কারাগারের দিনগুলো

পর্ব-১
সেভিং ব্লেড যখন অস্ত্র

১৪ই অক্টবর২০১২ সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে স্থানীয় যুবলীগের সন্ত্রাসীরা বাসায় হামলা করলো, আমার অপরাধ আমি শিবির করি। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লো একদল সন্ত্রাসী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হলো বেদম মারপিট সেই সঙ্গে গালাগালি **বাচ্চা শিবির করস! রুম তল্লাশীর নামে শুরু হলো লুটপাট, যে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে নিচ্ছে। মোবাইল/ল্যাপটপ/ইন্টারনেট মডেম কিছুই বাদ দিলোনা।
সার্টের কলার ধরে টেনে হিচড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসলো আরো মারার জন্য, এরই মধ্যে একজন চেচিয়ে বললো “ভাই ফোন দিছে ভাই আসতাছে” [এখানে ভাই বলে যাকে সম্বোধন করা হচ্ছে তিনি হচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী গডফাদার, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর হোসেন হিরণ, তার নামে কুখ্যাতি আছে তিনি নিজের হাতে মানুষকে নির্যাতন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন]।
ইতিমধ্যে আশেপাশে প্রচুর লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছেনা, একজনে এগিয়ে এসে মৃদু প্রতিবাদ করাতে সন্ত্রাসীরা তার দিকে তেড়ে গেলো। আর সময়টি ছিলো অফিস টাইম তাই স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কেউই এলাকায় ছিলেননা।
আমাকে সহ সন্ত্রাসীরা অপেক্ষায় থাকলো কখন তাদের “ভাই” আসেন। কিন্তু সন্ত্রাসীদের মনের খায়েশ পূর্ণ হওয়ার আগেই পুলিশ এসে হাজির। পুলিশ এসেই হামলাকারীদের পরিবর্তে আমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলো। চললো আরেক দফা রুম তল্লাশী। পুলিশ যুবলীগের নির্দেশ ক্রমে বহু কিছু জব্দ করলো এর মধ্যে একটি সার্প কম্পানীর সেভিং ব্লেড-ও ছিলো, এটা নাকি শিবিরের অস্ত্র এটা দিয়ে আমরা মানুষের রগ কাটি!!
আমিও পুলিশকে চাপ দিয়ে আমার ল্যাপটপ ও মোবাইল গুলো জব্দ তালিকার অর্ন্তভুক্ত করতে বাধ্য করলাম। তিনটি মোবাইলের মধ্যে দুটি পাওয়া গেলো, অন্যটি আগেই গায়েব করে দিয়েছে সোনার ছেলেরা।

পর্ব-২
রক্ষকই যেখানে ভক্ষকঃ
হাতকড়া পড়িয়ে আমাকে পুলিশ ভ্যানে তোলা হলো গাড়ি চলতে শুরু করতেই এক পুলিশ সদস্য সহানুভূতির সুরে বললো “ভাই আমরা এগুলা বুঝি রাজনৈতিক কারণে আপনাকে ধরিয়ে দিয়েছে, টেনশন কইরেননা, দোয়া করেন”। গাড়ি থানার দিকে যাওয়ার পরিবর্তে গাড়ি ঢুকে গেলো আওয়ামী গডফাদার হোসেন হিরণের বাড়ির আঙিনায়। আমাকে গাড়িতে বসিয়ে এসআই জাহাঙ্গীর উপরের তলায় গিয়ে কি কি যেন সলাপরামর্শ করে ফিরে এলেন, সাথে শ্রমিক লীগের এক নেতা। তিনি হুমকির স্বরে বললেন “**পুত আইজ পুলিশ আসাতে বাঁইচা গেলি নাইলে তোর হাত-পা ভাইঙ্গা দিতাম”।
গাড়ি এগিয়ে চললো, সেই সাথে শুরু হলো পুলিশ কতৃক ইভটিজিং এর পালা, রাস্তার পাশে মেয়ে দেখলেই গাড়ি স্লো করে ফাজলামী করছিলো পুলিশ সদস্যরা। রক্ষকই যেখানে ভক্ষক সেখানে আমরা কি আশা করতে পারি?
থানা কাস্টডিতে ঢুকানোর কিছুক্ষণ পরেই হাজির হলেন তরুন সাংবাদিক মোস্তফা আল কায়সার ভাই, এবং ওয়ার্ড ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদ। তারা উভয়েই আশ্বস্ত করলেন চেস্টা চলছে আপনি টেনশন করবেননা। এরই মধ্যে পুলিশ দু’তিন দফা জিজ্ঞাসাবাদ করলো, ল্যাপটপ তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হলো। কিছু ইসলামীক বই, বোখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফের পিডিএফ ভার্সন ছিলো ল্যাপটপে। থানায় বসে জানতে পারলাম ল্যাপটপে ইসলামীক বই রাখাও অপরাধ, সেগুলো হচ্ছে জিহাদী বই। হায়রা মুসলমানের বাচ্চা, খালি গরু খাইতেই শিখলি, নিজের দ্বীন চিনলিনা!!
এরই মধ্যে এক পুলিশ সদস্য এসে বলে গেলো “ভাই আপনাকে যাই জিজ্ঞাসা করা হোক আপনি যে শিবির করেন সেটা স্বীকার করবেননা, বলবেন একসময় করতাম এখন করিনা” আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, তিনি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন। জোহরের নামাজের টাইম হয়ে গেলে পুলিশের কাছ থেকে পত্রিকা নিয়ে পত্রিকা বিছিয়েই নামাজ আদায় করে নিলাম।
খাওয়ার সময় বেধে গেলো আরেক বিপত্তি, মানসিক টেনশনে এতক্ষন টের পাইনি, কিন্তু খাবার চিবোতে গিয়ে টের পেলাম দু’চোয়ালে তীব্র ব্যাথা। খুব একটা খেতে পারলামনা, ফেলে দিলাম।
সকল প্রচেস্টা ব্যার্থতায় পর্যবশিত হলো, দুপুর তিনটার দিকে আমাকে কোর্টে চালান করে দেয়া হলো। পুলিশ ভ্যানে করে কোর্টে যাওয়ার পথে মুক্ত বাতাসে বসে চট্টগ্রাম শহরটাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছিলো, প্রাণ ভরে দেখলাম, আবার কবে দেখতে পাবো তারতো কোন নিশ্চয়তা নেই!!

পর্ব-৩
সিগারেটের তীব্র ধোয়ায় আচ্ছন্ন একটি রুম, এক কোণের দরজা বিহীন একমাত্র টয়লেট থেকে প্রস্রাব মিশ্রিত পানি গড়িয়ে রুম সয়লাব। কমকরে হলেও একশো মানুশকে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে রুমটিতে, পাশেই দেখলাম কেউ ফেন্সিডিল বোতল থেকে ঢক ঢক করে গিলছে, কয়েকজন আবার গোল হয়ে বসে হেরোয়ীন-ইয়াবাতে দম নিচ্ছে। এসব সাপ্লাই দিচ্ছে পুলিশ সদস্যরাই, টাকার বিনিময়ে এখানে সবই পাওয়া যায়। এই ছিলো আদালত কাস্টডির মোটামুটি চিত্র।
সিগারেট তীব্র ধোয়া এবং গন্ধে দম নেয়াই দায় হয়ে দাড়ালো, নাক চেপে ধরে কোন রকমে একপাশে জায়গা করে দাড়ালাম, বসার উপায় নেই। এরই মধ্যে দেখলাম কিছু ইয়াং বয়সী ছেলে এই দূর্গন্ধযুক্ত ময়লা স্থানেই তায়ামুম করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো। কিছুটা স্বস্থি পেলাম, আমি এখানে একা নই, আন্দোলনের বেশ কিছু মুজাহিদ আমার পাশে আছে। হৃদয়ের মাঝে কেমন যেনো শিহরণ বয়ে গেলো, এই দুঃসহ পরিস্থিতিতেও যাদের হৃদয়কে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারেনাই, যারা এই চরম বিপদের মূহুর্তেও আল্লাহর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় নাই, তারা দীপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করছে “কুল ইন্নাস সালাতী ওয়া নুসুকী ওমাহ ইয়া ইয়া, ওমামাতি লিল্লাহী রব্বিল আলামীন”। বিপ্লব এদের দিয়েই সম্ভব, বিপ্লবের আলোক ছটা দেখা যাচ্ছিলো এই তরুণ মুজাহীদদের চোখে মুখে।
তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমিও আসর নামাজে শরীক হলাম। সালাম ফিরানোর পরে পরিচিত হওয়ার জন্য একজন ভাইকে রসীকতা করে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই মামলা কি, রাজাকারী কেস নাকি? তিনি হেসে সম্মতি জানালেন, মাথা গুনে দেখলাম আমরা সর্বমোট ১৩জন আছি, এর মধ্যে মাত্র একজন ইউসুফ ভাই চট্টগ্রাম মহানগরী দক্ষিনের জামায়াত কর্মী, বাকিরা সবাই মহানগরী উত্তর শাখায় কাজ করে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই একে একে মহানগরী উত্তরের শিবির নেতৃবৃন্দ ওকালত নামা এবং উকিল সহ হাজির হলেন, মহানগরী দক্ষিনের অর্থ সম্পাদক শাহীন ভাই দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন, কুশল বিনিময় শেষে তিনি অভয় দিলেন টুকটাক কথা হলো, ওকালত নামায় স্বাক্ষর নিয়ে তিনি চলে গেলেন, যাওয়ার আগে মহানগরী উত্তর-দক্ষিণ সবার জন্য প্রচুর পরিমানে খাবার এবং পানি পাঠিয়ে দিলেন। শাহীন ভাইয়ের সাথে কথা বলে মনটা অনেক হালকা হয়ে গেলো, বিষন্ন ভাবটা কেটে গেলো।
সন্ধার আগেই জামিন আবেদন করলেন আমার আইনজীবী, কিন্তু শিবিরের মামলা এত সহজে জামিন হবে এটা আশা করা যায়না, যা হওয়ার তাই হলো সন্ধার পরেই আমাদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হলো।

পর্ব-৪
আদালত চত্বর থেকে প্রিজন ভ্যান এসে থামলো চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকে। সুবিশাল তার গেইট, সুউচ্চ তার দেয়াল, তবে ছোট একটি দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে প্রবেশ করতে হয়।
জোড়ায় জোড়ায় হ্যান্ডকাফ পড়ানো হয়েছিলো, ভেতরে ঢুকতেই একজন চাবি দিয়ে হ্যান্ডকাফ খুলে দিলো। আমরা তেরো জন একপাশে গিয়ে দাড়ালাম, এ যেনো শিশাঢালা প্রাচীর। না না এটাতো আর জিহাদের ময়দান নয় এটা হচ্ছে কারাগার, এটাকে বলা যায় কাছে থাকার আকুলতা। কেউ কাউকে ছেড়ে বিচ্ছিন্ন হচ্ছিনা, কিছুক্ষণ আগেও ছিলাম অচেনা, কিন্তু মূহুর্তের মধ্যেই মনে হলো কতকালের চেনা, কত আপন, এটাই হচ্ছে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ।
ছোট একটা প্রিজন ভ্যানে ঠাসাঠাসি করে প্রায় পঞ্চাশ জন আসামী নিয়ে আসা হয়েছে, লাইন করে দাড় করিয়ে, চেক করা হচ্ছে, চেকিংয়ের পরে আরেকটা ফটক পেরিয়ে ঢুকতে হবে কারাগারের মূল অংশে।
চেকিংয়ের ধাপ আসতেই গলা শুকিয়ে গেলো, ধরনী দ্বিধা হও! অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা! এমন নোংরাভাবে চেক করতে কাউকে কখনো দেখিনাই, যাদের লুঙ্গি পরা ছিলো তাদের লুঙ্গি ঢিলা করে ভেতরে উঁকি দিয়ে চেক করা হচ্ছিলো, যাদের ফুলপ্যান্ট পড়া তাদের প্যান্ট হাটু পর্যন্ত নামাতে বাধ্য করা হচ্ছিলো।
আমার পেছনেই সংগঠনের অন্যান্য বন্দি ভাইয়েরা লাইনে দাঁড়িয়ে, শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো, লজ্বায় কারও দিকে তাকাতে পারছিনা।
চোখে আঁধার দেখছিলাম, কানের কাছে ফিসফিস করে এক কারারক্ষী প্রশ্ন করলো মামলা কি? জবাব দিলাম শিবিরের মামলা। শিবির করেন? স্বীকার করলাম হ্যা করি। আচ্ছা ভেতরে যান, হা করে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি হেসে বললেন চেক করার দরকার নেই, আপনি চলে যান।
কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে এলো, যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলন মানুষের ভালোবাসা নিয়ে এভাবেই টিকে আছে, টিকে থাকবে।

পর্ব-৫
দ্বিতীয় গেইট পেরোলেই সাজানো গোছানো একটা চত্বর, বাহারী ফুলের গাছে সুশোভিত চারিদিক। বাহ সুন্দর যায়গাতো! মজা করেই বললাম, অন্যরা হেসে ফেললো।
লাইন করে নিয়ে যাওয়া হলো বিশাল এক হলরুমে, এটাকেই বলা হয় আমদানী ওয়ার্ড। সদ্য আগত বন্দীদের এক রাতের জন্য এখানে এনে রাখা হয়, পরের দিন বিকালে তাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
শ’খানেক বন্দীদের জন্য রুমের কর্ণারে একটি মাত্র নোংরা টয়লেট, কোমর সমান উঁচু তার দরজা। বাহির থেকে কেউ দয়া করে চোখ সামলে না রাখলে লজ্জা ঢাকা অসম্ভব।
আমদানী ওয়ার্ডের পেছনের দিকে জানালার ওপাশেই ফাঁসির মঞ্চ, চমৎকার করে সাজানো মঞ্চটি, ছোট ছোট করে ছাটা সবুজ ঘাস, একপাশে সিমেন্টের সিড়ি। নয়নাভিরাম এই স্থানটি কতটা ভয়াবহ হতে পারে ভাবতেই শিউরে উঠলাম। মঞ্চের পেছনের দেয়ালে রঙিণ পাথর দিয়ে আকা সূর্যসেনের বিশাল এক আবক্ষ ছবি। সূর্যসেনকে এখানেই ফাঁসি দেয়া হয়েছিলো, এখন আবার সেই একই স্থানে তাকে পূজো দেয়া হচ্ছে, এটাই ইতিহাস, ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। কারাগারের দেয়াল ইতিহাসের ভাঙ্গাগড়ার নীরব স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকে চিরকাল।
সদ্য আগত বন্দীদের বলা হয় হাজতি, এবং সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের বলা হয় কয়েদী। কয়েদীদের মাঝে কারাগারের ভেতরের বিভিন্ন কর্ম বন্টন করে দেয়া হয়।
আমদানী ওয়ার্ডের দায়ীত্বপ্রাপ্ত একজন কয়েদী চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন “এই তোরা শিবিরের পুয়া কন কন আছস আত তুল চাই” শ’খানেক বন্দীর মধ্যে আমরা ১৩জন হাত তুললাম। তিনি আমাদের ১৩জনকে আলাদা করে একপাশে রাখলেন। আরেকজন কয়েদীকে নির্দেশ দিলেন “এই শিবির ভাইদের জন্য আলাদা ভালো বিছানা দিবি, তারা ছাত্র মানুষ, বিড়ি সিগারেট খায়না, বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া তারা সহ্য করতে পারবেনা, তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, সকালে উঠে ফজর নামাজ পড়বে, এক সাইডে তাদের বিছানা করবি”। এক নিঃশ্বাসে তিনি কথাগুলো বলে ফেললেন।
অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম কে এই লোক! ভাবলাম একসময় হয়তো শিবির করতো, তাই শিবিরের ভাইদের প্রতি এতটা আন্তরিক। পরে জেনেছিলাম তিনি অমুসলিম, রতনদা বলেই সবাই চেনে, জেলখানায় দীর্ঘদিন থাকার ফলে শিবিরের অনেক দায়ীত্বশীলের সাথে মিশে শিবিরের প্রতি তার পজেটিভ একটা ধারণা তৈরী হয়েছে, এবং কথা প্রসঙ্গে একদিন তিনি জানিয়েছিলেন, শিবিরের ছেলেদের তিনি ভালোবাসেন।

পর্ব-৬
ফাইল-ডাইল আর গাইল এই তিনে মিলে জেল খানা!
১৫ তারিখ। সারাদিনের শারিরীক-মানসিক ক্লান্তিতে কিনা জানিনা, চমৎকার ঘুম হলো। ফজরের নামাজের ইমামতি করলেন এনায়েত বাজার ওয়ার্ড ছাত্রশিবির সভাপতি আনোয়ার ভাই, আমাদের সাথে কয়েকজন কয়েদীও নামাজে শরীক হলেন। নামাজ শেষ হওয়ার পরে খুব করুণ ভাবে মোনাজাত পরিচালনা করলেন আনোয়ার ভাই। তার মোনাজাতের যে কয়টা লাইন মনে আছে সেগুলো হচ্ছে, “হে আল্লাহ তুমি জানো, আমাদের কোনো অপরাধ নেই। তোমার জমিনে তোমার দ্বীন কায়েমের জন্য কাজ করছি এটাই আমাদের অপরাধ, হে আল্লাহ আমাদের ভাইদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন জুলুম করা হচ্ছে, আমাদের প্রাণপ্রিয় দায়ীত্বশীলদের জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে, তুমি এই জালিম সরকারকে হেদায়েত দান করো, আর যদি তাদের নসীবে হেদায়েত না থাকে তবে তাদের ধ্বংশ করে দাও”। উচ্চস্বরে কান্নার পাশাপাশি আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে গেলো পুরো হলরুম, কেউ কেউ ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখছিলেন, হচ্ছেটাকি এখানে!
নামাজের কিছুক্ষণ পরেই একজন ঘোষক ফাইল! ফাইল! করে চেচিয়ে উঠলেন, ধরফর করে সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠলো, ফাইল অর্থহচ্ছে চারজন চারজন করে লাইন করে বসা, এটাই এখানের নিয়ম। প্রতিদিন তিনবার সকাল দুপুর এবং সন্ধ্যা ফাইল করে বসিয়ে আসামীদের মাথা গোনা হয়, কতজন আসামী আছে তার হিসেব করা হয়।
সকালে নানা রকম দাপ্তরিক কাজ শেষ করে, সবার মাঝে খুচুড়ি বিতরণ করা হলো, প্রতি শুক্রবার সকালে রুটির পরিবর্তে খিচুড়ি দেয়া হয়। খিচুড়ির পোঁকা বাছতে বাছতেই দেখলাম অনেকে খেয়ে দেয়ে হাত ধোঁয়া শেষ!
আনুমানিক সকাল ৯টার দিকে মাঈনুদ্দীন ভাই নামে এক কয়েদি(যাবজ্জীবন সাজা প্রাপ্ত) এসে আমাদের সাথে পরিচিত হলেন, তিনি জামায়াতের রুকন। পেশায় সম্ভবত মুসলিম স্কুল জামে মসজিদের খতিব ছিলেন। সদ্য আগত জামায়াত শিবিরের বন্দীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তিনি জানপ্রাণ দিয়ে সহায়তা করতে চেষ্টা করেন।
মাইনুদ্দীন ভাই আমাদের ১৩জনের নামের তালিকা নিয়ে গেলেন, তার ইচ্ছে ছিলো আমাদের সবাইকে একরুমে দিতে পারলে মানসিক ভাবে আমরা ভেঙে পড়বোনা। কিন্তু ততদিনে তিনি গরু ব্যবসায়ীদের শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন(গরু ব্যবসায়ীদের বিষয়ে পরের পর্বে বলা হবে), তারা সুবেদারের কাছে নালিশ জানালো মাঈনুদ্দীন ভাইয়ের জামায়াত কানেকশনের কথা, একদিন পানিশমেন্ট ওয়ার্ডে রেখে তার পরের দিন তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো কাশিমপুর কারাগারে।
খুব কস্ট হলো মাঈনুদ্দীন ভাইয়ের জন্য, সংগঠনের ভাইদের সহায়তা করতে গিয়ে নিজের পরিবারের সদস্যদের দুর্ভোগের মুখে ফেলে দিলেন! চট্টগ্রাম অধিবাসী তার পরিবারের সদস্যরা তাকে দেখতে হলে এখন থেকে গাজীপুরের কাসিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করতে হবে।

পর্ব-৭
জেল খানার সম্বল, থালা-বাটি কম্বল!
আমাদের চোখের সামনে দিয়েই মাঈনুদ্দিন ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো, চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিলোনা, আমরা এখানে বন্দী!
সদ্য আগত আসামীদের আড়ালে এখানে গরু বলা হয়, এবং চলে গরু বেচা-কেনা। বিভিন্ন ওয়ার্ডের দায়ীত্বপ্রাপ্ত ইনচার্জরাই গরুর ক্রেতা। কয়েদিদের মধ্য হতেই ইনচার্জ বানানো হয়, সেখানেও চলে গোপন লেনদেন। গরু ব্যাবসায়ীদের হাত অনেক লম্বা, নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জেল সুপার পর্যন্ত সবাই গরু বিক্রির টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন।
শিবিরের গরুর দাম একটু বেশি, কারণ যারা শিবির করে তাদের অধিকাংশেরই আর্থিক অবস্থা মোটামুটি পর্যায়ের, অন্যান্য আসামীদের মতো কথায় কথায় মারামারিতে লিপ্ত হয়না এবং প্রায় সব আসামীরাই এটা জানে শিবিরের ছেলেরা জেল খানায় বেশি দিন থাকেনা, সংগঠনের আইনজীবীরা তাদের মুক্ত করার জন্য জান-প্রাণ দিয়ে চেস্টা করে। অল্প সময়ে বেশি লাভ করার জন্যই মূলত শিবিরের গরুর এত চাহিদা। তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার কাজ করে সেটা হচ্ছে ওয়ার্ডে নামাজ পড়ানোর জন্য ঈমাম সংকট। শিবিরের ছেলেরাই যার যার ওয়ার্ডে ঈমামতির দায়ীত্ব পালন করে।
মাঈনুদ্দীন ভাই ধরা খেয়ে যাওয়াতে আমাদের নামের তালিকা জেল কতৃপক্ষের হাতে চলে যায়, আমাদের তেরো জনকে একসাথে রাখার পরিবর্তে ভিন্ন ভিন্ন তেরোটি ওয়ার্ডে বরাদ্দ করা হয়।
বিকাল বেলা সবার হাতে একটা থালা, একটা বাটি এবং দুটি পুরাতন ময়লা যুক্ত কম্বল দিয়ে যার যার বরাদ্দকৃত ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
এক হাতে কম্বল, অন্য হাতে থালা ভর্তি গন্ধযুক্ত বিশ্রী চেহারার ভাত, পোকাযুক্ত ডাল এবং বুড়ো আঙুলের কড়ের সমান এক টুকরো ভাজা মাছ নিয়ে লাইন করে ওয়ার্ডের দিকে যাওয়ার সময় ছল ছল চোখে আত্মার আত্মীয় ভাইদের এক এক করে ভিন্ন পথে প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এত অল্প সময়ে এত আপন হয়ে যাওয়া, বিচ্ছেদের এই অনুভূতি, এ কেবল ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের দ্বারাই অনুভব করা সম্ভব!

পর্ব-৮
পাঁচতলা একটা ভবন, ভবনের মাঝ বড়াবড় সিঁড়ি, প্রতি ফ্লোরের দু’পাশে দু’টি করে চারটি ওয়ার্ড, ঠিক আমাদের স্কুল ভবনের মতো। ওয়ার্ডের সম্মুখে টানা ব্যালকনি, ব্যালকনিতে মোটামোটা শিক দিয়ে বাহিরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বারবার গুনেও চৌদ্দ শিকের হিসেব মেলাতে পারিনাই। কেনোযে মানুষ জেলখানাকে চৌদ্দ শিখ বলে!
আমাকে নেয়া হলো কর্ণফুলী ভবনের তৃতীয় তলার ৮নম্বর ওয়ার্ডে, এখন থেকে জেলজীবনে এটাই আমার ঠিকানা।
ভবনের পরিবেশ মোটামুটি সুন্দরই বলা যায় নিচের তলায় একদিকে প্রিজন ক্যান্টিন, অন্যদিকটা খালি। ক্যান্টিন থেকে পিসি কার্ড দিয়ে শুকনো খাবার, ফল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা যায়। পঞ্চম তলার একদিকে জেএমবি’র ওয়ার্ড এবং অন্যদিকে পানিশমেন্ট ওয়ার্ড। কারাগারের ভেতরে যারা মারামারি করে তাদের পাঠানো হয় ওই পানিশমেন্ট ওয়ার্ডে, পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে ওয়ার্ডের ভেতরে বন্দী করে রাখা হয়, তাদের জন্য বাহিরে বের হওয়া নিষেধ। ভবনের সামনের আঙ্গিনায় বাহারী ফুলের বাগান, বন্দীরা দিনের বেলায় সেখানে ঘোরাফেরা করতে পারে।
প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে আসামীর সংখ্যা ৪০-৪৫জন। ওয়ার্ডে আসার কিছুক্ষণ পরেই ফাইল করা হলো। মাথাগোনা শেষ করে ওয়ার্ড তালাবদ্ধ করে মিয়াসাবরা চলে গেলেন, কারারক্ষীদের এখানে মিয়াসাব বলা হয়।
লম্বা মসজিদের মতো খোলামেলা একটা রুম, বিশাল বিশাল জানালা, জানালাগুলোতেও মোটামোটা শিক লাগানো। মেঝেতে প্রতিটি আসামীর জন্য দেড় হাত করে জায়গা বরাদ্দ। বরাদ্দকৃত দু’টি কম্বলের একটি ভাজ করে বিছানা আরেকটি দিয়ে বালিশ বানাতে হয়।
মাগরীবের নামাজের পরেই সবাই খেতে বসে গেলো, এখানে এটাই নিয়ম। আর ভাতের যা অবস্থা তাতে করে দেরী করলে এই পঁচা চালের ভাত মুখে দেয়ার উপযুক্ত থাকবেনা। ক্ষুধা ছিলোনা, তারপরেও নাক চোখ চেপে খেতে বসে গেলাম। তীব্র দূর্গন্ধযুক্ত ভাত, ডালের মাঝে পোকা, খাবারের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেটে পানি চলে আসলো, আল্লাহ এই অখাদ্য রিজিকে ছিলো! এগুলো খেয়েই কি বেঁচে থাকতে হবে! দুই তিন লোকমা খাওয়ার পরে পেট মুচড়ে উঠলো, ফেলে দেয়া ছাড়া উপায় ছিলোনা।
খাওয়ার পরে ওয়ার্ড ইনচার্জ কফিল(যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত) আমাকে ডেকে নিলেন, কারাগারের নিয়ম কানুন সম্পর্কে ব্রিফ করা হলো। তিনি আমাকে একটা প্রস্তাব দিলেন আমি যদি তার সাথে একটা চুক্তি করি তবে আমার ব্যবহার্য পানি নিচ তলা থেকে আমাকে টেনে আনতে হবেনা, তার লোকেরাই সেটা এনে দিবে। আর সরকারী খাবারের পরিবর্তে উন্নতমানের ভালো খাবার এবং ভালো বিছানার ব্যবস্থা করা হবে। বিনিময়ে তাকে চার হাজার টাকা দিতে হবে। গরু কিনে আনার মুজেজা এবার ক্লিয়ার হলো। দর কষাকষির সুযোগ মিস করলামনা, মাত্র দু’হাজার টাকায় রফা হলো। পরে শুনেছি কারও কারও কাছে থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ড ইনচার্জরা চাপ দিয়ে ৬-৭ হাজার টাকাও আদায় করেছে!

পর্ব-৯
রাখিব নিরাপদ দেখাবো আলোর(পড়ুন পাপের) পথ।
১৬ অক্টোবর ২০১২। ৪৫জন আসামীর মধ্যে ফজরের নামাজে মুসল্লি ছিলো ৬-৭জন, যারা এশা’র নামাজ আদায় করেছে তাদের মধ্যে অনেকেই দেখলাম ফজরের সময় অঘোরে ঘুমাচ্ছে। নামাজের কিছুক্ষণ পরে একজন ফাইল ফাইল করে চেচিয়ে উঠতেই সবাই ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে লাইন করে বসে পড়লো, বুঝলাম নগদে মাইরের উপর ঔষধ নাই!
ভবনের সামনের আঙিণায় পানি ভর্তি বিশাল দু’টি হাউজ, রাতের বেলায় হাউজ ভর্তি করে রাখা হয়, আয়রণ মিশ্রিত পানি কটকটে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। নোংরা পানি দেখতেই অরুচী হয়। ওয়ার্ডের গেট খুলে দিতেই পুরো বিল্ডিংয়ের মানুষ কেউ মগ, কেউ থালা নিয়ে হুড়মুড় করে নিচে চলে গেলো গোসল করার জন্য। সে কি কাড়াকাড়ি! কার আগে কে গোসল করবে! পানি শেষ হয়ে গেলে আর গোসল হবেনা। অনিচ্ছা সত্বেও গোসল করতে হলো, জেল খানার যা পরিবেশ চুলকানি হবে মাস্ট, তাই ঝুঁকি নিলামনা।
একই ওয়ার্ডে হরকে রকম মানুষ, চোর,ডাকাত,ছিনতাইকারী,জালটাকার ব্যবসায়ী,নারী নির্যাতন মামলার আসামী,মাদক বিক্রেতা,অপহরণকারী,খুনি সবই আছে এখানে, আছে বিপুল সংখ্যক নিরাপরাধ সাধারণ মানুষ। জেল জীবনে যেটা লক্ষ করেছি, আসামীদের প্রায় ৬০% হচ্ছে নিরাপরাধ, আসামী ধরতে হবে তাই পুলিশ ধরে আনে, অপরাধী কিনা সেটা পরে যাচাই করা যাবে।
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার উল্লেখ করছি, আমার পরিচিত এক বড় ভাই চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা দিয়ে যাচ্ছিলো, ওই সময় পুলিশ ২জন দাড়ি টুপি পড়া লোককে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ সদস্য তার পরিচিত হওয়ায় গ্রেপ্তারের কারণ জানতে চাইলে, পুলিশ জানালো আজকে কমপক্ষে ৫জন শিবির ধরার নির্দেশ আছে। বড় ভাই জিজ্ঞাসা করলো বাকি তিনজন কোথায় পাবেন? পুলিশ সদস্য জবাব দিলো, দেখি রাস্তা থেকে দাড়ি টুপি ওয়ালা দেখে তিনজন নিয়ে যাবো, চাকরি বাঁচাতে হবেতো!
কারাগারের স্লোগান হলো “রাখিব নিরাপদ দেখাবো আলোর পথ”। চমৎকার স্লোগান! তবে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন! চোর এখানে এসে ডাকাতের সাথে পরিচিত হয়, তৈরী হয় ডাকাতের সিন্ডিকেট। যারা এতদিন ছুড়ি হতে ছিনতাই করতো তারা এখানে এসে অস্ত্রব্যবসায়ীর সাথে পরিচিত হয়, জেল থেকে বের হয়ে অটোমেটিক মেশিন হাতে ছিনতাই করে। আমার ওয়ার্ডের এক মাদকব্যবসায়ী একদিন কথা প্রসঙ্গে জানালো, ভাই মদ ব্যবসাতে লাভ কম, ভাবছিলাম ইয়াবা ব্যবসা করবো, কিন্তু অনেক খুজেও চ্যানেল পাচ্ছিলামনা। এখানে আসাতে ভালোই হলো অনেকগুলো ডিলারের সাথে পরিচয় হয়েছে, বাহির হয়ে ইয়াবা ব্যবসা শুরু করবো। কয়েকজন অস্ত্রব্যবসায়ী প্রস্তাব দিলো, আপনারাতো পলিটিক্স করেন জিনিসপত্র লাগলে বইলেন, প্রয়োজনে আমার লোকেরা বাসায় গিয়ে পৌছে দিবে। তাদেরকে বুঝিয়ে বললাম শিবির অস্ত্রের রাজনীতি করেনা, কিন্তু বিশ্বাস করলো বলে মনে হয়না। এক পেশাদার খুনির সাথেও পরিচয় হয়েছিলো, তিনিও প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে বলেছেন, কি ভয়াবহ অবস্থা কল্পনা করা যায়!?
জেল জীবনে সবচাইতে যেটা অসহ্য লাগতো সেটা হচ্ছে সিগারেটের ধোঁয়া, হাতে গোনা কয়েকজন বাদে সবাই ধূমপায়ী। নাক চেপে ধরে, নিশ্বাস বন্ধ করে কতক্ষণ থাকা যায়! ব্যালকনিতে গিয়েও নিস্তার নেই, সেখানেও কেউনা কেউ ধূমপান করছে। একটু নির্মল বাতাসের জন্য ফুসফুস হাসফাস করতো কিন্তু উপায় নেই! কিছুদিনের মধ্যে অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গেলাম, শেষের দিকে আর কস্ট হতোনা।

পর্ব-১০
চমৎকার গালি জানে জেল খানার মানুষগুলো! বসে বসে তাদের গালাগালি আর সিগারেট টানা দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আপাতত। ওয়ার্ডে একটা রঙিন টিভি আছে, কতৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিতেই হয় সরকারের উন্নয়নের জোয়ার দেখানোর ব্যবস্থা করার জন্য, কারণ বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল নেই।
বিটিভিতে জামায়াত শিবিরের নৃশংসতার উপর ডকুমেন্টারী প্রচারিত হয়। ইস! কি নির্মম ভাবে পুলিশের উপর হামলা করছে শিবির ক্যাডাররা, আসামীরা সেটা দ্যাখে আর সমস্বরে হৈ হৈ করে উঠে, মার শালাদের! আরো মার! শুরু হয় রাজনৈতিক আলোচনা! পুলিশরে আরো মাইর দেয়া দরকার, জামাত-শিবিরই পারবো সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে, বিএনপি শ্যাষ, শিবির আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় করেনা, শিবিরের কাছে যে অস্ত্র আছে তা দিয়ে দুইটা বাংলাদেশ দখল করা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি আজগুবি সব আলোচনা।
দুপুরে খাবার পরে বারান্দায় পায়চারী করছি তখনি পাশের ৭নম্বর ওয়ার্ডে দেখলাম জামায়াত কর্মী হানিফ ভাইকে, আমাকে দেখেই হানিফ ভাই জড়িয়ে ধরলেন। খুব সহজ সরল মধ্যবয়সী মানুষ, নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন, পেশায় টাইলস মিস্ত্রি। আমাদের ১৩জনের গ্রুপে হানিফ ভাইও একজন, আমরা যে পাশাপাশি দু’টি ওয়ার্ডে আছি তা দু’জনের কেউই জানতামনা। হানিফ ভাইকে কাছে পেয়ে দু’জনেই স্বস্থি পেলাম, অদ্ভুত এই পরিবেশে সংগঠনের ভাই হচ্ছে সবচাইতে কাছের মানুষ।
৮নম্বর ওয়ার্ডে শিবির এসেছে খবর পেয়ে মহানগরী উত্তরের বদিউর রহমান ভাই ছুটে এলেন, ছোট খাটো গড়নের মানুষটি, লম্বা দাড়ি, সদা হাস্যময় চেহারা। অস্ত্রমামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তাকে। বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে নাটক সাজানোর চেস্টা করেছে, মহানগরী দায়ীত্বশীলদের জড়িয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য রিমান্ডের নামে চালানো হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। শেষ পর্যন্ত সক্ষম হয়নাই।
বদিউর রহমান ভাই আছেন ৪নম্বর ওয়ার্ডে, তার কাছেই জানতে পারলাম আমাদের ১৩জনের গ্রুপের মধ্যে জামায়াত কর্মী ইউসুফ ভাই তার রুমেই আছেন। এনায়েত বাজার ওয়ার্ড শিবির সভাপতি আনোয়ার ভাই ১২নম্বর ওয়ার্ডে, জামায়াত কর্মী হোসাইন ভাই ১৪নম্বরে, বাকিদের মধ্যে সংগঠনের সাথী মেডিক্যাল ছাত্র রেজাউল করিম দেখতে বাচ্চা বাচ্চা চেহারা হওয়ায় শিশু ওয়ার্ডে জায়গা করে নিয়েছে, তার সাথে ছিলো কুতুব উদ্দিন, কুতুব উদ্দিন সংগঠনের সাথী। আমাদের সাথে দুইজন আব্দুল্লাহ ছিলো, দু’জনকেই রাখা হয়েছে কারাগার মেডিক্যালে। এর মধ্যে জামায়াত কর্মী আব্দুল্লাহ ভাইয়ের অবস্থা ছিলো খুবই খারাপ, পুলিশ গ্রেপ্তার করে তার উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে, পিচঢালা পথে টেনে হিচড়ে গাড়িতে তুলেছে , হাতে পায়ে সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত সৃস্টি হয়েছিলো। মোটা মুটি সবার অবস্থান সম্পর্কে কিছু তথ্য পেয়ে এবং কর্ণফুলী ভবনে ৫জন ভাইকে পেয়ে মনটা একটু হালকা হয়ে গেলো। সময়টা খারাপ কাটবেনা! এরপর থেকে কর্ণফুলী ভবন শিবিরের অফিস হয়ে গেলো বদিউর রহমান ভাইয়ের রুম, জেল জীবনে তিনিই ছিলেন আমাদের অভিভাবক, কর্ণফুলী-৪ এখানেই হতো আমাদের আড্ডা।

পর্ব-১১
বাহিরের খবরের জন্য মন উসখুস করছিলো, মামলার কি অবস্থা, জামিন হবে কিনা, ওদিকে ২২অক্টোবর আবার পরীক্ষা শুরু, সব মিলিয়ে মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা কাজ করছিলো।
আসর নামাজের পরে ভিজিটর স্লিপ এলো, দর্শনার্থীদের জন্য তিনতলা একটা ভবন, ভবনের নিচের তলার একদিকে মহিলা বন্দীদের অভিভাবকদের জন্য এবং অন্য অংশটি পুরুষ বন্দীদের অভিভাবকদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। ২য় এবং ৩য় তলা বন্ধ রাখা হয়, অবশ্য ৫০০-১০০০টাকা ঘুশের বিনিময়ে ২য় তলায় নিরিবিলিতে কথা বলা যায়। জানালার গ্রিলের ফাক দিয়ে কথা বলতে হয়, উভয় প্রান্তে জালি এবং মধ্যখানে তিনস্তরের লোহার শিক বিশিষ্ট জানালা। চিরিয়া খানার বানরের সাথেও এর চাইতে ভালো ভাবে কথা বলা যায়! অতিসূক্ষ দৃস্টি শক্তি এবং তীব্র গর্জনশীল কন্ঠস্বর না থাকলে কথা বলা এবং শুনতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। প্রচুর সংখ্যক আসামী তাদের অভিভাবকদের সাথে একই স্থানে বসে কথা বলছে, কান্না কাটি, হৈচৈ, ঝগড়া! এর মধ্যে নিজের লোকের কথা বুঝতে হলে ঠোটের দিকে তাকিয়ে থেকে কথা বুঝে নেয়া ছাড়া উপায় নেই।
জানালার ফাঁক গলে তাকাতেই দেখলাম মহানগরীর অর্থসম্পাদক শাহীন ভাই এবং বর্তমান খুলশী থানা সেক্রেটারী মামুন ভাইয়ের নেতৃত্বে বেশ কিছু ভাই দেখা করতে এসেছেন।
শাহীন ভাইকে দেখে রসিকতা করে বললাম, কি ভাই সেই যে শ্বশুর বাড়ি দিয়ে গেলেন আরতো খোজ নেয়ার নাম নেই! শাহীন ভাই জানালেন মামলা জটিল কিছুনয় ৫৪ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, দ্রুত জামিন হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। বাড়ির খবর জানতে চাইলে বললেন, আমার বড় আপার সাথে মোবাইলে কথা বলার মাঝখানে হঠাৎ ওপাশ থেকে কথা বন্ধ হয়ে যায়, পরে দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলে জানতে পারেন, আপা জ্ঞান হারিয়েছেন। শাহীন ভাইকে সতর্ক করে দিলাম আব্বা যেনো কিছুতেই জানতে নাপারেন, অলরেডি ২বার স্ট্রোক করেছে! শাহীন ভাই আশ্বস্ত করলেন, জানালেন আব্বা এখনো কিছুই জানেনা!
আমি যেই এলাকায় থাকি সে এলাকার উপশাখা সভাপতি তাওহীদও এসেছে, তাকে এলাকার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। আমার ধারণা ছিলো, ঐ এলাকায় শিবিরের কবর রচিত হয়েছে! যেভাবে হাজার হাজার মানুষের সামনে দিয়ে মারধর করে, হাতকড়া পড়িয়ে আমাকে পুলিশে তুলে দেয়া হয়েছে, তাতে করে আর কোনো অভিভাবক তার সন্তানকে শিবিরের সাথে মিশতে দিবে বলে মনে হয়না। কিন্তু তাওহীদ শোনালো অন্য কাহিনী, আমাকে গ্রেপ্তার করায় এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃস্টি হয়েছে, এলাকার মানুষ স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দকে যা-তা বলছে! আওয়ামীলীগ নেতারা মুখ রক্ষা করতে পারছেনা! তারা অনেকেই এখন বলতে চাচ্ছে তারা ব্যাপারটি জানতোনা, জানলে এমন ঘটনা ঘটতোনা। এলাকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃস্টি হয়েছে, এক কট্টর আওয়ামীলীগ সমর্থক তার ছেলেকে শিবিরের হাতে তুলে দিয়েছেন, অথচ এতদিন তার ছেলেকে শিবিরের প্রগ্রামে যেতে বাঁধা দিতেন, মারধর করতেন। (পরবর্তীতে যেদিন চট্টগ্রামে আবিদ ভাই শহীদ হলেন সেদিন তার ছেলেও গুলিবিদ্ধ হয়েছিলো, সেটা অন্যদিন বলা যাবে)।
তাওহীদ আরো জানালো, আগে যেখানে আমার এলাকা থেকে ৫-৬জনের বেশি ছেলেকে মিছিলে পাওয়া যেতোনা, সেখানে গতকাল মিছিলে ১২জন উপস্থিত হয়েছে।
“তারা আল্লাহর দ্বীনের আলোকে ফুঁৎকারে নিভিয়ে দিতে চায় কিন্তু আল্লাহ তার দ্বীনের আলোকে প্রজ্জলিত রাখেন, যদিও মুশরিকরা অপসন্দ করে”।

পর্ব-১২
কবরের বিষন্নতা এখানে, এযেনো দুনিয়াতেই কবরের উপলব্ধি! বিচার দিবসের জন্য অনন্তকালের প্রতিক্ষা। দুনিয়ার কারাগারে অর্থ সম্পদ এবং রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করে যেমন ডিভিশন দেয়া হয়, তেমন আল্লাহর কারাগারে সৎকর্ম এবং আমল বিবেচনা করে কবরে ডিভিশন দেয়া হয়। সকল ব্যস্ততার অবসান ঘটেছে এই লাল পাচিলের অভ্যন্তরে। টাইম পাসের জন্য লুডু,টেলিভিশন,আড্ডা এবং সিগারেটই একমাত্র অবলম্বন (সর্ব সাধারণের জন্য)। বারান্দার লোহার শিক ধরে মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কতযে সময় পার করেছি তার ইয়াত্তা নেই!
আল্লাহর অশেষ রহমতে একটা তাফসীর মা’রেফুল কুরআন পেয়েছিলাম, হয়তো আমার আগের কোনো ভাই রেখে গিয়েছিলেন। সময় কাটাতাম কুরআনের তাফসীর পরে, আড্ডা দিয়ে এবং কখনো কখনো পত্রিকা পড়ে। সত্যি বলতে কি আমার জীবনে সবচাইতে বেশি ইবাদত করেছি ওই কারাগারে, ইবাদত করার জন্য এর চাইতে উপযুক্ত স্থান দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি আছে বলে জানা নেই। কুরআনের যে আয়াতটি কারাজীবনে সবচাইতে বেশি অনুপ্রাণীত করতো সেটা হচ্ছে , “নিশ্চই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো কিছুটা ভয় ভীতি (ভীতিপ্রদ পরিস্তিতি)ক্ষুধা এবং মাল,জান ও ফল-ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে।আর ধৈয অবলম্বন কারীদেরকে সুসংবাদ দাও।বাকারা-১৫৫”
অখন্ড অবসর, প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর সাহায্যের জন্য প্রতীক্ষা, এই দুঃসহ কারাজীবন একটা মানুষকে আল্লাহর মুখাপেক্ষি করতে বাধ্য। এজন্যই বোধহয় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ইসলামী ছাত্রশিবিরের কোন এক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে এসে বলেছিলেন, আমার হাতে যদি কারাদণ্ড দেয়ার ক্ষমতা থাকতো, শিবিরের প্রতিটি সদস্যকে কমপক্ষে তিনমাস কারাদন্ড বাধ্যতামূলক করে দিতাম।
১৭ তারিখ সকালে কারাগার অফিস থেকে ডাক আসলো, কেইস কার্ড নিয়ে অফিসে হাজির হলাম। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানালেন আমার নামে নতুন মামলা এসেছে! কাজীর দেউরীতে গাড়ি ভাংচুর, পুলিশের কাজে বাঁধা দান, পুলিশের উপর হামলা ইত্যাদি ৫-৬টা ধারা সম্বলিত একটি মামলা। অফিস থেকে ওয়ার্ডে আসার পরে সবাই ঘিরে ধরলো কি ব্যাপার ভাই অফিসে কেনো ডেকেছিলো? জানালাম আমার মামলার বাচ্চা হয়েছে! একটা নিয়ে এসেছিলাম এখন কিভাবে যেনো মামলা দুইটা হয়ে গেছে, বাচ্চা না হলেতো এটা সম্ভব নয়।
শিবিরের সাথে সরকারের আচরণ এমনই যেকোনো ভাবে গ্রেপ্তার করতে পারলেই হলো, পুরাতন শিবির সংশ্লিষ্ট যতগুলো মামলা আছে সবগুলোতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আমার পরে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের কাউকে কাউকে কারাগারে আনার পরে ৩-৪টা করে পুরাতন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

পর্ব-১৩
জেল খানার সম্বল বিড়ি আর সিগারেট!
প্রায় প্রতিদিনই গ্রুপে গ্রুপে দেখা করতে আসতেন সংগঠনের ভাইয়েরা। দিয়ে যেতেন নানা ধরনের শুকনো খাবার এবং বিড়ি-সিগারেট। এখানে একটা বিষয়ে সবাইকে অবাক করে দিতো, সেটা হচ্ছে জামায়েত-শিবিরের কর্মী সমর্থকদের পরস্পরের প্রতি ঈর্ষনীয় আন্তরিকতা। বিএনপি’র অনেক কর্মীদের দেখতাম আপসোস করে বলতেন, ভাই আপনারা জেলে থেকেও কত সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন, দল আপনাদের মামলা চালাচ্ছে, মামলা নিয়ে আপনাদের চিন্তা করতে হচ্ছেনা, খাবার; বিছানা; কাপড় সব দলের পক্ষ থেকে পাঠাচ্ছে, আর আমাদের দল আমাদের খবরও নেয়না। হাসতে হাসতে জবাব দিতাম আপনারা জেলে থাকলেতো যারা বাহিরে আছে তাদের লাভ, আপনাদের পোস্ট তারা দখল করতে পারবে, এই সুযোগ তারা কেনো হারাবে? আর আমাদের দলে পোস্ট হারানোর কোনো চিন্তা নেই, আমরা কেউ পোস্টের জন্য সংগঠন করিনা, সংগঠনের এক ভাই কস্ট পেলে আমরা সেটাকে নিজের কস্ট মনে করে ঝাপিয়ে পরি।
কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করতো সংগঠন মাসে আমাদের কতটাকা করে বেতন দেয়! অনেকেই জেল থেকে বের হয়ে সংগঠনে যোগ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতেন, তাদের ধারণা ছিলো সংগঠন বোধহয় আমাদের মাসিক ভাতা দেয়। তাদেরকে যখন বলা হতো জামায়াত-শিবির করতে হলে প্রতি মাসে সংগঠনকে নির্দিষ্ট অংকের চাদা দিতে হয় দল পরিচালনার জন্য, তখন তারা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করতো আপনিও দেন!?
এত বেশি পরিমাণে খাবার আসতো যে সেটা একজন মানুষের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে যেতো, তুলনামূলক দরিদ্র আসামীদের মধ্যে খাবারগুলো বিলি করতাম। এমন অনেক আসামী আছে যারা দীর্ঘদিন ধরে জেলে বন্দি আছেন কিন্তু আত্মীয়-স্বজন তাদের কোনো খোজ খবর নেয়না, তাদের চেয়ে অসহায় মানুষ মনে হয় এই দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি খুজে পাওয়া যাবেনা।
সবসময় শুনতাম জেলখানার সম্বল থালা বাটি কম্বল, কিন্তু এখানে এসে ধারণা পরিবর্তন হয়ে গেলো। হাতে যদি পর্যাপ্ত পরিমানে সিগারেট থাকে তবে তাকে জেলখানার রাজা বলা যায়। আপনি কোনো অন্যায় করেছেন আপনার শ্বাস্তি হবে, এক প্যাকেট সিগারেট দিয়ে দিন, মামলা শেষ। বাবুর্চির হাতে মাত্র একপ্যাকেট সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে দিন, বিনিময়ে এক সপ্তাহ ধরে আপনার কাছে মগ ভর্তি গরম ভাত পৌছে যাবে। আর ছোট খাটো ঘুষের জন্য ব্যবহার করা হয় বিড়ি।
মানুষ পারেও বটে, ভাতের মতো করে ধূমপান করে। ভাত না খেলে চলে কিন্তু বিড়ি ছাড়া জীবন অচল!
কারাগারের প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন চেয়ারম্যান আছে, অনেকেই হয়তো ভাবছেন কারাগারে গিয়ে চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছেটা এবার পূরণ করে নিবেন! তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, কারাগারের চেয়ারম্যানের দায়ীত্ব হচ্ছে ওয়ার্ডের টয়লেট এবং অন্যান্য ময়লা আবর্জনা ধোয়ামোছা করে ওয়ার্ড পরিচ্ছন্ন রাখা, বিনিময়ে তাকে দু’প্যাকেট বিড়ি দিতে হয়।

পর্ব-১৪
একদল শিবির নেতাকর্মী নিয়ে দুলাভাই এসে হাজির হলেন ১৮তারিখ বিকেল বেলায়, সাথে সিটি কর্পোরেশনের জামায়াত সমর্থিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহফুজ আলম ভাই। বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হলো, তিনি পারিবারিক ভাবে মামলা পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হলো ব্যাপারটি জটিল হয়ে যাবে, আমাদের নিজস্ব আইনজীবি আছেন তারা এব্যাপারে দক্ষ। কট্টর লীগ সমর্থক আমার এই ভাই, সরকারী অফিসার হওয়ার কারণে এখন প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি করতে না পারলেও একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। আমার হাসিখুশি চেহারা দেখে কিছুটা অবাক হয়েই বললেন, তুমিতো মনে হচ্ছে ভেতরে খুব আনন্দেই আছো, ওদিকে বাড়িতেতো কান্নাকাটির ধুম পড়ে গেছে, তোমার বোন খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে!
ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহফুজ আলম ভাইয়ের সাথেও কুশল বিনিময় হলো, একজন রাজনীতিবিদের মধ্যে যতরকম গুণাবলী দরকার সবগুলোই এই মানুষটার মধ্যে বিদ্যমান, মাঝে মাঝে মনে হয় আল্লাহ তাকে রাজনীতি করার জন্যই বোধহয় দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন! বয়সে নবীন এই মানুষটি আওয়ামী অধ্যুষিত এলাকায় তিন তিনবার নির্বাচিত আওয়ামীলীগের শক্তিশালী প্রার্থিকে পরাজিত করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। সবচাইতে অবাক ব্যাপার হচ্ছে জামায়াত প্রার্থী হওয়া সত্বেও তিনি হিন্দু ভোটারদেরও সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। তার নির্বাচনী এলাকাতে গত দুই বছরে তিনি যতগুলো সমাজসেবা মূলক কাজ করেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ওই এলাকায় এত কাজ হয়নি। ২২তারিখে পরীক্ষার আগেই জামিনের চেস্টা চলছে জানিয়ে তারা বিদায় নিলেন।
সাক্ষাৎ শেষে ফুরফুরে মেজাজে ওয়ার্ড এসে আড্ডায় ডুবে যেতাম, কখনো ৭নম্বর ওয়ার্ড কখন আনোয়ার ভাইয়ের ১২নম্বরে কিংবা হোসাইন ভাইয়ের ১৪নম্বরে, আর রেগুলার ডিউটি হিসেবে বদিউর রহমান ভাইয়ের রুমতো আছেই। জেল জীবনে অনেক ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, তাদের একেক জনের ঘটনা লিখতে গেলে একেকটা জনপ্রিয় নাটকে পরিণত হবে। ৮নম্বর ওয়ার্ডে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো দেলাওয়ার ও সালাউদ্দীনের সাথে, দুজনেই পটিয়ায় হিন্দু মন্দির ভাংচুর মামলার আসামী। ৭নম্বর ওয়ার্ডের তারেক ও মোর্শেদ, তারেক আমার কলেজ লাইফের বন্ধু, জোড়পূর্বক পাওনা টাকা আদায় করতে গিয়ে অপহরণ মামলার আসামী। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী হয়েছিলো সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর ডানহাত হিসেবে পরিচিত রাউজানের বিধান বড়ুয়ার সাথে, তার নামে সম্ভবত ৭২টি মামলা, কারাগারের সবাই তার সাথে হিসেব করে কথা বলে! আরো পরিচিত হয়েছিলাম মীরসরাই ট্রাজেডির সেই ট্রাক ড্রাইভারের সাথে, যার ভুলের কারণে ঝড়ে গেলো ৪৫টি শিশুর তাজা প্রান। আপনারা অনেকেই হয়তো রসু খাঁর নাম শুনে থাকবেন, হ্যা আমি সেই রসুখার কথাই বলছি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সিরিয়াল কিলার, তিনি আমার পাশের ওয়ার্ডেই ছিলেন, কয়েকবার তার সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম। যারা রসু খাকে চিনতে পারেননাই তারা গুগলে সার্চ দিতে পারেন।
৭নম্বর ওয়ার্ডে পরিচয় হয়েছিলো ফয়সলের সাথে, অপহরণ মামলার আসামী। রিমান্ডের আগেই পিটিয়ে ছেলেটির হাতের বাড়টা বাজিয়ে দিয়েছে পুলিশ। ফয়সলের বন্ধু প্রেম করতো একটি মেয়ের সাথে, ফয়সল টুকটাক দালালী করতো বন্ধুর জন্য। একদিন বন্ধু লুকিয়ে বিয়ে করে, মেয়েটিকে হানিমুনে নিয়ে যায় কক্সবাজারে। মেয়ের বাপের অপহরণ মামলা আর ফয়সলের হানিমুন এই ৭নম্বর ওয়ার্ড। সারাদিন ভুস ভুস করে বিড়ি টানতো আর কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান, ভাইয়া আমার জামিন হবে?

পর্ব-১৫
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান বানে, আর ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা ফাঁসির মঞ্চে উঠেও ছড়িয়ে দেয় কোরআনের বাণী। এ প্রসঙ্গে ইখওয়ানের সাঈয়েদ কুতুবের একটি ঘটনা উল্লেখ করছি, জালিম সরকার ইসলামী আন্দোলনের এই প্রাণপুরুষকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলো, ফাঁসির পূর্ব রাতে কারাগারের ঈমামকে পাঠানো হয় তাকে কলেমা পড়ানোর জন্য। সাঈয়েদ কুতুব তাকে জিজ্ঞাসা করেন আপনি কি এই কলেমা পড়ানোর জন্য বেতন পান? ইমাম স্বীকার করলেন হ্যা সরকার বেতন দেয়। সাইয়েদ কুতুব তখন বললেন, যে কালেমার ব্যাখ্যা মানুশকে জানানোর অপরাধে আমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে সেই কালেমা পড়ানোর জন্য সরকার আপনাকে বেতন দিচ্ছে! বুঝা যাচ্ছে আপনার কালেমার বুঝ আর আমার কালেমার বুঝ এক নয়, আপনার কোনো প্রয়োজন নেই।
আমরা হাসান আল বান্না, সাঈয়েদ কুতুবের উত্তর প্রজন্ম! আমাদের পূর্ববর্তী ছিলেন সালাউদ্দীন আইয়ূবী,মুসা ইবনে নুসায়ের। আমাদের জাতির ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন তারিক বিন জিয়াদ, মুহাম্মদ বিন কাসিম, বখতিয়ার খলজি! যাদের দিন কেটে যেত ঘোড়ার পিঠে, রাত কাটতো যায়নামাজে দাঁড়িয়ে। আমরা কেনো জালিমের কারাগারে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবো!
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তিগত ভাবেই দাওয়াতী কাজ চলতে থাকলো, পরবর্তীতে বদিউর রহমান ভাইয়ের রুমে বসে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে যেহেতু জনশক্তি বৃদ্ধির সুযোগ নেই সেহেতু সংগঠন সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করাই হবে আমাদের মূল টার্গেট। যেহেতু অধিকাংশ ওয়ার্ডের ইমাম ছিলো সংগঠনের ভাইয়েরা সেহেতু কাজটা আমাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে গেলো, আর কারাগারের পরিবেশটাও এমন, দুনিয়াবী কোনো ব্যস্ততা না থাকার কারণে মনযোগী শ্রোতা পাওয়া যায়। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে বিপুল সংখ্যক লোকের কাছে আমাদের ম্যাসেজ পৌছুতে পেরেছি। এদের মধ্যে অনেকেই বের হয়ে সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। কারাগার প্রশাসন ইসলামী বই ঢুকাতে কড়াকড়ি আরোপ না করলে, আমাদের যে বিপুল সংখ্যক ভাই এখন কারাগারে তাতে করে জামায়াতে ইসলামী কারাগার শাখা প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব ছিলোনা।
কারাগারের বাহির থেকে যেমন সহযোগীতা আসতো তেমনি ভেতর থেকেও সংগঠনের পুরাতন কয়েদীরা আমাদের সাথে রেগুলার যোগাযোগ রক্ষা করতেন, যেকোনো সমস্যা সমাধানে ঝাপিয়ে পড়তেন, সংগঠনের ভাইকে নিজের ভাই মনে করে সহযোগীতা করতেন। নিরাপত্তাগত কারণে সেইসব ভাইদের নাম এখানে প্রকাশ করছিনা।
কারাগারে শিবির শব্দটির সুন্দর একটা অর্থ আছে, এখানে ভালো লোক বোঝাতে শিবির শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যেমন আমাদের ওয়ার্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন জসিম ভাই, মধ্যবয়সী এই মানুষটি বুকে থাবা মেরে বলতেন "আমি চুরি করিনা, মিথ্যা বলিনা, আমি শিবির"! আবার কারারক্ষিদের মধ্যে যারা ঘুষ খায়না, দূর্ণীতি করেনা তাদের বলা হয় শিবির মিয়াসাব! আর আমরা শিবিরের ছেলেরা পরিচিত ছিলাম শিবির ভাই হিসেবে।
প্রায়ই পিসি কার্ড দিয়ে কেনাকাটা করতে কারা-ক্যান্টিনে যেতাম, দুইতিনটা ভবন মিলে একটাই ক্যান্টিন। একদিন অন্য ভবনের একটা ছেলে এসে তার পিসি কার্ড হারিয়েছে দাবী করে নতুন পিসি কার্ড চাইলো। পিসি রাইটার কিছুতেই নতুন কার্ড দিবেনা (অনেকেই মিথ্যা কথা বলে নতুন পিসি কার্ড বানায়), এই নিয়ে মহা হৈ চৈ! পিসি ম্যানেজার এসে জিজ্ঞাসা করলো তোমার মামলা কি, ছেলেটি জবাব দিলো শিবিরের মামলা, ম্যানেজার খেকিয়ে উঠলো আগে বলবানা! শিবিরের ছেলেরা মিথ্যা বলেনা, সাথে সাথে নতুন কার্ড ইস্যু করে দিলো।

পর্ব-১৬
অসুস্থ কাকাকে দেখতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু তার আগেই গ্রেপ্তার হয়ে যাই। ২০তারিখ সেই কাকাই অসুস্থ শরীর নিয়ে চট্টগ্রাম ছুটে এসেছেন আমার গ্রেপ্তারের খবর শুনে। ছোট বেলা হতেই কাকাকে একটু ভয় পেতাম, এজন্য খুব টেনশনে ছিলাম এই বুঝি ঝাড়ি খেতে হবে, চট্টগ্রাম তোমাকে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছি রাজনীতি করতে পাঠাইনাই! আগেই বারণ করেছিলাম এইসব রাজনীতি আমাদের দরকার নাই!
কিন্তু কাকাকে কিছুটা শান্ত দেখে অবাকই হলাম, কিছুটা ভয়ে ভয়ে জানালাম দু’টি মামলা দেয়া হয়েছে, এবং অনেকগুলো ধারা। আমার অবাক হওয়ার আরো বাকি ছিলো, কাকা তাচ্ছিল্যের সাথে কথাটি উড়িয়ে দিয়ে বললো, রাজনৈতিক মামলায় ১০০টি ধারা থাকলেই বা কি, মামলার কারনে কি আন্দোলন থেমে থাকবে! যাওয়ার পূর্বে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত ও তাহাজ্জুদ পড়ার পরামর্শ দিয়ে গেলেন। পরে ফুফুর কাছে শুনেছিলাম, কাকার ধারণা ছিলো আমি কাকাকে দেখে ভেঙে পড়বো হয়তো কান্নাকাটি করবো, কিন্তু আমার স্বতস্ফুর্ত কথাবার্তা এবং হাসি খুশি ভাব দেখে তিনি অবাক হয়েছিলেন। বুঝলাম আমাকে সাপোর্ট দিয়ে বলা কাকার কথাগুলো ছিলো বিচক্ষণতা!
যাওয়ার সময় কাকা জানতে চাইলেন কি কি লাগবে? আমি বললাম কিছুই লাগবেনা, খাবার দাবার সব আছে, কয়েক প্যাকেট সিগারেট পাঠিয়ে দিয়েন! কাকা চোখ বড় বড় করে শিবিরের সাথী তাওহীদকে জিজ্ঞাসা করলেন ও সিগারেট খায় কবে থেকে!? তাওহীদ বুঝিয়ে বললো খাওয়ার জন্য নয় ভেতরে বিভিন্ন কাজে সিগারেট দরকার হয়। কাকা কি বুঝলেন জানিনা, ইচ্ছেকৃত অথবা ভুল করে হোক সিগারেট বাদ দিয়ে প্রচুর পরিমাণ শুকণো খাবার, ফল এবং ব্যবহার্য জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিলেন, কিন্তু সিগারেট দিলেননা!
২১তারিখে জামিন আবেদন খারিজ হয়ে গেলো, ২২তারিখ পরীক্ষা শুরু কিন্তু কিছুই করার নেই। পরীক্ষার টেনশন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম, জীবনে পরীক্ষা এমন অনেক দেওয়া যাবে কিন্তু জেলেতো আর বার বার আসা যাবেনা, তাই মনযোগ দিয়ে জেল খাটতে থাকলাম!
প্রতিদিনই সংগঠনের বিভিন্নস্তরের কর্মীরা দেখা করতে আসতেন, বাহিরের খবর পেতে সমস্যা হতোনা, ভেতরেও পত্রিকা রাখার ব্যবস্থা ছিলো, আমাদের দেয়া হতো যুগান্তর। গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে আমার সর্বশেষ দায়ীত্বছিলো সংগঠনের শিশুকল্যান বিভাগে। শিশু বিভাগের ওমর ফারুক ভাই প্রায়ই দেখা করতে আসতেন, তিনি এসেই জিজ্ঞেস করতেন কি লাগবে, আমি হেসে জবাব দিতাম ল্যাপটপটা পাঠিয়ে দিলে ভালো হয়!
শুনেছি নরওয়ের তীব্রমুসলিম বিদ্বেষী এ্যান্ডার্স বেরিং ব্রেইভিক যিনি গুলি করে ৭৭জন মানুষকে হত্যা করেছেন তাকে ২১বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে এবং সাথে দেয়া হয়েছে হাইস্পীড নেটকানেকশন সহ ল্যাপটপ। সত্যি বলছি একটা ল্যাপটপ এবং হাইস্পীড নেট কানেকশন দেয়া হলে জেলখানাকে আমি আবাসিক হোটেল মনেকরে বছর দুয়েক কাটিয়ে দিতে পারবো!

পর্ব-১৭
৭নম্বর ওয়ার্ডের সামনের ব্যালকনির একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে দুপুর বেলায় পত্রিকা পরতাম। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে গল্প শোনাতেন বিধান বড়ুয়া, শোনাতেন র‍্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা, পালিয়ে থাকার দুঃসহ স্মৃতি। বন্ধু তারেক এবং মোর্শেদের রসিকতায় হেসে ফেলতাম উচ্চ শব্দে, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তুমুল তর্ক জমে উঠতো। ওয়ার্ডে তারেক এবং মোর্শেদ ছাড়া লীগ সমর্থক আর কেউ ছিলোনা, “দশ চক্রে ভগবান ভুত” টাইপের অবস্থা হতো, সবাই মিলে যেভাবে ক্ষেপাতাম বেচারা কথা বলার পর্যায়ে থাকতোনা!
নিয়ম করে প্রতিদিন সকালে আয়না এবং রেজর নিয়ে ব্যালকনিতে সেভ করতে বসে যেতো সিরিয়াল কিলার রসু খাঁ। এত নাম শুনেছি মানুষটার, এত ভয়ানক সব কাহিনী পত্রিকায় এসেছে তার নামে, অথচ এখানে কেউ তাকে পাত্তাই দেয়না!
চাঁদপুরের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে রসু খাঁ, সব সময় ফিট ফাট থাকতে পছন্দ করে, তবে কথাবার্তায় স্বাভাবিক মনে হলোনা। সম্ভবত রিমান্ড নির্যাতনে মাথার কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। আঙুলে এখনো রয়ে গেছে ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন, হাত পায়ের ২০টি নখ প্লাস দিয়ে তুলে ফেলা হয়েছে, দেয়া হয়েছে ইলেক্ট্রিক শক এবং বাঁশ ডলা।
সাহস করে তাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি মেয়েদের সাথে রিলেশনসিপ করতেন, তাদের ক্ষতি করতেন জানি। কিন্তু তাদের খুন করতেন কেনো? রসু খাঁ জবাব দিয়েছিলো “খুন না করলে মাথা ঠিক থাকতোনা, পাগল হইয়া যাইতাম”
এমন একজন খুনি যার নামে প্রায় ৩০টি হত্যা মামলা আছে, সে একে একে সবগুলো মামলায় জামিন লাভ করেছে, এখন শুধু একটা মামলা আছে যেটা বিচারক না থাকার কারণে ঝুলে আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আপনার মামলাগুলো পরিচালনা করে কে? তিনি জবাব দিয়েছিলেন মন্ত্রী এমপিরা (নাম বলেনাই) আমার মামলা দেখাশোনা করে।
যে সরকার পোস্টার লাগানোর অপরাধে, মিছিল করার অপরাধে বিরোধী দলের কর্মীদের ধরে ধরে জেলে ঢুকায়, যে সরকার বিচার বিভাগকে কেনা গোলামের মতো পরিচালিত করে, যে সরকার বিরোধী দল দমনে বিকাশের মতো খুনিদের গোপনে জামিন করিয়ে দেয়, সেই সরকার রসুখাঁ’দেরকে জেলে রাখবে কোন যুক্তিতে!
কারাগারে প্রতিদিন বিকেলে মজার একটা খেলা খেলতাম, এই সময়টাতেই নতুন আসামীদেরকে ওয়ার্ড পাঠানো হয়, আমি দূর থেকে দেখেই বলে দিতাম লাইনের ওই ছেলেটা শিবির আর লাইনের এত নম্বর ছেলেটি ইয়াবা ব্যবসায়ী, দেখা যেতো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হুবুহু মিলে যেতো। অনেকেই অবাক হয়ে জানতে চাইতো কিভাবে বললাম, শুধু হাসতাম রহস্য জানানো যাবেনা!
আসামী চেনার উপায় হচ্ছে, সাধারণতো চোর ডাকাত ছিনতাইকারী কিংবা মাদকসেবীদের পোশাক নোংরা থাকে, এক নজর দেখলেই এদের চেনা যায়। আর ভালো পোষাকের ইয়াং ছেলেদের মধ্যে দু’টি ক্যাটাগরি আছে, একটি ক্যাটাগরির ছেলেরা ভদ্রটাইপের জিন্স/নরমাল প্যান্ট এবং চুলের কাটিং স্বাভাবিক থাকে, চেহারাতেও একটা ইনোসেন্ট ভাব থাকে, এরা হচ্ছে শিবির। আরেক শ্রেণীর ছেলে যাদের প্যান্টের এখানে সেখানে ছেড়া, মাথার চুলের কাটিং বিভ্রান্তিকর, গায়ের পোশাক গুলো অত্যান্ত দামী এবং প্রচন্ড রকমের স্টাইলিশ এরা হচ্ছে ইয়াবা প্রজন্ম।
কারাগারে এত বেশি পরিমাণ ইয়াবা ব্যবসায়ী তরুনের সাথে পরিচিত হয়েছি যে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাতাম “আল্লাহ তুমি আমাকে অন্ততপক্ষে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে জেলে ঢুকাও নাই, আমি কারাগারে একারনে সন্তুষ্ট যে তোমার দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার কারণেই আমাকে এখানে আসতে হয়েছে”। কি সুন্দর সুন্দর ছেলে! কত উজ্বল ভবিষৎ ছিলো তাদের সম্মুখে, আর তারা বেছে নিয়েছে অন্ধকার জীবনের হাতছানি।
নতুন করে উপলব্ধি করলাম, জাতির তরুণদের জন্য ইসলামী ছাত্রশিবির হচ্ছে আল্লাহর বিশেষ রহমত!

পর্ব-১৮
কর্ণফুলী ভবনের সম্মুখেই বত্রিশ নম্বর সেল, ভবন এবং সেলের মাঝ বরাবর বাউন্ডারী ওয়াল দিয়ে ঘেরা দুটি ১তলা ভবন। দেখতে আর ৫টা সাধারণ ইট পাথরের ভবন মনে হলেও ওদিকে তাকালেই কেমন যেনো একটা শূণ্যতা বোধ করতাম, ওটাই কনডেম সেল! ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের প্রাথমিক ভাবে এখানে রাখা হয়, পরবর্তীতে সকল আইনি কার্যক্রম শেষে দন্ড কার্যকর করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে। ভেতরের যাওয়ার অনুমতি নেই, বাহির থেকে দেখতে বড় মনে হলেও ভেতরের রুম গুলো অনেক সঙ্কীর্ণ করে তৈরী করা হয়।
ওয়ার্ডের ব্যালকনি দিয়ে প্রায়ই মুক্ত আকাশ দেখতাম, বহুদূরে ভবনের ছাদে কাপড় শুকোতে আসা মুক্ত মানুষ দেখতাম, ডানামেলা উড়ন্ত পাখি দেখে পাখি হওয়ার খুব ইচ্ছে হতো। আবার যখন কনডেম সেলের দিকে তাকাতাম তখন নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হতো, ভেতরের মানুষ গুলোর মানসিক অবস্থা কল্পনা করার চেস্টা করতাম। প্রতিটা মূহুর্তে তারা মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে, অবধারীত মৃত্যু ধেয়ে আসছে, একটি একটি করে সেকেন্ড চলে যাচ্ছে খরচের খাতায়।
হঠাৎ একদিন কনডেম সেল থেকে আমার ডাক আসলো, কেউ একজন দেখা করতে চাইছে। ভীষণ অবাক হলাম, ফাঁসির সেলে আমার পরিচিত মানুষ কিভাবে থাকবে আর আমি এখানে আছি সেটাইবা কিভাবে জানে!
তীব্র কৌতুহল নিয়ে কনডেম সেলেরদিকে হেটে গেলাম, মূল গেটের ওপাশেই দেখলাম দু’জন যুবক আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। কাছে যেতেই সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন? আমি চিনতে না পেরে ইতস্তত বোধ করছিলাম, তবে পোশাকে বলে দিচ্ছে খাঁটি শিবির। দু’জনের মুখেই ছোট করে ছাটা চাপদাড়ি, গায়ে পাঞ্জাবী, আর সার্বক্ষণিক অমায়ীক হাসি। কনডেম সেলের ভেতরে থেকে কারো মুখে এমন নির্মল হাসি দেখবো কল্পনাও করতে পারিনাই। পরিচিত হলাম ইসলামী আন্দোলনের দুই মুজাহিদ আলমগীর ভাই ও আজম ভাইয়ের সাথে। ভেতরে ভেতরে চুপসে গেলাম, কি বলবো বুঝতে পারছিলামনা! নিশ্চিত মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকা মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় আমি জানিনা।
বেশ মিশুক প্রকৃতির মানুষ আলমগীর ভাই ও আজম ভাই, মনে হয় কতকালের চেনা ভাই আমার! মূহুর্তেই আপন করে নিলেন এই ছোট ভাইটিকে। কর্ণফুলী ভবনে শিবির এসেছে শুনেই তারা খবর পাঠিয়েছেন, শিবির মানে আত্মার ভাই, এক ভাই আরেক ভাইকে দেখার জন্য ব্যাকুল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমার খোজ খবর নিলেন, প্রব্লেম হচ্ছে কিনা জানতে চাইলেন। তাকে নিশ্চিত করলাম আমার কোনো প্রব্লেম হচ্ছেনা। সত্যি বলতে কি, আজম ভাই ও আলমগীর ভাইকে কনডেম সেলে দেখে আমার কষ্ট গুলো আমি মূহুর্তেই ভুলে গেলাম, চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। দ্বীনি আন্দোলন করার কারণে যেখানে আমার ভাইরা ফাঁসির দন্ড পেয়েও এমন নির্মল ভাবে হাসতে পারে, সেখানে সামান্য জেল জীবন আমার কাছে অতি তুচ্ছ মনে হলো।
নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হলো, জানতে পারলাম মামলার আপিল চলছে, এই সরকারের মেয়াদে আপিল শুনানী হলে ফাঁসি ঠেকানো যাবেনা। সর্বশেষ আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি জানতে চাইলেন কিছু লাগবে কিনা? বললাম এ কথাতো আমি আপনাদের জিজ্ঞাসা করবো, আপনারা এখান থেকে বের হতে পারেননা, আমারতো রেগুলার বাহির থেকে যোগাযোগ হয় এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আসে, আপনাদের কি লাগবে বলেন। তারা হেসে জবাব দিলেন সংগঠন তাদের সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখে, প্রয়োজনীয় সবকিছু বাহির থেকে পাঠানো হয়।
কথা আর ফুরায়না ওদিকে মিয়াসাব বারবার সিগনাল দিচ্ছেন কথা শেষ করতে। আবার ফিরে যেতে হবে কনডেম সেলের সঙ্কীর্ণ কক্ষে। অগ্যতা বিদায় নিতে হলো, বার বার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম দ্বীনি ভাইয়ের দিকে, আত্মার ভাইয়ের দিকে।

পর্ব-১৯
ঈদের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে, কারাগারের উঁচু পাচিল পেরিয়ে তার কিছুটা ছোয়া আমরাও উপলব্ধি করতে পারছিলাম। দলে দলে বিভিন্ন স্তরের দায়ীত্বশীলরা বিদায় নিতে আসছিলেন। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবেন, কিছুদিন দেখা হবেনা, হাসিমুখে তাদের বিদায় দিচ্ছিলাম। আপন জনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার স্মৃতিগুলো প্রবলভাবে অনুভব করছিলাম।
বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো প্রিয়মুখ গুলো, জানি ছোট বোন গুমড়ে গুমড়ে কান্না করে চোখ ফুলিয়ে ফেলবে, বড় আপা খাওয়া বন্ধ করে নিরবে চোখের পানিতে বুক ভাসাবে। আব্বা বার বার আমার সাথে কথা বলতে চাইবে, কিন্তু নানা রকম অজুহাত দিয়ে সবাই এড়িয়ে যাবে। আওয়ামী সাপোর্টার দুলাভাই হয়তো রাজনৈতিক তর্ক করার মতো উপযুক্ত প্রতিপক্ষ না পেয়ে কিছুটা বিষন্ন সময় কাটাবে।
জানি কেউ খাবেনা, ফ্রিজের এককোণে সযত্নে আলাদা করে রাখা হবে আমার প্রিয় কোরবানীর গরুর মাংস। ছোট ছোট ভাগ্নে গুলো সারাদিন কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে আপাকে বিরক্ত করে তুলবে, আম্মু মামা আসেনা কেনো, কবে আসবে? জবাব নেই, জবাব নেই!
২৭তারিখ ভোরেই সকল আসামীর জন্য জন্য কারাগার প্রাঙ্গণ উন্মুক্ত করে দেয়া হলো, যার যেখানে খুশি, যে ভবনে খুশি, ঘুরে বেড়াতে পারবে বাঁধাহীন ভাবে। শুধু মাত্র বছরের দুই ঈদের দিন সকল আসামীরা এই সুযোগ পেয়ে থাকে, এমন সুযোগ মিস করতে চাইলামনা। কারাগার চত্ত্বরেই ঈদের জামায়াত হলো, বিভিন্ন স্থরের কারা কর্মকর্তা বক্তব্য রাখলেন।
ঈদের জামায়াত শেষে খুজে খুজে সকল শিবির একসাথে জড়ো হলাম, একে অপরের সাথে কোলাকুলি করলাম পরম আবেগে। দল বেঁধে লাইন করে দেখা করলাম আজম ভাই ও আলমগীর ভাইয়ের সাথে, কনডেম সেলের গেইটে দাড়িয়েই তারা আমাদের সাথে দীর্ঘক্ষণ ধরে কথা বললেন। পরস্পরের খোজ খবর নিলাম, পুরো কারাগারটা ঘুরে দেখার এই সুযোগটা ভালোভাবেই কাজে লাগালাম। দেখা করলাম মুন্না ভাইয়ের সাথে, মুন্নাভাইয়ের ব্যাপারে এখানে বেশি কিছু বলছিনা, আল্লাহ এই মানুষটির কল্যান করুন।
এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করার এক পর্যায়ে একভাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন, দেখা করার স্লিপ এসেছে। ভিজিটর রুমে গিয়ে দেখলাম মহানগরীর দায়ীত্বশীল থেকে শুরু করে উপশাখা পর্যায়ের কর্মীদের বিশাল এক বাহিনী দেখা করতে এসেছে। ঈদের নামাজ শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ হলো, এত অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো লোক কিভাবে এলো, কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, এত সকাল সকাল কিভাবে এলেন? মহানগরীর বাইতুল মাল সম্পাদক শাহীন ভাই বললেন, আমরা ঈদের নামাজ পড়েছি কারাগারের সামনের মসজিদে।
কিছুটা হেসেই বললাম, মিয়া এগুলা করেন! ঈদের দিন আব্বা আম্মার সাথে ঈদ না করে আপনি কারাগারে এসে বসে আছেন, এটা কি ঠিক হলো? জবাবে শাহীন ভাই বললেন, আমাদের ভাইদের জেলের ভেতরে রেখে আমরা কিভাবে ঈদ করি? চোখের পানি ধরে রাখতে পারলামনা, আবেগে গলা বন্ধ হয়ে এলো, হয়তো গরাদের বাহিরে ছিলেন বলে তারা ব্যাপারটি বুঝতে পারেননাই, আমিও কান্না লুকিয়ে ফেললাম। অনেকক্ষণ কথা হলো, একে একে সবার সাথেই কথা বললাম।
শাহীন ভাইরা চলে যাওয়ার পরে আবার দলবদ্ধ ভাবে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম, এই ওয়ার্ড থেকে ওই ওয়ার্ড, এ ভবন থেকে সে ভবন, দেখতে দেখতে কোন দিক দিয়ে যে দিনটা কেটে গেলো বুঝতেই পারলামনা। ভেবেছিলাম জীবনের সবচাইতে বাজে ঈদের দিন হবে কারাগারের ঈদ, কিন্তু এখন বলতে পারি, আমার জীবনের পাওয়া সবচাইতে শ্রেষ্ঠ ঈদ ছিলো সেই দিনটি, যে ঈদের দিন ইসলামী আন্দোলনের শত শত মজলুম ভাইয়ের সান্নিধ্যে কাটাতে পেরেছি।

পর্ব-২০
কারাজীবনের ষোল কলা পূর্ণ হলো।
ঈদের পরের দিন আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন মহানগরী দক্ষিণের সভাপতি মহিউদ্দিন ভাই, সাথে মহানগরী শাখার অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। তখনো জানতামনা ২৯তারিখ আমার কোর্ট ডেট আছে, সবাইকে বলে দিলাম ৩১তারিখ আমাদের কোর্টে তুলবে। বিকালের দিকে কোর্টে যাওয়ার নোটিশ আসলো, অর্থাৎ ২৯তারিখ আমাকে কোর্টে নেয়া হবে।
কোর্টে যাওয়া ছিলো আসামীদের জন্য আতঙ্ক জনক একটা ব্যাপার। নিয়ম ছিলো যেদিন কোর্টে যেতে হবে তার আগের দিন নিজের ওয়ার্ড থেকে আমদানী ওয়ার্ডে গিয়ে থাকতে হবে। সমস্যা হলো আমদানী ওয়ার্ডেতো কারও পার্সোনাল বিছানা নেই এবং স্পেশাল খাবারো নাই, তাই বাধ্য হয়ে সেখানে নোংরা বিছানায় ঘুম এবং সরকারী খাবার খেতে হবে। এব্যাপারটা সামাল দেয়ার একটা উপায় ছিলো, কোর্টে যাওয়ার জন্য যারা নাম ডাকতে আসে তাদের এক প্যাকেট স্টার সিগারেট দিলে আমদানী ওয়ার্ডে না গেলেও চলে!
স্টার সিগারেট দিয়ে আমদানী ওয়ার্ডের আজাব থেকে রেহাই নিলাম। পরের দিন ভোর বেলা গোসল সেরে, নাস্তা নাকরেই আমি ও জামায়াত কর্মী ইউসুফ ভাই কোর্টের উদ্দ্যেশ্য রওয়ানা হলাম। ইউসুফ ভাইকে দেয়া হয়েছিলো পাচলাইশ থানার মামলা আর আমারটা ছিলো বোনাস হিসেবে পাওয়া ৫৪ধারা। আমার অন্য যেটা ছিলো সেটা হচ্ছে গাড়ি ভাংচুর,পুলিশের কাজে বাঁধা দান আরো হ্যান ত্যান কি কি নাকি করেছি, আমি নিজেও জানিনা। ৫/৬টা ধারা যুক্ত সেই মামলার ডেট পরেছে ৩১ তারিখে।
আমদানী ওয়ার্ডের এক পাশে কামাড় বসে আছে, হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে আসামীদের পায়ে লোহার ডান্ডাবেরী পড়ানো হচ্ছে, আমাকেও পড়তে হবে। ডান্ডাবেড়ি না পড়লে জেল খানার ষোল কলা পূর্ণ হবেনা, তাই কতৃপক্ষ দয়া করে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। দুই পায়ে দুটো লোহার রিং পড়ানো হলো, রিংয়ের সাথে দুটি লোহার রড লাগানো, হাত দিয়ে রড দুটি ধরে পা টেনে টেনে হাটতে হয়।
লাইন করে প্রিজন ভ্যানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ৬০/৭০জনের একটা গ্রুপ। আমার বাম হাতের সাথে অন্য একজনের হাত হ্যান্ডকাফ দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে। ডান হাত দিয়ে ডান্ডাবেড়ির রড ধরে কোনো রকমে পা টেনে টেনে এগিয়ে যাচ্ছি, লোহার চুরির সাথে পায়ের ঘর্ষণে মনে হচ্ছিলো জান শেষ হয়ে যাচ্ছে, রক্তা রক্তি কান্ড, পায়ের কয়েক জায়গায় ছিলে গেছে। ব্যাপারস না, আবু জেহেল আবু লাহাবরা এর চাইতেও জঘন্য উপায়ে সাহাবীদের কস্ট দিয়েছিলো, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
ছোট্ট একটা প্রিজন ভ্যান, স্বাভাবিক অবস্থায় সর্বোচ্চ ১০-১২জন মানুষ বসতে পারবে। আমাদের ৫০জনকে তোলা হলো এক গাড়িতে, ময়দার বস্তার মতো একজনের গায়ের উপর আরেকজনকে ঠেলে দেয়া হলো। একহাতে হ্যান্ডকাফ টান পড়লেই কাটাগুলো হাতের উপর আরো চেপে বসে, অন্য হাত দিয়ে ডান্ডাবেড়ি ধরে থাকায় অসহায়ের মতো অন্যদের গায়ের সাথে হেলান দিয়ে কোন রকমে দাড়িয়ে থাকলাম, গাড়ি আদালতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তীব্র ঝাঁকুনিতেও কিছু ধরে ব্যালেন্স রাখার অবস্থা ছিলোনা।
আদালত কাস্টডিতে নিয়ে হ্যান্ডকাফ খুলে দেয়া হলো। আবার সেই চিরচেনা দৃশ্য, বিড়ি-সিগারেট, হেরোয়িন-ইয়াবার সম্মিলিত ধোঁয়ার গন্ধ, ধোঁয়ায় ধুসরিত চারিদিক। অবশ্য এতোদিনে ব্যাপারগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আগের মতো অসহ্য লাগছেনা। জেল খানায় ডান্ডাবেড়ি হচ্ছে ক্ষমতার চিহ্ন, বড় বড় অপরাধীদেরই কেবল এই জিনিস পড়ানো হয়, ডান্ডাবেড়ির ক্ষমতায় একপাশে কিছুটা যায়গা বের করে আমি আর ইউসুফ ভাই বসে পড়লাম, আসলে এটাকে বসা বলেনা, এই লোহার চুরির এমনি মুজেজা যে, নাযায় বসা, নাযায় দাঁড়ানো, ঘুমাতেও সমস্যা।
খাবার নিয়ে চিন্তিত ছিলাম, সংগঠনের সবাই জানে ৩১তারিখ আমাকে কোর্টে উঠানো হবে। একপ্রকার নিশ্চিত ছিলাম আজ না খেয়েই দিনটা পার করতে হবে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে ইউসুফ ভাইয়ের স্ত্রী কার কাছে থেকে যেনো সংবাদ পেয়ে ছুটে এলেন, সাথে নিয়ে আসলেন প্রচুর পরিমানে গরুর ভূনা গোস্ত এবং চালের রুটি। আপাদমস্তক বোরখা আবৃত, মহিলা জামায়াতের কর্মী ভাবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ইউসুফ ভাই, কথা বার্তায় অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দিলেও পায়ে ডান্ডাবেড়ি দেখে কিছুটা মুষড়ে পড়লেন।
দুপুরের ট্রিপেই আমাদের আদালত থেকে কারাগারে ফিরিয়ে আনা হলো, হাফ ছেড়ে বাচলাম! সন্ধার ট্রিপে আনলে এই ডান্ডাবেড়ি পড়েই রাত পার করতে হতো, বিকাল ৫টা থেকে পরের দিন ভোর ৮টার আগে ডান্ডাবেড়ি খোলা হয়না।


পর্ব-২১
মহানগরী উত্তর এবং দক্ষিণের পক্ষ হতে ২৮তারিখ এবং ২৯তারিখ দুই দফা কারাগারের ভাইদের জন্য কোরবানীর মাংস এবং পোলাউ রান্না করে পাঠানো হলো। ২৭তারিখ কারাগার থেকেও সরকারী বরাদ্দকৃত কোরবানীর মাংস সরবরাহ করা হয়। এখানে সরকারী নিয়ম অনুযায়ী এমনিতেই সপ্তাহে একদিন গোশত দেয়া হয়। সরকারী বরাদ্দকৃত মাংসের টুকরো নিয়ে আসামীদের মধ্যে রীতিমতো গবেষণা হয়, এত ছোট সাইজতো হাতে করা সম্ভব নয়, নাকি মেশিনে কাটা হয়!?

সংগঠন থেকে এত বেশি পরিমাণে মাংস এলো যে সেটা একা খাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়, তাছাড়া বন্দীদের মধ্যে এমন অনেক আসামী আছে এই ঈদের সময় পর্যন্ত যাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে কোন আত্মীয় স্বজন আসেনাই। দুপুরে এবং রাতের বেলা সবাই মিলে তৃপ্তি সহকারে খাওয়া পর্ব সমাপ্ত করলাম। জানিয়ে দিলাম ইসলামী ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য খাবার পাঠানো হয়েছে, সবাই সংগঠনের জন্য দোয়া করবেন।

৩১তারিখ আবার কোর্ট ডেট পড়লো, একই মামলার আসামী অন্যান্য শিবির নেতাকর্মীদেরো আমদানী ওয়ার্ডে জড়ো করা হলো, বিপুল সংখ্যক শিবির নেতাকর্মী, ডান্ডাবেড়ির ঝনঝনানীতে মুখরিত চারিদিক। বদিউর রহমান ভাই কার কাছ থেকে যেনো একটা ফুটবল খেলার এ্যাংলেট ধার করে এনে দিলেন, ওটা পায়ে দেয়ার পরে লোহার চুড়ির সাথে পায়ের ঘর্ষণ জনিত যন্ত্রনার হাত থেকে কিছুটা রেহাই পেলাম। আবার সেই ময়দা ঠাসা হয়ে প্রিজন ভ্যানে করে তীব্র ঝাঁকুনি সহ্য করে আদালতের উদ্দেশ্যে ছুটে চলা।

প্রিজন ভ্যান আদালত চত্বের প্রবেশ করার পরে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা কাস্টডি-১ এ ঢুকলাম, এটা মোটামুটি পরিচ্ছন্ন থাকে। একটু কর্ণারের দিকে হওয়ায় কাস্টডি-২ এর অবস্থা অত্যান্ত ভয়াবহ, হেরোয়ীন ইয়াবার টাকা নিয়ে প্রায়ই সেখানে মারমারি হয়, হেরোয়ীন সেবিদের ভয়ে পুলিশও সেদিকে পা মাড়ায়না। অনেক সময় দেখা যায় ব্লেড দিয়ে একে অপরের দেহ রক্তাক্ত করে দিয়েছে, মারামারি থামার পরে পুলিশ সর্বোচ্চ হাসপাতালে নেয়ার দায়ীত্ব পালন করে থাকে।

আদালত কাস্টডিতে আমাদের ঢুকানোর কিছুক্ষণ পরেই একে একে মহানগরীর বিভিন্নস্তরের দায়ীত্বশীল এসে হাজির হলেন। পুলিশের কাছ হতে মোবাইল নিয়ে একটা জরুরী কল করলাম, পুলিশ সদস্যটি ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝাতে চাচ্ছিলেন এখানে যদিও ফোন দেয়ার নিয়ম নেই তবুও আমাদের উপকারের জন্য (মূলত বাড়তি কিছু ইনকামের জন্য) তিনি না করতে পারছেননা। তাকে আশ্বস্ত করলাম টাকা দেয়া হবে, অমায়ীক হাসিতে তিনি বিগলিত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হলেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহফুজ ভাই, শাহীন ভাই, মামুন ভাই সহ ওয়ার্ড পর্যায়ের একদল দায়ীত্বশীল। মামলার বিষয়ে অনেক কথা হলো, জানতে পারলাম মামলা হাইকোর্টে পাঠানো হচ্ছে, জজকোর্ট জামিন দিবেনা। একে একে সবাই বিদায় নিলেন, মহানগরী উত্তর-দক্ষিণ সমন্বয় না করে পৃথক পৃথক ভাবে সংগঠনের সকলের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিলো। প্রচুর পরিমাণে বিরাণী, রুটি,মাংস এবং বিভিন্ন টাইপের নাস্তা। কাস্টডি-১এ সংগঠনের বাহিরেও কিছু অন্যান্য আসামী ছিলেন, তাদের নিয়েই সেগুলো শেষ করলাম।

সতর্কতা অবলম্বন করে কাস্টডি-১এ ঢোকার পরেও কয়েকজন হেরোয়ীন সেবী আমাদের সাথে ঢুকে গেলো। তাদের মাঝে একজন ছিলেন পাজামা পাঞ্জাবী পরিহীত লম্বা দাড়ী ওয়ালা বজুর্গ(!) বেশ-ভূষা দেখে ভেবেছিলাম জামায়াতের কেউ হবে, কিছুক্ষণে মধ্যেই দেখলাম তিনি হেরোয়ীন নিয়ে বসে পড়েছেন, জিজ্ঞাসু দৃস্টিতে বদি ভাইয়ের দিকে তাকাতেই তিনি জানালেন মার্ডার কেসের আসামী। একজন দেখলাম সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরের দিকে যে কাগজটি থাকে সেটা ভাজ করে তাতে কিছু পাউডার নিয়ে, কাগজের নিচের দিকে লাইটার দিয়ে তাপ দিচ্ছে, আর সেই পাঞ্জাবী পড়া ব্যক্তি সহ বেশ কয়েকজন চক্রাকারে বসে কাগজের তৈরী চোঙ বাণীয়ে সেখান থেকে ধোঁয়া গ্রহণ করছে। কিছুক্ষণ পর পর চোখ বন্ধ করে সিগারেটে দুটো সুখটান দিয়ে ঝিম মেরে যাচ্ছে! লোকটাকে পেট পুড়ে বিড়ানী খাইয়েছিলাম, আপসোস হচ্ছিলো ওই বিরানী ফেলে দিলেও ভালো হতো!

গভীর মনোযোগ দিয়ে তাদের কান্ড দেখছিলাম, আমার দৃস্টি লক্ষ করে লোকটি উঠে এসে আমার সাথে আলাপ জুড়ে দিলো, জামায়াতের জন্য প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দিবো, শিয়ালের মতো একশো বছর বেচে কি লাভ! তার চাইতে বাঘের মতো একদিন বাচবো, আমারে জিনিস দেন! যা বলবেন তাই করবো, আরো হ্যান ত্যান কতো কিছু। আমার নির্লিপ্ত ভাব দেখে বুঝতে পারলো আমি তাকে পছন্দ করছিনা, তখন নতুন গল্প শুরু করলো, এইযে আপনি দেখছেন আমি হেরোয়ীন খাচ্ছি এটা কিন্তু আমি নেশা হিসেবে খাচ্ছিনা, এটা আমি ঔষধ হিসেবে খাচ্ছি। হেরোয়ীন বানানো হয়েছে কেনো? এটা বানানো হয়েছে যোদ্ধাদের জন্য, যাতে তারা যুদ্ধের ময়দানে কোন কিছু পরোয়া না করে, সাহস বাড়ে। আমিতো যোদ্ধা, তাই মাঝে মাঝে এটা খেতে হয়! বুঝলাম নেশার ঘোরে আবোল তাবল বকছে। হু হ্যা করে তাকে বসিয়ে দিলাম। দুপর ৩টার দিকে আমাদের আদালত থেকে কারাগারে ফিরিয়ে আনা হলো।

পর্ব-২২
জামিনের প্রত্যাশায় কেটে যেতে লাগলো সময়গুলো, দারূণ সখ্যগড়ে উঠলো পটিয়ার মন্দির ভাঙ্গা মামলার আসামী অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া দেলাওয়ার, ওয়েস্টার্ণ মেরিণ শিপইয়ার্ডের কর্মী সালাউদ্দীন(দু'জনই নিরাপরাধ), এবং ভলবো বাসের ড্রাইভার শুক্কুর ভাইয়ের সাথে। শুক্কুর ভাই গাড়িতে ফেন্সিডিল বহনের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তার কাহিনী শুনলে মাঝে মাঝে মনে হতো টমক্রুজের কোনো সিনেমার গল্প শুনছি, বাংলাদেশের ক্রাইম জগত এতো আধুনিক! অবাক হতে হয়। সবচাইতে অবাক হয়েছিলাম ঢাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের লুৎফর ভাইয়ের গল্প শুনে, তিনি হত্যা মামলার আসামী, মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি নিজ মুখে একাধিক হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করেছেন কিন্তু যে মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেই হত্যার সাথে তিনি জড়িত ছিলেননা। লুৎফর ভাই প্রায়ই একটা কথা বলতেন পাপ বাপকে ছাড়েনা, জীবনে অনেক অন্যায় করেছি এখন তার ফল ভোগ করছি।

মাঝে মাঝেই খবর আসতো আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেব এখন চট্টগ্রাম কারাগারে আছেন, হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠতো তাকে এক পলক দেখার জন্য। একদিন বিটিভির খবরে দেখলাম কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক মিযানুর রহমান ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, একজন মন্ত্রী সাংবাদিকদের ব্রিফিং দিচ্ছিলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মিজান ভাইয়ের কাছ থেকে শিবিরের নাশকতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। প্রচন্ড কষ্টের মধ্যেও হাসি পেলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রির কথা শুনে, কিছুদিন পূর্বে আমার পাশের ওয়ার্ডের কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার রসূ খা’র রিমান্ডের কাহিনী শুনেছিলাম, সেটাই বার বার মনে পড়ছিলো। রসূ খা’র সেই রিমান্ডের গল্পটি শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলামনা, তার বক্তব্যেই সেটি উপস্থাপন করছি।

তখন মাত্র আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, মিডিয়াতে আমাকে নিয়ে হেব্বি আলোচনা, পুলিশও হাতে আকাশের চাঁদ পেলো। বিগত সালের যতগুলো অমিমাংসিত নারী রিলেটেড হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছিলো, পুলিশ যেসব মামলার জন্য উপর থেকে রেগুলার ঝাড়ির সম্মুখিন হতো, সবগুলো হত্যার জন্যই আমাকে অভিযুক্ত করা হলো। আমাকে বানানো হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে বড় সিরিয়াল কিলার। যাই হোক, কোথায় যেনো একটা মাথা বিহীন নারীর লাশ পাওয়া গেছে সেটার জন্যও পুলিশ আমাকে মামলা দিলো, রিমান্ডে নিয়ে চালালো অমানুষিক নির্যাতন, স্বীকার করতেই হবে এই খুন আমি করেছি, কিন্তু সেটাতো আমি করিনাই, আমি কেনো স্বীকার করবো? একটানা পনেরো দিন পর্যন্ত আমার উপর নির্যাতন চালানো হলো, হাত পায়ের বিশটা আঙুলের নখ প্লায়ার্স দিয়ে টেনে উপড়ে ফেলা হলো, শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশে দেয়া হলো ইলেক্ট্রিক শক। শেষ পর্যন্ত নির্যাতন সইতে না পেরে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিলাম, হ্যা আমিই এই মহিলাকে খুন করেছি। ভেবেছিলাম স্বীকারোক্তি দিলেই নির্যাতন বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু ঘটলো উল্টোটা, এবার নতুন করে নির্যাতন শুরু হলো, লাশের মাথা কোথায় রেখেছি সেটা বলতে হবে!? আমিতো খুন করিনাই মাথা কোথায় পাবো!? মাইর সহ্য করতে না পেরে বললাম মাথা রাজশাহীতে রেখেছি, পুলিশ আমাকে নিয়ে গেলো রাজশাহী, মাথা দিতে পারলামনা আবার শুরু হলো মাইর। বললাম বরিশাল রেখেছি, নিয়ে গেলো বরিশাল, মাথা দিতে পারলামনা আবার মাইর। এভাবে বিশটার মতো জেলাতে ঘুরালাম, কিন্তু মাথা উদ্ধার হলোনা, নির্যাতন চলতে থাকলো অবিরাম। শেষে একদিন বলে ফেললাম মাথা খেয়ে ফেলেছি, পুলিশতো অবাক। মাথা খেয়েছিস! কিভাবে? হ্যা মুগের ডাল দিয়ে রান্না করে খেয়ে ফেলেছি! হাড়ি পাতিল কোথায়? ইটের ভাটায় রান্না করেছিলাম, হাড়ি পাতিল গুলো ইটের ভাটায় পুড়িয়ে ফেলেছি। পরের দিন পত্রিকায় রিপোর্ট আসলো, “রসু খা’র নৃশংসতা, মানুষ খুন করে মাথা দিয়ে মুড়িগন্ড রান্না করে খেয়েছে!” রসু খাঁ আঞ্চলিক টানে আক্ষেপ করে বলছিলো, ভাই হাচা কতার দাম নাই, মিছা কতা কইছি সবাই বিশ্বাস গেছে!

এই হলো আমাদের দেশের রিমান্ডের বাস্তব চিত্র, কিছুদিন পরে হয়তো শিবিরের কোনো এক কেন্দ্রীয় নেতা রিমান্ড নির্যাতনে স্বীকার করবে ওসামা বিন লাদেন শিবিরের কর্মী ছিলো, আলকায়দা নেতা আইমান আল জাওয়াহিরী শিবিরের গোপন সাথী! খোদ আলকায়দা সংগঠনটাই শিবিরের একটা উপশাখা।

পর্ব-২৩

নভেম্বরের ৭তারিখ, আর দশটা দিনের মতোই ব্যালকনির গরাদের ফাক দিয়ে সূর্যাস্তের প্রহর গুণছিলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই মুরগীর বাচ্চার মতো আমাদের খোয়াড়ে ঢুকিয়ে দরজা তালাবদ্ধ করা হবে। অন্যান্য দিনের মতোই একহাতে ভাজ করা দুটি কম্বল এবং অন্যহাতে এলমুনিয়ামের ভাঙ্গা থালায় করে পচা ভাত, নোংরা পোকাযুক্ত ডাল এবং বুড়ো আঙুলের কড়ের সমান এক টুকরো মাছ নিয়ে নতুন আসামীদের লাইন করে আসতে দেখলাম। ৭নম্বর ওয়ার্ডের অপহরণ মামলার আসামী বন্ধু তারেক এবং মোর্শেদ আমার সাথেই ছিলো, অভ্যাসবশত লাইনের বিভিন্ন আসামীদের মধ্যে কার মামলা কি হতে পারে সেটা তাদের বেশভূষা দেখেই একটা ধরাণা নিয়ে নিলাম। লাইনের তৃতীয় এবং পঞ্চম অবস্থানের ছেলে দুটি’কে দেখিয়ে বললাম ঐ দু’টো রাজাকার। তারেক হেসে বললো দেখা যাক তোমার আইডিয়া কতটুকু ম্যাচ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসামীদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভাগ করে দেয়া হলো, সৌভাগ্যবশত ঐ দুই আসামীকে আমার কর্ণফুলী ৮নম্বর ওয়ার্ডে বরাদ্দ করা হলো।

নতুন আসামীদের সাথে কথা বলার ব্যাপারে ওয়ার্ড ইনচার্জের কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে, প্রাথমিক ভাবে তিনি আসামীর সাথে কথা বলবেন, মানসিক ভাবে যতটুকু সম্ভব প্রেসার ক্রিয়েট করবেন এবং তার সাথে খাওয়ার টাকার ব্যাপারে একটা চুক্তি করে ফেলবেন, আগেভাগে অন্যকেউ কথা বললে হয়তো দরকষাকষিতে ইনচার্জের অবস্থান দূর্বল হয়ে যেতে পারে, সেই ভয়েই এই নিষেধাজ্ঞা। সরাসরি কথা বলতে না পারলেও চোখে চোখে কথা হয়ে গেলো, বুঝিয়ে দিলাম ভেঙ্গে পড়ার কিছুনেই, শক্ত ভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। কথায় আছে কারো পৌষমাস আর কারো সর্বনাশ, জেল জীবনের প্রথম দিন বলে ছেলেদুটোকে বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিলো, অন্যদিকে আমার অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন, দীর্ঘদিন পরে আমার একাকিত্বের অবসান ঘটিয়ে সংগঠনের দু’জন ভাইকে কাছে পেয়েছি এটা আমার জন্য বিশাল আনন্দের ব্যাপার ছিলো।

আসামীদের একজন ছিলো সংগঠনের সাথী হাসান মুরাদ চট্টগ্রাম কলেজের অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টের সভাপতি, অন্যজন মাহবুবুর রহমান সেও সংগঠনের সাথী ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার্থী। চমৎকার মিশুক প্রকৃতির ছেলে এই হাসান মুরাদ, অল্পকয়েক দিনের মধ্যেই ওয়ার্ডের সবার সাথে ভাব জমিয়ে ফেললো। অন্যদিক মাহবুবুর রহমান ছিলো শান্ত-শিষ্ট টাইপের, খুব কম কথা বলতো। অন্যরা যখন তুমুল আড্ডাতে ব্যস্ত মাহবুব তখন দু’হাটুর উপর মাথাগুজে সারাক্ষণ কি যেনো চিন্তা করতো।
হেই মাহবুব! আরে এত চিন্তার কি আছে, আমাদের সাথে আসো।
মাহবুব মুচকি হেসে জবাব দিতো, “সরকার জেল খাটতে পাঠিয়েছে তাই মনযোগ দিয়ে জেল খাটতেছি, ডিস্টার্ব কইরেননা!”
তার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পরতো আশেপাশের সবাই।

এই হাসিখুশি ছেলেটির ভেতরে কতটা যন্ত্রনা গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে সেটা বাইরে থেকে না দেখা গেলেও অনুভব করতে পারছিলাম। প্রচন্ড মেধাবী হওয়া সত্বেও গতবছর ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পায়নি, কিন্তু হতাশায় ভেঙ্গে পড়েনি, সংগঠনের অনুমতি সাপেক্ষে একটা বছর সাংগঠনিক কর্মকান্ড থেকে বিরত হয়ে পড়ালেখায় আত্মনিয়োগ করেছিলো। সংগঠন অধ্যুষিত ম্যাচ থেক সরে গিয়ে ছাত্রলীগের ম্যাচে উঠেছিলো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! পুলিশ ঐ ম্যাচ থেকে একমাত্র মাহবুবকেই ধরে নিয়ে এসেছে শিবির করার অপরাধে, অথচ বিগত একটি বছর যাবত সে শিবিরের কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলোনা, তার অপরাধ তার টেবিলে শিবির প্রকাশিত ভার্সিটি ভর্তি সহায়ীকা পাওয়া গেছে। এই ছেলেটি পরবর্তীতে আর ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনাই। সংগঠন আদালতের নির্দেশনা নিয়ে ব্যাপক ভাবে চেস্টা করেছিলো কারাগারের অভ্যান্তরেই পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে, কিন্তু ভার্সিটি কতৃপক্ষ চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয় তারা তাদের নির্দিষ্ট কেন্দ্রের বাইরে অন্য কোথায় পরীক্ষা নিবেনা।

হাসান মুরাদ এবং মাহবুব দু’জনেরই দুটি করে মামলা ছিলো, আদালত দু’জনেরই একদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিমান্ডের কথা শুনে ঘাবড়ে যায় তারা, পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে অভয় দিলাম, প্রব্লেমনাই রিমান্ডে কিছু হবেনা, সংগঠন ম্যানেজ করতে পারবে। আরে ভাই এত চিন্তার কি আছে, আপনারা কি চোর ডাকাত নাকি? আপনারা হচ্ছেন রাজবন্দী, আপনাদের গায়ে হাত দেয়ার আগে পুলিশ দুইবার চিন্তা করবে। মুখে অভয় দিলেও মনে জোর পাচ্ছিলামনা, শুধু দোয়া করছিলাম আল্লাহ যেনো আমাদের ভাইদের হেফাজত করেন।

অবশেষে রিমান্ডের দিন হাসান মুরাদকে নিয়ে যাওয়া হলো, কারাগারেই সেদিন মাহবুবের পরীক্ষা হওয়ার একটা সম্ভবনা ছিলো তাই তার রিমান্ড ডেট পিছিয়ে দেয়া হলো। পরের দিন সন্ধাবেলা পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিহিত অবস্থায় হাসান মুরাদ ফিরে এলো। রাতটা তার আমদানী ওয়ার্ডেই কাটানোর কথা ছিলো, কারারক্ষী জিজ্ঞাসা করে, ভাড়ার টাকা আছে কিনা তাহলে ওয়ার্ডে পৌছে দেয়া হবে। হাসান মুরাদ সম্মতি দেয়াতে এক প্যাকেট স্টার সিগারেটের বিনিময়ে আমদানী ওয়ার্ডের আজাব থেকে রেহাই লাভ করে। ডান্ডাবেড়ি পরিহীত অবস্থাতেই বসে বসে কোনমতে এশার নামাজ আদায় করলো ছেলেটি, চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়লো, আল্লাহ তুমি এই দৃশ্য দেখার পরেও তোমার বান্দাদের কবুল করবেনা! কোনো ভাবেই বসা যাচ্ছেনা পায়ের লোহার চুড়ির কারণে, বারবার অবস্থান চেঞ্জ করে বসতে হচ্ছে, এভাবে কি নামাজ পড়া যায়? এই ডান্ডাবেড়ি পরিহীত অবস্থাতেই তাকে রাত কাটাতে হবে, সকাল ৮টার আগে এটা খোলা হবেনা।

পরের দিন রিমান্ডের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম পুলিশ গায়ে হাত দেয়নাই, উল্টো গরুর গোস্ত দিয়ে ভাত খাইয়েছে, পাশাপাশি সংগঠন থেকেও মুরগির মাংস পাঠানো হয়েছে। রিমান্ডের রাতে ঘুম কেমন হয়েছে, মশায় কামড়েছে কিনা জানতে চাইলে জানালো,
মশায় কামড়ায়নি তবে ঘুম হয়নাই।
কেনো, ঘুম হয়নাই কেনো?
ভাই ঘুম কেমনে হবে, জুতা পায়ে হাটার শব্দ শুনলেই ঘুম ছুটে যেতো, এই বুঝি মাইর আরম্ভ হবে, আতঙ্কের একটা রাত পার করেছি।
আল্লাহ হেফাজত করেছে, আলহামদুলিল্লাহ।
দুইদিন পরে মাহবুবকেও রিমান্ডে নেয়া হলো, তবে সৌভাগ্যবশত তাকে রাতে থাকতে হয়নি, বিকালেই কারাগারে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

নভেম্বরের ২১ তারিখে আমাদের ওয়ার্ডে আনা হয় সংগঠনের সাথী ইব্রাহীমকে, ভারী মায়াময় চেহারা ছেলেটির, ঘণ ভুরূর নিচে উজ্জ্বল দুটি চোখে যেনো মায়ার বান ডেকেছে। দারুল উলুম আলীয়া চট্টগ্রামের ছাত্র ছিলো, এবার ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে কিন্তু ভর্তি হওয়ার আগেই পুলিশ তাকে কারাগারে ভর্তি করে দেয়। কারাগারের প্রথম দিন গুলোতে ভার্সিটি ভর্তির কথা চিন্তা করে সারাক্ষণ কান্নাকাটি করতো, পরে অবশ্য সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে, নিয়তির হাতে সবকিছু ছেড়ে দিতে হয়।

এভাবেই দেশব্যাপী ইসলামী আন্দোলনের অসংখ্য কর্মী সেক্রিফাইস করছে তাদের জীবনের অমূল্য সময়, ক্যারিয়ার। তারা স্বপ্ন দেখে একটি শোষণ মুক্ত, জুলুম মুক্ত ইসলামী সমাজের, তারা স্বপ্ন দেখে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।


পর্ব-২৪
সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের কারাগারের ভাষায় কয়েদী বলা হয়, কারাগারের দৈনন্দিন সমস্ত কাজ এই কয়েদীরাই করে থাকে, কারাকতৃপক্ষই নির্ধারণ করে দেয় কার দায়ীত্ব কি হবে। গোপন লেনদেনের মাধ্যমে সহজ এবং লাভজনক কাজগুলো বাগিয়ে নেয় অনেকেই।

আমাদের ওয়ার্ডের কাদের ভাইয়ের দায়ীত্ব পড়েছিলো রান্না ঘরের, সারাদিন কাজ শেষ করে বিকালের দিকে, সকালের বেচে যাওয়া অতিরিক্ত রুটিগুলো বিক্রি করতো ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, একসপ্তাহের রুটি এবং তরকারীর বিনিময়ে তাকে দিতে হতো একপ্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট। এই আয়ের টাকাতেই বাড়িতে তার স্ত্রী-সন্তানের সংসার খরচ চলতো। কাদের ভাইয়ের মুখ থেকে শুনলাম, দীর্ঘদিনের কারাজীবনের পরে এক বাবুর্চির জামিন হয়ে গেছে, কিন্তু বাবুর্চি কারাগার থেকে বের হতে চাচ্ছেনা, সে জেলারের সাথে দেখা করে আরো কিছুদিন থাকার অনুরোধ জানালো। মূল কথা হচ্ছে কারাগারে মাস শেষে গড়ে তার আয় ২৫-৩০হাজার টাকা, বাহিরে গেলে শ্রমিক জীবনে ৮-১০হাজার টাকা আয় করাই তার জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

কাদের ভাই ডাকাতী মামলার আসামী, গত ছয়বছরের মধ্যে তিনি মোট তিনবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রথমবার ৩বছর সাজা ভোগ করে বের হয়ে ৫দিনের মাথায় আবার ডাকাতী করতে গিয়ে গ্রেপ্তার, বছর খানেক কারাগারে কাটিয়ে বের হওয়ার পরে ২১দিনের মাথায় অস্ত্রসহ ডাকাতীর প্রস্তুতি গ্রহণকালে পুনরায় গ্রেপ্তার। কারাগারের সেই বিষন্নদিনগুলোতে এই মানুষটির সাথে আমার দারুণ সখ্য গড়ে ওঠে, জীবনের সুখদুঃখের কথাগুলো অবলিলায় আমার সাথে শেয়ার করতেন। নিজের স্ত্রী, স্কুল পড়ুয়া সন্তানদের কথাই বেশি আলোচনায় আসতো। কারাগারে এসেই তিনি কোরআন তিলাওয়াত শিখেন, বোখারী শরীফ থেকে নিয়মিত হাদিস তেলাওয়াত করে সবাইকে শুনাতেন। একই কারাগার, একই পরিবেশ, কেউ এখানে এসে জীবনের প্রথম ধূমপানের অভিজ্ঞতা অর্জন করে, আবার অন্যদিকে কেউ এখানে এসেই জীবনের প্রথম কোরআন তেলাওয়াতের অভিজ্ঞতা পেয়ে জীবনকে ধন্যকরে।

কারাগারের নিয়ম ছিলো মাগরীবের নামাজ পরার পরেই রাতের খাওয়া সেরে ফেলতে হবে। এমনিতেই পচা চালের ভাত, বেশিক্ষণ রেখে দিলে নষ্ট হয়ে যাবে, তাই যতদ্রুত সম্ভব খেয়ে ফেললেই ভালো! রাত ৮টার মধ্যেই এশার নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘড়ির কাটায় রাত ১০টা বাজতেই কাদের ভাই টেনে হিচড়ে ঘুম থেকে তুলে দিতো,
শামীম ভাই ওঠেন, ওঠেন।
কেনো ভাই?
খিদা লাগছে, নাস্তা করবো।
করেন, আমাকে কেনো?
আরে আপনাকে ছাড়া কিভাবে খাবো?
অগ্যতা উঠতে হতো, আমার ঘুম ভেঙেছে, অন্যদের কিভাবে ঘুমাতে দেই! একে একে ডেকে তুলতাম, হাসান মুরাদ, মাহবুব, দেলাওয়ার, সালাউদ্দীন সবাইকে। ছোটখাটো একটা আসর বসে যেতো, গোল হয়ে বসে তরকারী দিয়ে রুটি খাওয়ার সে মূহুর্তগুলো স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

নভেম্বরের ১১তারিখে আরো কয়েকজন শিবির নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে আনা হলো, চট্টগ্রাম কলেজের সোহরাওয়ার্দী হল শাখার সভাপতি রোকন ভাইকে দেয়া হলো কর্ণফুলী-১৪নম্বর ওয়ার্ডে। ততদিনে গ্রেপ্তার অভিযান পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে, কয়েকদিনের মধ্যেই কারাগারের বিভিন্ন ওয়ার্ডের রুমগুলোতে শিবির কর্মীদের আনাগোনা বেড়ে গেলো, চট্টগ্রাম কলেজের সভাপতি আবু বকর ভাইও গ্রেপ্তার। শীতাকুন্ড, মীরেরস্বরাই থেকে বিপুল সংখ্যক শিবির নেতাদের কারাগারে আনা হলো, তাদের মধ্যে একজনকে(সম্ভবত থানা সভাপতি) জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই কেমন আছেন? তিনি হাসতে হাসতে জবাব দিলেন ভাই অনেক ভালো আছি, বাহিরে থাকলে মিটিং,মিছিল,প্রোগ্রাম,বাইতুলমাল,কালেকশন বহুত ঝামেলা! তার উপর রাতের বেলা নিজের বাসায় ঘুমাতে পারিনা, এখানেই ভালো আছি, কিছুদিন বিশ্রাম নেয়া যাবে!

১২তারিখে মাহফুজ ভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম আমি সহ মোট পঁচিশ জনের হাইকোর্ট থেকে জামিন হয়েছে, কাগজপত্র আসতে আরো সপ্তাহ খানেক সময় লাগতে পারে। জানালাম ১৫তারিখ কোর্ট ডেট আছে এর মধ্যে যেভাবেই হোক ৫৪ধারার মামলাটির জামিন করাতে হবে নয়তো সেদিনও ডান্ডাবেড়ি পরেই কোর্টে হাজির হতে হবে। মাহফুজ ভাই অভয় দিলেন চেস্টা চলছে, হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্‌।


পর্ব-২৫
১৪ই নভেম্বর ছিলো আমার কারাভ্রমনের একমাস পূর্তি উৎসব। উৎসব উপলক্ষে মাহামান্য বিচারক আমার ৫৪ধারা (সন্দেহ জনক) ধারার মামলাটি হতে আমাকে জামিন প্রদান করেন। সাধারণত ৫৪ধারার মামলার জামিন হতে সর্বোচ্চ ২দিন সময় লাগতে পারে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের দিনই জামিনের আবেদন করা হলে জামিন প্রদান করা হয়। কিন্তু শিবিরের ছেলেরাতো সাধারণ কেউনা, তাই জামিন হতে একটি মাস সময় পার করতে হলো।

ভোরের দিকেই জামিন ঘোশক জামিনের ঘোষণা দিয়ে গেলেন, সকাল ১০টার দিকে কেসকার্ড হাতে নিয়ে অফিসে চলে গেলাম, সংশ্লিষ্ঠ কারাকর্মকর্তা না থাকাতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। এরই মধ্যে আলাপ জমে উঠলো বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এক বৌদ্ধ বিডিআর সদস্যর সঙ্গে। দেশের সাম্প্রতিক প্রসঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে বললাম, আপনাদের ধ্বংস করে সরকার বিজিবি গঠন করেছে, আগে আমরা যে বিডিআর’কে নিয়ে গৌড়াবান্বিত ছিলাম, আজকে সেই বিজিবিকে নিয়ে আমরা হীনমন্মতায় ভূগী, এটাকে এখন মেরুদন্ডহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। তিনি স্মীত হেসে জবাব দিলেন, ভাই একথা কি পাগলে বিশ্বাস করবে, ডাল-চাল কর্মসূচীর কারণে এতগুলো সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে? এটা একটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিলো, তাদের মূল টার্গেট ছিলো বিডিআর ধ্বংস করা, তারা সফল হয়েছে।

বিডিআর বিদ্রোহের বিচার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি হেসে ফেললেন, বিচারের সময় তাদেরকে কাগজে দাগ দিয়ে বলা হলো, তোমরা কি দাগের এপাশে থাকবে, নাকি ওপাশে থাকবে? দাগের একপাশে হচ্ছে স্বাক্ষী আরেকপাশে হচ্ছে আসামী। যদি স্বাক্ষীর ঘরে থাকো তবে শ্বাস্তি কম হবে। এই বৌদ্ধ যুবকটি বললো, আমিতো পিলখানাতে ছিলামনা, আমি কিভাবে স্বাক্ষী দিবো! আমি আসামীর কাঠগড়া বেছে নিলাম। তার বিরুদ্ধে মোট ১০জন স্বাক্ষী দিলো, এর মধ্যে ৭জন স্বাক্ষী তাকে একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দেখেছে। তিনি বললেন, মাননীয় আদালত আমার কিছু কথা বলার আছে, আমি একজন মানুষ, একই সময় ৭যায়গায় কিভাবে ছিলাম? বিচারক ধমক দিয়ে বললেন, তুমি চুপ করো, বেশি কথা বলবানা। বিচারে রায় হলো ৫বছর সশ্রম কারাদন্ড, এটাই হচ্ছে বিডিআর বিদ্রোহে বিচারের নমুনা।

তিনি জানালেন বিডিআর বিদ্রোহ নাটকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, কি নিদারূন যন্ত্রনা এবং কস্ট ভোগ করছে এই পরিবারগুলো! একটি পরিবারের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানালেন, নতুন বিয়ে করেছে, বিয়ের ৩মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহ, তার সাজা হয়ে গেলো ৫বছর। ফলাফল, বউ তালাক দিয়ে চলে গেছে, ছোট বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তাও ভেঙ্গে গেছে। হতাশা গ্রস্থ লোকটি নাকি শেষে আত্মহত্যা করেছে।

আরেক বিডিআর সদস্যের কথা বললেন, চাকরী হারিয়ে যিনি এখন এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী। সবাই তাকে বিডিআর হিসেবেই চিনে। তার জীবনের চূড়ান্ত টার্গেট নাকি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করা(বুঝে নিবেন)! এতগুলো পরিবারের দীর্ঘশ্বাস, বুকভরা হাহাকার, হৃদয়ভাঙা যন্ত্রনা এবং স্বতস্ফূর্ত অভিশাপ নিয়ে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তিতে ঘুমাতে পারেন!?

সীমান্তের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, ভাই আপনারা মুসলমানরা যতটা সাহসী এটাতেই ভারতীয়রা ভয়ে পেয়ে যায়। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেমন? তিনি একটা ঘটনার উল্লেখ করলেন, সীমান্তে টান টান উত্তেজনা, দীনভর বাঙ্কারে বসে আছে বিডিআর, সীমান্তের ওপারে ভারতীয়দের ক্যাম্পের দোতলায় মেশিনগান ফিট করে বসে আছে বিএসএফ। সীমান্তের ওপার হতে একটা গুলি আসতেই এপার হতে একটা গুলির জবাব দেয়া হচ্ছিলো, এভাবেই থেমে থেমে গুলি বর্ষণ চলছিলো। সারাদিন বসে থাকতে থাকতে বরিশালের এক বিডিআর সদস্য হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে গেলো, “শালা মালুর বাচ্চা মালু, কি পাইছোস তোরা!” বলেই মেশিন হাতে তুলে ব্যাঙ্কার হতে বের হয়ে দাড়িয়ে গেলো। হতভম্ব বিডিআরের অন্য সদস্যরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো, এত ভাড়ী একটা মেশিন একজন মানুষ এভাবে হাতে তুলে দাড়িয়ে যাবে তারা ভাবতেই পারেনাই, তাও শত্রুপক্ষ যেখানে গুলী তাক করে রয়েছে। কিন্তু সেই বরিশালের বিডিআর সদস্যটির সেদিকে নজর নেই, সে বাঙ্কারের সামনে দাড়িয়েই ভারতীয় ক্যাম্পের দোতলার মেশিনগান লক্ষ করে গুলি বৃস্টি চালাতে থাকলো। মেশিন অপারেটর বিএসএফ সদস্যরা মেশিন ফেলেই পালিয়ে গেলো, ঘটনার আকস্মিকতায় বিএসএফ এতটাই ভীতবিহবল হয়ে পড়লো যে দ্বীতীয়বার তাদের মেশিগানের সামনে আর কেউ যেতে সাহস করলোনা। পরের দিন পতাকা বৈঠকের পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয়দের পক্ষ হতে একটা বুলেটও আসেনাই।

অবশেষে কারাকতৃপক্ষের একজন এসে আমার কেসকার্ড হতে একটা মামলা কেটে দিলেন, হাফ ছেড়ে বাচলাম! ১৫তারিখ এই মামলাটির কোর্ট ডেট ছিলো, আজকে জামিন না হলে কালকে ডান্ডাবেড়ি পড়েই কোর্টে যাওয়া লাগতো। বিডিআর সদস্যটির কাছ হতে বিদায় নিয়ে ওয়ার্ডের পথে হেটে চললাম, চোখে মুখে স্বপ্নদীপ্ত প্রত্যয়, আমরাই পারি! এই তাবেদার জালিম শাহীর পতন করে, হারানো গৌরব আমরাই পুনরুদ্ধার করবো ইনশাআল্লাহ্‌।

মুসলিম আমি সংগ্রামী আমি
আমি চির রণবীর,
আল্লাহকে ছাড়া কাউকে মানিনা
নাড়ায়ে তাকবীর, নাড়ায়ে তাকবীর।
পর্ব-২৬
১৪ই নভেম্বর ৫৪ধারার মামলাটির জামিন হয়ে যাওয়াতে ১৫তারিখ সে মামলার কোর্ট হাজিরা বাতিল হয়ে গেলো, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম! যন্ত্রনাদায়ক একটি দিন থেকে আল্লাহ রেহাই দিয়েছেন। ১৭তারিখ শাহীন ভাই দেখা করতে আসলেন, পারিবারিক সাংগঠনিক নানা বিষয়ে কথা হলো। শাহীন ভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম ১৮তারিখ দেশব্যাপী শিবিরের বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচী আছে, গ্রেপ্তারকৃত শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সহ সকল কারাবন্দী নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবীতে এ কর্মসূচী। খুব আফসোস হচ্ছিলো, যদি বাহিরে থাকতাম তাহলে মিছিলে অংশ নিতে পারতাম। ‘রাজপথের শ্রেষ্ঠ বীর, ইসলামী ছাত্রশিবির’ স্লোগান দিয়ে জিহাদের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ার মতো অনুভুতি ভাষায় ব্যাক্ত করা যায়না। দীর্ঘক্ষণ কথা হলো শাহীন ভাইয়ের সাথে, বিদায়ের আগে শাহীন ভাই জানালেন ১৮তারিখে আবার দেখা করতে আসবেন, মিছিল শেষ করে কোর্টে দেখা করার চেস্টা করবেন, সেটা সম্ভব না হলে কারাগারেই দেখা হবে।

১৮তারিখ কোতোয়ালী থানার গাড়ি ভাংচুর মামলার হাজিরার ডেট। ১৭ তারিখ বিকালেই কোর্টে যাওয়ার স্লিপ চলে আসলো, নিয়ম মেনে এক প্যাকেট স্টাড় সিগারেট ঘুশের বিনিময় আমদানী ওয়ার্ডে রাত কাটানো হতে রেহাই নিলাম।

খুব ভোরেই আমদানী ওয়ার্ডে চলে গেলাম, কোর্টে যাওয়ার সকল প্রকার আনুষ্ঠানিকতা এখানেই সম্পন্ন করা হয়। একে একে সকল আসামীদের নাম ঘোষণা করে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হচ্ছে, যাদের একাধিক মামলা আছে তাদের পড়ানো হচ্ছে ডান্ডাবেড়ি। আমদানী ওয়ার্ডের একপাশেই দোতলায় ওঠার সিড়ির নিচে কামার বসে আছে, একে একে আসামী আসছে আর কামার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তাদের পায়ে ডান্ডাবেড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ, একটি মামলায় জামিন পাওয়ার ফলে আজকে আর ডান্ডাবেড়ি পড়তে হবেনা, ঝাড়া হাত পায়ে আজ কোর্টে যেতে পারবো, কিছুটা ফুড়ফুড়ে মেজাজে এখানে সেখানে ঘুড়ে বেড়াচ্ছি।

কোতোয়ালী থানার এই মামলার আসামী অনেক, বিপুল সংখ্যক শিবির কর্মীকে একসাথে জড়ো করা হয়েছে। একজন আরেকজনকে দেখেই জড়িয়ে ধরছিলাম, কুশল বিনিময় হচ্ছিলো। কোর্টে যাওয়ার দিনটি শিবিরের ছেলেদের জন্য স্পেশাল একটি দিন, এটাকে কারাগার শিবিরের পূনর্মিলনী দিবস বলা যায়। মাথা গুনে দেখলাম আমাদের সংখ্যা ৫০এর কাছাকাছি, হঠাৎ করেই মাথায় ভুত চাপলো, মিছিল করলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ, পলিটেকনিক শাখার সেক্রেটারী মান্নান ভাইও ছিলেন আমাদের সাথে, তাকে বলতেই রাজী হয়ে গেলেন। অন্যদের সাথেও আলোচনা করলাম, অধিকাংশই উৎসাহের সাথে সম্মতি দিলো, দুই একজন মৃদু ভাষায় বললো যদি প্রব্লেম হয়?
আরে ভাই! জেলের ভেতরে আবার প্রব্লেম কি? আমাদের কি নতুন করে গ্রেপ্তার করবে? জেলের ভেতরে কি নতুন জেল আছে?
অবশেষে সবাই রাজী হয়ে গেলো। যেহেতু মিছিলের প্রস্তাবক আমি, সেহেতু আমার উপরেই স্লোগান ধরার দায়ীত্ব চাপিয়ে দেয়া হলো।

আসামীদের প্রিজন ভ্যানে তোলার আগে নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়, ৪জন ৪জন করে লাইন দিয়ে বাসানো হয়, এটাকে কারাগারের ভাষায় বলা হয় ফাইল করে বসা। আসামীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এক গাড়িতে সবাইকে নেয়া সম্ভব হলোনা, আমাদের ভ্যানে মোট আসামী তোলা হলো ৪০জনের মতো সেখানে শিবির ছিলাম ৩০জন, বাকিরা অন্য মামলার আসামী। প্রিজন ভ্যান এগিয়ে যাচ্ছে আমরাও প্রস্তুতি নিচ্ছি মিছিলের, বাহিরে মুক্ত পরিবেশে আমাদের ভাইরা আমাদের জন্য মিছিল করছে, আমরা ভেতরে বসে মিছিল করবো, আনন্দে এবং আবেগে চোখে পানি চলে আসছিলো।

জেল গেইট অতিক্রম করে লালদিঘী ময়দানের কর্নার স্পর্শ করতেই গগন বিদারী স্লোগানে ফেটে পড়লো প্রিজন ভ্যান। ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর’। ‘ইসলামী ছাত্রশিবির, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’। ‘বিপ্লব বিপ্লব, ইসলামী বিপ্লব’। ‘শিবিরের বিপ্লব, ইসলামী বিপ্লব’। স্লোগানে স্লোগানে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে, প্রিজন ভ্যানের ড্রাইভার সম্ভবত মজা পেয়ে গেছে, এমনিতে লালদিঘী ময়দানের রাস্তা অতিক্রম করেই গাড়ি সর্টকাটে আদালতের দিকে ঢুকে যায়, কিন্তু ব্যাতিক্রম ভাবে আজ গাড়ি কিছুটা ঘুড় পথে চলে গেলো পুলিশ কমিশনারের কার্য্যালয়ের দিকে, সেখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে আদালতের দিকে নিয়ে যাবে। আমরাও উৎসাহ নিয়ে মিছিল চালিয়ে গেলাম। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, গগনবিদারী স্লোগানে প্রকম্পিত রাজপথ, সড়কের দু’পাশ হতে কড়তালি দিয়ে মিছিলকে স্বাগত জানাচ্ছে অফিসগামী জনতা, আবেগঘণ রোমাঞ্চকর এক দৃশ্য।
‘বীর চট্টলার মাটি, শিবিরের ঘাটি’। ‘শিবির দিচ্ছে আলোর ডাক, ছাত্রসমাজ জাগরে জাগ’।

আদালত চত্ত্বরে প্রিজন ভ্যান প্রবেশ করলো, সুবোধ বালকের মতো কিছু হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে আমরা আদালত কাস্টডির দিকে হেটে চললাম। পূর্বপরিকল্পনা মতো শিবিরের সবাই কাস্টডি-১ এ প্রবেশ করলাম, কাস্টডি-২নম্বর ছেড়ে দিলাম সকল ২নম্বর লোকদের জন্য। হেরোয়ীন-ইয়াবা খোরদের বিরক্ত করে আমরা নিজেরাও বিরক্ত হতে চাইনা। আধাঘন্টার মধ্যেই পরের প্রিজন ভ্যানে বাকি আসামীদেরও নিয়ে আসা হলো, শিবিরের সবাইকে ডেকে কাস্টডি-১এ নিয়ে এলাম, মিছিল মিস করায় খুব আপসোস করছিলো তারা।

৫০জন শিবিরের ছেলে এক জায়গায়, উৎসব মুখর একটা পরিবেশ, শুরু হলো ইসলামী সংগীত। কখনো সমবেত কন্ঠে, কখনো একক কন্ঠে, সংগীত চলছিলো একের পর এক। আমি গাইলাম শিবির সংগীত, “পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে আমরা শিবির গড়েছি, শপথের সঙ্গীন হাতে নিয়ে সকলে নবীজির রাস্তা ধরেছি, আমরা শিবির গড়েছি” সকলেই কন্ঠ মেলালো প্রানের সঙ্গীতে। অবাক দৃস্টিতে পুলিশ সদস্যরা তাকিয়ে আছে, এরা কি কারাবন্দী নাকি পিকনিক পার্টি!

কিছুক্ষণ পরেই এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে হাজির হলেন, দুই হাত জোড় করে রিকোয়েস্ট করলেন, ভাই আমাদের বিপদে ফেলে আপনাদের কি লাভ? আপনারা প্রিজন ভ্যানে মিছিল করলেতো দেশের অবস্থার পরিবর্তন হবেনা। আপনারা মিছিল করেছেন, আমাদের উপরে প্রচন্ড চাপ এসেছে। ডিজিএফআই, ডিবি, র‍্যাব, গোয়েন্দা সংস্থার লোক এসে আদালত চত্ত্বর ভরে গেছে। প্লিজ ভাই, আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও যাওয়ার সময় মিছিল করবেননা! আমাদের হয়রানী করে আপনাদের কি লাভ? কারাগার হতে বের হয়ে অনেক মিছিল করতে পারবেন। রসিকতা করে বললাম, কারাগার হতে বের হয়ে মিছিল করলেতো আবার এখানে নিয়ে আসবেন! তার করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত করলাম, ঠিক আছে ফেরার পথে মিছিল হবেনা।

একে একে মহানগরী এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের বিভিন্ন দায়ীত্বশীল এসে হাজির হলেন, সাথে করে নিয়ে এলেন প্রচুর পরিমানে খাবার এবং পানি। স্মরণীয় একটি দিন হয়ে রইলে কারাগারের এই দিনটি, আনন্দের মুহূর্তগুলো বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না, মনে হলো এইতো কিছুক্ষণ আগে এলাম।

দুপুর ২টায় কারাগারে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে আমাদের প্রিজন ভ্যানে তোলা হলো, প্রিজন ভ্যানে ৩টি সিট থাকে মহিলা আসামীদের জন্য, পুরুষ আসামীদের দাড়িয়েই যাওয়া আসা করতে হয়। সেদিন মহিলা আসামী ছিলোনা, একটাতে পুলিশ বসলো, পাশেই আমি বসলাম। নানা বিষয়ে কথা হলো পুলিশের সাথে, বিশেষ করে আমরা মিছিল করাতে পুলিশের উপর কেমন প্রেসার গেছে সেটা সে বারবার উল্লেখ করছিলো এবং অনুরোধ করছিলো এখন মিছিল করে যেনো তাকে বিপদের মুখে ঠেলে না দেই।


পর্ব-২৭
ভাঙা গলা নিয়ে ওয়ার্ডে ফিরে আসলাম, ফ্যাস ফেসে কন্ঠস্বর, গলা থেকে হাঁসের মতো আওয়াজ বের হচ্ছিলো। মিছিলের ঘটনা শুনার জন্য চারিদিকে ভীড় করে দাড়ালো ওয়ার্ডের অন্যান্য আসামীরা। বুঝলাম, ভালোই আলোড়ন তুলেছে আমাদের এই মিছিল, হাসান মুরাদ, মাহবুব সহ অন্যান্যরা বাহবা দিচ্ছিলো। ৭নম্বর ওয়ার্ডের ছাত্রলীগ সমর্থক তারেক ও মোর্শেদের সাথে রসিকতা করে বিধান বড়ুয়া বলছিলেন, ‘শিবিরের পোয়া অক্কলের পাওয়ার দেইক্কোনা? ইতারা কারাগারে আইও মিছিল গড়ে, আর তোয়ারা ক্ষমতায় থাকিও জেলে ঢুকি বই রইয়ো। শিকো, ইতারাত্তুন শিকিলও পলিটিক্স ক্যানে গড়ে’।

বিকালে মাইকে ঘোশনা দিয়ে সকল ওয়ার্ডের ইনচার্জদের মিটিং-এ ডাকা হলো, কারাকতৃপক্ষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন, ‘এখন থেকে কোনো ওয়ার্ডে শিবিরের তিনজন ছেলে একসাথে কথা বলতে পারবেনা, যদি কেউ নিয়ম লঙ্ঘণ করে তবে তাকে শাস্তির সম্মুখিন হতে হবে’, শাস্তি বলতে কেস টেবিলে নিয়ে ইচ্ছেমতো পেটানো হবে। নতুন এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ হচ্ছে আমরা যে মিছিল করেছি তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের পানিশমেন্ট!

ঘোশনা শুনেই মাহবুব এবং হাসান মুরাদ সহ শিবিরের নতুন বন্দীদের গলা শুকিয়ে গেলো! ভাই এখন কি হবে?
ততদিনে কারাগারের পরিবেশ এবং নিয়ম কানুন সম্পর্কে ভালো একটা আইডিয়া হয়ে গেছে, কারাগারে ঢুকলে ওকালতি পড়া ছাড়াই মানুষ উকিল হয়ে যায়, আমিও হয়ে গিয়েছিলাম। বিভিন্ন মামলার ধারা উপধারা এবং কোন ধারায় কি ধরনের শাস্তি এবং জামিনের উপায়, সব জানা হয়ে গেছে। না হওয়ার কিছু নেই, চোর,ডাকাত, গুন্ডা, বদমাস, নেশাখোড়, বউয়ের মামলা সহ সব ধরণের মামলার আসামীকে একসাথে রাখা হয়, তাদের মামলার কাহিনী শুনতে শুনতে কান পঁচে গেছে।
তাদের অভয় দিলাম, চিন্তার কিছু নাই, কারাগারের অলিখিত কোনো নিয়মই স্থায়ী নয়, দুই চারদিন হয়তো জ্বালাতন করবে তারপর যেই সেই। আর আমরা যখন পরস্পরের সাথে কথা বলবো তখন কি আমাদের পিঠে শিবিরের সাইনবোর্ড লাগানো থাকবে? কিছুটা আশ্বস্ত হলেও ভয় পুরোপুরি কাটেনি তা তাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছিলাম। কারাগারে নতুন আসলে এমন ভয় থাকাটাই স্বাভাবিক!

আমাদের মিছিলের প্রতিক্রিয়া ছিলো অভাবনীয়, মিছিলের পরবর্তী পানিশমেন্ট হিসেবে শিবিরের ছেলেদের উপর যে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিলো, তাতে করে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো। আমার এই হঠকারী প্রস্তাবের কারণেই সবাইকে কষ্ট পেতে হচ্ছে ভেবে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিলো। কিন্তু দুইদিন পরেই মনের আকাশে দূর্ভাবনার মেঘ কেটে ঝলমলে সূর্য উকি দিলো।

সেদিন ছিলো, হাসান মুরাদ সহ একঝাক শিবির নেতাকর্মীর একটি মামলার কোর্ট ডেট, তাদের সবারই একাধিক মামলা থাকায় খুব টেনশন কাজ করছিলো, কারণ সবাইকেই ডান্ডাবেড়ি পড়ানো হবে। বদিউর রহমান ভাইয়ের মাধ্যমে একজন থেকে ফুটবল খেলার এ্যাংলেট ধার করে দিলাম হাসান মুরাদকে, পায়ে ডান্ডাবেড়ি পড়ার আগে এ্যাংলেট পড়ে নিলে চামড়া ছিলে রক্ত ঝড়ার সম্ভাবনা কমে যায়, এবং ব্যাথাও কম লাগে। কোর্টের উদ্দেশ্যে সকাল ৮টার দিকে ওয়ার্ড হতে বের হয়েছিলো হাসান মুরাদ, কখন ফিরবে ঠিক নেই, এর আগেরবার ফিরতে সন্ধ্যা হওয়ায় সারারাত ডান্ডাবেড়ি নিয়ে কষ্ট করতে হয়েছিলো ছেলেটিকে, কারণ ভোরের আগে এটা খোলার উপায় নেই।

সকাল ৮টায় বের হলেও ৯টার দিকে দেখলাম হাসান মুরাদ হেলতে দুলতে ওয়ার্ডের দিকে ফিরে আসছে, মুখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি।
ব্যাপার কি! আজকে আপনার কোর্ট ডেট ছিলোনা?
কোর্টে যাওয়া লাগবেনা, এখানেই হাজিরা হয়ে গেছে, হাসতে হাসতেই জবাব দিলো মুরাদ।
কিভাবে সম্ভব হলো, অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
মূল ব্যাপার হচ্ছে, আমরা সেদিন প্রিজন ভ্যানে মিছিল করায় কারা কতৃপক্ষ ভয় পেয়ে যায়। তাই কতৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, শিবিরের আসামীর সংখ্যা বেশি হলে কোর্টে নেয়া হবেনা, মামলার আনুষ্ঠানিকতা কারাগারেই সম্পন্ন করা হবে। কতৃপক্ষের একজন বলছিলো, ‘তোমাদের কোর্টে নেয়া যাবেনা, কোর্টে নিলেই তোমরা মিছিল করবা, কি দরকার ঝামেলা করে!’
হাসান মুরাদ হাসতে হাসতে বলছিলো, ভাই মিছিল করাতেতো ভালোই হলো। এখন আর ডান্ডাবেড়ি পড়ে, প্রিজন ভ্যানে ময়দা ঠাসা হয়ে কোর্টে যাওয়া লাগবেনা! দুনিয়ার জাহান্নামের একটা আজাব হতে মুক্তি পেলাম! আমিও হাসছিলাম তবে সেই হাসিটা ছিলো দায়মুক্তির, মনের ভেতর যে অপরাধবোধ কাজ করছিলো নিমেষেই তা হতে মুক্তি লাভ করলাম। আর একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, কারাগারের ভেতরে শিবির কর্মীরা একসাথে ৩জন কথা বলতে পারবেনা বলে যে বিধান প্রশাসনের পক্ষ হতে জাড়ি করা হয়েছিলো, সেটা ৩দিনের বেশি লাস্টিং করেনাই!

এরপরে দীর্ঘদিন পর্যন্ত অধিক সংখ্যাক শিবির কর্মীর একই দিনে কোর্ট ডেট থাকলে তাদের কোর্টে নেয়া হতোনা, আমি কারাগার হতে মুক্তি পাওয়ার পরেও মাস দুয়েক এমন নিয়ম দেখেছি। এখন সেটা চেঞ্জ হয়েছে কিনা জানানাই।

পর্ব-২৮

হঠাৎ করেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগ নামের কিছু হিংস্র হায়েনা হামলা করলো, ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে সাধারণ ছাত্ররা প্রশাসনকে হুশিয়ার করে দিলো, অবিলম্বে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের এখান হতে সরিয়ে না দিলে পরবর্তী ঘটনার জন্য ছাত্রদের দায়ী করা যাবেনা। প্রশাসন ছাত্রদেরকে আশ্বাস দিলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়েছিলো, গাড়ি ভর্তি করে পুলিশ এসে হলের সকল ছাত্রকে নিরাপত্তার সাথে কারাগারে পৌছে দিলো। নভেম্বরের ১৮তারিখেই জানতে পারলাম বিপুল সংখ্যক শিবির কর্মীকে কারাগারে আনা হয়েছে, মেডিকেল শাখা ছাত্রশিবিরের সকল পর্যায়ের নেতাই এখন কারাগারে। ভালোই হলো, কাধে কাধ মিলিয়ে সবাই মিলে জেল খাটবে, একাকীত্ব বিষন্নতা আচ্ছন্ন করতে পারবেনা এই ভবিষ্যৎ ডাক্তারদের।
১৯তারিখ বিকালেই দেখলাম লাইন করে একঝাক পরিচ্ছন্ন চেহারার ছেলেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠানো হচ্ছে, একনজর দেখলেই যে কেউ বলে দিবে এগুলো শিবিরের ছেলে। মহা উৎসাহ নিয়ে অন্যন্য আসামীরা তাদের দেখছে, জেলখানার ইতিহাসে এতগুলো হবু ডাক্তার একসাথে এসেছে বলে কারো জানা নেই।

আমার ওয়ার্ডের ইনচার্জ অনেক দর কষাকষি করে তিনজনকে কিনে এনেছে, হামদান কাফী, রায়হান এবং রাশেদ। মেডিকেল শাখা ছাত্রশিবির সেক্রেটারী হাসান আল বান্না ভাইকে দেয়া হয়েছে একই ভবনের ১৪নম্বর ওয়ার্ডে।
সর্বমোট ৪০জন মেডিকেল ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো, এদের মধ্যে ৩৯জন বিভিন্ন বর্ষের ছাত্র এবং একজন শিক্ষানবীশ ডাক্তার, যিনি পরবর্তীতে কারাগারের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কারাগার হতেই বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।

সময়ের পরিবর্তনে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে শিবিরের আসামীর পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকলো। অন্যন্য আসামীরা মজা করছিলো, “শামীম ভাই! কারাগার শিবির মুক্ত করতে হবে, শিবিরের ছেলেদের কারাগারে থাকতে দেয়া হবেনা!”

এদিকে এক মজার ঘটনা ঘটে গেলো! আমাদের পাশের ওয়ার্ডের বন্ধু মোর্শেদ সব সময় মনখারাপ করে থাকতো, আমাকে ডাকা হতো “টেনশন ফ্রি ম্যান” কারণ হচ্ছে তারেক এবং মোর্শেদ দুইজনেই বাহিরে তাদের প্রিয় কাউকে রেখে এসেছে, কিন্তু সেদিক হতে শিবিরের ছেলেরা নিরাপদ ছিলো, শিবিরের ছেলেদের পড়াশোনার টেনশন ছাড়া অন্য কোনো টেনশন ছিলোনা। মোর্শেদ সবসময় আফসোস করতো ‘আহ! কত সুযোগ ছিলো বিয়ে করে ফেলতে পারতাম, কি ভুল করলাম!’
সেদিন হঠাৎ করেই কারা-অফিস হতে মোর্শেদকে কল করা হয়! মোর্শেদতো ভয়ে শেষ, ভাবছিলো হয়তো অফিসে কোনো রিপোর্ট গেছে তাই পানিশমেন্টের জন্য ডাকা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই মোর্শেদ হাসি মুখে ফিরে আসে, হাতে ১৫পৃষ্ঠার বিশাল সাইজের একটা চিঠি এবং একপিস ফটো। আর যায় কোথায়! ওয়ার্ডের এমন কেউ নেই যে চিঠি এবং ছবি দেখেনাই। বিধান বড়ুয়া’র কাছে স্পেশাল আদালত বসানো হলো, জড়িমানা হিসেবে সবাইকে পিঠা খাওয়াতে হবে। আসামী সানন্দ চিত্তে শ্বাস্তি মেনে নিলো।



পর্ব-২৯

কারাগারের ভেতরের কারাগার!

জেলখানার ভেতরে সবচাইতে অবহেলিত এবং নির্যাতনের স্বীকার হয় সাধারণ আসামীরা, যাদের খোজ খবর নেয়ার মতো আত্মীয়স্বজন কিংবা বাহির হতে সাপোর্ট দেয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা নেই। মূলত জোড় জবরদস্তী করে টাকা আদায় করার জন্যই এ নির্যাতন চালানো হয়।
শিবিরের মামলার আসামী হওয়ায় শিবির কর্মীদের এই নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়না। এর একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে শিবিরের ইউনিটি! একজন শিবির কর্মী হয়রানীর শিকার হলে হাজার হাজার শিবির কর্মী তাকে উদ্ধারে ঝাপিয়ে পড়ে। তাছাড়াও প্রশাসনিক রিপোর্টিং এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তিকে বিচারের সম্মুখিন করা হয়। ওয়ার্ড ইনচার্জরা একথা ভালো করেই জানে, শিবিরের কোনো কর্মীকে হয়রানী করা হলে এটার জন্য তাকে পস্তাতে হবে, এমনকি ইনচার্জের দায়ীত্ব হতেও তাকে অব্যহতি দেয়া হতে পারে।

আমাদের সাথে গ্রেপ্তার হয়েছিলো এনায়েতবাজার ওয়ার্ডের কর্মী শাহাদাৎ, ওয়ার্ড ইনচার্জ তুচ্ছ কারণে শাহাদাৎকে অপদস্ত করে। ইনচার্জের এই অমানবিক আচরণের কথা সংগঠনকে জানানোর দুই দিন পরেই তার ইনচার্জ পদ বাতিল করে তাকে রান্না ঘরে বাবুর্চির কাজে নিযুক্ত করা হয়। এমন অনেক ওয়ার্ড ইনচার্জকে দেখেছি যারা ওয়ার্ডে বসে হাতের তুড়িতে রাজা-উজীড় মেরে ফেলে, তারাই আবার শিবিরের কয়েদিদের সামনে গেলে বিড়ালের মতো মিউ মিউ আচরণ করছে। ওয়ার্ডে বসে শিবিরের ছেলেদের সাথে গলা উচিয়ে হম্বি তম্বি করার কিছুক্ষণ পরেই আবার রিকোয়েস্ট করছে একথা যেনো শিবিরের কয়েদীদের না জানানো হয়।

এই লেখাটি তৈরী করার কিছুদিন পূর্বে গ্রেপ্তার হয়েছেন জামায়াত কর্মী রমজান চাচা, একসময়ের দূর্ধর্ষ সন্ত্রাসী রমজান চাচা এখন সাচ্চা মুমিন। আল্লাহ কাকে কখন হেদায়েতের সুশিতল আশ্রয়ে সিক্ত করেন সেটা কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়। চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াত শিবিরের এমন কোনো কর্মী নেই যে কিনা সাদা দাড়ি, সাদা পাঞ্জাবী এবং সাদা পাগড়ী শোভিত রমজান চাচাকে চেনেনা। বয়বৃদ্ধ এই মানুষটি জামায়াত-শিবিরের প্রতিটি মিছিলে হাজির হয়ে যান সবার আগে সবখানে।

তখন সবেমাত্র শিবিরের কর্মী হয়েছি, বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা সংগঠন নিয়ে। লালদিঘীর একটি সমাবেশে পরিচিত হলাম বৃদ্ধ রমজান চাচার সাথে, রমজান চাচা বলছিলেন, ‘দেখো ইসলামী ছাত্রশিবির হচ্ছে আল্লাহর নিয়ামত, সবাই শিবির করতে পারেনা, আল্লাহ যাদের কবুল করেন শুধু মাত্র সেইসব ছাত্ররাই শিবির করতে পারে’।

কারাগারে এসে রমজান চাচার কথাটিকে আরেকবার স্মরণ হয়েছিলো! টেকনাফের একজন শিবির কর্মী ব্যাথা পেলে তেতুলিয়ায় অবস্থানরত অন্য শিবির কর্মী সে ব্যাথা অনুভব করে। কারাগারের কর্ণফূলী ওয়ার্ডের একজন শিবির কর্মী কষ্ট পেলে যমুনা ওয়ার্ডের অপর শিবির কর্মী সে কষ্ট হৃদয় দিয়ে অনুভব করে। এইযে ঐক্য এই যে ভালোবাসা, এই যে সংগঠনের একভাইয়ের প্রতি অন্যভাইয়ের আন্তরিকতা, এটা কেবল ইসলামী আন্দোলনেই সম্ভব, এটা কেবল আল্লাহর নিয়ামত প্রাপ্ত ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীদের মধ্যেই সম্ভব। এবং এই ঐক্য এই আন্তরিকতা এবং ভালোবাসাই বাতিলের জন্য আতঙ্ক, জালিমের জন্য হুঙ্কার। শিবিরের কোনো কর্মীকে কটু কথা বলার আগে জালিমকে চিন্তা করতে হয় এই কথা তিনি ঐ শিবির কর্মীকে বলছেননা, এটা তিনি বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শিবির কর্মীর বিরুদ্ধে বলছেন।

কারাগারের অভ্যন্তরেও কারাগার আছে, শুনতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তব। একজন আসামীকে কারাগারের আনার পরে প্রথম দিন রাখা হয় আমদানী ওয়ার্ডে এবং পরেরদিন তাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। নিয়ম হচ্ছে আসামী তার বরাদ্দকৃত ওয়ার্ডে যাওয়ার পরে সে নিজের মতো করেই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে, প্রয়োজনে অন্যন্য আসামীদের সাথে কথাবার্তা বলে টাইমপাস করবে, বই পড়বে, লুডু খেলবে, দাবা খেলবে এবং কারাগারের কিছু রুলস বাদ দিয়ে নিজের ব্যাপারে সে স্বাধীন। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন, ওয়ার্ডের প্রথমদিনই ওয়ার্ড ইনচার্জ আসামীকে প্রেসার ক্রিয়েট করে টাকার জন্য! টাকা দিতে পারলে তাকে দেয়া হবে ভালো বিছানা, কিছুটা ভালো খাবার এবং প্রয়োজনীয় পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা, স্বাধীন চলাফেরা এবং অন্যদের সাথে কথা বলার অধিকার। আর যদি ইনচার্জকে টাকা না দেয়া হয় তবে আসামীর এই অধিকারগুলো কেড়ে নেয়া হয়, তাকে আবদ্ধ করা হয় একটি অদৃশ্য কারাগারে। আসামীকে কারও সাথে কথা বলতে দেয়া হয়না, উঠতে বসতে শুনতে হয় বলার অযোগ্য গালাগালি, বিছানা দেয়া হয় টয়লেটা যাওয়া-আসার দরজার পাশে, পানির জন্য করা হয় জ্বালাতন, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চুরী করা হয় এবং অসহনীয় করে দেয়া হয় সেই আসামীর জীবন। এমনও দেখেছি, টাকার জন্য দরিদ্র আসামীকে টয়লেটের মধ্যে ঢুকিয়ে মারধর করছে ওয়ার্ড ইনচার্জ এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা, জোড় পূর্বক নিয়োজিত করেছে টয়লেট পরিস্কার করার কাজে।
শুধু মাত্র দেখেই যেতাম, কিছুই করার ছিলোনা, নিজের এলাকায় বিড়ালও বাঘ! এটা কয়েদিদের এলাকা, এখানে তাদেরই রাজত্ব চলবে! আমরা হলাম ক্ষণিকের অতিথি, সরকারী মেহমান! দেখতে দেখতে গা-সওয়া হয়ে গেছে, অবাক হইনা, কষ্ট পাওয়ার অনুভুতি ভোতা হয়ে গেছে!

মেডিক্যাল শাখা শিবিরের যে তিনজন ভাইকে আমাদের ওয়ার্ডে আনা হয়েছে, তাদের সাথে ইনচার্জের দশহাজার টাকার চুক্তি হয়েছিলো, সংগঠনের দায়ীত্বশীলরা সার্বিক কাজে ব্যস্থ থাকায় এবং চল্লিশজন আসামীর বিছানাপত্র থেকে শুরু করে অন্যন্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কালেকশন করতে ব্যস্ত থাকায় টাকা পাঠাতে একটু দেরী হয়ে যায়। তাছাড়া কর্মী শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগীতা নিয়েই এই সংগঠন পরিচালিত হয়, সম্ভবত সংগঠনের তহবিলেও তখন পর্যাপ্ত টাকা ছিলোনা।
এদিকে ওয়ার্ড ইনচার্জ কফিল দেরী মানতে নারাজ, টাকা তাকে দিনের মধ্যেই দিতে হবে। এই নিয়ে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তারা শিবিরের ওই তিনজন ভাইয়ের খাবার বন্ধ করে দেয় এবং হুমকি দেয়, পরবর্তীতে তাদের সাথে অন্যান্য সাধারণ আসামিদের মতো একই আচরণ করা হবে।

ওয়ার্ড ইনচার্জের এই টাইপের আচরণ দেখে যেকারও পক্ষেই মাথা ঠান্ডা রাখা কঠিন, আমি প্রস্তাব দিলাম ইনচার্জের সাথে যে চুক্তি ছিলো সেটা বাতিল করে দেয়া হোক, বদিউর রহমান ভাইয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কালেকশন করে দেয়া যাবে, তাছাড়া পিসি কার্ড দিয়ে খাবারও কিনে খাওয়া যাবে। কিন্তু মেডিক্যালের স্টুডেন্টরা সম্ভবত গ্যাঞ্জামে জড়াতে চাচ্ছিলোনা, তারা আপোষের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করতে চাচ্ছিলো, শেষ পর্যন্ত একদিনের আল্টিমেটামের মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা হয়।
হামদান কাফি’র পিতার মাধ্যমে কথাটি পৌছে যায় ডেপুটি জেলার সোহেলের কানে। সোহেল হচ্ছেন কট্টর আওয়ামী পন্থী লোক, অন্যদিকে সে আবার কাফি’র দূর সম্পর্কের আত্মীয়। যা হওয়ার তাই হলো, ওয়ার্ড ইনচার্জের কপালে জুটলো চড় এবং কাফি’র পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার সৌভাগ্য(!) কাফি অবশ্য পায়ে হাত দেয়ার আগেই ক্ষমা করে দিয়েছিলো।



পর্ব-৩০

মেডিক্যাল ছাত্রদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরে ওয়ার্ড ইনচার্জ অনেকটাই সোজা হয়ে গেলো, আসামীরা কিছুটা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছিলো। অন্যান্য আসামীদের সময় কাটতো লুডু খেলে, লুডু খেলা তেমন একটা পছন্দ করতামনা, কিন্তু মেডিক্যাল ছাত্রদের দেখলাম খেলাটির প্রতি প্রবল আগ্রহ। ক্যান্টিন হতে একটা লুডু বোর্ড কিনে আনলাম, খেলতে খেলতে হেব্বি মজা পেয়ে গেলাম, দারুন সময় কেটে যাচ্ছিলো আড্ডা এবং লুডু খেলা নিয়ে।

উপরে উপরে হাসিখুশি দিনপার করলেও, ভেতরে ভেতরে টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। চারদেয়াল বন্দী অসহ্য-অসহনীয় গৎবাঁধা এ জীবন! বুকটা হাসফাস করছিলো একচিলতে মুক্ত আকাশের জন্য, একরাশ মুক্ত বাতাসের জন্য। ক্ষনে ক্ষনে মনে পড়ছিলো সেই মুক্ত-স্বাধীন দিনগুলোর স্মৃতি, আত্মীয়-পরিজন বেস্টিত জীবন।

১১নম্বর ওয়ার্ডের একজন আসামী দেখলাম দেয়ালে মাথাঠুকে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে, এই নির্মম দমবন্ধ হওয়া পরিবেশে কেউ কেউ সম্ভবত পাগল হয়ে যায় মানসিক অস্থিরতার কারণে। আমাদের ওয়ার্ডের আজীজ নামে একজন আসামী দেখলাম তার বউয়ের সাথে সাক্ষাৎএর সময়ে, জামিন না হওয়ার কস্ট সহ্য করতে না পেরে লোহার গ্রিলের সাথে মাথা ঠুকে শিশুর মতো চিৎকার করে কাদছে, বউকে দেখলাম কান্না করতে করতে মূল গেইট দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। এটাই ছিলো নিত্যদিনের কারাগারের বিরহের অভিজ্ঞতা।

৫৪ধারার মামলাটির জামিন হয়ে গেছে সেই কবে, তারও আগে নভেম্বরের ১১তারিখে মূল মামলাটারও জামিন হয়ে গেছে, কিন্তু হাইকোর্ট হতে জামিনের কাগজ আসতে দেরী হওয়ায় মুক্তি পাচ্ছিলামনা। মনে কিছুটা সন্দেহ ছিলো, সত্যিই কি জামিন হয়েছে? নাকি সান্তনা দেয়ার জন্য দায়ীত্বশীলরা মিথ্যে বলেছে! একদিনতো শাহীন ভাইকে বলেই ফেললাম, ভাই আমি ধৈর্য ধরতে রাজি আছি, কিন্তু দয়া করে আমাকে মিথ্যা সান্তনা দিবেননা, সত্যি করে বলেন জামিন হয়েছ কিনা? শাহীন ভাই হেসে বলছিলেন, জামিন হয়েছে, কাগজ আসতে একটু সময় লাগছে। স্বাভাবিকভাবে হাইকোর্ট হতে জামিনের কাগজ আসতে সপ্তাহ খানিকের বেশি সময় লাগেনা, কিন্তু ১৪দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কাগজ না আসায় কিছুটা অস্বস্তি কাজ করছিলো।

কাফী কার কাছে যেনো শুনেছিলো আমরা মিছিল করায় কতৃপক্ষ শিবিরের ছেলেদের পানিশমেন্ট দিয়েছে, আড্ডার একটা পর্যায়ে কথাপ্রসঙ্গে কাফী জিজ্ঞাসা করলো, শামীম ভাই আপনি থাকতে ওরা মিছিল করলো কিভাবে? আপনি বাধা দিতেন!
কি বলব? কিছুক্ষণ হাসলাম!

এরই মধ্যে মেডিক্যাল শাখার গ্রেপ্তারকৃত শিবির নেতাকর্মীদের কোর্ট ডেট চলে আসলো, প্রস্তুতি নিয়ে সবাই আমদানি-২ এ গিয়ে হাজির হলেও কিছুক্ষণ পরেই তাদের ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়া হলো। কাহিনী আর কিছুনা, মিছিল আতঙ্ক! প্রশাসন ভয়ে পেয়ে গেছে, এতগুলো শিবিরের ছেলেকে একসাথে আদালতে নেয়া হলে নিশ্চিত তারা পূর্বের মতোই প্রিজন ভ্যানে মিছিল করবে। মিছিল ঠেকাতে আদালতের কার্যক্রম কারাগারেই সম্পন্ন করে ফেলা হলো। মিছিলের অকল্যানে ডান্ডাবেড়ির স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হলো মেডিক্যাল শাখার শিবির নেতাকর্মীদের!


পর্ব-৩১

জামিনের ডকুমেন্টের জন্য প্রহর গুণছি, আমি সহ সর্বমোট ২৫জন শিবির কর্মীর একসাথে জামিন হয়েছে হাইকোর্ট হতে, জামিনের ডকুমেন্ট আসলে সবার একসাথেই আসবে। মহানগরীর দায়ীত্বশীলরা এসে জানালেন জামিনের ডকুমেন্ট এসেছে ঠিকই কিন্তু একটু ঝামেলা হয়ে গেছে, হাইকোর্ট হতে পাঠানো ডকুমেন্টে আমার নাম ভুল এসেছে। ভুল সংশোধনের জন্য কাগজ আবার হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে, সংশোধন হয়ে ফিরে আসতে যতদিন সময় লাগে। তারমানে সরকারী সিস্টেমে এই ডকুমেন্ট হাইকোর্টে যেতে আসতে আরো কমপক্ষে ১০দিন অপেক্ষা করতে হবে, বেশিও লাগতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশে মান্ধাত্বার আমলের যোগাযোগ ব্যবস্থা, যেখানে দু’মিনিটের একটা ইমেইলেই কাজটি করা সম্ভব, সেখানে সময় লাগছে প্রায় দু’সপ্তাহ!

২২তারিখ সকাল বেলা কারা প্রশাসনের পক্ষ হতে শিবিরের মামলার আসামীদের নামের তালিকা নিয়ে যাওয়া হলো। বিকাল বেলা একজন কয়েদি দেখলাম বিশাল এক লিস্ট নিয়ে হাজির, মামলা দেয়া হবে! শিবিরের আসামীদের নতুন মামলা দেয়া হবে! হার্ট বিট বেড়ে গেলো, প্রতিনিয়ত যেখানে জামিননামা’র কাগজের প্রহর গুনছি, সেখানে নতুন মামলা দেয়া হলে নির্ঘাত দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো।
নামের লিস্ট দেখে একটা একটা করে কেসকার্ড বের করছে আর প্রতিটি কেসকার্ডে নতুন করে দু’টি মামলা লিখে দিচ্ছে! মেডিক্যাল শাখা শিবিরের প্রত্যেকের নামেই দেখলাম নতুন করে দুটো মামলা যুক্ত করা হলো। আমরা যারা পুরাতন আসামী ছিলাম, তাদের কেসকার্ড পাশেই পড়ে ছিলো। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকর, বুকের উপর হতে বিশাল এক পাথুর পাহাড়ের নেমে গেলো। তবে যে সকল ভাইদেরকে নতুন মামলা দেয়া হয়েছে তাদের জন্য খারাপ লাগছিলো, যদিও সংগঠন সবগুলো মামলা একসাথেই পরিচালিত করবে, এবং সবগুলো মামলার জামিন দুই একদিন আগে পিছে করে হয়ে যাবে।

পরীক্ষার্থী এবং মেডিক্যাল ছাত্রদের পড়াশোনার সুবিধার কথা বিবেচনা করে সংগঠন প্রশাসনিকভাবে তাদের জন্য আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করলো, কয়েকটা দিনের পরিচয়ে দ্বীনি ভাইদের সাথে রক্তের ভাইয়ের মতোই সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিলো, মাত্র তিনজন ভাই ওয়ার্ড চেঞ্জ করলো অথচ মনে হচ্ছিলো মূহুর্তেই যেনো ওয়ার্ড ফাকা হয়ে গেছে।
ওয়ার্ড ইনচার্জ জানালো আমাকেও নতুন ওয়ার্ডে যেতে হবে, হাসান মুরাদের চেহারার দিকে দেখলাম তাকানো যাচ্ছেনা, চোখ টলমল করছে। ইব্রাহীমতো আমাকে জড়িয়ে ধরেছে আর ছাড়ছেইনা, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আটকে গিয়েছি গুটিকয়েক ইসলামের সৈনিক! ইনচার্জকে অনুরোধ করলাম, আমি যাবোনা, আপনি মানা করে দেন।

প্রায়ই বিকেল বেলা কর্ণফুলি ভবনের সামনের রাস্তায় হাটাহাটি করতাম, কখনোবা পানিশূন্য হাউজের উপর বসে চলতো তুমুল আড্ডা। প্রশাসনের উপরের স্তরের কারও আসার সম্ভাবনা থাকলে মিয়াসাবরা উঠিয়ে দিতো, আর তেমন সম্ভাবনা না থাকলে নিজেরাই যোগ দিতে আড্ডায়, প্রাণবন্ত সে আড্ডায় অধিকাংশ মিয়াসাবকেই দেখেছি শিবিরের প্রতি সহানুভূতিশীল। এবং সংগঠনের ব্যাপারে পজেটিভ ধারণা পোষণ করেন।
কৌতুহল বশত একদিন ৫ম তলার জেএমবি ওয়ার্ডের কথা জিজ্ঞাসা করলাম, আমরা তিনতলায় থাকলেও কখনো সেখানে যেতে পারিনি, সাধারণ আসামীদের সেখানে যাওয়া নিষেধ। মিয়াসাব বললেন আরে ভাই বইলেননা, চৌদ্দজনে চৌদ্দ রকমে নামাজ পড়ে! আমি জিজ্ঞাসা করলাম, নামাজ নিয়ে তাদের মধ্যে কখনো মারামারির ঘটনা ঘটেছে? মিয়াসাব না সূচক জবাব দিলেন, এবং জানালেন তারা জামায়াতেই নামাজ পড়ে তবে হাত বাধা নিয়ে একেকজন একেক রকমের নিয়ম মানে। আমি হেসে জবাব দিলাম তাহলে প্রব্লেম কি! একটা জায়গাতেতো তারা ঐক্যমত আছে, দেশে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে তাদের মূল প্রব্লেম যেটা তা হচ্ছে, তারা যে পদ্ধতীতে ইসলাম কায়েম করতে চায় সেটা বাস্তব সম্মত নয়।

আমাদের ওয়ার্ডে জুয়েল ছিলো ধর্ষণ মামলার আসামী, প্রেমিকার বাপে মিথ্যা মামলা দিয়ে এই শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়েছে। দারুণ প্রাণবন্ত ছেলে, সারাক্ষণ হাসি ঠাট্টা করে মাতিয়ে রাখতো সবাইকে, সন্ধার আগে আগে যখন ওয়ার্ডের সামনের লোহার গ্রিল ধরে সূর্যাস্ত দেখতাম, জুয়েল তখন পাশে এসে দাড়াতো। একদিন দূরের বাড়ির ছাদে একটা মেয়েকে দেখিয়ে জুয়েল জিজ্ঞাসা করলো, শামীম ভাই ওইযে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছেন?
‘কোন মেয়েটা? ও হ্যা দেখতে পাচ্ছি!’
‘আসেন মেয়েটাকে টিজ করি!’
জুয়েলের কথা শুনে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘টিজ করে কি লাভ?’
মুখের ভাব সিরিয়াস করেই জুয়েল বললো, ‘লাভ আছে, আসেন টিজ করি’।
আমিও সিরিয়াস ভাব নিয়ে বললাম ‘আচ্ছা আপনি টিজ করেন আমি দেখি’।
এবার জুয়েল বললো, দেখেন আমরা যদি মেয়েটাকে টিজ করি, মেয়েটা কি করবে? জুয়েল সিরিয়াস!
আমি জিজ্ঞাসা করলাম কি করবে?
মেয়েটা কারাগারের প্রশাসনের কাছে নালিশ করবে।
আমি বললাম, হ্যা, তারপরে?
জুয়েল সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো, তখন কারাগার প্রশাসন বলবে, তোদের মতো বেয়াদ্দব পোলাদের কারাগারে স্থান নাই, যা ভাগ! আমাদের কারাগার হতে বের কর দিবে!
হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গিয়েছিলো, ছেলেটা এমন সব রসিকতা করে, না হেসে পারা যায়না!


পর্ব-৩২

ততদিনে প্রচন্ড শীত নেমে এসেছে কারাগারে, ডিসেম্বরের হাড়কাপানো শীত! কারাগারের অভ্যান্তরে রাতের বেলা ফ্যান বন্ধ করার নিয়ম নেই, হতাশ ব্যাক্তিদের কেউ যেনো ফ্যানের সাথে কিছু একটা গলায় দিয়ে ঝুলে না পরে তারই জন্য এই ব্যবস্থা। যদিও রাতের বেলা পালক্রমে পাহাড়ার ব্যবস্থা আছে, তারপরেও পাহারার দায়ীত্বপ্রাপ্তরাও অনেক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। সারারাত চোখের সামনে জ্বলতে থাকে তীব্র আলোক বাতি, আলোকিত ঘরে ঘুমাতে আমার প্রব্লেম হয়না, তবে প্রথম প্রথম অনেকেই ঘুমাতে পারেনা কস্ট হয়।

গভীর রাতে পাহারাদার চেচিয়ে ওঠে, টেনে টেনে বলে, হই কর্ণফুলী আস্টো-চল্লিশ, নয় নম্বর খবর ল! আবার কখনো কখনো মজা করে বলে, কর্ণফুলী আস্টো-চল্লিশ নয় নম্বর ঘুম যার! মূলত পাহাড়ার দায়ীত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি সচেতন আছে সেটা বুঝানোর জন্যই এই সংকেত দেয়া হয়। কথাগুলোর অর্থ হচ্ছে কর্ণফুলী-৮এর বর্তমান আসামীর সংখ্যা চল্লিশ! নয় নম্বর ওয়ার্ডের কি খবর? তখন নয় নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়ার দায়ীত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি চেচিয়ে ওঠে কর্ণফুলী নয়-বিয়াল্লিশ, দশ নম্বর খবর ল! এভাবেই একের পরে এক পাহারাদার ধারাবাহিক ভাবে তাদের উপস্থিতি ঘোষণা করে। কখনো কখনো রাতে ঘুম না আসলে পাহারাদারকে থামিয়ে দিয়ে আমিই ঘোষণা দিতাম, কর্ণফুলী-৮ চল্লিশ! নয় নম্বর জামিন!

প্রতিদিন কমকরে হলেও পনেরো বার বিভিন্ন টাইপের ঘোষণা দেয়ার জন্য কয়েদিরা ওয়ার্ডে আসতো, কখনো জামিন ঘোষণা, কখনো দেখার স্লিপ, কখনো ওকালতনামা, কখনো পিসিকার্ডের টাকা আসার ঘোষণা এবং তাদের ঘোশণা করার স্টাইলটাও ছিলো মজার! কখনো কখনো ঘোশকের স্টাইল নকল করে কাউকে ভড়কে দেয়ার জন্য জানালার পাশে গিয়ে আমরাও নাকি স্বরে ঘোশণা দিতাম, “এ মাহবুবুর রহমান, পিতা মোস্তাফিজুর রহমান, থানা চকরিয়া!” সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হয়তো বাথরুমে ছিলো, ব্যাপক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতো তার নাম ঘোষণা করা হয়েছে, কাহিনী কি!

একদিকে ডিসেম্বরের হাড়কাপানো ঠান্ডা, অন্যদিকে মাথার উপর ভনভন করে ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা, কখনো কখনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে সুইচবোর্ড টিপে পাখা বন্ধ করে দেয়া হতো, তখন শুরু হতো মশার উপদ্রব, ঝাকে ঝাকে মশা! নিরুপায় হয়ে পাখা চালিয়েই রাখা হতো। প্রতি তিনজনের গায়ে দেয়ার জন্য একটি কম্বল বরাদ্দ ছিলো, শত বছর আগে সম্ভবত সে কম্বল ধোয়া হয়েছিলো, নাকের সামনে নেয়ার উপায় নেই! গামছা দিয়ে মাথা সহ মুখমন্ডল পেচিয়ে মুখোশ বানিয়ে ফেলতাম, গলার কাছে দিতাম গিট! বাহির থেকে একটা চাদর এনেছিলাম সেটা দিয়ে সমস্ত দেহ পেচিয়ে তার উপরে কম্বল দিয়ে ঘুমাতাম। এতো সতর্কতার পরেও সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখের ভেতরে ধুলোর অস্তিত্ব টের পাওয়া যেতো!

প্রতিদিনই কেউনা কেউ দেখা করতে আসতো, কারাগারে যাওয়ার আগে ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে যেসব ভাইয়ের সাথে দীর্ঘদিন ধরে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি, তারাও এসেছে, তাদের মধ্যে মহানগরীর সাবেক শিক্ষা সম্পাদক শিব্বির আহম্মদ ভাই, প্রবাহ কোচিং-এর সাবেক দায়িত্বশীল গোলাম রসূল মাসুদ ভাই, সাবেক ওয়ার্ড দায়ীত্বশীল সুমন ভাই, রিমণ ভাই সহ অগণিত ভাই।

কনডেম সেলের আজম ভাই আলমগীর ভাইয়ের সাথে আদালতে যাওয়া আসার পথে প্রায়ই দেখা হতো, মাঝে মাঝে খবর দিয়ে কনডেম সেলের গেটে ডেকে নিতেন। কথা হতো নানা বিষয়ে, তাদের সাংগঠনিক জীবনের স্মৃতিকথা গুলোই আমাকে বেশি আকৃস্ট করতো। কারাগারে গিয়ে কেউ ছোলা মুড়ি খেয়েছেন কিনা জানিনা, তবে আলমগীর ভাই এবং আজম ভাই আমাদের জন্য ছোলামুড়ি পাঠিয়েছিলেন সাথে ছিলো খিড়ার ছালাদ! আল্লাহ জানেন কোথা থেকে তারা এগুলোর ব্যবস্থা করেছিলেন! ঈদের পরে পাঠিয়েছিলেন বিড়ানী।

ডিসেম্বরের ২৭তারিখে শাহীন ভাই দেখা করতে এলেন, জামিনের ব্যাপারে নতুন কোনো তথ্য জানাতে পারলেননা। তবে ক্ষীণ আশ্বাস দিলেন দু’চারদিনের মধ্যেই বের হতে পারবো। শাহীন ভাই জিজ্ঞাসা করলেন শীতের কাপড় লাগবে কিনা, তাহলে বাহির হতে শীতের কাপড় পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। হেসে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই কাহিনী কি খুলে বলেন, দুই/চারদিনের জন্যতো শীতের কাপড় পাঠানোর কথানা, নাকি লংটার্ম রেখে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন! শাহীন ভাই হেসে দিলেন।



পর্ব-৩৩
বাঁচতে হলে খেতে হবে।
পিয়াজ কাচামরিচ দিয়ে বানানো অসহায় টাইপের চানাচুর ভর্তা এবং আলুভর্তাই ছিলো কারাগারের সবচাইতে সুস্বাদু খাবার, এগুলো দিয়ে ভাত খেয়েই তৃপ্তির ঢেকুর তুলতাম। কারাভ্যন্তরে ধারালো জিনিস ঢুকানো নিষেধ, চা চামচ দেয়ালে ঘসে ধারালো ছুড়ি বানিয়ে সেগুলো দিয়েই পিয়াজ মরিচ কাটা হয়। শরিষার তেলে অদ্ভুত কায়দায় আগুন জ্বালিয়ে গরম করা হয় তরকারী, অবশ্য সবই করা হয় প্রশাসনের অগোচরে, ধরা পড়লে কপালে জুটবে মাইর অথবা এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট ঘুষের বিনিময়ে মুক্তি!

কারাগারে সরকারী ভাবে সকাল বেলা রুটি দেয়া হতো, রুটির কানাগুলো ছিলো জুতোর শুকতলার মতো শক্ত! প্রথমে রুটিগুলোকে দুই হাত দিয়ে ঘসে তার গায়ের শুকনো ঝুড় ঝুড়ে আটাগুলো পরিস্কার করা হতো, এরপরে রুটির চারদিকের শক্ত অংশটা গোল করে ছিড়লে সেটা পরিণত হতো খাওয়ার উপযুক্ত রুটিতে। পূর্বের রাতে বেচে যাওয়া গন্ধযুক্ত ভাতগুলোকে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হতো, সকাল বেলা সেগুলোকে দুই হাত দিয়ে কচলিয়ে পাচ/ছয় বার ধুয়ে বন্টন করা হতো আসামীদের মধ্যে।
নিয়ম ছিলো যারা পান্তা ভাত খাবে তারা রুটি পাবেনা, আর যারা রুটি খাবে তারা পান্তা ভাত পাবেনা। ওই পচাগলা ভাতের জন্যই আসামীদের মধ্যে লাইন পড়ে যেতো, সবাই রুটিতে অভ্যস্ত না!

রুটি খাওয়ার জন্য দেয়া হতো চিনি অথবা গুড়, কখনো কখনো আগের রাতে বেচে যাওয়া তরকারীও গরম করে দেয়া হতো। তিনবেলা ভাতে অভ্যস্ত আমি, তারপরেও রুটি খাওয়া ছাড়া উপায় নেই, ওই ভাত গলা দিয়ে নামবেনা!
বাহির হতে পাঠানো মুড়ি-চানাচুর, এবং বিস্কিটে ব্যাগ ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো, খাওয়া হতোনা, যায়গাটা আসলে খাওয়ার উপযুক্ত নয়, অন্তত আমি খেতে পারতামনা। কাকা চিড়ে পাঠিয়েছিলেন, ওটা দিয়েই দু’তিন দিন বদিউর রহমান ভাইয়ের রুমে সংগঠনের ভাইয়েরা পিকনিক করলাম!

ভবনের সিড়ির পাশেই আছে খাবারের দোকান, পিসি কার্ড দিয়েই কিনতে হয়, অবৈধভাবে নগদ টাকায়ও বেচা-কেনা হয়, তবে সেটাও সিস্টেম করে নিতে হয়। সকাল বেলা সিঙ্গারা কখনোবা হালুয়া রুটি, দুপুরে মাছ, আলুভাজি এবং পিয়াজু পাওয়া যায় ভাত খাওয়ার জন্য। পিয়াজু দিয়ে ভাত খাওয়াটা চানাচুর ভর্তার মতোই আরেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা!




পর্ব-৩৪
অপশাসনের বাংলাদেশ এবং পরবাসী মুসলমান

কারাগারে গিয়ে একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম, কুকুরের লেজ সোজা করা প্রচলিত আইনী ব্যবস্থায় অসম্ভব! প্রশাসনের নাকের ডগায় এখানেও আসামীরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মাথা ফাটায়, একে অপরের জিনিসপত্র চুরি করে, কারাগারের ভেতরেই চলে অবাধে মাদক গ্রহণ, ব্যাভিচার! নির্যাতনের শিকার হয় নিরাপরাধ মানুষ।

টাকার বিনিময়ে এদেশে সবই সম্ভব, হেরোয়ীন হতে শুরু করে সব রকমের মাদকদ্রব্য সরবরাহ করে পুলিশ! আমার ওয়ার্ডের এক ছিনতাইকারীর কাছে শুনেছিলাম, থানায় পুলিশের মার সহ্য করতে না পেরে পুলিশের পায়ে ধরে বলছিলো, “স্যার আমাকে ছেড়ে দেন আমি ভালো হয়ে যাবো, জবাবে পুলিশ বলছিলো এই কথা না বলে তুই আমার পেটে একটা লাত্থি মার! তোরা ভাল হয়ে গেলে আমাদের পেট চলবে কিভাবে?” এই হচ্ছে আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের অবস্থা।

আদালত ভবনের ইটেও নাকি ঘুশ খায়, কথাটির উদ্ভব হয়েছিলো সম্ভবত আদালত পাড়ার দূর্ণীতির কথা বুঝাতে গিয়ে। দূর্ভোগে পড়া অসহায় মানুষদের নিয়েও যে প্রতারণার ব্যবসা করা যায় একশ্রেণীর আইনজীবিদের না দেখলে সেকথা বিশ্বাস হতোনা। অসহায় আত্মীয় স্বজন যখন নিরুপায় হয়ে দ্বারে দ্বারে ছোটা ছুটি করে আসামীর মুক্তির জন্য, ঠিক তখনি এরা হাজির হয়, মামলার বিবরণ শুনেই তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে ওঠে “ধুর! এইটা একটা মামলা হইলো! এর চাইতে দুই/চারটা মার্ডার করে আসলে একটা কথা ছিলো, টেনশন কইরেননা জামিন হয়ে যাবে”। আশার আলো দেখে অসহায় গৃহবধু কিংবা অশিক্ষিত গ্রাম্য কৃষক, শেষ সম্বল হালের গড়ু অথবা গহনা বিক্রয় করা টাকা তুলে দেয় উকিলের হাতে, এরপরেই শুরু হয় উকিলের ধানাই পানাই, মুখোশ উন্মচন হয় একজন প্রতারকের।
এ প্রসঙ্গে একটি প্রচলিত কৌতুক মনে পড়ে গেলো শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলামনা, “সদ্য ওকালতি পাশ করা এক নামকরা উকিলের ছেলে জীবনের প্রথম মামলাতেই জিতে গেলো, মহা আনন্দে দুই হাত ভর্তি মিস্টির প্যাকেট নিয়ে বাসায় ফিরতেই বাবা জিজ্ঞাসা করলো, কিসের মিস্টি? বাবার মুখে মিস্টি তুলে দিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে ছেলে জবাব দিলো, বাবা তুমি গত ৬বছর ধরে যে মামলা লড়ছিলে আমি আজকে সেটাতে জিতে আসলাম! বাবার মুখ হতে মিস্টি পড়ে গেলো, তিনি আর্তনাদ করে বললেন এ তুই কি করলি! আমার টাকার মেশিন শেষ করে দিলি!?

পাশের ওয়ার্ডের মোর্শেদ জিজ্ঞাসা করেছিলো, বাহির হতে বই আনা যাবে কিনা। সাথে সাথেই এক কারারক্ষি জিজ্ঞাসা করলো, ইসলামীক বই কিনা? ইসলামীক বই আনা নিষেধ! অন্য বই হলে কথা বলে দেখা যায়।
সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের নাগরিকরা তাদের ঘরে ইসলামিক বই রাখতে পারছেনা, অথচ মার্ক্স-লেনিনের বই রাখতে নিষেধ নেই। আপনি হিন্দু বৌদ্ধ কিংবা খৃস্টানদের বই রাখতে পারবেন কিন্তু ঘরে ইসলামীক বই রাখতে পারবেননা, তাহলে জিহাদী বই রাখার অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে। একটি মুসলিম দেশের অধিবাসী মুসলিমরা নিজেদের ধর্মীয় বই পড়ার অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে, তাহলে কি এদেশের মুসলিমরা নিজগৃহে পরবাসী!

মুরব্বিদের কাছে শুনেছি একাত্তরে দেশ স্বাধীন হবার পরে এদেশে ধুতি পরে কেউ রাস্তায় চলাফেরা করলে তাকে নমস্কারের সহিত সম্মান জানানো হতো, আর দাড়ি টুপি পরিহীত কাউকে দেখা গেলে তাকে করা হতো লাঞ্ছিত-অপমানিত। এমনও শুনেছি ঘাদানিক কমিটির লোকজন নাকি রাস্তার মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়েছিলো, দাড়ি ওয়ালা কাউকে দেখলে প্রথমবার আল্টিমেটাম দেয়া হতো, আর পরেরবার জোড় করে দাড়ি কেটে দিতো। কথাগুলো কেমন জেনো অবিশ্বাস্য লাগতো, বিশ্বাস হতোনা, মনে হতো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হতে বোধ হয় মিথ্যে বলছে। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপট সেকথাগুলোকেই বাস্তব প্রমাণ করে দিচ্ছে।



পর্ব-৩৫
আকাঙ্খিত জামিন, অনাকাঙ্খিত বিচ্ছেদ!

ফজরের নামাজের পরে হালকার উপর ঝাপসা একটু বিছানায় গড়িয়ে নেয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, ৩১ডিসেম্বরও ব্যাতিক্রম ছিলোনা, প্রচন্ড ঠান্ডায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ছিলাম। এরই মধ্যে ৭নম্বর ওয়ার্ড হতে ঘোষকের দ্রুত কন্ঠের জামিন ঘোষণা ভেসে আসলো, “এই জামিন শুনেন! এ মোঃ হানিফ পিতাঃ ননা মিয়া, থানা কোতওয়ালী জামিন.........!”

সবাই জানে হানিফ ভাই আমার কেসপার্টনার, একই মামলার একাধিক আসামীদের কেসপার্টনার বলা হয়। হানিফ ভাইয়ের জামিন হয়েছে মানে আমারও জামিন হয়েছে, কিছুক্ষণ পরেই ঘোশক আমার ওয়ার্ডে আসবে এবং আমার জামিন ঘোষণা করবে, এটা নিশ্চিত। হই হই করে উঠলো এতোদিনের সঙ্গী-সাথীরা, যাদের সাথে কাটিয়েছি প্রায় দু’টি মাস! যে জামিনের জন্য এতোদিনের হাহাকার, যে জামিনের জন্য এত প্রচেস্টা, যে জামিনের জন্য এতো দৌড়ঝাপ, প্রতীক্ষা। আজকে সে জামিন আসছে শুনেই বুকের ভেতরটা কেমন যেনো শূণ্য হয়ে গেলো, চোখের সামনে ভেসে উঠলো হাসান মুরাদের সহজ সরল চোখে থই থই জল কিংবা ইব্রাহীমের করুণ চাহনী। মনযোগী মাহবুবের মনদিয়ে জেল খাটা, ভার্সিটিতে ভর্তি হতে না পারার বিষণ্ণ স্মৃতি! মনে পড়ছিলো ইব্রাহীমের সে জিজ্ঞাসা, শামীম ভাই আপনার জামিন হয়ে গেছে, আপনিতো যে কোনো দিন চলে যাবেন, আমরা এখানে একা কিভাবে থাকবো?

কম্বল মুড়ি দিয়েই আশাপাশের হই চই শুনছিলাম, চোখের সামনে ভাসছিলো বিগত ৫১দিনের স্মৃতি। লুৎফর ভাই এক টানে মুখের উপর হতে কম্বল তুলে নিলেন, ওয়ার্ডের সকল আসামী আমার চারপাশে ভিড় করেছে, খুশিতে ঝলমল করছে সকলের মুখ! বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছিলোনা, বার বার তাকাচ্ছিলাম সংগঠনের ভাইদের মুখের দিকে, তারাও দেখলাম খুশিতে ফেটে পড়েছে, বিদায় যে কতটা আনন্দের হতে পারে, এদের মুখের দিকে না তাকালে সেটা কারও পক্ষে অনুভব করা অসম্ভব!

পাশের ওয়ার্ডের জামিন ঘোষণা শেষ হতেই ঘোষক আমার ওয়ার্ডে চলে আসলো, একের পর এক নাম ঘোষণা করেই যাচ্ছে, এরপরে এলো আমার নাম। নাম ঘোষণা শেষ করে ঘোষক জিজ্ঞাসা করলো ভাই খুশির খবর দিলাম কি দিবেন?
হেসে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি চান বলেন, দেয়ার চেস্টা করবো?
তিনি বললেন আপনি খুশি হয়ে যা দিবেন তাই নিবো!
জেলখানাতেতো এক প্যাকেট সিগারেট দিলেই সবাই খুশি হয়, একপ্যাকেট সিগারেটেই তিনি খুশি হয়ে চলে গেলেন!

জানতাম যেকোনো দিন জামিন হয়ে যাবে, কিন্তু আজকেই যে সেইদিন সেটা জানা ছিলোনা, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবেই অন্যরকম একটি ভোর নিয়ে আবির্ভুত হলো দিনটি। কারাগারে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় যেটা দেখেছি, জামিন ঘোষণার খুশিতে জামিনপ্রাপ্ত ব্যাক্তি যখন সকলের সাথে কোলাকুলিতে ব্যস্ত, ঠিক সেই মূহুর্তেই কতিপয় লোক ব্যস্ত থাকে তার জিনিসপত্র চুরি করার কাজে। জুতা স্যান্ডেল হতে শুরু করে কিছুই বাকি থাকেনা। আমার ব্যাগ আগেই গুছিয়ে রেখেছিলাম এবং সবাইকে এটাও জানিয়ে দিয়েছি, আমি চলে যাওয়ার সময় কিছুই সাথে নিবোনা, ব্যাগের জিনিসপত্র সংগঠনের ভাইয়েরা ব্যবহার করবে।

বিপুল সংখ্যক আসামী পরিণত হয়েছিলো বিপুল সংখ্যক শুভান্যুধায়ী-বন্ধুতে। লুৎফর ভাই, কাদের ভাই, খানে আলম, চেয়ারম্যান জসিম, বিধান দা, তারেক, মোর্শেদ, সালাউদ্দীন, দেলাওয়ার, একে একে সবার কাছ হতেই বিদায় নিলাম, রসু খাঁ দেখলাম ঘুমিয়ে আছে তাই জাগালামনা। বিদায়ের সময় দেলাওয়ারের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম, বিগত দিনগুলোতে সংগঠন সম্পর্কে দেলাওয়ার একটা পজেটিভ ধারনা অর্জন করেছিলো, দেলাওয়ার কমিটমেন্ট দিলো বের হয়ে ছাত্রশিবিরের সাথে সম্পৃক্ত হবে।

সংগঠনের ভাইদের মধ্যে হাসান মুরাদ, ইব্রাহীম, মাহবুব এবং দুইজন জামায়াত সমর্থক ছিলেন সাঈদ ভাই এবং শহীদ ভাই, (তারা অন্য একটি সন্দেহজনক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন)। কর্ণফুলী-৪এ ছিলেন বদিউর রহমান ভাই এবং ইউসুফ ভাই (ইউসুফ ভাই আমার সাথে একই দিন গ্রেপ্তার হলেও ভিন্ন থানার ভিন্ন মামলা হওয়ায় জামিন হতে টাইম বেশি লাগছিলো)। দীর্ঘদিনের কারাজীবনের সঙ্গী এই ভাইদের কারাগারের চারদেয়ালের অভ্যন্তরেই ফেলে যেতে হচ্ছে! বিচ্ছেদের এই অনুভুতি, মনের ভেতরকার তোলপাড়, হৃদয় ভাঙার এই গান ভাষায় ব্যাক্ত করা অসম্ভব।

সদ্য জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তির বিদায় বেলায় অধিকাংশ আসামী তাকে একটা জিনিসই দিতে চায় সেটা হচ্ছে ফোন নম্বর! প্রিয়জনের কাছে সংক্ষেপে একটি তথ্য জানিয়ে দেয়ার অনুরোধ! এই অনুরোধের মূল্য এবং মর্জাদা মুক্ত স্বাধীন ব্যক্তি কখনো উপলব্ধি করতে পারবে বলে মনে হয়না। পঞ্চাশটিরও বেশি ফোন নম্বর এবং প্রতিটি নম্বরের নিচে সংক্ষেপে একটু লেখা, কেউ লিখেছে আমি ভালো আছি, চিন্তা করবেনা, আবার কেউ প্রিয়জনকে দেখা করার অনুরোধ করেছে, কেউবা অনুরোধ করেছে মামলার সর্বশেষ অবস্থার তথ্য নিয়ে যেনো তার সাথে দেখা করা হয়। চেয়ারম্যান জসিম ভাই অনুরোধ করলেন, ওয়ার্ডের মুসল্লিদের জন্য কিছু টুপি এবং তসবী কিনে পাঠানোর জন্য।

ঝাড়া হাতপায়েই ওয়ার্ড হতে বেরিয়ে এলাম, ভবনের সামনের হাউজে তখনো একদল আসামী ঠেলাঠেলি করে গোসল করছে, প্লেটে প্লেটে ঠোকাঠুকির শব্দ হচ্ছে, হলুদ থক থকে আয়রণ যুক্ত সে পানির কথা ভোলার নয়। আজকে আর গোসল করলামনা, এখান হতে বেরিয়ে গোসল করবো ইনশাআল্লাহ্‌!

সংগঠনের ভাইয়েরা কর্ণফুলী ওয়ার্ডের সামনের মূল গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। কনডেম সেলের সামনে দিয়ে আসার সময় বার বার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম যদি আলমগীর ভাই-কিংবা আজম ভাইকে একটু বিদায় জানাতে পারতাম! যদি বিদায় বেলায় একনজর তাদের সাক্ষাৎ পেতাম! কিন্তু সব ইচ্ছেতো আর পূরণ হয়না! বদি ভাইকে বলে এসেছিলাম, তাদের কাছে সালাম পৌছে দিতে। কনডেম সেলের খাবার সরবরাহের দায়ীত্বে নিয়োজিত কয়েদী সুমনের সাথেও দেখা হয়ে গেলো, তাকে বলে দিলাম আমার জামিনের সংবাদটা ভেতরে পৌছে দিতে।


পর্ব-৩৬

প্রশাসনিক ভবন হতে শুরু করে পুরো কারাগারটাই মূলত পাহাড়ের উপরে অবস্থিত, কিন্তু কর্ণফুলি ভবন এবং তার পেছনের সমান্তরালে ৩টি ভবনের অবস্থান পাহাড়ের গভীরতায়। মূল কারাগারের কাঠামো দেখলে মনে হয় কর্ণফুলি ভবন কারাগারের এক্সটেনশন, অর্থাৎ যখন কারাগার তৈরী করা হয়েছিলো তখন এই ভবনের যায়গাটি কারাগারের অন্তর্ভুক্ত ছিলোনা। কারাগারের মূল বাউন্ডারীর একটি অংশ কেটে কর্ণফুলী ভবন সহ নতুন বাউন্ডারী তৈরী করা হয়েছে। কারাগারের মূল অংশ হতে কর্ণফুলী ভবনে যেতে ছোট খাটো একটি ব্রিজ পার হতে হয়। কর্ণফুলি ভবন হতে বেরিয়ে ব্রিজে উঠতে গেলেই হাতের বামপাশে কনডেম সেল।

আমাকে যেতে হবে কেস টেবিলে, জামিন প্রাপ্ত সকল আসামীকে কেস টেবিলে জড়ো করা হয়। সেখান হতে সকল প্রকার পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পন্ন করে, কিছু অফিসিয়াল ধাপ অতিক্রম করে দেয়া হয় মুক্তি।
ব্রিজ পার হয়ে কেসটেবিলে যাওয়ার পথেই হাতের ডানে পদ্মা ভবন। পদ্মা ভবনের নিচের তলায় পঙ্গু ওয়ার্ডে থাকেন মুন্না ভাই, এর পূর্বে মুন্নাভাইকে একটি ওয়ার্ডের ইনচার্জ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু পঙ্গুওয়ার্ডের আসামীদের কাছে মুন্নাভাই এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন যে, তারা সকলে মুন্না ভাইয়ের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। অবশেষে ভালবাসার কাছে পরাজিত হন মুন্না ভাই, সেখানেই থেকে যান।

বিদায় নেয়ার জন্য হাজির হলাম মুন্না ভাইয়ের ওয়ার্ডে, মুন্নাভাই তখন ঘুমাচ্ছিলেন। বিছানার পাশেই পড়ে আছে ক্রাচ, ক্রাচে ভর দিয়েই তিনি একপায়ে চলাফেরা করেন। ঘুম হতে জাগানো ঠিক হবে কিনা ভাবছিলাম, পাশ হতে একজন বললেন, ঘুমায়নাই এমনিই শুয়ে আছে, আপনি ডাক দেন ডাক দিলে উঠে যাবে। আস্তে করে ডাক দিতেই কম্বলের নিচ হতে মুন্নাভাইয়ের মাথা বেড়িয়ে এলো, বিদায় নিলাম। ইসলামী আন্দোলনের কারাবন্দী ভাইদের সহায়তার জন্য নিবেদিত এই ভাইটিকে আল্লাহ হেফাজত করুন। বিপদে আপদে যখন যে ভাইটি ডেকেছে, হাজির হয়ে গেছেন মুন্নাভাই! ক্রাচে ভর করেই হাজির হয়েছেন তিনতলায়-চারতলায়, দাড়িয়েছেন সমস্যাগ্রস্থ ভাইটির পাশে।

কেস টেবিলে তখন হাজির হয়েছে বিপুল সংখ্যক আসামী, শুধুমাত্র শিবির কর্মীই এসেছে ২৭জনের মতো। এরপরে আছে বউয়ের মামলার আসামী, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, জখম, ধর্ষণ সহ নানারকম মামলার আসামী সবাই জামিনপ্রাপ্ত। প্রতিদিন এতো সংখ্যক আসামীর জামিন হয় অথচ কারাগার খালি হয়না, বরং তার চাইতেও বেশি সংখ্যক আসামীতে ভরে যায় কারাগারের ওয়ার্ড সমূহ, পাশাপাশি পুলিশ,আইনজীবি এবং জেলারদের পকেটও ভরে!

জামিন কর্মকর্তা আসতে তখনো অনেক দেরী, তালিকা দেখে দেখে আসামীদের সংখ্যা মিলানো হলো কয়েকবার, যারা বাকি ছিলো তাদেরকেও আনা হলো। শারিরীক শনাক্তকারী চিহ্ন, পিতা-মাতার নাম, থানা, জেলা মিলিয়ে তারপরে নিশ্চিত করা হলো আসামী আসল নাকি একই নামের অন্য কেউ বেরিয়ে যাচ্ছে। এরপূর্বে নাকি নাম-পিতার নাম মিলে যাওয়ায় এক মামলার আসামীর স্থলে অন্য মামলার আসামী বেরিয়ে যাচ্ছিলো, ফাইনাল চেকিংয়ে গিয়ে ধরা পড়ে আসামী ভূয়া, তাই আজকে একটু বাড়তি সতর্কতা।

শিবিরের ২৭জনের মধ্যে পলিটেকনিক শাখার শিবির কর্মীরাও ছিলো, আরো ছিলো আমাদের সাথে গ্রেপ্তার হওয়া ইউসুফ ভাই বাদে বাকি ১২জন এবং আরো কিছু শিবির কর্মী যাদের নামে অন্য থানার আরো কয়েকটি মামলা আছে। মুক্তির আনন্দে ঝলমল করছিলো সবার চেহারা, তারপরেও কিঞ্চিত চিন্তিত সবাই, সত্যিই কি জামিন হবে? নাকি জেলগেট থেকে আবার গ্রেপ্তার! শিবিরের জন্যতো সবই সম্ভব! প্রশাসন চাইলেই যা খুশি করতে পারে, খুন না হলেও বানিয়ে দেয়া যায় হত্যা মামলার আসামী।

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সংশ্লিষ্ট কারাকর্মকর্তা হাজির হলেন, অন্যান্য আসামীদের হতে শিবিরের ছেলেদের আলাদা করা হলো। নাম ঠিকানা যাচাই করে তাদের সকলকে পাঠিয়ে দেয়া হলো জামিনের মূল অফিসে, আমাদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়েই তিনি চলে গেলেন। সত্যিই এটা সাহারা-মখাদের দেশ, এটা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, এদেশে যা খুশি তাই সম্ভব! চোর,ডাকাত,খুনি,বদমাস সবাই মুক্তি পায়, আর কোরআনের সৈনিকদের বন্দী রাখা হয় কারাগারের চারদেয়ালে, জামিন হলেও নিস্তার নেই।

পর্ব-৩৭

কারাকতৃপক্ষ হতে সকালের নাস্তা হিসেবে রুটি পাঠানো হলো, রুটির যায়গায় রুটি পড়ে রইলো কেউ হাতও দিলোনা। সংগঠনের কয়েদীরা কিছু বিস্কিট এনে দিলো, সেগুলো দিয়েই সকালের নাস্তা সেড়ে নিলাম। একজন ঘোশকের সাথে ভালো খাতির হয়ে গিয়েছিলো, তার কাছে জিজ্ঞাসা করলাম ব্যাপার কি আমাদের বের হতে দিচ্ছেনা কেনো? তিনি জানালেন শিবিরের মামলার ব্যাপারে সরকারের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া আছে, মুক্তির আগে সবগুলো থানায় ফোন করা হবে, এবং প্রয়োজনে নতুন মামলাতে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পুণরায় কারাগারে পাঠিয়ে দিবে।

কেস টেবিল হচ্ছে ছোট খাটো একটা ভবনের নাম, এখানেই আসামিদের প্রাথমিক সালিশ বিচার হতে শুরু করে নানা রকম অফিসিয়াল কাজ করা হয়। কেসটেবিলের উত্তর পাশে কারাগার হাসপাতাল, দক্ষিণ দিকে ডিভিশন ভবন। পূর্ব দিকে আমদানী ওয়ার্ড এবং পশ্চিম পাশে দর্শনার্থী ভবন। আগেরদিন শুনেছিলাম চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রাবাসে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু ছাত্রকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের সবাই এখন আমদানী ওয়ার্ডে আছে, বিকালেই তাদেরকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠানো হবে।

সেই সকাল সাতটা সাড়ে সাতটার দিকে এসেছি, এখন বাজে প্রায় ১০টা। অপেক্ষা আর ভালো লাগছিলোনা, আমার ওয়ার্ডের ইনচার্জ কফিলকে দেখলাম এদিকেই আসছে, সবাইকে বসিয়ে রেখে তাকে নিয়ে চলে গেলাম আমদানীতে। সদ্য গ্রেপ্তার হওয়া শিবিরের ভাইরা দেখলাম বেশ উৎসাহের সাথে জেল খাটছে, আমদানীতে চলছে তুমুল আড্ডা। জেল খানায় এসেছে নাকি পিকনিক স্পটে এসেছে তাদের মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই! সবার সাথে পরিচিত হলাম, আমাদের জামিন হয়েছে শুনে খুব উল্লাস প্রকাশ করলো তারা।

আমদানীতে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে কেস টেবিলে ফিরে এলাম। এদিকে প্রশাসন সম্ভবত আমাদের ব্যাপারটা ভুলেই গেছে এমন একটা ভাব! কারও কোনো খবর নেই, কেউ কিছু বলতে পারছেনা, আমাদের মুক্তি দেয়া হবে নাকি আবার ওয়ার্ডে ফিরে যেতে হবে কিছুইনা। বাহির হতে খবর আসলো, চট্টগ্রাম মহানগরী উত্তর এবং দক্ষিণের দায়িত্বশীলরা আমাদের রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করছেন।

জোহরের নামাজের টাইম হয়ে আসছে, কেউ কেউ বলছে দুপুরের খাবার এখানেই খেতে হতে পারে। এরই মধ্যে সংগঠনের কয়েদীরা বেশ কয়েকবার বিস্কিট এবং পানি পাঠিয়েছেন। এক কয়েদীকে প্রশ্ন করলাম কি সমস্যা ভাই, আর কতক্ষণ?
তিনি জবাব দিলেন সর্বোত্তম স্যার এখনো অনুমতি দেয়নাই, সর্বোত্তম স্যার অনুমতি দিলে তারপরেই আপনাদের মূল অফিসে পাঠানো হবে।
সর্বোত্তম স্যার কে, জেলার পোস্টের সিনিয়র কেউ?
‘না না, তিনি ডেপুটি জেলার’।
‘কি বলছেন! পদের দিক হতে জেলারের জুনিয়র অথচ তার উপাধী হচ্ছে সর্বোত্তম?’
তিনি হেসে জবাব দিলেন, সর্বোত্তম তার পোস্টের নাম নয়, ওই লোকের নামই হচ্ছে সর্বোত্তম, পুরো নাম হচ্ছে সর্বোত্তম চাকমা!
খাইছে! আমি ভাবছিলাম ওই ব্যাটা মনে হয় জেলের সব অফিসারের সিনিয়র অফিসার, সর্বোত্তম!!!

দুপর একটার দিকে আমাদের ডাক পড়লো, লাইন করে নিয়ে যাওয়া হলো কারাগার অফিসে। বিশাল বিশাল সব ফাইলে ভর্তি টেবিল এবং আলমারী, মান্ধাত্বার আমলের অফিসিয়াল সিস্টেম, একটি মাত্র কম্পিউটারে মহিলা অপারেটর কি যেনো লিখছিলো। টেবিলের ওপাশেই বসে আছেন গোলগাল চেহারার এক উপজাতী ভদ্রলোক, বুকের নেমপ্লেটে লেখা সর্বোত্তম চাকমা! কিছুটা নাকি স্বরেই তিনি বলে উঠলেন, আপনারা সবাই শিবির করেন? উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি বলে চললেন, আপনাদের জামিন হয়েছে আটকে রাখবোনা, তবে মনে রাখবেন আপনাদের ছবি আমাদের কাছে আছে, তাছাড়া আপনারা গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় একজন ফটোগ্রাফার অপেক্ষা করবেন, তিনি আপনাদের একটি ছবি তুলবেন। এরপরেও যদি আপনারা মিটিং মিছিল করেন তবে আমরা ছবি দেখেই আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবো। তার বক্তব্য শেষ হলো।
কারাগারে আনার পরে আমাদের ছবি তোলা হয়েছিলো, ফাইল দেখে দেখে আমাদের ছবি এবং সনাক্তকারী চিহ্ন ইত্যাদি মিলিয়ে অফিসিয়াল কার্যক্রম সম্পন্ন করা হলো। পিসি কার্ড জমা দিয়ে বাকি থাকা টাকাও তুলে নিলাম।

আবার সেই বিশাল গেইট, গেটের ওপাশেই মুক্ত জগত! উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা সকলের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছিলাম, জেল গেইটে পুলিশ অপেক্ষা করে আছে কিনা কে জানে! ছোট একটা দরজা খুলে দেয়া হলো, সেটা দিয়েই লাইন করে বেরিয়ে এলাম সকলে, আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছিলো মুক্ত পৃথিবী, মুক্ত আকাশ এবং সংগঠনের দায়িত্বশীলরা। মামুন ভাই এবং শাহীন ভাই এসেছিলেন মটর সাইকেল নিয়ে, সেটাতেই উঠে বসলাম।

বিদায় কারাগার! তবে চিরবিদায় দিতে পারছিনা, ইসলামী আন্দোলন যেহেতু করছি আবার দেখা হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়।

2 comments:

Unknown বলেছেন...

ভাই এই গল্প পড়া খুবই কঠিন। কারন অশ্রু সংবরন করা যায় না। চোখ ঝাপসা হয়ে যায়।
তবে যেটা উপলদ্ধি হল ইসলামী আন্দোলনকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবেনা।
অনেক হতাশার মাঝে কারাগারের দিনগুলি উষার পুর্বাভাস।

Unknown বলেছেন...

কান্না এসে যায় কষ্টে আর ঈর্ষাও হয়, নবীদের একটা সুন্নত আপনারা পালন করলেন আমি এখনো পারিনি। প্রবাসের মাটি থেকে দোয়া করি আল্লাহ আপনাদের ভাল রাখুক।আমিন।

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম