ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবির


প্রারম্ভিকা
"তোমাদের মাঝে এমন একটি দল থাকবে যারা মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকবে, সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।"- আল-কুরআন।

মানব সভ্যতার ইতিহাস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যেখানে অন্ধকার সেখানে আলোর মশাল নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন স্রষ্টার দূত। অন্যায়, অনাচার, পাপাচার, অসত্য, সুন্দর ধরাকে করেছে কর্দমাক্ত, কলুষিত ও বিষাক্ত তখনই মহামহিম আল্লাহর অপার করুণাময় রহমতের বারি বর্ষিত হয়েছে ধ্বংসোন্মুখ জাতির ওপর।

সেই বারিধারা হযরত আদম (আ) এর মাধ্যমে শুরুহয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত নবুওয়ত নামক পন্থায় প্রবাহিত হয়েছে। তারই অমিয় ঝর্ণাধারা অদ্যাবধি প্রবাহমান। জান্নাতের সেই রহমতের আবেহায়াতে অবগাহন করতে সময়ের কতিপয় জিন্দাদিল মর্দে মুজাহিদ পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি কাফেলা লক্ষ তরুণের প্রাণের স্পন্দন, মুক্তির মোহনা, সত্যের ঠিকানা সেই জান্নাতি কাফেলার নাম 'বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির'। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে যার যাত্রা শুরুহয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি। মানুষ গড়ার আঙিনা তথা শিক্ষাঙ্গনে প্রকৃত মানুষ গড়ার যে গুরুদায়িত্ব সামনে রেখে এ কাফেলার যাত্রা শুরুহয়েছে অযুত বাঁধার পাহাড় ভেদ করে আজও তা সেই লক্ষ-পানে ছুটে চলছে নিরলস-ভাবে। ছাত্র সমাজকে জাহান্নামের পার্শ্বদেশ থেকে কুরআনের আহ্বান জানিয়ে সরিয়ে এনেছিল এ কাফেলা। কর্মীদের ত্যাগ-কুরবানী, জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিষ্পেষণ, আহত-পঙ্গুত্ব ও শাহাদাত বরণের বিনিময়ে আজ এ কাফেলা পরিণত হয়েছে মুক্তিকামী মানুষের একমাত্র আশা আকাঙ্ক্ষার স্থল, দিশেহারা তারুণ্যের একক অবলম্বন।

সভ্যতা, জ্ঞান, আলো ও প্রগতির কথিত সূতিকাগার যখন চুড়ি বর্ম বালা পরিহিত তরুণদের বিষাক্ত ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত ছিল, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ ধর্মনিরপেক্ষতা আর সর্বহারার মতবাদ যখন কুরে কুরে খাচ্ছিল কোমলমতি জ্ঞান-তাপস ছাত্র সমাজের মগজ, যখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি ছিল না, ছিল না শান্তি স্বস্তি আর স্বকীয়তা। অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন আর সাংস্কৃতিক গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করার সকল আয়োজন সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে তখনই হেরার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে এ জাতির কতিপয় শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের শ্রম, ঘাম আর ত্যাগের বিনিময়ে গাঢ় তমসার বুক চিরে উদিত হয় নতুন সূর্য, জাতি দেখতে পায় আশার আলো।

স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি অনেকাংশে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করলেও স্বাধীনতা উত্তর ছাত্ররাজনীতি অস্ত্র, সন্ত্রাস আর পেশী শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়ে চরম নেতিবাচক ও বিধ্বংসী ধারায় নেমে পড়ে। ভারতীয় সেবাদাস আওয়ামী চক্রের লুন্ঠন আর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের বিরোধিতা করতে গিয়ে যে জাসদের জন্ম হয়, তারাও এক সময় সন্ত্রাস ও পেশীনির্ভর হয়ে পড়ে। ছাত্র আন্দোলনের একটি ধারা হয়ে পড়ে ক্ষমতাসীন দলের শিখণ্ডী। বড় বড় ছাত্র সংগঠনসমূহের আদর্শিক দেউলিয়াপনা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নৈতিক অবক্ষয়, সাংগঠনিক বিপর্যয়, কর্মসূচিহীনতা তথা সামগ্রিক অন্তঃসারশূন্যতা শিক্ষাঙ্গনে গাঢ় অমানিশার সৃষ্টি করে। সেই তমসার বুক চিরে এই কাফেলার আবির্ভাব ঘটে।

শিবির প্রতিষ্ঠার ইশতিহারে এই সংগঠনের উদ্ভব ও তার লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়।:

"এ দেশের তরুণ ছাত্র সমাজের কাছে ইসলামের শাশ্বত আলো পৌঁছে দেয়ার এক মহান দায়িত্ব পালন করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের যাত্রা শুরুহলো। চমক লাগানো সাময়িক কোন উদ্দেশ্য হাসিল নয়, বরং শোষণ-বঞ্চনার শিকার এদেশের সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই আমাদের ব্রত। আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (সা:) প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী আমরা ছাত্রদের চরিত্র গঠন করতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, জাতীয় জীবনে সকল অনৈতিকতা ও অমানবিকতার উৎস হচ্ছে বর্তমান ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা। তাই জাতির জন্য উপযুক্ত নাগরিক ও নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন করতে শিবির বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক নানাবিধ সমস্যা লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশের অন্তরায়। আমরা ছাত্র সমাজের দাবি দাওয়া আদায়ে গঠনমূলক ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াসী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের সর্ব পর্যায়ে যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক শোষণ, সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ন্যায় অবাঞ্ছিত অবস্থা বিরাজ করছে এর উৎস অনুসন্ধান করা অপরিহার্য। সমস্যাপীড়িত এই পৃথিবীর ইতিহাসের সত্যিকার রায় হচ্ছে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ছাড়া শান্তির আশা সুদূর পরাহত। তাই ইসলামী ছাত্রশিবির একটি সুখী, সুন্দর ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে তার সকল প্রচেষ্টা নিয়োগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।"

১৯৭৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন জনাব মীর কাসেম আলী এবং সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন ডঃ আঃ বারী। কমিটিতে আরও ছিলেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, বাশারাত হোসেন, মুহাম্মদ আলী, এনামুল হক। কেন্দ্রীয় সংগঠন ঘোষণার কিছুদিন পরই ঢাকা মহানগরীতে সংগঠন কায়েম করা হয়।এর পর শুরুহয় সারাদেশব্যপী আহ্বায়ক কমিটির সদস্যদের সফর। জেলা, মহানগর ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ ঘুরে ঘুরে আহ্বায়ক কমিটি সংগঠন কায়েম করে। এ পর্যায়ে আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়।

মে মাসের ৪, ৫ ও ৬ তারিখে ঢাকায় সারাদেশের প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিনিধিবর্গই সংগঠনের প্রথম কার্যকরী পরিষদ সদস্য হিসাবে বিবেচিত হন।

১০, ১১, ১২ ডিসেম্বর '৭৭ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন। সম্মেলনের সফলতা কামনা করে দেশ ও বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ শুভেচ্ছাবাণী প্রদান করেন।

১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসের সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মীর কাসেম আলীর ছাত্রজীবন শেষ হয়ে গেলে নতুন কেন্দ্রীয় সভাপতি হন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সেক্রেটারী জেনারেল মনোনীত হন মুহাম্মদ আবু তাহের।

১৯৭৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর ঢাকার হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত হয় শিবিরের দ্বিতীয় সম্মেলন। সম্মেলন উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রুহুল ইসলাম। সম্মেলনের সফলতা কামনা করে শুভেচ্ছা বাণী প্রদান করেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আঃ সাত্তার, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, চবির ভিসি আবদুল করীম, জাবির ভিসি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ঢাকা পৌরসভার চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত প্রমুখ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের কার্যক্রম
সারাদেশের ছাত্র সমাজ চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছিল এ ধরনের কাফেলার। সাড়া পড়ে গেল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া,দেশের প্রতিটি অলিতে গলিতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউটে হাজার হাজার তরুণ যোগ দেয় এই কাফেলায়। গঠিত হয় এই কাফেলার বিভিন্ন ইউনিট। ঢাকা মহানগরী ইউনিট গঠিত হয় মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সভাপতি ছিলেন এ টি এম আজহারুল ইসলাম।

স্বাধীনতা দিবস পালনঃ
ইসলামী ছাত্র শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কর্তৃক ১৯৭৭ সালের ২৬ মার্চ মধুর ক্যান্টিনে স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভায় কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।

হলে হলে কমিটি গঠনঃ
প্রতিটি হল শাখায় সাধারণ সভা করে হল অডিটোরিয়ামে শিবিরের কমিটি ঘোষণা করা হয় এবং সাধারণ ছাত্রদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়।

বিভিন্ন কর্মসূচী পালনঃ
কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হল মসজিদ, অডিটোরিয়াম, ক্লাসরুম সহ বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে কর্মসূচী পালন করা হত। সদস্য বৈঠক, দায়িত্বশীল বৈঠক প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হত বেশিরভাগ সময়ে শহীদুল্লাহ হল মসজিদে।

ভাস্কর্য নির্মাণের বিরুদ্ধে শিবিরঃ
ছাত্রশিবির ব্যাপকভাবে সত্যান্বেষী ছাত্র সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে। পাশাপাশি অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের আদর্শ, উদ্দেশ্য, কর্মসূচী ও কর্মীদের মানের তুলনা করে দলে দলে এ সংগঠনে যোগদান শুরুকরে। শিক্ষক সুধী সমাজে স্বস্তির ছাপ লক্ষ্যকরা যায়। সত্য মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের অনিবার্য বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় শিবিরের কর্মতৎপরতার সাথে সাথে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থান করার অর্বাচীন সিদ্ধান্ত হয়। যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ রদ পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের সান্তনা ও ক্ষতিপূরণ হিসাবে, যে বিশ্ববিদ্যালয়কে শান্তিনিকেতনের দাদা বাবুরা মক্কা-ফাক্কা-ঢাক্কা বলে তুচ্ছ জ্ঞান করত, যে বিশ্ববিদ্যালয়কে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় বলে উপহাস করত, আর যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান যুবসমাজকে জ্ঞানের আলো দান, স্বজাতিত্ব, স্বকীয়তা ও মুসলিম কৃষ্টি-কালচার, শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চাসহ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার নিমিত্তে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম-রাম সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ধারক মূর্তিপূজার চর্চা শুরুহবে, শিবির এ বিষয় মেনে নিতে পারেনি। এই অন্যায়, অনাচার ও পাপাচারের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিবিরের জিন্দাদিল মুজাহিদ ভাইয়েরা স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান শুরুকরেন এবং বিবৃতি প্রদান করেন। স্বাক্ষর সংগ্রহ করাকালীন সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন ও জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীদের নেতৃত্বে শিবির কর্মীদের ওপর আক্রমণ পরিচালিত হয়।

১৯৭৭ সালের ২৮ আগস্ট

ঘাতক ফ্যাসিস্ট চক্র শিবির নেতা ফরহাদ ভাই ও আঃ আওয়াল ভাইকে অপহরণ করে মুহসীন হলে নিয়ে যায়। এ দুজনের উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হচ্ছিল। এ খবর দ্রত ছড়িয়ে পড়ে। ঐ সময় মোহাম্মদপুর কলেজে শিবিরের জেলা সভাপতি ও সেক্রেটারিদের লিডারশীপ ট্রেনিং চলছিল। শহীদুল ইসলাম ভাই এ খবর টি,সি তে পৌঁছালে মীর কাসেম আলী ভাই উপস্থিত দায়িত্বশীল ভাইদের আহবান জানান ঐ দুজন অপহৃত ভাইকে উদ্ধার করার জন্য। আজহার ভাইয়ের নেতৃত্বে ১৫ জনের ১টি গ্রু প বের হলেন ডাকসু ভবন, মধুর কেন্টিন, লেকচার থিয়েটার হয়ে সূর্যসেন হল ও রেজিষ্টার বিল্ডিং এর মাঝ পথ দিয়ে মহসীন হলের দিকে, অপর গ্রু পটি আবুল কাশেম হায়দার ভাইয়ের নেতৃত্বে কলাভবনের সামনে দিয়ে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও ভিসির বাড়ির সামনের রাস্ত্মা দিয়ে মহসীন হলের মাঠে অবস্থান নেন। এই গ্রু পে সদস্য সংখ্যা ছিলেন ১০ জন। এই গ্রু পের উদ্দেশ্য ছিল জহুরুল হক হল থেকে যেন সন্ত্রাসী হামলা পরিচালিত হতে না পারে। এই গ্রুপের উপর হামলা চালালে আবুল কাশেম হায়দার ভাই মারাত্মকভাবে আহত হন এবং তাঁকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে সন্ত্রাসীচক্র চলে যায়। ওদিকে আজহার ভাইয়ের নেতৃত্বধীন গ্রুপ মহসীন হলের গেটে পৌঁছলে সন্ত্রাসীরা কলাপসিবল গেট আটকে দেয়। গেট খেলার জন্য চেষ্টা করলে শিবির কর্মীদের সাথে সংর্ঘষ হয় এবং শিবির কর্মীরা ফিরে আসে কেন্দ্রীয় মসজিদে। সন্ত্রাসীরা মসজিদের ভিতরে না ঢুকলেও বাইরে থেকে ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারে। অপহৃত দুজন ভাই গেস্টরুমেই বন্দী ছিলেন, বিষয়টি না জানা থাকার কারণে উদ্ধার কাজে বিঘ্ন ঘটে। পরে আবদুত্তাওয়াব নামক এক ভাইয়ের সহায়তায় তারা দুজন মুক্ত হন।

তখন আজহার ভাই, বাচ্চু ভাই, মঞ্জু ভাই, আক্কাস ভাই, শহীদুল ইসলাম ভাই, হায়দার ভাই, শাহজালাল চৌধুরী ভাই, হালিম ভাই (ইফা), বজলুর রশীদ ভাই, আনিসুজ্জামান, আলমগীর, আকরাম হোসেন প্রমুখ ছুটে চলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ঐ দিন ছিল মাহে রমজান ও শুক্রবার। গাঁদা গাছের ডাল নিয়ে অগ্রসরমান এই কাফেলার পিছু ফিরে তাকাবার কিছুই ছিল না। লক্ষ্যছিল আত্মার আত্মীয় পরম প্রিয় অপহৃত দ্বীনি ভাইদের উদ্ধার করা। কিন্তু হায়েনার রক্ত পিসাসা তখনও মেটেনি। জাসদ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে মানুষরূপী জানোয়ারের দল ঝাঁপিয়ে পড়ে এই উদ্ধার কর্মীদের ওপর। সূর্যসেন হলের কাছাকাছি পৌঁছামাত্র ইট, সুরকী, রামদা, বল্লম নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে তথাকথিত প্রগতিবাদী মানবতাবাদী ও সভ্যতার নামে বর্বরতার ধারকগন। ওরা মুহসীন হলের কলাপসিবল গেট আটকে দিয়ে শিবির কর্মীদের মারপিট শুরু করে। জীবন বাজি রেখে শিবির কর্মীরা উদ্ধার করে আনতে চেষ্টা করে তাদের প্রিয় ভাই ফরহাদ ও আব্দুল আওয়ালকে। এরই মাঝে আব্দুল আওয়াল ভাইয়ের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায় হায়েনার ছোবলে। আহত হন ২০/২৫ জন শিবির কর্মী। মহসীন হল থেকে ফিরে আসার সময় সূর্যসেন হল থেকে কিছু সন্ত্রাসী শিবির কর্মীদের উপর ইট পাটকেল নিক্ষেপসহ হামলা করতে উদ্যত হলে শিবির নেতা রেজাউল করিম শফিক সূর্যসেন হলের কলাপসিবল গেট আটকাতে চেষ্টা করেন এবং এ সময় তাকে বটি দিয়ে আঘাত করা হয় এবং তিনি মারাত্মক ভাবে আহত হন।

শিবির কর্মীরা মসজিদে নামাজ পড়তে প্রবেশ করলে ওরা মসজিদের গেট বন্ধ করে দেয় এবং ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। তারপর আমাদের ভাইয়েরা কেউ কেউ আলীয়া মাদ্রাসায় প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করেন আর অন্যেরা মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।


ডাকসু ১৯৭৯
স্বাধীনতা পরবর্তীকালের প্রথম বৈধ স্বীকৃত ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। সে নির্বাচনে শিবির তাহের-কাদের পরিষদ নাম নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রশিবির ব্যাপকভাবে ছাত্রছাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। শিবিরের সৃশৃঙ্খল কার্যক্রম, নৈতিক বলিষ্ঠতা রুচিশীল বক্তব্য জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তোলে। এ নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার বেশ কিছুদিন পূর্ব থেকে শিবির সাময়িকভাবে প্রকাশ্য কার্যক্রম স্থগিত রাখে। নির্বাচনী কার্যক্রমের মাধ্যমে শিবির পুরোদমে প্রকাশ্যে কার্যক্রম শুরু করে। কলাভবন থেকে টি.এস.সি হয়ে সাইন্স এনেক্স ভবন ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মাঝামাঝি রাস্তা দিয়ে যখন শিবিরের বিশাল নির্বাচনী মিছিল অতিক্রম করছিল তখন মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রত্বে সন্ত্রাসী চক্র মিছিলে হামলা করে। শিবির এ হামলা বলিষ্ঠতা ও দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করে। ফলে সাধারণ ছাত্রদের মাঝে আরো বেশি আস্থা অর্জিত হয়। এ নির্বাচনে শিবিরের প্যানেল ভোট ছিল ১০০০ (এক হাজারের মত)। আবদুল কাদের ভাই জি এস পদে ১৪০০ ভোট পেয়েছিলেন। এ নির্বাচনে ডাকসুতে একটি আসনসহ এস এম হলে সাহিত্য সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে শিবির মনোনীত প্যানেলের ওমর ফারুক বিজয়ী হন।

ডাকসু ১৯৮০

নিয়মতান্ত্রিক গঠনমূলক আন্দালনের ধারক ও বাহক ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে সচেষ্ট হয়। ১৯৮০ সালে ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলে এনাম কাদের পরিষদ ঘোষিত হয় শিবিরের পক্ষ থেকে। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ হলে হলে শিবিরের তৎপরতা ও পরিচিতিকে আরো ব্যাপকতর করে তোলে। প্রতিটি ছাত্রের কাছে শিবিরের দাওয়াত পৌঁছাতে ইসলামের শাশ্বত সুন্দর কৌশল অবলম্বন করা হয়। শিবিরের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হয়ে পড়ে ছাত্রসমাজ। নির্বাচনে শিবিরের প্যানেল ভোট আরো বেশি বেড়ে যায়। কাজের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায় ইসলামের জন্য।

১৯৮২ সালের ডাকসু নির্বাচন: বোমা হামলা
১৯৮২ সালের গোড়ার দিকে ক্যাম্পাসে ইসলামী দাওয়াতের দ্রুত প্রসার ঘটছিল। বাতিল শক্তির গাত্রদাহের কারণ হলেও ইসলামের সৌন্দর্য সাধারণ ছাত্রদেরকে ব্যাপক হারে আকৃষ্ট করছিল। এরই মাঝে কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। শিবির ঘোষণা করলো এনাম কাদের পরিষদ। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন রং বেরংয়ের পোষ্টার লিফলেট প্রকাশসহ ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল। ইসলামের শাশ্বত আদর্শ ও মূল্যবোধকে সামনে রেখে ছাত্রশিবির শুরু করল আকর্ষণীয় প্রচারণা। চারিদিকে রব পড়ে গেল শিবির হয়তো অনেকগুলো পদে বিজয়ী হবে। এ ধরনের জল্পনা কল্পনার মাঝ দিয়ে এগুতে থাকল নির্বাচনী আবেশ। প্রচারণা শেষ হবে ২১ জানুয়ারি রাত বারটায়। সকল সংগঠন শেষ মুহূর্তের প্রদর্শনী আর প্রচারণার উৎসবে মাতোয়ারা। সর্বাপেক্ষা দীর্ঘ মিছিলটি জসীম উদ্দিন হল, সূর্য সেন হল ও মহসীন হল পার হয়ে নীলক্ষেতগামী রাস্ত্মা ধরে এফ আর হলের গেটের সামনে এসে পৌঁছে। ক্ষুদ্রাকার ঐ হলে তখন অন্য দুটো ছাত্র সংগঠনের মিছিল থাকায় দীর্ঘতর এই মিছিলের কর্মীরা কুরআনে শেখানো ধৈর্য আর প্রজ্ঞা ব্যবহার করে ফটকের বাইরে সামনের রাস্ত্মায় অপেক্ষা করতে থাকে। সবার মুখে নির্বাচনী গান ও শ্লোগান।
ঘড়ির কাটা রাত দশটার সময় সংকেত দিচ্ছিল। হটাৎ বিকট দুটো শব্দের আওয়াজ কানের পর্দা নাড়িয়ে দিল। সামান্য নীরবতা আর সাথে সাথেই নারায়ে তাকবীরের ধ্বনি। চারিদিকে ধোয়াটে অন্ধকার। তাজা রক্ত। তোফাজ্জল ভাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। জামাকাপড় ছেড়া, সমস্ত শরীর রক্তাক্ত। সাইফুল্লাহ ভাইয়ের পা ঝুলছে, মাংস থেতলে গেছে। মুজাহিদ, নাইম, মতিউর রহমান মল্লিক, আতাউর রহমান,আবুল কালাম,আবদুল হাই,শেখ মহিউদ্দিন,মোঃ মাকসুদুর রহমান, খালেদ, জামাল উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, মনোয়ার ফিরোজ আলম, আঃ হালিম, আঃ মান্নান, মোঃ লাকমান, সোলায়মান, এম এ রহীম,সারোয়ার হোসেনসহ আহতদের শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে ঝরতে থাকে রক্তের প্রবাহ। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নীলক্ষেতের কালো পীচঢালা রাজপথ তাদের রক্তে ভেসে যায়। রিক্সা, গাড়ি আর ট্রলিতে করে আহতদের দ্রু ত হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা চলছিল। সমগ্র হাসপাতালে বিভীষিকাময় দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। এক একটা ট্রলি যাচ্ছে আর রক্ত আগাগোড়া তার ক্ষতচিহ্ন একে দিচ্ছে। ডাক্তার নার্স আর ছাত্রদের ছুটাছুটিতে হাসপাতল প্রকম্পিত।

এদিকে শিবিরের মিছিলটি বিক্ষুব্ধ রূপ ধারণ করে নিউ মার্কেট এলাকা হয়ে নিউ এলিফ্যান্ট রোডস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সমবেত হয়। একটু পরেই সিদ্ধান্ত হলো ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবন অভিমুখে যাওয়া হবে।

বিক্ষুব্ধ মিছিলটি ঘটনার তদন্তের দাবিতে ভিসির বাসভবনের সামনে আসলে পুলিশ গতিরোধ করে। নেতৃবৃন্দ কর্মীদেরকে শান্ত হয়ে ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থানের নির্দেশ প্রদান করেন। অবশেষে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের মাঝে ভিসি এসে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের আশ্বাস দেন। সমবেত ছাত্রজনতাকে শান্ত ও আশ্বস্ত করতে বক্তব্য রাখেন শিবিরের সভাপতি এনামুল হক মনজু। তোফাজ্জলের বাম পা, সাইফুল্লার ডান পা আর নাইম আহমদের ক্ষত বিক্ষত মাথা দেখে যখন ধৈর্য্যচ্যুতি ছিল স্বাভাবিক, তখনও নেতার নির্দেশ মানতে দ্বিধা করেনি আদর্শবাদী এ কাফেলার সৈনিকগণ।

মূহুর্তের মধ্যে এক নারকীয় ঘটনার সংবাদ সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ ঢাকা মহানগরীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

 সর্বস্তরের লোকজন ছুটে আসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দিকে। শোকাহত দর্শনার্থীদের ভিড় সামলানো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। মুমূর্ষরুপে আহত ভাইদের জন্যে রক্ত দিতে এগিয়ে আসেন দীনি ভাইয়েরা। সভ্যতার তথাকথিক সূতিকাগারে এ পাশবিক জিঘংসার রূপ দেখে বিবেক হয়ে পড়ে স্তম্ভিত ও হতবাক।

রাত সাড়ে বারটায় ভাইস চ্যান্সেলর সমস্ত ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে বসেন। এ ঘৃণ্য কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। তদন্ত কমিটি গঠন ও পরদিন শুক্রবার বিশ্বদ্যিালয়ের বটতলায় ভাইস-চ্যান্সেলরের সভাপতিত্বে ছাত্র-শিক্ষক কর্মচারীদের যৌথ সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে শিবির নেতৃবৃন্দ ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পূর্ব নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মতামত দেন। ফলে নির্বাচনের তারিখ বলবৎ থাকে।

পরদিন শুক্রবার সকল দশটায় ভিসি ফজলুল হালিম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এক নজিরবিহীন প্রতিবাদ সভা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছরের ইতিহাসে সেটিই প্রথম এবং শেষ সভা যা একজন ভিসির সভাপতিত্বে বটতলায় অনুষ্ঠিত হয়। বটতলায় দাঁড়িয়ে শুধু ভিসিই বক্তব্য রাখেননি, ক্লাস ছেড়ে ছুটে এসেছেন সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী, অফিস ছেড়ে চলে এসেছেন কর্মকর্তা কর্মচরারী ভাই বোনেরা। ছাত্রজনতার ঢল নেমেছিল সেদিন। শোকের কালো পর্দা ছিড়ে স্লোগান উঠে তোফাজ্জল ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে পারেনা, সাইফুল্লাহ ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে পারেনা।

সাইফুল্লাহ ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ভাইস চ্যান্সেলর নিজেই ছিলেন এ ধরনের ব্যতিক্রমী সভার আহ্বায়ক।

সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির তৎকালীন সভাপতি ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়া, কর্মচারী সমিতির এস. এম. শফিউর রহমান পান্না, জাসদ ছাত্রলিগের মনির উদ্দিন, ছাত্রলীদের ওবায়দুল কাদের সমিতির আবদুল্লাহ তারেক, বিপস্নবী ছাত্রমৈত্রীর আতাউর রহমান ঢালী সহ ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ১৯টি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

সমাবেশে ৩৫ জন শিবির কর্মীর আহত হবার প্রতিবাদ, দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানসহ বিশ্ববিদ্যালয়কে সন্ত্রাস ও অস্ত্রমুক্ত করার জন্য সকলেই ঐক্যবদ্ধ শপথ গ্রহণ করেন। সমাবেশে ভিসি ফজলুল হালিম চৌধুরী বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য এসে হাত পা হারাতে হলে এখানে আমার বা অন্য কারো থাকার প্রয়োজন নেই।

তিনি বলেন, শুধু জাতীয় ক্ষেত্রে নয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জ্ঞান বিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবদান ও সুনাম রয়েছে তা অক্ষুন্ন রাখতে হলে এ ধরনের পরিস্থিতি রোধে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ছাত্রদের এগিয়ে আসতে হবে।

প্রমাণ করতে হবে তারা অন্যায় ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্যথায় এ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন স্বল্প সময়ের নোটিশে এ সমাবেশে বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষকের উপস্থিতিতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এ জাতীয় ঘটনা আমরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘটতে দিতে পারি না। এ জন্য ছাত্র সংগঠনগুলোকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।

নিন্দা ও প্রতিবাদঃ
ইসলামী ছাত্র শিবিরের শান্তিপূর্ণ মিছিলে ন্যাক্কারজনক বোমা হামলার প্রতিক্রিয়ায় সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত শেস্নাগান আর মিছিলের রেশ ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সংগ্রামী চট্টলা। শহর শাখা শিবিরের উদ্যোগে মিছিল বের হয় মুসলিম হল থেকে। চাকসুর নেতৃত্বে মিছিল বের হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে। বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকেও বের হয় অনুরপ মিছিল।

এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের আমীরে শরীয়ত মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজী হুজুর, আই ডি এল এর চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রহীম, জাগপার আহবায়ক আনিসুর রহমান, সর্বদলীয় ইসলামী সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ক্যাপ্টেন (অব:) আঃ রব, ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না, নবনির্বাচিত ভিপি আখতারুজ্জামান, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন বাবুল, ছাত্রফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহবায়ক আখতার হোসেন, ছাত্রলীগের প্রধান কাজী আবদুল্লাহ আল মাসুদ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদরের সভাপতি গোলাম সরওয়ার মিলন। জামাতের সেক্রেটারি জেনারেল শামছুর রহমান, নগর জামায়াতের তৎকালীন আমীর ও সেক্রেটারী যথাক্রমে মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ প্রমুখ। বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ওয়াকিল আহমদ বলেরন, এ ধরনের সন্ত্রাসের নিন্দাই শুধু করিনা এ সবের অবসানও কামনা করি।

আহতদের প্রতিক্রিয়াঃ
আল কুরআনের নিশান বরদার কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের ডাকসু নির্বাচনোত্তর মিছিলে অংশ নিতে এসে পা হারান তোফাজ্জল হোসেন। তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়ার পূর্ব রাতেই বাম পা অপরেশন থিয়েটারে নিয়ে কেটে ফেলতে হয়েছিল। ডান পা ও আঘাতে ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত। তার প্রতিক্রিয়া ছিল আমি ভাল আছি, কারো কারো অবস্থাতো আমার চেয়েও অনেক বেশি খারাপ। তাদের জন্য খারাপ লাগছে। পা হারানোর জন্য আমি দুঃখিত নই।

 আপনি বিশ্বাস করুন আর নাই করুন আমি এতে খুশীই হয়েছি। আল্লাহর পথেতো তেমন কিছুই করতে পারি নি। ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আমার এ পা হারানোর যদি সামান্য কুরবানী হিসাবে আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় তাতেই আমার সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা। চোখে মুখে অত্যন্ত দৃঢ়তা ফুটিয়ে তোফাজ্জল বললেন- ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুগে যুগে অসংখ্য মানুষ যে বিরাট কোরবানী করেছেন, রক্ত ঢেলেছেন, তার তুলনায় আমার ঘটনা অতি তুচ্ছ। যখনি কোথাও ইসলামকে উত্থিত হতে দেখা গেছে বাতিল শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে তা রুখতে চেষ্টা করেছে। প্রত্যয়ী কন্ঠে তিনি বললেন, আমাদের রক্তদান ইনশাআল্লাহ বৃথা যাবে না। আজীজ, মোহাম্মদ, সাইফুল্লাহ, নাইম, আহমদ, শেখ মহীউদ্দীন, খালেদ, সাইফুল্লাহ, একরাম, হোসনে মুজাহিদ, সারওয়ার হোসেন, মতিউর রহমান মল্লিকসহ হাসপাতলের বেডে শয্যাশায়ী মারাত্মকভাবে আহত অন্যান্যদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে প্রায় একই ধরনের মন্তব্য উচ্চারিত হয়। সাইফুল্লাহ বললেন- পা হারিয়ে আমার দুঃখ নেই। শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও মনের দিক থেকে আমি দুর্বল নই।

এত লোমহর্ষক ও হৃদয় বিদারক ঘটনার পরপরই অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র শিবির ডাকসুতে ১টি সদস্যপদ লাভ করে। এছাড়া মহসীন হল ছাত্রসংসদে ৪টি, এস এম হলে ১টি, এফ এইচ হলে ১টি আসন লাভ করে এবং ভোটের কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। ডাকসুতে সদস্য পদে হাবিবুর রহমান নামে একজন ভাই নির্বাচিত হন। শিবিরের প্যানেল থেমে মহসীন হলের ছাত্র সংসদে পাঠকক্ষ সম্পাদক পদে রাশেদুজ্জামান ভাই, নাট্য সম্পাদক পদে নুরুদ্দিন রেজা ভাই, সাহিত্য সম্পাদক পদে মহীউদ্দিন পান্নু ভাই এবং কার্যকরী কমিটির সদস্য পদে মোশাররফ হোসেন ভাই নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালের ৬ ফেব্রু য়ারি বটতলায় বিশাল প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সামরিক শাসনামলঃ
১৯৮২ সালে লে.জে. হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার পর জাতীয় রাজনীতির সাথে সাথে নেমে আসে ছাত্র রাজনীতিতেও নিষেধাজ্ঞা। ছাত্র শিবির কুরআনের কাজ করতে নিষেধাজ্ঞাকে ভ্রু ক্ষেপ করতে পারে না। তাই শববেদারী কুরআন ক্লাস, স্টাডি ক্লাস প্রভৃতি প্রোগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শিবিরের বলিষ্ঠ কর্মসূচী ছিল। ঐ ইস্যুতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও সংগ্রামী ছাত্রজোট এর সাথে যুগপৎ কর্মচসূচী পালন করে। এরশাদ যখন হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ বন্ধ ঘোষণা করে সংগঠনের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি পেশ করা হয়। ছাত্র রাজনীতি থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হলে আবার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়।

কুরআন বাজেয়াপ্তকরণ মামলার বিরুদ্ধে কর্মসূচীঃ
কলকাতা হাইকোর্টে কুরআন শরীফ নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত মামলা দাযের করা হলে সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সাময়িক শাসন উপেক্ষা করে প্রতিবাদ মিছিল বের করে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। এক পর্যায়ে পুলিশ পুরো মিছিল ঘিরে ফেলে এবং মিছিলে লাটিচার্জ এর শুরুকরলে তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ডাঃ য়ৈদ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের (সাবেক এম.পি) সহ বেশ ক'জন ভাই আহত হন। মিছিলের একাংশ বায়তুল মোকাররম পৌছলে সেখানেও পুলিশ ব্যারিকেড দেয় এবং মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু শিবিরের ভাইয়েরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি আবদুস সাত্তার ভাইয়ের নেতৃত্বে সেই মিছিল ভারতীয় দুতাবাস ঘেরাও করে এবং স্মারকলিপি।

ভর্তির কাজে সহায়তা
১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুদের জন্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভর্তি গাইড " ফোকাস" এর নিয়মিত প্রকাশনা শুরুহয়। শুরুহয় আনুষ্‌ানিকভাবে " ফোকাস কোচিং" এর কার্যক্রম।

১৯৮৪ সালে ফোকাস গাইড বিক্রি করতে গেলে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে কিছু বামসংগঠনের কর্মী বাধার সৃষ্টি হয়। পরবর্তী বছর ১৯৮৫ সালে শিবির বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা ছাত্রদের ভর্তি কার্যক্রম সহায়তা করতে গেলে কিছু সংখ্যক জ্ঞানপাপী বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী শিবির কর্মীদের উপর অতর্কিতে হামলা চালায় এবং বেশ কিছু ভাই আহত হন।

১৯৮৭ সালে চট্টগ্রামে হাফেজ আবদুর রহীম সহ কয়েজন ভাই শহীদ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদের ঝড় ওঠে কায়েমী স্বার্থবাদী তথাকথিত প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ তখন সামরিক শাসনের বিরোধিতা করলেও শিবিরকে সহ্য করতে চায়নি।

১৯৮৭ সালে চারুকলা ইনষ্টিটিউটের সামনে শিবিরের মহা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সামরিক সরকার ও কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রে ও যোগসাজশে সৃষ্ট সাংগঠনিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগে যায় ৪/৫ বছর। ১৯৮৮ সালে দিকে এ সমস্যা উত্তরণের পরপরই শুরুহয় আরেক ষড়যন্ত্র। ইসলাম বিরোধী সকল ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে একযোগে শিবিরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, অত্যাচার, নির্যাতন, যুলুম ও সন্ত্রাস পরিচালনা করতে থাকে। শুরুহয় হলে হলে নির্যাতনের নতুন অধ্যায়। অসংখ্যা ভাইয়ের রুম পোড়ানা বাইখাতা-পত্র নোট জ্বালিয়ে দেয়া, দাঁড়ি রাখা, নামাজ পড়া আর কুরআন পড়ার অপরাধে নিরীহ নিরপরাধ শিবির নেতা-কর্মীদের হল থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটছিল অহরহ। এ পর্যায়ে জহুরুল হক হলের সাথী আফজাল ভাইয়ের কাছে থেকে ছাত্র কল্যাণের টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং তাঁর পা ভেঙ্গে দেয়। বর্তমানে তিনি পটুয়াখালী কলেজে অধ্যাপনারত। মহসীন হলের আবুল কাশেম ফজলুল হক ভাইকে মারাত্মকভাবে আহত করে। (তিনি) বর্তমানে বেলাবো কলেজে আছেন) এস.এম. হলের ইফতার পার্টিত হামলা করে। ১৯৮৯ এর ডাকসু নির্বাচনের মিছিলে কলাভবনের সামনে হামলা করে। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে জামিল আখতার রতন নিহত হবার পর উদোরপিগিু বুদোর ঘাড়ে চাপানোর হীন কৌশল হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির কর্মীদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হয়। সকল প্রকার অসংঘর্ষ সংগাত এগিয়ে চলার নীতি অবলম্বন করে শিবির শিক্ষা বৈঠক, পাঠচক্র, আলোচনা চক্র শববেদারী প্রভৃতি কার্যক্রম চালিয়ে যায়। প্রভোস্ট, ভিসিসহ শিক্ষকবৃন্দ এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ শিবিরকে সর্বোচ্চ শৃঙ্খলাবদ্ধ সংগঠন হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং হলের বিভিন্ন প্রোগ্রামে উপস্থিত হয়ে শিবির কর্মীদেরকে উৎসাহিত করে চট্টগ্রামে জাফর জাহাঙ্গীর, বাকি উল্লাহর শাহদাতের প্রতিবাদে সর্বশেষ বড় মিছিল বের করে।

১৯৮৯ সালে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কবীর নামক একজন ছাত্র নিহত হওয়ার পর তারা আবার শিবির বিরোধী সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং হলে হলে ন্যাক্কারজনক শিবিরবিরোধী ফ্যাসিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হয। তথাপি ৯০এর সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শিবির আপোষহীন ভূমিকা পালন করে।


ডাকসু ১৯৮৯
দীর্ঘ সাত বছর পর ১৯৮৯ সালে আবার ডাকসু নির্বাচনে তফশিল ঘোষিত হল। শিবিরের পক্ষ থেকে ঘোষিত হয়। শামছু-আমিন-মুজিব পরিষদ। এ নির্বচানে শিবিরের অংশগ্রহন এবং স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় খুবই বাধাগ্রস্থ হতে হয়। তেমন বেশি মিছিল-মিটিং করা যাযনি। গ্রুপভিত্তিক এবং ব্যক্তিগতভাবে নির্বচানী প্রচারনা পরিচালিত হয়। প্যানেল ভোট পড়ে এক হাজারের বেশি। এ নির্বাচনে মুজিববাদী ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন সংগ্রামী ছাত্র ঐক্য প্রায় ৮০০০ মত ভোট পেয়ে বিজয়ী হয় এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ৭০০০ মত ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়।


ডাকসু ১৯৯০
এনির্বাচনে তফসিল ঘোষিত হলে শিবির ঘোষণা করে আমিন-মুজিব-হেলাল পরিষদ। এ সময় বাতিল পন্থীদের রক্তচক্ষু আরো হিংস্র আকার ধারন করে। হলে হলে শিবির কর্মীগণ আতংকে দিনাতিপাত করতে হত। শিবিরের ভিপি প্রার্থী ও তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি ডাঃ আমিনুল ইসলাম ডাকসু ক্যাফেটোরিয়া চা পান করতে গেলে হামলা করে অশুভ শক্তি। পরে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি শফিকুল আলম হেলাল সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে প্রক্টর অফিসে আনা হয়। এ নির্বচানেও শিবিরের ভোটপ্রাপ্তি বেড়ে যায়। এবং সুষ্পষ্টভাবে তৃতীয়স্থান অধিকারী ছাত্র সংগঠন হিসাবে স্বীকৃতি হয়। ছাত্রদলের আমান-খোকন পরিষদ ৭০০০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়। ছাত্র লীগ ৩০০০ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় এবং শিবির দেড় হাজার মত ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান দখল করে এবং জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের চেয়ে শিবিরের সমর্থন বেশি একটি সুষ্পষ্ট হয়ে পড়ে। এমনি ভাবে বর্ষিষ্ণু শক্তকে বরদাস্ত করে পারল না ক্ষয়িষ্ণু বাতিল শক্তিগুলো। তারা সিদ্ধান্ত নিল মরণ কামড় দেয়ার। কিন্তু তাদের মৃত্যু তরান্বিত হল।

১৯৯১-৯৬
১৯৯১ সালের ২৭ মে ভিসি. মনিরুজ্জামান মিঞা সন্ত্রাস বিরোধী সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় কৃষি মন্ত্রী ও আমীরের জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী তৎকালীন জাতীয় সংসদের জামায়াত সংসদীয় দলের নেতা ও সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে আমন্ত্রিত হয়ে ভিসির সম্মলন কক্ষে আগমন করে কিন্তু ছাত্রলীগ, জাতীয় ছাত্রলীগ, জাসদ চাত্রলীগ, ছাত্রফ্রন্ট ও ছাত্র ইউনিয়নের কতিপয় জ্ঞানপাপী সন্ত্রাসী জনাব মতিউর রহমান নিজামীর ওপর আক্রমণ করলে ছাত্রশিবির নেতৃবৃন্দ জীবনবাজী রেখে মেহমানকে উদ্ধার করেন।

ছাত্রলীগ নামধারী এই সন্ত্রাসীরা চামচ, কাঁচের প্লেট, গ্লাস বোতল ইত্যাদি ভেঙ্গে মুহতারাম নিজমীর উপর আক্রমণ চালায়। ভিসি এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের কে অনুনয় বিনয় করে নিবৃত্ত করতে চাইলেও পুলিশী অ্যাকশন বাধা দিয়েছেন। জনাব নিজামী মাথাসহ সারা শরীরে মারাত্মকভাবে আহত হন। অল্পের জন্য তাঁর জীবন রক্ষা পায় বলে চিকিৎসকবৃন্দ জানান। এই গভীর সংকটাপন্ন মুহুর্তে শিবির নেতা কামালুদ্দীন, কবীরুল ইসলাম, আবু ইউসুফ, আঃ কাদের প্রমুখ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র নামধারী হায়েনাগণ অনেক দিন রাত ঠান্ডা প্রতিরোধে হোগলা বা খড় ব্যবহার করেও আন্দোলনের এই অকুতোভয় সৈনিকদের মুখ কখনও মলিন হয়নি। ১৯৯২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তথাকথিত গণ আদালত নামক নাট্যমঞ্চ স্থাপিত হওয়ার পর হলগুলোতে শুরুহয় নতুন তান্ডব। হলের গেস্টরুম বা ছাদে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো নামাজী সহজ-সরল ছাত্র পেলেই। সিগারেট আর মদ পান করতে দেয়া হত পরীক্ষা হিসাবে। এ দুটো অনারাসে পান রতে না পারলে শিবির সন্দেহ করে মারধর করার চেষ্টা চলত। ১৯৯২ সালে বিশ্বিবিদ্যালয় শাখা শিবিরের সেক্রেটারি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কৃতী ছাত্র আবু ইউসুফকে পিঠে ছুটিরকাঘাত করে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা।

উদোরপিন্ডি বুদোর ঘাড়ে
১৯৯৩ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র মৈত্রী কর্মী জুবায়ের চৌধুরী রিমুর দুঃখজনক মৃত্যু ঘটলে ছাত্র মৈত্রীসহ সকল ছাত্র সংগঠনের কর্মীবৃন্দ শিবিরের উপর পৈশাচিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উদোরপিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোর চিরাচরিত কৌশল অবলম্বন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন হল থেকে শিবির কর্মীদের উচ্ছেদ করা শুরুকরে। ২০ সেপ্টেম্বর এসএম হল থেকে বের করে দেয়া হয় শিবির নেতা মুবিনুল ইসলাম ও সাদেকুর রহমাকে। শহীদুল্লাহ হল থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর বের করে দেয়া হয় হল সেক্রেটারি মন্‌জু ও আমিনুল রহমানকে। একই দিনে এফ এইচ হল থেকে বের করে দেয়া হয় শিবির নেতা জি এম সাইফুর রহমান ও সাইফুল ইসলামকে। মহসিন হল থেকে বের করে দেয়া হয় হামিদুল্লাহকে। সুর্যসেন হল থেকে বের করে দেয়া হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রাশেদ, দর্শনের আনিসুর রহমান ও লোক প্রশাসনের রেজাউল করীমকে। মুজিব হল থেকে শামছুদ্দোহা জিহাদ সহ কয়েকজনকে বের করা হয়। ২০ সে্প্টেম্বরের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। সেখানে দাড়ি টুপিওয়ালা বা নামাজী ছাত্র দেখা যেতো সেখানেই পাশবিক ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া হতো। আরবি-স্ট্রাডিজের ছাত্রসহ সন্দেহভাজন অনেককেই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। সন্দেহবশত অমুসলিম শশ্রুমন্ডিত ছাত্রকেও প্রহার করা হয়। বের করে দেয়া হয় শিবির নেতা মোশারফ হোসেন মাসুদকে। এজন্যই এক স্বনামধন্য কবি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনকে ডাকাতদের গ্রাম বলে আখ্যায়িত করতে বাধ্য হয়েছেন।

এর আগে ১৩ই জুলাই ১৯৯৩ এস এম হলের তৎকালীন সভাপতি ইমামুদ্দীন কিরণকে বের করে দেয়া হয় শিক্ষা সফরের আয়োজন করার অপরাধে। তার সাথে আরো বের করা হয় চট্টগ্রাম মহসিন কলেজের সাবেক ভিপি ও এস.এম. হলের তৎকালীন সেক্রেটারী মহিউদ্দিন মুকল, হাফিজুর রহমান, আবদুল হালিম ফারুক, তোফাজ্জল হোসেন কে। ২০০১ সালে ছাত্রলীগ ক্যাডার সাইফুল মুজিব হলে অপহরণ করে নির্যাতন চালায় মাসুদ রেজার উপর এই নির্যাতন চালায় মাসুদ রেজার উপর। এই নির্যাতন শুরুর সাথে সাথে ডিসি আজাদ চৌধুরী প্রক্টর নুরুন্নবীসহ প্রভোস্টকে জানানোর পরও তেমন কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। শুধুমাত্র ইসলাম চর্চা আর কুরআন শিক্ষার অপরাধ ছাড়া অন্যান্য ঘটনার সময় অবশ্য প্রশাসন তেমন নীরব ছিল না।

বর্তমান অবস্থা
শত সহস্র জুলুম নির্যাতন করার পারঙ্গমতা প্রদর্শন করলেও ক্ষমতার পালাবদলে আওয়ামী পেটোয়া বাহিনী ছাত্রলীগ আজ আর কোন হলেই দৃশ্যমান নয়। অন্যান্য বাম ছাত্র সংগঠনের অবস্থাও নিবু নিবু প্রায়ছাত্রলীগ ৪ বছর পর কমিটি ঘোষণা করলেও ক্যাম্পাসের বাইরে এবং মধুর কেন্টিনে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। বামসংগঠনগুলো বহিরাগতসহ ২৫/৩০ জনের মিছিল, দেয়াল লিখন আর ইস্যু ভিত্তিক কিছু আন্দোলন করার চেষ্টা করলেও জনপ্রিয়তা প্রায় শুন্যের কোঠায়।

উপসংহার:
সত্যের সংগ্রামে যে ফুল ফুটেছিল ১৯৭৭ সালে ৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র মসজিদ আঙ্গিনায় তা আজ সুগদ্ধি ছড়িয়ে-বিমোহিত করছে কেটনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার ভূখন্ডের প্রতিটি শহর-নগর, গ্রাম-গঞ্জ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসাসহ সর্বত্র। লক্ষ লক্ষ তরুণ আজ কুরআনের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার আশায় এগিয়ে আসছে এ কাফেলা পানে।। সকল ছাত্রসংগঠন আদর্শহীনতা, মেধাহীনতা ও সন্ত্রাস নির্ভরতার কারণে ক্রম ক্ষয়িষ্ণু হিসাবে অস্তিত্বের সংকটে ভূগতে থালেও নিবির ক্রমবর্ধিষ্ণু এক আদর্শিক কাফেলা হিসাবে দ্রুততার সাতে লক্ষ্যপানে ছুটে চলছে। ১৯৮৯ এবং ১৯৯০ এর ডাকসুতে যথাক্রমে শামছু-আমিন-মুজিব ও আমিন-মুজিব-হেলাল পরিষদ গড়ে সহস্রাধিক ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে থাকলে বর্তমানে শিবির অন্যতম প্রধান ছাত্র সংগঠন হিসাবে পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় কয়েকগুন বেশি ছাত্রেদের প্রিয় কাফেলা হিসাবে কুরআনের আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি হলে শিবিরের রয়েছে শক্তিশালী সংগঠন। অন্য কোন ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম হলগুলোতে খুব কমই দৃশ্যমান হয়। ক্ষমতাসীন দলে ছাত্রসংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় ও হল কমিটিসমূহ মেয়াদোত্তীর্ণ। দেশের সীমা ছাড়িয়ে এর সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। আজ আবু জাহল-আবু লাহাবের উত্তরসূরী বাতিল-পন্থীদের গাত্রদাহ সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আল্লাহর সৈনিকদের এই কাফেলার অগ্রগতি রুখতে কারো সাধ্য নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সেই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে শিবির। কেননা আল্লাহ বলেন,

"তারা ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায় আল্লাহ নূরকে, কিন্তু আল্লাহ তার নূর প্রজ্জ্বলনে পরিপূর্ণতা বিধান করবেন।"

গ্রন্থনায়: মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামান ভূঁইয়া,
সাবেক সেক্রেটারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।


১৯৭৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী এই কাফেলার প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন জনাব মীর কাশেম আলী এবং সেক্রেটারী জেনারেল মনোনীত হন . আব্দুল বারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন জনাব টি এম আজহারুল ইসলাম এবং সেক্রেটারী মনোনীত হন জনাব আব্দুল কাদের বাচ্চু

সেই খেকে এই কাফেলার পথ চলা। আজো চলছে সে তার আপন গতিতে। ইতোমধ্যেই সেদিনের সেই ছোট্ট কাফেলা পরিনত হয়েছে শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জিবীত দেশপ্রেমিক এক মহাকাফেলায়।

১৯৭৭ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি সেক্রেটারীবৃন্দ:

সন
সভাপতি
সেক্রেটারী
১৯৭৭
এটিএম আজহারুল ইসলাম
আব্দুল কাদের বাচ্চু
১৯৭৮ (জুন)
আবুল কাশেম হায়দার
এটিএম আজহারুল ইসলাম
১৯৭৭-৭৯
আবদুল কাদের বাচ্চু
নজরুল ইসলাম খাদেম
১৯৭৯-৮০
আবদুল কাদের বাচ্চু
আশেক আহমদ জেবাল
১৯৮০-৮১
আশেক আহমদ জেবাল
সুলতান আহমদ
১৯৮১-৮২
আশেক আহমদ জেবাল
সুলতান আহমদ (আংশিক)
জাকির হোসেন (আংশিক)
১৯৮২-৮৩
.বি.এম. আঃ সাত্তার
মহীউদ্দিন
১৯৮৩-৮৪
.বি.এম. আঃ সাত্তার
মজিবুর রহমান
১৯৮৪-৮৫
মুজিবুর রহমান
আবুল হোসাইন
১৯৮৫-৮৬
মুজিবুর রহমান
বনি আমিন
১৯৮৬-৮৭
মুজিবুর রহমান
বনি আমিন
১৯৮৭-৮৮
মুজিবুর রহমান
শফিকুল আলম হেলাল (আংশিক)
রাশেদুজ্জামান (আংশিক)
১৯৮৮-৮৯
শফিকুল আলম হেলাল
আমিনুর রহমান
১৯৮৯-৯০
আমিনুর রহমান
আবু ইউসুফ
১৯৯০-৯১
আমিনুর রহমান
আবু ইউসুফ
১৯৯১-৯২
আমিনুর রহমান
আঃ মালেক
১৯৯২-৯৩
আমিনুর রহমান (অক্টোবর)
মোশারফ হোসেন মাসুদ
আঃ মালেক (আংশিক)
আনিসুর রহমান
১৯৯৩-৯৪
মোশারফ হোসেন মাসুদ
আনিসুর রহমান
১৯৯৪-৯৫
মোশারফ হোসেন মাসুদ
আনিসুর রহমান
১৯৯৫-৯৬
আনিসুর রহমান
আখতার হোসেন মজুমদার
১৯৯৬-৯৭
আনিসুর রহমান
আখতার হোসেন মজুমদার
১৯৯৭-৯৮
আখতার হোসেন মজুমদার
মুবিনুল ইসলাম
১৯৯৮-৯৯
আখতার হোসেন মজুমদার
.এস.এম. আশরাফ মাহমুদ উজ্জ্বল
১৯৯৯-২০০০
.এস.এম. আশরাফ মাহমুদ উজ্জ্বল
এফ. কে. এম. শাহজাহান
২০০০-২০০১
এফ.কে. এম. শাহজাহান
মোঃ জাহিদুর রহমান
২০০১-২০০২
মোঃ জাহিদুর রহমান
মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামান ভূইয়া
২০০২-২০০৩
মোঃ জাহিদুর রহমান
মিয়া মো: তরুন (আংশিক)
মো: বেলাল হোসেন (আংশিক)
২০০৩-২০০৪
মো: বেলাল হোসেন
শিশির মো: মনির
২০০৪-২০০৫
শিশির মো: মনির
মো: আকতার হোসেন
২০০৫-২০০৬
মো: আকতার হোসেন
মীর্যা গালিব
২০০৬-২০০৭
মীর্যা গালিব
মো :আবু তালিব (আংশিক)
ষোবায়ের আহমেদ ভ্থঁইয়া (আংশিক)
২০০৭-২০০৮
ষোবায়ের আহমেদ ভ্থঁইয়া
মু: বেলাল হোসাইন (আংশিক)
আনিসুর রহমান (আংশিক)
২০০৮-২০০৯
ষোবায়ের আহমেদ ভ্থঁইয়া
আনিসুর রহমান
আনিসুর রহমান
শফীউর রহমান
২০০৯-২০১০
আনিসুর রহমান
ওবায়দুল ইসলাম (আংশিক)
মহব্বত আলী (আংশিক)
২০১০-২০১১
মহব্বত আলী
মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন
২০১১-২০১২
মহব্বত আলী
শাহ মো: মাহফুঅুল হক (জুন)


from Dhaka University Branch website (link)

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম