১৯৬৯ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র আবদুল মালেক ইসলামবিদ্বেষী শক্তির হাতে টিএসসিতে আক্রান্ত হয়ে ১৫ আগস্ট শাহাদাত বরণ করার পর সমগ্র দেশ যখন শোক-দুঃখ ও বেদনায় ভারাক্রান্ত তখন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি ফররুখ আহমদ সেই শাহাদাতকে মোবারকবাদ জানিয়েছিলেন এভাবে, "শহীদেরা সত্যের সাক্ষ্য হয়ে থাকবে, সত্যের পথে চিরদিন তোমাকে আমাকে ডাকবে"। শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদাতের খবর যখন মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে জানানো হয় তখন তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আবদুল মালেক এ দেশে ইসলামের পথে প্রথম শহীদ হতে পারে, কিন্তু শেষ নয়।’ হয়েছেও তাই।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত বাংলাদেশ। মানুষ ভেবেছে আর পরাধীনতা নয়, আর পরাজয় নয়, নয় আর ভাঙ্গনের সুর; এবার গড়ার পালা, বিজয়ের অন্তহীন পথচলা। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। তাইতো দেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলো কী করে হাজার কোটি টাকার অস্ত্র, খাদ্য, ধনসম্পদ ট্রাক বোঝাই হয়ে পাশের দেশ ভারতে চলে যাচ্ছে। কী করে আমাদের স্বাধীনতা জিম্মি হয়ে পড়ছে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতাকারী একটি কাপালিক শক্তির কাছে। কী করে দেশের যুব ও তরুণ সমাজ জড়িয়ে পড়ছে অপরাধ জগতের সাথে আর কী করে জন্ম নিচ্ছে নেশাগ্রস্ত, অস্ত্রসজ্জিত, হাইজ্যাক, রঙবাজি ও মাস্তানিতে ব্যাপৃত হতাশ যুবকদের এক অবক্ষয়ী প্রজন্ম। পিতার চোখে নেই ঘুম, মায়ের মুখের হাসি গেছে হারিয়ে, ফুরিয়ে গেছে বোনের বুকে লালিত আশা। কী হবে এই নতুন প্রজন্মের? কে এদের উদ্ধার করবে নিরাশার এই ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে?
এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে বসে একদল চিন্তাশীল তরুণ গড়ে তোলেন বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের মুক্তিকামী কাফেলা ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’।
সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব পৃথিবীর এক চিরস্থায়ী বিধান। মিথ্যা কখনো সইতে পারে না সত্যকে; অসুন্দর কখনো মেনে নিতে পারে না সুন্দরকে। ছাত্রশিবিরের এই আলোকযাত্রাকেও তাই মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশের মিথ্যার ধ্বজাধারী সম্প্রদায়। তাইতো ১৯৭৭ সালে ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠিত হলে যথারীতি শুরু হলো সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব, সুন্দর-অসুন্দরের সংঘাত। আঘাত আর আক্রমণ আসতে লাগলো শিবিরকর্মীদের ওপর।
মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার যে কাফেলাটি এলো পথহারা যুব-তরুণকে পথের দিশা দিতে, সেই কাফেলাটির বিরুদ্ধে একযোগে শুরু হলো অপপ্রচার, হুমকি, হামলা-মামলা, হত্যা ও সন্ত্রাসী বাধা প্রদান। শিবিরকর্মীরা হারাতে লাগলেন হাত, পা, চোখসহ শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। শিবিরের কাফেলায় বাড়তে লাগল রগকাটা আহত তরুণের সংখ্যা। ধীরে ধীরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুন্দর চত্বর আর রাজপথ রঞ্জিত হলো ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের পবিত্র রক্তে। হযরত হামযার (রা) নেতৃত্বাধীন শহীদের কাফেলায় ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ যুক্ত হলেন ছাত্রশিবিরের ৩ জন ভাই। সেই যে শুরু। এ ধারা এখনও অব্যাহত আছে।
১৯৮২ সালের ওই দিন এক সুন্দর সকালে শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মতিহার চত্বরে শিবিরকর্মীদের ওপর পরিচালিত হলো এক নিষ্ঠুর আক্রমণ। সম্পূর্ণ বিনা উসকানিতে ও কোনো কারণ ছাড়াই অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হলো শিবিরের তিনজন কর্মীকে, আহত হলেন অনেকেই, যার একজন শহীদ হলেন কয়েকদিন পর ২৮ ডিসেম্বর।
সেদিনের বাতিল শক্তির সেই নৃশংসতা ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন। ইটের ওপর রেখে আরেকটি ইট দিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করা হয় শহীদ আইয়ুব আলীর মাথাটি। আজও কেউ জানে না আইয়ুব আলীর অপরাধ কী ছিল। কেনই বা তাকে এভাবে লাশ হয়ে ফিরে যেতে হলো কুষ্টিয়ার গ্রামে তার ক্রন্দনরত মায়ের কাছে!
শহীদ আবদুল মালেকের পথ বেয়ে চলে গেলেন সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার। তারপরও কাফেলা থেমে থাকেনি, চলেছে দুর্নিবার। আর এ পথে চলতে গিয়ে শহীদদের তালিকা হয়েছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, রক্তের স্রোতের ধারা হয়েছে আরও বলিষ্ঠ। দেখতে দেখতে শহীদের তালিকায় যুক্ত হলো ১৩৬ জন তরুণের হাসিমাখা মুখ। রচিত হলো এক অনুপম শহীদি মিছিল।
চট্টগ্রামের খুরশিদ আলম; চাঁপাইনবাবগঞ্জের আব্দুল মতিন, রাশিদুল হক, শীষ মুহাম্মদ, সেলিম, শাহাবুদ্দিন; চট্টগ্রামের মোস্তফা আল মোস্তাফিজ ১৯৮৫ সালে এই শহীদের তালিকায় যুক্ত হলেন। কুরআনের সম্মান রক্ষার জন্য সেদিন যে শহীদেরা প্রাণ দিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন স্কুলের ছোট ছোট সোনামণিরা যাদের জীবনের কোথাও পাপ এসে ক্লেদাক্ত করতে পারেনি।
’৮৬-র শহীদ সেলিম জাহাঙ্গীর, মাহফুজুল হক চৌধুরী, জাফর জাহাঙ্গীর ও বাকীউল্লাহ রেখে গেছেন শাহাদাতের অত্যুজ্জ্বল নমুনা।
হাফেজ আব্দুর রহিম, স্কুলছাত্র আমীর হোসাইন, কারমাইকেল কলেজের ছাত্রনেতা আব্দুল আজিজ সেই কাফেলায় যোগ দিলেন পরের বছর। ১৯৮৮ সালে গৌরবগাথা রচনা করলেন শহীদ আইনুল হক, নাসিম উদ্দিন চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, আব্দুস সালাম আজাদ, আসলাম হোসাইন, আসগর আলী ও আবু সাঈদ মুহাম্মদ সায়েম। তারেকুল আলম, জসীম উদ্দিন মাহমুদ, শফিকুল ইসলাম, আফাজ উদ্দিন চৌধুরী, শিহাব উদ্দিন, জহির উদ্দিন মোহাম্মদ লিটন, খোরশেদ আলম, হাফেজ মুহাম্মদ ইয়াহিয়া, আলী হোসেন, আব্দুল খালেক, মীর আনসার উল্লাহর মতো তরুণেরা মায়ের বুক খালি করে শহীদি মিছিলে যোগ দেন ১৯৮৯ সালে। স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে ১৯৯০-এর রক্তঝরা দিনগুলোতে দীনের জন্য বক্ষ পেতে দিয়ে চলে গেলেন শহীদ মোজাহের আলী ও শহীদ খলিলুর রহমান।
’৯১-তে এসে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন প্রিয় সাথী শেখ ফিরোজ মাহমুদ ও এ কে এম গোলাম ফারুক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক জঘন্যতম অধ্যায় সূচনা হয় ১৯৯২ সালের ১৬ জানুয়ারি। দেশের সংবিধান, মানবীয় মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতি চরম ধৃষ্টতা দেখিয়ে পরজীবী এক সন্ত্রাসীচক্র জন্ম দেয় তথাকথিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। আর তাদের দোসরদের হাতে একে একে ঝরে পড়েন শহীদ মুনসুর আলী, সাইজুদ্দীন ও আতিকুল ইসলাম দুলাল। আমাদের ছেড়ে চলে যান শহীদ আমিনুল ইসলাম বিমান, ইকবাল হোসেন, নজরুল করিম, আজিবর রহমান, সাইফুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম মামুন।
১৯৯৩ সালে শহীদি মিছিলে যোগ হয় শিবিরের সর্বাধিক সংখ্যক নেতাকর্মীর নাম। এসএসসি’র ছাত্র কুতুব উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান কাজী মোশাররফ হোসাইন ও মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার সাথে যোগ দেন যশোরের মুস্তাফিজুর রহমান ও রবিউল ইসলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিরোধীদের নির্মমতার শিকার হন তাঁরা। রংপুরের সাইফুল ইসলাম, নবম শ্রেণীর এতিম ছাত্র শেখ আমানুল্লাহ, চট্টগ্রামের ডা. মিজানুর রহমান মিজান ও বোরহান উদ্দিন, শামসুজ্জামান খান রেজা, কামরুজ্জামান আলম আর শেখ মোজাম্মেল হক মঞ্জুও যোগ দেন শহীদের সারিতে। ২০ সেপ্টেম্বর কলেজের মসজিদ চত্বরে কুপিয়ে ও পরে জবাই করে শহীদ করা হয় খুলনা বিএল কলেজের নির্বাচিত জিএস ছাত্রনেতা মুন্সি আবদুল হালিমকে। এই ঘটনার জের ধরে শাহাদাতবরণ করেন উক্ত কলেজের ছাত্র-সংসদের নবনির্বাচিত সাহিত্য সম্পাদক শেখ রহমত আলী।
১৯৯৪ সালে কাফেলার সারি থেকে শহীদি মিছিলে নাম লেখালেন শহীদ নূরুল আলম, মুহাম্মদ ইউসুফ, এস.এম কাওছার, জাফর আলম, কামরুল ইসলাম ও খুলনা বিএল কলেজের ভারপ্রাপ্ত জিএস আবুল কাশেম পাঠান। পরের বছর যে ১২ জন ভাই শিবিরের শহীদি কাফেলায় যোগ দিলেন তারা হলেন চুয়াডাঙ্গার শহীদ মুস্তাফিজুর রহমান, সিরাজগঞ্জের ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কক্সবাজারের খাইরুল ইসলাম, ফেনীর একরামুল হক, লালমনিরহাটের মঈনুল ইসলাম, চট্টগ্রামের আনোয়ার হোসাইন, যশোরের আখতারুল কবির, কামিলের ছাত্র লক্ষ্মীপুরের ফজলে এলাহী, সিলেটের আব্দুল করিম, ফেনীর আলাউদ্দিন, বরিশালের শওকত হোসেন তালুকদার ও মোমেনশাহীর মঞ্জুরুল কবির। শহীদ শাহ আলম, হাসান জহির ওলিয়ার, আব্দুল খালেক হামিদ, মুহাম্মদ ওয়াহিদ, এইচএসসি’র ছাত্র গোলাম জাকারিয়া ও শাহজাহান, জয়নাল আবেদীন আজাদ এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে লাশ হয়ে যাওয়া আমিনুর রহমান ১৯৯৬ সালে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন।
১৯৯৭ সালে শহীদ হন ৩ জন ও ’৯৮ সালে ৫ ভাই। ১৯৯৯ সালে শহীদ হন সিলেটের এনামুল হক দুদু, টাঙ্গাইলের যোবায়ের হোসাইন ও হাটহাজারীর মহিবুল করিম সিদ্দিকী। একই বছর ১৭ আগস্ট ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হাতুড়ি দিয়ে নির্দয়ভাবে আঘাতে শহীদ করে দশম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী আহমদ যায়েদকে। লক্ষ্মীপুরের কামাল হোসাইন ও মাহমুদুল হাসান, চট্টগ্রামের আনসার উল্লাহ্ তালুকদার ও রহিম উদ্দিন, সাতক্ষীরার আলী মোস্তফা এবং সিলেটের আব্দুল মুনিম বেলাল বছরের শেষের দিকে যোগ দেন শহীদের কাফেলায়। চট্টগ্রামের শহীদ সালাহ্ উদ্দিন, খাইরুল ইসলাম ও জাহাঙ্গীর আলম সবুজ ২০০০ সালে রক্ত দিয়ে শহীদি খাতায় নাম লেখান।
শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনের স্বাভাবিক ঘটনা। এই আন্দোলনের গতিকে বেগবান করতে শাহাদাতের নজরানা পেশ করা পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। ইসলামী ছাত্রশিবিরের এই শাহাদাতের ধারা সে কারণে অব্যাহত থেকেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে শহীদ হন চাঁপাইনবাবগঞ্জের এইচএসসি ফলপ্রার্থী আব্দুস শাকুর, রাজশাহীর জাহাঙ্গীর আলম, সাতক্ষীরার রফিকুল ইসলাম, কুমিল্লার নবম শ্রেণীর ছাত্র ইব্রাহীম চৌধুরী মঞ্জুর ও নোয়াখালীর এইচএসসি ফলপ্রার্থী নিজাম উদ্দিন। স্কুলের শিক্ষকদের সাথে খারাপ আচরণ ও ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় মৌলভীবাজারের দশম শ্রেণীর ছাত্র বেলাল হোসেন এবং পাবনার আলিম প্রথম বর্ষের ছাত্র মুস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক শাহাদাত বরণ করেন ২০০২ সালে। ২০০৩ সালে মেধা অনুযায়ী ছাত্র ভর্তির পক্ষে মত প্রকাশ করায় কুষ্টিয়া পলিটেকনিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শফিকুর রহমান শিমুল এবং কলেজ মসজিদে নামাজরত অবস্থায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে মৌলভীবাজারের আলমাছ মিয়া শহীদ হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে অতর্কিত হামলা করে হাতুড়ি ও রড দিয়ে মাথা থেঁতলে দিলে দীর্ঘ তিন মাস ঢাকায় হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ২০০৪ সালের ২৪ এপ্রিল শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন বগুড়ার সাইফুদ্দিন।
বাতিল শক্তির নির্মমতার আরেক শিকার এসএসসিতে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিবিরকর্মী শহীদ রেজবুল হক সরকার প্লাবন। গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর সন্তান রেজবুল হক প্লাবন তার চমৎকার রেজাল্ট শুনে যেতে পারেননি। তার আগেই উপর্যুপরি অস্ত্রের আঘাতে পুরো মাথা ও শরীর থেঁতলে শহীদ করে দেয়া হয় তাঁকে। তারিখটা হচ্ছে ২০০৫ সালের ১৫ জুন। একই বছর শহীদ হন মোমেনশাহীর রায়হান খন্দকার ও সিলেটের শোয়েব আহমদ দুলাল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে পৈশাচিকতার চরম নজির স্থাপিত হয় ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। সারা বিশ্ব সেদিন হতবাক হয়ে গিয়েছিল মানবতার বিরুদ্ধে নির্মম পাশবিকতার করুণ দৃশ্য অবলোকন করে। রাজধানী ঢাকার পল্টনের রাস্তায় সাপ মারার মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে লাশের উপর নৃত্য কেবল নরপশুদের পক্ষেই শোভা পায়। চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত অনুষ্ঠানে নেতাসর্বস্ব ১৪ দলের মানবরূপী হায়েনাদের লগি-বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্রের ভয়াবহ আক্রমণে শিবিরের ২ জন নেতা শাহাদাত বরণ করেন। তারা হলেন শহীদ মুজাহিদুল ইসলাম ও হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপন। একই ঘটনার জের ধরে হায়েনাদের শিকারে পরিণত হন কুড়িগ্রামের রফিকুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জের আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল, কুমিল্লার মুহাম্মদ শাহজাহান ও পল্টনে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ঢাকার সবুজবাগের সাইফুল্লাহ মুহাম্মদ মাসুম। বছরের মাঝামাঝি সময়ে অসামাজিক কার্যকলাপের প্রতিবাদ করায় ১৭ জুন শহীদ হন সীতাকুন্ডের শাফায়েত উল্লাহ ভূঁইয়া।
মাঝের দুই বছর অর্থাৎ ২০০৭ ও ২০০৮ সাল শাহাদাতের কোনো ঘটনা না ঘটলেও ২০০৯ সালে নীল নকশার নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী সমর্থিত মহাজোট সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নির্মমতার শিকার হলেন দুইজন ভাই। ৯ মার্চ অপহরণের পর ধারালো অস্ত্র দিয়ে অমানুষিক অত্যাচারের পর ট্রেনের নিচে ফেলে দিয়ে শরীর থেকে পা দু’টো বিচ্ছিন্ন করে শহীদ করা হয় জামালপুরের মেধাবী ছাত্র হাফেজ রমজান আলীকে। ১১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ দিবসের র্যালিতে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ১৩ মার্চ বহিরাগত সন্ত্রাসী ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় উন্মত্ত ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শিবির সেক্রেটারি শরীফুজ্জামান নোমানীকে রামদার আঘাতে মাথা দ্বিখণ্ডিত ও ডান হাতের আঙুল কেটে হত্যা করা হয়। ২০১০ সালে এসে শহীদের সারিতে যোগ হলো আরও তিনটি নাম। ৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রাণ দেন গণিত শেষ বর্ষের দরিদ্র ছাত্র কথিত ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন। সরকার দলের নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য এর দায় চাপানো হলো চির মজলুম ছাত্রশিবিরের ওপর। ব্যস, মাত্র ২ দিনের ব্যবধানে লাশে পরিণত হন আমাদের প্রিয় দুই ভাই। চাঁপাইনবাবগঞ্জে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে অবস্থানরত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র পিতামাতার একমাত্র সন্তান হাফিজুর রহমান শাহীনকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান চতুর্থ বর্ষের মেধাবী ছাত্র মহিউদ্দিন মাসুমকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে ছাত্রলীগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক মেধাবী ছাত্র শিবির নেতা হারুনুর রশীদ কায়সারকে শাটল ট্রেন থেকে অপহরণ করে জবাই করে ফেলে দেয়া হয়।
এরই মাধ্যমে হযরত হামযার (রা) শহীদি কাফেলায় ছাত্রশিবিরের ১৩৬ জন সংযুক্ত হলেন। ঘাতকরা খড়গহস্ত হয়ে শেষ করতে চেয়েছে ইসলামের সাহসী সৈনিক তৈরির কারখানা ইসলামী ছাত্রশিবির নামক বিশাল কাফেলাকে। কিন্তু মৃত্যু যাদের প্রিয় ঠিকানা, তাদেরকে কি কেউ কখনো পরাস্ত করতে পেরেছে? পারেনি বদরে, ওহুদে, হোনায়নে, তাবুকে কিংবা সিন্ধুতে এবং বাংলার এই সবুজ জমিনেও। কাফেলার সারি কেবল বেড়েই চলেছে আর বেড়ে চলেছে বাতিল শক্তির মর্মযাতনা ও গাত্রদাহ। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, শাহাদাতের এই নজরানার দরুন বাংলার জমিন অনেক উর্বর হয়েছে, আরো উর্বর হবে এবং এই পথ বেয়েই একদিন ইসলামী বিল্লবের সোনালি সূর্য উদিত হবে বাংলাদেশের পূর্ব দিগন্তে। কিন্তু কী অপরাধ ছিল শাহাদাত বরণকারী প্রিয় ভাইদের? না, ছিল না কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ কিংবা স্বার্থ সংঘাত। “তাঁদের একমাত্র অপরাধ ছিল যে তাঁরা মহাপরাক্রমশালী এক আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছিলেন যিনি স্বপ্রশংসিত।” জীবন্ত শহীদের সারিও কম দীর্ঘ নয় এই শহীদি কাফেলার। হাত, পা, চোখসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ হারিয়ে এখনও দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন অনেকে। তবুও তাঁরা এতটুকু ব্যথিত নন, নন মর্মাহত।
প্রায় প্রতিটি শাহাদাত ও সন্ত্রাসী ঘটনার পর বিভিন্ন সময়ে বুলেটিন, প্রচারপত্র ইত্যাদি ছাপা হয়েছে। অবশেষে ১৯৯২ সালে সকল শহীদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্মৃতিসমূহ একত্রিত করে প্রকাশ করা হয় ‘রক্তাক্ত জনপদ’ নামক একটি পুস্তিকা। এখন শহীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তাই সময়ের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে পুনরায় একটি গ্রন্থ প্রকাশের দাবি উত্থাপিত হলে প্রথম ৩০ জন ভাইয়ের শাহাদাতের ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত হলো ‘স্মৃতি অমলিন’ নামক এই পুস্তকটি। আশা করি এই বইটি আমাদের রক্তাক্ত ইতিহাসের এক অনবদ্য দলিল হিসেবে টিকে থেকে ইতিহাসবিস্মৃত প্রজন্মের চেতনাকে আরো শাণিত করবে, তাদেরকে জাগিয়ে তুলবে নতুন প্রেরণায়। ৩০ জন শহীদের শাহাদাতের ঘটনাপ্রবাহের সাথে অসংখ্য সন্ত্রাস ও নির্যাতনের ঘটনাপ্রবাহ এতে এসেছে। তাদের জীবনের অসংখ্য চিত্রের মাঝ থেকে সামান্যই এখানে আনা সম্ভব হয়েছে। আরো বিস্তারিত গ্রন্থবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা আমরা উপলব্ধি করছি।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বসে এ কথা অনায়াসেই বলা যায় যে সন্ত্রাসের এই ধারা সহজে দূরীভূত হবার নয়। আর ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের লক্ষ্যে পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের পথে সন্ত্রাস থাকবেই। আর সন্ত্রাস থাকলেই ঝরবে আরো বহু শহীদের লাশ। আল্লাহ আমাদের সমস্ত শ্রমকে কবুল করুন, আমাদের সকল শহীদকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দিন এবং আগামী প্রজন্মকে এই বই থেকে সন্ত্রাসবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।
শহীদেরা সত্যের সাক্ষ্য হয়ে থাকবে (এক নজরে শাহাদাতের ইতিহাস)
☼→
শাহাদাৎ
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: