শফীউদ্দীন সরদার
নীরব সাধনায় নিরলস কর্মী; প্রেক্ষিত: ঐতিহাসিক উপন্যাস
আধুনকি বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের ধারাটি অনেকটা সৌখিন কাজের মত। কোন একজন ঔপন্যাসিক তার জনপ্রিয়তার চুড়ান্ত পর্যায়ে এসে দু’একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন। আর এইসব উপন্যাস অনেকটা বিষয়বস্তুর চেয়ে লেখকের কারণেই জনপ্রিয় হতে দেখা যায়! ব্যাতিক্রম যে নেই তা নয়।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমনটাই দেখা যায়। ফলে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের অপ্রতুলতা দৃষ্টিগ্রাহ্য। অথচ ইতিহাসকে তরুণ প্রজন্মের কাছে সুখপাঠ্য করে উপস্থাপনের জন্য ঐতিহাসিক উপন্যাসের বিকল্প নেই বললেই চলে। কেউ হয়তো চলচ্চিত্রের কথা বলবেন; এক্ষেত্রে চলচ্চিত্র একটি সীমাবদ্ধ মাধ্যম। দুই/তিন ঘন্টার একটা চলচ্চিত্রে একটি ঘটনাই যথার্থভাবে আনা কঠিন। সেখানে ইতিহাসের দীর্ঘ ঘটনা-পরম্পরা উঠিয়ে আনা অনেকটাই কঠিন, দু:সাহসিক ও ব্যয়বহুল কাজ। তাই ইতিহাসের পাঠকের কাছে উপন্যাসের মাধ্যমে অতীতকে উপস্থাপন করা সহজ, কার্যকর ও গ্রহনযোগ্য। এমন একটি সম্ভাবনাময় সাহিত্য শাখায় বাংলাদেশে নিরলসভাবে কাজ করেছেন এমন উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের মধ্যে উজ্জ্বলতম একটি নাম শফিউদ্দীন সরদার।
বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাস নিয়ে কাজ করেছেন যারা। কেউই একমাত্র একটি শাখা নিয়ে একাধারে লিখেছেন এনটা দেখ যায় না। আবার যারা লিখেছেন তারা কোন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বা নির্দিষ্ট একটা সময়কে কেন্দ্র করে লিখে গেছেন। এমন উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য কয়েকটি হল মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ হুমায়ূন আহমেদের ‘মাতাল হাওয়া’ , ‘বাদশাহ নামদার’ ও এখনো প্রকাশের অপোয় ‘দেয়াল’ কিংবা ছোটদের জন্য ‘সূর্যের দিন’। আনিসুল হকের ‘মা’ ও সদ্য প্রকাশিত ‘যারা ভোর এনেছিল’। হরিপদ দত্তের ‘মোহাজের’। এমন আরো আরো। [এই নিবন্ধের মূল টার্গেট এটা নয়। বিধায় আর কোন নাম দেয়া হলনা] এছাড়াও আমাদের আজন্ম অহংকার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলো অন্যতম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে ঐতিহাসিক উপন্যাসের মূল ফোকাসটির কেন্দ্র হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা। ফলে আমরা গোর্কির ‘মাদার’ ও তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’- এর মত উপন্যাস পাইনি আমাদের বাংলা সাহিত্যে।
এই যখন আমাদের হাল তখন এমন একজন আসলেন আমাদের ইহিতাসের উপাখ্যান শুনাতে যিনি একাধারে লিখে গেলেন বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমনের পর থেকে স্বাধীনতা উত্তর সময়ের গল্প। একেবারেই ভিন্ন এক স্টাইলে। ভিন্ন এক আদর্শিক চেতনায় উজ্জ্বীবিত হয়ে। সে প্রসঙ্গে আসছি আরো পরে। আজকের আলোচনার কেন্দ্র আমাদের সেই নীরব সাধনায় নিরলস কর্মবীর সফীউদ্দীন সরদার।
সফীউদ্দীন সরদারের জন্ম ১৯৩৫ সালে নাটোর জেলার হাবিলা নামক গ্রামে। বর্তমান বাসাও নাটোর শহরের শুকুলপট্টিতে। তিনি একাধারে শিক, গবেষক, অবসর প্রাপ্ত ম্যাজিষ্ট্রেট। সর্বোপরি তিনি এখন আমাদের কাছে একজন সফল ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিক। ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এই লেখক পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন নব্বই দশকের শেষের দিকে। দৈনিক ইনকিলাবে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘বখতিয়ারের তলোয়ার’ নামক উপন্যাসের মাধ্যমে। যেটি বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে মদীনা পাবলিকেশন্স হতে। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই পাঠক, সমালোচক ও সুধীজনের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। বইয়ের বর্ণনার ভাষাশৈলী, ঘটনার ধারাবাহিকতা, সংঘটিত সময়ের জীবন-যাত্রার যথার্থ উপস্থাপন, পাত্র-পাত্রীর সংলাপে পরিমিতবোধ ইতিহাসের যথার্থ উপাদান প্রভৃতি মিলিয়ে পাঠকের বিশ্বাস হয় এজন প্রতিশ্র“তিশীল লেখকের আগমনের। আর লেখকও পাঠকের বিশ্বাসের প্রতি আস্থা রেখে উপহার দিতে থাকেন একের পর এক সুখপাঠ্য ঐতিহাসিক উপন্যাসের। এরপর এই একই পত্রিকায় লেখকের আরো দুইটি উপন্যাস ধরাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। যথারীতি আগেরটির মতই জনপ্রিয়তা পায়। উপন্যাস দুটি হল, বার পাইকার দূর্গ ও যায় বেলা অবেলায়। এছাড়াও লেখকের ‘সূর্যাস্ত’ উপন্যাসটিও অধুনা লুপ্তপ্রায় সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানে প্রকাশিত হওয়ায় দেশের মাদ্রাসা শিতি পাঠকের কাছে দ্রুতই তার পরিচিতি বাড়তে থাকে। এরই ফলে এই পত্রিকার প্রতিটি ঈদ সংখ্যায় লেখকের উপন্যাস কমন আইটেম হয়ে যায়। অনেকগুলো উপন্যাস আমরা এই সাপ্তাহিকটির কল্যাণে পাঠ করতে পারি।
লেখকের কলম থেকে আজ পর্যন্ত আমরা পেয়েছি প্রায় অর্ধশত বই। এর মধ্যে ছাব্বিশটিই ঐতিহাসিক উপন্যাস। এই ছাব্বিশটি উপন্যাসের ইতিহাসের বিস্তৃতি হল ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির আগমন পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর সময় পর্যন্ত। আর এই একটি জায়গায় লেখকের অনন্যতা। কারণ বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস শাখায় আর আগে কারও নামের পাশে এতগুলো ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার কৃতিত্ব নেই। নেই প্রায় আট’শ বছর বিস্তৃত সময়কে কেন্দ্র করে এত দীর্ঘ কোন সিরিজ লেখার কষ্টসাধ্য সাধনার কৃতিত্বও। আর এই বিশাল কর্মটি করতে লেখকের সাহিত্য সাধনার সময়টাও একটা বড় বিষ্ময়। মাত্র বিশ বছর সাহিত্য সাধনায় তিনি এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি সম্পাদন করেন। কতটুকো ডেডিকেটেড থাকলে এ বিশাল সাহিত্য সম্ভার নির্মাণ করা সম্ভব এটা একজন সাহিত্যকর্মী মাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন।
সফীউদ্দীন সরদারের ছাব্বিশটি উপন্যাসের বিষয় আর সময়কাল নিয়ে আলোচনা করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠবে। লেখক ঐতিহাসিক উপন্যাসের এই দীর্ঘ সিরিজটি শুরু করেছেন ‘বখতিয়ারের তলোয়ার’ নামক উপন্যাসের মাধ্যমে যা আগেই বলা হয়েছে। আর এটি শেষ করেছনে দখল নামক বইটির মাধ্যমে। প্রকাশনার আগ-পিছ হলেও ইতিহাসের পরম্পরায় এটিই এই সিরিজের শেষ উপন্যাস এখন পর্যন্ত। এটা লেখকেরও ভাষ্যও।
লেখকের ঐতিহাসিক উপন্যাসের নাম ও বিষয় নিম্নরূপঃ
০১. বখতিয়রের তলোয়ার: ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গবিজয়।
০২. গৌড় থেকে সোনার গাঁ: বাংলায় স্বধীন সালতানাতের প্রতিষ্ঠা।
০৩. যায় বেলা অবেলায়: গিয়াস উদ্দীন আযম শাহ্র রাজত্বকাল।
০৪. বিদ্রোহী জাতক: রাজা গণেশের রাজত্বকাল।
০৫. বার পাইকার দূর্গ: সুলতান বারবাক শাহ্ ও দরবেশ ইসমাঈল গাজীর সময়কাল।
০৬. রাজ বিহঙ্গ: সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ এর রাজত্বকাল।
০৭. শেষ প্রহরী: দাউদ খান কররানী ও কালাপাহাড় এর সময়কাল। ( এই বইটি কলকাতা থেকেও প্রকাশিত।)
০৮. প্রেম ও পূর্ণিমা: সুবাদার শায়েস্তা খানের সময়কাল।
০৯. বিপন্ন প্রহর: নবাব মুশিদ কুলি খান ও সরফরাজ খান এর রাজত্বকাল।
১০. সূর্যাস্ত: পলাশীতে স্বাধীন বাংলার স্বাধীনতার সূর্যাস্ত।
১১. পথ হারা পাখি: ফকির মজনু শাহ্ ।
১২. বৈরী বসতি: সৈয়দ আহমদ বেরেলভী, তিতুমীর প্রমুখ।
১৩. বখতিয়ারের তিন ইয়ার: বখতিয়ার খিলজীর সাথে আসা তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর জীবন।
১৪. দাবানল: সিপাহী বিদ্রোহের শুরু ও শেষ।
১৫. রোহিনী নদীর তীরে: সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদে আকবরের বাধা দান বিষয়ক।
১৬. ঈমানদার: দাণিাত্যের একজন প্রভাবশালী মুসলমান।
১৭. ঠিকানা: ১৯৪৭ এর দেশবিভাগ।
১৮. ঝড়মুখী ঘর: দেশ বিভাগ পরবর্তী সময় থেকে ভাষা আন্দোলন ও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
১৯. অবৈধ অরণ্য: স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর সময়।
২০. দখল: ১৯৭১ পরবর্তী সময় থেকে আশির দশক শুরু পর্যন্ত।
২১. দীপান্তরের বৃত্তান্ত: আন্দামানের বন্দীদের নিয়ে।
২২. অন্তরে প্রান্তরে:
২৩. রাজনন্দিনী: সামাজিক ঐতিহাসিক।
২৪. রুপনগরের বন্দী:
২৫. লা ওয়ারিশ: লেখকের আত্মজৈবনিক।
২৬. বার ভূঁইয়ার উপাখ্যান: বাংলার বার ভূঁইয়া।
লেখকের এই উপন্যাসগুলোর বেশ কিছু বৈশিষ্ট আছে। যা লেখককে আর দশজন ঔপন্যাসিকের থেকে আলাদা করেছে। অথবা বলা যায় আর দশজন লেখকের থেকে একটু আলাদা বা সযত্ন দৃষ্টিপাতের দাবী রাখে। লেখক তার উপন্যসের চরিত্র নির্বাচনে সূক্ষ্ম মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। অন্য অনেকের উপন্যাসে কোনটা ইতিহাসের চরিত্র আর কোনটা লেখকের কল্পিত চরিত্র এটা বুঝতে পাঠকের প্রায়সই সমস্যা হয়। ফলে ইতিহাসের বিকৃতিটা হয় অনায়াসেই। ঠিক একারণেই রবীন্দ্রনাথ ঐতিহাসিক উপন্যাসে ইতিহাস বিকৃতির আশংকা করেছেন। কিন্তু শফীউদ্দীন সরদারের উপন্যাসে একজন পাঠক সহজেই অনুধাবন করতে পারেন কোনটা ইতিহাসের চরিত্র বা ঘটনা আর কোনটা লেখকের কল্পিত চরিত্রের ঘটনা। তখন একজন পাঠক যুগপৎ ইতিহাস পাঠের আনন্দ ও উপন্যাস পাঠের আনন্দও উপভোগ করতে পারেন। পাঠকের বাড়তি পাওনা হিসেবে লেখকের উপন্যাসে থাকে সময়ের ছাপ। লেখক তার উপন্যসের চিত্রায়নে যে সময়টা বা ইতিহাসের যে অংশটুকো নির্বাচন করেন সেখানে তিনি সচেতনভবে সেই সময়ের মানুষের জীবনযাত্রা, ভাষা, মানসিকতা, সংস্কৃতি, পারসোনালিটি, রাষ্ট্রনীতি, রাজ্যপ্রধানদের খেয়ালিপনা ও দুর্বল-সবল দিক, পারিপার্শিকতা, স্থানের বর্ণনা ইত্যাদি বিষয় এমনভাবে উপস্থাপনা করেন যে একজন পাঠক বইটি পাঠর সময় সেই সময় সেই সময়ের ভাষা-সংস্কৃতিকে এমনভাবে উপলব্ধি করেন মনে হয় পাঠক ঠিক সেই সময়েই ভ্রমণ করছেন। পাঠক একটা ঘোর তন্ময়তার মধ্য দিয়ে তার পাঠ ও অতীতে মনোঃভ্রমণ সমাপ্ত করে ফিরে আসেন বর্তমানে। আর ঠিক এই জায়গায় একধরণের পাঠকের শুরুতে একটু সমস্যা হতে থাকে। যেহেতু লেখকের লেখার বিস্তৃতি মুসলিম শাসনকাল। সবাই জানেন মুসলিম শাসনামলে এদেশের মানুষের ভাষায় ফারসি ভাষার প্রভাব ছিল বেশি। অপরদিকে সেই সময়ে বাংলার শাসকদের অধিকাংশ ছিল বহিরাগত। তাদের ভাষা হতো হয় ফরসি না হয় পশতু, উর্দু, হিন্দি আর কর্মকর্তাদের ভাষাও হতো নানা রকন কারও উড়িয়া কারও অসমিয়া বা দাণিাত্যের কোন ভাষা। ফলে লেখকের চরিত্রের সংলাপে সেইসব চরিত্রের নিজস্ব ভাষা থাকায় কেউ কেউ পাঠের শুরুতে একটু মনোযোগহীনতায় ভোগেন। যা আমার বেলায়ও হয়েছিল। কিন্তু একবার পাঠ শুরু করে দিয়ে কয়েকটি পৃষ্ঠা শেষ করে ফেললে পাঠক এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন যা পাঠককে চুম্বকের মত আটকে রাখে উপন্যাসটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
সফীউদ্দীন সরদারের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলোর তুলনামূলক আলোচনায়ও আমারা তাকে উজ্জ্বলতম আসনেই পাই। [প্রিয় পাঠক! আমার ভয়াবহ সীমবদ্ধ পাঠ অভিজ্ঞতায় করা তুলনা মূলক আলোচনাটা মাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল] যে কজন ঔপন্যাসিকের ঐতিহাসিক উপন্যাস পাঠের সুযোগ হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম উপমহাদেশের নসীম হিযাযী , এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার প্রমুখ। মিশরের নজীব কিলানী। আরবের আলী তানতাবী। আর অন্য দিকে গোর্কি, তলস্তয় প্রমুখ। এদের মধ্যে সমরেশ উপন্যাসের ইতিহাস অনেকটাই বাম আন্দোলন কেন্দ্রিক যেমন গর্ভধারিনী। সুনীলের ইতিহাস ততটা বিস্তৃত নয় সরদারের তুলনায়। আলতামাসের ‘দাস্তানে ঈমান ফারোশুকী’ বিখ্যাত ও জনপ্রিয়। তবে মিশরের সুলতান সালহুদ্দীন আয়ুবীর সময়কালটা এমনভাবে তিনি এনেছেন যেখানে উপন্যাসের প্রয়োজনে ইতিহাসটা গৌণ হয়ে পরেছে। অপরদিকে নসীম হিযাযীর উপন্যাসে ইসলামের সোনালী যুগের সূচনাপর্ব ও পতনপর্ব নিয়ে বিস্তৃত হয়ে ভারত বিভাগে এসে থেমেছে। হিযাযীর উপন্যাসেও পাত্র-পাত্রী কে এতটা ফলাও করা হয়েছে যে ত্রেবিশেষ ইতিহাস গৌণ। তবে সরদার ও হিযাযীকে আমরা একই ঘরারানার উপন্যাসিক বলতে পারি। দুজনের পার্থক্য হিযাযী কল্পিত চরিত্রকে শক্তিশালী করেছেন আর বর্ণনাকে বেশি কাব্যিক ও আবেগময় করেছেন। সরদার কল্পিত পাত্রপাত্রীকে অনুজ্জ্বল রাখার চেষ্টা করে ইতিহাসের বর্ণনাকে প্রাধান্য দিয়ে ভাষাকে গদ্যরসে রসালু করার চেষ্টা করেছেন। আবেগকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয়। যেখানে হিযাযী তা পারেননি। তারপরও কালই এর সঠিক বিচার করবে।
দুজনের মূল প্রচেষ্টা পাঠকের সামনে ইতিহাসের সরস উপস্থাপনাটাই মোটাদাগে চোখে পরে। আবার গোর্কি ও তলস্তয়ের উপন্যাসের বিষয়টা হলো একটা নির্দিষ্ট আন্দোলন আর ঘটনার উপল্য। সে ক্ষেত্রে সরদারকে যে কোন পাঠকই বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক উপন্যাসের ধারায় একজন সফল ও উল্লেখযোগ্য লেখকের মর্যাদা দিবেন অনায়াসেই। আর তাঁর অবদান ও ত্রে বিবেচনায় তাকে সেরা আসনটি আজ না হোক সামনের কোন একসময় নিরপে বিবেচনায় দিতেই হবে।
আরেকটা বিষয়ও এখানে উল্লেযোগ্য। সরদার কিন্তু কখনই নিউজ কভারেজটা বা প্রচারের আলোটা নিজের দিকে নিতে পারেননি। পঞ্চাশটিরও বেশি বই প্রকাশের পরও পাঠকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনায় অভিজাত প্রকাশক বলে আমরা পাঠকরা যাদের মনে করি সেই প্রকাশকদের কেউই সরদারের বই প্রকাশ করেননি। এখানে অভিজাত বলায় বিতর্ক হতে পারে। তবে আমরা সাধারণ পাঠক যাদেরকে ২১শে বই মেলায় সরব উপস্থিত দেখি ও যারা দেশের সেরা ও জনপ্রিয় লেখকদের বই প্রকাশ করে নিয়মিত। প্রকাশ করে নানা বৈচিত্রময় বিষয়ের বই আর আছে প্রকাশনার জগতে ঐতিহ্য। তাদেরকেই অভিজাত মনে করি। আমাদের আলোচিত লেখকের কোন বই এমন প্রকাশক আজও প্রকাশ করেনি এটা বুঝা যাবে লেখকের প্রকাশক তালিকা দেখলেই। [আমি সরদারের সব প্রকাশকের কাছে দুঃখিত] এতে করে লেখকের জনপ্রিয়তাটা একটা শ্রেণিতে আটকে আছে। এর বাইরের বিদগ্ধ পাঠকের কাছে তিনি পৌঁছতে পারেননি এর কারণের মধ্যে আমি মনে করি কয়েকটি এমন- প্রথমত: লেখকের প্রকাশকরা তার বইয়ের প্রচারে তেমন ইভেস্ট করেনি। দ্বিতীয়ত: লেখক ঢাকায় না থাকার কারণে মিডিয়া ও সমালোচকদের সাথে সেভাবে যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। তৃতীয়ত: নাটোরের শুকুল পট্টি থেকে একজন লেখক জনপ্রিয়তায় ঢাকার লেখকদের ছাড়িয়ে যাবে এমন কোন একটা বিষয়( নাও হতে পারে)। চতুর্থত: লেখকের চারপাশের আত্মীয়, শুভাকাঙ্খী ও দায়িত্বশীল লোকদের ব্যর্থতা। কারণ একজন লেখকের প্রচারের আলোয় আসতে মৌলিক যোগ্যতা ছাড়াও যে শারিরিক ও মানসিক পরিশ্রমের দরকার তা অবসরপ্রাপ্ত সরদারের ছিলনা।পঞ্চমত: হয়তো যথাযথ রাজনৈতিক চ্যানেলটা মেইনটেন করতে পারেননি তিনি। ষষ্ঠত: হতে পারে জামাত তার কাছ থেকে সুবিধা নিতে চেয়েছে। ফলে অন্যরা এটাকে দেখে তাকে এড়িয়ে গেছেন। তবে নাটোর থেকে লেখক এই জাতিকে যা দিয়েছেন নানান কিছু মেইনটেন করে চলা অনেক বিখ্যাত লেখক আমাদের তা দিতি পারেননি । অথচ এতটা সাধনা করেও শুধুমাত্র প্রচারের আলোয় না আসার কারণে লেখক এই ৭৭ বছর বয়সেও বলেন “কিছু পাওয়ার আশায় আমি আমার কাজ করিনি। জাতির প্রতি দায়বদ্ধতাই আমাকে কিছু করতে তাড়িত করেছে। এতে করে যদি আমার জাতি কোন উপকার পায় এটাই আমার বড় পাওনা। পরণেই অন্য একটা প্রশ্নের জবাবে লেখক বলেন পৃথিবীতে কাজের স্বীকৃতি পেতে চায়না এমন মহাপুরুষ আজও জন্ম নেয়নি। সুতরাং স্বীকৃতির প্রাপ্য কাজ যদি আমি করে থাকি তাহলে আমার স্বীকৃতি আমাকে আরো উজ্জীবীত করবে এটা তো কমন।” আর লেখকের কথাটার সাথে আমরা মিলিয়ে দেখতে পারি আমাদের প্রিয় নবী স. এর বিদায় হজের ভাষনের শেষ উক্তিটিরও।
এ তো গেল ঐতিহাসিক উপন্যাসের কথা। সামাজিক উপন্যাস, রম্য, নাটক, শিশু সাহিত্য কোথায় তিনি বিচরণ করেননি! কোন কোন পাঠকের মতে এক ‘চলন বিলের পদাবলী’র জন্যই লেখক একটা জাতীয় সম্মান পেতে পারেন! আর ‘অপূর্ব অপেরা’! চমৎকার একটা বই। লেখকের জাত চেনানোর জন্য যথেষ্ট। লেখকের সামাজিক উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল: অপূর্ব অপেরা, চলন বিলের পদাবলী, শীত বসন্তের গীত, পাষাণী, দুপুরের পর, রাজা ও রাজকন্যারা, থার্ড পণ্ডিত, মুসাফির, গুনাহগার প্রভৃতি। লেখক এসব উপন্যাসে সমাজের যে ছবি চিত্রায়ন করেছেন তা তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও পর্যণ থেকেই করেছেন তা পাঠক উপলব্ধি করতে পারেন পাঠের শুরুতেই। সামাজিক দন্দ্ব, টানাপড়েন, প্রেম-ভালবাসা, বিরহ, হতাশা স্বপ্নভঙ্গ প্রভৃতি বিষয় এদেশের মানুষের মনস্তত্বকে পাঠের পর তিনি যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা এক কথায় অভুতপূর্ব। লেখকের স্বার্থকতা হল প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের মনস্তত্বকে খুব নিবীড় পাঠের মাধ্যমে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং সেই উপলব্ধিটা পাঠকের মাঝে সংক্রমিত করার দতাও দেখিয়েছেন সুনিপুনভাবে। তার প্রতিটা উপন্যাসই পাঠের সময় পাঠকের মনে হবে আরে এযে আমারই কাহিনী বা এটাতো পাশের বাড়ীর ছেলেটা বা মেয়েটার জীবনের সাথে হুবহু মিলে যায়। অথবা আরে এটাতো আমদেরে সমাজের কথা। তবে লেখকের লেখায় শহুরে উচ্চ বিত্তের জীবনযাত্রাকে খুব বেশী উপস্থাপন করা হয়নি। আবার যেটুকো করা হয়েছে সেখানেও সেই শ্রেনীকে খুব মনোযোগের সাথে উপস্থাপন করা হয়নি। তবে তার প্রতিটা সামাজিক উপন্যাসই সুখপাঠ্য এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
শিশুদের জন্য লিখেছেন: ভুতের মেয়ে লীলাবতী, পরীরাজ্যের রাজকন্যা, রাজার ছেলে কবিরাজ ও যাদুর বাশী।
নাটক: গাজী মন্ডলের দল, সূর্যগ্রহণ, বন মানুষের বাসা, রূপনগরের বন্দী ও কাঁকড়া কেত্তন।
কাব্য নাট্য: দীপ দুর্ণিবার ও রাজপুত্র এছাড়াও লিখেছেন আরো নানা রকম বই এসবের মধ্যে আছে কিছু পাঠ্য বইও।
সুদূর নাটোর থেকে সরদার আমাদের বাংলা সাহিত্যের মাঠে যে চাষ করেছেন আর যে ফসল ফলিয়েছেন; তা এক কথায় অনন্য। যদি লেখকের প্রতি প্রচারের আলোটা সেভাবে আসতো তবে কেবল ‘গৌড় থেকে সোনার গাঁ’ ও ‘চলন বিলের পদাবলী’র জন্যই লেখক একটা জাতীয় সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখেন। আর যদি লেখকের সমগ্র সাহিত্য কর্ম নিয়ে কথা হয় তাহলে বাংলা সাহিত্যে সরদার এমন একটা উজ্জ্বল নাম যাকে কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যাবেনা। লেখকের প্রতি জাতীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য হলেও তাকে আমারা একটা সম্মান দিতে বাধ্য। কিন্তু আমাদের বৈশিষ্ট হল আমারা আমাদের কোন প্রতিভাকে তখনই মূল্যায়ন করি যখন তিনি মূল্যায়নের মত জাগতিক জগতের বাসিন্দা নন। সরদারের বেলায় যেন এমনটি না হয় এটা আমাদের প্রত্যাশা এবং কর্তৃপরে কাছে অনুরোধও।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে ২০০৯ সালে আমরা অসুস্থ লেখককে দেখতে গিয়েছিলাম বেশ কজন পাঠক। তখন নানা কথার ফাঁকে তিনি বলেছিলেন যে বেঁচে থাকতে যে সম্মান আমার জন্য নেই; সেই সম্মান মৃত্যুর পর চাই না। এক পর্যায়ে আবগের অতিশয্যে লেখক বলেন আমি বাংলা একাডেমির মেম্বারও ছিলাম মেম্বার নম্বরসহ বলতেছিলেন... তখন তার মাঝে একটা দুঃখবোধ আমরা দেখতে পেয়েছি। লেখক জাগতিক কোন প্রতিদান চাইনা বলার পরও এটাকে আমরা লেখকের অভিমান হিসেবেই মনে করছি।
আমরা মনে করি শফীউদ্দীন সরদার তার উপযুক্ত সম্মান পেয়েই মৃত্যুবরণ করবেন। ততদিন পর্যন্ত মহান আল্লাহ্ তাঁকে আমদের মাঝে বর্তমান রাখুন। দেশের নীতিনির্ধারকগণ এই বিষয়টি দ্রুতই উপলব্ধি করবেন এই আশায় অপেক্ষার প্রহর গুণছি আমারা ।
লেখক : সুপান্থ সুরাহী
সাক্ষাতকার: বাঙলাকথার সঙ্গে সাক্ষাকারে শেকড়সন্ধানী ঔপন্যাসিক শফীউদ্দীন সরদার
জীবনটা হলো অতিথিশালায় বসবাস করার মতো, যে অল্পদিন সেখানে থাকে তাকে কম পেমেন্ট করতে হয়
[শফীউদ্দীন সরদার। বাংলা সাহিত্যের শেকড়সন্ধানী ঔপন্যাসিক। ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে তিনি বিপুল জনপ্রিয় হয়েছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যান্য শাখায়ও তাঁর সদর্প বিচরণ। প্রবীণ এ কথাশিল্পীর রয়েছে বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা। তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে সমপ্রতি খোলামেলা কথা বলেছেন বাঙলাকথার সঙ্গে। বাঙলাকথার নির্বাহী সম্পাদক সমর ইসলামকে দেয়া তার সাক্ষাকারটি এ সংখ্যায় পত্রস' করা গেল।]
বাঙলাকথা : বাংলা-সাহিত্যে শেকড়সন্ধানী ঔপন্যাসিক হিসেবে আপনি তুমুল জনপ্রিয় একজন কথাসাহিত্যিক। ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস লিখে আপনি বাংলা-সাহিত্যে এক ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছেন। আপনার সৃষ্টিকর্ম আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি বর্তমান প্রজন্মকে ইতিহাস শেখানোর নতুন টনিক হিসেবে কাজ করছে। আপনি অবগত আছেন যে, বাঙলাকথা নামে আমরা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক একখানা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করছি নিয়মিত। পত্রিকাটির বয়স বেশি না হলেও ইতোমধ্যেই পাঠকদের কাছে বেশ আদৃত হয়েছে। আমরা বাঙলাকথার মাধ্যমে আপনার বর্ণাঢ্য কর্মজীবন এবং দীর্ঘ সাহিত্য-জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু কথা আমাদের পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই।
শফীউদ্দীন সরদার : হ্যঁ, অবশ্যই। তোমাদের পত্রিকা আমি দেখেছি। খুবই ভালো লেগেছে।
বাঙলাকথা : প্রথমেই আপনার জন্ম কখন কোথায় হয়েছে এবং আপনার পারিবারিক পরিচয় সম্পর্কে যদি কিছু বলুন?
শফীউদ্দীন সরদার : ম্যাট্রিকুলেশান সার্টিফিকেট অনুযায়ী আমার জন্ম তারিখ ইংরেজি ১৯৩৫ সনের ১লা মে। কিন’ আসল জন্ম সনটা হবে ইংরেজি ১৯৩২ বা ১৯৩৩ সন। বয়স বেশি হয়ে যাওয়ায় ম্যাট্রিক পরীক্ষবর সময় বয়স দুই তিন বছর কমিয়ে দেয়া হয়। প্রথম ভর্তির সময়ই ভুল করে বয়সটা বেশি ধরিয়ে দেয়ার জন্যে এমনটি ঘটে।
আমার জন্মস’ান বর্তমান নাটোর জেলার নলডাঙ্গা থানার হাটবিলা গ্রামে। আমার আব্বা শিশুকালে ইন্তেকাল করেন। আম্মা ইন্তেকাল করেন শৈশবকালে। আমরা দুই ভাই দুই বোন। বোন দুইজন ও ভাইটি ছেলে মেয়ে রেখে ইন্তেকাল করেছেন। আমার চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। দুই ছেলে গ্র্যাজুয়েট আর বাদবাকি সবাই এমএ পাশ। দুই ছেলে ব্যবসা করে আর অন্য সবাই চাকরি করে নানাস’ানে। মেয়ে পাঁচজনই কলেজের অধ্যাপিকা।
বাঙলাকথা : আপনার শৈশব এবং পড়াশোনার শুর্বটা যেভাবে হয়-
শফীউদ্দীন সরদার : আমার অতি শিশুকালে আমার আব্বা ইন্তেকাল করেন। এর দুই তিন বছরের মধ্যেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার মস্তবড় পরিবারের নারী-পুর্বষ সকলেই একের পর এক ইন্তেকাল করেন। বেঁচে থাকেন নাবালক চার ছেলে মেয়ে নিয়ে একমাত্র আমার আম্মা। মাথার উপর কোন অভিভাবক না থাকায় আমার গৃহসংলগ্ন অত্যন্ত অসৎ এক গ্রামপ্রধান ও তার ভাই জমিদারের কাচারীর নায়েবের যোগসাজসে আমাদের চলিৱশ পয়তালিৱশ বিঘে জমি নিলামে তুলে ধরে নেয়। শুধু তাই নয়, আমাদের বিশাল বসতবাটিটাও ঐ মাতবর তার নিজের নামে করে নেয়। চেষ্টা করে কোন ফল না হওয়ায় আমার আম্মা ঐ বসতবাড়ি থেকেও উচ্ছেদ হয়ে যান এবং আমাদের নিয়ে ঐ গ্রামেই আমার ফুফুর বাড়িতে গিয়ে একপাশে ঘর তুলে থাকেন।
আমড়া গাছে আমড়াই ফলে, আপেল বা আঙুর ফলে না। ঐ অসৎ গ্রামপ্রধান ও তার অসৎ ভাইয়ের ছেলেরাও ছিল অত্যন্ত অসৎ। আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়টিকে পাঠশালায় ভর্তি করে দেয়া হলেও সে পাঠশালায় যায় না। গ্রামের ছেলেদের সাথে মারামারি করে দিন কাটায়। ছেলেকে পাঠশালামুখী করার জন্যে ছেলের পাঠশালায় যাওয়ার একটি সঙ্গী খুঁজতে গিয়ে ঐ অসৎ মাতবরের অসৎ ভাইয়ের নজর পড়ে আমার উপর। তাই সে আমার আম্মার কাছে গিয়ে দরদী সেজে আমাকে পাঠশালায় ভর্তি করে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। আমার বয়স তখন পাঁচ সাড়ে পাঁচ বছর। আমার আম্মা রাজী না হওয়ায় সে নাছোড়পি-ে হয়ে আমার আম্মাকে বুঝাতে থাকে এবং শেষ অবধি আমাকে ভর্তি করতে রাজী করিয়ে তবে ছাড়ে।
কিন’ কুকুরের লেজ টানলেও সোজা হয় না। পাঠশালায় যাওয়ার সঙ্গী করে দেয়া সত্ত্বেও লেখাপড়ায় তার ঐ ধাঁড়ি ছেলের কিছুমাত্র উন্নতি হয় না। কিন’ আমি পাঠশালায় ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়ায় অত্যন্ত মনোযোগী হই ও অল্পদিনেই পাঠশালার ছাত্র-শিৰক আর স’ানীয় গ্রামবাসীদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করি। চারদিকের সবাই আমার প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠে।
প্রচ- ঘা লাগে ঐ মাতবর আর তার ভাইয়ের বুকে। নিঃস্ব করে দেয়া ঐ পরিবারের ছেলেই (অর্থাৎ আমি) শেষে তাদের ও তাদের ছেলেদের চেয়ে অধিক নামীদামী ও মূল্যবান ব্যক্তি হয়ে উঠবে- এটা তারা সহ্য করতে পারে না। কোনভাবে আমার লেখাপড়া বন্ধ করতে না পেরে তারা আমাকে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার নানা রকম চেষ্টা করতে থাকে। আমার শৈশব নিয়ে বলতে হলে বলতে হয়, এদের দুশমনী থেকে আত্মরক্ষব করার তৎপরতার মধ্যে দিয়েই আমার শৈশব কেটেছে।
বাঙলাকথা : শৈশবের এমন কোনো স্মৃতি আছে কি যা এখনও আপনার মন-মুকুরে ভেসে ওঠে?
শফীউদ্দীন সরদার : সুখের কোনো স্মৃতি নেই। শৈশবের সব স্মৃতিই দুঃখের। সে সব কথা না-ই বা বললাম।
বাঙলাকথা : সাহিত্যে এলেন কিভাবে এবং কেন?
শফীউদ্দীন সরদার : ছাপা না হলেও স্কুলে থাকতেই আমি কবিতা ও ছোট ছোট গল্প লিখতাম। পরবর্তীকালে প্রকাশকদের উৎসাহে কর্মজীবনের পাশাপাশি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করি। তখন থেকেই সাহিত্য চর্চা আমার কাছে একটি নৈতিক দায়িত্ব হয়ে উঠে আর আজও তাই আছে। নৈতিক অবৰয় থেকে যতটুকু পারি সমাজকে উদ্ধার করার প্রয়াসেই সাহিত্য চর্চা করি।
বাঙলাকথা : ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রতি আকর্ষণ কিভাবে সৃষ্টি হয়?
শফীউদ্দীন সরদার : আমি ইতিহাসে অনার্স ও এমএ পাশ করি। কিন’ ইতিহাসের একটি বিশেষ অংশ বাদ দিয়ে আমাদের সে সময়ে ইতিহাসের সিলেবাস রচনা করা হয়েছিল। সে অংশটি হলো, ১২০৩ খৃষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজীর নদীয়া বিজয় থেকে ১৫৭৬ খৃষ্টাব্দে দাউদ কাররানীর রাজমহলের যুদ্ধ পর্যন্ত বাংলা মুলুকের পৌনে পাঁচশ’ বছরের ইতিহাস। গৌড়, পা-ুয়া ও তা-ার মুসলমান শাসনের এক অবিস্মরণীয় ও ঐতিহ্যময় অতীত। অথচ এ অতীত ছিল অন্ধকারে। ইংরেজ ও তাদের সহযোগীদের চাতুর্যে এ অতীত আমাদের স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটির ইতিহাসের পাঠ্য তালিকায় আসেনি। অন্য কথায়, মুসলমানদের এই ঐতিহ্যময় ইতিহাস মানুষকে জানতে দেয়া হয়নি। ইতিহাস জানার উদ্দেশ্যে ইতিহাস কম লোকেই পড়ে। ইতিহাস গল্প-উপন্যাসের মধ্যে এলে তবেই মানুষ তা জানতে পারে। তাই মুসলমানদের এই ঐতিহ্যময় ও অবিস্মরণীয় ইতিহাস মানুষকে জানানোর জন্যেই আমি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় লিপ্ত হই।
বাঙলাকথা : ঐতিহাসিক উপন্যাসের বাইরেও আপনি অনেক গল্প, উপন্যাস, নাটক, এমনকি কবিতাসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় বিচরণ করেছেন- সেগুলো সম্পর্কে যদি কিছু বলুন?
শফীউদ্দীন সরদার : সাহিত্য চর্চা ছোটকাল থেকেই ভালো লাগতো আমার। তাই অন্তরের টানেই ঐতিহাসিক উপন্যাসের পাশাপাশি সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করেছি আর করি।
বাঙলাকথা : আপনার এমন কোন প্রিয় ব্যক্তিত্ব বা লেখক কিংবা সাহিত্যকর্ম আছে কি- যিনি বা যা আপনার সাহিত্য জীবনের উপর প্রভাব ফেলেছে বা অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে?
শফীউদ্দীন সরদার : না, তেমন কেউ বা তেমন কিছু নেই। একমাত্র পাকিস্তানী ঔপন্যাসিক নসীম হিজাযীই অনেকটা প্রভাব ফেলেছে আমার সাহিত্য জীবনের উপর।
বাঙলাকথা : আপনার একান্ত ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
শফীউদ্দীন সরদার : আমার একান্ত ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যা বলার তা ইতোপূর্বেই বলে ফেলেছি। এর বেশি বিশেষ কিছু নেই।
বাঙলাকথা : সাহিত্য রচনার বাইরে কর্মজীবনে আপনি প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, অধ্যাপনা করেছেন, নাটক লিখেছেন, অভিয়নও করেছেন। এতসব কাজের মধ্যে কোন কাজে আপনি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেছেন?
শফীউদ্দীন সরদার : সাহিত্য চর্চায় আমি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেছি আর করি।
বাঙলাকথা : জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে আপনার অনুভূতি ও মূল্যায়ন জানতে চাই।
শফীউদ্দীন সরদার : মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আমরা তা নিয়ে ভাবি না। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবো এই ধারণায় জীবন ধারণ করি। আর জীবনটা হলো অতিথিশালায় বসবাস করার মতো। যে অল্পদিন সেখানে থাকে তাকে কম পেমেন্ট করতে হয়। অর্থাৎ তার কম পাপ হয়। আর যে সেখানে অনেক দিন থাকে তাকে অধিক মূল্য দিতে হয়। অন্য কথায়, অনেকদিন বেঁচে থাকলে অনেক বেশি পাপে নিমজ্জিত হতে হয়।
বাঙলাকথা : জীবনের সবচেয়ে সুখকর ও দুঃখের স্মৃতি সম্পর্কে বলুন?
শফীউদ্দীন সরদার : সুখকর স্মৃতি বলতে আমার স্ত্রীর সাথে আমার প্রথম দিনের প্রেমের স্মৃতি আর দুঃখের স্মৃতি বলতে আমার আম্মার কর্বণ মৃত্যু। অজ্ঞদের ভুলের জন্যে উনি দম বন্ধ হয়ে মারা যান।
বাঙলাকথা : আপনার প্রিয় লেখক কে? এই সময়ের কোন লেখকের লেখা আপনি পড়েন কি না?
শফীউদ্দীন সরদার : প্রিয় লেখক কিছুটা নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন আর অধিকটা নসীম হিজাযী। এ সময়ের লেখকদের লেখা আমি বেশি পড়ি না। কারণ, প্রায় সবগুলোই নীতি-আদর্শ বিবর্জিত অশৱীল ও কুর্বচিপূর্ণ লেখা। বিশেষ করে সেক্যুলারপন’ীদের লেখা আমি বড় একটা পড়ি না।
বাঙলাকথা : নতুন প্রজন্মের লেখকদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
শফীউদ্দীন সরদার : কথা ঐ একটাই। কিছু কিছু সৎ লেখক থাকলেও সিংহভাগ লেখকই লারেলাপ্পা আর ডু-ফুর্তি জাতীয় দায়িত্বহীন লেখক। সমাজের অবৰয় নিয়ে এদের কোন মাথা ব্যথা নেই।
বাঙলাকথা : সাহিত্যে আপনার প্রাপ্তি/অপ্রাপ্তি- কি কি পুরস্কার আপনি পেয়েছেন?
শফীউদ্দীন সরদার : বেসরকারী পর্যায়ের অনেক পুরস্কারই পেয়েছি। কোন সরকারী জাতীয় পুরস্কার পাইনি। প্রাপ্তি বলতে আমার পাঠকদের তৃপ্তি ও আমার প্রতি তাঁদের প্রগাঢ় ভালোবাসা।
বাঙলাকথা : পরিশুদ্ধ মনন গঠনে বই পড়ার গুর্বত্ব সম্পর্কে যদি কিছু বলুন?
শফীউদ্দীন সরদার : পরিশুদ্ধ মনন গঠনে সৎ সাহিত্য, অর্থাৎ অশৱীলতা ও কুর্বচি বিবর্জিত বই পড়ার গুর্বত্ব অনেক। ধর্মীয় মূল্যবোধ আলৱাহপ্রীতি আলৱাহভীতি সম্বলিত ও পরকালের উপর বিশ্বাস সৃষ্টিকারী বই পাঠের মূল্য আমি মনে করি ইবাদতের সওয়াবের সমান। অন্য ছাইভস্ম পাঠ মানে ভূতের বেগার খাটা। তাতে অধঃপতনের পথই প্রশস্ত হয়।
বাঙলাকথা : জীবনের এ পর্যায়ে এসে আপনার কোনো অতৃপ্তি আছে কি না?
শফীউদ্দীন সরদার : আমার একখানা বই যিনি একবার পড়েন, তিনি অত্যন্ত খুশি হন এবং আমার সবগুলো বই পড়ার বিপুল আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন’ আমি থাকি ঢাকা থেকে বহুদূরে এক মফঃস্বল শহর নাটোরে। ঢাকায় থেকে নিজের ঢোল নিজে পিটাতে না পারায় আমার সাহিত্যের খবর বেশি লোকের জানা নেই। আর ঢাকার কুলীন সাহিত্য পরিম-লে আমি তেমন পরিচিতও নই।
অথচ পাঠকপ্রিয়তা কম বেশি যা-ই থাকুক, ঢাকার অনেক সাহিত্যিক ঢাকায় থেকে নিজের ঢোল নিজেই তুমুল হাতে পিটে এমন প্রচ- রকমের সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন যে, সকল সাহিত্য আসরে পৌরহিত্য করার জন্যে ডাক পড়ে তাঁদের আর সাহিত্যের প্রতিটি প্রসঙ্গে তাঁদের নিয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে মাতামাতি করেন সবাই। এর উপর আবার একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার হস্তগত করার ফলে সাহিত্যিক হিসাবে তাঁদের খ্যাতি ও পরিচিতি আরো দশগুণে বেড়ে গেছে।
অপর দিকে অত্যন্ত পাঠকপ্রিয় লেখক হওয়া সত্ত্বেও আমি বরাবরই পড়ে রইলাম পরিচিতির অন্তরালে। অতৃপ্তির প্রশ্ন সেখানে স্বাভাবিকভাবে আসবেই।
বাঙলাকথা : বাঙলকথা সম্পর্কে যদি কিছু বলুন?
শফীউদ্দীন সরদার : পত্রিকার বেশ কয়েকটি সংখ্যা আমি দেখেছি। ভালো লেগেছে বলেই গত ঈদ সংখ্যায় তোমাদের পত্রিকায় আমার লেখা উপন্যাস ছাপতে দিয়েছি। পত্রিকা প্রকাশ অনেক কঠিন কাজ। তোমাদেরই এখন সময় কঠিনকে জয় করার। বেশ পর্বিছন্ন পত্রিকা তোমরা করছো। ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে এই শুভ কামনা রইলো। বাঙলাকথা পরিবার, তার কলাকুশলী, পাঠকসহ সংশিৱষ্ট সকলকে মোবারকবাদ এবং শুভ কামনা।
বাঙলাকথা : বার্ধক্য, অসুস’তা ও ব্যস্ততার মাঝেও সময় করে আমাদের সাক্ষাকারে অংশ নেয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
শফীউদ্দীন সরদার : জীবনের কিছু খ-িত অংশ পাঠকদের সামনে তুলে ধরার জন্যে তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ।
সাক্ষাতকার গ্রহণ- সমর ইসলাম
1 comments:
আমি স্যারের অনেক বড় ভক্ত। স্যারের ৫-৬ টা বই পড়েছি। কত ভাল লেগেছে তা বুঝাতে পারবো না। অনেক মুল্যবান সময় নষ্ট করে স্যারের কয়েক টা বই পড়েছি।
তাকে আল্লাহ নেক হায়াত দান করুন। এবং আমাদের কে যেন ভাল ভাল বই উপহার দিতে পারে আল্লাহ যেন তাকে সেই তাওফিক দান করেন । আমিন !