গত ৫মে ২০১৩ দিবাগত গভীর রাতে আওয়ামী লীগ সরকার এই দেশের ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। পূর্বঘোষিত কর্মসূচী অনুসারে রাজধানী ঢাকার মতিঝিলে অবস্থান ধর্মঘট করছিলো অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। রাতের অন্ধকারে আলো নিভিয়ে দিয়ে চারপাশ থেকে ঘিরে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও সাঁজোয়া গাড়ির বহর নিয়ে তাদের উপর চালানো হয় তথাকথিত ‘অপারেশন ফ্রিডম’ বা অপারেশন শাপলা। দশ হাজার পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং গুপ্তবাহিনী সদস্যের সম্মিলিত আক্রমনে মতিঝিল শাপলা চত্বর কয়েক মুহুর্তে হত্যা করা হয়েছে শত শত নিরীহ শান্তিপ্রিয় মাদরাসা শিক্ষক ও ছাত্রকে। এই গণহত্যাকে লুকিয়ে রাখার জন্য সমস্ত মিডিয়াকে বাধ্যতামূলকভাবে সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো মধ্যরাতের ভেতরে। সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সম্প্রচার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কারণে হত্যাকান্ড চলাকালীন মধ্যরাতেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দুইটি টিভি চ্যানেল; দিগন্ত টিভি এবং ইসলামিক টিভি। অসংখ্য আলেমে দ্বীনের রক্তে সেই কালোরাতে শাপলা চত্বর ডুবে গিয়েছিলো। সরকার তার সমস্ত শক্তি দিয়ে এ অপকর্ম আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ অপকর্মে প্রধান সহযোগীর ভূমিকা পালন করছে বামপন্থী ও আওয়ামী নাস্তিক সাংবাদিকদের পরিচালিত মিডিয়া চ্যানেলগুলো।
এই বর্বর হত্যাকান্ড কোন ধর্মের বিবেকবান মানুষের পক্ষেই মেনে নেয়া সম্ভব না। আর আমরা যারা মুসলিম, তাদের হৃদয় আজ বেদনাহত। আজ বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়, যে আলেমদের আজান শুনে বাংলার মানুষ জেগে ওঠে প্রতি দিন, শুধুমাত্র রাসূল (সাঃ) এর ইজ্জতের অবমাননার প্রতিবাদ করার অপরাধে তাদের নির্বিচারে হত্যা করে দমন করা হবে এই বাংলাদেশে, ৯০% মুসলিম জনসংখ্যার এই দেশে। এই আলেমে দ্বীন ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের কি অপরাধ ছিলো? শুধুমাত্র ঈমানের তাগিদে রাস্তায় নেমে শহীদ হতে হলো হাজারো মসজিদের ঈমাম, মুয়াজ্জিন, হাফেজে কোরআন, মুফতি, মাওলানা এবং সাধারণ মুসলিমদেরকে, যাদের অনেকের লাশও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কোনদিন।
কি ঘটেছিলো সেই দিন?
পূর্বঘোষিত ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীর অংশ হিসেবে অনেকটা উৎসব মুখর পরিবেশেই সারা দেশ থেকে আলেম উলামারা আসতে থাকেন। ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং আল্লাহপ্রেমী মানুষের ঢল নামা এই অবরোধ অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে চলতে থাকে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদেরও স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা করতে দেখা যায়।
বেলা এগারোটার দিকে প্রশাসনের কাছ থেকে অবরোধ শেষে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার অনুমতি পায় হেফাজতে ইসলাম। যদিও হেফাজত নেতাদের দাবী ছিলো বায়তুল মুকাররম মসজিদের উত্তর গেটে সমাবেশ করবার, কিন্তু ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে শাপলা চত্বরেই সমাবেশ করবার নির্দেশ দেয়া হয়। সেই নির্দেশনার আলোকে বিভিন্ন স্থান থেকে ইসলামপ্রিয় তৌহিদী জনতার ঢল নামে শাপলা চত্বর অভিমুখে। ইতোমধ্যে একটি ছোট মিছিল গুলিস্তান হয়ে শাপলাচত্বর আসবার পথে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। নিরস্ত্র ও নিরীহ আলেমদের উপর সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় মুহূর্তেই রঞ্জিত হয়ে ওঠে রাজপথ, লগি-বৈঠার তান্ডব ও দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্রের হামলায় শাহাদত বরণ করেন দুই জন আলেম। পুলিশ সম্পূর্ণ দর্শক হিসেবে তা অবলোকন করে। এভাবেই পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। খালি হাতে ও ইট পাটকেল নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা, কিন্তু পুলিশ ও আওয়ামী-যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের নৃশংসতায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পল্টন, কাকরাইল, বিজয়নগর এলাকাতেও। একের পর এক গুলিবিদ্ধ লাশ পড়তে থাকে হেফাজত কর্মীদের। এইসব খবর আসতে থাকলে শাপলাচত্বরে জড়ো হওয়া লাখ লাখ মানুষ বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠতে থাকেন, কিন্তু হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ চরম ধৈর্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে সবাইকে শান্ত করে রাখেন।
এভাবেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে এশার আজান পড়ে যায়। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী শাপলাচত্বরে আসতে চাইলেও পলাশী এলাকায় তার গাড়িবহর আটকে দেয়া হয়, পরে বাধ্য হয়ে লালবাগ মাদ্রাসায় ফিরে গিয়ে আহমদ শফী নির্দেশনা প্রেরণ করেন, ১৩ দফা দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘট চলতে থাকবে। মুহূর্তেই ইসলামপ্রিয় তৌহিদী জনতার কুরআন তিলাওয়াত ও জিকিরে মশগুল হয়ে ওঠে পুরো মতিঝিল এলাকা ও তার আশপাশ। অপরদিকে থেমে থেমে বায়তুল মুকাররম, পল্টন ও কাকরাইল এলাকায় তখনও চলতে থাকে সংঘর্ষ।
এ অবস্থায় চরমতম অ্যাকশনে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। মতিঝিল শাপলাচত্বরের এই জনসমুদ্রকে ঘিরে র্যাব-পুলিশ ও বিজিবির প্রায় দশ হাজার সদস্যের একটি যৌথবাহিনী এবং সাঁজোয়া গাড়িবহর নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলার অপেক্ষায় পজিশন নেয় কাকরাইল, দৈনিক বাংলা মোড়, ইত্তেফাক মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে। এক পর্যায়ে মতিঝিল এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়, ওখানে উপস্থিত সকল মিডিয়া ও সাংবাদিকদের সরিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য মোবাইল ফোন ও ফেসবুক-টুইটারের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে পৌছে যায় পুলিশের এই রণপ্রস্তুতির কথা। এক অজানা আশংকায় সময় কাটাতে থাকে সবাই।
কালোরাতের হত্যাযজ্ঞ
৫ই মে দিবাগত রাত তখন প্রায় আড়াইটা। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে আগত আলেমে দ্বীন ও মুসল্লিদের অনেকেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। অসংখ্য মুসল্লি তখনও জিকিরে মশগুল। এ অবস্থায় মাইকে ভেসে আসে পুলিশের একটি ঘোষণাঃ “আপনারা সরে যান। এখন আমরা শাপলা চত্বর খালি করার জন্য যা করা দরকার তাই করব।“ স্বাভাবিকভাবেই এতে রাজি না হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের অবস্থানে থেকে যান আল্লাহর পথে নিবেদিতপ্রাণ মুসল্লিরা। বেশিরভাগই এসময় ঘুমিয়ে ছিলেন। জেগে থাকা মুসল্লিরা জিকির করছিলে। কিন্তু আর কোন কথা বাড়ায়নি সরকারের পেটোয়া সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনী। আর কোন সুযোগ না দিয়ে ১০ হাজারেরও বেশি পুলিশ,র্যাব,বিজিবি ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা সব দিক থেকে ঘিরে হামলা শুরু করে। ব্রাশফায়ারের মুহুর্মুহু গুলি, গ্রেনেড, টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেড নিয়ে নিরস্ত্র মুসল্লিদের ওপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ে এই অমানুষগুলো। ঐ মুহুর্তে শাপলাচত্বরে থাকা মুসল্লিদের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি আর বোমা আসতে থাকে। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঘটে যায় পৃথিবীর ইতিহাসের বর্বরতম এক হত্যাযজ্ঞ। পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মাঝে সরকারী হায়েনারা তাদের হিংস্রতা চরিতার্থ করে উল্লসিত হয়ে উঠে। উপস্থিত জনতার অনেকে কোন কিছু বুঝে উঠারই সুযোগ পাননি। অনেকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই গুলী ও বোমার শিকার হয়ে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন। বেশিরভাগ মুসল্লি ঘুম ভেঙ্গে হতবিহবল অবস্থাতে কিছু বুঝে উঠার আগেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।
এভাবে নির্বিচার গুলি চালিয়ে অবশেষে পুলিশ দখল করে নেয় শাপলা চত্বর। যারা অন্ধকারের মধ্যে খালি হাতেই কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, নির্মম বুলেট আর সাউন্ড গ্রেনেড তাদের চিরতরে থামিয়ে দিয়েছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই পুলিশের জলকামান, ওয়াসা ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দিয়ে ঐ এলাকা ধুয়ে মুছে রক্তের সব চিহ্ন পরিস্কার করে ফেলা হয়েছে। অসংখ্য লাশ গাড়িভর্তি করে গুপ্তস্থানে ডাম্পিং করা হয়েছে অথবা বৈদ্যুতিক চুল্লীতে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন,প্রথমেই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। এতে হেফাজত কর্মীদের প্রতিরোধ করার মনোবল ভেঙে যায়। মিডিয়াতে সম্পূর্ণ ব্ল্যাক আউটের পরও ইন্টারনেটে প্রকাশিত স্বল্পসংখ্যক ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়,শাপলা চত্বরের আশপাশে অমানবিকভাবে রাস্তায় সিড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য লাশ। অনেক জায়গায় জমে গেছে কয়েকজনের লাশের স্তুপ। গোপন ছবিতে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে শুধু সোনালী ব্যাংকের সিঁড়ি ও এর আশপাশে পড়ে আছে অসংখ্য লাশ। শাপলা চত্বরের সবচেয়ে কাছের এই ভবনটিতে গতকাল আশ্রয় নিয়েছিলেন হেফাজতকর্মীরা। জীবন বাঁচাতে তাদের প্রাণান্তকর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় নির্বিচার গুলি,গ্রেনেড আর ব্রাশফায়ারে। এরপর মতিঝিল ও আরামবাগের বিভিন্ন অলিগলিতে আশ্রয় নেয়া আলেমদের উপ অ্যাকশন শুরু করে পুলিশ। সেখানেও ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকায় এক নারকীয় পরিবেশ নেমে আসে মতিঝিল ও শাপলা চত্বরে।
কত লোক নিহত হয়েছে?
মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ৬ মে রাতে কত লোক নিহত হয়েছে? বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে গতকাল এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন জানায়,নিহতের সংখ্যা ২,৫০০ এরও বেশি হতে পারে। হেফাজতের ইসলামের হিসাবে নিহতের সংখ্যা ২,০০০ থেকে ৩,০০০ হতে পারে, এর বেশিও হওয়া অসম্ভব কিছু না। বিরোধী দল বিএনপি বলছে, শাপলা চত্বরে সহস্রাধিক লোককে হত্যা করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের একজন রিপোর্টার দাবি করেছেন, তিনি নিজে পাঁচটি ট্রাকে করে লাশ স্তুপ করে বয়ে নিয়ে যেতে দেখেছেন। তাৎক্ষণিক লাইভ রিপোর্টিংয়ে তার সেই মন্তব্য প্রচার হলেও এরপর থেকে সেই খবর আর প্রচার করেনি চ্যানেলটি। এদিকে মার্কিন টিভি স্টেশন সিএনএন বার্তা সংস্থা এপির বরাত দিয়ে জানায়,৬ই মে রাতের নিহতের প্রকৃত সংখ্যা হয়তো কখনোই জানা যাবে না। ঘটনাস্থলে মিডিয়া কাভারেজে অংশগ্রহণরত সাংবাদিকদের মতে, শত শত লোককে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে ৬ই মে কালোরাতে। মানবাধিকার কর্মীদের ধারণা হলো, নিহতের সংখ্যা এতোই বেশি যে সরকার কোনো দিনই তা প্রকাশ হওয়ার কোন সুযোগ দেবে না। এ কারণেই মহানগর পুলিশ কমিশনার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, “ঐ রাতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি”।
মিডিয়া ব্ল্যাকআউট, পরিকল্পিত অপপ্রচার ও তার জবাব
হেফাজতে ইসলামের সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এই অবস্থান কর্মসূচিতে নির্বিচার হত্যাকান্ড চালানোর পর তা চাপা দেয়ার জন্য সব রকম প্রচেষ্টা চালানো হতে থাকে। প্রায় সকল মিডিয়ায় চলতে থাকে ব্ল্যাকআউট, হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ায় পরিকল্পিতভাবে শুরু করা হয় পবিত্র কুরআনে আগুন দেয়া সহ স্বর্ণ -গহনার দোকান লুটপাট করার ঘৃণ্য ও কল্পিত অভিযোগ। লাশের মিছিলের চেয়ে হেফাজতের তথাকথিত ধ্বংসযজ্ঞই হয়ে ওঠে মুখ্য আলোচ্য বিষয়। এমনকি সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত বলেন হেফাজত মতিঝিলের সকল ব্যাংক লুট করতে চেয়েছিলো বলেই তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সরকারী নিষেধাজ্ঞা আসবার পরও দিগন্ত টিভি গোপনে তার কাভারেজ চালিয়ে যেতে থাকে। এ কারণে মধ্যরাতেই পুলিশ হানা দেয় দিগন্ত অফিসে, মূল্যবান যন্ত্রপাতি আটক করে নিয়ে যায় এবং বন্ধ করে দেয় চ্যানেলটি। একইভাবে কোন কারণ ছাড়াই ইসলামিক টিভিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে রাত ৮-৯টার দিকে বায়তুল মুকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটের নিকটবর্তী জুয়েলারী মার্কেট এবং ইসলামী বইপুস্তকের দোকানে রহস্যজনকভাবে আগুন ধরানো হয়। এতে ইসলামী বইপুস্তকের সাথে পুড়ে যায় বেশ কিছু কুরআনও। আশ্চর্যজনক হলো, যে আলেম উলামারা সারা জীবন কুরআনকে ধারণ করেন, কুরআনের আন্দোলনের জন্যই মাঠে নেমে রক্ত ঝরাচ্ছেন, তাদের উপরই এই নাশকতার দায়ভার চাপায় একশ্রেণীর বামঘেষা নাস্তিকবাদী মিডিয়া ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।
উপসংহার
নাস্তিক ও বাম মতাদর্শ প্রভাবিত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এই দেশ পরিচালনায় সকল ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। একের পর এক দুর্নীতি, কেলেংকারী, শেয়ার বাজার ধ্বস, গার্মেন্টস সেক্টর ধ্বংস করে দেশের অর্থনীতিকে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে পুরোমাত্রায়। আর তাই বাংলাদেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়ে জঙ্গীবাদের ধুঁয়া তুলে বিদেশী শান্তিরক্ষী বাহিনী আনার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। সুষ্ঠ নির্বাচন হলে এই দুর্নীতিবাজ দলটি কোনভাবেই আবার ক্ষমতায় আসতে পারবে না তা আজ সকলের সামনেই সুস্পষ্ট। সে কারণেই দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধপরিস্থিতি করে হামিদ কারজাই হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এই ক্ষমতালিপ্সার জন্য তিনি হাজার হাজার নিরীহ শান্তিপ্রিয় আলেমে দ্বীন ও মুসল্লিদের উপর বর্বরতম হত্যাকান্ড চালাতেও দ্বিধাবোধ করছেন না। এইসকল আলেমদের কোন ক্ষমতালিপ্সা ছিলো না, ছিলো না কোন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস। শুধুমাত্র ইসলাম ও আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) অবমাননার প্রতিবাদেই তারা নেমে এসেছিলেন রাজপথে। কিন্তু যে কোন বিরোধী দল-মতকে স্তব্ধ করে দেয়ায় সুপটু এই স্বৈরাচারী সরকার ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা চালিয়ে তাদের দমন করার চেষ্টা করেছে। জাতির এই বিপর্যয়কর মুহুর্তে আসুন আমরা ধৈয্যধারণ করে মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করি। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সর্বশক্তিমান ও সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারকারী। এছাড়াও নিজ নিজ এলাকায় জনসচেতনতা গড়ে তুলুন, আলেমে দ্বীনদের যৌক্তিক দাবীর সাথে একাত্নতা ঘোষণা করুন এবং যে কোন মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখুন। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে আমরা এইসব হিংস্র ষড়যন্ত্রকারী খুনীদের বধ্যভূমি কিংবা কোন বৈদেশিক অপশক্তির ক্রীড়াক্ষেত্র বানাতে দেবো না ইনশাআল্লাহ।
৫ই মে ২০১৩। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে ইসলামের ইতিহাসের একটি অধ্যায় সূচিত হলো। জয়-পরাজয়ের এই অধ্যায়ের সূচনা থেকে যে উপলব্ধি ও শিক্ষাগ্রহণ, তা এখানে লিখে রেখে যেতে চাই।
ঘটনার শুরুটা এরকম ছিলো :
৫ই মে ফজরের পর থেকেই ঢাকার ৬টি প্রবেশমুখে লক্ষ লক্ষ মানুষের অবরোধ, বেলা বাড়ার সাথে সাথে মোট সংখ্যা ৫০ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। উপস্থিত পুলিশদেরকে নিজেদের খাবার-পানি-শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করলো হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা। দুপুর থেকে সেই অ্যাপ্যায়নের জবাব হিসেবে গুলি করে হত্যাযজ্ঞ শুরু হলো, এবং থেমে থেমে চলতে লাগলো। আন্দোলনের নেতা আহমদ শফি সাহেব মতিঝিলের মঞ্চে পৌঁছাতে পারলেন না নিরাপত্তার অভাবে। অনির্দিষ্টকালের অবস্থান শুরু হলো মতিঝিলে। সন্ধ্যার আগ দিয়ে জনতার ভিড়ের মধ্য দিয়ে দুটি লাশ প্রবেশ করলো মঞ্চে; সেই লাশ দেখে কান্না উত্তেজনায় পরিণত হলো। মানুষজন রাস্তার আইল্যান্ডের গাছের ডাল ভেঙে নিতে শুরু করলো। এটি ছিলো বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে দেবার ডিসাইসিভ মোমেন্ট। ইতিহাস বদলে দেবার জন্য তখন প্রয়োজন ছিলো শুধু একটি নির্দেশের : রক্তের বদলা নিতে যুদ্ধে নেমে পড়া। পরিবর্তে নির্দেশ এলো শান্ত থাকার, ধৈর্য ধারণ করার এবং জিকির করার। কিন্তু শয়তান আরো দ্রুত কাজ করছিলো।
পল্টনে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলছিলোই, এমতাবস্থায় গভীর রাতে যা করা হলো :
বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে পুরো এলাকা অন্ধকার করে দেয়া হলো, বিভিন্ন টিভির লাইভ সম্প্রচার তো আগেই জোরপূর্বক বন্ধ করেছিলো, সেইসাথে উপস্থিত সকল মিডিয়াকর্মীকে সরিয়ে দেয়া হলো স্পট থেকে। দিগন্ত টিভির সম্প্রচার যন্ত্র খুলে নিয়ে যাওয়া হলো, বন্ধ হয়ে গেলো দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার। এরপর রাত আড়াইটায় কিছু জিকিররত এবং কিছু ঘুমন্ত ও ক্লান্ত মানুষের উপর তিন বাহিনীর ১০-১২ হাজার সদস্য ক্র্যাকডাউন শুরু করলো। RAB, পুলিশ ও বিজিবি হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ির ছাদ থেকে প্রফেশনাল শ্যুটার দিয়ে গুলিবর্ষণ এবং মাটিতে থাকা বাকি সকলে থামতে নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ৪০-৪৫ মিনিট ধরে গুলি চালালো। সেইসাথে পিপার স্প্রে, জলকামান, হ্যান্ড গ্রেনেড, সাউন্ড গ্রেনেডসহ হেভি আর্টিলারি, রায়টকার ছিলো। লক্ষ লক্ষ ক্লান্ত, নিস্তেজ ও ঘুমন্ত মানুষের মাঝে যারা বেঁচে পালাতে পারলো, তাদেরকেও ঢাকার সীমানা ত্যাগ করার আগেই খুঁজে খুঁজে ধরে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হলো। আর কিছু অংশে অভিযানের নাটক চিত্রায়িত করা হলো, এবং এতক্ষণ অনুপস্থিত থাকা সময় টিভি, একাত্তর টিভি, এরা সেগুলো ধারণ করলো : পিকআপ ও বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকা হেফাজত কর্মীদেরকে পুলিশ গুলি করছে না, এমনকি লাঠি দিয়ে মারছেও না, কেবল লাঠি দিয়ে মারের ভঙ্গি করে ভয় দেখিয়ে "যা, ভাগ, পালা, দৌড় দে" ইত্যাদি বলে তাড়িয়ে দিচ্ছে। অল্প কয়েকজন পড়ে থাকা মানুষকেও ভিডিও করলো তারা। কিন্তু বাকি লক্ষ লক্ষ মানুষ কোথা দিয়ে কিভাবে কোথায় গেলো এবং তাদের কী হলো, সেই শাপলা চত্বরের চতুর্দিকের ভিডিও তারা দেখালো না।
ভোর হবার আগেই ৮-৯টি বা তারও বেশি (২৫টিও হতে পারে) ময়লার ট্রাকে করে লাশ গুম করা হলো। রক্তের চিহ্ণ যথাসম্ভব মুছে ফেলা হলো। ফজরের নামাজ শেষে উঠে ল্যাপটপে অসংখ্যা লাশের ছবি-ভিডিও দেখলাম, কিন্তু সবই ফেইসবুকে, মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলোতে নয়। যারা কাভার করতো, তাদের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো আগেই।
কেউ কখনোই সঠিক জানবে না সেই এক-দেড় ঘন্টার গণহত্যায় আসলে কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ইসলামবিরোধী পত্র-পত্রিকাগুলো ৩, ৫, ৮ ইত্যাদি লিখছে, কেউবা বলছে ৫০-৫২, আর ফেইসবুকের ছবিতে অসংখ্য। অনেকে গোপন সূত্রে বিভিন্ন মিডিয়া কর্মী ও পুলিশ-বিজিবি সদস্যের বরাত দিয়ে বলছে যে কমপক্ষে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম দাবী করেছে ৩ হাজার আলেমকে হত্যা করা হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা আসলেই অজানা, সেটা এমনকি দশ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
উপলব্ধি এই যে, মুসলমানের জীবনের দাম সংখ্যা দিয়ে নিরূপন হয় না। যখন থেকে আমরা মুসলমানের মৃত্যুর "সংখ্যাকে" দাম দিতে শুরু করেছি; যখন থেকে ৫ এর চেয়ে ১০ এর দাম বেশি, তার চেয়েও আমাদের কাছে দাম বেশি ১৫০ জনের কিংবা আজকের শহীদ ৩০০০ জনের, তখন থেকেই আমরা শহীদের সিঁড়িতে উঠে পড়েছি।
যখন ৫ জন মুসলমানকে হত্যার বদলা না নিয়ে আমরা "পাঁচ জন !" এই সংখ্যার ভয়াবহতা নিয়ে পড়লাম, তখন শয়তান জেনে গেলো যে ৫ জনকে হত্যা করলে তারা পার পেয়ে যাবে। যখন এ বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে ১৫০ এর বেশি মানুষকে হত্যা করলো তারা, এবং আমরা বদলা না নিয়ে, পাল্টা আঘাত না করে শত্রুর পাশবিকতার প্রমাণস্বরূপ সংখ্যা নিয়ে প্রচারণা-ব্যবসা শুরু করলাম; হত্যার বদলা নেবার চেয়ে "১৫০" সংখ্যাটির ভয়াবহতা প্রচার আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো, তখন শত্রু বুঝে গেলো যে, ১৫০ জনকে হত্যা করলে তারা পার পেয়ে যাবে, আমরা বদলা নেবো না। যখন ৫ই মে দিবাগত রাতে ৩ হাজারে অধিক মানুষকে তারা হত্যা করলো, এবং আমরা বদলা না নিয়ে দোয়া দিবস পালন এবং সংখ্যা নিয়ে শত্রুর সাথে কাড়াকাড়ি শুরু করলাম, তখন তারা ৩ হাজারের অধিক মানুষকে হত্যা করার সাহস পেয়ে গেলো; জেনে গেলো যে ভবিষ্যতেও যখন তারা ৩ হাজার মানুষকে শহীদ করবে, তখনও আমরা শত্রুর সাথে সংখ্যা নিয়েই কাড়াকাড়ি করবো, এবং তাদের কাছে ও বিশ্বের কাছে বৃহৎ সংখ্যার প্রমাণ হাজির করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকবো।
মুসলমানের জীবন তো পয়সার মত খরচ করার জিনিস নয় যে যত খরচ করবো, তত দামী জিনিস বিনিময়ে পাবো ! এটা তো এমন নয় যে ৩০ জনের জীবনের বিনিময়ে একদিনের হরতাল কিনবো, ১৫০ জনের জীবন খরচ করলে বিখ্যাত আলেমকে মুক্ত করতে পারবো, ৩ হাজার জনের জীবন খরচ করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাবো, আরো ৫ হাজার খরচ করলে সরকারে যাবো আর লক্ষাধিক জীবন খরচ করলে ইসলামী রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবো ! মুসলমানের জীবন তো পয়সার মত খরচ করার জিনিস নয় ! শহীদের সংখ্যার যেই সিঁড়িতে আমরা উঠতে শুরু করেছি, অতি সত্ত্বর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তা থেকে নেমে সমতলে না আসলে আমরা আল্লাহর কাছে জালিমের সহায়তাকারী হিসেবে পরিগণিত হবো। এবং এই ক্ষতির চেয়ে বড় ক্ষতি আর নাই।
৫ই মে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে ইসলামের ইতিহাসের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। এর সূচনাকারী মাহমুদুর রহমান, প্রথম নেতৃত্বদানকারী আল্লামা আহমদ শফী; এবং এই অধ্যায়ের কেবল শুরু : এতে আরো নাম যুক্ত হবে ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশের গণ মুসলমান বড় আশা করে হেফাজতে ইসলাম ও আহমদ শফী সাহেবের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ৫ই মে দিবাগত রাতের হত্যাযজ্ঞের পর তাদের অনেকেরই হয়তো আশাভঙ্গ হয়েছে, অনেকেই হতাশ হয়েছেন। কাফির-মুনাফিকদের কথায় পরে আসছি, কিন্তু আমরা ইসলামপন্থীরা ৫ই মে তে একদল জয়ী হয়েছি, এবং একদল হয়েছি পরাজিত। জয়ী হয়েছেন সেই লক্ষ লক্ষ মানুষ, যারা সৎ নিয়তে আল্লাহ-রাসূলের ভালোবাসায় জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমেছেন, এবং সেই মানুষেরা, যারা শহীদ হয়েছেন। যারা সেদিন মাঠে নেমেছিলেন, তারা পরকালের জন্যে অসীম পাথেয় সংগ্রহ করে পাপমুক্ত হয়েছেন, আর যারা শহীদ হয়েছেন, তারা অতি দ্রুত প্রতিশ্রুত পুরষ্কার পেয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গিয়েছেন। এই সান্নিধ্য আমাদের অতি নিকটে অবস্থান করে, যেকোনো মুহুর্তে চলে যেতে হতে পারে তাঁর কাছে।
আজকের এই গুম হয়ে যাওয়া বিকৃত লাশগুলো জান্নাতের সুবাতাস লাভে এখন ধন্য। অপরদিকে পরাজিত হয়েছে তারা, যারা সামর্থ্য ও দায়িত্ব সত্ত্বেও পথে নামে নাই, যারা আজকে এই গণহত্যা অবলোকন করলো, যারা অতীতেও করেছে, এবং যারা হয়তো ভবিষ্যতেও করবে। তারা পরাজিত হয়েছে, তারা জান্নাতের প্রতিশ্রুতি কিনতে পারে নাই। আর জয়ী হয়েছে তারা, যারা শহীদি মৃত্যুর মাধ্যম সেই প্রতিশ্রুতি কিনে নিয়েছে; আর পুরষ্কার পেতে তাদের বিলম্বও হয়নি।
(কার্যতঃ) গ্রেফতার হবার আগে আল্লামা আহমদ শফী সকলকে সর্বোচ্চ সংযম ও ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন। এই আদেশে অনেকে ক্ষুব্ধ, অনেকে মনোক্ষুণ্ম। বিজয় সবসময় প্রত্যাশিত পথে আসে না। বিজয় একদিনেও অর্জিত হয় না। ধৈর্য ধারণ ও শান্ত থাকা এই সময়ের সবচে' কঠিন এবং সবচে' গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে এই শান্ত হবার মানে নমনীয় হওয়া নয়। যখন আমি এই ব্লগ লিখছি, তখনও থেমে থেমে সরকারী সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচারে হেফাজত কর্মীসহ সাধারণ মুসল্লিদের চিৎকার, কান্না কানে ভেসে আসছে, আজ ফজরের পর থেকেই এমনটা চলছে। এই শান্ত হওয়ার মানে নমনীয় হওয়া নয়, এই ধৈর্য ধারণের মানে দায়িত্ব ও কর্ম ত্যাগ করা নয়। এই ধৈর্য ও সংযম এর অর্থ বিচার-বিশ্লেষন, শিক্ষা গ্রহণ ও উপলব্ধি। এর অর্থ দৃঢ়তা অর্জন, এবং মাহমুদুর রহমান ও আল্লামা শফী যেই আলোর ঝাণ্ডা উত্তোলন করেছেন, সময়ের সাথে তা বহন করা।
বৈশ্বিক ইসলামী গণজাগরণের বাংলাদেশের চিত্র আমরা অবলোকন করছি। এই ইতিহাসের আমরা সাক্ষী। প্রতিশ্রুত সেই বিজয় সন্নিকটে। এখন আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে কাফির-মুনাফিক শনাক্ত করা। দায়িত্ব হয়ে পড়েছে তাদেরকে সর্বাবস্থায় বর্জন করা, হোক সে বহু বছরের বন্ধু, হোক হে স্বামী, স্ত্রী কিংবা ভাই-বোন। বিশেষভাবে তরুণ সমাজসহ এদেশের গণ মানুষের নৈতিকতা ধ্বংসের যে চেষ্টা গত ত্রিশ বছর ধরে চলে আসছিলো, যার পিছনে দেশী-বিদেশী শক্তির লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়, এবং যেটা গত কয়েক বছরে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিলো, তার সবকিছু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো মাহমুদুর রহমান ও আহমদ শফীর নেতৃত্বে। যাদেরকে ইসলাম বিমুখ করার জন্য শয়তানের এত শ্রম, এত চেষ্টা, সেই তরুণ ছেলে-মেয়েরাই ইসলামের পথে অধিক ঝুঁকে পড়লো। যে ছেলে-মেয়েরা ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাসের কিছুই জানতো না, তারাই আজকে ইসলামের পথে চলে আসছে, এবং তাদের এই পরিবর্তন হচ্ছে খুব দ্রুত। ইসলামের পক্ষের এই ডেসপারেট তরুণেরাই ভবিষতে এদেশে ইসলামের পতাকা বহন করবে ইনশাআল্লাহ।
একজন মুসলমানের জীবনব্যাপী দায়িত্ব হলো ইসলামের জ্ঞান অর্জন এবং তার প্রচার-প্রসার করা। পাশাপাশি অন্যায়-অনাচার দেখলে তার প্রতিবাদ ও প্রতিহত করাও দায়িত্ব। আমাদের আশেপাশে মানবতার এত দলন, ইসলামের এত বেশি অবমাননা ও মানুষের উপর এত বেশি অন্যায়-অবিচার যে তার হিসাব করে শেষ করা যাবে না। এগুলো মানুষকে ইসলামের দিকে আরো টেনে এনেছে সত্য, তবে যে সংযম ও ধৈর্য ধারণের চর্চা মুসলমান হিসেবে আমাদের সারা জীবনই করতে হবে, তা যেনো এই অন্যায়-অনাচারের প্রতিবাদ-প্রতিহতের কাছে গৌণ হয়ে না পড়ে। আমাদের মূল দায়িত্ব ইসলামকে জানা ও প্রচার-প্রসার করা। যখন ইসলামের আলোয় প্রতিটা মানুষ আলোকিত হয়ে উঠবে, তখন মিথ্যা আপনা থেকেই দূরীভুত হয়ে যাবে। আমি জানি অসংখ্য মুসলমান আজকে দেশে-বিদেশে কাঁদছে, নামাজে মোনাজাতরত হাত ভিজে উঠছে, এবং এ-ও জানি যে যখনই মুসলমান আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দেন। আমাদের আবেদন, আমাদের সত্য কর্ম নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে পৌঁছেছে, এবং আল্লাহ অবশ্যই তাতে সাড়া দিয়েছেন। আমাদের শুধু ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে সঠিক পথে অবিচল থাকতে হবে : আল্লাহ-ই তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন।
আমাদের অনেক ভুল, অনেক ভ্রান্তি। জ্ঞান অর্জন, তার প্রচার-প্রসার এবং ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার পাশাপাশি সর্বদা আল্লাহর কাছে দিকনির্দেশনা চাইতে হবে, ক্ষমা-প্রার্থনার মাধ্যমে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, এবং তিনিই উত্তম কুশলী।
নূরে আলম
মে ৭, ২০১৩।
http://nure-alam.blogspot.com/2013/05/blog-post.html
হেফাজতের ইসলামের বিবৃতি
৩ হাজার নেতা-কর্মীর শাহাদাত॥ আহত ১০ সহস্রাধিক॥ নিখোঁজ অসংখ্য
পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি’র সমন্বয়ে যৌথবাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের যুগপৎ হামলায় রাজধানীর মতিঝিলস্থ শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে রোববার গভীর রাতে ঘুমন্ত আলেম-ওলামাদের ওপর নির্বিচারে গুলী, বোমা, গ্রেনেড, টিয়ারশেল এবং রাবার বুলেট নিক্ষেপের মাধ্যমে প্রায় ৩ হাজার আলেম-ওলামা ও হেফাজত নেতা-কর্মীদের হত্যা এবং শহীদদের লাশ গুমের তীব্র নিন্দা-প্রতিবাদ ও শহীদদের রূহের মাগফেরাত কামনা করে বিবৃতি দিয়েছেন সংগঠনের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরীর যুগ্ম আহ্বায়ক মাওলানা জাফরুল্লাহ খান প্রেরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, নেতৃগণ বলেন, সরকার দেশ থেকে ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধ ধ্বংস করতে নানাবিধ ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তারা ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তারা বিভিন্নভাবে দেশের স্বনামধন্য ও বরেণ্য আলেম-ওলামাদের চরিত্র হননের আয়োজন করে যাচ্ছে। সরকার ইসলামের মর্মমূলে আঘাত করার জন্যই আত্মস্বীকৃত নাস্তিক-মুরতাদের শাহবাগের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চে নামিয়ে ইসলাম, নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছে। এসব শাহবাগীদের অপতৎপরতা রোধে দেশের আলেম-ওলামাসহ ইসলামপ্রিয় জনতা ফুঁসে উঠেছে এবং আত্মস্বীকৃত নাস্তিক-মুরতাদ ও নবী-রাসূল অবমাননাকারীদের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন শাস্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৫ মে ঢাকা অবরোধ ও বিকেলে থেকে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে লাগাতার অবস্থানের কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা আলেম-ওলামা, ইসলামপ্রিয় জনতা ও হেফাজতের নেতা-কর্মীরা শাপলা চত্বরে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। অবরোধ চলাকালে ১৩টি পয়েন্টে সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী ও সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা তোহিদী জনতার ওপর হামলা চালিয়ে বহু সংখ্যক মানুষকে হতাহত করেছে। তারা শাপলা চত্বরমুখী তৌহিদী জনতার ¯্রােতে পথে পথে বাধা প্রদান, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। এমন কী তারা পবিত্র কুরআন শরীফে অগ্নিসংযোগ করে এর দায়ভার চাপিয়েছে তৌহিদী জনতার ওপর। তাদের জিঘাংসা থেকে রাস্তার দু’পাশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা রক্ষা পাননি। এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা হেফাজতের আন্দোলনের অংশ হলেও সরকারের মদদপুষ্ট মহল বিশেষ এসবের দায়ভার জনতার ওপর চাপাচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে পবিত্র কুরআন শরীফে অগ্নিসংযোগের জন্য ছাত্রলীগ-যুবলীগকে দায়ী করে সংবাদ প্রকাশিত হলেও এর দায়ভার চাপানো হচ্ছে হেফাজতের ওপর। কিন্তু দেশের ইসলামপ্রিয় জনতা সরকারের এ অপপ্রচারে কখনোই বিভ্রান্ত হবে না বরং এসবের যথোপযুক্ত জবাব দেবে।
তারা বলেন, দিনব্যাপী কর্মসূচি পালনের পর তৌহিদী জনতা ও আলেম-ওলামাগণ উন্মুক্ত আকাশের নিচে যখন গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন তখন আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার ঘুমন্ত জনতার ওপর পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও দলীয় সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে নির্বিচারে গুলী, বোমা, গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করতে শুরু করে। রাতের অন্ধকারে এমন বর্বোরোচিত ও কাপুরোষিত হামলায় তৌহিদী জনতা খালি হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় ও অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের আঘাতে একের পর এক শাহাদাত বরণ করতে শুরু করেন। এতে ঘটনাস্থলেই প্রায় তিন হাজার তৌহিদী জনতা শাহাদাত বরণ করেন এবং ১০ হাজারেরও অধিক আহত হন। তারা রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। শহীদদের লাশ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ট্রাকে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। এখনও অগণিত নেতা-কর্মী নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের পরিবার-পরিজন, শুভাকাক্সক্ষী ও শুভান্যুধায়ীরা তাদের কোনো খোঁজ না পেয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন।
তারা আরও বলেন, সরকার ঈমানী আন্দোলনকে দমন করার জন্য যত অপচেষ্টাই করুক না কেন তারা কখনোই সফল হবে না। জুলুম-নির্যাতন, হত্যা-সন্ত্রাস, গুম যত বাড়বে তৌহিদী জনতার আন্দোলন ততই শাণিত হবে। হত্যা-সন্ত্রাস চালিয়ে অতীতে ফেরাউন, নুমরূদ ও হামানদের শেষ রক্ষা হয়নি আওয়ামী লীগও শেষ রক্ষা করতে পারবে না। তারা এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ এবং সকল স্তরের জনতার প্রতি সর্বোচ্চ সংযম ও ধৈর্য ধারণের উদাত্ত আহ্বান জানান এবং শহীদদের রূহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করেন ও সৃষ্ট যেকোনো পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ থেকে আগামী দিনে ঘোষিত সকল কর্মসূচি সর্বাত্মকভাবে সফল করার আহ্বান জানান। প্রেস বিজ্ঞপ্তি।
মহাজোটের চার গণহত্যা
কাদের গণি চৌধুরী
শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত চার বছরে চারটি বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশে। এসব গণহত্যায় জীবন গেছে নিরীহ মানুষ, পোশাক শ্রমিক, আলেম, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ ও বিডিআর সদস্যদের। তবে সবচেয়ে বেশি প্রাণ গেছে আলেম-ওলামাদের। রোববার মাঝ রাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে জিকিররত আলেমদের বুকে একযোগে গুলি চালিয়েছে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও সরকারি দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা। চারদিক
থেকে আসতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজার হাজার রাউন্ড গুলি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি এসে বিঁধতে থাকে আলেমদের বুকে। গুলিবিদ্ধ পাখির মতো রক্তাক্ত অসংখ্য আলেমকে পড়ে থাকতে দেখা যায় রাস্তায়। আলেমদের সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর তসবিহ রক্তে ভিজে চুবচুব করছিল। মতিঝিলের পিচঢালা কালো রাস্তা আলেম-ওলামাদের রক্তে লালে লাল হয়ে যায়। এত রক্ত ধুয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে হিমশিম খেতে হয় সরকারি কর্মচারীদের। আল্লাহ-রাসুল (সা.)-এর ইজ্জত রক্ষার দাবি নিয়ে এসে এসব আলেমকে জীবন দিতে হলো।
রাত আড়াইটার দিকে সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন পড়ে আছে অনেকের নিথর দেহ। আবার অনেকে বেঁচে থাকার আকুতি জানাচ্ছিলেন সরকারি বাহিনীর কাছে। বাধার কারণে ছবি তুলতে পারেনি ফটোসাংবাদিকরা। দিগন্ত টিভি কিছু কিছু ফুটেজ সরাসরি দেখাচ্ছিল বলে চ্যালেনটি তাত্ক্ষণিক বন্ধ করে দেয়া হয়। একই কারণে বন্ধ করে দেয়া হয় ইসলামিক টিভির সম্প্রচার।
কত লোককে হত্যা করা হয়েছে, সে হিসাব এখনও মেলেনি। হেফাজতের দাবি, শত শত আলেম ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান হত্যা করা হয়েছে। একই দাবি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের সবাই একমত যে, মহাজোট সরকারের এ গণহত্যা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যাকেও হার মানিয়েছে।
এদিকে গত মার্চে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে তৌহিদি জনতা মিছিল বের করলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে একশ’রও বেশি মানুষকে হত্যা করে। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর ও বেদনাদায়ক ট্র্যাজেডি পিলখানা হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি। এতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গত ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজায় ডেকে নিয়ে শত শত নিরীহ গার্মেন্ট শ্রমিককে ভবন ধসে হত্যা করা হয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত ৬৭৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও চলছে এ উদ্ধারকাজ। নিখোঁজ রয়েছে সহস্রাধিক শ্রমিক।
বিডিআর হত্যাযজ্ঞ : মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র দেড় মাসের মাথায় দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর ও বেদনাদায়ক ট্র্যাজেডি বিডিআর বিদ্রোহ ও সেনা কর্মকর্তা হত্যাযজ্ঞ। এতে প্রাণ হারায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। সেদিনের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারগুলো। সেসব পরিবার আজও কাঁদছেন। কেন এ হত্যাযজ্ঞ, এর নেপথ্যে কারা ছিল—এসব প্রশ্নের জবাব ও ট্র্যাজেডির নেপথ্য রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের ৫১ জন সামরিক কর্মকর্তা শহীদ হয়েছিলেন। আর ২০০৯ সালে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র দু’দিনের বিদ্রোহে পিলখানায় ৫৭ জন কর্মরত সেনা কর্মকর্তা, একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, দু’জন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ জন বিডিআর জওয়ান, পিলখানার বাইরে সেনাবাহিনীর এক সিপাহি, এক পুলিশ কনস্টেবল ও তিন পথচারী নিহত হন। ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানার সুয়্যারেজ লাইন দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়েছিল ৩ সেনা কর্মকর্তার লাশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণের পর ২৭ ফেব্রুয়ারি মাটিচাপা অবস্থায় পাওয়া গেছে লাশের স্তূপ। অর্ধশত সাহসী ও নির্ভীক সেনা কর্মকর্তার সারি সারি লাশ দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল দেশের মানুষ।
দরবার হলের সিসিটিভি’র রেকর্ড থেকে পাওয়া তথ্য ও তদন্ত অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২ মিনিটে পিলখানার দরবার হলে বিডিআরের বার্ষিক দরবার শুরু হয়। দরবারে উপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ৫৬০ জন। সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে ডিজি বক্তব্য দেয়ার সময় মঞ্চের বাম দিক থেকে অস্ত্র হাতে দরবার হলে প্রবেশ করেছিল একজন সিপাহি। তার পিছু পিছু প্রবেশ করে আরও দুজন। তাদের একজন দরবার হলে প্রবেশ করে ডিজির দিকে অস্ত্র তাক করে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে। ডিডিজি ব্রিগেডিয়ার এম এ বারী অপর কয়েকজন কর্মকর্তার সহায়তায় তাকে নিরস্ত্র করেন। এরই মধ্যে দরবার হল থেকে বেরিয়ে যায় অন্য দুজন সিপাহি। তখন সিপাহিদের কেউ একজন ‘জাগো’ বলে চিত্কার শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে বিডিআর সদস্যরা অস্ত্র হাতে নিতে থাকে। আর এভাবেই শুরু সশস্ত্র বিদ্রোহের। সকাল সাড়ে নয়টায় ডিজি মে. জে শাকিল আহমদ নিজে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফোন করে সেনা হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান। কিন্তু তার কথায় কেউ সাড়া দেননি। বিদ্রোহীরা নিরাপত্তায় নিয়োজিত দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে অস্ত্রাগার লুট করে। সকাল সাড়ে দশটায় বিদ্রোহীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে দরবার হলে প্রবেশ করে এবং কর্মকর্তাদের বের হয়ে আসার নির্দেশ দেয়। ওই সময় ডিজিকে বৃত্তাকারে ঘিরে মানবপ্রাচীর তৈরি করে কর্মকর্তারা মঞ্চের পেছন দিক থেকে বেরিয়ে আসেন। আনুমানিক সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা সারিবদ্ধভাবে দরবার হল থেকে বেরিয়ে কয়েক সিঁড়ি নামামাত্রই মুখোশ পরা কিছু ব্যক্তি কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে। মুহূর্তেই ঢলে পড়েন ডিজিসহ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা। ১১টায় বিদ্রোহীরা গোলাবারুদ সংগ্রহ করে। ১১টা নাগাদ সেনাবাহিনীর একটি দল বিডিআর ৪ নম্বর ফটকের কাছে অবস্থান নেয়। এ সময় বিদ্রোহীরা প্রায় ১৬টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। বাইরে থেকে প্রচণ্ড ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়। দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারের মাধ্যমে লিফলেট ছুড়ে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। এ সময় বিদ্রোহীরা হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি করে এবং হেলিকপ্টারটিতে ৬টি গুলি লাগে। দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে বিদ্রোহীদের পক্ষে ৩ নম্বর গেটে একটি মিছিল বের হয়। এতে নেতৃত্ব দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী। তার ছেলে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী লেদার লিটনও বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত বলে বিভিন্ন তদন্ত ও স্বীকারোক্তিতে পাওয়া গেছে। এ কারণে লেদার লিটনকেও হত্যা মামলায় আসামি করা হয়। দুপুর ১২টার পর বিদ্রোহীরা প্রায় ২০ মিনিট এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বিদ্রোহীরা মাইকে ঘোষণা দেয়, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একা পিলখানায় যেতে হবে।
জানা গেছে, ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সাদা পতাকা নিয়ে ৪ নম্বর গেটে যান জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সরকারি দলের হুইপ মির্জা আজম। বেলা ৩টায় প্রতিমন্ত্রী নানক, এমপি ফজলে নূর তাপস ও হুইপ মির্জা আজমের সঙ্গে ৪ নম্বর ফটকে অবস্থানরত জওয়ানরা কথা বলতে রাজি হয়। বেলা ৩টা ৪০ মিনিটে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে যায়। যমুনার ওই বৈঠকে তিন বাহিনীর প্রধান উপস্থিত ছিলেন। এ সময় পিলখানার ভেতরে জওয়ানরা ট্যাঙ্কে করে টহল ও মুহুর্মুহু গুলি ছোড়ে। কিছুক্ষণ পরপর তারা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক ও ভীতি ছড়ায়। বিদ্রোহ শুরুর পর কিছু ব্যক্তি সেনা কর্মকর্তাদের বাসভবনে হামলা, লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে; বহু নারীর শ্লীলতাহানি ঘটায়। এ তাণ্ডবলীলা চলতে থাকে দু’দিন ধরে। এর মধ্যে ভয়ে বিভিন্ন স্থানে পরিচয় গোপন করে লুকিয়ে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করতে থাকে। ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছেন। সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে যমুনা থেকে বিদ্রোহীদের প্রতিনিধি দলকে নিয়ে পিলখানায় ফেরেন তিনি। সন্ধ্যা ৭টায় বিদ্রোহীরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে গেজেট আকারে প্রকাশ করার দাবি জানায় এবং একইভাবে গুলি ছুড়ে ভীতি ছড়াতে থাকে। সন্ধ্যার পর পিলখানার বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে গর্ত খুঁড়ে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পিলখানায় যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। রাত দেড়টায় বিদ্রোহীরা কিছু অস্ত্রসমর্পণ করে। উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় চলতে থাকা পরদিন বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন। দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। বিকাল সোয়া ৪টায় এক ডজনের বেশি ট্যাঙ্ক ধানমন্ডি এলাকায় অবস্থান নেয়। এ সময় পিলখানার আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকা থেকে সব লোককে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বিকাল ৫টায় বিদ্রোহীরা অস্ত্রসমর্পণ শুরু করে এবং পিলখানা থেকে পালিয়ে যেতে থাকে। এ সময় শত শত বিডিআর জওয়ান পিলখানা থেকে পালিয়ে যায়। সন্ধ্যা ৭টায় সমর্পণ করা অস্ত্র বুঝে নিতে পিলখানায় পুলিশ প্রবেশ করে। পরদিন ফায়ার সার্ভিস এবং পুলিশ নিহত ও নিখোঁজদের লাশের সন্ধান শুরু করে। পিলখানা হাসপাতালের মরচুয়ারির পূর্বপাশে গণকবর থেকে একসঙ্গে বের করে আনা হয় ৩৮ সেনা কর্মকর্তার লাশ। সারি সারি লাশ দেখে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা দেশ। স্বজনহারাদের আহাজারিতে সৃষ্টি হয় হৃদয়বিদারক দৃশ্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয় তিন দিনের শোক।
সাঈদীর ফাঁসির রায় পরবর্তী গণহত্যা : ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পরপরই প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সারাদেশ। রাস্তায় নেমে আসেন আলেম-ওলামা ও সাঈদী ভক্তরা। বিক্ষুব্ধ সাঈদী ভক্তদের ওপর ইতিহাসের বর্বর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে পুলিশ ও সরকারের পেটোয়া বাহিনী। এ হত্যাযজ্ঞ চলে সপ্তাহজুড়ে। এ সময় শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সাতক্ষীরায় ৮ জামায়াত-শিবির, ১ আ.লীগ কর্মী ও ১০ সাধারণ নাগরিকসহ ১৯ জন, বগুড়ায় ৭ জামায়াত-শিবির, ৩ মহিলা ও ১ শিশুসহ ১৪ জন, রংপুরে ১ পুলিশ সদস্যসহ ৯ জন, গাইবান্ধায় চার পুলিশ সদস্যসহ ৮ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের ৩ সহ ৭ জন, জয়পুরহাটে ৬, নোয়াখালীতে বিএনপি ও যুবদলের ২ জনসহ ৪ জন, রাজশাহীর বাঘায় ১ ও গোদাগাড়ীতে ২ জনসহ মোট ৩, সিরাজগঞ্জে ২, কক্সবাজারে ৩, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১ যুবলীগ কর্মীসহ ৪ জন, লোহাগাড়ায় ১ পুলিশ সদস্যসহ ২ জন, সাতকানিয়ায় ১ এলডিপি কর্মীসহ ৩ এবং মৌলভীবাজার, নাটোর, রাজধানীর মিরপুর, দিনাজপুর, বাঁশখালী, সোনাইমুড়ী, সিলেট, চট্টগ্রাম, কেরানীগঞ্জ, নীলফামারী, হরিণাকুণ্ড, সেনবাগ ও উল্লাপাড়ায় ১ জনকে হত্যা করা হয়। এ সময়ের মধ্যে পাঁচ সহস্রাধিক গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন অন্তত আরও ২০ সহস্রাধিক ব্যক্তি। আহতদের মধ্যে কয়েকজন পরবর্তীতে মারা যান।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর দেশব্যাপী বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের নির্বিচার গুলিবর্ষণে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এছাড়া শাসক দলের যুবলীগ-ছাত্রলীগের তাণ্ডবেও হত্যার শিকার হন অনেকে। একইভাবে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির হরতাল চলাকালে সৃষ্ট সহিংসতায় পুলিশসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন।
স্বাধীনতার পর মাত্র ৭ দিনে এতো হত্যাকাণ্ডের নজির নেই। মানবাধিকার সংস্থাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরা একে গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, স্বাধীনতার পর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ এটি। যদিও গত দু’দিনে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হামলা চালিয়ে এর চেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে নিহত পরিবারগুলোর করুণ চিত্র পাওয়া গেছে। পরিবারের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বনকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে নিহতদের পরিবার। সেখানে চলছে মাতম। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নিহতরা পরিবারের একমাত্র অবলম্বন ও উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় পরিবারগুলোতে অনেকেই এখন না খেয়ে দিনাতিপাত করছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সরকারের পক্ষ থেকে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর খোঁজখবর নেয়া তো দূরের কথা অধিকাংশ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে উল্টো পুলিশের পক্ষ থেকে এক বা একাধিক মামলা করায় তারা বর্তমানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পুলিশ নিরস্ত্র জনতাকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করলেও উল্টো পুলিশের শতাধিক মামলায় সারাদেশে লক্ষাধিক নাগরিককে আসামি করা হয়েছে। ফলে দেশজুড়ে চলছে পুলিশের গণগ্রেফতার অভিযান। অধিকাংশ এলাকায় এখন নাগরিকরা নিজ ভিটেবাড়ি ছাড়া হয়ে পালিয়ে যাযাবর জীবনযাপন করছেন। অনেক এলাকা এখন পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিনের সহিংসতায় গুলিবিদ্ধসহ গুরুতর আহতরা হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে গেলে সেখানেও সরকারের পেটুয়া বাহিনী পুলিশ ও দলীয় ক্যাডাররা হামলা চালাচ্ছে।
সাভারে গণহত্যা : গত ২৪ এপ্রিল সাভারে সংগঠিত হয় আরেক গণহত্যা। এ গণহত্যার শিকার হন অসংখ্য গার্মেন্ট শ্রমিক। সাভার থানা যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও স্থানীয় সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মুরাদ জংয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড সোহেল রানা জোর করে শত শত গার্মেন্ট শ্রমিককে ব্যবহারে সম্পূর্ণঅনুপযোগী একটি ভবনে ঢুকিয়ে হত্যা করে। এ পর্যন্ত এ গণহত্যায় ৬৭৬ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এখনও উদ্ধার হচ্ছে মরদেহ।
রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দেয়ার পর পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হয়। টিভি চ্যানেলেও বিপজ্জনক এ ভবন নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করে। গণহত্যার দিন গার্মেন্ট শ্রমিকরা ঝঁকিপূর্ণ এ ভবনে কাজ করতে রাজি না হলে রানার পক্ষে হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা করা হয় ‘দু-একটি ফিলার ফাটলে কিছুই হয় না। আপনারা কাজে যোগ দিন।’ এরপরও কেউ কেউ কাজে যোগ দিতে না চাইলে তাদের পিটিয়ে কাজে পাঠানো হয়। গার্মেট মালিকরাও শ্রমিকদের বেতন বন্ধ করে দেয়া ও চাকরিচ্যুতির হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে হতদরিদ্র গার্মেন্ট কর্মীরা কাজে যোগ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধসে পড়ে অভিশপ্ত ৯তলাবিশিষ্ট ভবন রানা প্লাজা। চাপা পড়ে এ ভবনের পাঁচটি গার্মেন্টে কর্মরত ৫ হাজারের মতো শ্রমিক । এ মৃত্যুপুরী থেকে গতকাল পর্যন্ত ২৪৩৭ জনকে জীবিত এবং ৬৭৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। স্বজনরা ঘটনাস্থল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডসহ আশপাশের হাসপাতাল এবং মর্গে খুঁজে ফিরছেন তাদের। উদ্ধার কাজের সঙ্গে যুক্ত রেডক্রিসেন্ট ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানিয়েছেন, গত দু’দিন ধরে উদ্ধারকৃত লাশগুলোর বেশিরভাগই পচে গেছে। লাশ বিকৃত হওয়ায় পোশাকের রঙ চেনার কোনো উপায় নেই। স্বজনরাও চিনতে পারছে না তাদের প্রিয় মানুষটিকে। তারপরও পকেটে থাকা মোবাইল ফোন এবং পরিচয়পত্র দেখে শনাক্ত করার চেষ্টা করছে রেডক্রিসেন্টের সদস্যরা।
গত ৪৮ ঘণ্টার ঢাকা , সৃষ্টি করলো বর্বরতার নতুন ইতিহাস : গত ৪৮ ঘণ্টার ঢাকা সৃষ্টি করেছে নতুন বর্বরতার ইতিহাস। হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে গত দু’দিন ধরে যেভাবে নির্বিচারে আলেমদের হত্যা করা হয়েছে দুনিয়ার ইাতহাসে এ নজির নেই। মাত্র ১৫ মিনিটের অপারেশনে অগণিত আলেমকে হত্যা ও আহত করা হয়েছে। মতিঝিলের পিচঢালা কালো রাস্তা আলেম-ওলামাদের রক্তে লালে লাল হয়ে গেছে। এ সব আলেম নবীজির (স.) ইজ্জত রক্ষার দাবিতে ঢাকা অবরোধ করতে এসেছিলেন। অবরোধ শেষে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ওলামা-মাশায়েখরা সমাবেশ করছিলেন মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। এ সমাবেশে যোগ দেন লাখ লাখ তৌহিদি জনতা। সমাবেশে আসার পথে আলেম ও মাদরাসা ছাত্রদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডাররা। আওয়ামী লীগের বিবি অ্যাভিনিউর কার্যালয়ের সামনে মাদরাসার এক ছাত্রকে যুবলীগ ক্যাডাররা পিটিয়ে হত্যা করে। আহত হন আরও অনেকে। এরপর শুরু হয় উত্তেজনা।
ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় গভীর রাতে। রাত আড়াইটার দিকে মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে দৈনিক বাংলা মোড় পর্যন্ত লাখো আলেম জিকির করছিলেন। কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। এরই মধ্যে হঠাত্ গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে মতিঝিল এলাকা। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আলেমদের বুকে একযোগে গুলি চালায় র্যাব, পুলিশ, বিজেপি ও সরকারি দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা। চারদিক থেকে আসছিল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। হাজার হাজার রাউন্ড গুলি। তপ্ত বুলেট এসে বিঁধছিল আলেমদের বুকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে পায়রার মতো রক্তাক্ত অসংখ্য আলেম লুটিয়ে পড়েন রাজপথে। আলেমদের সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর তসবি রক্তে ভিজে চুবচুব করছিল। মতিঝিলের পিচঢালা কালো রাস্তা আলেম-ওলামাদের রক্তে লালে লাল হয়ে যায়। এত রক্ত ধুয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে হিমশিম খেতে হয় সরকারি কর্মচারীদের। আল্লাহর রাসুলের ইজ্জত রক্ষার দাবি নিয়ে এসে এসব আলেমদের জীবন দিতে হলো।
রাত আড়াইটার দিকে সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন পড়ে আছে অনেকের নিথর দেহ। আবার অনেকে বেঁচে থাকার জন্য আকুতি জানাচ্ছিলেন সরকারি বাহিনীর কাছে। অবশ্য এক ঘণ্টার মধ্যে পুরো মতিঝিল এলাকা জনশূন্য করে ফেলা হয়। বাধার কারণে হতাহতের খুব একটা ছবি তুলতে পারেনি ফটো সাংবাদিকরা। দিগন্ত টিভি কিছু কিছু ফুটেজ সরাসরি দেখাচ্ছিল বলে ওই টিভি চ্যানেলটি তাত্ক্ষণিক বন্ধ করে দেয়া হয়।
এ গণহত্যা চলাকালে গুলি, টিয়ারশেল এবং সাউন্ড গ্রেনেডের আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মতিঝিল ও এর আশপাশের এলাকা। এখানকার বাসা-বাড়িতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা আশপাশের বিভিন্ন অলিগলিতে এমনকি গাছের ডালে আশ্রয় নেয়। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ওই সব অলি-গলিতেও হানা দেয়।
মতিঝিলে গণহত্যাই শেষ নয়, গতকাল দিনভর তৌহিদি জনতার সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশ, বিজেপি ও সরকারি দলের ক্যাডারদের। এতে অন্তত ১৯ জন গণহত্যার শিকার হন। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হত্যা করা হয়েছে ৪ জনকে। বাগেরহাটে হত্যা করা হয়েছে ২ জনকে।
0 comments: