পোস্টিং হয় এবং এখানে আসার পর তার সাথে বহুবার আমার Interaction হয়েছে। Islamic Economics Research Bureau-তে অন্যদের সাথে তার গতিশীল নেতৃত্ব ও অসামান্য পরিশ্রম বাংলাদেশে সুদবিহীন একটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও ফলপ্রসূ পরিচালনার ক্ষেত্রে তার অনন্য ভূমিকা ছিল। তিনি প্রচুর লেখাপড়া করতেন এবং যখন আলোচনা বক্তব্যে বিভিন্ন অথরিটিকে কোট করতেন আমি বিস্মিত হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম। বাংলাদেশের বঞ্চিত কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তার উদ্বেগ ছিল লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশ সরকারের সাবেক শিক্ষা সচিব জনাব ইরশাদুল হক যখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন তখন জনাব কাসেমের উদ্যোগে তার নেতৃত্বে তিনি একটি ফোরাম গঠন করেছিলেন। ঐ ফোরামের আমিও সদস্য ছিলাম। তার উদ্যোগ, উদ্যম, সাহসী ভূমিকা এবং দরদী মন অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন, ইবনে সিনা হাসপাতাল, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, ইসলামী ব্যাংক টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, রাবেতা ওয়ার্কশপ প্রভৃতি তার অনন্য কীর্তি। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি যে পরিশ্রম করেছেন তা কল্পনা করা যায় না। এগুলো তিনি নিজের জন্য গড়ে তোলেননি, তুলেছেন জনগণের খেদমতের জন্য, দেশ-বিদেশে বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য। পাঠকদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, সারা দুনিয়ায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকানার কিছু ধরন প্রকৃতি আছে। যেমন Individual Ownership (ব্যক্তি মালিকানা), Partnership (অংশীদারিত্ব ভিত্তিক মালিকানা) এবং Joint Stock Company (যৌথ মূলধনী কোম্পানি)। আবার যৌথ মূলধনী কোম্পানিও দু’ধরনের হয়। একটি প্রাইভেট লিমিটেড আরেকটি পাবলিক লিমিটেড। জনাব মীর কাসেমের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ব্যাংকিং কোম্পানির অধীনে রেজিস্ট্রিকৃত এবং দক্ষ ও সঙ্গতিসম্পন্ন একটি ব্যাংক যা প্রতিবছর জাতীয় কোষাগারে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব প্রদান করে; এই ব্যাংকটির শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃস্টান সকলেই আছেন এবং এখনো পর্যন্ত ব্যাংকটি দুর্নীতিমুক্ত; সরকারি ও কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংক যেখানে ডাকাতের আস্তানায় পরিণত হয়েছে এই ব্যাংকটি সেখানে সততার রোল মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। দিগন্ত টেলিভিশন, নয়া দিগন্ত পত্রিকা, ইবনে সিনা হাসপাতাল, ফার্মাসিউটিক্যাল, ট্রাস্ট, ব্যাংক ফাউন্ডেশনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অডিট হয়, সরকারি পরিদর্শন হয়। দুর্মুখরা বলে বেড়ান এগুলো তার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান এবং তিনি লাখ লাখ কোটি টাকার মালিক। আমি প্রতিষ্ঠানগুলোর রিপোর্ট রিটার্ন, আয় ও ব্যয় বিবরণী এবং অডিট প্রতিবেদন অধ্যয়ন করে পূর্ণ দায়িত্বশীলতার সাথে বলতে পারি যে, এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মীর কাসেম আলী অথবা তার পরিবার অথবা জামায়াতের অর্থ নেয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। বরং বিভিন্ন চাপ দিয়ে সরকারই বিভিন্ন তহবিলে তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রত্যেকটিই লাভজনক, কারণ এখানে সৎ ও যোগ্য লোকের সংখ্যাই বেশি। এ জন্য জনাব কাসেমকে পুরস্কার দেয়া সরকারের জাতীয় কর্তব্য ছিল। কিন্তু তারা তা করেননি। মীর কাসেমের পারিবারিক অবস্থা জানলে অনেকেই অবাক হবেন। আগামী কুরবানিতে গরু কেনার জন্য তার পরিবারের হাতে কোনো অর্থ নেই। তিনি ও তার পরিবার যে বাড়িটিতে থাকতেন বা থাকেন, সেই বাড়িটি অনেক পুরাতন যার মধ্যে আধুনিকতার কোনো ছাপ নেই। দুপুরে বহুদিন আমি তাকে চিড়া আর কলা দিয়ে লাঞ্চ সারতে দেখেছি। আমি আশ্চর্য হই অনেকগুলো পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল তাকে ধনকুবের বলে আখ্যায়িত করে। সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে রাজপ্রাসাদের ছবিসহ অনেক ধনকুবের তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল, অনেকের বিরুদ্ধে ট্যাক্স ফাঁকির অভিযোগ উঠেছিল। কই মীর কাসেমের কথা তো তখন উঠেনি? এখন গুজব তোলা হচ্ছে কেন? এই মিথ্যা গুজবে সরকারও অংশ নিচ্ছেন কেন? মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাক্ষ্য প্রমাণহীন অভিযোগে তাকে ফাঁসি দেয়ার অভিযোগ করেছেন তার আইনজীবী। যে সময়ে এই অপরাধ সংঘটনের কথা বলা হচ্ছে সে সময় মীর কাসেম নামক ছেলেটির বয়স ছিল সর্বোচ্চ ১৮ থেকে ১৯ বছর। ঐ সময়ে অথবা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তার এই অপরাধের কথা শোনা যায়নি, ২০১৪ সালের আগেও নয়। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম অথবা দেশের অন্য কোথাও কোনো থানায় বা আদালতে মামলা হয়নি।
তিনি যদি অপরাধই করে থাকেন তাহলে ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেন কিভাবে? স্বাধীনতা-উত্তরকালে তার কাজের জন্য তাকে পুরস্কার দিতে পারলেন না, সন্দেহজনক প্রমাণ ও সাক্ষীর ভিত্তিতে ফাঁসি দিলেন। আদালত তার বিবেচনায় এটিকে ন্যায় বিচার মনে করেছেন। ভাল কথা। কিন্তু ফাঁসির রায় কার্যকর করার আগে তার আইনজীবী ছেলেটিকে গুম করে দিয়ে সাদা পোশাকের লোকেরা যে অপরাধ করেছে তার বিচার কি হবে? আমার দৃষ্টিতে মীর কাসেমের ফাঁসি হয়নি। তিনি শহীদ হয়েছেন। আকাশ থেকে একটি নক্ষত্রের পতন হয়েছে।
ড. মোঃ নূরুল আমিন
0 comments: