আলাদাভাবে প্রত্যেকটি মানুষের এবং সমগ্রভাবে গোটা মানব জাতির মনস্তত্ব বিশ্লেষণ করিলে পরিষ্কার দেখিতে পাওয়া যায় যে, মানুষের গভীর মনে এক দয়াময় প্রভুর তীব্র চবেতনা বিদ্যামান। বস্তুত: মানব-প্রকৃতিতে এই চেতনাই হইতেছে সবচেয়ে আদিম ও সমদিক সুস্পষ্ট এবং সর্বাধিক শক্তিশালী। এই চেতনা মানুষের সমগ্র মনোরাজ্যকে, তাহার সমস্ত স্নায়ূমন্ডলীকে সর্বোতভাবে গ্রাস করিয়া আছে। ঠিক এই কারণেই আদিম মানব সেই প্রথম থেকেই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অনুভব করিতে পারিয়াছিল এবং ধীরে ধীরে তাঁহার দয়া ও অনুগ্রহ, তাঁহার বিপুল শক্তি ও ঐশ্বর্যের অবদান লক্ষ্য করিয়া তাঁহার দিকে আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল। তাঁহার আনুগত্য স্বীকার করিতে এবং নিজেকে তাঁর নিকট পরিপূর্ণরূপে সোপর্দ করিয়া দিতে বিশেষ ভাবে ব্যাগ্র-ব্যাকুল হইয়া পরিয়াছিল। অতএব এক সৃষ্টিকর্তাকে স্বীকার করার ইতিহাস মানবজাতির ইতিহাসের মতই আদিম ও দীর্ঘ। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে মানুষের ধারণা বস্তুজগতের মত ক্রমশ: বিবর্তিত হইয়া বহুত্ববাদ হইতে একত্ববাদ হইতে একত্ববাদ আসিয়া পরিণত হইয়াছে-আধুনিক বিজ্ঞানীদের এই ধারণা সম্পূর্ণরূপে ভূল ও প্রতারণাময়, সন্দেহ নাই।
মানুষ নিজের সম্পর্ক চেতনা লাভ করিয়াই দেখিতে পাইয়াছে। তাহার দেহের অভ্যন্তরে প্রভূত শক্তি ও বহুবিদ গুণ-গরিমার বিপুল সমাবেশ আর বাহির পৃথিবীতে দেখিতে পাইয়াছে কত অগণিত দ্রব্যসামগ্রী তাহার সুখ-সম্ভোগ বিধানের জন্য নিরন্তর প্রস্তুত ও মহাকর্মে নিযুক্ত হইয়াছে। ইহার ফলে একদিকে যেমন সে একমাত্র সৃষ্টিকর্তার অতুলনীয় দয়া-অনুগ্রহ দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছে এবং তাহাকে ভালবাসিয়াছে তেমনি উহার পরই সেই সৃষ্টিকর্তার রুদ্র কঠিন বৈশিষ্ট্যের কথা জানিতে পারিয়া তাহার প্রাপ্ত এই সব সম্পদ হারাইবার আতংকে ভীত-শংকিত হইয়া পড়িয়াছিল। অতএব এক সৃষ্টিকর্তাকে স্বীকার করার ইতাহাস মানবজাতির ইতিহাসের মতই আদিম ও দীর্ঘ। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে মানুষের ধারণা বস্তুজগতের মত ক্রমশ: বিবর্তিত হইয়া বহুত্ববাদ হইতে একত্ববাদে আসিয়া পরিণত হইয়াছে-আধুনিক বিজ্ঞানীদের এই ধারণা সম্পূর্ণরূপে ভূল ও প্রতারণাময়, সন্দেহ নাই।
মানুষ নিজের সম্পর্কে চেতনা লাভ করিয়াই দেখিতে পাইয়াছে, তাহার দেহের অভ্যন্তরে প্রভূত শক্তি ও বহুবিদ গুণ-গরিমার বিপুল সমাবেশ আর বাহির পৃথিবীতে দেখিতে পাইযাছে কত অগনিত দ্রব্যসামগ্রী তাহার সুখ-সম্ভোগ বিধানের জন্য নিরন্তর প্রস্তুত ও মহাকর্মে নিযুক্ত হইয়াছে। ইহার ফলে একদিকে যেমন সে একমাত্র সৃষ্টিকর্তার অতুলনীয় দয়া-অনুগ্রহ দেখিয়া মুদ্ধ হইয়াছে এবং তাহাকে ভালবাসিয়েছে তেমনি উহার পরই সেই সৃষ্টিকর্তার রুদ্র কঠিন বৈশিষ্ট্যের কথা জানিতে পারিয়া তাহার প্রাপ্ত এই সম্পদ হারাইবার যে, যে আল্লাহ তাআলা দয়া করিয়া তাহাকে এত কিছু দিয়াছেন, সেই আল্লাহ তাআলাই তাঁর নিজ ইচ্ছামত ও নিজ শক্তির বলে আবার এই সব কাড়িয়া লইতে পারেন। এই জন্যই মানুষ একদিকে তাহার প্রাপ্ত সম্পদগুলির সংরক্ষণ ও আরো অধিক প্রাপ্তির আশায় আল্লাহ তাআলার হুকুম পালন করিবার জন্য এবং অন্যদিকে সেই সম্পদ হারাইবার ভয়ে খোদার নিষিদ্ধ কাজকর্ম হইতে বিরত থাকিবার জন্য অধিক আগ্রহান্বিত হইয়া পড়িল। ইহা হইতেই প্রমাণ হইয়া যায় যে, প্রকৃতির বিকট রূপ দেখিয়া ভীত ও সন্ত্রস্ত হইয়াই মানুষ সর্ব প্রথম বিধাতার পূজা করিতে শুরু করে নাই। বরং তাহার পূর্বে প্রাপ্ত সম্পদের ভিতর দিয়া সৃষ্টি কর্তার দিকে মানুষ কৃতজ্ঞতায় একান্তভাবে বিনয়বনত হইয়া পড়িয়াছে। এ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকদের ধারণার ভ্রান্তি সুস্পষ্ট।
দানের কথা চিন্তা করিলেই জাগে দাতার সম্পর্কে চেতনা। আর এই দান ও দাতার সন্দেহতিত প্রত্যয়ই মানুষের মনে জাগাইয়া তোলে দাতার প্রতি সুগভীর কৃতজ্ঞতা এবং তাঁহার আনুগত্য করার উদ্দম ভাবাবেগ। ইহা শুধুমাত্র অভ্যাসের সৃষ্টি নয় আর কেবল তামদ্দুনিক জীবন যাপনের ফলও ইহা নয়। এই ভাবধারা আমরা অনেক সময় বন্য পশুর মধ্যেও প্রত্যক্ষ করিয়া থাকি। কিন্তু মানুষের প্রকৃতিতে এই ভাব বর্তমান পাওয়া যায় সবচেয়ে উত্তম স্বত:স্ফূর্ত ও উন্নতরূপে। এই ভাবাবেগই মানুষের প্রকৃতিতে জন্ম দিয়াছে এক অটল-অমোঘ ইনসাফের নিদারুণ স্বীকৃতি। তাই আজ মানুষের জন্য ওজন করা হয় যে দাড়িপাল্লায়, সেই মানুষ পরের জন্য মাপে ঠিক সেই বাটখাঁরা দিয়া। ইনাসাফের এই তীব্র অনুপ্রেরণাই খালেছে আস্তক্যবাদ এবং তাওহীদের সুদৃঢ় বুনিয়াদ স্থাপিত করিয়াছে। নিখিল মানুষের হৃদয়-মন তাই সেই এক এর সন্ধ্যানেই সন্থন করিয়াছে সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সীমাহীন সমূদ্র। মানুষের প্রকৃতিগত এই ইনসাফ একদিকে দাবি করে যে, সৃষ্টিকর্তার সমস্ত গুণ ও অধিকারকে পরিপূর্ণরূপে স্বীকার করিতে হইবে। আর তাঁহার সে সব অধিকার ও গুণকে স্বীকার করা হইবে, তাহাতে অন্য কাহাকেও অকারণ শরীকদার মনে করা হইবে না। অন্যথায় ইহা একটা মস্তবড় জুলুম ও পরের অধিকার নষ্ট করার একটা ভয়ানক অপরাধ হইবে, সন্দেহ নাই।কাজেই এই কথা উদাত্তকন্ঠে ষোষণা করা যাইতে পারে যে, বিশ্ব ভূবনের একমাত্র সত্য ও সবচেয়ে বড় ইনসাফ হইতেছে তাওহীদ (সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদ) এবং সবচেয়ে বড় জুলুম হইতেছে শিরক (বহুত্ববাদ)। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির ব্যাপারে এবং মানুষের নিকট প্রাপ্য ইবাদত-উপাসনায় অন্য কাহাকেও শরীক করেন নাই। একমাত্র আল্লাহ তাআলাকেই সৃষ্টিকর্তা ও উপাস্যরূপে গ্রহণ করিতে আদেশ করিয়া অন্যের কাছে মাথা নত করার লাঞ্চনা হইতে মানুষকে রক্ষা করিয়াছেন। মানব জাতির প্রতি ইহা তাঁহার সমস্ত শ্রেষ্ঠ অনুগ্রহের মধ্যে অন্যতম। কারণ মানুষকে যদি দুনিয়ার সমস্ত বড় শক্তিমানের কাছে মাথা নত করিতে ইহত, ভয় ও উপাসনা করিত হইত, তাহা হইলে আল্লাহর সেরা সৃষ্টি এই মানুষ জাতির একদিকে যেমন চরম অবমাননা হইত, অন্য দিকে তেমনি মানুষের জীবন ভরিয়া কেবল প্রত্যেক বড় জিনিসেরই পূজা করিতে হইত। তখন তাহার আবস্থা হইত মহল্লার এক সাধারণ চৌকিদাররের মত গ্রামের মোড়ল ও ইউনিয়ন বোর্ডের দফাদার চেয়ারম্যান হইতে শুরু করিয়া দেশের লাট-প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত প্রত্যেক অফিসারকেই বিনীত আদাব-আরজ করা। প্রত্যেকের হুকুম তালিম করা এবং প্রত্যেকের ধমক ও গালাগাল খাওয়াই হইতে তাহার জীবনের নিত্যকার কর্তব্য। অথবা তাহার অবস্থা হইত বৃন্তচ্যুত একটা ছিন্ন-শুকনা পাতার মত, হওয়ার সামান্য দোলা-ই তাহাকে ঠেলিয়া লইয়া যাইত এক স্থান থেকে অন্যস্থানে, একদিকে হইতে অন্যদিকে। মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্বের মূলে রহিয়াছে এই সুগভীর তত্বকথা। এই জন্যই মানব প্রকৃতি স্ববাবত:ই ভালবাসে ও কামনা করে আঁধারের পরিবর্তে আলো, মুর্খতার বদলে সত্যজ্ঞান আর অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার স্থানে পরম স্থিরতা, নির্ভরতা ও স্বচ্ছদৃষ্টি। চারিদিকে বিস্তৃত এই বিশ্ব-ভূবন তাহার সম্মুখে একটা বিরাট রহস্য হইয়া থাকিবে, ইহার সুস্পষ্ট কোন সমাধান সে পাইবে না, ইহার শুরু ও শেষ সম্পর্কে কোন নিশ্চিত ধারণাই তাহার থাকিবে না, একথা মানুষ কি করিয়া বরদাশত করিতে পারে? মানুষ নিজের অস্তিত্ব ওজীবনের উদ্দেশ্যে সম্পর্ক তাহার ভাল-মন্দ ও পাপ-পূন্য সম্পর্কে সে একেবারেই বে-খবর থাকিবে-কিছুই জানিবেনা, বুঝিবেনা যে সে কোথা হইতে আসিয়াছে কোথায় যাইবে এবং এইখানে নিজের সাথে ও চারিপার্শ্বের এই কোটি কোটি মানুষের সাথে সে কি ধরণের ব্যবহার করিবে, কিরূপ সম্পর্ক স্থাপন করিবে, ইহা একটা বড়ই অস্বাভাবিক ব্যাপার। মনব প্রকৃতি এই ধরণের অন্ধত্ব ও অজ্ঞতা কিছুতেই বরদাশত করিত পারে না। এই প্রকারের সমস্ত প্রশ্ন সম্পর্কে চিন্তা করা, তাহার সঠিক নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য সমাধান সন্ধান করা এবং তাহার প্রত্যেকটা সম্পর্কে একটা না একটা পরিষ্কার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মানব প্রকৃতির ঐকান্তিক দাবি। মানুষ এ বিষয়ে মাথা না ঘামাইয়া ও গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত না হইয়া কিছুতেই স্বস্তি পাইতে পারে না, ইহা মানব মনের অতি স্বাভাবিক পিপাসা, ইহার পরিতৃপ্তি অপরিহার্য! কিন্তু সেই পরিতৃপ্তি হইবে কেমন করিয়া?
এ প্রশ্নের প্রকৃত জওয়াব এই যে, মানুষ এক আল্লাহকে স্বীকার করিলেই এই উদগ্র পিপাসার নিবৃত্তি হইতে পারে। তাহা ছাড়া আর যাহাই সে করিবে, তাহাই হইবে ধাঁ ধাঁ-একটা মারাত্মক প্রতারণা। এই আল্লাহ তাআলাকে স্বীকার করিলেই মানুষের অশান্ত ও উচ্ছৃংখল মন স্থিরতা লাভ করিতে পারে, নিরবচ্ছিন্ন স্বস্তি ও আরামের নিশ্বাস ছাড়িতে পারে। বস্তুত তাওহীদ একটা আলো। এই আলো মানব হৃদয়ে প্রকটিত হইলেই সমগ্র সমস্যার সমাধান-সমস্ত প্রকারের জিজ্ঞাসার সুষ্ঠু জওয়াব সহজেই লাভ করা যায়। এই বিশাল প্রকৃতির বুকে মানুষ তাহার নিজের অস্তিত্ব ওঅবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা করিতে পারে, এখানে তাহাকে কি করিতে হইবে, মানব সমাজের অসংখ্যা পদের মাঝে সে কোন পথ গ্রহণ করিবে আর কোন পথ বর্জন করিবে তাহা সে অতি সহজেই নির্ধারণ করিতে পারে। ইহা দ্বারাই তাহার চারিত্রিক আদর্শ, অর্থনৈতিক বিধি-ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন ও সমাজ-পদ্ধতি অতীব সহজ ও প্রাঞ্জল হইয়া যায়।
এই উপায়ে মানব জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান পাইয়াও যাহার নিছক সন্দেহ ও অমূলক অবিশ্বাসের বশবর্তী হইয়া তাহাকে কার্যকরভাবে গ্রহণ করে না, তাহারা মানব জাতির কুলাংগার। অবজ্ঞা ও সন্দেহবাদ মনোরাজ্যের একটা মারাত্মক রোগ, ইহা মানুষের মন ও প্রকৃতিগত স্বাস্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই রোগ যত শিঘ্র দূর হয়, মানব মনের স্বাস্থ্য রক্ষার পক্ষে ততই মঙ্গল। মানুষের মনে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব এবং তাঁহার একত্ববাদ সম্পর্কে যে দৃঢ় প্রত্যয় রহিয়াছে, তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মানুষ তাহার নিজের ভিতর হইতেও পায়, বাহির প্রকৃতি হইতেও পায়। তাঁহাকে ছাড়া এই বিশ্ব-ভূবনের এবং তাহার নিজের অস্তিত্বের এই বিরাট রহস্যের কোন মাধ্যমেই সে করিতে পারে না। বস্তুতপক্ষে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব, তাঁহার একত্ববাদ এবং সমগ্র মহান গুণ-বৈশিষ্ট্য তাঁহার গুণান্বিত হওয়ার ইহাও একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। আর এই প্রমাণ যে সত্য, এই সমাধান যে একেবারে অকাট্য ও সন্দেহতীত তাহারও প্রমাণ এই যে, ইহা দ্বারা মানব মনের দুর্নিবার পিপাসা মেটে, তাহার অশান্ত মন স্বস্তি এবং স্বান্তনা লাভ করিতে পারে। কিন্তু সেই আল্লাহর এবং তাঁহার সমস্তু গুণ-বৈশিষ্ট্য স্বীকার না করিয়া কোন মানুষ যদি অন্য কাহাকেও প্রভু বলিয়া মান্য করে এবং তাহাকে আল্লাহর মর্যদা দান করে তবে ইহা তাহার চরমতম দুর্ভাগ্যের প্রমাণ ছাড়া আর কি হইতে পারে। সে চলন্ত ট্রেনের দরজাকে নিজের ঘরের দরজা মনে করিয়া বাহির আংগিনায় পা রাখিয়া তাহার নিজের এই মারাত্মক ভ্রন্তিরই প্রায়শ্চিত্ত করিতে থাকে তাহার সমস্ত জীবন ভরিয়া।
মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে আরো গবেষণা করিলে এই তত্ব লাভ করা যায় যে, মানুষ স্বাভাবত:ই অপমান, লাঞ্চনা আধোগতি, পরের আনুগত্য ও গোলামীকে ঘৃণা করে এবং নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্য লাভ করাকে একান্তভাবে কামনা করে। নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভার অপূর্ব কীর্তি দেখিতে পাইয়া মানুষ মনে করে এই বিশাল দুনিয়ায় তাহার সমতূল্য ও তাহার প্রতিদ্বন্ধি আর কেহই নাই। এই শ্রেষ্ঠত্ব বোধের বড় মনস্তাত্বিক কারণ এই যে, মানুষ প্রকৃত পক্ষে আশরাফুল মাখলুকাত এই দুনিয়ার সে সৃষ্টিকর্তার খলীফা। মানুষ তাহার এই বিশিষ্টতা ও প্রতিনিধিত্বের প্রচন্ড অনুভূতি লইয়াই এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়াছে। তাহার এই পদ অনুসারে তাহার প্রকৃতিতে যদি এই শ্রেষ্ঠত্বের চেতনা স্বতস্ফূর্ত হইয়া না থাকিত, তবে সে এই পদের মর্যদা রক্ষা করিতে পাই যে, মানুষ অনেক সময় খোদায়ীর দাবি করিয়া বসে। মানুষ কখনো নিজেকে নিজের জাতির, তথা সমস্ত মানুষের গর্দানের মালিক ও জান-মালের একচ্ছত্র সম্রাট মনে করিতে শুরু করে। আর দাস হওয়ার বদলে খোদা হইয়া আল্লাহরই সৃষ্ট এই ধরণীতে নিজের আইন জারী করার মাধ্যমে নিজেরই প্রভুত্ব কায়েম কারিতে উদ্যত হয়। কিন্তু এই শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে যখন সে দিখিতে পায় যে, তাহার সেই এই সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতাকে তাহার জীবনের শুরু ও শেষ বাল্য ও বার্ধক্যের দুই পংগুতার বেড়াজাল দিয়া ঘিরিয়া রাখা হইয়াছে, তখন আপনা আপনিই তাহার গর্বোন্নত মস্তক আবনমিত হইয়া আসে। তখন খোদায়ীর রাজ-তখত ছাড়িয়া সে দাসত্বের ধূলি মাটিতে নামিয়া আসে এবং নিখিলের কোটি মানুষের সারিতে সমান হইয়া দাঁড়াইয়া যায়। তাহার যে ললাট কোনদিন কাহারও সম্মুখে নত হয় নাই, তাহাই এখন অবলুন্ঠিত হইয়া পড়ে এমন শক্তির কাছে, যিনি দুনিয়ার সমস্ত শক্তি যোগ্যতার একমাত্র উৎস এবং সমগ্র আকাশ ও ভূসমন্ডলের একমাত্র মালিক ও ব্যবস্থাপক। কাহাকেও আল্লাহ বা আল্লাহ বলিয়া মানিয়া লইবার আগ্রহ মানুষের প্রকৃতিতে আছে বলিয়াই যে সে আল্লাহকে স্বীকার করে তাহা নয়, তাহার নিজের প্রকৃতিই ত আল্লাহর জন্য সতত ব্যাকুল, কিন্তু সে নিজের অভ্যন্তরে বিপুল শক্তির সমাবেশের সঙ্গে সঙ্গে যখন তাহার অক্ষমতা সসীমতাকেও প্রত্যক্ষ করে, তখন সে পরিষ্কার দেখিতে পায়, তাহার ধন-সম্পত্তি, ক্ষমতা ও রাজত্ব কোন কিছুই তাহার নিজের নয়, সবই আল্লাহর দান, উপরন্তু প্রকৃতিক জগতের উপর তাহার কোনই হাত নাই। মানুষের প্রকৃতিতে শ্রেষ্টত্বের অনুভূতি এত তীব্র ও প্রচন্ড যে, অনেক সময় সে এই দিক দিয়া একেবারে অন্ধ হইয়া যায় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তাহার এই অক্ষমতা ও অসহায়তা তাহার নিকট ধরা না পড়ে ততক্ষণ সে খোদায়ীর দাবি ত্যাগ করিতে মোটেই সম্মত হয় না।
মানুষ যখন পরমরূপে এক বিধাতাকে লাভ করে, তখন সে দুনিয়ার সব কিছুরই প্রভুত্ব অস্বীকার করিয়া নিজেকে একান্তভাবে তাঁহারই দরবারে উৎসর্গ করিয়া দেয়। তখন সে উদাত্ত কন্ঠে ষোষণা করে আশহাদুআল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু- اَشْهَدُ اَلله اِلهَ اِلاَّ اَللهُ ـ আমি আল্লাহ ছাড়া আর কাহাকেও মানি না। কিন্তু তখনো যদি কেহ অন্যের প্রভুত্ব স্বীকার করিতে প্রস্তুত হয় তবে তাহাকে সেই দ্বীন প্রকৃতির ভিখারীর মত মনে করা যাইতে পারে, যে একজনের কাছ থেকেই তাহার প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিস পাওয়া সত্বেও মুঠি মুঠি ভিক্ষার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া ফিরে এবং নীচতার কদর্যতা এত সীমাহীন হইয়া যায় যে, তাহার অপেক্ষাও সর্বহারার নিকট ভিক্ষার হাত দরাজ করিতে তাহার বিন্দুমাত্র লজ্জা বোধ হয় না। ঠিক এই অবস্থায় পৌঁছিয়াই মানুষ পাহাড়, বৃক্ষ, নদী, হিংস্র জন্ত, সংসহার মূর্তি কিংবা বিশেষ গুণে ভূষিত একজন মানুষের প্রভুত্ব স্বীকার করিয়া তাহার পূজা করিতে, তাহার রচিত আইনকে নির্বিচারে পালন করিতে শুরু করে। বস্তুত: মানুষের মূল প্রকৃতি ইহা নয়, ইহা তাহার আসল প্রকৃতির চরমতম বিকৃতি। ভিক্ষুকদের সংখ্যা আজ অত্যন্ত বেশী হওয়া সত্ত্বেও ইহাতে কোনই সন্দেহ নাই যে, মানুষের মূল প্রকৃতিই হইতেছে ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মান অনুভূতি ও পর-নিপেক্ষতা। ঠিক সেইরূপ এক সৃষ্টিকর্তার সহিত শরীককারীদের সংখ্যা আজ গণনাতীত হওয়া সত্বও মানব-প্রকৃতির মূল সত্য যে তাওহীদ তাহা চিরকালই সূর্যের মত দেদীপ্যমান থাকিবে।
এক আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব ওপ্রভুত্বকে অস্বীকার করার কোন উপাই মানুষের নাই, তাহার ভিতরে প্রচুর শক্তি-সামর্থ মওজুদ থাকা সত্ত্বেও সে নিজের হৃদয়-মনে তীব্রভাবে অনুভব করে একটা দু:সহ রিক্ততা ও প্রচন্ড হাহাকার। এক আল্লাহকে স্বীকার না করিয়া সেই এক এর সমীপে নিজেকে উজাড় করিয়া ঢালিয়া না দিয়া সে কিছুতেই স্বস্তি পাইতে পারে না। পরন্তু মানুষ যখন এক আল্লাহকে নিসংশয়ে কবুল করে তখন সে দুনিয়ার সমস্ত প্রকার বিশ্ব হইতে নিরপেক্ষ, মুক্ত ও সম্পূর্ণ আজাদ হইয়া যাইতে পারে। অতপর বিশ্ব-প্রকৃতির কোন বিরূপ, কোন ভয়ংকর রূদ্র মূর্তি, কোন অসাধারণ শক্তি এবং কোন মানুষের অপূর্ব ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা দেখিয়া সে কিছুমাত্র বিচলিত ও মন্ত্রমুগ্ধ হয় না। ইহাদের কাহাকেও প্রভু বা সৃষ্টিকর্তারূপে গ্রহণ করিবার, কাহারো সামান্য তারিফ-প্রশংসা ও গুণকীর্তণ করিবার কোনই আব্যশকতা সে মনে করে না। একমাত্র প্রভুর গোলামী করার পরিবর্তে অসংখ্যা প্রভু, মালিক ও মনিবকে সে কিছুতেই স্বীকার হইতেছে আল্লাহ তাআলা। এবং সেজন্য ভক্তি, শ্রদ্ধা ও প্রশংসা পাইবার যোগ্য একমাত্র তিনি-অন্য কেহ নয়।
মানব প্রকৃতিতে কেবল শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতিরই বিদ্যমান নয়, তার সঙ্গেই আছে নিজের নিকৃষ্টতার ও অসহায়তার চেতনা। মানুষের ভিতরে বিপুল শক্তি আছে, প্রতিভা আছে, তাহা দ্বারা সে আকাশ ও পৃথিবী রাজ্যের গোপন শক্তি সম্পদগুলিকে আবিষ্কার করিয়াছে। দুর শূন্যলোকে সে নিজের সিংহাসন স্থাপিত করিয়াছে, পাহাড়ের বুক ভেদ করিয়াছে, সমুদ্রের উপর দিয়া অবলীলাক্রমে নিজের সিংহাসন স্থাপিত করিয়াছে, পহাড়ের বুক ভেদ করিয়াছে, সমুদ্রের উপর দিয়া অবলীক্রমে নিজের বিজয়রথ চালাইয়াছে, কিন্তু এই সব কিছু সত্ত্বেও সে নিজের অসাহয়তা ও অক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ। সে জানে যে, যেসব শক্তি ও প্রতিভার দৌলতে সে এই সব র্কীতিকলাপ করিতে পারিয়াছে, সে নিজে তার একটিরও সৃষ্টিকর্তা বা নিরুংকুশ মালিক নয়। তার ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীর কোনটাই সে নিজে সৃষ্টি করে নাই, সকলই অন্যের দেওয়া। সে শুধু নিজের ভিতরের সমস্ত শক্তি নিযুক্ত করিয়া সাধনা করিয়াছে মাত্র। এইভাবে প্রত্যেকটি বুদ্ধিমান মানুষই নিজের জীবনের প্রত্যেকটা অধ্যায় ও কাজে এক আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব এবং তাঁহার সর্বগ্রাসী প্রভুত্বকে মর্মে মর্মে অনুভব করিতে পারে।
দুনিয়ার বড় বড় খোদাদ্রোহী মানুষের প্রকৃতিতেও এই চেতনার জাগরণ ও উদ্দীপনা দেখিতে পাওয়া যায়। যেসব দুর্দান্ত দাম্ভিক মানুষ বিজ্ঞানের মানুষ বিজ্ঞানের জোরে বিশ্ব-প্রকৃতিতে জয় করার গৌরব আল্লাহেক অস্বীকার করার স্পর্ধা করিয়াছিল, আল্লাহর এই দুনিয়াতে নিজের প্রভুত্ব কায়েম করিয়া ও নিজের রচিত আইন জারী করিয়া অধিকার চর্চা করিয়াছিল, আজ আমরা পরিষ্কার দেখিতে পাইতেছি, তাহাদের সমস্ত ক্ষমতা ও সাধনার অনিবার্য ব্যর্থতা। তাহাদের বিলীয়মান অবস্থা তাহাদের চোখে আংগুল দিয়া দেখাইয়া দিতেছে মনুষ্য জাতির নিস্করুণ অসহায়তা। তাহারাও ধীরে ধীরে এক আল্লাহ তাআলারই পরিপূর্ণ প্রভুত্ব স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়া পড়িতেছে। তাওহীদের অনিবার্যতা নতুন করিয়া বুঝিবার অভিনব দিন আজ সমাগত।
وَفيْ اَلاَرْضِ اِيَتٌ لِلُوُوْ قِنِيْنَ وَ فِىْ اَنْفُسِكُمْ اَفَلاَ تُبْصِرُوْنَ ـ
পৃথিবীতে প্রতিবিন্দুতে, এবং হে মানুষ! তোমাদের মন ও প্রকৃতির মধ্যে এক আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের নিদর্শন রহিয়াছে, তাহা বিশ্ববাসীগণই বুঝিতে পারে, কিন্তু তোমরা কি তাহা দেখিতে পাওনা?
0 comments: