আপনারা আবশ্য জানেন যে, মানুষকে আয়ত্তাধীন রাখার প্রধানতম উপায় হচ্ছে দায়িত্বানুভূতি। তাই যদি কারো এরূপ ধারণা হয় যে, তাকে তার কোনো কাজের জন্য কারো নিকট জবাবদিহি করতে হবে না, বরং সে তার কাজে সম্পূর্ণ স্বাধীন ; এমনকি, তার নিকট কোনো অন্যায় কাজের কৈফিয়ত তলব করার এতোটুকু অধিকার পর্যন্ত কারো নেই, তখন উক্ত মানুষের অবস্থা হবে লাগামহীন উটের সমতূল্য। একথাটি কোনো এক ব্যক্তি বিশেষের বেলায় যেমন প্রযোজ্য, অনুরূপভাবে কোনো দল, সমাজ বা সমগ্র বিশ্বের মানব সমাজের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে। অর্থাৎ কোনো একদল লোক যখন ভাবে যে, তারা তাদের কাজে সম্পূর্ণ স্বাধীন, এমন কি তাদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ দুটি কথাও বলার অধিকার কারো নেই, তখন উক্ত দল কর্তৃক ‘ধরাকে শরা জ্ঞান করা’ মোটেই আশ্চর্যজনক নয়। এমনিভাবে যখন কোনো এক জাতি অন্য জাতির উপর এবং কোনো এক রাজা আপন রাজত্বের সীমায় নিজেকে সর্বদিক দিয়ে শক্তিশালী ও স্বাধীন মনে করার সুযোগ পায়, তখন উক্ত প্রবল জাতি কর্তৃক দুর্বল জাতি ও রাজা কর্তৃক নিরীহ প্রজাবর্গ নানাদিক দিয়েই নিপীড়িত ও নির্যাতিত হতে থাকে। এ নিষ্ঠুর সত্যটি এ দুনিয়ার সমস্ত অশান্তির প্রধানতম কারণ স্বরূপ বিভিন্ন রঙ্গে ও রূপে অহরহ আমাদের চোখের সামনে প্রকাশ হতে চলেছে এবং যতোদিন পর্যন্ত মানুষ তদপেক্ষা কোনো এক বিরাট শক্তির নিকট আপন কাজের জন্য দায়ি হওয়ার সত্যটি মেনে নিতে প্রস্তুত না হয়, ততোদিন পর্যন্ত অত্যাচারের দ্বার রুদ্ধ হয়ে বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব হতে পারে না।
এখন আপনারা আমাকে বলুন, উক্ত বিরাট শক্তির প্রকৃত মালিক এক আল্লাহ ভিন্ন অন্য কেউ হতে পারে কি? মানুষের মধ্য হতে তো কেউ এ শক্তির অধিকারী হতে পারে না। কারণ এ শক্তির অধিকার লাভের পর মানুষ হবে অত্যাচারী ও অবিচারী। এক কথায় সে তখন হবে এ দুনিয়ার ফেরাউনদের অন্যতম। ফলে কেউ হয়ত তার সমর্থন লাভ করে খুব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করার সুযোগ পেয়ে বসবে, আর কেউ বা তার রোষাগ্নিতে পতিত হয়ে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হবে। তাই এ জটিল সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে ইউরোপে ষবধমঁব ড়ভ হধঃরড়হ বা জাতিসংঘ কায়েম করা হয়েছিল, কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের সেই সংঘের অস্তিত্ব তেমন মজবুত হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত সেই তথাকথিত জাতিসংঘ মুষ্টিমেয় কয়েকটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের হাতের ক্রীড়নক সেজে ছোট ও দুর্বল রাজ্যসমূহের সাথে অবিচার করে শান্তির পরিবর্তে সমগ্র বিশ্বের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখিত তিক্ত অভিজ্ঞতার পর একথা আমাদের কাছে স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়েছে যে, মানুষের মধ্যে এমন কোনো শক্তির সৃষ্টি হওয়া সম্ভবপর নয় যা দ্বারা এ দুনিয়ার বড়-ছোট সমস্ত জাতির শক্তিকে যথাযথভাবে আয়ত্তে রাখা যায়। তাই আমরা বলতে বাধ্য হবো যে, উক্ত শক্তি নিশ্চিতরূপে মানবীয় সীমার বহু উর্ধে তদপেক্ষাও ঢের উচ্চ শ্রেণীর জিনিস, আর তা আল্লাহ তা‘আলার অসীম শক্তি ও মহিমা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। তাই এ দুনিয়ায় সুখ-শান্তিতে বসবাস করার উদ্দেশ্যে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করত বিশেষ বিনীত ও অনুগত প্রজাসম তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করা ও দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস অন্তরে স্থাপন পোষণ করা আবশ্যক যে, তিনি আমাদের গুপ্ত ও প্রকাশ্য সবকিছু অবগত আছেন এবং একদিন আমাদের প্রত্যেককে স্ব-স্ব আমলনামা হাতে নিয়ে তাঁর আদালতে হাজির হওয়া ভিন্ন গত্যন্তর নেই।
বস্তুত একমাত্র উল্লেখিত সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা অবলম্বনের মধ্যেই মানব জাতির সত্যিকার সুখ-শান্তি নিহিত।
একটি সন্দেহ
আমার বক্তব্য শেষ করার পূর্বে আপনাদের সন্দেহ দূর করার উদ্দেশ্যে আরো একটি জরুরি কথা নিবেদন করা আবশ্যক মনে করছি। আপনারা স্বভাবতই ভাবতে পারেন যে, যখন আল্লাহর আদেশ ভিন্ন ক্ষুদ্র-বৃহৎ কোনো শক্তিই এদিক-ওদিক চলবার সামর্থ নেই বলে প্রমাণ পাওয়া গেলো, যখন সমগ্র মানবসমাজ আইনগত আল্লাহর রায়ত শ্রেণীতে পরিনত হলো, তখন ক্ষুদ্র মানব কি করে আল্লাহদ্রোহী হতে সাহসী হয়? কি করে বান্দাদের উপর আপন প্রভুত্ব বিস্তার করত অন্যায় ও অত্যাচারের তাণ্ডবলীলা চালিয়ে থাকে? কেন আল্লাহ তাআলা যথাসত্ত্বর উক্ত অত্যাচারীর শাস্তি বিধান করেন না?
এ সন্দেহের উত্তর এই যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর বিরাট রাজত্বের সামনে কয়েকটি মানুষ এ দুনিয়ার শক্তিশালী কোনো এক বাদশাহ কর্তৃক তাঁর অধীনস্ত কোনো স্থানের শাসনকার্য পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী স্বরূপ। উক্তস্থানের অন্তর্গত রেল লাইন, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, দেশ রক্ষা ও সৈন্যবাহিনী ইত্যাদি তাঁরই করতলগত। তাই তাঁর ব্যাপক শক্তির তুলনায় তৎকর্তৃক নিযুক্ত কর্মচারীর ক্ষমতা অতীব তুচ্ছ ও নগণ্য। এমনকি, বাদশাহের ইচ্ছা ভিন্ন কর্মচারীর এক পা এদিক-ওদিক চলার শক্তিও নেই, কিন্তু বাদশাহ উক্ত কর্মচারীকে প্রদত্ত ক্ষমতা এবং সৎ-অসৎ ব্যবহারের পরীক্ষা করার জন্য যথেষ্ট স্বাধীনতা প্রদান করত দূর হতে নীরবে তার কার্য নিরীক্ষণ করে থাকেন। এমতাবস্থায় শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, ভদ্র ও নিমক হালাল (কৃতজ্ঞ) কর্মচারী রাজপ্রদত্ত ক্ষমতায় ক্ষমতাবান হয়েও দেশের কোনো প্রকার অন্যায় ও অত্যাচারের সৃষ্টি না করে রাজভক্ত কর্মচারীর ন্যায় আপন কতর্ব সম্পন্ন করে নিজেকে রায়ত বা প্রজার নিকট প্রিয় করে তুলতে সচেষ্ট হয়। ফলে বাদশাহ তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে তার পদমর্যাদা বৃদ্ধি করে থাকেন, পক্ষান্তরে কর্মচারী যদি দুষ্টবুদ্ধি ও নিমকহারাম (অকৃতজ্ঞ) হয় এবং প্রজাগণ যদি নির্বোধ বা অশিক্ষিত হয় তখন উক্ত কর্মচারী বাদশাহ প্রদত্ত ক্ষমতায় নিজেকে পূর্ণ ক্ষমতাবান মনে করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ও নিজেকে বাদশাহ বলে ঘোষণা করার অন্যায় সাহসেও সাহসী হয়ে থাকে। আর এদিকে মূর্খ ও অশিক্ষিত প্রজাবর্গ কোর্ট আদালতে চাকুরির কাজে এমনকি ফাঁসির আদেশ প্রদানেও উক্ত কর্মচারীর পূর্ণ ক্ষমতা দর্শন করে তাকে বাদশাহ বলে স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করে না। আর ঐদিকে বাদশাহ দূর হতে অন্ধ প্রজাবর্গ ও বিদ্রোহী কর্মচারীর অন্যায় আচরণ নিরীক্ষণ করতে থাকেন। ইচ্ছা করলে মুহূর্তেই তিনি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করতে পারেন, কিন্তু তিনি খুব ধীর-স্থির, তাই সত্ত্বর শাস্তির ব্যবস্থা না করে প্রজাবর্গ ও কর্মচারীকে স্বাধীনতা প্রদান করেন তাদের পরীক্ষা করতে থাকেন যেনো তাদের দুষ্টবুদ্ধির সকল মাত্রা পুর্ণভাবে প্রকাশ পায়। বাদশাহ অচিরেই এদের জন্য কোনো শাস্তি বিধান করেন না। এর কারণ এই যে, তার শক্তি এতো বিরাট ও ব্যাপক যে, উক্ত বিদ্রোহী কর্মচারী হাজার চেষ্টা করেও তাঁর বাদশাহী ছিনিয়ে নিতে কখনো সক্ষম নয় বরং বিদ্রোহী ও অকৃতজ্ঞতার দ্বারা স্বীয় ধ্বংসের সুনিশ্চিত কারণ হতে থাকবে। এরূপে প্রজাবর্গের বিদ্রোহ ও অন্যায় আচরণ যখন চরমে উঠে, তখন বাদশাহের পক্ষ হতে উভয়ের জন্য এমন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়, যার হাত হতে অব্যাহতির কোনো তদবীরই তখন আর কার্যকরী হয় না।
বন্ধুগণ!
আমরা উক্ত রাজ-কর্মচারী এবং প্রজাবর্গের প্রত্যেক ব্যক্তি আজ উল্লেখিত কঠিন পরীক্ষায় লিপ্ত। এখানে আমাদের জ্ঞান, শক্তি, কর্তব্যপরায়ণতা ও আনুগত্যের কঠিন পরীক্ষা চলছে। আমাদের প্রত্যেককে আজ এ মীমাংসা করতে হবে যে, আমরা আমাদের প্রকৃত বাদশাহের নিমক-হালাল প্রজা কিনা। অবশ্য আমি আমার জন্য নিমক হালাল হওয়ারই চূড়ান্ত মীমাংসায় উপনীত হয়েছি এবং প্রত্যেক আল্লাহদ্রোহীর সাথে পরিষ্কাররূপে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছি। আর আপনারাও আপনাদের স্ব-স্ব পথ নির্ধারণে সম্পূর্ণ স্বাধীন। একদিকে ঐ সকল উপকার ও অপকার, যা আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত শক্তিতে শক্তিবান আল্লাহদ্রোহী কর্মচারীর মধ্যস্থতায় আপনারা পেয়ে থাকেন, অন্যদিকে ঐ সকল লাভ-লোকসান, যা স্বয়ং সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলা আপন বান্দাহদের উপর পৌঁছাতে ষোলআনা সক্ষম। এখন আপনারা আপনাদের পছন্দনুযায়ী এ দুয়ের কোনো একটিকে নিজেদের জন্যে মনোনীত করুন।
0 comments: