১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘদিন পরও আজ পর্যন্ত এখানে আদর্শ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়নি। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নাগরিকদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবার ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থা চলে আসছে আরো আগে থেকে।
মুসলিম শাসনামলে ভারত উপমহাদেশে চালু ছিলো ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা। সে শিক্ষা ব্যবস্থায় তৈরি হতো আদর্শ নাগরিক, আদর্শ মুসলিম এবং দেশ পরিচালনার যোগ্যাসম্পন্ন দক্ষ নেতৃত্ব ও জনশক্তি।
কিন্তু ১৭৫৭ সাল থেকে যখন ইংরেজরা ভারতবশর্ষ দখল করে নিতে থাকে, তখন থেকে তারা এ দেশে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা করে, যে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা থেকে তারা এ দেশে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা করে, যে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা লাভকারীরা তাদের মানসিক গোলাম হিসেবে তৈরি হবে। তাদের খাদেম ও সেবক হয়ে কাজ করবে এবং মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলেও সত্যিকার খাদেম ও সেবক হয়ে কাজ করবে এবং মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলেও সত্যিকার মুসলিম হয়ে গড়ে উঠবেনা। শেষ পর্যন্ত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাহীন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা তার শৌর্যবীর্য হারিয়ে স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং কার্যকারিতা হারয়ে ফেলে। অপরদিকে বৃটিশদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা জমে উঠে। চাকুরি বাকরিসহ বস্তুগত জীবন ধারণ ও জীবন যাপনের জন্যে তখন এই শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ে।
সেই থেকে এদেশে চালু হয় দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা। অর্থ্যাৎ দুই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা। একটি হলো বৃটিশদের বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা। আর অপরটি হলো পূর্ব থেকে চলে আসা মুসলামানদের ধর্মীয় তথা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে।
এ সময় মুসলমানরা রাষ্ট্র ও ক্ষমতা হারিয়ে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ার কারণেই তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও ধীরে ধীরে সেকেলে হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের পরিচালিত মাদ্রাসাগুলো শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্য লোক তৈরি করবার উপযুক্ততা হারিয়ে ফেলে।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার সময় ভারত বিভক্ত হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে গঠিত হয় ভারত।
মুসলমানরা স্বাধীন পৃথক রাষ্ট্র দাবি করেছিল ইসলাম অনুযায়ী দেশ পরিচালনার জন্যে। তাদের আদর্শিক ঐতিহ্য ও শিক্ষা সংস্কৃতি চালু করবার জন্যে। কিন্তু যারা পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় আরোহণ করে, তারা মুসলামনদের এই প্রাণের দাবির সাথে গাদ্দারি করে। তারা পাকিস্তানে কিছুতেই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ও চালু করেনি। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেনি। তারা ইংরেজদের চালু করেনি। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেনি। তারা ইংরেজদের চালু করে যাওয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা সবই হুবহু বহাল রাখে। কিছু সংস্কার সংশোধন করলেও ইসলামের পক্ষে তেমন কিছুই করেনি। কেবল মুসলমান জনগণের প্রবল চাপের মুখে বাধ্য হয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান নামের সাইন বোর্ডটি গ্রহণ করে। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা করেননি। অতপর চব্বিশ বছরের মাথায় পাকিস্তান ভেংগে যায়। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যায় পাকিস্তান হিসেবে।
স্বাধীন বাংলাদেশেরও চব্বিশ বছর বিগত হলো। আদর্শ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা এখানে চালু হয়নি। জনগণের প্রাণের দাবি ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণীত ও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
১৯৭১-র স্বাধীনতার পর কয়েকবারই জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়েছে। ডঃ কুদরাত-এ-খুদা, মজীদ খান ও প্রফেসর মফিজ উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। প্রথম কমিশনটি ছিলো ডঃ কুদরাত-এ-খুদা কমিশন। এ কমিশনের রিপোর্টের উপর বিগত ৪ ফেব্রুয়ারি ৯৭ তারিখে ঢাকাস্থ হোটেল সুন্দরবনে একটি আলোচনা সভার স্বাগত ভাষণে আমি বলেছিলাম:
আপনারা জানেন, ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন সরকার কর্তৃক ড:কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। একই সালের ২৪ সেপ্টেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এ কমিশনের উদ্বোধন করেন। কমিশন সদস্যগণ ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে ভারত সফর করেন। এক মাসব্যাপী সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। অতপর কমিশন সরকারি প্রস্তাবের নির্দেশনানুযায়ী ১৯৭৩ সালের ৮জুন প্রধানমন্ত্রীর নিকট অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী রিপোর্ট গ্রহণ করে সন্তোষ প্রকাশ করেন। (বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ভূমিকা-)
আপনারা একথাও অবগত আছেন, ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরির্তনের পর উক্ত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট আর বাস্তবায়িত হয়নি। এ বিষয়টিও নিশ্চয়ই আপনাদের দৃষ্টি এড়ায়নি যে, বর্তমান সরকার ইতোমধ্যেই উক্ত কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কিমিশনই রিপোর্টকে গণমুখী ও যোগপযোগী করে একটি বাস্তবভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নে উদ্দেশ্যে অধ্যাপক শামসুল হকের নেতৃত্বে ৫৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটিও গঠন করেছে।
একথাতো তো কোন প্রকার সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের জন্যে অবশ্যি একটি যুগোপযোগী বাস্তবভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রয়োজন। কিন্তু যুগোপযোগী এবং বাস্তবভিত্তিক কথা দুটি আপেক্ষিক। এ দুটি কথাই দৃষ্টিভংগি দ্বারা বিবেচিত ও প্রভাবিত হয়ে থাকে। যেমন, কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকেও গণমুখী, যুগোপযোগী এবং বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা রিপোর্ট বলা হয়েছিল।
এ রিপোর্টের ভূমিকায় বলা হয়: আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের সুপারিশসমূহ বাস্তাবায়িত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রের এ অবঞ্চিত পরিস্থিতির অবসান ঘটবে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে নব দিগন্তের সূচনা হবে।
নবদিগন্ত সূচনাকারী সেসব সুপারিশ কি? উক্ত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট থেকে আমি কয়েকটি সুপারিশ আপনাদের সামনে উল্লেখ করছি:
১. কাজেই দেশের কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্তসহ সকল শ্রেণীর জনগণের জীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের উপলব্ধি জাগানো, নানাবিধ সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা অর্জন এবং তাদের মাঝে বাঞ্চিত নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির প্রেরণা সঞ্চারই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান দায়িত্ব ও লক্ষ্য। (অধ্যায়: ১:১)
২. আমাদের শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবোধ শিক্ষার্থীর চিত্তে জাগ্রত ও বিকশিত করে তুলতে হবে এবং তার বাস্তব জীবনে যেন এর সম্যক প্রতিফলন ঘটে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। (অধ্যয় : ১: ২)
৩. সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির সকল নাগরিকদের ....শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে। (অধ্যায় : ১:২)
৪. নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজে স্বাধীন চিন্তা, সৃজনশীল, সংগঠন ক্ষমতা ও নেতৃত্বের গুনাবলী বিকাশের উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। (অধ্যায়: ১:৯)
৫. প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশেকে গভীরভাবে ভালবাসতে হবে এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদ আদর্শের সম্যক উপলব্ধি অর্জন করতে হবে। (অধ্যায় ২:৩)
৬. সমগ্র দেশে সরকারী ব্যয়ে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত একই মৌলিক পাঠ্যসূচি ভিত্তিক এবং অভিন্ন এবং অভিন্ন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। (অধ্যায় ৭:৯)। (অর্থ্যাৎ মাদ্রাসা শিক্ষা থাকবেনা)।
৭. প্রাথমিক শিক্ষার পঠিতব্র বিষয় : সাপ্তাহিক পিরিয়ড:
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা থাকবেনা। ৬ষ্ট, ৭ম ও ৮ম শ্রেণীতে সপ্তাহে ধর্ম শিক্ষার ২টি করে পিরিয়ড থাকবে। (অধ্যায় ৭:১০)
৮. মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর হবে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। এ স্তরের শিক্ষার্থীদের বয়সের প্রেক্ষিতে ধর্ম শিক্ষার একই শিক্ষা পরিবেশ শিক্ষাদানের সুযোগ সৃষ্টি শিক্ষা মনোবিজ্ঞান সম্মত। (অধ্যায় : ৭:১০) । অর্থ্যাৎ সহশিক্ষা।
৯. নবম শ্রেণী হতে শিক্ষা কার্যক্রম মূলত দ্বিধাবিভক্ত হবে: (ক) বৃত্তিমূরক শিক্ষা ও (খ) সাধারণ শিক্ষা। (অধ্যায় ৮:৫)। (ধর্মীয় শিক্ষা থাকবেনা)।
১০. মাদ্রসা শিক্ষা পদ্ধতি অনেকটা একদেশদর্শী। কেননা সকল শিক্ষার্থীকেই ইসলাম সম্পর্কে বিশেষ শিক্ষা প্রদান মাদ্রাসার লক্ষ্য। (অধ্যায়: ১১:২)
১১. বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মাদ্রাসা শিক্ষার আমূল সংস্কার ও যুগোপযোগী পূর্ণগঠনের প্রয়োজন। আমাদের সুপারিশ হচ্ছে দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রিপোর্টের সপ্তম আধ্যায় বর্ণিত একই প্রাথমিক শিক্ষাক্রম (১ম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত) প্রবর্তিত হবে। (অধ্যায় ১১:৩)। অর্থ্যাৎ মাদ্রাসা থাকবেনা।
এ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাস্তব ও কর্মমূখী করার জন্যে অনেকগুলো প্রস্তাবই আছে। তবে সেই সাথে শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতির ঈমান আকীদা, ধ্যান ধারণা, দৃষ্টি ভংগি ও ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করার একটা পরিকল্পনাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মকে ইসলামী আদর্শের বিপরীত বিশেষ ধ্যান ধারণা ও দৃষ্টিভংগিতে গড়ে তোলার সুস্পষ্ট সুপারিশ এই রিপোর্ট রয়েছে। সুতরাং এ রিপোর্টকে কতটা গণমুখী ও বাস্তব ভিত্তিক বলা যায়?
বর্তমান সরকার উক্ত কমিশনের সুপারিশমালাকে বাস্তবভিত্তিকে করে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্যে যে কমিটি গঠন করেছে, সে কমিটি কি কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের সুপারিশমালায় সন্নিবেশিত লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভংগি পাল্টাবে? জাতির ঈমান আকীদা,দৃষ্টিভংগি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা কি তারা চিন্তা করবে? তারা কতি পারবে ইসলামী আদর্শভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে? দীনি শিক্ষার অস্তিত্ব বজায় রাখতে?
সরকার কমিটি সদস্যদের তালিকা প্রকাশ করার পর জাতি হতাশ হয়েছে। ইতোমধ্যেই এ কমিটির ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় বিরুপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ কমিটি জাতির প্রত্যাশিত শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে বলে সচেতন মহল মনে করতে পারেছনা। ফলে ইসলামী শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।১
সরকার ড: কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে বাস্তবভিত্তিক ও যুগোপযোগী করার জন্য যে কমিটি গঠন করেছে (জানুয়ারি ৯৭তে), সে কমিটিকে প্রস্তাব ও সুপারিশমালা প্রদানের জন্যে সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজ ২১
১. দ্রষ্টব্য : জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নে প্রস্তাব ও সুপারিশমালা গ্রন্থ প্রকাশক: সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজ, জুন ১৯৯৭।
মার্চ ৯৭ তারিখে ন্যাম এ এক সেমিনার কাম ওয়ার্কশপের আয়োজন করে। উক্ত সেমিনারে স্বাগত ভাষণ প্রদাকালে আমি বলেছিলাম:
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু নীতিহীন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতিকে বিভ্রান্ত করে। শিক্ষা অবশ্যই এমন হতে হবে, যে, শিক্ষা মানুষকে স্রষ্টামুখী করে এবং সাথে সাথে জীবন ও জগতকে সঠিক নীতি ও দক্ষতার সাথে পরিচালিত করার উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। তাই শিক্ষানীতি আমাদের লাগবেই। আমাদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। তাই শিক্ষানীতি আমাদের লাগবেই। আমাদের শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে একথা সুস্পষ্ট করে বলে দিতে হবে যে, আমরা আমাদের সন্তানদের মধ্যে কোন দৃষ্টিভংগি, ধ্যান-ধারণা, আকিদা, কোন ঐতিহ্য চেতনা এবং কিসের প্রেরণা সৃষ্টি করতে চাই? অর্থ্যাৎ আমরা আমাদের শিক্ষা দর্শনকে কোন ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে চাই? একথাতো পরিষ্কার, মানুষের দৃষ্টিভংগি ও নৈতিক চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে যদি ধর্মীয় বিশ্বাসকে ভিত্তি বানানো না হয়, তাহলে Stanly Hull এর কথাই যথার্থ। তিনি বলেছিলেন, তিনটি R অর্থ্যাৎ Reading, Writing এবং Arithmetic এর সাথে যদি ৪র্থ R মানে Rascal-ই পাবেন। অর্থ্যাৎ সেক্ষেত্রে শিক্ষাথীর্রা Rascal হতে বাধ্য। বিশ্বের অবশ্যি এক আল্লাহমূখী হতে হবে। তিনি এবং তাঁর বিধানই মানুষের সত্যিকার কল্যাণ সাধন করতে পারে। মানুষের সত্তাকে তিনিই সোনালি চুলকে নয়, আমার সত্তাকে ভালোবাসবে প্রেমিকার এ দাবির প্রেক্ষিতে মহাকবি W.B.Yeats বলেছিলেন:
I heard an old religious man
But yesternight declare
That he had found & text to prove
That only God, my dear,
Could love you for your self alone
And not for your yellow hair.
হ্যাঁ, কেবল আল্লাহই মানুষকে সত্যিকার ভালোবাসেন। তাই কেবল তাঁর বিধানই মানুষের ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণের গ্যারান্টি। মানব কল্যাণের শিক্ষা ব্যবস্থা কেবল আল্লাহ বিধানের ভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে।অপরদিকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হতে হবে এতোটা উন্নত একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছে। এ প্রতিবেদনের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বল হয়েছে:
১. ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক,ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা।
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভোমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীকে সচেতন করা।
৩. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রণিত করে তোলা এবং তাদের চিন্তা চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং চরিত্র সুনাগরিকের গুলাবলির বিকাশ ঘটানো।
৪. দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য শিক্ষাকে প্রয়োগমুখী, উৎপাদনক্ষম, সৃজনশীল করে তোলে এবং শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, দায়িত্ববান ও কর্তব্যপরায়ণ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা।
৫. কায়িক শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আগ্রহী করে তোলা এবং শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে আত্মকর্ম সংস্থানে নিয়োজিত হওয়ার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার দক্ষতা অর্জনে সমর্থ করা।
৬. বিশ্বভ্রাতত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতাবোধ গড়ে তোলা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা।
৭. গণতান্ত্রিক চেতনাবোধের বিকাশের জন্য পারষ্পরিক মতাদর্শের প্রতি সহনশীল হওয়া এবং জীবনমুখী, বস্তুনিষ্ঠ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশে সহায়তা করা।
৮. শিক্ষার প্রত্যেক স্তরে পূর্ববর্তী স্তরে অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতাও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত দৃঢ় করা ও এগুলো সম্প্রসারণে সহায়তা করা এবং নবতর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থীদের সমর্থ করা।
৯. জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতির ধারা ও নৈতিক মূল্যবোধ বিকশিত করে বংশ পরস্পরায় হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা।
১০. দেশর জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা।
১১. বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষালাভের সমান সুযোগ-সুবিধা অবারিত করা।
১২. শিক্ষার জাতি, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে নারী পুরুষ বৈষম্য (Gender bias) দূর করা।
১৩. শিক্ষার সর্বস্তরে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার প্রতিফলন ঘটানো।
১৪. পরিবেশ-সচেতনতা সৃষ্টি করা। ৩
৩. পরিবেশ : জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা: ৯,৪০।
এখানে ২নং পয়েন্ট সুস্পষ্ট ও অকাট্য কথা বলে দেয়ার পর ৩ নং পয়েন্ট মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি, তা উহ্য ও অস্পষ্ট রেখে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। তাছাড়া ৬,৭ ও ৯ নং পয়েন্টসমূহ খুবই বিভ্রান্তিকর। এছাড়া এ প্রতিবেদনের ভেতরেও মাঝে মাঝে বেশ বিভ্রান্তিকর সুপারিশ করা হয়েছে।
এযাবত যতোগুলো শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেই প্রকাশ হয়েছে, তার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। তবে শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিকে বিভিন্ন সময় সংস্কার করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময় কিছু কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলাম, বিজ্ঞান,প্রযুক্তি ও আধুনিক দৃষ্টিভংগির সমন্বয়ে এখনো ঢেলে সাজানো হয়নি।
আমাদের দেশে এখনো মূলত সেই ইংরেজ আমল থেকে চলে আসা দুই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। একটি হলো ট্রেডিশনাল মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা আর অপরটি ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা। একটি আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে বিবর্জিত আর অপরটি ইসলামী আদর্শ বিবর্জিত। একটি জাতির লোকেরা দুই ধারায় শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে আরেক ধারার শিক্ষার্থীরা সুধারণা পোষণ করেনা। আদর্শ মুসলিম জাতি গঠনের জন্যে এর কোনো ধারাই এখন আর উপযুক্ত নয়। উভয় ধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকেই আমাদের বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার।
বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা
ইংরেজরা আমাদের দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে গেছে সেটাকেই আমরা বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা বলছি। এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিরেট কতিপয় উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখেই তৈরি করা হয়েছিল। তাই এটাকে বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা বলাটাই যুক্তিযুক্ত।
ইংরেজ শাসকরা এদেশে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে, যার উদ্দেশ্য ছিলো ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে থেকে একদল শিক্ষিত মানসিক গোলাম ও প্রভু ভক্ত লোক তৈরি করা, যারা জাতিগতভাবে ভারতীয় থাকবে, কিন্তু মানসিকভাবে হানাদার শাসক ইংরেজদের ধ্যান ধারণায় পরিগঠিত হবে।
বৃটিশরা এসেছিল এদেশে শাসন শোষণ করতে। তাই এদেশীয়দের মধ্যে থেকে তাদের এমন একদল লোক প্রয়োজন ছিলো, যারা তাদেরেক প্রভু মনে করবে, তাদের সভ্যতা সস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করবে, তাদের আচার আচরণ ও চিন্তা দর্শনকে চমৎকার মনে করবে এবং একান্ত অনুগত বাধ্যগত দাসের ন্যায় দেশ পরিচালনার কাজে তাদের সেবা সহযোগিতা করবে। যে ব্যক্তি তাদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে যতো বেশি নিষ্ঠার সাথে সেবা করবে সে নিজেকে ততোবেশি গৌরবান্বিত মনে করবে।
তাদের নিজেদের দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিলো, তা ছিলো রাজ্য শাসন, রাজ্য বিস্তার ও নিজেদের চিন্তা দর্শন বিস্তারের উপযোগী লোক তৈরি করার উদ্দেশ্যে প্রণীত।
সুতরাং নিজেদের দেশে তারা যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে, তা তৈরি হচ্ছিলো সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানের উপযুক্ত লোক আর জবর দখল করা দেশগুলোতে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে তা থেকে লাভ করছিল প্রভু ভক্ত ও আনুগত্য পরায়ণ লোক। এভাবেই তারা শাসক ও সেবক শ্রেণীর লোক তৈরি করছিল। তাদের চালু করে যাওয়া সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের দেশে এখনো চালু আছে। এই বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থাটিই আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে চালু রয়েছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদেরকে একটি স্বতন্ত্র ও আদর্শ সভ্যতা সংস্কৃতির অধিকারী জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি। এ শিক্ষা আমাদের জাতিকে মানসিকভাবে করেছে বহুগামী। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু আমাদের চিন্তাধারা বিচিত্রগামী। এই শিক্ষার অসংখ্য ত্রুটি আছে। তবে এর প্রধান প্রধান ত্রুটিগুলো নিম্নরূপ:
১. আল্লাহ বিমুখ শিক্ষা ব্যবস্থা: বৃটিশদের চালু করে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন সময় কিছু কিছু সংস্কার ও মেরামতের কাজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূলধারা নিরেট আল্লাহ বিমুখ জড়বাদী দর্শনের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই পৃথিবী এবং এই মহাবিশ্ব কে সৃষ্টি করেছেন? কি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন? আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এর জবাব নাস্তিকতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। কিংবা সংশয়বাদী ধারণা পেশ করা হয়েছ।
এই বিশ্ব জগতের যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, তিনিই যে গোটা মহাবিশ্ব অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে পরিচালনা করেছেন, তিনিই যে মানুষকে বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, মানুষের জীবন যাপনের জন্যে জীবন দর্শন ও জীবন বিধান দিয়েছেন, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার এই দৃষ্টিভংগি অনুপুস্থিত।
২. ঈমানি দর্শন বর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা: আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে সঠিক জীবন দর্শন দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আল্লাহ, আল্লাহর একত্ব, রিসালাত, আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াত, পরকাল, আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতা, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি ঈমানি দর্শনের ধারণা বিবর্জিত এ শিক্ষা ব্যবস্থা আর্দশবাদী মানুষ তৈরি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এ শিক্ষা ব্যবস্থা পরকালে বিমুখ দুনিয়া পূজারী মানুষ তৈরি করে। মানুষকে তার শাশ্বত জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা এখানে নেই। মানুষের প্রকৃত কল্যাণ অকল্যাণ, জীবনের আসল ব্যর্থতা ও সার্থকতা জানবার ব্যবস্থা এখানে নেই। ঈমান বিবর্জিত বস্তুবাদী দর্শনই এ শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি।
৩. জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশনা বর্জিত শিক্ষা : আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার মূলধারাই যেহেতু আল্লাহ বিমুখ ও ঈমান আকীদা বিবর্জিত দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আদর্শিক জীবন ও জীবন পদ্ধতি লাভ করার তো কোনো প্রশ্নই আসেনা। মহান আল্লাহ অহী ও নব্যূয়তের মাধ্যমে মানুষের জন্যে যে হিদায়াত ও জীবন যাপন পদ্ধতি পাঠিয়েছেন, এ শিক্ষা ব্যবস্থা সে সম্পর্কে নিরব। শুধু নীরবই নয়, বরং বিরূপ। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা শিক্ষিত হচ্ছে, তারা না ইসলামী জীবন পদ্ধতি যাপন পদ্ধতি পাঠিয়েছেন, এ শিক্ষা ব্যবস্থা সে সম্পর্কে নীরব। শুধু নীরবই নয়, বরং বিরূপ। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা শিক্ষিত হচ্ছে, তারা না ইসলামী জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো জ্ঞান লাভ করার সুযোগ পাচ্ছে, না সত্যিকার মুসলিম হয়ে গড়ে উঠতে পারছে আর না জীবন যাপনের সঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছে। এর ফলে এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকদের মধ্যে বহুরংগী জীবন যাপনের প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
৪. প্রকৃত লক্ষ্য বিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা: ইসলামী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মানুষের মাঝে এক আল্লাহর গোলামি করার প্রবণতা সৃষ্টি করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের মুক্তিলাভের প্রেরণা সৃষ্টি করা, আল্লাহ প্রদত্ত সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে নিজেদেরকে পেশ করার যোগ্যতা অর্জন এবং খিলাফত পরিচালনা এবং মানবতার সেবা করার দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করা। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভাবধারা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা লাভকারীরা জীবনের কোনো মহত লক্ষ্য অর্জন করেনা এবং উপরোল্লিখিত শ্রেষ্ঠ গুনাবলী ও যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেনা।
৫. নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ব্যর্থতা: এই আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের নৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ দেউলিয়া করে ছেড়েছে। গোটা জাতিকে নৈতিক অধ:পতনের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করে দিয়েছে। এখানে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টির কোনো মানদন্ড নেই। আদর্শ ও লক্ষ্য বিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থার ফল এ রকমই হয়। যে শিক্ষা ব্যবস্থা এক আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করেনা, পরকালের জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি করেনা, আদর্শ জীবন পদ্ধতির প্রতি উদ্বুদ্ধ করেনা, সে শিক্ষা ব্যবস্থাতো আদতেই মেরুদন্ডহীন। এরূপ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে নৈতিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়। এ শিক্ষা ব্যবস্থার কুফলে আমাদের জাতি দিন দিন নৈতিক অধ:পতনের দিকে তলিয়েই চলেছে।
৬. নেতৃত্ব ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ব্যর্থতা: আমরা আগেই আলোচনা করে এসেছি, এ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল বৃটিশদের মানসিক দাস আর অনুগত সেবক তৈরি করার জন্য। এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে স্বাধীন দেশ ও জাতিকে পরিচালনা করার যোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবার আশা করা যায়না। নিজ দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্যে আত্মত্যাগী শিক্ষিত মানুষ এখান থেকে বের হবার আশা করা যায়না। তাইতো দেখা যায়, জাতির মেধাবী লোকেরা স্বদেশ থেকে বিদেশেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
৭. জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টিতে ব্যর্থতা : এ শিক্ষা ব্যবস্থা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এ শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে মানসিকভাবে বহুমত ও পথের অধিকারী বানিয়ে দেয়। একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মানসিকভাবে পরস্পরভাবে পরস্পরের শত্রু হয় গড়ে উঠে। ছাত্র জীবন শেষে তারা বিভিন্ন মত ও পথে পরিচালিত হয় এবং জাতিকেও বিভিন্ন পথ ও মতের দিকে ধাবিত মত ও পথে পরিচালিত হয় এবং জাতিকেও বিভিন্ন পথ ও মতের দিকে ধাবিত করবার চেষ্টা করে। ফলে জাতির মধ্যে দিন দিন হানাহানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনৈক্য প্রসারিত হচ্ছে। ঐক্য ও সংহতির বন্ধন একেবারে শিথিল হয়ে পড়েছে। জাতি অসংখ্য মত ও পথের অনুসারী হয়ে পড়েছে।
৮. সংকীর্ণ মতপার্থক্য সৃষ্টি ও লালন করা এ শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট।
৯. সন্ত্রাস : এ শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক দেউলিয়াত্বের কারণে শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সন্ত্রাস আজ আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার অপরিহার্য অংগে পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এখানকার শিক্ষকরা পর্যন্ত সন্ত্রাসের দিকে ঝঁকে পড়েছে।
১০. এ শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে উন্নত জীবনবোধ সৃষ্টি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
১১. এ শিক্ষা ব্যবস্থা স্বার্থপর, স্বার্থন্বেষী নিরেট বস্তুবাদী দৃষ্টিভংগির লোক তৈরি করছে। এ শিক্ষা ব্যবস্থার আরেকটি অকল্যাণকর বৈশিষ্ট হলো সহশিক্ষা। সহশিক্ষা শিক্ষার পরিবেশকে বিনষ্ট করে দিয়েছে। ইসলামী জীবনবোধ ও মূলবোধকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। ছেলে মেয়েদের অবাধ মেলামেশার চরম কুফল জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।
১২. দুর্নীতির প্রসার: দুর্নীতি আমাদের জাতি সত্তার অংশে পরিণত হয়েছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসছে জঘণ্য ঘুষখোর, চোরাকারবারী, মানুষের অধিকার হরণকারী, আইনকানুন ও নিয়মশৃংখলা লংঘনকারী, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, স্বজনপ্রীতিকারী, যুলুমবাজ, মদখোর, মদখোরা, জুয়াবাজ, ফাঁকিবাজ, প্রতারক, চোর, ডাকাত ইত্যাদি। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্যে, আদর্শ মানুষ তৈরির মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। আর আমাদের ভাগ্যে জুটেছে এর বিপরীত ফল। আমরা এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রেখেছি, যা দুর্নীতি শিক্ষা দিচ্ছে এবং এর শিক্ষার্থীরা দুর্নীতির কাজে দক্ষ হয়ে বেরুচ্ছে।
১৩. ধর্মীয় শিক্ষার লেজুড়: অবস্থার প্রেক্ষিতে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার গোটা ধর্মীয় ভাবধারার সাথে ইসলামিয়াত ও ইসলামের ইতিহাসের লেজুড় জুড়ে দেয়া হয়। ইসলামিয়াতকে নিচের শ্রেণীগুলোতে কখনো ঐচ্ছিক, কখনো বাধ্যতামূলক রাখা হয়। উক্ত শ্রেণীতে ইসলামিয়াত ও ইসলামের ইতিহাস ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়।
ইসলামের ইতিহাস নামে এমন ইতিহাস ছাত্রদের পড়ানো হয়, যাতে ইসলামকে বিকৃত এবং ইসলামের ইতিহাসকে স্বার্থপরতা ও যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ফলে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যারা পাশ করে বের হয় তারা ইসলামের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যায়। বরং অনেকেই একেবারে ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে বের হয়। ইংরেজ শাসকরা মুসলিম যুবকদের ইসলাম বিদ্বেষী বানাবার একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ইসলামের ইতিহাস বিভাগ চালু করে। অমুসলিমদের লেখা ইতিহাস এখানে ছাত্রদের পড়ানো হয়। এ বিভাগের মাধ্যমে ইসলামকে একটি জঘণ্য মানবতা বিরোধী ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এ বিভাগের মাধ্যমে বৃটিশরা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতি গ্রহণ করে।
ইসলামিয়াত বা ইসলামী শিক্ষা নামে এ বিষয়টি চালু করা হয়েছে তাতে ইসলামের পূর্ণাংগ ধারণা দেয়া হয়না। তবে যতটুকু ধারণাই দেয়া হয় তার ফলাফল ইসলামের পক্ষে খুব একটা যায়না। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে।
পহেলা কারণ হলো, নিচের শ্রেণীগুলোর ইসলামিয়াত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী শিক্ষা বিভাগে ইসলামকে পূর্ণাংগ জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষা দেয়া হয়না। ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রতিও গুরুত্বরোপ করা হয়না।
ইসলামিয়াত বিষয়টি গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পরগাছার মতো। ছাত্রদের অন্য সকল জ্ঞান বিজ্ঞান এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়, পরকাগাছার মতো। ছাত্রদের অন্য সকল জ্ঞান বিজ্ঞান এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়, যার ফলে গোটা বিশ্বজগত আল্লাহ ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে এবং সফলভাবে পরিচালিত বলে তারা অনুভব করে। আল্লাহ রসূল ও পরকালের প্রয়োজনীয়তাই তারা অনুভব করেনা। ছাত্রদের গোটা চিন্তাধারাই এ দৃষ্টি ভংগিতে গড়ে তোলা হয়। অতপর ইসলামিয়াতের ক্লাসে মৌলভি সাহেব আল্লাহ, রসূল, কিতাব ও পরকাল আছে এবং এগুলোর প্রতি ঈমান আনতে হবে বলে শিক্ষা দেন।
একদিকে সামগ্রিকভাবে ছাত্রদের মধ্যে আল্লাহ বিমুখ দৃষ্টিভংগি সৃষ্টি করা হচ্ছে, অপরদিকে ইসলামিয়াতে ক্লাসে আল্লাহমুখী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। ছাত্রদের সামগ্রিক দৃষ্টিরভংগির সাথে ইসলামিয়াতের শিক্ষাটা পরগাছার মতোই থেকে যাচ্ছে এবং তাদের দৃষ্টিভংগির কাছে চরমভাবে মার খাচ্ছে। নিরানব্বই মণ লবণের সাথে এক মণ চিনি মিশালে সে চিনি লবণের সাথে বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য।
এভাবেই প্রবল আল্লাহ বিমুখ দৃষ্টিভংগি গড়ে তুলে তার উপর আল্লাহমুখী হালকা ধারণা পেশ করে ছাত্রদের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দেয়া হয় এবং সে দ্বন্দ্বে বেচারা পরগাছা ইসলামিয়াত চরমভাবে পরাজিত হয়। এর ফলে ইসলামের বিরোধিতায় তারা সাহসী হয়ে উঠে।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষা বা ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের কথায় আসা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব চাইতে ঘৃণীত বিভাগ সম্ভবত এটি। এ বিভাগের ছাত্র শিক্ষকরা মোল্লা মৌলবাদী খেতাবে ভূষিত। এবিভাগের ছাত্রদের কর্মপোযোগী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। এ বিষয়ে পাশ করার পর তাদের না সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয় আর না সিভিল প্রশাসনে। কোনো প্রকারে ইসলামিয়াতের শিক্ষকতা করে তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাদের সামাজিক মর্যাদাকে হেয় করে দেখা হয়। মোট কথা ধর্মীয় শিক্ষার এই লেজুড় ও পরগাছা থেকে ছাত্ররা:
ক. ইসলামকে পূর্ণাংগ জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থা হিসেবে জানতে পারেনা।
খ. ইসলামকে হানাহানি কাটাকাটির ধর্ম ও মানবতা বিরোধী বলে শিক্ষা লাভ করে।
গ. তাদের মনে ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
ঘ. ইসলামকে একটি খেল তামাশার বিষয় হিসেব গ্রহণ করে।
ঙ. এটাকে সমাজের জন্যে কল্যাণকর মনে করা হয়না।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা:
আমাদের দেশে বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষার দুটি ধারা চালু আছে। একটি হলো দারসে নেজামি পদ্ধতি। এ পদ্ধতির মূল আদর্শ দেওবন্দ মাদ্রাসা। অপরটি হলো আলীয়া পদ্ধতি। এ পদ্ধতি সূচনা হয় কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এ পদ্ধতি শ্রেণী ভিত্তিক এবং এতে আধুনিক শিক্ষার কিছুটা লেজুড় লাগানো হয়েছে। এই দুই ধারার মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে মৌলিক তফাতে খুব কমই। মূলত উভয় ধারাই মুসলিম শাসন আমলে ভারতবর্ষে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিলো, তারই শিক্ষাক্রমের অনুসারী।
মোটকথা, আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন ও জরাজীর্ণ। মুসলিম শাসনামলে এ শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো যুগ উপযোগী। তখন এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই সরবরাহ হতো রষ্ট্র নায়ক, রাষ্ট্র পরিচালনার কর্মকর্তা ও কর্মচারী। সামরিক বিভাগের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী কুটনীতিকসহ সকল শ্রেণীর দায়িত্বশীল লোক।
এরপর বৃটিশরা এলো। তারা তাদের ধাঁচের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং সেই রাষ্ট্রে কর্মচারী হবার উপযোগী লোক তৈরি করবার মতো শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে।
গোটা বৃটিশ আমলে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তার প্রচীনত্ব নিয়ে চলতে থাকে। বৃটিশরা চলে যাবার পর দেশ স্বাধীন হলো। পাকিস্তান নামের স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। অতপর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলো। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তার প্রাচীনত্ব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রাচীনত্ব নিয়েই সে এখনো ভবিষ্যত্বের পথে এগিয়ে চলেছে।
ইতিহাস এগিয়ে চলেছে। ভারতবর্ষে মুসলিম সম্রাজ্যের পতন হয়। দেশ বিভক্ত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থার বিবর্তন ঘটে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। মানুষের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভংগির মধ্যে পরিবর্তন আসে। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তার সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ও শিক্ষাক্রমকে বুকে ধারণ করে পাহাড়ের মতো অটল আবিচল হয়ে পড়ে আছে আপন স্থানে।
ফলে যুগ ও কালের যতোই পরিবর্তন হতে থাকলো ততোই এ শিক্ষা ব্যবস্থা তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে থাকলো। এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বেরুতে থাকলো, সমকালীন সমস্যাবলী ও জীবনধারার সাথে তারা সম্পর্কহীন হয়ে পড়লো। এখন এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বেরুচ্ছে, তাদের জন্যে মসজিদের ইমামতি, মাদ্রাসা ও মক্তব্যের শিক্ষকতা, ইসকুলের ধর্ম শিক্ষকের পদ অলংকরণ আর ধর্মীয় বাহাছ বিতর্কের তুফান ছুটানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিম্নোক্ত ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো দ্বারা জর্জরিত।
১. মূল শিক্ষা ব্যবস্থাটিই বহু শতাব্দীকালের প্রাচীন এবং বর্তমান কালের কার্যকারিতা বর্জিত।
২. শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি যুগের চাহিদার অনুপূরক নয়।
৩. এখানে যুগ উপযোগী রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বাণিজ্যনীতি, পররাষ্টনীতি, আইন ও বিচারনীতি, কৃষি ও কারিগরী শিক্ষা দানের কোনো ব্যবস্থা নেই। এগুলো শেখার জন্যে মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে মাদ্রাসা পাশ করার পর পুনরায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়। তাও সকল ক্ষেত্রে এবং সকলের জন্যে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়না।
৪. এখানে প্রাচীন ফিকহ শাস্ত্রের উপরই অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। স্বাধীন চিন্তা, গবেষণা ও ইজতিহাদের দরজা এখানে সম্পূর্ণ বন্ধ।
৫. এখানে কুরআনের প্রাচীন তাফসীরই পড়ানো হয়। তবুও পূর্ণাংগ কুরআন পড়ানো হয়না। কুরআনের উপর গবেষণাধর্মী পড়ালেখার কেনো ব্যবস্থা এখানে নেই।
৬. হাদীস শাস্ত্রের একই অবস্থা। হাদীসের উপর গবেষণাধর্মী পড়া লেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। হাদীস যাচাই বাছাই করার মতো যোগ্যতা অর্জন করবার কোনো সুযোগ এখানে নেই।
৭. ইসলামকে পূর্ণাংগ জীবন দর্শন ও ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা এখানে নেই। ফলে এই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ইসলামকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু করবার শিক্ষা ও কর্মপন্থা জানা যায়না।
৮. এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সিভিল সার্ভিসের জন্যে লোক তৈরি হয়না। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হবার যোগ্য লোক তৈরি হয়না। কুটনীতিক তৈরি হয়না। শিল্প ও বাণিজ্য পরিচালনার যোগ্য লোক তৈরি হয়না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ তৈরি হয়না। রাষ্ট্র নায়ক তৈরি হয়না। ফলে এখান থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বেরুচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার কী পোস্ট গুলোতে তাদের স্থান হয়না।
৯. এখান থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বেরুচ্ছে, তারা সমাজে সত্যিকারভাবে মর্যাদাবান হতে পারছেনা। ধর্মীয় কারণে কিছুটা ভক্তি শ্রদ্ধা তারা লাভ করেন বটে, কিন্তু রাষ্ট্রীয়,প্রশাসনিক ও সামাজিক পদমর্যাদা তারা অধিষ্ঠিত হতে পারছেনা। ফলে সমাজে তাদের ছোট ও হেয় হয়ে থাকতে হয়।
১০. এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে যেহেতু রাষ্ট্র ও সমাজের জন্যে দক্ষ জনশক্তি লাভ করা যায়না, সে কারণে মাদ্রাসা গুলো সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থেকেও বঞ্চিত।
১১. মাদ্রাসাগুলোতে যারা শিক্ষা দান করেন, তারাও অদক্ষ। তাদের ও কর্মহীনতার কারণে তারা ব্যাপকহারে ধর্মীয় বাহাছ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ফলে সারাদেশে ধর্মীয় কোন্দল জাল বিস্তার করে আছে।
১২. মাদ্রাসাগুলো থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বের হয়, অদক্ষতা ও কর্মহীনতা কারণে তারা ব্যাপকহারে ধর্মীয় বাহাছ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ফলে সারাদেশে ধর্মীয় কোন্দল জাল বিস্তার করে আছে।
১৩. সামগ্রিকভাবে জাতি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি হতাশ ও আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। যেহেতু ধর্মীয় পরিমন্ডলের বাইরে এখান থেকে শিক্ষা লাভকারীরা সমাজ পরিচালনা ও সমাজে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করবার যোগ্যতা অর্জন করেনা, সেজন্যে অভিভাবকরা সাধারণত তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করাননা। কেবল তিনটি কারণে মাদ্রাসায় পড়তে আসে:
ক. একান্ত ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করার কামনায়।
খ. মাদ্রাসা শিক্ষা শেষ করার পর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তী হবার নিয়্যতে।
গ. গরীব লোকরা আর্থিক অনটনের কারণে তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠায়।
এই তিনটি কারণে যারা মাদ্রাসায় পড়তে আসে তাদের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। ছাত্রের অভাবে বহু মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। টিকে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে বহু মাদ্রাসাকে ছাত্র সংখ্যা যা নয়, তার চাইতে বাড়িয়ে দেখাতে হচ্ছে।
এথেকেই বুঝা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি সামগ্রিকভাবে অনাস্থা কতো প্রবল এবং এ শিক্ষা ব্যবস্থা কতোটা সেকেলে এবং অকেজো হয়ৈ পড়েছে।
মেরামত করে কাজ হবেনা।
আধুনিক বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা এবং প্রাচীন মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার এইসব দুর্গতি দেখে বিভিন্ন সময় এগুলোকে মেরামত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। পাকিস্তান আমল পর্যন্ত মাদ্রাসাগুলোতে উর্দূ মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হতো। বাংলাদেশ আমলে আলীয়া পদ্ধতিতে বাংলা মাধ্যম চালু করা হয়েছে। দারসে নিযামি পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে এখনো সংস্কার করেনি। বিভিন্ন সময় আলীয়া পদ্ধতি বাংলা, ইংরেজি, অংক, সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় এবং কোথাও কোথাও কিছু কিছু শ্রেণীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কিছু কিছু বিষয় চালু করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক কাঠামোর সাথে এগুলো খুব একটা খাপ খায়নি। ফলে এসব মেরামত/সংস্কার দ্বারা মূল অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায়ও বিভিন্ন সময় সংস্কার মেরামত করার চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষাক্রমের উন্নতি সাধন করার চেষ্টা করা হয়েছে। নতুন ধরনের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রকার সংস্কার প্রস্তাব আনা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন নতুন বিষয় ও বিভাগ চালু করা হয়েছে। কিন্তু বৃটিশদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভাবধারায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি।
প্রয়োজন আমূল পরিবর্তনের
আসলে এ ধরনের আংশিক মেরামত, সংস্কার, সংশোধন ও সংযোজন দ্বারা ফল হবেনা। প্রয়োজন আমূল পরিবর্তনের।
বাংলাদেশের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। নিজেদের রাষ্ট্র পরিচালনা, রাষ্ট্রের উন্নয়ন, জাতির কল্যাণ ও আত্ম নির্ভরশীলতা অর্জনের দায় দায়িত্ব নিজেদের উপর। নিজেদের জাতিকে উন্নত করে গড়ে তোলা এবং বিশ্বের দরবারে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব নিজেদের।
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। এখানকার শতকরা পঁচাশিভাব নাগরিক মুসলাম। এখানকার মানুষ অত্যন্ত ইসলাম প্রিয়, আল্লাহভক্ত ও ধর্মভীরু।
অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ পিছে পড়ে আছে। জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের সম্পদ কম। আমাদের জনশক্তিকে সম্পদে পরিণত করার মধ্যেই আমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
মুসলিম হিসেবে আমাদের আছে গৌরবান্বিত ইতিহাস। আছে মহান ঐতিহ্য। এক উন্নত অনুপম ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধিকারী জাতি আমরা। আমাদের আছে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা।
আমাদের কাছে আছে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন দর্শন ও জীবন বিধান। আমাদের জীবন দর্শন ও জীবন বিধান সম্পূর্ণ নির্ভুল। পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির কাছে নির্ভুল জীবন বিধান নেই।
সারা বিশ্বে আমাদের সোয়াশো কোটি মুসলমান ভাই আছে। তারা আমাদের অংশ। তারা আমাদের সাহায্যকারী ও সহযোগী।
এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে আমাদের দেশে চালু করতে হবে নতুন এক শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রণয়ন করতে হবে নতুন শিক্ষানীতি, নতুন কারিকুলাম, পাঠ্যসূচি, পাঠ্যতালিকা। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় উপরোক্ত ভাবধারাগুলো গতিশীল থাকতে হবে নদীর স্রোতধারার মতো।
এই নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা হবে এমন শিক্ষা ব্যবস্থা, যে শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের একটি আদর্শ ও সুসংহত জাতিতে পরিণত করবে। আমাদের জাতিকে প্রকৃত মুসলিম উম্মাহ হিসেবে গড়ে তুলবে। আমাদের জীবনকে সামগ্রিক উন্নতির শিখরে আরোহণ করাবে। স্বাধীন মর্যাদাবান জাতি হিসেবে টিকে থাকতে শিখাবে। আমাদেরকে পরকালের মুক্তির পথে পরিচালিত করবে। দক্ষতার সাথে দেশ ও জাতিকে পরিচালনার যোগ্যতা দান করবে।
0 comments: