চারিদিকে বিস্তৃত এই বিশাল প্রকৃতির বাহ্যরূপ এবং ইহার মনোরম শ্যামল শোভা প্রত্যেকটি চিন্তাশীল মানুষকেই অনিবার্যরূপে আকৃষ্ট করে, মুগ্ধ করে। আমরা পরিষ্কার দেখিতে পাইতেছি, এই দুনিয়ায় কোন একটি জিনিস সম্পর্কেও নির্বার থাকিতে পারে না। দূর আকাশ হইতে এই ভূলোক পর্যন্ত প্রত্যেকটি বস্তু-প্রত্যেকটি অণু-পরমাণু পর্যন্ত মানুষকে রীতিমত ভাবাইয়া তোলে, জাগাইয়া দেয় তাহার ভিতরের সৌন্দর্যনুভূতি এবং যখন সে তার চতুষ্পার্শ্বের এই মনোমুদ্ধকর আবেষ্টনীর প্রোজ্জল রূপ দেখিতে পায়, তখনি তাহার ভিতরের মানুষ জিজ্ঞাসা করিয়া উঠে এই বিপুল শোভামন্ডিত জগতের সৃষ্টি হইল কেমন করিয়া?
এই দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিসই বহু বিভিন্ন উপাদানে নির্মিত। সেই উপাদানগুলি পরষ্পর বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও সেগুলির মধ্যে একটি চমৎকার সামঞ্জস্য ও সহযোগিতা বিদ্যমান। সৃষ্টির প্রত্যেকটি অণু-পরমাণূকে কেন্দ্র করিয়া অহর্নিশ আবর্তিত হইতেছে ইলেক্ট্রন ও প্রোট্রন। ইহাতে একটা ন নেগেটিভ, অন্যটা পজিটিভ। অন্য কথায় একটা স্ত্রী অন্যটা পুরুষ। ইহাদের সুনিয়ন্ত্রিত আবর্তনের দরুণ সৃষ্টির প্রত্যেকটা বস্তু বাঁচিয়া থাকে। নারী ও পুরুষ দেহ ও প্রকৃতির দিক দিয়া, বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ গুণ-গরিমার দিক দিয়া কতইনা বিভিন্ন। কিন্তু তবুও ইহাদের মধ্যে যে মানসিক ও দৈহিক মিলন-প্রীতি বর্তমান, তাহা কে অস্বীকার করিতে পারে? ইহারা প্রত্যকেই নিজ নিজ গুণ বৈশিষ্ট্য ও অন্তর্নিহিত শক্তির দরুণ প্রত্যেকের তরে শুধু কমনীয়ই নয়, বরং ইহাদের পরষ্পরের মিলন না হইলে ইহাদের সকল শক্তিই অর্থহীন হইয়া যায়। সমগ্র বিশ্ব-প্রকৃতির বিভিন্ন জিনিস সম্পর্কেও এই তত্ত্ব সম্পূর্ণরূফে প্রযোজ্য। আকাশ ও পৃথিবী, রাত ও দিন, শীত ও গ্রীষ্ম, আলো ও অন্ধকার-সমস্তই স্বামী-স্ত্রীর মত পরষ্পর বিভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও এক নিবিড় গভীর বন্ধনে আবদ্ধ। এমনকি স্বামী-স্ত্রী যেমন একে অপরকে ছাড়া পুরাপুরি ব্যর্থ ও নিষ্ফল ঠিক তেমনি দুনিয়ার বিভিন্ন অংশ ও উপাদানগুলির প্রত্যেকটি উহার জুড়ির সংযোগ ব্যতীত সম্পূর্ণরূপে অর্থহীন অংশ ও উপাদানগুলির প্রত্যেকটিই উহার জুড়ির সংযোগ ব্যতীত সম্পূর্ণরূপে অর্থহীন হইয়া পড়ে। স্বতন্ত্রভাবে দুনিয়ার বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে যেমন এই কথা সত্য, সামগ্রীকভাবে সারা বিশ্বজগত সম্পর্কেও এই কথা অনস্বীকার্য। দুনিয়ার প্রত্যেকটি বস্তুর অস্তিত্ব বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য পৃথিবীর এই বিরাট কারখানার অহর্নিশ একান্তভাবে কার্যনিরত হইয়া থাকা আবশ্যক। ধানের একটা চারা অংকুরিত হইয়া বাঁচিয়া থাকিতে পারে না, যতক্ষণ না এই বিশ্ব-প্রকৃতির প্রয়োজনীয় সমগ্র উপাদানগুলি উহার লালন-পালন, রক্ষাণাবেক্ষণ ও পরিবর্ধনের কাজে নিজ নিজ শক্তি পরিপূর্ণরূপে নিযুক্ত করে। মাটি দেয় দাঁড়াইবার আশ্রয় ও শিকড় ছড়াইবার জন্য বিস্তৃত ভূমি, বৃষ্টি দান করে পানির অংশ, সূর্য তাপ দিয়া উহাকে উত্তাপ্ত রাখে, শিশির দেয় শীতলতা, বাতাস দেয় কোমল স্নেহের স্পর্শ। এই সবকিছুই যখন একটা বিশেষ নিয়ম-শৃংখলা ও পরিমাণের সমতার সহিত নিযুক্ত হয়, তখনি ধানের একটা গাছ এবং উহার শীর্ষে সোনালী বর্ণের শত শত কণা সমন্বিত কয়েকটি ছড়া সৃষ্টি হইতে পারে-তাহার পূর্বে নয়। পরন্তু এই অপরিহার্য জিনিসগুলির কোন একটির পরিমাণ একটু বেশী বা কম হইলেই সৃষ্টি ধ্বংস হইয়া যাওয়া অবশ্যম্ভবী।
কিন্তু এখন প্রশ্ন এই যে, নিখিল বিশ্ব-প্রকৃতির সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশ কি আপনা-আপনিই হইতেছে? না ইহার পশ্চাতে আছে কোন শক্তিমান সুব্যবস্থাপক সত্তা-যিনি এই বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য স্থাপন করেন এবং উহাকে এমনি করিয়া একটা নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে পরিচালিত করেন?
এ সম্পর্কে সিদ্ধান্তমূলক কথা এই যে, কোন মানুষের মনই একথা স্বীকার করিতে পারে না যে, এই সব কোন সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত সৃষ্টি হইয়াছে। দুনিয়ার ছোট বড় যে কোন জিনিস সম্পর্কেই আমরা কল্পনা করি না কেন, আমরা কিছুতেই ধারণা করিতে পারি না যে, তাহা নিজে নিজেই অস্তিত্ব লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছে। যদি ধরিয়াও লওয়া যায় যে, এই দুনিয়ার সৃষ্টি একটা আকষ্কিক ঘটনামাত্র, নিজে নিজেই ইহা অস্তিত্ব লাভ করিয়াছে এবং কোন ব্যবস্থাপক ব্যতিরেকে উহার বিভিন্ন উপাদানে ক্রমবিকাশ ঘটিয়া যাইতেছে, কিন্তু সেই বিভিন্ন উপাদানগুলির মধ্যে সংযোগ ও সামঞ্জস্য সাধনও কি একটা আকষ্কিক ব্যাপার? মাটিতে একটা বীজ বপন করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদানগুলি মিলিত হইয়া একটা গাছ সৃষ্টি করার কাজে উহাকে কেন সাহায্য করিবে? মায়ের গর্ভে এক ফোটা শুক্র প্রবিষ্ট হইয়া কেন সৃষ্টি করিবে হাড়-মাংস অস্থিমজ্জা বিশিষ্ট একটা সুঠাম সুগঠিত ও পূর্ণাঙ্গ অবয়ব বিশিষ্ট মানব দেহ? কোন বুদ্ধিমান মানুষই কি একথা বিশ্বাস করিতে পারে যে, পাহাড়, চন্দ্র, সূর্য, পাখী, মানুষ ও পশু সব কিছুই একটা দুর্ঘটনার মত আত্মপ্রকাশ করিয়াছে? নিজ থেকেই প্রত্যেকটির ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে? তাহার পর একেবারে আকষ্কিকভাবেই তাহাদের মধ্যে এই বিষ্ময়কর মিলন ও সংযোগ ঘটিয়াছে? তাহার পর একেবারে আকষ্কিভাবে ইহার সমস্তই মানুষের জন্য কেবল উপকারীই নয়, একান্ত সেবক হইয়া পড়িয়াছে; মানুষের বুদ্ধি এই ধরনের অস্বাভাবিক দুর্ঘটনাকে কোন ক্রমেই সত্য বলিয়া স্বীকার করিতে পারে না। কোন মানুষই এমন একটা দোকানের কল্পনা করিতে পারে না সেখানে বেচা-কেনা রীতিমতই চলিতেছে, মূল্য দেওয়া নেওয়াও যথাযথরূপে সম্পাদিত হইতেছে, এক জিনিস বিক্রয় হইয়া সেখানে আসিয়া ভর্তি হইতেছে আরও অনেক নূতন নূতন দ্রব্যসম্ভার, অথচ দোকানদার সেখানে কেহই নাই। বর্তমানে এমন কোন আবিষ্কৃত হইয়া থাকিলেও উহার অন্তরালে উহার পরিচালক একজন নিশ্চয়ই থাকিবে, তাছাড়া সেই যন্ত্র চলাও কিছুতেই সম্ভবপর নহে।
বিশ্ব প্রকৃতির কোণে কোণে প্রতি পরতে পরতে আমরা সুষ্পষ্টরূপে দেখিতে পাই এক সুদূঢ়, মজবুত ও সর্বব্যাপী নিয়মশৃংখলা। বাহ্যদৃষ্টিতে মনে হয় এই দুনিয়া বহু ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের কেন্দ্রভূমি, অন্যদিকে আমরা দেখিতে পাই এহেন ভিন্ন ভিন্ন জিনিসগুলির পারষ্পরিক এই কঠিন সংঘর্ষের মধ্যে ছোট বড় সমস্ত জিনিস যে কেবল বাঁচিয়া ও দাঁড়াইয়াহ আছে তাহা নয়, বরং সৃষ্টি জগতের বাড়িতেছে, ক্রমবিকশিত হইতেছে। একদিকে মনে হয় বিশ্বজগতের প্রত্যেকটি বস্তু এবং শক্তিই সম্পূর্ণ মুক্ত ও স্বাধীনভাবে নিজ নিজ গন্তব্য পথে তীব্র অগ্রসর হইতেছে। ইহার কোন একটিও যে কোন সুদৃঢ় নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুসরণ করিতেছে কিংবা ইহা যে কোন উচ্চতর শক্তির অধীন ও অনুগত হইয়া চলিতেছে, স্থুলদৃষ্টিতে তাহা মোটেই গোচরীভূত হয় না।
এইভাবে সৌরজগত সম্পর্কে যখন আমরা সুক্ষ্মদৃষ্টিতে চিন্তাকরি, কিংবা কোন অণুবিক্ষণ যন্ত্র দ্বারা পর্যবেক্ষণ করি, তখন আমরা সুস্পষ্টরূপে দেখিতে পাই যে, এক একটা বিরাট গ্রহ বিশেষ একটা দিকে তীব্র গতিতে হু হু করিয়া ছুটিয়া যাইতেছে। অনেক সময় এমনও হইয়া থাকে যে, এক একটি গ্রহ যদি মাত্রই না থামিয়া একেবারে উদ্দাম গতিতে কেবল সম্মুখের দিকেই অগ্রসর হইতে থাকে, তবে এই পৃথিবীর সাথে উহার সংঘর্ষে অবশ্যম্ভাবী এবং উহার ফলে এই মাটির পৃথিবীর সম্পূর্ণরূপে চূর্ণ বিচূর্ণ ও টুকরা টুকরা হইয়া যাওয়া একান্তভাবে অবাধারিত। এই ধরনের পর্যবেক্ষণের ফলেই অনেক জ্যোতির্বিদ সময় সময় ঘোষণা করিয়া থাকেন যে, এত দিনের মধ্যে অমূক গ্রহটির সহিত এই পৃথিবীর সংঘর্ষ হইবে। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট সময় ভিন্ন এক দিকে ছুটিতে শুরু করিয়াছে-যেমন কোন সুদক্ষ সহিস তীব্র গতিতে ছোট ঘোড়ার লাগাম কশিয়া ঘুরাইয়া দেয় অন্য আর একদিকে। ফলে এই দুনিয়া আসন্ন ও অবধারিত এক কঠিন বিপদের হাত হইতে রেহাই পাইয়া যায় নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে।
কিন্তু ঘোড়ার মতো উদ্দাম গতিতে ছোটা শূন্যমার্গের এই অসংখ্যা গ্রহের সহিস কে? পরিচালক কে? কে এই- গুলির লাগাম দৃড় মুষ্টিতে টানিয়া ধরিয়াছে এবং নির্দিষ্ট একটি সীমা পর্যন্ত উহাকে ছুটিয়া যাইতে দিয়া পুনরায় যখন ইচ্ছা এমনভাবে কশিয় ধরিতেছে যে, তাহার পরে উহার কোন একটিও নিজ ইচ্ছামত এক ইঞ্চি পরিমাণও অগ্রসর হইতে পারে না? ইহা কি শুধুই দুর্ঘটনা শুধুই স্বভাবের নিয়ম? ইহা কি অন্ধ ও জড়গ্রহগুলির নিজ নিজ ইচ্ছাক্রমেই সংঘটিত হইতেছে? না, তাহা হইতে পারে না। মানুষের মন জ্ঞান-বিবেক তারস্বরে ঘোষণা করে-আকাশ ও পৃথিবী রাজ্যকে একমাত্র আল্লাহ তাআলাই তাঁহার নিজস্ব সৃষ্টি-নিয়মের কঠিন মুষ্ঠিত ধারণ করিয়া আছেন।
আল্লাহ আকাশ রাজ্যকে এতদূর দূঢ় নিয়মে বাঁধিয়া রাখিয়াছেন যে, আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত উহার একটির উপর অন্য আর একটি আসিয়া পড়িতে ও কোনরূপ সংঘর্ষ বাঁধাইতে পারে না।
চারিদিকে এই জগতের বুকে আমরা এই সব বিষয়ে বাস্তবভাবেই প্রত্যক্ষ করিয়া থাকি; কিন্তু আরও অগ্রসর হইয়া যখন আমরা বিশ্ব জগতের নৈতিক গ্রহগুলির গতিবিধি ও পারষ্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ গবেষণা করি, সেখানেও আমরা পরিষ্কার দেখিতে পাই উক্ত নীতিরই বাস্তব কার্যকরিতা।
নৈতিক জগতে একটা ভুল নীতি ও বাতিল মতবাদের সৃষ্টি হয়। আর সেই সঙ্গে জন্ম হয় সেই নীতি ও মতবাদের প্রচারক এবং উহার নিশানবর্দার। তাহার পর তাহাতে গঠিত হয় একটা বাতিল চরিত্র নীতি, একটা বাতিল অর্থ-ব্যবস্থা এবং ভুল রাষ্ট্রপতি। এমন কি এই বাতিল নীতিগুলির জয়জয়কার দেখিয়া অনেক সময় মনে হয় সত্য-মত ও সত্য-নীতির আওয়াজ বুঝি বাতিলের উচ্চকিত কলকোলাহলে ক্ষীণ ওস্তদ্ধ হইয়া যাইবে, সত্যের পতাকা বুঝি এবার চিরদিনের তরে ধুলায় লুন্ঠিত হইবে। তারপরে সেই বাতিল নীতি ও ভুল আদর্শ এক মহা অবকাশ পাইয়া বসে এবং সেই অবকাশে সে তাহার বিষাক্ত জীবাণু সমগ্র জল স্থলের প্রতি পরতে পরতে ছড়াইয়া দেয়। এই সংকটময় মুহূর্তে সত্যের পতাকাবাহীগণ পূর্ণমাত্রার নৈরাশ্যের অন্ধকারে ডুবিয়া যায়, ব্যর্থতার আঘাতে সত্যের সেই সৈনিকদের আত্ম ভাঙ্গিয়া খান খান হইয়া যায়। কিন্তু সহসা সেই নি:সীম অন্ধকারের বক্ষ দীর্ণ করিয়া নতুন সূর্যের উদয় হয়, কোন এক অদৃশ্য হস্ত আকষ্কিভাবে সকল লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকিয়া সেই বাতিল নীতি ও আদর্শকে পরাজিত করে, উহাকে ভাঙ্গিয়া চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া দেয় এবং তার অফুরন্ত সাহায্যে সত্যের বিজয়ডংকা নতুন করিয়া বাজিয়া উঠে। সত্য-নীতি ও আদর্শ পৃথিবীর বুকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এইসব সূক্ষ্ম তত্ত্ব কথা প্রত্যক্ষ করিয়া জানিবার পর কোন মানুষকি এক মুহূর্তের তরেও বিশ্বাস করিতে পারে যে, এই দুনিয়া নিজস্বভাবে ও স্বীয় একক ক্ষমতার বলে কোন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া-ই অস্তিত্ব লাভ করিয়াছে এবং নিজেরই শক্তির বলে ইহা দাঁড়াইয়া আছে? কেহ কি মনে করিতে পারে যে, এই দুনিয়া কতগুলি বিভিন্ন প্রকারে মৌল উপাদান ও বস্তুর একটা সমষ্টি মাত্র এবং ইহা কোন উচ্চতর শক্তির কঠিন মুষ্টিতে আবদ্ধ নয়? পরিচালিত নয় কোন মহাশক্তিমান সত্তার নিয়ন্ত্রণে?
কাজেই এই কথা অনস্বীকার্যরূপে প্রমাণীত হইয়া যাইতেছে যে, এই বিশ্বপ্রকৃতির অন্তরালে এক বুদ্ধিমান ও পরাক্রমশালী মহান সত্তা বর্তমান, যিনি উহাকে সৃষ্টি করিয়াছে এবং যিনি জ্ঞান, শক্তি, প্রতিপালন, ক্ষমতা ও প্রতিকার স্বত:স্ফুর্ত গুণ বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণভাবে গুণান্বিত ও বিভূষিত। তিনিই নিজ জ্ঞান ও সৃজনী প্রতিভার দ্বারা জড়জগতের বিভিন্ন উপাদানগুলির পরষ্পরের মধ্যে একটা নিবিড় সংযোগ, সামঞ্জস্য ও মিলন সৃষ্টি করিতেছেন এবং সেইগুলির সমগ্র ভাবে একটা সুনির্দিষ্ট ও কল্যাণময় উদ্দেশ্যেসাধন করিবার জন্য ব্যবহার করিতেছেন।
এইখানে এ কথারও সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে যে, আকাশ হইতে পৃথিবী পর্যন্ত এবং এই আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে বহু নয়-একটি মাত্র সত্তাই বর্তমান, যিনি সৃষ্টিকর্তা, মালিক, যিনি নিজ ইচ্ছামত ইহার ব্যবহার ও প্রয়োগ করিয়া থাকেন। অন্যকোন ইচ্ছা তাঁহার শরীক নাই-অংশীদার বা সাহায্যকারী নাই। দুনিয়ার বিভিন্ন অংশ ও উপাদানগুলির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া যখন সেইগুলির সংযোগ সৃষ্ট এই সুন্দর সুরূপ ঐক্য অর্থ্যাৎ সমষ্টিগত দুনিয়ার রূপ ও সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করি, তখন ঠিক এই তত্ত্বই আমাদের সম্মুখে উদঘটিত হয় যে, এই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা ও মালিক মাত্র একজন সুরুচি সম্পন্ন এবং সুদক্ষ ককরিগরের দুষ্টান্তহীন শিল্প সৃষ্টির ফলশ্রুতি। উহার বিভিন্ন অংগ ও অংশের গঠন রূপদান যদি বিভিন্ন কারিগরের বিভিন্ন ইচ্ছা অনুসারে সাধিত ও বিকশিত হইতে পারিত না। এইভাবে সমগ্র দুনিয়ার সমষ্টিগত রূপও যখন কোন মানুষ প্রত্যক্ষ করি, তখন সে নিশ্চিতরূপে এই সিদ্ধান্তই করিত বাধ্য হয় যে, চারিদিকে বিস্তৃত পৃথিবীর এই চাকচিক্য ও মনোহর শোভা সৌন্দর্য একটি মাত্র পছন্দেরই স্বেচ্ছামূলক অভিব্যক্তি। যদি বহুবিধ ইচ্ছা ও রুচি তাহাতে কাজ করিয়া থাকিত এবং এই দুনিয়া বহু বিভিন্ন দেবতার লীলাক্ষেত্র হইত তবে প্রথম : উহার অস্তিত্ব ও স্থিতিই হইত সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। আর তা স্থায়ী হইত বলিয়া যদি ধরিয়াও লওয়া যায় তবুও ইহা এমনি রকমের এক সুসজ্জিত সুবিন্যাস্ত ও সুশৃঙ্ক্ষলিত সভামন্ডুপ কিছুতেই হইতে পারিত না; হইত একটা প্রকান্ড ও অসংবৃত গুদামঘর। এবং উহাকে আজ একটা সুন্দর ও অজস্র শোভার পরিপূর্ণ নিখুঁত ঐক্য হিসাবে না দেখিয়া আমরা উহাকে দেখিতে পাইতাম একটা ভয়ানক ও বিকট আকৃতির বীভৎস জিনিসরূপে। কারণ বিভিন্ন স্বাধীন নিরুংকুশ ইচ্ছার সংঘর্ষে কোন সুশৃংখলা ও সামঞ্জস্যপূর্ণ জিনিস সৃষ্টি হইতে পারে না, ইহা বৈজ্ঞানিক সত্য।
উপরন্তু আকাশ ও পৃথিবীর ব্যবস্থাপক ও পরিচালক যদি ভিন্ন ভিন্ন হইত, কিংবা যদি ইহা অসংখ্যা রুচি ও ইচ্ছার লীলাক্ষেত্র হইত, অথবা ভাল ও মন্দ, আলো ও অন্ধকার সৃষ্টিকর্তা যদি আলাদা হইত, তাহা হইলে বিশ্ব-ভূবনের এই বিপুল ও বিভিন্ন অংশ-উপাদানের মধ্যে এইরূপ নিবিড় ঐক্য ও সামঞ্জস্য থাকিতে পারিত না বরং ইহার একটার সাথে অন্যটার সংঘর্ষে সৃষ্টিজগত ভাঙ্গিয়া চুরমার হইয়া যাইত। বিশ্ব-প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে বিরোধ ও বৈষম্য দেখিতে পাইয়া যদি কেহ মনে করিয়া থাকে যে, ইহা ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবীর রুচি বা ইচ্ছা অনুসারে সৃষ্টি হইয়াছে, তবে তাহারা ভ্রান্ত ও প্রতারিত। কারণ স্থুল, নিতান্তই বাহ্যিক বিরোধ মাত্র! ইহার অন্তপ্রদেশে রহিয়াছে পূর্ণমাত্রার সাদৃশ্য সাযূয্য।
সৃষ্টি জগতের মধ্যে আর একটি রহস্য আছে, তাহা বিপরীত জিনিসের দ্বারা বিপরীত জিনিসের সৃষ্টি। সবুজ কাঁচা গাছ থেকে অগ্নিফূলিংগ নির্গত হওয়া, নিষ্প্রাণ জড় পদার্থ হতে প্রাণীর সৃষ্টি-কী এক অদ্ভূত ব্যাপার নয়? বিজ্ঞানের কার্যকরণ পরষ্পরা-তত্ত্ব এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মিথ্যা, একেবারেই ভূয়া বলিয়া মনে হয়। বিশ্ব-প্রকৃতিকে যাহারা নিছক কার্যকরণ পরম্পরার অন্ধ-নিয়মের অনিবার্য ফলশ্রুতি বলিয়া মনে করে, তাহারা এখানে সম্পূর্ণরূপে কুপোকাত। উপরুন্ত একই প্রকারের উপাদানের দ্বারা অসংখ্য স্ববিরোধী ও বিচিত্র জিনিসের সৃষ্টিকেও কি সামান্য ব্যাপার বলিয়া মনে করা যায়? একই মাটি, একই নিয়মে প্রবাহিত বায়ু, বৃষ্টি, শিশিরও এক, কিন্তু সংমিশ্রণে সৃষ্টি হইল যে উদ্ভিদ হইল কত বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন প্রকৃতির ও কত বিচিত্র। একই পিতার ঔরষে একই মায়ের গর্ভে জন্ম হইল কত বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন প্রকৃতির ও বিভিন্ন চরিত্রের এবং বিভিন্ন লিংগের সন্তান।
কত বিচিত্র ফুল আছে এই পৃথিবীতে, তাহা হিসাব করিবে কে? বৃক্ষরাজির পাতার ও ফলের আকার-আকৃতি, উহার পরিমাণ, রং, স্বাদ ও গন্ধ-সবই বিরোধী। কিন্তু সেসব বিরোধ একেবারেই বাহ্যিক। তাহাতে বিভিন্ন ইচ্ছা শক্তির কার্যকরিতা আছে বলিয়া মনে করিবার কোনই কারণ নাই। উপরন্তু বিশ্বপ্রকৃতির বাহ্যিকরূপ ও সৌন্দর্য বিভিন্ন উপাদানের পারষ্পরিক সংমিশ্রণ, দ্বন্দমূলক সৃষ্টিধারা এবং একই প্রকারের উপাদানের দ্বারা বিভিন্ন জিনিসের সৃষ্টি-এই সব কিছু দ্বারাই সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ হয় যে, এই দুনিয়া কোন আকষ্মিক ঘটনার ফলে অস্তিত্ব লাভ করে নাই এবং বিভিন্ন দেবদেবীর কীর্তিও ইহা নয়। স্থূলদর্শী মানুষ সমুদ্রের বুকে উত্তাল তরঙ্গমালাই শুধু দেখিতে পায়, কিন্তু সেই উর্মিমালার অতলতলে যে শুক্তি এবং সে শুক্তির অভ্যন্তরে যে বহুমূল্য মুক্তা, সে পর্যন্ত তাহার দৃষ্টি মাত্রই পৌঁছাতে পারে না। লোনা জলের সমুদ্র এবং মিঠা পানির দরিয়ায় বাহ্যত: কতই না প্রভেদ; কিন্তু ভাবিবার বিষয় এর উভয় প্রকারের নদী দ্বারা কেমন করিয়া একই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইতেছে। মানুষ এই উভয় প্রকারের পানি দ্বারা নিজেদের খাদ্য, নিজেদের অলংকার ও সম্পদ অর্জন করিতেছে। জাহাজ পরিচালনা ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের কাজ উভয়ের উপর দিয়া সমানভাবে কত সহজেই না সাধিত হইতেছে। রাতের অন্ধকার ও দিনের আলো, চন্দ্র ও সুর্য সম্পর্কে চিন্তা করিণলেও দেখা যায় ইহারা নিজ নিজ গরিমা ও বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়া কতই না পরষ্পর বিরোধী, কিন্তু তাহা সত্বেও ইহারা কত একাগ্রতা ও সামঞ্জস্যের সহিত বিশ্ব-প্রকৃতি এবং উহার আধিবাসী উদ্ভিদ পশু ও মানুষের অবিশ্রান্ত খেদমত করিতেছে। কাজেই আকাশ রাজ্যের দেবতা একজন এবং পৃথিবীর দেবতা আর একজন কিংবা বৃষ্টিপাত হয় একজনের ইংগিতে, বৃক্ষরাজিতে ফল ধরে অন্য দেবতার ইচ্ছায়-ধারাণা করার মূলে কোনই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বর্তমান নাই, থাকিতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে-অসংখ্যা প্রকারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের সংযোগ সৃষ্টি হইয়া একজন এককেন্দ্রিক প্রভু ও সম্রাট ব্যতীত এই দুনিয়া পরিপূর্ণ দৃঢ়তার সহিত বর্তমান রহিল কেমন করিয়া? এই পৃথিবীতে বিভিন্ন শক্তির ও বিভিন্ন অংশের পারষ্পরিক সংঘর্ষে নিরন্তর লাগিয়াই আছে, বিভিন্ন ও পরস্পর বিরোধী জিনিসের পারষ্পরিক দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম অবিরাম চলিতেছে; কিন্তু দুনিয়ার এই পান্সী নৌকা এই উত্তাল তরঙ্গমালার ঊর্দ্ধে থাকিয়া সামলাইয়া আত্মরক্ষা করিয়া, আছাড়া পড়িয়া আবার উঠিয়া সম্মুখের দিকে কেবল চলিতেছে আর চলিতেছে। একমাত্র প্রভূর সুদৃঢ় প্রভুত্ব কার্যকর হইয়া না থাকিলে কবে যে ইহা চূর্ণ বিচূর্ণ ও বিষ্মৃতির অতল দরিয়ায় ডুবিয়া যাইত তাহার কোন ঠিকানাই ছিল না।
নিখিল-প্রকৃতির এবং সমগ্র জীব-জন্তু ও বস্তু জড় হইতে উদ্ভূত, কোন সষ্ট্রা নাই, কোন ব্যবস্থাপক নাই-বর্তমান কালের এক শ্রেণীর বৈজ্ঞানিকদের ইহা এক বলিষ্ঠ মত। উপরন্তু তাহাদের দূঢ় বিশ্বাস এই যে, বিশ্ব-সৃষ্টি সম্পর্কে ইহাই হইতেছে সর্বশেষ কথা। কিন্তু এই বলিষ্ঠ মতের গোড়ায় যে কতখানি দুর্বলতা ও অযৌক্তিকতার নির্লজ্জতা নিহিত রহিয়াছে তাহা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিচার করিলেই প্রকট হইয়া পড়ে।
জড় সম্পর্কে প্রাচীন মত এই যে, দুনিয়ার যে সব নতুন সংঘঠিত ঘটনার আবর্তন আমরা অনুভব করিয়া থাকি তাহা সবই অননূভুত পরমাণু কীর্তি। চেতনা ও মন জড়েরই ক্রিয়া, জড় নিছক একটা পদার্থ বিশেষ, বাকী সমস্ত তাহারই অভিব্যক্তি মাত্র।
বস্তুত জীবন ও চৈতন্যের যান্ত্রিক বা জড়ীয় পন্থায় বিশ্লেষণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। মানবদেহের সমস্ত গুরূত্বপূর্ণ কার্যাবলী যথা রক্তের প্রবাহ, হজম, শ্বাস-প্রশ্বাস প্রভূতি বর্ধিষ্ণু দেহেরই পরিচায়ক ও পরিপোষক। পদার্থ বিজ্ঞান কিংবা রাসায়নিক পন্থায় ইহার বিশ্লেষণ করা যায় না। কারণ তাহাতে প্রশ্ন হইতে পারে যে, পূর্বে কোন প্লান রচনাবলী ছাড়া অ-মন হইতে মন এর সৃষ্টি হইল কিরূপে? নির্জীব ও অচেতন জড় হইতে জীবনের উদগম হইল কেমন করিয়া? জীবন, মন ও চেতনা কি নিজেই সৃষ্টি হইয়াছে? তাহা হওয়া কি কোন প্রকারেই সম্ভব?
বস্তুত: গোড়াতেই এক সৃষ্টিকর্তা ও এক ব্যাবস্থাপক স্বীকার না করিয়া লইলে জীবনের বিশ্লেষণ কিছুতেই সম্ভব হইতে পারে না। তিনিই জড়ের মধ্যে এক বিরাট ও অপূর্ব ক্ষমতা দান করিয়াছেন, তিনিই সেই জড়কে বিবর্তিত ও বিকশিত করিতেছেন। প্রকৃতির যদি শৃংখলা না থাকিত, তবে না দুনিয়া হইতে পারিত, না জীবন। এই শৃংখলাকে কায়েম রাখিয়াছেন বিশ্ব-প্রকৃতির একমাত্র সৃস্টিকর্তা ও ক্রমবিকাশদাতা আল্লাহ তাআলা।
যন্ত্র-বিজ্ঞান জীবনকে শুধু জড়ের সাহায্যেই বুঝিতে চায়; কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে স্বয়ং বিজ্ঞানই জড়ের তত্ত্ব ও এত সুন্দর ও সুস্পষ্ট করিয়া বিশ্লেষিত করিয়াছে যে, তাহা আল্লাহ তাআলারই প্রবল ও দুর্লংঘ নিয়ম শৃংখলার অধীনে বিলীন এবং কঠিন দাসত্বের নিগড়ে বন্দী। উহা এই দুনিয়ার প্রভুত্ব, মালিকত্ব ও সৃষ্টি-শক্তির বিন্দুমাত্র অধিকারী নয়। এই সবের অন্তরালে আল্লাহ তাআলাই হইতেছেন ইহাদের সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা এবং এই সকলের উপর তিনিই একমাত্র ও একচ্ছত্র প্রভু। বিশ্ব-ভূবনের প্রতিটি অণূ-পরমাণু সমানভাবে সেই একমাত্র আল্লাহ তাআলারই একান্ত দাস। অতএব-
হে মানুষ! তোমরা সেই মহান প্রভূর দাসত্ব কবুল করা যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববতী লোকদের সৃষ্টি করিয়াছেন। তাহা হইলে সম্ভবত: তোমরা (তাঁহার আজাব হইতে) বাঁচিতে পারিবে। তিনি তোমাদের জন্য মাটির শয্যা এবং আকাশের ছাদ তৈয়ার কিরয়াছেন। ঊর্ধ্বে হইতে বৃষ্টিপাত করিয়াছেন। অতএব তোমরা জানিয়া শুনিয়া এক আল্লাহ তাআলার সাথে অন্য কেহ শরীক আছে বলিয়া মনে করিও না।
0 comments: