৫ নভেম্বর ২০১৪, সন্ধ্যায়ই জানা গেলো পরদিন ৬ নভেম্বর সকাল দশটায় আমাদের সাক্ষাৎকার। মনে মনে প্রস্তুতী নিলাম। এই সংকট সন্ধিক্ষণে অনেক স্মৃতি অনেক ঘটনাই মনে পড়লো। মনের মাঝে তখন এক তুফান বয়ে চলছে। ছাত্র জীবনের আন্দোলনের কঠিন মুহূর্তে তাকে পেয়েছিলাম অবিভাবক হিসেবে, আবার বড় ভাই হিসেবে। তার সাথে সম্পৃক্ত অনেক স্মৃতির কথা স্মরণ করতে করতে চোখে ঘুম এসে গেলো।
ঘুমে এক উদ্দীপনাময় স্বপ্ন দেখলাম। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আমার ভায়রা ভাইয়ের ছেলে শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুম ও অপর আত্মীয় হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপন শাহাদাত বরণ করে। দীর্ঘ ৮ বছর পর আজ রাতে স্বপ্নে তাদের সাথে সাক্ষাৎ। স্বপ্নে দেখছি হঠাৎ মাসুম আমার সামনে হাজির। তার মুখমন্ডল থেকে সূর্যের আলোক রশ্মির মত জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এর পরই দেখলাম একই রূপে আমার দিকে এগিয়ে আসছে শিপন।
স্বপ্নেই তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কেমন আছ?’
তারা জবাব দিলো, ‘খালু আমারা খুব ভালো আছি। আমরা যে হোস্টেলে আছি সেখানে উন্নতমানের খাবার দেয়া হয়। খুবই উন্নত মানের ঘরে আমরা ঘুমাই, প্রতিনিয়ত আমাদের নামে উপহার আসে। আমাদের কোন জিনিষের অভাব নেই। আপনি কি আমাদের হোস্টেলে যাবেন? আসুন আমরা আপনাকে সেখানে নিয়ে যাই।’
আমি বললাম, ‘অবশ্যই যাবো। তোমাদের থাকার জায়গাটা আমি দেখতে চাই।’
তারা আমাকে হাত ধরে সামনে এগুতে লাগলো। কিছুদূর এগুতেই দেখলাম বিশাল এক প্রাচীর আমাদের সামনে। তারা কিছুদূর অগ্রসর হতেই প্রাচীরটা বিভক্ত হয়ে গেলো। তারা দু’জন ভিতরে প্রবেশ করলো। কিন্তু আমি প্রাচীরের সামনে যেতেই প্রাচীরটা আবার জোড়া লেগে গেলো। আমি হাত দিয়ে প্রাচীরের বিভক্তি স্থান শনাক্ত করার চেষ্টা করছিলাম। প্রাচীরটি অনেক মোটা মনে হলো। কয়েকবার চেষ্টা করেও পারলামনা প্রাচীরের বিভক্তিস্থান শনাক্ত করতে।
এমন সময় পেছন থেকে একটি ডাক শুনতে পেলাম, ‘আকন্দ থামো।’ মনে হলো কণ্ঠটি অনেক পরিচিত। পেছনে তাকানোর চেষ্টা করলাম। মনে হলো দূর থেকে কেউ ডাকছে।
হঠাৎ সামনে দেখলাম কামারুজ্জামান ভাই এগিয়ে আসছেন। লক্ষ্য করলাম তিনি এগিয়ে আসতেই প্রাচীরটি পূর্বের মত খুলে গেলো। আর কামারুজ্জামান ভাই বললেন, ‘তুমি একটু অপেক্ষা কর।’ আমি লক্ষ্য করলাম উনি ঢুকার সাথে সাথে তা আবার বন্ধ হয়ে গেলো।
প্রচীরের অংশ বিশেষ খুলে যাবার সাথে সাথে এক পলকের দৃষ্টিতে ভিতরের দৃশ্যটি আমার চোখের পর্দায় আটকে গেলো। আমি দেখতে পেলাম, বিরাট প্রশস্ত এক উদ্যান। সারি সারি গাছ, ফুলের বাগান, দুদিক দিয়ে বিস্তৃত কার্পেট মুদ্রিত রাস্তা। এমন বাগান আমি কখনো দেখিনি। দেখলাম বাগানের ঠিক মধ্যখানে একটি পানির নহর। তার রং নীলাভ। নহরের মাঝখানে দেখলাম পানির সুউচ্চ ফোয়ারা। সেখানে সাদা, লাল ও বেগুনী রংয়ের পানি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সূর্যের কারনে তা ঝলমল করছে। রাস্তার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত অনেক তরুন সারিবদ্ধভাবে নানা ধরণের ফুলের সমাহারে সজ্জিত তোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছে। এর মাঝেই কামারুজ্জামান ভাই ভিতরে প্রবেশ করলেন। সমস্বরে একটি ধ্বনি শুনতে পেলাম। ‘আহলান, সাহলান, কামারুজ্জামান।’
আমি ‘মাসুম মাসুম, শিপন শিপন, কামরুজ্জামান ভাই…’ বলে চিৎকার করে উঠলাম। মাসুম বললো, ‘খালু আমি হোস্টেল সুপারের অনুমতি নিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবো- একটু দাঁড়ান।’
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ৮ বছর পূর্বে যে শিপন, মাসুম শহীদ হয়েছে স্বপ্নে তাদের সাথে সাক্ষাৎ, তাদের সাথে এগিয়ে যাওয়া, প্রাচীর খুলে যাওয়া, প্রাচীরের ভিতরের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য আমার মাঝে এক উদ্বীপনার সৃষ্টি করলো। কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের পূর্বে এ স্বপ্ন আমার মাঝে এক ভাবান্তর সৃষ্টি করলো। বার বার মনে উদয় হচ্ছিল প্রাচীরটা কিসের? কেনই বা এ প্রাচীর? শহীদ মাসুম, শহীদ শিপনের জন্য খুলে গেলো, আবার আমি এগিয়ে আসতেই কেন তা বন্ধ হয়ে গেলো? মাসুমই বা হোস্টেল সুপারের অনুমতির কথা বলে কি বুঝাতে চাইলো? বিশাল বিস্তীর্ণ উদ্যানই বা কিসের? এ স্বপ্নের তাৎপর্য কি? এসব ভাবতে ভাবতেই সকাল হয়ে আসলো। ফজরের নামাজ আদায়, কুরআন অধ্যয়ন, গোসল, নাস্তা সেরে ছুটে চললাম কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশ্যে।
সেখানে কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাক্ষাতের জন্য কারাফটকের ভিতরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। সামান্য পরেই তাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসা হলো। রাতের স্বপ্নে যে পোশাকে তাকে দেখেছিলাম সে পোশাকেই যেন তিনি আমাদের সামনে হাজির হলেন।
এর পর পেরিয়ে গেছে ৫টি মাস। এই ৫ মাসে ৪ বার তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রত্যেক বারেই স্বপ্নের সেই পোশাকে সজ্জিত অবস্থায় তাকে আমাদের সামনে আসতে দেখেছি। ১১ এপ্রিল শনিবার রাতে তাকে হত্যা করার পর বার বার সেই স্বপ্নের কথা মনে হচ্ছিল। এ স্বপ্ন আমার অন্তরে চির দেদীপ্যমান থাকবে। প্রাচীরের ভিতরের সেই নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য বার বার আমার দৃষ্টিশক্তিতে ভেসে উঠছে। এক অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে উঠছে হৃদয়, মন। হৃদয়ের সীমাহীন হাহাকার আর স্বপ্নের সেই অপরূপ দৃশ্য মনোজগতে এক বিভিষিকাময় দৃশ্যের অবতারণা করছে। অন্তর ফাঁটানো আবেগ দিয়ে দু’আ করি, হে আল্লাহ্! তুমি আমাদের প্রিয় নেতা কামারুজ্জামান ভাইয়ের শাহাদাতকে কবুল কর। আমীন।
জালেম সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ বাংলাদেশ
জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল জনাব মুহাম্মদ
কামারুজ্জামানকে শনিবার রাত ১০ টার পর হত্যা করেছে (ইন্নলিল্লাহি………
রাজিউন)। মহান রাব্বুল আলামীন তার শাহাদাত মঞ্জুর করুন।
জনাব মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বাংলাদেশের সবুজ জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য যে রক্ত দিয়েছেন আল্লাহ্ তার প্রতিফোঁটা রক্তের বিনিময়ে এ জমিনকে ইসলামের জন্য কবুল করুন। আমীন।
যে সময়ের যে অভিযোগে তাকে হত্যা করা হলো সে সময়ে তিনি উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর একজন ছাত্র ছিলেন।
শেরপুরের নিভৃত পল্লীর একজন তরুন এই বয়সে কিভাবে সরকারের এই অভিযোগের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে তা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ অবশ্যই মূল্যায়ন করবেন। নিছক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সরকার তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। তিনি রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের শিকার। জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে শাহাদাতের পূর্ব মুহূর্তে তিনি ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ও তার প্রিয় দেশবাসীর উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য রেখে গিয়েছেন তা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের প্রস্ততী চলাকালে তিনি বলেছেন-
১) আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ, আমাকে অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। যে সোহাগপুর পল্লীর ঘটনার সাথে আমাকে জড়ানো হয়েছে তার সাথে আমার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। আমি জুলুমের শিকার। আল্লাহ তায়ালা যেন আমার শাহাদাতকে কবুল করেন। আমি দেশবাসীর নিকট এই দোয়াই কামনা করি। আমার উপর যে অবিচার করা হয়েছে তার বিচারের ভার আমি সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক মহান রাব্বুল আলামীর নিকট অর্পন করলাম। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আদালতে আখিরাতে ন্যায়বিচার করবেন এবং আমাকে হত্যা করার প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে উপযুক্ত শাস্তি দিবেন।
২) আমি আমার শাহাদাতের পূর্বে আন্দোলনের কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, এ আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে কুরআনের চর্চা ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। বিশেষ করে তাফহীমুল কুরআন গভীর মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করতে হবে। কুরআন আমাদেরকে আলোর পথ দেখাবে। কারাগারের বন্দীশালায় আটক জীবনযাপনের সময় আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি, কুরআনের জ্ঞানের চাইতে শক্তিশালী সম্পদ আর কিছু হতে পারে না। আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে এই জ্ঞানের ভান্ডার যত সমৃদ্ধ হবে আন্দোলন তত সমৃদ্ধ হবে। কর্মীদের নৈতিক মান মজবুত হবে। ঈমানের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পাবে। সর্বোপরি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেতনা বেগবান হবে। আমি প্রতিটি কর্মী ভাইদেরকে কুরআনকে তাদের নিত্যসঙ্গী বানানোর জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
৩) ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যই নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বাতিলের সাথে ইসলামী আন্দোলনের কোন আপোষ হতে পারে না। সত্যের নিকট মিথ্যার পতন অবশ্যম্ভাবী। মিথ্যা সবসমই পরাভূত এবং পরাজিত। মিথ্যার দানবীয় শক্তির নিকট ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা কোন দিনও আপোষ করতে পারে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের নিকট থেকে ঈমানের পরীক্ষা গ্রহণের কথা বলেছেন। এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয় মহান রাব্বুল আলামীন তাদের হাতেই দ্বীনের ঝান্ডা তুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আমি আন্দোলনের কর্মীদেরকে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতী নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
৪) মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে পছন্দ করেন তাদেরকেই শহীদ হিসেবে কবুল করেন। বিনিময়ে শহীদের রক্ত ঝরা ময়দানে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করেন। আমি দেশবাসীর নিকট দোয়া চাই, আমি যেন আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দা হিসেবে তার নিকট গৃহীত হই। আল্লাহর পছন্দের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হওয়ার চাইতে মুমিনের জীবনে উত্তম প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না।
৫) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ভাইদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপোষহীন ভূমিকা পালন করে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এদেশের মানুষ অত্যাচারীর হাত থেকে উদ্ধারের জন্য জামায়াতকে তাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে গ্রহণ করবে ইনশাআল্লাহ্।
৬) আমি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী ভাইদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, তরুণ বয়সে নিজেদের লেখাপড়া ও সকল কিছু উৎসর্গ করে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে এ দৃষ্টান্ত বিরল। তাদের ত্যাগ কিছুতেই বৃথা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা তরুনদের রক্তের উপরে তার দ্বীনকে বিজয়ী করবেন ইনশাআল্লাহ্।
৭) আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশ এবং জাতি জুলুমের হাত থেকে মুক্তি পাক। আল্লাহ্ আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিকে সকল ষড়যন্ত্রের হাত থেকে উদ্ধার করুন।
জনাব মুহাম্মদ কামারুজ্জামান পরিবারের সাথে শেষ সাক্ষাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মহান আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে দু’আ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা যেন তার শাহাদাতকে কবুল করেন। আমরা রাব্বুল ইজ্জতের দরবারে হৃদয় উজাড় করা আবেগ দিয়ে দু’আ করছি, হে আল্লাহ্, তুমি আমাদের প্রিয় নেতা ও ভাই শহীদ কামারুজ্জামানের শাহাদাতকে কবুল কর। আমীন।
- মতিউর রহমান আকন্দ
ঘুমে এক উদ্দীপনাময় স্বপ্ন দেখলাম। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আমার ভায়রা ভাইয়ের ছেলে শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুম ও অপর আত্মীয় হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপন শাহাদাত বরণ করে। দীর্ঘ ৮ বছর পর আজ রাতে স্বপ্নে তাদের সাথে সাক্ষাৎ। স্বপ্নে দেখছি হঠাৎ মাসুম আমার সামনে হাজির। তার মুখমন্ডল থেকে সূর্যের আলোক রশ্মির মত জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এর পরই দেখলাম একই রূপে আমার দিকে এগিয়ে আসছে শিপন।
স্বপ্নেই তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কেমন আছ?’
তারা জবাব দিলো, ‘খালু আমারা খুব ভালো আছি। আমরা যে হোস্টেলে আছি সেখানে উন্নতমানের খাবার দেয়া হয়। খুবই উন্নত মানের ঘরে আমরা ঘুমাই, প্রতিনিয়ত আমাদের নামে উপহার আসে। আমাদের কোন জিনিষের অভাব নেই। আপনি কি আমাদের হোস্টেলে যাবেন? আসুন আমরা আপনাকে সেখানে নিয়ে যাই।’
আমি বললাম, ‘অবশ্যই যাবো। তোমাদের থাকার জায়গাটা আমি দেখতে চাই।’
তারা আমাকে হাত ধরে সামনে এগুতে লাগলো। কিছুদূর এগুতেই দেখলাম বিশাল এক প্রাচীর আমাদের সামনে। তারা কিছুদূর অগ্রসর হতেই প্রাচীরটা বিভক্ত হয়ে গেলো। তারা দু’জন ভিতরে প্রবেশ করলো। কিন্তু আমি প্রাচীরের সামনে যেতেই প্রাচীরটা আবার জোড়া লেগে গেলো। আমি হাত দিয়ে প্রাচীরের বিভক্তি স্থান শনাক্ত করার চেষ্টা করছিলাম। প্রাচীরটি অনেক মোটা মনে হলো। কয়েকবার চেষ্টা করেও পারলামনা প্রাচীরের বিভক্তিস্থান শনাক্ত করতে।
এমন সময় পেছন থেকে একটি ডাক শুনতে পেলাম, ‘আকন্দ থামো।’ মনে হলো কণ্ঠটি অনেক পরিচিত। পেছনে তাকানোর চেষ্টা করলাম। মনে হলো দূর থেকে কেউ ডাকছে।
হঠাৎ সামনে দেখলাম কামারুজ্জামান ভাই এগিয়ে আসছেন। লক্ষ্য করলাম তিনি এগিয়ে আসতেই প্রাচীরটি পূর্বের মত খুলে গেলো। আর কামারুজ্জামান ভাই বললেন, ‘তুমি একটু অপেক্ষা কর।’ আমি লক্ষ্য করলাম উনি ঢুকার সাথে সাথে তা আবার বন্ধ হয়ে গেলো।
প্রচীরের অংশ বিশেষ খুলে যাবার সাথে সাথে এক পলকের দৃষ্টিতে ভিতরের দৃশ্যটি আমার চোখের পর্দায় আটকে গেলো। আমি দেখতে পেলাম, বিরাট প্রশস্ত এক উদ্যান। সারি সারি গাছ, ফুলের বাগান, দুদিক দিয়ে বিস্তৃত কার্পেট মুদ্রিত রাস্তা। এমন বাগান আমি কখনো দেখিনি। দেখলাম বাগানের ঠিক মধ্যখানে একটি পানির নহর। তার রং নীলাভ। নহরের মাঝখানে দেখলাম পানির সুউচ্চ ফোয়ারা। সেখানে সাদা, লাল ও বেগুনী রংয়ের পানি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সূর্যের কারনে তা ঝলমল করছে। রাস্তার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত অনেক তরুন সারিবদ্ধভাবে নানা ধরণের ফুলের সমাহারে সজ্জিত তোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছে। এর মাঝেই কামারুজ্জামান ভাই ভিতরে প্রবেশ করলেন। সমস্বরে একটি ধ্বনি শুনতে পেলাম। ‘আহলান, সাহলান, কামারুজ্জামান।’
আমি ‘মাসুম মাসুম, শিপন শিপন, কামরুজ্জামান ভাই…’ বলে চিৎকার করে উঠলাম। মাসুম বললো, ‘খালু আমি হোস্টেল সুপারের অনুমতি নিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবো- একটু দাঁড়ান।’
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ৮ বছর পূর্বে যে শিপন, মাসুম শহীদ হয়েছে স্বপ্নে তাদের সাথে সাক্ষাৎ, তাদের সাথে এগিয়ে যাওয়া, প্রাচীর খুলে যাওয়া, প্রাচীরের ভিতরের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য আমার মাঝে এক উদ্বীপনার সৃষ্টি করলো। কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের পূর্বে এ স্বপ্ন আমার মাঝে এক ভাবান্তর সৃষ্টি করলো। বার বার মনে উদয় হচ্ছিল প্রাচীরটা কিসের? কেনই বা এ প্রাচীর? শহীদ মাসুম, শহীদ শিপনের জন্য খুলে গেলো, আবার আমি এগিয়ে আসতেই কেন তা বন্ধ হয়ে গেলো? মাসুমই বা হোস্টেল সুপারের অনুমতির কথা বলে কি বুঝাতে চাইলো? বিশাল বিস্তীর্ণ উদ্যানই বা কিসের? এ স্বপ্নের তাৎপর্য কি? এসব ভাবতে ভাবতেই সকাল হয়ে আসলো। ফজরের নামাজ আদায়, কুরআন অধ্যয়ন, গোসল, নাস্তা সেরে ছুটে চললাম কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশ্যে।
সেখানে কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাক্ষাতের জন্য কারাফটকের ভিতরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। সামান্য পরেই তাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসা হলো। রাতের স্বপ্নে যে পোশাকে তাকে দেখেছিলাম সে পোশাকেই যেন তিনি আমাদের সামনে হাজির হলেন।
এর পর পেরিয়ে গেছে ৫টি মাস। এই ৫ মাসে ৪ বার তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রত্যেক বারেই স্বপ্নের সেই পোশাকে সজ্জিত অবস্থায় তাকে আমাদের সামনে আসতে দেখেছি। ১১ এপ্রিল শনিবার রাতে তাকে হত্যা করার পর বার বার সেই স্বপ্নের কথা মনে হচ্ছিল। এ স্বপ্ন আমার অন্তরে চির দেদীপ্যমান থাকবে। প্রাচীরের ভিতরের সেই নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য বার বার আমার দৃষ্টিশক্তিতে ভেসে উঠছে। এক অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে উঠছে হৃদয়, মন। হৃদয়ের সীমাহীন হাহাকার আর স্বপ্নের সেই অপরূপ দৃশ্য মনোজগতে এক বিভিষিকাময় দৃশ্যের অবতারণা করছে। অন্তর ফাঁটানো আবেগ দিয়ে দু’আ করি, হে আল্লাহ্! তুমি আমাদের প্রিয় নেতা কামারুজ্জামান ভাইয়ের শাহাদাতকে কবুল কর। আমীন।
মতিউর রহমান আকন্দ |
জনাব মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বাংলাদেশের সবুজ জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য যে রক্ত দিয়েছেন আল্লাহ্ তার প্রতিফোঁটা রক্তের বিনিময়ে এ জমিনকে ইসলামের জন্য কবুল করুন। আমীন।
যে সময়ের যে অভিযোগে তাকে হত্যা করা হলো সে সময়ে তিনি উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর একজন ছাত্র ছিলেন।
শেরপুরের নিভৃত পল্লীর একজন তরুন এই বয়সে কিভাবে সরকারের এই অভিযোগের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে তা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ অবশ্যই মূল্যায়ন করবেন। নিছক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সরকার তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। তিনি রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের শিকার। জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে শাহাদাতের পূর্ব মুহূর্তে তিনি ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ও তার প্রিয় দেশবাসীর উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য রেখে গিয়েছেন তা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের প্রস্ততী চলাকালে তিনি বলেছেন-
১) আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ, আমাকে অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। যে সোহাগপুর পল্লীর ঘটনার সাথে আমাকে জড়ানো হয়েছে তার সাথে আমার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। আমি জুলুমের শিকার। আল্লাহ তায়ালা যেন আমার শাহাদাতকে কবুল করেন। আমি দেশবাসীর নিকট এই দোয়াই কামনা করি। আমার উপর যে অবিচার করা হয়েছে তার বিচারের ভার আমি সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক মহান রাব্বুল আলামীর নিকট অর্পন করলাম। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আদালতে আখিরাতে ন্যায়বিচার করবেন এবং আমাকে হত্যা করার প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে উপযুক্ত শাস্তি দিবেন।
২) আমি আমার শাহাদাতের পূর্বে আন্দোলনের কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, এ আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে কুরআনের চর্চা ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। বিশেষ করে তাফহীমুল কুরআন গভীর মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করতে হবে। কুরআন আমাদেরকে আলোর পথ দেখাবে। কারাগারের বন্দীশালায় আটক জীবনযাপনের সময় আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি, কুরআনের জ্ঞানের চাইতে শক্তিশালী সম্পদ আর কিছু হতে পারে না। আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে এই জ্ঞানের ভান্ডার যত সমৃদ্ধ হবে আন্দোলন তত সমৃদ্ধ হবে। কর্মীদের নৈতিক মান মজবুত হবে। ঈমানের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পাবে। সর্বোপরি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেতনা বেগবান হবে। আমি প্রতিটি কর্মী ভাইদেরকে কুরআনকে তাদের নিত্যসঙ্গী বানানোর জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
৩) ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যই নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বাতিলের সাথে ইসলামী আন্দোলনের কোন আপোষ হতে পারে না। সত্যের নিকট মিথ্যার পতন অবশ্যম্ভাবী। মিথ্যা সবসমই পরাভূত এবং পরাজিত। মিথ্যার দানবীয় শক্তির নিকট ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা কোন দিনও আপোষ করতে পারে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের নিকট থেকে ঈমানের পরীক্ষা গ্রহণের কথা বলেছেন। এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয় মহান রাব্বুল আলামীন তাদের হাতেই দ্বীনের ঝান্ডা তুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আমি আন্দোলনের কর্মীদেরকে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতী নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
৪) মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে পছন্দ করেন তাদেরকেই শহীদ হিসেবে কবুল করেন। বিনিময়ে শহীদের রক্ত ঝরা ময়দানে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করেন। আমি দেশবাসীর নিকট দোয়া চাই, আমি যেন আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দা হিসেবে তার নিকট গৃহীত হই। আল্লাহর পছন্দের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হওয়ার চাইতে মুমিনের জীবনে উত্তম প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না।
৫) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ভাইদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপোষহীন ভূমিকা পালন করে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এদেশের মানুষ অত্যাচারীর হাত থেকে উদ্ধারের জন্য জামায়াতকে তাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে গ্রহণ করবে ইনশাআল্লাহ্।
৬) আমি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী ভাইদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, তরুণ বয়সে নিজেদের লেখাপড়া ও সকল কিছু উৎসর্গ করে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে এ দৃষ্টান্ত বিরল। তাদের ত্যাগ কিছুতেই বৃথা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা তরুনদের রক্তের উপরে তার দ্বীনকে বিজয়ী করবেন ইনশাআল্লাহ্।
৭) আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশ এবং জাতি জুলুমের হাত থেকে মুক্তি পাক। আল্লাহ্ আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিকে সকল ষড়যন্ত্রের হাত থেকে উদ্ধার করুন।
জনাব মুহাম্মদ কামারুজ্জামান পরিবারের সাথে শেষ সাক্ষাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মহান আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে দু’আ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা যেন তার শাহাদাতকে কবুল করেন। আমরা রাব্বুল ইজ্জতের দরবারে হৃদয় উজাড় করা আবেগ দিয়ে দু’আ করছি, হে আল্লাহ্, তুমি আমাদের প্রিয় নেতা ও ভাই শহীদ কামারুজ্জামানের শাহাদাতকে কবুল কর। আমীন।
- মতিউর রহমান আকন্দ
0 comments: