এই মহামনীষীর জন্ম ১৯৩০ সালে। বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানাধীন পাখিয়ারটিলা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত দ্বীনদার পরিবারে। দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় যখন তিনি ভর্তি হন তখন তাঁর বয়স মাত্র ১০ বছর। ওই বয়সেই কিছু দিনের ব্যবধানে তিনি তার মা-বাবাকে হারান। তিনি পরম আত্মত্যাগ ও খোদাপ্রদত্ত মেধা, সদাচার, লেখাপড়ায় একাগ্রতার মাধ্যমে একাধারে ১০ বছর এখানেই অতিবাহিত করেন। একই সঙ্গে যুগশ্রেষ্ঠ ওস্তাদগণের স্নেহ-ভালোবাসা এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কৃতিত্বের সঙ্গে ধর্মীয় বিষয়াদিতে ব্যুত্পত্তি অর্জনে সক্ষম হন। এই নবী প্রেমিক সংগ্রামী বুজুর্গের বাল্য, প্রাথমিক ও উচ্চতর শিক্ষার স্তরটা ছিল খুবই অভিনব ও সমৃদ্ধ ঘটনায় ভরপুর। শিক্ষা অর্জনের অদম্য বাসনা নিয়ে ১৩৭১ হিজরি সনে ছুটে যান ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে। সেখানে তিনি চার বছর অবস্থান করে দাওরায়ে হাদিস, ফুনুনাতে আলীয়া, দাওরায়ে তাফসির কোর্সে অধ্যয়ন করেন। দেওবন্দে অধ্যয়নকালে তিনি যাঁদের সংস্পর্শে ধন্য হন, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় শায়খুল আরব ওয়াল আজম, যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, জ্ঞান ও খোদাভীতির সুউচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার, আওলাদে রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানীর (রহ.) নাম। ওই বয়সেই তিনি এই মহামনীষীর হাতে বায়আত গ্রহণ করে তিনি খুব কম সময়ের মধ্যে খেলাফতপ্রাপ্ত হন। ইলম, আমল ও আধ্যাত্মিকতায় ধন্য আল্লামা আহমদ শফী দা.বা. একাধারে চার বছর বিরামহীন অধ্যয়ন ও বিশ্ববিখ্যাত ওস্তাদগণের খেদমত ও তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণের মাধ্যমে হাদিস, তাফসির, ফিকাহশাস্ত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যুত্পত্তি অর্জন করে যুগের অন্যতম মুহাদ্দিস প্রজ্ঞাবান বুজুর্গ আল্লামা মাদানির ইল্মী ও আমলী প্রতিনিধি হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে শিক্ষক হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন। খোদা প্রেমের এই মহান অভিযাত্রী তাঁর কর্ম জীবনের সূচনা করেন এখান থেকেই। তার অধ্যাপনার সুনাম এবং সুখ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। চাতকের মতো ছুটে আসতে শুরু করে তাঁর দরসে হাজার হাজার ছাত্র।
১৪০৭ হিজরিতে হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালকের গুরুদায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়। বর্তমানে মহাপরিচালকের পাশাপাশি শায়খুল হাদিসের দায়িত্বও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সুচারুভাবে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন, মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা উপমহাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর ইলম ও প্রজ্ঞার উত্স থেকে অনুপ্রেরণা লাভকারী ছাত্র, শিষ্য, মুরিদ ও অনুসারী। এদের সংখ্যা বর্তমানে সম্ভবত লাখ লাখ ।
মুসলিম উম্মাহর এই ত্যাগী, সংগ্রামী, শিক্ষানুরাগী বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক আল্লামা শাহ্ আহ্মদ শফী দা.বা. জীবনের শুরু থেকে শিরক, বিদআত ও যাবতীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই করে যাচ্ছেন। তাঁর আবেগঘন, জ্বালাময়ী ও সারগর্ভ বক্তব্য শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখে গভীর রাতে দুনিয়াবাসী যখন থাকে গভীর নিদ্রায় বিভোর, ঠিক সেই মুহূর্তে আল্লাহপ্রেমিক এই মানুষটি নিদ্রা ত্যাগ করে দাঁড়িয়ে যান জায়নামাজে এবং একান্ত নির্জনে বসে আদায় করেন বিভিন্ন ধরনের অজিফা। কায়মনোবাক্যে দোয়া করেন দেশের জন্য, মুসলিম উম্মাহ্র জন্য।
আল্লামা শাহ্ আহ্মদ শফী দেশের শীর্ষ আলেমে দ্বীন হিসেবে আগে থেকেই সুপরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে নাস্তিক ব্লগারচক্রের বিষাক্ত থাবা যখন ইসলামের ভিত্তিমূলে আঘাত হেনে উপর্যুপরি দ্বীনকে ক্ষত-বিক্ষত করছে, তখনই গর্জে ওঠেছেন প্রায় ৯০ বছর বয়সী বীর চট্টলার এই সিংহপুরুষ। তাঁর এই গর্জন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকম্পিত হয়ে ওঠেছে বাংলার আকাশ-বাতাস। এই সংগ্রামী বীর সিপাহসালারকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দীর্ঘ সুস্থ হায়াত দান করুন। আমীন!...
আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এক
কাঁকর বিছানো পথ, কত বাধা, কত সমুদ্র-পর্বত। কত চক্রান্ত, কত ষড়যন্ত্র। কত মিথ্যাচার, কত অপপ্রচার। শাসকের রক্তচক্ষু। প্রলোভনের হাতছানি। বাস, ট্রেন, লঞ্চ বন্ধ। তারপরও পুলিশ, র্যাব, প্রশাসন ও সরকারের হুমকি-ধমকি, বিভ্রান্তিকে ব্যর্থ করে দিয়ে দেশ ও ধর্মরক্ষার জন্য মানুষ ছুটে আসছে ঢাকার দিকে। মানুষ আসছে টেকনাফের নাফ নদীর কিনার থেকে। মানুষ আসছে তেঁতুলিয়ার মহানন্দা পারের কুটির থেকে। মানুষ আসছে হাটহাজারী থেকে। সিলেট থেকে। চট্টগ্রাম থেকে। বরিশাল থেকে। খুলনা থেকে। রাজশাহী-রংপুর থেকে। জীবনমৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চি মাটি থেকে আসছে মানুষ। লাঞ্ছিত-বঞ্চিত অধিকারহারা মানুষ। মানুষ আসছে পায়ে হেঁটে। আসছে বন্যার স্রোতের মতো। আসছে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো। কবিকণ্ঠ তাইতো উদ্বেল হয়ে ওঠে :
বাজ্ল কি রে ভোরের সানাই নিঁদ-মহলার আঁধার-পুরে।
শুনিছ আজান গগন-তলে অতীত-রাতের মিনার-চূড়ে\
সরাই-খানার যাত্রীরা কি ‘বন্ধু জাগো’ উঠ্ল হাঁকি?
নীড় ছেড়ে ঐ প্রভাত-পাখি গুলিস্তানে চল্ল উড়ে\
আজ কি আবার কা’বার পথে ভিড়্ জমেছে প্রভাত হ’তে।
নাম্ল কি ফের হাজার স্রোতে ‘হেরা’র জ্যোতি জগত্ জুড়ে\
আবার খালেদ তারিক মুসা আন্ল কি খুন-রঙিন্ ভুষা,
আস্ল ছুটে হাসীন্ ঊষা নও-বেলালের শিরীন্ সুরে\
তীর্থ-পথিক দেশ-বিদেশের আর্ফাতে আজ জুট্ল কি ফের,
‘লা শারীক আল্লাহ্’-মন্ত্রের নাম্ল কি বান পাহাড় ‘তুরে’\
আঁজ্লা ভ’রে আন্ল কি প্রাণ কার্বালাতে বীর শহীদান,
আজকে রওশন জমীন-আস্মান নওজোয়ানীর সুর্খ্ নূরে\
দুই
হেফাজতে ইসলামের আমির দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন, শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী গত ৪ এপ্রিল রাজধানীর লালবাগ মাদরাসায় আয়োজিত জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে আজকের (৬ এপ্রিল) বহুল আলোচিত-আলোড়িত লংমার্চ সম্পর্কে যখন বলছিলেন—‘আমাদের এই লংমার্চ কাউকে গদি থেকে হটানো বা কাউকে গদিতে বসানোর উদ্দেশ্যে নয়। নিরেট ঈমানের তাগিদে দেশ ও ইসলামের সুরক্ষার জন্য নিয়মতান্ত্রিক অহিংস ও অসহিংস আন্দোলন। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব দলের মুসলমানকে এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তা না হলে আমাদের ওপর খোদায়ি গজব অনিবার্য। এ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতেই এ বৃদ্ধ বয়সে আমি ময়দানে নামতে বাধ্য হয়েছি। কারও এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য নয়, বরং আল্লাহ, তাঁর রাসুল (সা.) এবং ইসলামের অর্পিত দায়িত্ব পালন নিয়ে, ঈমানের তাগিদ ও শাহাদাতের তামান্না নিয়ে ময়দানে নেমেছি।’
আল্লামা শফী সারা দেশের ঈমানদার জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘ঢাকামুখী লংমার্চকে স্বাগত জানাতে আমি ঢাকা চলে এসেছি। আপনারা ইসলাম ও দেশরক্ষার এই লংমার্চকে সর্বাত্মকভাবে সফলের জন্য চিড়া-মুড়ি, শুকনো খাবার আর হাতে তসবিহ ও জায়নামাজ, মুখে আল্লাহর নামের জিকির করতে করতে ঢাকায় আসুন। যেখানে বাধা আসবে সেখানেই জায়নামাজ বিছিয়ে আল্লাহর নাম স্মরণ করে বসে পড়ুন। ইনশাআল্লাহ কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে হেফাজতে ইসলামের এই কর্মসূচিকে বানচাল করা যাবে না।’
এই বর্ষীয়ান মহাপুরুষ আবেগ ও বেদনা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘এই ৯৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে এখন আমার রাজপথে থাকার কথা ছিল না। এখন আমার প্রয়োজন ছিল বিশ্রামে থাকার। কিন্তু আরামকে হারাম করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে আজ রাজপথে নামতে বাধ্য করেছে। শুধু বাধ্যই বলবো কেন, আসলে আমার এবং এদেশের আলেম সমাজের এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। আল্লাহ জাল্লাশানুহু, আমার পেয়ারা নবী হজরত রাসুলে করিম (সা.) না থাকলে, মসজিদ না থাকলে, আমার বেঁচে থাকার, কোনো মুসলমানের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। এখন শহীদ নয়তো গাজী হওয়া ছাড়া কোনো মুসলমানের জন্য ঘরে বসে থাকা জায়েজ নেই। প্রত্যেকের নিজ নিজ শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী এর প্রতিবাদ না করলে এদেশের ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসবে। কেননা নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত আমাদের এ দেশে বর্তমানে আল্লাহ ও রাসুল (স.)-কে কটাক্ষ করে যে ভয়ঙ্কর ও জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে, তা পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে এ পর্যন্ত কেউ করতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই।’
সেজন্যই সেই অন্যায় অন্যায্য অযৌক্তিক জুলুমের বিরুদ্ধে সংবিধানে ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনস্থাপন, কোরআনবিরোধী নারী ও শিক্ষানীতি বাতিল, আল্লাহ-রাসুলের (সা.) ও ইসলামের অবমানাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস, শাহবাগি নাস্তিক-মুরতাদ, প্রিয় নবী (স.)-এর শানে কুত্সা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থাসহ ১৩ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমার এই লংমার্চ।
আল্লামা শফী যখন সংবাদ সম্মেলনে এই কথাগুলো বলছিলেন, তখন আমি ছিলাম আমার এক বন্ধুর অফিসে। সেখানে আরও দু’একজন ছিলেন। হঠাত্ তাদের মধ্যে একজন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
আমরা একটু হতচকিত হলাম। চোখ মুছতে মুছতে ভদ্রলোক বললেন, কিছু মনে করবেন না। এই কান্না আমার আবেগের কান্না। কষ্টের কান্না। গত ৪০টি বছর ধরে বাংলাদেশের পবিত্র জমিনের ওপর বসে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের দোসররা ইসলামের বিরুদ্ধে, কোরআনের বিরুদ্ধে, আল্লাহ ও রাসুলের বিরুদ্ধে, দাড়ি-টুপি ও ইসলামী লেবাসের বিরুদ্ধে, ঈমান ও আকিদার বিরুদ্ধে, মসজিদ ও মাদরাসার বিরুদ্ধে একের পর এক চালিয়েছে হিংস্র আক্রমণ। অপমানে অপমানে জর্জরিত করেছে ইসলাম ও মুসলমানদের। সেই অপক্রিয়ার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে শাহবাগের ব্লগারদের শয়তানি।
আমার মতো অনেকেই ধরে নিয়েছিল, সব শেষ হয়ে গেল। বাংলাদেশের মাটি থেকে ধর্ম-সংস্কৃতি সব যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে থাকবে কী? হতাশায় ভেঙে পড়েছিলাম। জায়নামাজ ভিজিয়েছি চোখের পানি দিয়ে।
সেই সময় রাজধানী ঢাকা থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে, দুর্যোগের অন্ধকার ভেদ করে, প্রথমবারের মতো সুদূর হাটহাজারীতে জ্বলে উঠলো সত্যের শিখা। দূষিত-বিষাক্ত মেঘ সরিয়ে দেয়ার জন্যই যেন আকাশের মতো উদারতা নিয়ে, পর্বতের মতো দৃঢ়তা নিয়ে, সমুদ্রের মতো গভীরতা নিয়ে, বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক আকাশের যথার্থ অভিভাবকের মতো, পিতার হৃদয় নিয়ে এগিয়ে এলেন আল্লামা শফী। তিনি তার ব্যাকুল হৃদয় দিয়ে মাতৃভূমির ক্ষত মোচনের জন্য, মানুষের কষ্ট নিরাময়ের জন্য, দিগন্তের দিকে বাড়িয়ে দিলেন তার স্নেহময় হাত। বললেন, ভয় নেই। এক আল্লাহ জিন্দাবাদ। ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালা কে বাদ।
যেন মহাপ্লাবনের সর্বনাশের মুখে নির্ভয় বাণী নিয়ে জাতির সামনে দাঁড়ালেন নূহ (আ.)। পেছনে ফেরাউনের বিশাল বাহিনী, সামনে লোহিত সাগরের উন্মাতাল ঢেউ, ভীত-সন্ত্রস্ত, কম্পমান বনি ইসরাইলের সামনে সমুদ্রের বক্ষ চিরে যেন আলোর পথ খুলে দিলেন মুসা (আ.)। যেন ইয়ারমুকের রণাঙ্গনে ঝলসে উঠলো খালিদ বিন ওয়ালিদের তরবারি। যেন সওর পাহাড়ের গুহায় খলিফা আবু বকরের (রা.) কানে মহানবীর সেই অভয় উচ্চারণ—ভয় পেয়ো না। এখানে কেবলমাত্র আমরা দু’জন নই। আরও একজন আছেন, তিনি আল্লাহ।
যেন মক্কা বিজয়ের পর খানায়ে কাবার অভ্যন্তরে স্থাপিত মূর্তির সারির সামনে দাঁড়ালেন মহানবী (সা.)—সত্য এসেছে, মিথ্যা দূর হও।
যে দেশে ইসলামের সাম্য, শান্তি, ন্যায় ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে, যে দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে সংখ্যাতীত মানুষ—সেই দেশকে রক্ষার জন্য, সেই মহান ধর্মকে রক্ষার জন্য, সেই রক্তে ভেজা শহীদী ঈদগাহ রক্ষার জন্য ডাক এসেছে লংমার্চের। তাই তো আমি আমার আবেগ ধরে রাখতে পারছি না।
ভদ্রলোকের কথায় আমরা অভিভূত হই। সত্যিই এই যে লংমার্চ, এই যে মানুষের ছুটে আসা, এ তো সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। কারণ এই লংমার্চের যিনি মহানায়ক, তিনি তো কোনো সিংহাসন চান না। তার তো ক্ষমতার প্রতি সামান্য মোহও নেই। তিনি তো প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না। প্রেসিডেন্ট হতে চান না। এই লংমার্চ তো শুধু দেশকে পাপমুক্ত করার জন্য। তওবার জন্য। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। রাসুল (সা.)-এর প্রেমের জন্য।
তাই তো এই লংমার্চ কোনো ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে নয়। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেও নয়। শুধু অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য।
আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব ইচ্ছে করছে আল্লামা শফীর সঙ্গে হজরত নূর কুতব উল-আলমের তুলনা করতে। দরবেশ নূর কুতুব উল-আলমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে, রাজা গনেশের অত্যাচার থেকে বাংলাদেশের মজলুম মানুষকে বাঁচানোর জন্য সুদূর জৌনপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন সুলতান ইবরাহীম শর্কী। দরবেশের ডাককে গুরুত্ব দিয়ে ইবরাহীম শর্কী সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছিলেন বাঙাল মুলকে। আর আজ অন্য কাউকে ডাক না পাঠিয়ে, দরবেশ কুতুবের সুযোগ্য উত্তরসূরি আল্লামা শফী এই বৃদ্ধ বয়সে সত্য রক্ষার জন্য নিজেই নেমে এসেছেন পথে।
তিন
এই লংমার্চে যারা ছুটে এসেছেন এবং আসছেন, তাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। পিস্তল, বন্দুক, কাটারাইফেল নেই। লাঠি নেই। পাথর নেই। হিংসা-ঘৃণা নেই। স্বার্থপরতা নেই। তাদের বুকে পবিত্র কোরআন। হাতে তসবিহ-জায়নামাজ। কণ্ঠে একটাই ধ্বনি—আল্লাহু আকবর। একটাই স্লোগান। একটাই বাণী, এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।
যারা মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচতে চান, যারা ধর্মীয় সম্প্রীতি নিয়ে বাঁচতে চান, যারা শান্তি ও স্বাধীনতার সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চান, তারা যে ধর্মেরই হোন না কেন, তিনি পাদ্রী, পুরোহিত, মং, যাই হোন না কেন, সত্য ও সৌন্দর্যের এই ভরা জোয়ারের সময়, ন্যায়ের কাফেলায় অংশ না নিয়ে ঘরে বসে থাকবেন না। পথে নামুন।
সত্যের শিরনি হাতে পথে নেমেছেন সত্যসাধক আল্লামা শফী। সেই শিরনি প্রাণভরে গ্রহণ করুন। তার হাতে কওসর ভরা পেয়ালা, তা প্রাণ ভরে পান করুন। তার চলার পথে গোলাপের সৌরভ। সেই সৌরভ অঙ্গে মেখে ধন্য হোন।
জীবনকে উন্নত থেকে উন্নততর করার জন্যই তো মানুষ এই রকম মহা মুহূর্তের অপেক্ষায় থাকে।
চার
লংমার্চ অর্থাত্ দীর্ঘ যাত্রা। পৃথিবীতে কবে কোথায় কখন চালু হয়েছিল আমার জানা নেই। তবে পৃথিবীর প্রথম লংমার্চ পরিচালিত হয় মহানবী (স.)-এর নেতৃত্বে। অত্যাচারী রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের আক্রমণ থেকে মুসলিম জাহানকে বাঁচানোর জন্য নবম হিজরিতে মদিনা থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে তাবুকের উদ্দেশে পরিচালিত হয় লংমার্চ। ইতিহাসে এই লংমার্চ তাবুক অভিযান হিসেবে খ্যাত হয়ে আছে। এই দীর্ঘ লংমার্চে রসুলের (স.) সঙ্গী ছিলেন ৩০ হাজার সাহাবি সৈন্য। আর ছিল ৯০০ উট ও ১০০ ঘোড়া। বাকি সবাই ছিলেন পদাতিক। বর্ণনা থেকে দেখা যায়, প্রতি ১৮ জন সৈন্যের জন্য ছিল মাত্র একটি উট। সেই ১৮ জন পর্যায়ক্রমে উটে সওয়ার হতেন। খাদ্য সামগ্রীর অপ্রতুলতার কারণে অনেক সময় গাছের পাতা খেতে হচ্ছিল। উটের সংখ্যা কম হওয়া সত্ত্বেও ক্ষুধার জন্য উটও খেতে হচ্ছিল। এজন্য ইতিহাসে এই বাহিনীর নাম হয়েছে ‘জায়সে উছরত’ বা অভাব-অনটনের বাহিনী।
অপরিসীম দুঃখ-কষ্ট সয়ে রসুলের (স.) নেতৃত্বে সত্যের সৈনিকরা ১৫ দিন ধরে একটানা হেঁটে পৌঁছে যান তাবুকে। সেখানে ২০ দিন অবস্থান করে বিজয়ী বাহিনী ফিরে আসে মদিনায়। মোট ৫০ দিন ব্যয় হয় এই অভিযানে।
এরপর, যে লংমার্চ পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের মাথায় বজ্রাঘাত হেনে চীনের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করেছিল সাম্যবাদ, সেই লংমার্চের নায়ক ছিলেন আজকের আধুনিক চীনের স্থপতি কমরেড মাও সে তুং। ১৯৩৪ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ১৯৩৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চলেছিল এই ঐতিহাসিক লংমার্চ। দক্ষিণ-পূর্ব চীনের জিয়াংশি ও ফুজিয়ান থেকে শুরু হয়ে এই লংমার্চ ১১টি প্রদেশ পাড়ি দিতে অতিক্রম করেছিল ১২ হাজার কিলোমিটার পথ। চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের সঙ্গে এই লংমার্চে অংশ নিয়েছিল ৮০ হাজার সশস্ত্র কমিউনিস্ট ক্যাডার অর্থাত্ রেড আর্মি। পৃথিবীর এই দীর্ঘতম লংমার্চের সেনারা পাড়ি দিয়েছে দুর্গম পর্বত, শ্বাপদসঙ্কুল চড়াই-উতরাই। জনবিরল ও খাদ্যশূন্য মালভূমি। খরস্রোতা নদী, হ্রদ ও গভীর বন। এছাড়া চিয়াং কাই শেকের কুওমিন টাং বাহিনীর আক্রমণ তো লেগেই ছিল। এই জীবন-মৃত্যুর লংমার্চে, ধারণা করা হয়, প্রথম ১২ মাসেই ৫০ হাজার কমিউনিস্টের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু কমরেডদের এই আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি।
অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে শেষ হয় লংমার্চ। শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন চিয়াং কাই শেক। অবসান ঘটে সাম্রাজ্যবাদের দালালদের অত্যাচার-নির্যাতনের। চীনের আকাশে উদিত হয় লাল সূর্য। প্রতিষ্ঠিত হয় শোষণমুক্ত শাসনব্যবস্থা।
আরেকটি ঘটনাকে পাশ্চাত্যের সাদা চামড়ার ইতিহাসবিদরা লংমার্চ হিসেবে দেখতে চান। সেই লংমার্চের ঘটনাটি ঘটে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। সময়কাল ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল। জার্মান সেনারা তাদের হাতে আটক ২ লাখ ৫৭ হাজার যুদ্ধবন্দির মধ্যে প্রায় ৮০ হাজার বন্দিকে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে পোল্যান্ড ও চেকস্লোভাকিয়ার ওপর দিয়ে হেঁটে তাদের বন্দিশিবিরে যেতে বাধ্য করে। এ ঘটনাটিকে অনেকে ‘ব্ল্যাকমার্চ’ নামেও অভিহিত করে থাকেন। সামান্য কিছু খাবার ছাড়া বন্দিদের আর কিছু দেয়া হতো না বলে কেউ কেউ এটাকে ‘ব্রেডমার্চ’ও বলে থাকেন।
আমাদের ইতিহাসে লংমার্চকে সংযুক্ত করার একক কৃতিত্ব মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও পানি আইনকে থোরাই কেয়ার করে গঙ্গার পানির ওপর বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করে ভারত চালু করে মরণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ। শুকিয়ে যায় প্রমত্তা পদ্মা। দেখা দেয় ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ ছিল না। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সেই ঘোর দুর্দিনে মুক্তিযুদ্ধের ‘অকৃত্রিম বন্ধু’ ভারতের এই একতরফা পানি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় কি যায় না ভেবে সবাই যখন তোতলাচ্ছিলেন, দ্বিধাহীন চিত্তে জাতীয় স্বার্থের পক্ষে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে গর্জন করে উঠলেন মওলানা ভাসানী। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বাপ্নিক জাতিসংঘসহ সারা পৃথিবীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের কাছে ভারতের পানি আগ্রাসনের স্বরূপ উন্মোচন করে পাঠালেন তারবার্তা। ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে সাফ জানিয়ে দিলেন, যদি আমাদের ন্যায্য পানি না দাও তাহলে আমি ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করব। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব ফারাক্কা বাঁধ। ইন্দিরা গান্ধী অনুরোধ করলেন লংমার্চ বাতিল করতে। মওলানা ভাসানী জানিয়ে দিলেন তাহলে পানি দাও। ১৬ মে, ১৯৭৬ সাল সকাল ১০টার মধ্যে রাজশাহীর মাদ্রাসা-ময়দানকে কেন্দ্র করে লাখ লাখ মানুষের ঢলে ভেসে গেল পুরো শহর। লংমার্চ শুরু হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে ফারাক্কা অভিমুখে। সে ছিল জাতীয় ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ঘটনা। শুধু দেশপ্রেমকে বক্ষে ধারণ করে প্রতিবাদ প্রতিরোধের শপথে দৃপ্ত হয়ে আকাশ কাঁপিয়ে স্লোগান উঠল, ‘ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, মরণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ।’ ‘চলো চলো ফারাক্কা চলো পদ্মার বুকে পানি আন।’ পেছনে লাখ লাখ মানুষের মেঘের মতো মিছিল নিয়ে ফারাক্কা অভিমুখে এগিয়ে চললেন অশীতিপর জননায়ক মওলানা ভাসানী। সন্ধ্যায় মিছিল পৌঁছল চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সেখানে রাত্রিবাস। পরদিন মহানন্দা পাড়ি দিয়ে মিছিল চলল সীমান্ত অভিমুখে। শিবগঞ্জ পার হয়ে কানসার্ট হাইস্কুল ময়দান পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে যায়। আর এগুতে দেয়া হলো না মিছিলকে। ওদিকে সীমান্তে ফারাক্কার বাঁধ বরাবর হাজার হাজার সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে ভারত। মহামিছিলকে থামালেন মহানায়ক। বললেন, আমার নিরস্ত্র জনতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করেছে ভারত। বিশ্ববাসীকে আমন্ত্রণ জানালেন বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যের চিত্র দেখে যেতে। ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশে বললেন, হয় আমার ন্যায্য পানি দাও, নইলে আরও বড় কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাব আমি। দেশবাসীর উদ্দেশে বললেন, ভারত আমাদের বন্ধু হতে পারে না। সত্যিকারের কোনো বন্ধু এভাবে একটি বন্ধু দেশকে শুকিয়ে মারতে পারে না। ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিলেন তিনি।
১৬ থেকে ১৭ মে ১৯৭৬—এই দুই দিন চলেছিল ফারাক্কা মিছিল। ১৯৭১ সালের পর ফারাক্কা লংমার্চকে কেন্দ্র করেই দ্বিতীয়বারের মতো সিসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এ দেশের মানুষ। আর সেই প্রথমবার ভারত ভীতসন্ত্রস্ত চিত্তে অনুভব করেছিল বাংলাদেশের গর্জন। তার পরই জিয়াউর রহমানের সরকার ফারাক্কা ইস্যু নিয়ে যায় জাতিসংঘে। আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছিল ভারত।
আমার পরম সৌভাগ্য, আমি সেই মহামিছিলে সামান্য একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। যে কয়টা কাজ আমাকে আমার মাতৃভূমির জন্য ফোয়ারার মতো জাগিয়ে রাখে, ফারাক্কা লংমার্চ তার অন্যতম। ফারাক্কা লংমার্চে অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা আমার জীবনের এক মূল্যবান সঞ্চয়।
বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘাতক শান্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে ১৯৯৭ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত হয় পার্বত্য লংমার্চ। ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে খাগড়াছড়িতে গিয়ে সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয় এই লংমার্চ। এই লংমার্চের পথে পথেও ছিল বাধা আর বাধা। এই লংমার্চেও আমি কিছু ভূমিকা রাখি। খাগড়াছড়ি সমাবেশের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমার ওপর।
বাংলাদেশের চলমান জীবনে আরও একটি লংমার্চের কথা স্মরণযোগ্য। ভারতের উগ্রসাম্প্রদায়িক ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), বজরং দল ও শিবসেনাদের গুণ্ডাপাণ্ডারা মুঘল সম্রাট জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ বাবর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দেয়। এই ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ইসলামি সংগঠনগুলো ঢাকা থেকে বেনাপোল সীমান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ লংমার্চ পরিচালনা করে। শায়খুল হাদিস আজিজুল হক, মুফতি ফজলুল হক আমিনী ও মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের নেতৃত্বে ১৯৯৩ সালে এই লংমার্চে দেশের ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। সে সময় সীমান্তে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হন বেশ কয়েকজন।
‘আমরা সীমান্তবাসী’র লংমার্চেরও একটা প্রেক্ষাপট আছে। ২০১০ সালে বছরজুড়ে বাংলাদেশের সীমান্তে অপদখলীয় ভূমি নিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ গুলি করে বেশ ক’জন বাংলাদেশীকে হত্যা ও আহত করে। সিলেটের জৈন্তাপুরের ডিবির হাওর থেকে গোয়াইনঘাটের সোনারহাট সীমান্ত পর্যন্ত কয়েক দফা গুলির ঘটনায় সারা বছর সীমান্ত এলাকার জনসাধারণের ছিল উদ্বেগ, আতঙ্ক ও উত্কণ্ঠা। সীমান্ত এলাকার এসব অপদখলীয় জমি নিয়ে যৌথ জরিপকাজ শুরু হলে সীমান্তবাসীর মধ্যে আরেক দফা উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। এদিকে ভূমি রক্ষায় সিলেট সীমান্তের মানুষ আন্দোলন শুরু করে। সিলেট জেলা বিএনপির সহসভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য দিলদার হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে সেখানে কয়েক মাস ধরে চলছিল প্রতিরোধ আন্দোলন। তীব্র আন্দোলনের মুখে জরিপের নামে বাংলাদেশের ভূমি ভারতকে তুলে দেয়ার কার্যক্রম একপর্যায়ে স্থগিতও করা হয়। কিন্তু জরিপ চলাকালে জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাটের কয়েক স্থানে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী দখল করে নেয় বাংলাদেশের ভূমি। এই পরিস্থিতিতে দেশের ভূমি রক্ষা ও সীমান্তের প্রতিবাদী জনতার সঙ্গে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করার জন্য আমরা সীমান্তবাসী আয়োজন করে এই লংমার্চের। বাংলাদেশের ইতিহাসে সীমান্তবাসীর এই লংমার্চও আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচিত হবে।
এই লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বর্তমান সরকার কর্তৃক নির্যাতিত, আমার দেশ-এর অকুতোভয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। ২০১১ সালে ১ অক্টোবর সিলেট থেকে জাফলং সীমান্ত পর্যন্ত পরিচালিত এই লংমার্চ কাঁপিয়ে দিয়েছিল বর্তমান শাসকদের মসনদের ভিত্তি।
পাঁচ
আল্লামা শফীর আহ্বানে যারা আজ ধর্ম ও দেশ রক্ষার লংমার্চে অংশ নিয়েছেন, যারা বলছেন দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাব না, তাদের মধ্যে বিভেদ ও বিভক্তি সৃষ্টির জন্য সরকারের ছত্রছায়ায় নানা রকম ষড়যন্ত্র হচ্ছে। লোভ ও লালসার কথা তো আছেই। তার চেয়ে বেশি আছে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি। জেল ও জুলুমের আতংক। ফলে কারও কারও মনের মধ্যে ভয় ঢুকে যেতে পারে।
প্রাণের ভয়, চাকরি হারানোর ভয় আরও কত রকম ভয়। দেখা দিতে পারে দ্বিধা এবং সংশয়। তাদের উদ্দেশ্যে বলি নবী ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র ইসমাইলের সেই আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করতে। যখন তাঁকে কোরবানি করার জন্য মহান পিতা নিয়ে যাচ্ছিলেন, সে সময়ও শয়তান দিচ্ছিল ধোঁকা। কিন্তু ইসমাইল (আ.) ছিলেন স্থির, নিষ্কম্প, দ্বিধাহীন।
সেজন্যই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ভয় করিও না হে মানবাত্মা’র ভাষায় বলি :
“তখেত তখেত আজ দুনিয়ায় কমবখেতর মেলা,
শক্তি-মাতাল দৈত্যরা সেথা করে মাতলামী খেলা।
ভয় করিও না, হে মানবাত্মা, ভাঙ্গিয়া পড়ো না দুখে,
পাতালের এই মাতাল রবে না আর পৃথিবীর বুকে।
তখেত তাহার কালি পড়িয়াছে অবিচারে আর পাপে
তলোয়ারে তার মরিচা ধরেছে নির্যাতিতের শাপে।
... ... ... ... ... ... ... ... ...
সত্য পথের তীর্থ পথিক! ভয় নাই, নাহি ভয়,
শান্তি যাদের লক্ষ্য, তাদের নাই নাই পরাজয়।
অশান্তিকামী ছলনার রূপে জয় পায় মাঝে মাঝে,
অবশেষে চির-লাঞ্ছিত হয় অপমানে আর লাজে।
পথের উর্দ্ধে ওঠে ঝোড়ো বায়ে পথের আবর্জনা,
তাই বলে তারা উর্ধ্বে উঠেছে—কেহ কভু ভাবিওনা!
উর্দ্ধে যাদের গতি, তাহাদেরী পথে হয় এরা বাধা;
পিচ্ছিল করে পথ, তাই বলে জয়ী হয় না ক কাদা!
... ... ... ... ... ... ... ... ...
পুণ্য তখেত বসিয়া যে করে তখেতর অপমান,
রাজার রাজা যে তার হুকুমেই যায় তার গর্দান!
ভিস্তিওয়ালার রাজত্ব, ভাই, হয়ে এল ঐ শেষ;
বিশ্বের যিনি সম্রাট তাঁরি হইবে সর্বদেশ!
ছয়
লংমার্চে যারা অংশ নিচ্ছেন, পথে পথে তাদের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে। ঝড়, বৃষ্টির চাইতেও বেশি সহ্য করতে হবে সরকারের শত্রুতা। সেজন্যই লংমার্চের পথের দু’ধারে যাদের বাসস্থান, তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে যে যেভাবে পারেন আল্লাহর মেহমানদের যত্ন নিন। সেবা দিন। নিজেরাও পারলে অংশ নিন। দেখবেন মুসাফিরদের যেন অসমাদর না হয়।
লংমার্চের পথিকদের উদ্দেশে আমাদের অনুরোধ, পথে এমন কোনো কাজ করবেন না, যাতে আল্লামা শফীর মহান সংগ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুণ্ন হয়।
আপনাদের তো ইহলৌকিক কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। শুধু একটাই তো চাওয়া, মহাপ্রভুর সৃষ্টিকে আবাদযোগ্য রাখা। তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
শয়তান অনেক ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে—সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকাটা জরুরি। মানুষের জান ও মালের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে।
আপনাদের চলার পথে দু’পাশে এবং আপনাদের কণ্ঠে কণ্ঠে শুধু ধ্বনিত হোক জাতীয় কবির কবিতা :
“উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ,
আমরা বলিব, ‘সাম্য, শান্তি, এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।’
উহারা চাহুক সঙ্কীর্ণতা, পায়রায় খোপ, ডোবার ক্লেদ,
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।
উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদী দর্জা চাই;
নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই।
ওরা মরিবে না, যুদ্ধ বাধিলে লুকাইবে ওরা কচু বনে,
দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে।
মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির-অবিশ্বাসী,
অবিশ্বাসীরাই শয়তানী চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুল-চাষী।
ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি,
মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লা-মানুষে জানাজানি।
যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে দেখো রে ভাই,
উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই।
ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মোরা আল্লাহর রাজ্য চাই,
দ্বন্দ্ববিহীন আনন্দলীলা এই পৃথিবীতে হবে সদাই।
নিত্য সজীব যৌবন যার, এস এস সেই নৌ-জোয়ান,
সর্বক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির আত্মদান।
ওরা কাদা ছুড়ে বাধা দেবে ভাবে—ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ,
মোরা ফুল ছুঁড়ে মারিব ওদের, বলিব—আল্লাহ জিন্দাবাদ!”
0 comments: