তাওহীদ বিশ্ব-প্রকৃতির অন্তর্নিহিত এক মাত্র গভীর ও মহা সত্য। একটা বিরাট বৃক্ষের সাথে ইহার তুলনা করা যাইতে পারে। একটা বৃক্ষের মতই ইহার মূল শিকার বিশ্ব-প্রকৃতি ও মানব-হৃদয়ের গভীর তলদেশে মজবুত গাঁথিয়া আছে। ইহার কাণ্ড উপরে প্রকাশমান, ইহার শাখা-প্রশাখা সুদূর ঊর্ধ্বলোকে বিস্তারিত-ইহা পরিব্যাপ্ত করিয়া আছে নিখিল সৃষ্টিকে।
অতএব ইহার মূলকে স্বীকার করিলেই অব্যশম্ভাবীরূপে মানিয়া লইতে হয় ইহার কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখাকে এবং ইহার পত্র-পল্বব ও ফলফূলকে। ইহার মূলকে স্বীকার করিয়া ইহার বাহ্যিক কোন অংশকে স্বীকার না করিলে বস্তুত: সেই মূলকেই করা হয় অস্বীকার। -স্বীকার করিয়াছি বলিয়া মনে হইলেও তাহাকে ভ্রম ও প্রতারণাই বুঝিতে হইবে। পক্ষান্তরে ইহার মূলকে অস্বীকার করিলেই পরিস্কার অস্বীকার করা হয় ইহার সমগ্র সত্তাকে। ইহার মূল ও শাখা প্রশাখার পরস্পরের মধ্যে অবস্থিতির দিক দিয়া সামান্য কিছু পার্থক্য থাকিলেও মানব জীবনের বিশ্বাস ও কাজের ক্ষেত্রে উহাকে স্বীকার করার ব্যাপারে উহাদের মধ্যে কোনই পার্থক্য নাই। সূর্যকে স্বীকার করিলে অনিবার্য রূপে স্বীকার করিতে হয় উহার দিগন্তব্যাপী আলোক রশ্মিকে-মূলের সাথে ইহার শাখা প্রশাখা এত নিবিড় ভাবে জড়িত।
নির্দিষ্ট একটা গাছকে যখন আমরা স্বীকার করি, তখন উহার পাতা, উহার ফুল ফলকেও মনে প্রাণে অনিবার্য রূপে মানিয়া লইতে হয়। পক্ষান্তরে নির্দিষ্ট ফল পাইতে হইলে উহার বীজকে উপযুক্ত রোপন করিয়া উহার ধীরে ধীরে অংকুরিত হওয়া এবং ক্রমে একটা বিরাট ফলদায়ক মহীরূহে পরিণত হওয়ার অতি স্বাভাবিক পন্থাকেই অবলম্বন করিতে হইবে। তাহা ছাড়া সেই ফল পাওয়ার জন্য কোন উপায়ই থাকিতে পারে না। তাওহীদের দাবি সুস্পষ্ট ও বিস্তারিতরূপে বুঝিবার জন্য গোড়াতেই এই নিগূঢ় তত্ত্ব পরিষ্কার করিয়া অনুধাবন করা আবশ্যক।
তাওহীদ অর্থ সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদ, নিখিল বিশ্ব-ভূমণ্ডলে যাহা কিছু আছে, চন্দ্র-সূর্য ও গ্রহ-নক্ষত্র হইতে শুরু করিয়া এই মাটির পৃথিবীর সর্বপ্রকার জীবজন্ত, বস্তু ও মানুষ এই সব কিছুকেই যে মহান শক্তিমান সত্তা সৃষ্টি করিয়াছেন-তিনি এক, তিনি একক এবং তিনিই হইতেছেন আল্লাহ তাআলা। তাঁহার একত্বের অনস্বীকার্য প্রমাণ আছে সৌরাজগতের সুবিন্যস্ত নিয়ম-শৃংখলার মধ্যে, আছে এই ধূলির ধরণীর প্রতিটি অণুপরমাণুতে এবং আছে মানুষের দুর্জেয় রহস্যাবৃত প্রকৃতির মধ্যে। প্রত্যেক সুস্থ মস্তিস্কের মানুষই এই তত্ত্ব স্বীকার করিতে বাধ্য। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, সৃষ্টিকর্তা সমগ্র বিশ্ব-জগতের প্রথমবার সৃষ্টি করিয়া দিয়া তিনি কি বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছেন কিংবা ইহার পরিচালন ও প্রতিপালনের দায়িত্ব অন্য কাহারো উপর ন্যস্ত করিয়া তিনি নিজে বিশ্রাম করিতেছেন? না সৃষ্টির আদি হইতে অজাতক ইহাকে একমাত্র তিনিই পরিচালিত করিয়াছেন, ক্রমবিকাশ এবং নিত্য-নব সৃষ্টির প্রকাশ ও লয় একমাত্র তাঁহারই ইংগীত হইতেছে? আর অনন্তকাল পর্যন্ত একমাত্র তাঁহারই সর্বব্যাপী প্রভুত্ব সমানভাবে বর্তমান থাকিবে?
প্রশ্নটি যতই জটিল হউক না কেন ইহার সুচিন্তিত ও প্রকৃত জওয়াব হইতেছে এই যে, সৃষ্টি জগত আদি হইতে আজ পর্যন্ত যখন একটি মাত্র নিয়ম পালন করিয়া চলিয়াছে, সে নিয়মের কোন ব্যতিক্রম আজ পর্যন্ত হয় নাই এবং সৃষ্টির এই বিরাট কারখানাটা কোন দিনই এক মুহূর্তের তরেও থামিয়া যায় নাই, তখন হইতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকিতে পারে না যে, ইহা এক মহাপরাক্রান্ত সৃষ্টিকর্তারই পরিচালনাধীন। এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার বিন্দুমাত্র অধিকার ও সামর্থ্য কাহারো নাই।অতএব আল্লাহ তাআলাই যেমন নিখিল বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা; তেমনি ইহার পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, পরিচালক, জীবন ও মৃত্যুদানকারী এবং জীবিকা প্রদানকারীও যাহা কিছু পাইতেছি তাঁহারই নিকট হইতে পাইতেছি। জীবজন্ত, বৃক্ষরাজি ও মনষ্য জাতির জন্ম মৃত্যুর ব্যাপারে, জীবিকা প্রদানের ব্যাপারে, আর পৃথিবীর পরিচালনার ব্যাপারে সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কাহারো প্রভুত্ব ও হস্তক্ষেপ রহিয়াছে কিংবা আল্লাহর সাথে অন্য কাহারো শরীকদারী আছে বলিয়া যাহারা মনে করে, তাহারা চরমরূপে ভ্রান্ত, বস্তুত; তাহারা সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদ বিশ্বাসী নয়, তাহারা অংশীবাদী। ইহাতে কোনই সন্দেহ নাই যে, তাহাদের এই বিশ্বাসের সত্যতার কোনই যুক্তি নাই: বিশ্বপ্রকৃতির নিয়ম ওব্যবস্থা সম্পর্কে সন্দেহতিক জ্ঞান তাহাদের নাই।
জীব-জন্তুকে জীবিকা দান করার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কাহারও নাই। তিনিই প্রয়োজনানুরূপ নিয়মিতভাবে নিখিল জীবরে রিজিক দান করিতেছেন। আবার যখন কাহারো জীবনের আয়ু ফুরাইয়া আসে তাঁহারই হুকুম মত তাহার মৃত্যু হয়। এই সব ব্যাপারে অন্য কোন শক্তি আল্লাহ তাআলার শরিক নাই। তাহাই যদি হয়, তবে মানুষের আশা করিবার প্রার্থনা এবং নির্ভর করিবার স্থান তিনি ছাড়া আর কোথাও থাকিতে পারে না। অতএব এই বিশ্ব-ভুবনে ভয় করিবার যোগ্য তিনি ছাড়া আর কেহই নাই, কারণ কাহাকেও ভয় করিবার যতগুলি কারণ থাকিতে পারে, তাহা সবই সেই সৃষ্টিকর্তার মহান সত্তায় কেন্দ্রীভূত। এই জন্যই উপাসনা আরাধনা পাইবার অধিকারী একমাত্র তিনিই। দাসত্বও আনুগত্য একমাত্র তাঁহারই করিতে হইবে দুনিয়াতে মানুষ জীবন যাপন করিবে একমাত্র তাঁহারই দেওয়া জীবন-বিধান অনুযায়ী। তাঁহাকে ভয় করিয়া তাঁহার অপছন্দনীয় কাজ হইতে বিরত থাকা মানুষের কর্তব্য। অন্য কাহাকেও তাঁহার প্রতিবিম্ব, কিংবা পুত্র, কিংবা মানুষের আকৃতিতে খোদার প্রকাশ মনে করিয়া তাহার পূজা করা সৃষ্টিকর্তার অবমাননা। যে সৃষ্টিকর্তার সত্তা এত বিরাট, এত মহান এবং পবিত্র ও পরমানুখাপেক্ষীহীন! সেই তিনি-ই এই দুনিয়ার সামান্য জিনিসের মধ্যে আশ্রয় লইবেন কেন?
এই বিশ্ব-ভুবনের মালিক কে? ইহা মানব-মনের এক বিরাট জিজ্ঞাসা। কিন্তু যিনি নিজ ক্ষমতা বলে নিজ ইচ্ছামত ইহাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, ক্রমবিকাশ দান করিয়া চালাইয়া নিতেছেন, তিনি ছাড়া ইহার মালিক আর কে হইতে পারে? দুনিয়ার কোন অজ্ঞানতাপূর্ব ভূখন্ডের শুধু সন্ধান লাগাইয়াই যদি কেহ উহার মালিক হইতে পারে, একটা নতুন জিনিস শুধু আবিস্কার করার দাবিতেই যদি আবিষ্কারক উহার স্বত্বাধিকারী হইতে পারে, তাহা হইলে নিখিলের সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা যিনি, তিনি ছাড়া ইহার মালিকানার অধিকারী আর কেহই হইতে পারে না। কেন দেব-দেবী কোন মানুষই এই পৃথিবীর কোন একটা জিনিসের একচ্ছত্র মালিকত্বের অধিকারী নয়। পৃথিবী, আকাশ-রাজ্যে এবং ইহার ভিতরের ধন দৌলত, জায়গা জমি, এমন কি মানুষের অংগ প্রত্যংগ, মন ও মস্তিক্স, সব কিছুই একমাত্র মালিক তিনিই। মানুষের কাছে এই প্রকৃত মালিকেরই নির্দেশ মত। পৃথিবী রাজ্যের উপর স্বয়ং মানুষের মন ও মস্তিষ্কের উপর জীবন ও রাষ্ট্রের উপর একমাত্র সেই রাজাধিরাজেরই আইন চলিত, তাঁহারই মর্জিমত মানুষ তাঁহার প্রতিনিধি হইয়া এই দুনিয়ার তাঁহারই ইচ্ছাকে পূর্ণ করিবে ইহা তাওহীদের বাস্তব দাবি।
আল্লাহ তাআলাকে সমগ্র বিশ্ব জগতের সষ্টিকর্তা ও জীবনদাতা স্বীকার করিয়া এই পৃথিবীর উপর এবং ইহার শ্রেষ্ঠ অধিবাসী এই মানব জাতির উপর অন্য কাহারো মালিকত্ব, প্রভুত্ব ও অন্য কাহারো রচিত আইন জারি করা এক দু:সাহসিক জুলুম মানব প্রকৃতির এক অন্তনির্হিত ইনসাফ ইহা কিছুতেই বরদাশত করিতে পারে না। মানুষ তাহারই মত আর একজন মানুষকে কিংবা দেব-দেবীকে, অথবা কোন জীব-জন্তুকে প্রভু বলিয়া, পূজা পাইবার অধিকারী বলিয়া এবং স্বয়ং মানব জীবনের বিপুল ক্ষেত্রের জন্য আইন রচয়িতা বলিয়া কিছুতেই স্বীকার করিতে পারে না। অন্য মানুষের নিরুংকুশ শাসনক্ষমতাকে সে নির্বিকার চিত্তে মানিয়া লইতে পারে না। ইহা মানব প্রকৃতি, উদ্দাম তেজবীর্যের ও শ্রেষ্ঠত্ববোধের সম্পূর্ণ বিরোধী-তাওহীদের একেবারে বিপরিত।
সৃষ্টিকর্তার নিজস্ব কতগুলি গুণ আছে, আছে কতগুলি একচ্ছত্র অধিকার। সেই গুণ ও অধিকারগুলিকে মানব জীবনে পরিপূর্ণরূপে স্বীকার করা ও কাজের ভিতর দিয়া তাহাকে রূপায়ন করা তাওহীদের ঐকান্তিক দাবি। তাওহীদের স্বীকার করিলে ও দাবিকে পূর্ণ করিতেই হইবে। সে গুণগুলি অতি উত্তম, সে অধিকারগুলি খুবই বাস্তব ও ন্যায় সংগত। যিনি নিখিল দুনিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন, যিনি প্রতিটি জীবজন্তু ও বস্তুর জীবন ও জীবিকা দান করিয়াছেন তাঁহার জ্ঞান সর্বব্যাপী সুদূর প্রসারী। বিশাল ভূবনের পরতে পরতে কোথায় কি হইতেছে, তাহা একদিকে যেমন তাঁহারই ইচ্ছায় হইতেছে, তেমনি সে সম্পর্কে তিনি পুংখানুপুংখরূপে অবহিত। পাপীর পাপ, পূণ্যশীলের পুণ্য কাজ-সবই তাঁহার জ্ঞানগত। বিপন্নের কাতর প্রার্থনা, দু:খীর আহাজারী, ক্ষমা প্রার্থীর অনূতপ্ত হৃদয়ের কাতর আকুতি-সবই সমান ও প্রত্যক্ষভাবে তাঁহার নিকট পৌঁছায়। তাঁহার অজানা কিছুই নেই, তাঁহার দৃষ্টির অগোচরে কিছুতেই হইতে পারে না। তাহার দৃষ্টির অগোচরে কিছুই হইতে পারে না। তাঁহার দরবারে প্রত্যেকটি মানুষই নিজ আবেদন সরাসরি ভাবে পেশ করিতে পারে। সে জন্য কোন উকিল কিংবা পেশকারের আবশ্যক নাই! তাঁহার দুয়ার সতত সকলেরই জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত। অতএব কাহাকেও একমাত্র সৃষ্টিকর্তারূপে স্বীকার করা এবং সেই সঙ্গে তাঁহার জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ মনে করা আর তাঁহার দরবারে সুপারিশ কিংবা শাফায়াতকারী রূপে তাঁহার আনুগত্য ও বিধান পালন ছাড়া অন্য কাহাকেও অছীলা ধারণ করা তাওহীদের মূলে কুঠারাঘাত করার শামিল-সন্দেহ নাই।
আল্লাহ তাআলা যখন সমানভাবে সকলের এবং সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা, তখন তিনি সকলের পক্ষে সমানভাবে সুবিচার অবশ্যই হইবেন। কাহারো প্রতি তাঁহার অকারণ পক্ষপাতিত্ব থাকিতেই পারে না। কাজেই তিনি অন্য কাহারো সুপারিশক্রমে কোন পাপীকে রেহাই দিবেন কিংবা কাহারো বদদোয়াক্রমে কোন পুণ্যশীলকে তিনি জাহান্নামে নিক্ষেপ করিবেন-ইহা বিশ্বাস করার অর্থ তাঁহার ইনসাফকারিতার শাশ্বত গুণকে অস্বীকার করা। যদি কেহ মনে করে যে, আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহ পাইতে হইলে অন্য কাহাকে অছীলা ধরিতে হইবে, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে যে, আল্লাহ তাআলার সুবিচার ও সুদূর প্রসারী দৃষ্টির প্রতি তাহার মাত্রই বিশ্বাস নাই-ইহা তাওহীদ বিশ্বাসের সম্পূর্ণ খেলাফ। বস্তুত: একমাত্র আল্লাহ তাআলারই দেওয়া পরিপূর্ণ বিধান মত জীবন যাপন করাই হইতেছে ইহকাল ও পরকালে সর্ববিধ শান্তি লাভ করার একমাত্র উপায়। ইহা তাওহীদের মূল শিক্ষা।
আল্লাহ তাআলা সারা বিশ্বের ভূবনের একমাত্র Controller নিয়ন্ত্রণকারী। সবরকমের নীচতা, অসাহয়তা, অভাবত্ব, পরমুখাপেক্ষিতার পংকিলতা হইতে তিনি পবিত্র এবং দুনিয়ার প্রত্যকটি অণুপরমাণূ পর্যন্ত তাঁহারই প্রতি মুখাপেক্ষী; সকলেরই উপর তাঁহার আধিপত্য স্থাপিত। তাঁহার কোন কাজ ও ইচ্ছায় বাধা দিতে পারে, তাহার অনুমতি ব্যতীত একটুও নড়াচড়া করিতে পারে, এমন ক্ষমতা কাহারও নাই। তিনি ক্ষমাশীল, মার্জনা পরায়ন-পাপীরা পাপ তিনিই মার্জনা করিতে পারেন, অপরাধ গোপন তিনিই করিতে পারেন।
যে আল্লাহ সৃষ্টি করিয়াছেন, সমগ্র জীবনের প্রতিপালন ও জীবন যাপনের সমস্ত উপাদান যিনি প্রতিনিয়ত দান করেন, যিনি মায়ের গর্ভের গোপন কারখানার অন্তরালে তাঁহার অদ্ভুত সৃজনক্ষমতার অপূর্ব লীলা প্রদর্শন করেন, জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে তাঁহাকেই রব্ব স্বীকার করা মানুষ মাত্রেই কর্তব্য। মানুষ আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা করুক ইহা তিনি মাত্রই পছন্দ করেন না। মানুষ তাঁহার আদেশানুবর্তী হইয়া জীবন যাপন করুক ইহাতেই তাঁহার সন্তুষ্টি। মানুষকে তিনি বুদ্ধি দিয়েছেন, বিবেক দিয়েছেন, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিচার করিয়া চলিবার ক্ষমতা দিয়াছেন, এখন মানুষ বুঝিয়া শুনিয়া নিজের জন্য যে পথকে ইচ্ছা বাছিয়া লইতে পারে। তাওহীদের এই বিপ্লবী ধারণা মাত্রই নতুন নয়-চিরন্তন; একেবারে আদিম। আধুনিক দুনিয়ার কোন কোন দেশে বা কোন কোন সমাজে এই ধারণা বর্তমান থাকিলেও তাহাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইহা কার্যকরভাবে মাত্রই অনুসারিত হয় না। ইহাকে প্রকাশ্য মুনাফেকী বলিয়া অভিহিত করা যাইতে পারে। তাওহীদ বিশ্বাসের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবিদার মুসলিমরাও আজ এই স্তরে নামিয়া আসিয়াছে।
তাই তাওহীদ আজ দুনিয়ার সকল মানুষকে আহব্বান জানাইতেছে, তোমরা যদি সত্যিই সৃষ্টিকর্তার একত্বকে বিশ্বাস কর, তবে জীবনের সকল কাজ-কারবারে তাঁহারই আনুগত্য কর। জীবনের কোন কাজেই দাসত্বও আনুগত্যের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার সাথে অন্য কাহাকেও শরীক করিও না। আর আল্লাহর আনুগত্য করিলে তাহা নামাকাওয়াস্তে শুধু বাহ্যিক বেশ-ভূষাল কিংবা কেবল আনুষ্ঠানিকভাবে করিলেই চলিবে না; একান্ত খালেছ দিলে ও খাঁটিভাবে করিতে হইবে। অন্তরের নিবিড়তর দরদ ও ঔৎসুক্য সহাকারে করিতে হইবে।
আকাশ, পৃথিবী ওসৃষ্টির উপর যাঁহার একচ্ছত্র প্রভুত্ব বলিয়া বিশ্বাস কর, তোমাদের অন্তর মুখের প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা এবং ইবাদত বন্দেগী খালেছভাবে তাঁহারই উদ্দেশ্যে নিযুক্ত কর, তাঁহাকেই হৃদয় ঢালিয়া ভালবাস, নিজেকে একান্তভাবে তাঁহারই নিকট সোপর্দ করিয়া দাও। আর সেই সব দ্রব্য সামগ্রীর ব্যবহার সম্পর্কে, উপকারী অপকারী ও হালাল হারাম নির্ধারণকারী হিসাবেও একমাত্র তাঁহারই নির্দেশ মানিয়া চল। এ সম্পর্কে অন্য কাহারো কোন অধিকার বা ক্ষমতা আছে বলিয়া মনে করিও না-স্বীকার করিও না। কারণ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাহারো হালাল হারাম জায়েয নাজায়েয বা বৈধ-অবৈধ নির্ধারণ করার অধিকারী দান করা পরিষ্কার শিরক। জীবনের সমগ্র ক্ষেত্রে এক আল্লাহ তাআলার একচ্ছত্র প্রভুত্ব স্থাপিত করাই হইতেছে তাওহীদের প্রকৃত অধিকার। এ অধিকার অনস্বীকার্য। অতএব বর্তমান দুনিয়ার গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সামাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ ও কমিউনিজম প্রভৃতি যত রাজনৈতিক আদর্শের প্রচলন আছে এবং পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও সম্পত্তির তোমরা স্বীকার করিতে পারে না, নিজেদের আর্দশ বলিয়া গ্রহণ করিতে পার না। কারণ নির্বিশেষে এই সবগুলি নীতিই মানুষের রচিত-মানুষের অনুর্বর ও অপরিনামদর্শী মস্তিস্ক হইতে প্রসূত, তাহার অপূর্ণ জ্ঞানের অভিজ্ঞতা ও ভিত্তিহীন ধারণার উপর স্থাপিত। তদূপুরি ইহার কোন একটিও গ্রহণ করিলে ইসলামের আদর্শ হইতে তোমরা ততখানিই বিচ্যুতি ঘটিবে-দূরে সরিয়া যাওয়া হইবে। ইসলাম আল্লাহর পরিপূর্ণ ব্যবস্থা। এবং তাহার সবই দুনিয়ার মানব রচিত নীতি হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, একবারে আলাদা জিনিস। আল্লাহর উপাসনা ও বন্দেগী করার সংকীর্ণ পরিবেশ তাওহীদকে স্বীকার করিয়া কর্মজীবনের বিপুল ক্ষেত্রে এই সব মানব রচিত নিয়ম বিধান কবুল করা ও অনুসরণ করা তাওহীদেরই ভিত্তিমূল চিরতরে চূর্ণ করিয়া দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।
এবং ঠিক এর জন্য তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাহারো আইন মানিয় না; জীবনে কোন ক্ষেত্রেই নয়। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাহাকেও অন্য কোন মানুষকে আইন রচনার অধিকার দিও না। অন্য কাহারো রচিত আইন অনুযায়ী বিচার ফায়সালা করিও না। মানুষের রচিত কোন নীতি অনুযায়ী বিচার ফায়সালা করিও না। মানুষের রচিত কোন নীতি অনুযায়ী তোমাদের রাষ্ট্র, তোমাদের সমাজ ও অর্থ ব্যবস্থা পরিচালিত করিও না, মানব প্রভুত্বের বুনিয়াদে গঠিত হইয়াছে যত রাষ্ট্র তাহা গণতান্ত্রিকই হউক কিংবা সমাজতান্ত্রিক, তোমরা তাহার কোনটারই আনুগত্য স্বীকার করিও না। মানব রচিত আইনের ভিত্তিতে দাঁড়াইয়া আছে যে সব আদালত ফৌজদারী তাহার নিকট তোমরা কোন বিচার প্রার্থনা করিরও না। কারণ বিচার করার কোন অধিকার এবং সুবিচার করার ক্ষমতাই তাহার নাই। কুরআনের পরিভাষায় ঐ সবগুলি প্রতিষ্ঠানেরই নাম হইতেছে তাগুত। এই তাগুতকে একেবারেই অস্বীকার কর এবং মনুষ্য সমাজে একমাত্র সৃষ্টিকর্তারই প্রভুত্ব ও আইন স্থাপিত কর-আজিকার দুনিয়ার নিখিল মানুষের কাছে ইহাই হইতেছে তাওহীদের অকুন্ঠ ও ঐকান্তিক দাবি।
قَاتِلُوْهُمْ حَتَّىْ لاَتَكُوْنُ فِتْنَتٌ وَّيَكُو}نَ الدَيْنُ كُلُّهُ لِلَّهِ ـ
আল্লাহ তাআলাকে যাহারা অমান্য করে, তাহাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, তাহাদিগকে হত্যা কর, যেন দুনিয়ায় ফেতনা ফাসাদ কিছুমাত্র অবশিষ্ট না থাকে এবং সমস্ত রাজত্ব, আধিপত্য ও আইন যেন একমাত্র আল্লাহরই স্থাপিত হয়।
0 comments: