অধ্যায় ০৬ : তাওহীদের গুরুত্ব

‌‌‌‌‌‌
মানবদেহে হৎপিন্ডের যে গুরুত্ব ইসলামের সমগ্র ধর্মব্যবস্থায় তাওহীদেরও ঠিক সেই মর্যাদা বর্তমান। হৎপিণ্ড যদি সুস্থ-সবল ও সক্রিয় থাকে, তবে মানুষের শরীরও থাকে স্বাস্থ্যবান, তেজপূর্ণ। ঠিক এই কারণেই তাওহীদ ব্যতীত মানুষের কোন কাজই আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় না, সুফল দান করিতে পারে না। এই তাওহীদকে পরিপূর্ণরূপে স্বীকার করিয়া লওয়ার পর আশা করা যায়, মানুষের অনিচ্ছাকৃত পাপ মার্জনা করা হইবে। এই কারণে আল্লাহ তাআলা মানুষের শিরক কিছুতেই ক্ষমা করিবে না। এতদ্ব্যতীত অন্য পাপকে ইচ্ছা হইলে তিনি ক্ষমা করিবেন।

কিন্তু তাওহীদের এই গুরুত্বের মূলীভূত কারণ কি? কারণ এই যে, মানুষের সমগ্র জীবনধর্ম ইমারত তিনটি জিনিসের উপর স্থাপিত: তাওহীদ নব্যুয়াত এবং পরকাল। ইহার অর্থ এই যে, সমগ্র জীবনধর্মের এক তৃতীয়াংশ হইতেছে এই তাওহীদ, আরো একটু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করিলে দেখা যায় যে, তাওহীদ হইতেছে জীবন ধর্মের মূলকথা একেবারে কেন্দ্রীয় ধারণা। নবুয়্যত ও পরকাল-বিশ্বাস তাহার অনিবার্য শাখা মাত্র। কারণ আল্লাহ তাআলাকেই একমাত্র জীবন-বিধান প্রস্তুকারী এবং আইন রচিয়তা হিসাবে স্বীকার করাই হইতেছে তাওহীদের মর্মকথা। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর হুকুম বিধান বিশ্বমানবের নিকট পৌঁছান তাঁহার নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে। কাজেই ইহাতে আর কোনই সন্দেহ থাকিতেছে না যে, হযরত মুহাম্মাদ (স) কে রাসূল এবং জীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগে অনুসরণযোগ্য একমাত্র নেতা হিসাবে স্বীকার করা তাওহীদের একটি প্রধান ও অবিভাজ্য অংশ। আল্লাহ তাআলাকে যে ব্যক্তি এক বলিয়া মানিবে; কিন্তু হযরত মুহাম্মাদের উপস্থাপিত শরীয়াত বা জীবন-বিধান অনুযায়ী জীবন-যাপন করিবে না সেতো কাট্টা মুশরিক, তাওহীদের সাথে তাহার কোনই সম্পর্ক থাকিতে পারে না। তাহার পর থাকিয়া যায় পরকালের বিশ্বাসের গোড়ার কথাই হইতেছে এই তাওহীদ। যাহারা পরকাল-বিশ্বাস করে, কিন্তু সেই সঙ্গে তাহারা আল্লাহ তাআলার সহিত শরীক করে এবং ত্রাণকর্তা হিসাবে আরো অনেকের অধিকারকে স্বীকার করে, পরকালের প্রতি তাহাদের বিশ্বাস একেবারেই অর্থহীন। এই সব আলোচনার দ্বারা পরিস্কার বুঝা যায় যে, জীবন-ধর্মের সমস্ত ব্যবস্থাই তাওহীদের উজ্জ্বল আলোকে ভাস্কার ওদীপ্তমান। ইহা ব্যতীত কোন বিশ্বাস যেমন মাত্রই কার্যকরী হইতে পারে না, তেমনি জীবনের কোন কাজই ফলপ্রদ হইতে পারে না। এই তাওহীদ থেকেই শুরু হয় জীবন ধর্মের প্রথম পদক্ষেপ, আবার এখানেই অংকিত হয় তাহার শেষ পদরেখা। শুরুতেও তাওহীদ এবং শেষপ্রান্তেও এই তাওহীদই বর্তমান। শরীয়তের হুকুম আহকাম ও আল্লাহর আইন-কানুগুলি প্রকৃত পক্ষে সেই কালেমা তাওহীদ পর্যন্ত পৌঁছিবার উপায় এবং পন্থা মাত্র।
তাওহীদের এই অসাধারণ গুরুত্বের কারণেই প্রত্যেক নবী এবং রাসূলই নিজ নিজ দাওয়াত শুরু করিয়াছেন এই তাওহীদ থেকেই। তাঁহারা এই কেন্দ্র-বিন্দুতে এমন মজবুত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন যে, কোন অবস্থাতেই তাঁহারা সেই বিন্দু থেকে বিচ্যুত হন নাই; হইতে রাজী হন নাই। বিচ্যুত হওয়া তো দূরের কথা, এই মূল তাওহীদ প্রচার করার ব্যাপারে কিছুমাত্র খোশামুদী কিংবা নরম-নরম ভাব অবলম্বন করে নাই। এই ব্যাপারে কোন প্রকারের দুর্বলতা বা ক্লান্তি কিংবা বাতিলের সহিত সমঝোতার মনোভাবের তাঁহারা মাত্র্ই প্রশ্রয় দেন নাই। সকল রকমের বাধা-বিপত্তিকে অবলীলাক্রমে অতিক্রম করিয়া তাহারা সম্মুখের দিকে-বঞ্চিত মঞ্জিলের দিকে অগ্রসর হইয়াছেন। তাঁহাদের এই বিপ্লবী দাওয়াত বাণী প্রচার করিতে তাঁহারা মাত্রই কুন্ঠিত বা বিচলিত হন নাই। এমন কি, শেষ পর্যন্ত তাহারা মুষ্টিমেয় সঙ্গী সাথীদের লইয়া জন্মভূমি পরিত্যাগ করত: সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দেশে চলিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছেন, তাহা এই তাওহীদের বাণী। ইহারই জন্য তাঁহার সবকিছু অকাতরে বিসর্জন দিয়াছেন। সবকিছু ছাড়িয়া শুধু একটি মাত্র জিনিসকেই সমস্ত জীবনের সাথী হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন। এই তাওহীদের রক্ষা করিবার জন্য তাওহীদবাদীগণ নিজেদের অতি নিকটাত্মীয়দের বুকে ছুরি চালাইতেও মাত্রই দ্বিধা করেন নাই। ইহারই জন্য স্বামী স্ত্রীর এবং স্ত্রী স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ করিয়াছে। সমস্ত প্রকারের পূর্ব আত্মীয়তা ছিন্ন হইয়া-গিয়াছে সেই সব লোকের দ্বারা যাহার ছিলেন মানবতার শ্রেষ্ঠ প্রতীক এবং দয়া-ভালবাসা, সারল্য ও উদরতা এবং আত্মীয়তা রক্ষার বাস্তব প্রতিমূর্তী। মানব-জীবনে তাওহীদের গুরুত্ব এতখানি যে, মানুষের এক হাত যদি তাওহীদের বিরোধীতা করে, তবে অন্য হাত দ্বারা তাহাকে কাটিয়া ফেলিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ কিংবা ব্যথা অনুভবও করা যাইতে পারে না।
কারণ, আকাশের তলে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অনস্বীকার্য অধিকার এবং তাঁহার সেই ব্যাপক ও বিরাট অধিকারকে স্বীকার করা যায় কেবলমাত্র এই তাওহীদের মাধ্যমে। বস্তুত: ইহাই সুবিচার ও সু-শৃঙ্খলার মূল বুনিয়াদ। এই অধিকার যে ভাল জানেন বা পূর্ণমাত্রার স্বীকার করে না, সে দুনিয়ার কাহারো হক চিনিতে পারে না,- তাহার নিজেরও নয়। ফলে তাহার দ্বারা এমন সব জুলুম ও না-ইনসাফী, শোষণ ও উৎপীড়ন অনুষ্ঠিত হইবে যেমন অনুষ্ঠিত হইতেছে বর্তমান দুনিয়ার সব তাওহীদ-বিরোধী জালিম ও অকৃতজ্ঞ মানুষের দ্বারা।
দুনিয়ার যুগে যুগে নবী আসিয়াছেন এবং তাঁহার আজীবন সাধনার ভিতর দিয়া এই তাওহীদেরই প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছেন। তাওহীদের এই ব্যাপক ও বিপ্লবী রূপ নির্দিষ্ট কোন কালের জন্য সীমাবদ্ধ নয়, ইহা চিরকালীন, শাশ্বত ও চিরন্তন। সৃষ্টির প্রলয়কাল পর্যন্ত তাহা কার্যকরী থাকিবে এবং চিরদিনই ইহা ইহতে সেই শক্তি ও উপকারিতা লাভ করা সম্ভব, যাহা বারে বারে পৃথিবীতে দেখানো হইয়াছে নবীদের বিপ্লবী সাধনার ভিতর দিয়া। কিন্তু তাহার জন্য অপরিহার্য শর্ত এই যে, তাওহীদের সেই আসল ধারণা প্রকৃত রূপকেই গ্রহণ করিতে হইবে। গ্রহণ করিতে হইবে উহার সমগ্রটাকে। আর তাহাকে বাস্তবে রূপায়িত করিবার জন্য সঠিক সেই পন্থাই অবলম্বন করিতে হইবে, যাহা সুস্পষ্টরূপে নির্দিষ্ট করিয়া দিয়া গিয়াছেন আম্বিয়ায়ে কেরাম।
তাওহীদকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার যে পন্থা আম্বিয়ায়ে কেরাম দেখাইয়া গিয়াছেন তাহা সম্পূর্ণতা: কার্যকরযোগ্য-বাস্তব ও সামাজিক। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ইহার বিপ্লবীরূপ নিখুঁতরূপে দেখিতে পাই আম্বিয়ায়ে কেরামের ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে এবং সেখান থেকেই দেখিতে পাই সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ইহা কি বিরটা বিপ্লব সৃষ্টি করিতে পারে: আর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে করিতে পারে কী অভূতপূর্ব শক্তিদান।
তাওহীদের এই আওয়াজ যখন মানব সমাজে উত্থিত হয়, তখন চারিদিকে একটা প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তাওহীদ বিশ্বাসী মানুষেরা চারিদিকে হইতে সকল প্রকার সম্বন্ধ ও সংস্কারের আগল ভাংগিয়া অগ্রসর হয় এই কেন্দ্রবিন্দুর দিকে। ভাংগার পরেই জাগে সংগঠন বা পুনর্গঠনের অনুপ্রেরণা। ইহা ধ্বংসের পরে সৃষ্টির চিরন্তন দাবি। কাল বৈশাখী ঝড় প্রশান্ত সমুদ্রের বুকে প্রলয় তুফানের সৃষ্টি করে, কিন্তু তাহাকে পরিচালিত করে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে দিকে। বহুকে ভাংগিয়া একের প্রতিষ্ঠা-ই হইতেছে তাওহীদের প্রকৃতি।
তাওহীদের কেন্দ্র বিন্দুতে বিভিন্ন মানুষের জামায়েত হওয়ার পর যে সমাজ সৃষ্টি হয়, তাহার রূপ এক, রঙ এক, আদর্শ এক, লক্ষ্যও এক। তাহা গলানো ধাতুর তৈরী প্রাচীরের মতই দুর্ভেদ্য। সেই এক এর উদ্দীপনা নিখিল মানবের মনে জাগায় বিভেদ ও বিচ্ছেদের সমস্ত প্রকার চূর্ণ করিয়া একেরই সমতল পটভূমিতে সমবেত হওয়ার আকুল পিপাসা। মানবাতীত শক্তি ও অধিকারের ক্ষেত্রে যেমন তাহারা এক আল্লাহ ছাড়া আর কাহাকেও স্বীকার করে না-দুনিয়ার মানুষের মধ্যেও তাহারা স্বীকার করে না কোন প্রকারের বৈষম্য ও ভেদাভেদ। আঞ্চলিক, জাতিগত, ভাষাগত, কিংবা শ্রেণী ও বর্ণগত সমস্ত বৈষম্যকেই তাহারা চূর্ণ করিয়া দেয় তাওহীদ বিশ্বাসের অনির্বচনীয় প্রেরণায়। সমস্ত মানুষই এক, এক-এরই সৃষ্টি, এক আদেমরই সন্তান। মানুষ মানুষের প্রভু হইতে পারে না, মালিক হইতে পারে না। মানুষ কখনো মানুষের জন্য আইন ও জীবন-বিধান রচনা করিতে পারে না। সমস্ত মানুষ সমান ভাবে এক প্রভুরই অধীন দাস, সবই সেই একেরই মালিকানা সম্পত্তি, সেই একেবারেই বিধান ও আইন পালন করিতে বাধ্য নিখিল জগতের মানব জাতি। তওহীদের এই মৌলিক ধারণা-ই মানব সমাজের স্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থাপিত করিতে পারে, ইহাই আনিতে পারে এক অনাবিল মিলন ও ঐক্য। কিন্তু বর্তমান দুনিয়ার মানুষ চলিয়াছে কোন দিকে। প্রভুত্বও মালিকানা লইয়া আজ পৃথিবীব্যাপী চলিয়াছে পাশবিক কাড়াকাড়ি। মানুষে মানুষে বিবেধ ও বৈষম্যের আকাশ জোড়া প্রচীর আজ গোটা মানব গোষ্ঠীকে টুকরা টুকরা করিয়া দিয়াছে। বিভিন্ন জাতি আজ জাতীয়তার তীব্র ঝাঁজালো মদ পান করিয়া উন্মাদ হইয়াছে। সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা তীব্র বিষে দুনিয়ার বিভিন্ন সম্প্রদায় আজ মারাত্মক রূপ ধারণ করিয়াছে। তাই আজ তাহারা খাচা ভাঙ্গা ক্ষুধার্ত সিংহের মত একে অন্যের উপর লফাইয়া পড়িতেছে একটা দুর্মদ জিঘাংসাবৃত্তি লইয়া।চারিদিকে স্বার্থের সংঘাত-শক্তির রক্ত-সংগ্রাম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জের শেষ না হইতেই অধিকার লইয়াই আজিকার দুনিয়ার এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। তদুপরি বর্তমান বিজ্ঞান এই সংগ্রামের প্রয়োজনারূপ সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জামের ব্যবস্থা করিয়া দিয়া ইহাতে ঘৃতাহুতি দিয়াছে। আধুনিক বিজ্ঞান মানব মনের হিংস্রাভাবকে উত্তেজিত করিয়াছে, কিন্তু মনুষ্যত্ব শিক্ষা দেয় নাই। মানুষ তাই আজ শুধু অন্যের হরণ করিতে, অন্যের বুকে ছুরি বসাইতে কিংবা অন্যের উপর নিজের প্রভুত্ব স্থাপিত করিতেই উদ্যত। মানুষের সাথে মানবোচিত ব্যবহার করিতে মানুষকে ভালবাসিতে, বিচার ইনসাফের সহিত পরের অধিকার দান করিতে আজ কেহই রাজী নয়। আর ইহাই হইতেছে বর্তমান সভ্য দুনিয়ার চরম অসভ্যতা। আরো একটু অগ্রসর হইয়া চিন্তা করিলে পরিস্কার বুঝিতে পারা যায় যে, প্রভুত্ব ওমালিকত্ব লাভের এই যে প্রবল উন্মাদনা মানুষের মনে জাগিয়া উঠিয়াছে, বস্তত: ইহাই হইতেছে বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য; ইহাই দুনিয়াব্যাপী এই অশান্তির মূলীভূত কারণে। যতদিন মানুষকে নিরুংকুশ প্রভুত্ব ও অধিনায়কতার অধিকারী বলিয়া মনে করা হইবে, ততদিন তাহা লাভ করিবার জন্য একটা প্রবল পাশবিক লালসা মানব মনকে দুর্মদ করিয়া তুলিবেই আর ততদিন পর্যন্ত পৃথিবীর সমস্যার কোন সমাধানই হইবে না। সমাধান হওয়া তো দূরের কথা, ইহা ক্রমশ : আরো জটিল আকার ধারণ করিবে এবং আরো অধিকতর শক্তিশালী ও ধ্বংসকারী অস্ত্র আবিস্কার লইয়া চলিবে দুর্বার প্রতিযোগিতা।

কাজেই অতিবড় সত্য কথা, আজ উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করিবার দিন আসিয়াছে যে, মানুষ কখনই মানুষের প্রভু হইতে পারে না। পৃথিবীর ধন-সম্পত্তির নিরুংকুশ মালিক মানুষ হইতে পারে না এবং মানুষের জন্য মানুষের জন্য মানুষ মূলগতভাবে কোন আইন-ই রচনা করিতে পারে না। পৃথিবীতে প্রকৃত শান্তি স্থাপিত করিতে হইলে আজ আমন এক প্রভুর সন্ধান করিতে হইবে-যিনি নিজে বিরাট ও অপ্রতদ্বন্দ্বী ও অসীম শক্তির মালিক, যাঁহার সমীপে মাথা নাত করিতে, যাঁহার রচিত আইন পালন করিতে দুনিয়ার কোন মানুষই একবিন্দু কুন্ঠাবোধ করিতে পারে না। এবং যিনি নিজজ্ঞান ও প্রতিভার বলে মানুষের প্রকৃতি, মনস্তত্ব, প্রয়োজন সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত হইবেন, মানুষের জন্য যিনি এমন নিয়ম-কানুন রচনা করিতে পারিবেন, যাহা নির্ভুল ও সর্বব্যাপক হওয়ার সর্বব্যাপক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিখিল মানুষের পক্ষে সবচেয়ে বেশী উপকারী বলিয়া প্রতিপন্ন হইবে।
এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ব সম্মুখে রাখিয়া যে কেহ চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারিবে যে, উল্লেখিত গুণাবলীর অধিকারী এই বিশ্বভূবনে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কেহই হইতে পারে না। শক্তির আঁধার তিনি, সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা যিনি, তাঁহার জ্ঞান ও প্রতিভার কোন সীমা নাই, নাই কোন তুলনা। মানুষের ভাল মন্দ তিনি ছাড়া আর কেহই বুঝে না বলিয়া মানুষের জন্য অন্য কেহই জীবন বিধান রচনা করিতে পারে না। পক্ষান্তরে আল্লাহ তআলা যে আইন-ই রচনা করিবেন তাহা সর্বাঙ্গ সুন্দর হইবে তাহা নিখিল মানুষের নিকট সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হইবে। কেননা তিনি সকলেরই বন্দেগী পাইবার একমাত্র অধিকারী। তাহার রচিত আইন নিখিল মানুষের সকল পর্যায়ের সকল দেশের, বর্ণের ভাষার ও শ্রেণীর মানুষের নিকট সকল কালে সমান ভাবে গ্রহণযোগ্য হইবে। কোন মানুষই তাঁহার আইন পালন করিতে কোনই দ্বিধাবোধ করিবে না।
আজ দুনিয়ার মানুষ নিত-সংঘটিত যুদ্ধ বিগ্রহের অভিশাপ জর্জরিত, অতিষ্ঠ ও ওষ্ঠাগতপ্রাণ। আজ তাহারা সত্যিই শান্তি চায়। কিন্তু মানবতার চিরন্তন দুশমনেরা একদিকে যেমন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করিয়া প্রকৃতির শাশ্বত নিয়মের বিরোধীতা করিতেছে, তেমনি অন্যদিকে সৃষ্টিকর্তার প্রভূত্বের প্রকৃত অধিকারকে অমান্য এবং তাঁহার দেওয়া জীবন-বিধানকে উপেক্ষা য়া নিজেরাই মানুষের প্রভু হইবার ব্যর্থ চেষ্টা করিতেছে। বস্তুত: এইরূপ অস্বাভাবিক কার্যকলাপের দরুণ বিশ্ব-শান্তি বারবার ক্ষুণ্ন হইতেছে, ব্যাহত হইতেছে। সেইসব দুশমনেরা মাঝেমাঝে বিশ্ব-শান্তির জন্য বিশ্বরাষ্ট্র স্থাপনের যে জল্পনা কল্পনা করিতেছি প্রকৃত পক্ষে উহাতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হইয়া অশান্তি সৃষ্টিরই মস্ত বড় কারণ হইয়া দাঁড়াইবে। অতীত ও বর্তমান জাতিসংঘই উহার প্রকৃষ্ঠ প্রমাণ। কিন্তু বাস্তবাইক পক্ষেই যদি তাহারা পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করিবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়া থাকে আর সেই উদ্দেশ্যে যদি তাহারা বিশ্ব-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রাহান্বিতই হয়, তাহা হইলে আজ তাহাদের সর্বপ্রথম এই কথা ঘোষণা করিতে হইবে যে:
প্রভুত্ব, আইন রচনার অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কাহারোই নাই-থাকিতে পারে না। প্রথমেই মানবীয় প্রভুত্বকে স্পষ্ট ভাষায় ও উদাত্ত কন্ঠে অস্বীকার করিতে ইহবে। আর সেই সঙ্গে স্বীকার করিতে হইবে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে-একমাত্র আল্লাহকে। আর প্রভুত্ব ও আইন রচনার জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী পূর্ণমাত্রায় কেবল এক আল্লাহকেই বর্তমান আছে বলিয়া বিশ্বাস করিতে হইবে, মানিয়া লইতে হইবে। দুনিয়ার মানুষ ধন-সম্পদ-উৎপাদন-উপায় এবং এই রাজ্য ও রাজত্ব সব কিছুর উপর একমাত্র আল্লাহর দেওয়া আইন-বিধানকে জারি করিতে হইবে। বস্তুত: ইহাই হইতেছে তাওহীদ। এই দুনিয়ার নির্লিপ্ত শান্তি স্থাপন করিতে হইলে ইহার শুধু যে গুরুত্ব রহিয়াছে, তাহাই নহে, ইহা ভীন্ন কোন উপায়ই মানুষেরই মানুষের থাকিতে পারে না, কোন পন্থাই আর নাই। পৃথিবীর স্বার্থপর রাজনীতিক আর রাষ্ট্রকর্তারা যদি আজিও ইহা অস্বীকার করে, তবে তাহাদের অন্ধত্ব, তাহাদের অহমিকা ও কুপমন্ডুকতা ছাড়া আর কিছু নয়। দুনিয়ার সুস্থ বিবেবসম্পন্ন মানুষের সুস্থ চিন্তার ধারক ও বাহকেরা আজ তাওহীদের সত্যতা ও গুরুত্বকে পূর্ণ মাত্রায় স্বীকার করিতেছে, মর্মে মর্মে অনুভব করিতেছে, মস্তক অবনত করিয়া মানিয়া লইতেছে ও মহাসত্যকে। তাই আজ দুনিয়ার নিখিল মানুষকে আমরা আহ্বান জানাইতেছে আকুল কন্ঠে:
يَااَيُّهَا النًَّاسُ اعْبُدُوْ رَّبُكُمْ الَّذِىْ خَلُقَكُمْ وَالَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ ـ (البقرة)
হে মানুষ : দাসত্ব কবুল কর তোমাদের সেই এক প্রতিপালকের যিনি তোমাদের সৃষ্টি করিয়াছেন, সৃষ্টি করিয়াছেন তোমাদের পূর্ববর্তী সব মানুষকে। সম্ভবত: ইহারই সাহায্য তোমরা রক্ষা পাইতে পারিবে সকল প্রকার ধ্বংস ও ক্ষতি হইতে।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম