আল্লাহ তাআলাই আমার ও নিখিল দুনিয়ার একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, একমাত্র মালিক, একচ্ছত্র আইন রচয়িতা, একমাত্র আশা ও ভয় করার যোগ্য এবং একমাত্র উপাস্য- আল্লাহ ছাড়া এই সব ব্যাপারে আমি আর কাহাকেও স্বীকার করি না, মান্য করি না।----ইহা তাওহীদের এক বিরাট বিপ্লবী ঘোষণা। আমরা যখন পড়ি : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু তখন আমরা ঠিক এই কথারই ঘোষণা করিয়া থাকি।
ইহা মানবতার এক দুর্নিবার ও তেজপূর্ণ দাবি। ইহা যুগপৎভাবে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমাজগত জীবনকে পরিব্যাপ্ত করিয়া লয়। ইহা মানুষের সমগ্র জীবনটাকে লইয়া প্রলয়ংকর কাঁপন লাগাইয়া দেয়। মানুষের আকীদাহ ও বিশ্বাস হইতে শুরু করিয়া সমগ্র কর্ম-জীবন এক প্রচন্ড ইনকিলাব সৃষ্টি করিয়া তাওহীদ বিরোধী সমস্ত বিশ্বাস ও কাজকে মানুষের জীবন হইতে নি:শেষে অপসৃত করিয়া দেয়। তাহার মধ্যে জীবনকে, তাহার মতবাদ, চিন্তাধারা, ইচ্ছা বাসনা, হৃদয়াবেগ এবং দৃষ্টিভংগীকে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া কিতাবের শিক্ষার সাজে ঢালিয়া গঠন করে। তাহার মনোজগতের সবচেয়ে উচ্চতম স্থানে অভিষিক্ত করে আল্লাহর প্রেমকে, সে হইয়া যায় সর্বোতভাবে খোদার, খোদাময়। জীবনের যে কোন ব্যাপারেই সে আল্লাহ তাআলাকে ছাড়া অন্য কাহাকেও নিজের নাফসকে, দেশচলতি প্রতাকে এবং শাসকদের রচিত আইনকেও মাত্রই স্বীকার করে না। দুনিয়ার লোক-সমাজের উপর আল্লাহ ছাড়া আর যাহার যাহার প্রভুত্ব চলিতেছে, সেই সমস্তকেই সে মনে করে অনধিকার চর্চা করার অপরাধে অপরাধী।
তাওহীদের এই বিশ্বাস ও ঈমান মানুষের মনে ধীরে ধীরে দানা বাঁধিতে ও পূর্ণত্ব লাভ করিতে থাকে। পরিণামে তাহার মন জীবনের সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহ প্রেরিত নবীকেই নিজের একমাত্র নেতা ও পথপ্রদর্শক মানিয়া লয় এবং তাঁহার বিরোধী কিংবা তাঁহার অধীনতা হইতে মুক্ত সমস্ত প্রকারের নেতৃত্বকেই সে অস্বীকার করে-পৃথিবী হইতে তাহাকে উৎপাটিত করিতে উদ্বুদ্ধ হয়। কাজেই তখন সে শুধু লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলিয়াই ক্ষান্ত হয় না, তখন সে পূর্ণ করিয়া বলে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। আল্লাহর কিতাবকে জীবনের পরিপূর্ণ বিধান বলিয়া স্বীকার করা, সেই কিতাবে উল্লেখিত সমস্ত রীতি-নীতি, হুকুম-আহকাম ও আদর্শকে নিজের কর্মজীবনে পরিস্ফুট করিয়া তোলা এবং মানব জীবনে উহা ছাড়া অন্য কোন আইনের কিংবা রাজনীতির আধিপত্যকে মাত্রই বরদাশত না করা তাওহীদ-বিশ্বাসের বাস্তব নমুনা। তাওহীদের এই প্রভাব যে পরিমাণে পরিলক্ষিত হইবে, মনে করিতে হইবে তাহার অন্তরের মধ্যেও তাওহীদের সেই বীজ তত পরিমাণে বর্তমান। বীজ ও গাছের মধ্যে যে সম্পর্ক তাওহীদের এই বিশ্বাস এবং তদনুযায়ী কাজের মধ্যেও ঠিক সেই সম্পর্ক বিদ্যমান। বীজের মধ্যে যাহা কিছু যেভাবে বর্তমান থাকে, গাছের আকারে ঠিক তাহাই সেইভাবে আত্মপ্রকাশ করে বাহির পৃথিবীতে। এমন কি গাছের পরীক্ষা করিয়া অনায়াসেই বলিতে পারা যায় উহার বীজের মধ্যে কি ছিল আর কি ছিল না। পক্ষান্তরে বীজ ব্যতীত যেমন গাছের কল্পনা করা চলে না, উর্বরা জমিতে ভাল বীজ বপন করা অথচ তাহাতে গাছের উদগম না হওয়াও ঠিক তেমনি অস্বাভাবিক। তাওহীদ বিশ্বাস এবং মানুষের ব্যাপক কর্মজীবন ও ঠিক এইরূপ। যেখানে বিশ্বাস বর্তমান; কর্মজীবনে তাহার চরিত্রে ব্যবহারে আদান-প্রদান ও চেষ্ঠা সাধনায় রুচি ও প্রকৃতিতে সমস্ত শক্তি ও যোগ্যতার প্রয়োগে-মোট কথা জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যাপারে তাহার বাস্তব অভিব্যক্তি অনিবার্যরূপেই হইতে বাধ্য। বাহ্যিক প্রকাশ যেখানে দেখা যাইবে না, মনে করিতে হইবে, বুকের অন্তরালে উহার বিশ্বাসের অস্তিত্ব নাই।
তাহার পর মহান সৃষ্টিকর্তার ভয় করিয়া, পরকালের পাপ-পূণ্যের হিসাবের কথা স্মরণ করিয়া আল্লাহ তাআলার নিষিদ্ধ ও অপছন্দীয় কাজ করিতে পারে না। তাহার জীবন প্রাণ বিপন্ন হইতে পারে, তাহার লাখ টাকা ক্ষতি হইতে পারে, কিন্তু তবু সে এমন কাজ কিছুতেই করিতে পারে না। যাহা আল্লাহর নিষিদ্ধ, যাহা আল্লাহর অপছন্দনীয়। মানুষ যখন আল্লাহ তাআলাকে তাঁহার সমস্ত প্রকারের গুণ গরিমা সহকারে বিশ্বাস করে, স্বীকার করে, তখন সে তাহার এই তাওহীদ-বিশ্বাসের সরল-সহজ পথ হইতে কোন ক্রমেই বিচ্যুত হইতে পারে না। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া শক্তি-সামর্থ, সময়-যোগ্যতা, অর্থ ও সম্পত্তি কোন কিছুকেই সে আল্লাহ-নির্ধারিত পথ ও নিয়মের বিপরীত কোন কাজে প্রযুক্ত করিতে পারে না। এই অনুপ্রেরণা তাওহীদ বিশ্বাসীর মনে প্রাণে যখন তাহার পূর্ণ আসন অধিকার করিয়া বসে, তখন সে সৃষ্টিকর্তার সকল নিষিদ্ধ ও অপছন্দনীয় কাজ হইতে ঠিক সেই প্রকারই বাঁচিয়া থাকে যেমন সমস্ত জীবজন্ত, দূরে সরিয়া থাকে সমস্ত প্রকারের ক্ষতিকর জিনিস হইতে।
মানুষের অভ্যন্তরে এই তীব্র প্রেরণা জাগাইয়া তোলা তাওহীদের প্রথম প্রভাব। ইহা মানুষের সমগ্র জীবনকে ইসলামের একই রঙের করিয়া তোলে। কিন্তু এই প্রেরণা জাগাইয়া তোলা একদিকে যেমন কঠিন ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার, অন্যদিকে ইহা খুব অল্প সময়ের মধ্যে এবং অতি তাড়াতাড়ি অর্জন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। ইহা খুব ধীরে ধীরে ক্রমবিকাশ লাভ করে এবং দীর্ঘকালীন সাধনার পর ফুল ফুটায় এবং ফল দান করে-যেমন বীজ হইতে গাছ এবং সেই গাছে ফুল ও ফল হইয়া থাকে একটা স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে এবং অনেক দেরীতে।
এইভাবে ধীরে ধীরে নিরবচ্ছিন্ন সাধনার ভিতর দিয়া মানুষ যখন এই অধ্যায়ে পূর্ণত্ব লাভ করে, তখনি তার আরম্ভ হয তাওহীদের পরিবর্তী এবং সর্বশেষ স্তরের মহাযাত্রা। এইখানে আসিয়া পৌঁছিলে মানুষের হৃদয়-মন আল্লাহ, তাঁহার রাসূল এবং রাসূলের প্রচারিত জীবনধর্মের সাথে এমন নিবিড়ভাবে যুক্ত হইয়া যায় যে, আল্লাহ তাআলার গভীর প্রেমে সে নিজেকে এবং নিজের সব কিছুকেই তাঁহারই দরবারে অকাতরে উৎসর্গ করিয়া দিয়া কোন কাজে সৃষ্টিকর্তা সন্তুষ্ট হইবেন, তখন মানুষ কেবল তাহারই তালাশ করিয়া ফিরে। কেমন করিয়া তাঁহার অফুরন্ত রহমত লাভ করা যাইবে, অহর্নিশ শুধু সেই চিন্তায়ই মশগুল হইয়া থাকে। এই পর্যায়ে মানুষ উন্নীত হইয়া মানুষ তাহার নিজেকে, তাহার পারিপার্শ্বিক সমাজকে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে, নিরীক্ষণ করে; আর সমস্ত ক্ষেত্র থেকেই সে আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজগুলিকে দূর করিয়া দিয়া পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর প্রভূত্বকে স্থাপিত করিতে চেষ্টা করে। সে একদিন যেমন নিজের মধ্যে গায়রুল্লাহর বিন্দুমাত্র প্রভুত্বকে সহ্য করিতে পারে না, তেমনি এই দুনিয়ার কোন অংশে কোন মানুষের মধ্যে আল্লাহ ছাড়া অন্যের প্রভুত্বকে সে কিছুতেই থাকিতে দিতে পারে না। গায়রুল্লাহর আধিপত্য ও প্রভুত্বের বিরুদ্ধে তাহার এই ক্ষমাহীন অভিযান দুর্নিবার ভাবে চলিতে থাকিবে ততদিন, যতদিন তাহার মনে বীর্য আছে- দেহে প্রাণ আছে। সৃষ্টিকর্তার সেরা সৃষ্টি এই মানুষ জাতি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মানুষ কিংবা বস্তুর প্রভুত্ব স্বীকার করিয়া, তাহার দাসত্ব করিয়া মরিবে, ইহা সে কিছুতেই সহ্য করিতে পারে না।
বস্তুত তাওহীদের এই ব্যাপক অর্থের প্রতি কার মধ্যে কতখানি বিশ্বাস আছে, তাহা নি:সন্দেহে বুঝিতে পারা যায় এই তাওহীদের ভিত্তিতে আল্লাহ তাআলা এই আইনকে দুনিয়ায় প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করার সাধনার দিক দিয়। তাওহীদের প্রতি যাহার বিশ্বাস যত তীব্র এবং দৃঢ় সে তত অক্লান্ত ও নিস্বার্থভাবে তাগুতের প্রভুত্ব উৎপাটিত করিয়া দিয়া আল্লাহ তাআলার প্রভুত্বকে স্থাপিত করিবার জন্য সাধনা করিবে। পক্ষান্তরে যাহার মধ্যে এই বিশ্বাস যত ম্লান ও দুর্বল, আল্লাহ তাআলার হুকুমতে কায়েম করার সাধনা তাহার জীবনে তত কত পরিলক্ষিত হইবে। বরং তাহার জীবনের প্রত্যেক কাজ কর্মে দেখা যাইবে তাওহীদ ও শিরকের সাথে শুধু গোজামিল দেওয়ার হীন প্রচেষ্টা। মুখে মুখে তাওহীদ বিশ্বাসের বড় বড় দাবি শোনা যাইবে, কিন্তু কাজে কর্মে দেখা যাইবে তাগুতের প্রভুত্বের কাছে নতি স্বীকার। এবং এইভাবেই সে নিজের মন ও জীবনকে অসংখ্যা প্রভুর দাসত্বের জালে জড়াইয়া ওষ্ঠাগত-প্রাণ হইয়া পড়িবে। দুনিয়াব্যাপী এই যে শয়তানের নিরুংকুশ রাজত্ব চলিতেছে আর তাওহীদ বিশ্বাসের দাবিদারগণ যে নিজেদের জান-মাল কুরবান করিয়া আরো মজবুত করিয়া তুলিতেছে, ইহা দ্বারা কি নিশংসয়ে বুঝা যায় না যে, তাহারা নিজের সমগ্র জীবনে একমাত্র সৃষ্টিকর্তার প্রভুত্ব, মালিকত্ব ও আইন রচনার অধিকারক মাত্রই স্বীকার করে না। মানুষের জীবন এক অবিভাজ্য ইউনিট, ইহাকে টুকরা টুকরা করা, ইহার রাজনীতি ও ধর্মকে দুইটি আলাদা ভাগে ভাগ করিয়া দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। তাওহীদবাদী মানুষ সৃষ্টিকর্তা, উপাস্য ও প্রভুরূপে যেমন এক আল্লাহকেই স্বীকার করে, ঠিক তেমনি সে নিজের সমগ্র জীবনের বাদশাহ ও আইন রচয়িতা হিসাবে এক আল্লাহকেই স্বীকার করে। মানুষ ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় কাজে আল্লাহ তাআলার নিয়ম পালন করিবে; কিন্তু রাজনীতি, শাসনতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক কাজ কারবারে দুনিয়ায় প্রচলিত রীতিনীতির অনুসরণ করিবে-এই প্রকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন আদর্শ অনুসরণ করিয়া চলা তাওহীদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বস্তুত : তাওহীদবাদী মানুষ তাহার ব্যক্তিগত জীবন হইতে শুরু করিয়া পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রভৃতি সমগ্র ব্যাপারেই তাওহীদবাদীই থাকিবে-এক আল্লাহ তাআলার নিয়ম-কানুন পালন করিয়া চলিবে, কোন ক্ষেত্রেই সে আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত পন্থা পরিত্যাগ করিবে না।
মানুষ নিজে যে মত পোষণ করে সেই মতের প্রচার এবং উহার বিরুদ্ধ মতের বিরোধিতা করা- এমন কি দুনিয়া থেকে উহাকে বিলুপ্ত করার উদ্দেশ্যে তাহার নিজের সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করিয়া চেষ্টা করা মানব-প্রকৃতির এক চিরন্তন ও শাশ্বত সত্য। কোন মানুষ নিজের মত প্রচার না করিয়া পারে না। কাজেই মানুষের বাহ্যিক রুচি-প্রকৃতি এবং কাজ-কর্মের ব্যাপারে বন্ধুত্ব ও শত্রুতার লক্ষণ দেখিয়াই বুঝিতে পারা যায় তাওহীদকে কে কতখানি বিশ্বাস করে, আর কে কতখানি করে অবিশ্বাস।
অতএব তাওহীদ কেবল মাত্র একটা দার্শনিক কিংবা ধর্মীয় তত্ত্ব-ই নয়, ইহা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব ধর্মীয় আদর্শ। মানুষের ব্যক্তি, সমাজ, তথা রাষ্ট্রীয় জীবনের উপর উহার গভীর প্রভাব অনিবার্যরূপে প্রবর্তিত হইয়া থাকে। সেই প্রভাব পরিলক্ষিত না হইলে তাওহীদ বিশ্বাসের অস্তিত্ব আছে বলিয়া মনে করিবার কোনই কারণ থাকিতে পারে না। এই তাওহীদ ব্যক্তি-মানুষকে এক পরিপূর্ণও অতুলনীয় আজাদী দান করিয়া সৃষ্টি জগতে তাহাকে শ্রেষ্ঠ ও বিশিষ্ট করিয়া তোলে। সমগ্র দুনিয়া এবং উহার ভিতরের সমস্ত বস্তুই শুধু মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হইয়াছে। মানুষ তাহা নিজের কাজে ব্যবহার করিবে, তাহান ভোগ করিবে; তাহা দ্বারা দুনিয়ার উপর শুধু মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হইয়াছে। মানুষ তাহা নিজের কাজে ব্যবহার করিবে, তাহা ভোগ করিবে; তাহা দ্বারা দুনিয়ার উপর শুধু আল্লাহ তাআলার হুকমাত কায়েম করিবে; ইহাই হইল মানুষের একমাত্র কাজ। কিন্তু তাওহীদকে বিস্তারিত রূপে অনুধাবন না করিলে এবং কর্মজীবনে উহাকে একমাত্র আদর্শ হিসাবে গ্রহণ না করিলে মানুষের প্রাপ্য সে কিছুতেই লাভ করিতে পারে না। বরং তাহার কাপুরুষতা ও নীচতা এত তীব্র আকার ধারণ করে যে, দুনিয়ার সামান্য জিনিস দেখিয়াও সে ভয় পায়; তাহার অন্তরাত্ম কাঁপিয়া উঠে। যে সব জিনিস মানুষের গোলামী করিবার জন্য সৃষ্টি হইয়াছে, এহেন মানুষ নিজেই সেই সবের দাসত্ব ও আনুগত্য করিতে শুরু করে। নিজেরই মত মানুষকে প্রভু, মালিক, মনিব, আইন-রচয়িতা বলিয়া স্বীকার করে, একান্ত দাসানুদাসের মত তাহাদের সম্মুখে অবনত হয়, মাথা লুটায়। তাহাদের অন্নদাতা ভাগ্যবিধাতা নবজাতির জন্মদাতা নবরাষ্ট্রের স্রষ্টা, দেশ ও জাতির রক্ষাকর্তা এবং দরিদ্রের মা বাপ প্রভৃতি মুশরেকী উপাধিতে ভূষিত করে।
এমন কি জীবিত লোকদের অতিক্রম করিয়া মৃতদের কবরে পর্যন্ত হাজীর হয় এবং কবরস্থ লোকদের নিকট নিজেদের আবেদন ও অন্তরের ব্যাথা বেদনা জানাইয়া তাহাদের সাহায্য প্রার্থনা করে! প্রকৃতিক নিয়মের উপয় এইসব মৃত ব্যক্তিদের হাত আছে বলিয়া মনে করে। অদৃশ্য জগত সম্বন্ধে ইহারা জ্ঞাত এবং মানুষের ক্ষতি বা উপকার সাধনের ব্যাপারে ইহাদের অব্যর্থ ক্ষমতা আছে বলিয়া বিশ্বাস করে। ধীরে ধীরে এই সব তাওহীদ-বিহীন মানুষ প্রত্যেকটা পাথর, অলী-দরবেশের প্রত্যেকটা কবর ও প্রত্যেকটা বৃক্ষকে উপাস্য দেবতা হিসাবে হিসাবে গণ্য করিয়া এবং অতীতকালে কোন শক্তিমতির প্রতিমূর্তি গড়িয়া উহার পূজা করিতে শুরু করে। তাহার কাছে মাথা নত করিয়া তাহার মনুষ্যত্বকে লাঞ্চিত করে। প্রত্যেকটা ঘন-নিবিড় জংগল, প্রত্যেকটা উপকারী ও অপকারী জিনিসই তাহাকে আহ্বান জানায় তাহার দাসত্ব করিবার জন্য ইহাদের কোন একটারও সম্মুখে নিজের আত্মাকে লাঞ্চিত করিতে এবং তাহাকে তাহা পদদলিত করিতে দিতে তাহার কোনই দ্বিধা সংকোচ হয় না। ফলে তাহাকে তাহা পদদলিত করিতে দিতে তাহার কোনই দ্বিধা সংকোচ হয় না। ফলে তাহার মর্যাদা-মহাত্ম্যের উচ্চতম স্থান হইতে পতিত হইয়া সে ক্রমশ: গড়াইয়া কেবল নীচের দিকেই পড়িতে থাকে। আল্লাহ তাআলা তাহাকে যে সম্মান ও বিশিষ্ট মর্যাদা দান করিয়াছিলেন, তাহাকে সে চিরদিনের তরে হারাইয়া ফেলে।
কিন্তু তাওহীদের প্রচন্ড প্রদীপ্ত আলো যখনই মানুষের হৃদয়জগতকে উদ্ভাসিত করিয়া তোলে, তখন সহস্য তাহার হৃদয় মনে ও কর্ম জগতে এক বিরাট বিপ্লবের সূচনা হয়। যে মানুষকে এখনই দেখা গিয়াছিল দুনিয়ার সমল সামান্য জিনিস হইতেও নিকৃষ্ট ও নীচ, তাওহীদের বলে সে নিমিষে এতদূর শক্তিমান হইয়া পড়ে, তাহার সম্মান এত উচ্চ ও উন্নত হইয়া যায় যে, আল্লাহ তাআলাকে ছাড়া দুনিয়ার আর সব জিনিসই তাহার নিকট অপেক্ষা হীন ও মূল্যহীন বলিয়া প্রতিপন্ন হইতে শুরু করে। মানুষ একমাত্র এই তাওহীদকে গ্রহণ করিয়াই প্রকৃত আজাদী লাভ করিতে পারে, অন্য কিছু দ্বারা নয়। আজাদীর যতগুলি মত ও ধারণা দুনিয়ার বর্তমান আছে, তাহার প্রত্যেকটির মধ্যেই মৌলিক ভাবে নিহিত আছে মানুষের গোলামী। গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম বা ডিক্টেরবাদ-যার কথাই বলা হোক না কেন, ইহার কোনটাই মানুষকে প্রকৃত আজাদী দান করিতে পারে না, মানুষের গোলামীর নাগপাশ হইতে মুক্ত করিতে পারে না। পৃথিবীর ইতিহাসে আমার এই দাবির সত্যতা প্রমাণ করে।
কিন্তু তাওহীদের ভিতরে এই বিপ্লবী আগ্নেয়-শক্তি আসে কোথা থেকে? তাওহীদবাদী মানুষের কাছে এই নিগূঢ়তত্ব উদঘটিত হইয়া যায় যে, সুখ-দু:খ, জীবন ও মৃত্যু, দারিদ্র্য ও ঐশ্বর্য-সবকিছুরই আসিবার ও যাইবার একটি মাত্র পথই বর্তমান, কাজেই সকল অবস্থাতেই সে তাহার সমস্ত আশা-আকাংখা সেই একই পথে নিবদ্ধ করে, সেই একই পথকে সে ভয় করে। সে নিশ্চিতরূপ জানে যে, এই দুনিয়া বিভিন্ন দেবতাদের কিংবা বিভিন্ন প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের লীলাক্ষেত্র নয়, বরং একমাত্র মালিক ও সর্বাভিজ্ঞ আল্লাহ তাঁহার নিজ ক্ষমতা ও প্রতিভার বলে এই বিশ্ব কারখানাটা পরিচালিত করিতেছেন। তাহার ইচ্ছা ও হুকুমের বিপরীত এই পৃথিবীর কোন কাজ-কর্মে একবিন্দু হস্তক্ষেপ করিতে পারে এমন ক্ষমতা এই বিশ্বভুবনে কাহারো নাই। সে ইহাও জানে যে, এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা সত্য ও সত্যপ্রিয়, এই জন্যই এই দুনিয়ার অবিমিশ্র বাতিলের কোনই অস্তিত্ব নাই! সে একান্তরূপে বিশ্বাস করে যে, আইন রচনা করার অধিকার বা ক্ষমতা কোন মানুষেরই নাই-কাজেই সে অন্য মানুষকে ভয় করিবে কেন? তাহার রচিত আইন পালন করিবে সে কিসের জন্য? যাহার নিকট এই মহান সত্য ধরা পড়িয়াছে, সে এক বিরাট, অমূল্য সম্পদ লাভ করিয়াছে। তাহার এই ধনাগার চিরস্থায়ী, তাহার জীবন চিরন্তন ও অক্ষয়, সে মরিয়াও অমর।
দু:খ-শান্তির সকল অবস্থাতেই এই শ্রেণীর মানুষের মন মগজ ও ঈমান থাকে অবিচালিত। প্রাচুর্য ও অভাব কোন অবস্থাই তাহার মনের স্থির ও গভীর প্রশান্তিকে চূর্ণ করিতে পারে না। ইহারা হাতাশা হয় না, নিরাশার ঘন অন্ধকার ইহারা কখনো নিজদিগকে হারাইয়া ফেলে না। গৌরব, অহংকার, নির্বুদ্ধিতায় ইহার কোন সময়ই নিজেদের পায়ে কুঠার মারে না। যে প্রকার হাসিমুখে তাহারা সুখের সময়কে অভিনন্দন করে, বিপদ ও পরীক্ষার কঠিন মুহূর্তের-ও তাহারা সম্বর্ধনা জানায় মনের অনুরূপ অবিচল বিশ্বাসে।
একজন তাওহীদবাদী মানুষের অন্তর্দেশ এমনিই হইয়া থাকে। অন্তরের দিক দিয়া সে পরিপূর্ণরূপে একাগ্রচিত্ত হয় এবং এই নিষ্ঠা ও একাগ্রতা ধীরে ধীরে তাহার বর্হিদেশ ও কর্মজীবনকেও সৌন্দর্যমন্ডিত ও মহিমান্বিত করিয়া তোলে। প্রকৃতিক নিয়মের কাছে সে নিজে যেমন অসহায় ও অক্ষম, মানুষের কর্মজগতের জন্য আল্লাহ তাআলার দেওয়া বিধানের সম্মুখে সে নিজে ইচ্ছা করিয়া ঠিক তেমনি অক্ষমতাকে গ্রহণ করে। আল্লাহর দেওয়া আজাদী সে ইচ্ছা করিয়া নিজ খুশীমত তাঁহারই ইচ্ছার সমীপে সোপর্দ করিয়া দেয়। সূর্য, চন্দ্র, বৃষ্টি ও বায়ু, নদী ও পর্বত নিত্যন্ত জড়পদার্থ বলিয়া বাধ্য হইয়াই দাসত্ব করে, তাহার নিজের আনুগত্য করে। কেননা তাহা না করিলে সে সবের কোন উপায় নাই; কিন্তু তাওহীদবাসী মানুষ নিজেরাই নিজেদের নাকে রশি-বাঁধিয়া চারিদিকের এই বিরাট কাফেলার সহিত চলিতে শুরু করে। ইহাই হইতেছে মানুষের আসল মর্যাদা! এবং এই ইচ্ছাগত নতি স্বীকার ও আনুগত্যই হইতেছে তাওহীদের মর্মকথা। এইভাবে নিজেকে আল্লাহ তাআলার কাছে সোপর্দ করিয়া দেওয়ার ব্যাপারে যে যতদূর অগ্রসর এবং পরিপূর্ণ হইতে পারিবে তাওহীদের পথে চলবার সর্বপ্রথম স্তরের মানুষ নিজের নফসের দাসত্ব পরিত্যাগ করিয়া নিজকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার দাসত্বের নিগড়ে বন্দী করে। দ্বিতীয় স্তরে সে নিজের জাতি, দেশ, জন্মভূমি এবং প্রচলিত সমগ্র রীতিনিতি ও আইন প্রথার সমস্ত বন্ধন হইতে পরিপূর্ণরূপে আজাদ হইয়া একান্তভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করে এবং সর্বশেষ স্তরে মানুষ মনের ঐকান্তিক আগ্রহে ও আনন্দে উদ্বেলিত হৃদয়ে ইহজীবন অপেক্ষা আল্লাহর নৈকট্য ও সাহচর্যকেই অধিকতর সব কিছুকেই একন্তভাবে উৎসর্গ করে মহান আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে-এই দুনিয়ার বুকে আল্লাহর হুকুমাত কায়েম করিবার করিবার মহত্তর উদ্দেশ্যে। তাওহীদ পথের ইহা যেমন শেষ মঞ্জিল, মানুষের উন্নতিরও ইহা সর্বশেষ স্তর।
বল, হে মানুষ! নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার সমস্ত ইবাদাত-বন্দেগী, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু সবকিছুই আল্লাহ তাআলার জন্য উৎসর্গকৃত; যিনি সারে জাহানের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও প্রভু। এইসব ব্যাপারে কেহই তাঁহার শরীক নাই। আমার সমস্ত কিছুই এমনিভাবে তাঁহারই উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করিবার জন্য আমাকে আদেশ করা হইয়াছে এবং এইজন্য, আমি প্রথমে অন্য সকলের আগেই নিজকে তাঁহারই সমীপে সোপর্দ করিলাম।
0 comments: