‘বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস’ বইটিতে প্রায় দু’শ বছর যাবত মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের উৎপীড়ন অবিচারের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। অতীতের কথা কেউ কেউ মনগড়া মনে করতে পারেন। তাদের জন্য, বর্তমান সময়ে ভারতে কি হচ্ছে তা কি তারা দেখছেন না? সেখানে প্রতিনিয়ত রোমহর্ষক দাংগায় যে মুসলমানদেরকে নির্মূল করা হচ্ছে তা কি তারা দেখেন না? (বইটি ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত, উল্লেখ্য ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়)
“অত্র ইতিহাসটিতে মুসলিম জাতির গৌরবময় অতীত ইতিহাসের দিকে নতুন প্রজন্মের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। মুসলিম জাতির ইতিহাস কালের কোন এক সময় থেকে শুরু হয়ে অন্য এক বিশেষ সময়ে গিয়ে শেষ হয়নি। এ ইতিহাস শুরু হয়েছে প্রথম মানব হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর আগমন থেকে আর তা চলতে থাকবে দুনিয়ার শেষ দিন পর্যন্ত। তাই আমাদের অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেই সামনে অগ্রসর হতে হবে”।
বাংলায় মুসলমানদের প্রথম আগমন কবে হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে তা ১২০৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির দ্বারা নদীয়া জয়ের অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছিল। বখতিয়ার খলজীর আগমনের দ্বারা বাংলায় প্রথম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মুসলিমদের আগমন ঘটে, এরপর ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধ পর্যন্ত পাঁচশত চুয়ান্ন বছরের প্রায় পুরোটাই মুসলিমরা শাসন করেছে ঠিকই, কিন্তু এর মাঝেও আবির্ভাব ঘটেছে ইতিহাসের অনেক নায়ক খলনায়কের, যাদের মধ্যে ছিল অত্যাচারী হিন্দু রাজা গণেশ যে অতিমাত্রায় মুসলিম বিদ্বেষী ছিল, সে হত্যা করেছে বহু আলেম, অলী, দরবেশ মুসলিম মনীষী ও ধর্মপ্রাণ মুসলিম।
“একদা শায়খ মুঈনুদ্দীন আব্বাসের পিতা শায়খ বদরুল ইসলাম বিধর্মী রাজা গণেশকে সালাম না করার কারণে তিনি খুব ক্রুদ্ধ হন। অতঃপর তিনি উক্ত শায়খকে দরবারে তলব করেন, তাঁর কামরায় প্রবেশের দরজা এত সংকীর্ণ ও খাট করে বানানো হয় যেন, প্রবেশকারীকে আপনা আপনিই উপুড় হয়ে প্রবেশ করতে হয় বা কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে প্রবেশ করতে হয়। শায়খ রাজার মতলব বুঝতে পেরে প্রথমে তাঁর দুখানি পা কামরার ভিতরে রাখেন এবং মস্তক অবনত না করেই প্রবেশ করেন। রাজা গণেশ তাকে তৎক্ষণাত হত্যা করেন এবং অন্যান্যা আলেমগণকে একটি নৌকায় করে মাঝ নদীতে ডূবিয়ে মারেন”।
অথচ এই রাজা গণেশের পুত্র ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি ইতিহাসে জালাল উদ্দিন শাহ (পূর্বনাম যদু) হিসেবে খ্যাত।
আমাদের এই বাংলার ইতিহাসেই রয়েছে কিভাবে হোসেন শাহ নামক এক শাসকের আগমন ঘটে এবং তার মাধ্যমে সমাজে ব্যাপক শিরক আর বিদ’আতের প্রসার ঘটে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে, পৌত্তলিকতায় আক্রান্ত মুসলিম সমাজ নিজেদের আর হিন্দুদের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে না পেয়ে উভয়ের সংস্কৃতিকে এক ও অভিন্ন করার হাস্যকর প্রচেষ্টা চালিয়েছে !
ফরায়েজী আন্দোলনঃ
মুসলিমদের থেকে খাজনা আদায়ের ভার দেয়া হল হিন্দুদের উপর। নতুন প্রভুকে সন্তুষ্ট করার জন্যে তারা প্রজাদের উপর শুরু করল নির্মম শোষণ-পীড়ন। বিলাতী বস্ত্রের বাজার তৈরি করার জন্যে তাঁতীদের নির্মূল করা হল (১৭৭০-১৮২৫)। ১৭৬৬ সালে প্রতিমণ লবণের উপর দুটাকা হারে কর ধার্য করে লবণ ব্যবসা ইউরোপীয়দের হাতে একচেটিয়া করে দেয়া হল। এভাবে সকল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে থেকে বিতাড়িত করে মুসলিমদের দারিদ্রে নিক্ষেপ করা হল।
শুধু তাই নয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনেও মুসলমানরা বাধাগ্রস্ত হতে লাগলেন। অত্যাচারী হিন্দু জমিদারেরা এলাকায় গরু কুরবানী ও আযান নিষিদ্ধ করলেন। প্রজাদের দাড়ির উপর খাজনা আরোপ করা হল ! আর পূজাপার্বণে মুসলিমদেরকে চাঁদা দিতে, পূজার যোগান ও বেগার দিতে বাধ্য করা হল। মুসলমানদেরকে ধূতি পরতে ও দাঁড়ি কামিয়ে গোঁগ রাখতে বাধ্য করা হল। মুসলিমদের ধর্ম, তাহজিব তমদ্দুনকে ধ্বংস করে হিন্দুজাতির মধ্যে একাকার করে ফেলার এক সর্বনাশা পরিকল্পনা শুরু হল। ধর্মপ্রাণ মুসলিম হয়ে উঠলো দিশেহারা। বাংলার মুসলিমদের এহেন চরম দুর্দিনে ১৭৮৪ সালে ফরিদপুরে জন্ম গ্রহণ করেন হাজী শরীয়তুল্লাহ।
শহীদ তিতুমীর ও অত্যাচারী জমিদার কৃষ্ণদেবঃ
“তিতুমীর কৃষ্ণদেব রায়কে একখানা পত্র মারফত জানিয়ে দেন যে, তিনি কোন অন্যায় কাজ করেননি, মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ করছেন। এ কাজে হস্তক্ষেপ করাতো কোন ক্রমেই ন্যায়সংগত হতে পারে না। নামায পড়া, রোযা রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছাটা ইত্যাদি মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় নির্দেশ। এ কাজে বাধা দান করাতো ধর্মের উপর বাধা দান করা।
তিতুমীরের জনৈক পত্রবাহক কৃষ্ণদেব রায়ের হাতে পত্রখানা দেয়ার পর কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তাও পাঠক সমাজের জেনে রাখার প্রয়োজন আছে।– এখানে তা উল্লেখ করা হল
পত্রখানা কে দিয়েছে জিজ্ঞাসা করলে পত্রবাহক চাঁদপুরের তিতুমীর সাহেবের নাম করে। তিতুমীরের নাম শুনেই জমিদার মশাইয়ের গায়ে আগুন লাগে। রাগে গরগর করতে করতে সে বল্লো, কে সেই ‘ওহাবী’ তিতু? আর তুই ব্যাটা কে?
নিকটে জনৈক মুচিরাম ভাণ্ডারী উপস্থিত ছিল। সে বললো, ওর নাম আমন মণ্ডল। বাপের নাম কামন মণ্ডল। ও হুজুরের প্রজা। আগে দাড়ি কামাতো, আর এখন দাড়ি রেখেছে বলে হুজুর চিনতে পারছেন না।
পত্রবাহক বললো, হুজুর আমার নাম আমিনুল্লাহ, বাপের নাম কামাল উদ্দীন, লোকে আমাদেরকে আমান-কামল বলে ডাকে। আর দাড়ি রাখা আমাদের ধর্মের আদেশ। তাই পালন করছি।
কৃষ্ণদেব রাগে থর থর কাপতে থাকে আর বললো, ব্যাটা দাড়ির খাজনা দিয়েছিস, নাম বদলের খাজনা দিয়েছিস? আচ্ছা দেখাচ্ছি মজা। ব্যাটা আমার সাথে তর্ক করিস, এত বড় স্পর্ধা! এই বলে মুচিরামের উপর আদেশ হল তাকে গারদে বন্ধ করে উচিৎ শাস্তির। বলা বাহুল্য, অমানুষিক অত্যাচার ও প্রহারের ফলে তিতুমীরের ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ হলেন আমিনুল্লাহ। সংবাদটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল”।
এই অত্যাচারী জমিদারের কিছু যুলুম,
১. দাড়ির উপর সেই আমলের আড়াই টাকা হারে খাজনা আদায় ও গোঁফ ছাটার জন্যে পাঁচ সিকা খাজনা
২. মসজিদ নির্মাণের উপর পাঁচশ এবং পাকা মসজিদ হলে এক হাজার টাকা করে জমিদার সরকারে নজর দিতে হবে।
৩. আরবী নাম রাখলে প্রত্যেক নামের জন্য পঞ্চাশ টাকা ফি
৪. গো হত্যা করলে ডান হাত কেটে নেয়া হবে ইত্যাদি
“আব্দুল গফুর সিদ্দিকী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বের কিছু ঘটনা বর্ণণা করে বলেন, কর্ণেল স্টুয়ার্ট তিতুমীরের হুজরা ঘরের সম্মুখস্ত প্রধান প্রবেশদ্বারের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে দেখলেন এক ব্যক্তি সাদা তহবন্দ, সাদা পিরহান ও সাদা পাগড়িতে অংগ শোভা বর্ধন করতঃ তসবিহ হাতে আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন। স্টুয়ার্ট মুগ্ধ ও বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পথ প্রদর্শক রামচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ব্যক্তিই তিতুমীর ? এক ত বিদ্রোহী বলে মনে হয় না?”
রামচন্দ্র বললো, এই ব্যক্তিই বিদ্রোহী তিতুমীর। নিজেকে তিতু বাদশাহ বলে পরিচয় দেয়। আজ আপনাদের আগমনীতে ভংগী পরিবর্তন করে সাধু সেজেছে” !
সাইয়েদ আহমেদ শহীদঃ
বাল্যকাল থেকেই সাইয়েদ আহমদ শরীর চর্চায় অভ্যস্ত ছিলেন এবং তিনি ছিলেন অসাধারণ দৈহিক শক্তির অধিকারী। শৈশবকাল থেকে তাঁর মধ্যে জিহাদের প্রেরণা জাগ্রত ছিল এবং তিনি প্রায় সমবয়সীদের সামনে বলতেন , ‘আমি জিহাদ করব, ‘আমি জিহাদ করব’। সকলেই এটাকে শিশুসুলভ প্রগলভ উক্তি বলে মনে করতো।
কিন্তু তাঁর মা শিশুর এ উক্তিকে সত্য বলে বিশ্বাস করতেন। গোলাম রসূল মেহের ‘তাওয়ারিখে আজমিয়ার’ বরাত দিয়ে বলেন, বালক সাইয়েদ আহমেদ বসতির বালকদের মধ্য থেকে একটি ‘লশকরে ইসলাম’ দল গঠন করতেন এবং উচ্চস্বরে জিহাদী স্লোগানসহ একটি কল্পিত ‘লশকরে কুফফার’ এর উপর আক্রমণ চালাতেন এবং ‘ইসলামী সেনাদল’ জয়লাভ করলো এবং ‘কাফের সেনাদল’ হেরে গেল বলে চিৎকার করে আকাশ বাতাস মুখরিত করতেন।
মোপলা বিদ্রোহঃ
তারা ছিলেন দক্ষিণাত্যের মালাবার অঞ্চলের মুসলিম অধিবাসী, তারা নিজেদেরকে আরব বণিকদের বংশোদ্ভূত বলে দাবী করে। তারা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও ধর্মপ্রাণ। ইংরেজদের দ্বারা নিষ্পেষিত হওয়ার কারণে ১৮৭৩,১৮৮৫,১৮৯৪ এবং ১৮৯৬ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
(সংক্ষেপে বইয়ের বিষয়াবলী)
|
পেজ-ভিউ
1 comments:
জাজাখাললাহ