অধ্যায় ০৪ : মুসলিম শাসনামলে উপমহাদেশের ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা

১. আভাস
৬২২ ঈসায়ী সালে মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার সূচনা সেখানে থেকেই। মসজিদে নববী ইসলামের প্রথম শিক্ষায়তন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম শিক্ষক। সাহাবায়ে কিরাম প্রথম ছাত্রসমাজ।এখান থেকেই সম্মুখে অগ্রসর হয় উম্মতে মুহাম্মাদীর শিক্ষার ইতিহাস।
অতপর ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হতে থাকে। সাহাবায়ে কিরাম এবং তাঁদের উত্তরসূরীরা পৃথিবীতে লাঞ্চিত ও বঞ্চিত মানবতার দুয়ারে দুয়ারে বয়ে নিয়ে যান ইসলামের সুমহান শিক্ষা। যেখানেই তাঁরা গিয়েছেন, সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষ গড়ার কেন্দ্র। সেখানেই প্রজ্জ্বলিত হয়েছে জ্ঞানের আলো। এক নতুন সভ্যতা সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে প্রাণ চাঞ্চল্য।
ইসলামের এ সুমহান সভ্যতা সংস্কৃতির জোয়ারেই প্লাবিত হয়েছিল তেত্রিশ কোটি দেবতার দেশ হিন্দুস্তান। ব্যাপকভাবে এসেছেন এখানে ইসলামের পাতাকাবাহীরা। তাঁরা এসেছেন আরব, ইরান ও আফগানিস্তান থেকে। তাঁরা এসেছেন কখনো বীরের বেশে, কখনো দরবেশের বেশে। তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন এদেশের প্রতিটি অঞ্চলে, গ্রামে গঞ্জে বন্দরে। ব্যক্তিগত ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁরা এদেশে গড়ে তুলেছিলেন হাজারো শিক্ষাকেন্দ্র। সেসব শিক্ষাকেন্দ্র থেকে তৈরি হয়েছেন অসংখ্যা শাসক ও কর্মচারী, সৈনিক ও সেনাপতি, ফকীহ ও আলেমে দীন এবং মুফাসসির ও মুহাদ্দিস। মোটকথা, একটা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার দক্ষ লোকই সে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে তৈরি হয়েছিল।
২..উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমন ও শাসন.
খেলাফায়ে রাশেদীনের আমল থেকেই এদেশে ইসলাম প্রচারকগণ আসতে থাকেন। পরবির্তীকালে হাজারো মুবাল্লিগ এদশে এসে ইসলাম প্রচার করেন। এমনকি মুসলমান আরব ব্যবসায়ীরাও এদেশে ইসলাম প্রচার করেন। এদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এদেশের অসংখ্যা মানুষ ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। বিরাট বিরাট এলাকা ইসলামের ভূমিতে পরিণত হয়। কিন্তু মুসলামানগণ এদেশের শাসন ক্ষমতা লাভ করেন সামরিক অভিযানের মাধ্যমে। উমাইয়া খলীফা ওলীদ ইবনে আবদুল মালেকের শাসনামলে [৭০৫-৭১৫ খৃ:] সেনাপতি ইমাদ উদ্দীন মুহাম্মাদ বিন কাসেম সাকাফি সর্বপ্রথম [৭১২-৭১৩ খৃ:] ভারত উপমহাদেশের সিন্ধু ও মুলতান এলাকা মুসলিম শাসনাধীন করেন। অতপর গযনীর সুলতান সবুকতগীন [৯৭৭-৯৯৭ খৃ:] এবং তার পুত্র সুলতান আবুল কাসেম মাহমুদ [৯৯৮-১০৩০ খৃ:] পূর্বদিকে সিন্ধু নদের তীর পর্যন্ত গযনীর ইসলামী রাজ্যকে বিস্তৃতি করেন। এরপরে বিভিন্ন সময় নানা উপায়ে বিভিন্ন মুসলিম ব্যক্তি ও বংশ এদেশের শাসন ক্ষমতা লাভ করেন এবং ধীরে ধীরে তাঁরা গোটা ভারতবর্ষে সর্বশেষ শাসক ছিলেন মুগল বংশের সম্রাটগণ। তাঁদের শাসন যুগের শেষদিকে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে সর্বপ্রথম ইংরেজরা বাংলাদেশ দখল করে মুগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে তাদের আশ্রয়ে বৃত্তিভোগী শাসকে পরিণত করে। সর্বশেষ ইংরেজ বৃত্তিভোগী মুগল সম্রাট বাহাদুর শাহের [১৮৩০-১৮৫৭ খৃ:] আমলে সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ায় এবং বিপ্লবীগণ কর্তৃক তাকে ভারত সম্রাট ঘোষণা করায় ইংরেজরা তাকেঁ রেংগুনে নির্বাসিত করে এবং তাঁর সন্তানদের দিল্লীর রাজপথে গুলী করে হত্যা করে। এদেশে ইংরেজদের হাতে এভাবে মুসলমানদের ক্ষমতা নি:শেষ হয়ে যায়। গোটা মুসলিম ভারত করায়ত্ব করতে তাদের একশত বছর সময় লাগে।
৩. উপমহাদেশে মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন
কয়েক শতাব্দীকালের এ দীর্ঘ শাসনামলে এদশে মুসলামানদের সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো দক্ষ ও আদর্শ মানুষ গড়ার কারখানা। মুসলামানরা এদেশে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে শিক্ষার ক্ষেত্রে এক সুদূর প্রসারী বিপ্লব সাধন করেন। ১৮৮২ সালে ইংরেজদের এক শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে বলা হয় :
আর সব মুসলিম দেশের মতই ভারতবর্ষে মুসলমানদের অনুপ্রবেশের পর তারা তাদের মসজিদগুলোকে শিক্ষাকেন্দ্রের জন্য সরকারকে তেমন ব্যয়ভার বহন করতে হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়াকফ ও উইলের সম্পত্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। দীনদার লোকেরা পারলৌকিক পূণ্য লাভের জন্য ওয়াকফ এবং সম্পত্তি প্রদানের অসিয়ত করে যান। পাক ভারতীয় মসজিদ কেন্দ্রিক মাদ্রাসার এ অবস্থা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল পর্যন্ত বলবত থাকে।
উপমহাদেশে মুসলমানদেরে শিক্ষা কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠার একটা চিত্র এ রিপোর্ট থেকে পাওয়া যায়। তবে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে এদেশে সর্বপ্রথম কখন এবং কোথায় মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয় সেকথা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। অবশ্য ইতিহাস গ্রন্থাবলী প্রতিষ্ঠিত হয় সেকথা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। অবশ্য ইতিহাসে গ্রন্থাবলী থেকে এতটুকু জানা যায় যে, আবুল কাসেম মাহমুদের শাসনামলে থেকে এদেশে মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থার পত্তন হয়।
প্রফেসর সাইয়েদ মুহাম্মাদ সলীম লিখেছেন :
৫৮৯ হিজরী মোতাবেক ১১৯২ খৃষ্টাব্দে হিন্দুস্তানে মুয়েযুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে সাম [শিহাবুদ্দীন গোরী নামে খ্যাত] কর্তৃক ইসলামী হুকুমাতে কায়েম হয়। তার শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার সাথে সাথে রাজ্যের চতুর্দিকে শিক্ষা দীক্ষার চর্চা ছড়িয়ে পড়ে। এ জ্ঞানপ্রিয় বাদশাহ সর্ব প্রথম দিল্লীতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বাদশার নাম অনুযায়ী এ মাদ্রাসার নামকরণ হয়, মাদ্রাসায়ে মুয়েযীয়া। পরবর্তী বাদশাহ কুতুবদ্দীন আইবেক [১২০৬-১২১২ খৃ:] আজমীরে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদ্রাসাকে আড়াই দিনের ঝুপড়ি বলা হতো। তৃতীয় মাদ্রাসাটি মুলতান ও উচের শাসনকর্তা নাসীরুদ্দীন কুবাচা উচে প্রতিষ্ঠা করেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক কাযি মিহনাজুদ্দীন সিরাজ জুরজানি [মৃত্যু ১২৬০ খৃ:] সর্ব প্রথম উচ্চ মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োজিত হন। পরে তিনি মাদ্রাসার মুয়েযীয়ার প্রধান শিক্ষক হিসেবে বদলি হন।
অতপর মুসলিম শাসক, আলেম, আমীর ও বিদ্যোসাহী দীনদার লোকদের প্রচেষ্টায় গোটা ভারববর্ষে আনাচে কানাচে মকতব মাদ্রাসা তথা ইসলাশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। জনৈক ঐতিহাসিকের ভাষ্য অনুযায়ী।
সুলতান মুহাম্মাদ বিন তুগলকের [১৩৫২-১৩৫৯ খৃ:] আমলে দিল্লীতে এক হাজার মাদ্রাসা ছিলো। এর মধ্যো শাফেয়ি মাযহাবের লোকদের একটা মাদ্রাসা ছিলো। শিক্ষকদের সরকারি কোষাগার থেকে ভাতা প্রদান করা হতো। মাদ্রাসাগুলোতে দীনি শিক্ষার সাথে সাথে অংক এবং দর্শন শাস্ত্রের শিক্ষাও দয়ো হতো।
রোহিলা খন্ডের হাফেযুল মুলক নওয়াব রহমত আলী খানের [মৃত্যু ১৭৪৪ খৃ:] জীবন চরিত থেকে জানা যায় :
দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হয়ে পড়ার পরও কেবলমাত্র রোহিলা খন্ড জেলার বিভিন্ন মাদ্রাসার পাঁচ হাজার আলিম শিক্ষাদান কার্যে নিয়োজিত ছিলেন। হাফেযুল মুলক নওয়াব রহমত আলী খানের কোষাগার থেকে তারা নিয়মিত ভাতা পেতেন।
এস, বসুর এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থ থেকে জানা যায়:
ইংরেজ শাসনের পূর্বে কেবলমাত্র বাংলাদেশই আশি হাজার মকতব ছিলো। [ম্যাকস মুলারের শিক্ষা রিপোর্ট]
৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে গড়ে উঠেছিল :
মুসলিম শাসনামলে এদেশে বিভিন্ন সময় নানা প্রকার বিছিন্ন প্রচেষ্টায় মকতব ও মাদ্রাসা গড়ে ওঠে।
১. কখনো ধনী প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কল্যাণধর্মী কাজ হিসেবে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতেন এবং খরচ বহনের জন্যে মাদ্রাসার নামে সম্পত্তি ওয়াকফ দিতেন। এ সম্পত্তি থেকেই শিক্ষক ও ছাত্রদের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ হতো। ছাত্রদের শিক্ষা ও জীবিকার যাবতীয় ব্যয় মাদ্রাসা থেকেই বহন করা হতো।
২. অনেক সময় কোনো আলিম ব্যক্তগত প্রচেষ্টায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতেন এবং যাবতীয় ব্যয়ভার নিজেই বহন করতেন। তিনি নিজেই শিক্ষক নিয়োগ করতেন ছাত্রদের শিক্ষা ও খাবার ব্যয় নির্বাহ করতেন।
৩. কখনো কোনো ধনী ব্যক্তি নিজ সন্তানদের শিক্ষার জন্যে শিক্ষক নিয়োগ করতেন। ঐ শিক্ষককে কেন্দ্র করে ছাত্র সংখ্যা বাড়াতে মাদ্রাসা আকার ধারণ করতে করতো। শিক্ষক নিয়োগকারী নিজেই যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করতেন।
৪. কখনো আবার যোগ্য আলিমকে কেন্দ্র করে জ্ঞানপিপাসু ছাত্ররা তাঁর পাশে জড়ো হতো। লেখাপড়া চলতো মসজিদে। ছাত্ররা লিজং থাকতো এবং শিক্ষকগণ থাকতেন মসজিদে হুজরায়।
৫. কোনো কোনো সময় শাসকগণ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতেন এবং তারাই এর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
এমনিভাবে অসংগঠিত ও বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় অসংখ্যা মকতব মাদ্রসা গড়ে উঠেছিল। এটা ছিলো শিক্ষার প্রতি মুসলমানদের নজীরবিহীন আগ্রহের ফল।
৫. মাদ্রসা গৃহ:
মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর কয়েক শতাব্দী যাবত মসজিদই মুসলামানদের শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ভারতবর্ষে মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যে প্রথম স্বতন্ত্র গৃহ কখন এবং কোথায় নির্মিত হয়েছিল সে ইতিহাস সুনির্দিষ্টভাবে খুঁজে বের করা বড় মুশিকল। তবে যতোটুকু জানা যায়, এদেশে মুসলামানদের চার প্রকার শিক্ষা কেন্দ্র ছিলো:মসজিদ,মাদ্রসা ও মকতবের স্বতন্ত্র গৃহ,কোনো আমীর বা ধনী ব্যক্তির বসতবাটির অংশ বিশেষ এবংকোনো গাছের নিচে।
৬. মাদ্রাসার আসবাবপত্র:
প্রফেসর সাইয়েদ মুহাম্মাদ সলীম তাঁর হিন্দ ও পাকিস্তান মে মুসলমানুকা নিযামে তালীম ও তারবিয়াত গ্রন্থে মুসলিম শাসনামলে এদেশে মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের আসবাবপত্র সম্পর্কে লিখেছেন:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হতো খুবই সংক্ষিপ্ত আকারের। বালকদের বসার জন্যে থাকতো চাটাইয়ের বিছানা; কিতাবপত্র রাখার জন্যে ভূমি থেকে অল্প উঁচু কাষ্ঠখন্ড; শিক্ষকের বসার জন্যে গদীর আসন। এ ছাড়া পাঠ্য পুস্তকাদি এবং সামান্য কাষ্ঠ সামগ্রীর সমন্বয়ে গঠিত হতো গোটা প্রতিষ্ঠান। টেবিল চেয়ার তো সে সময় নবাবদের বাড়ীতেও পাওয়া যেতোনা। ইংরেজদের বিজয়ের পরই এসবের প্রচলন শুরু হয়। অপ্রয়োজনীয় কোনো আসবাবপত্র মাদ্রাসায় থাকতোনা। অতিশয় মিতব্যয়ীতা ও সাদাসিধে ভাবে কর্ম সম্পাদন করা হতো। এ কারণে মাদ্রসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালানা খুবই সহজ ছিলো।
. শিক্ষার কাঠামো
মুসলিম শাসনামলে এদেশে শিক্ষা বিভাগ নামে স্বতন্ত্র বিভাগ ছিলোনা। পাঠ্য বিষয় এবং পাঠ্যসূচি প্রণয়নেও সরকারের কোন হাত ছিলোনা। উলামায়ে কিরাম এবং শিক্ষকগণই ঠিক করতেন কি পড়াবেন। তাই সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সুনির্দিষ্ট কোনো শিক্ষানীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হতোনা। তবে শেষ পর্যন্ত নিন্মরূপ একটি বুনয়াদি কাঠামো গড়ে ওঠে।
১. মকতব: এতে কুরআন পাঠ ও ফার্সি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা হতো।
২. ফার্সি মাদ্রাসা: মূলত আরবি মাদ্রসাগুলোই ছিলো উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র। এতে আরবি ভাষা ও দীনি ইলমের উচ্চ শিক্ষা প্রদান করা হতো।
. ভর্তি
মকতব এবং ফার্সি মাদ্রাসাসমূহে ভর্তির ব্যাপারে তেমন কোন নিয়মনীতি পালন করা হতোনা। যখনই কেউ লেখা পড়া করতে আসতো তাকে পাঠে শরীক করে নেয়া হতো। আরবি মাদ্রসাআগুলোতে অবশ্য ভর্তির সময় ছিলো শাওয়াল মাস। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে একমাস পরেও ভর্তি করা হতো।
৯. ভর্তির বয়স
জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলামানের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। এ ব্যাপারে বয়সের কোন প্রশ্ন ওঠেনা। যখনই কোনো ব্যক্তির বোধদয় হতো তখনই সে জ্ঞানার্জনে আত্মনিয়োগ করতে পারতো। মাদ্রসাগুলো তাকে সহযোগিতা করতো। বয়সের ভিত্তিতে কোনো তারতম্য করা হতোনা। কেউ কেউ অধিক বয়সে জ্ঞানার্জনে আত্মনিয়োগ করতেন। সাধারণভাবে মাদ্রসাগুলোতে বালকদের সাথে বয়স্কদেরও দেখা যেতো।
১০. শ্রেণী বিন্যাস
সে সময় মাদ্রাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোতের শ্রেণী বিন্যাস পন্থা ছিলোনা। শিক্ষার কাল বছর দ্বারা গণনা না করে পাঠ্য পুস্তক দ্বারা করা হতো। বলা হতো এ ছাত্র অমুক অমুক কিতাব পড়েছে, বা অমুক কিতাব পড়া বাকি আছে। প্রত্যেক ছাত্রকে পৃথক পৃথক (পাঠ দেয়া হতো)। প্রত্যেকদের প্রতিস্বতন্ত্রভাবে দৃষ্টি রাখা হতো। কেউ কেউ দ্রুত কিতাব শেষ করতে পারতো। আবার কেউ কেউ দীর্ঘদিন একই কিতাব নিয়ে পড়ে থাকতো। সকল ছাত্র একত্রে বসে তাদের পাঠ মুখস্থ করতো।
১১. শিশু শিক্ষার সূচনাকাল
শিক্ষিত মুসলিম পরিবারসমূহে প্রাচীনকাল থেকে এ প্রথা চলে আসছিল যে, তাদের সন্তানরা যখন চার বছর চার মাস চারদিন বয়সে উপনীত হতো, তখন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের শিক্ষাদান শুরু হতো। এ অনুষ্ঠানকে বিসমিল্লাহর অনুষ্ঠান বলা হতো। এটা একটা উৎসব অনুষ্ঠানে পরিণত হতো। অভিভাবকগণ তাদের বন্ধু বান্ধবদের এ অনুষ্ঠানে দাওয়াত করতেন। সন্তানে পরিণত হতো। তিনি রাব্বি ইয়াসসির ওলঅ তু আসসির ওয়া তামমিম বিল খায়ির, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়িয়ে অতপর সূরা আলাকের প্রথমিক কয়েকটি আয়াত এবং সূরা ফাতিহা পড়িয়ে দিতেন। শিশু এ পাঠ আওড়াতে থাকতো। উপস্থিত সকলের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হতো। অভিভাবকের সামর্থনুযায়ী অনুষ্ঠানে শিক্ষকগণ ইনাম পেতেন।
‌১২. শিক্ষার সময়সূচি
মকতব ও মাদ্রসাগুলোতে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শিক্ষাদান কাজ আরম্ভ হয়ে বেলা প্রায় ১১টা পর্যন্ত তা অব্যাহতভাবে চলতো। অবশ্য আরবি মাদ্রাসাগুলো আসর পর্যন্ত চলতো। মাঝখানে যোহেরের নামায ও খাবারের বিরতি হতো। কোনো কোনো শিক্ষক চূড়ান্ত পর্যায়ের ছাত্রদের এশা ও তাহাজ্জুদের পরও পড়াতেন। পড়া লেখার যাবতীয় কাজ মাদ্রসাতেই সম্পন্ন করা হতো।
১৩. সাপ্তাহিক ছুটি
শুক্রবার ছিলো সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বৃহস্পতিবারে অর্ধদিবস পর্যন্ত মাদ্রাসা খোলা থাকতো। এ সময়টাও মসজিদ বা মাদ্রাসার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যয় হতো। কোনো কোনো আরবি মাদ্রসার মঙ্গলবারে পাঠদান হতোনা। সেদিন ছাত্ররা পাঠ্যপুস্তকের কটি তৈরি করতো। শিক্ষকগণ গ্রন্থ রচনার কাজ করতেন।
১৪. বার্ষিক ছুটি
মুসলিম শাসনামলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় সারা বছরই পড়ালেখা চলতো। ছুটি থাকতো খুবই কম। বার্ষিক ছুটি মোটামুটি নিম্নরূপ ছিলো:
১. ঈদুল ফিতর ২দিন
২. ঈদুল আযহা ৫দিন
৩. মুহাররম ৬দিন [বাংলাদেশে]
৪. সফর মাসের শেষ বুধবার ১দিন [বাংলাদেশে]
৫. শবে বরাত ১দিন
মোট ১৫দিন।
১৫. খেলাধূলা
বর্তমান যুগের মতো তখন খেলাধুলার প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হতোনা। খেলাধুলায় সময় অপচয় করতে নিষেধ করা হতো। মাদ্রাসাগুলোতে খেলাধূলার ব্যাপক ব্যবস্থা ছিলোনা। অবশ্য কোথাও কোথাও ছাত্র শিক্ষক সকলে মিলে ব্যায়াম করতেন। কোথাও কোথাও যুদ্ধ বিদ্যার প্রশিক্ষণ হতো। ইমাম গাযালি প্রমুখ শিশুদের জন্যে খেলাধূলা অপরিহার্য মনে করতেন।
১৬. শাস্তি
শিষ্টাচার বা আদব শিক্ষাদানের জন্যে সে যুগে শাস্তি বা দন্ড প্রদানকে শিক্ষার অপরিহার্য অংগ মনে করা হতো। এ ক্ষেত্রে ছোট ছোট ব্যাপারেও ছাত্রদের শাস্তি দেয়া হতো। ভর্তির সময় অভিভাবকগণ বলে যেতেন: হাড় আমাদের শরীর আর চামড়া আপনাদের। কোনো কোনো শিক্ষক দন্ডদানে বিশেষভাবে খ্যাতিমান হয়ে উঠতেন। বেয়াড়া এবং পলাতক ছাত্রদের খুঁজে বের করে পিটাতে পিটাতে মাদ্রাসার আনা হতো। শিক্ষাকে তখন কোন ঐচ্ছিক ব্যাপার মনে করা হতোনা। বরং শিক্ষা ছিলো আবশ্যিক ও বাধ্যতামূলক। তাই লেখা পড়ায় ছাত্রদের সামান্যতম অলসতাও কঠোর দৃষ্টিতে দেখা হতো।
১৭. খাদ্য
মাদ্রাসায় খানা পাকানোর ব্যবস্থা ছিলোনা। এলাকাবাসীরাই ছাত্রদের খাবারের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। ছাত্ররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসতো অথবা মাদ্রাসায় এনে ছাত্র শিক্ষক সকলে মিলে একত্রে খাবার খেতো।
১৮. থাকা
স্থানীয় ছাত্রদের বলা হতো মুকীম। দূরাগত ছাত্রদের বলা হতো মুসাফির। মুসাফির ছাত্ররা মাদ্রাসা কক্ষে কিংবা মসজিদের হুজরায় থাকতো। চাটাইয়ের উপর শুয়ে পড়তো। লজিং থাকার প্রথাও ছিলো।
১৯. শিক্ষা সমাপন
মেধাবী ছাত্ররা ১৪/১৫ বছর বয়সেই ফার্সি ও আরবি মাদ্রাসার শিক্ষা সমাপন করতো। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবি পনের বছর বয়সে শিক্ষা সমাপন করেন। যাদের মেধাশক্তি কম ছিলো, শিক্ষা সমাপন করতে তাদের আরো কয়েক বছর বেশি সময় লাগতো।
২০. সমাবর্তন
সকল ফার্সি ও আরবি মাদ্রাসার শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠান করা হতো। এতে বড় বড় আলিমদের দাওয়াত দেয়া হতো। সেখানে ফাতিহা পাঠ করে শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্রদের জন্যে দোয়া করা হতো। অতপর কোনো একজন বুযর্গ তাদেরকে উপাধিতে ভূষিত করতেন। এ সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে ফাতিহা ফেরাগ বলা হতো।
২১. উপাধি
সে আমলে ফার্সি মাদ্রাসা সমাপনকারীকে মুন্সি এবং আরবি মাদ্রাসা সমাপনকারীকে আলিম খেতাব দেয়া হতো। মুগল আমলের পূর্বে চূড়ান্ত ইলম হাসিলকারীকে দানিশ মন্দ বলা হতো। মাওলানা গোলাম আলী আযাদের [মৃত্যু ১৭৮৫খৃ:] যামানায় দানিশ মন্দের পরিবর্তে মৌলভী খেতাব চালু হয়। ফার্সি মাদ্রাসা থেকে পাশ করার পর ছাত্ররা সরকারি চাকুরীর উপযুক্ত বিবেচিত হতো।
২২. শিক্ষক
ফার্সি মাদ্রাসা শিক্ষকদের মিয়াজি আখন্দজি কিংবা মোল্লাজি বলা হতো। আরবি মাদ্রাসা শিক্ষকদের বলা হতো মৌলভি কিংবা মোল্লা সাহেব।
২৩. সর্দার পড়ুয়া
মুসলিম শাসনামলে নামকরা আলিমদের শিক্ষাকেন্দ্রে এ প্রথা ছিলো যে, তারা কোনো উপযুক্ত মেধাবী ছাত্রকে সর্দার পড়ুয়া নিয়োগ করতেন। উস্তাদ যা পড়িয়ে যেতেন সে তার পুণরালোচনা ও ব্যাখ্যা করতো। এরূপ ছাত্রকে মূয়ীদ বা মনসবদার বলা হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাকালে
২৪. পাঠ্য বিষয়
আগেই বলেছি, শিক্ষা বিভাগ বলে সরকারের তখন কোনো বিভাগ ছিলোনা। শিক্ষানীতি ও শিক্ষার বিষয় প্রণয়েনে সরকারের কোন হাত ছিলোনা। বড় বড় আলিম ও শিক্ষকগণই এ দায়িত্ব পালন করতেন। শিক্ষানীতি, পাঠ বিষয়, পাঠ্য তালিকা তারাই প্রণয়ন করতেন। শিক্ষানীতি প্রণয়নে সরকারি হস্তক্ষেপ তো দূরের কথা বরং বহু শাসক ও সুলতানদের প্রশাসনেই আলিমদের বিরাট প্রভাব ছিলো।
২৫. পাঠ্য তালিকা : মকতব
১. সর্বপ্রথম কায়দায়ে বাগদাদি পড়ানো হতো।
২. অতপর কুরআন শরীফের ৩০তম পারা (আমপারা) পড়ানো হতো।
৩. আমপারা শেষ হবার পর গোটা কুরআন মজীদ খতম করানো হতো। কুরআন মজীদ খতম করার আগে অন্য কোন কিতাব পড়ানো হতোনা।
৪. কুরআন মজীদ খতমের পর কারিমা প্রভৃতি চরিত্র গঠনমূলক ফার্সি বই পড়ানো হতো।
৫. অযু এবং নামায শিখানো হতো। সকল ছাত্রকেই (আসর) নামাযের জামায়াতে শরীক হতে হতো।
২৬. শিক্ষাদান পদ্ধতি : মকতব
১. শিক্ষক ছাত্র সকলেই বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলে পাঠ আরম্ভ করতেন।
২. ছাত্ররা বিছানায় উস্তাদের সম্মুখে আদবের সাথে হাঁটু পেতে বসতো।
৩. ছাত্রদের প্রথমে বিগত পাঠ শুনাতে হতো। তা শুনাতে পারলেই নতুন সবক (পাঠ) দেয়া হতো।
৪. বৃহস্পতিবারে নতুন করে সবক দেয়া হতোনা। সেদিন বিগত সাত দিনের পড়া শিক্ষক শুনতেন।
শিশুরা সাধারণ সাত/আট বছর বয়সেই কুরআন পড়ে শেষ করতো। পূর্ণ কুরআন খতম করার পূর্বে কোনো ছাত্রই অন্য কোন শিক্ষা আরম্ভ করতে পারতোনা।
২৭. পাঠ্য বিষয়: ফার্সি মাদ্রসা
সুলতান মাহমুদ গযনভীর শাসনকাল থেকে নিয়ে কোম্পানির শাসনকাল পর্যন্ত (১০৩০-১৮৩৫খৃ:) ফার্সি ছিলো এদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা। সে জন্যে এদেশে ব্যাপক হারে ফার্সি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব মাদ্রাসার হিন্দু ছাত্ররাও পড়তো। ফার্সি ভাষা ছাড়াও জাগতিক জ্ঞান বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষাও দেয়া হতো। এসব প্রতিষ্ঠানের পাঠ্য বিষয় ছিলো মোটামুটি নিম্নরূপ:
১. ফিকাহ
২. আখলাক: এতে সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকও অন্তর্ভূক্ত হতো। যেমন : নীতিশাস্ত্র, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, পৌরনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি।
৩. ইতিহাস: ইতিহাসের সাথে কিসসা কাহিনীও পড়ানো হতো।
৪. ভাষা ও সাহিত্য: এতে ফার্সি গদ্য ও পদ্য পড়ানো হতো।
৫. পত্র: এর দ্বারা চিঠিপত্র ও দরখাস্ত দস্তাবিজ ইত্যাদি লেখা শিখানো হতো।
৬. গণিত: এতে ব্যবসা বাণিজ্য ও হিসাব শাস্ত্রের যাবতীয় জ্ঞানদান করা হতো।
৭. খোশ নবিশি (সুলেখা)
ফার্সি মাদ্রাসায় শিক্ষার মেয়াদ কতো বছর ছিলো তা বিস্তারিতভাবে কিছু জানা যায়না। নবাব মিরযা দাগের (১২৪৭-১৩২৫ হি:) একটা পত্র থেকে জানা যায়, তিনি তিন বছরে ফার্সি মাদ্রাসার পড়ালেখা শেষ করেন।
২৮.শিক্ষাদান পদ্ধতি: ফার্সি মাদ্রাসা
১. কুরআন মজীদ খতম হবার পর পরই ফার্সি ভাষা শিক্ষাদান শুরু হতো।
২. মুখস্ত করার প্রতি জোর দেয়া হতো।
৩. ছাত্ররা শুনে এবং পড়ে পাঠ মুখস্ত করতো।
৪. প্রত্যেক ছাত্রকে পৃথকভাবে পাঠদান হতো। শিক্ষক প্রত্যেক ছাত্রের প্রতি দৃষ্টি রাখতেন।
৫. তৃতীয় পহর সুলেখা এবং অংকের জন্যে নির্দিষ্ট থাকতো।
৬. সাধারণত বুধবারের নতুন কিতাবের সবক দেয়া হতো।
২৯. পাঠ্য বিষয়: আরবি মাদ্রাসা
মুসলিম শাসনামলে এদেশে আরবি মাদ্রাসাগুলোই ছিলো উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে কুরআন, হাদীস এবং ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন দিক সম্পর্ক আরবি ভাষায় উচ্চ শিক্ষা প্রদান করা হতো। আরবি মাদ্রাসাগুলোতে পাঠ্যগ্রন্থ নির্বাচনে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা হতো। কুরআন, হাদীস, ফিকহ ইত্যাদি বিষয়ে যথযথ জ্ঞানের উপযুক্ত গ্রন্থাবলী পাঠ্য তালিকাভূক্ত করা হতো। শেষ পর্যায়ে দর্শন শাস্ত্রের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা হতো। পাঠ্য গ্রন্থবলী পরিবর্তন করা হতো খুব কমই। মুসলিম শাসনামলে বিভিন্ন সময় আরবি মাদ্রাসাগুলোতে মোটামুটি নিম্নরূপ পাঠ্য বিষয় চালু ছিলো:
১. ইলমে সরফ,
২. ইলমে নাহূ,
৩. উসূলে ফিকাহ,
৪. ফিকহ,
৫. তাফসীর,
৬. হাদীস,
৭. ইলমে কালাম,
৮. মানতিক, ফালসাফা (দর্শনশাস্ত্র)
৯. তাসাউফ,
১০. আরবি সাহিত্য (গদ্য ও পদ্য)
৩০. শিক্ষাদান পদ্ধতি: আরবি মাদ্রাসা
পাঠ্য গ্রন্থাবলী গুরুত্ব ও আকারের প্রেক্ষিতে সেগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করে পাড়ানো হতো।
১. সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি: এ পর্যায়ে শিক্ষক বক্তৃতার মাধ্যমে গ্রন্থের উদ্দেশ্য ও মূল বক্তব্য বুঝাতেন। এ পদ্ধতি আধুনিক কালের Lecture method এর অনুরূপ।
২. মধ্যম পদ্ধতি : এ পর্যায়ে ব্যাকরণ, অলংকার শাস্ত্র প্রভৃতিও আলোচনার অন্তর্ভূক্ত ছিলো। ছাত্রদের প্রশ্নের জবাব দেয়া হতো। সন্দেহ সংশয়ের নিরসন করা হতো এবং সুক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ ও যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে মূল বক্তব্য বুঝিয়ে দেয়া হতো। এটা ছিলো সুক্ষ্ম INTENSIVE অধ্যয়ন পদ্ধতি।
৩. ব্যাপক আলোচনা পদ্ধতি: এ পর্যায়ে উপরোক্ত দুপ্রকারের আলোচনা ছাড়াও ব্যাপক ব্যাখ্যা এবং উপমা উদাহরণের মাধ্যমে ছাত্রদের জ্ঞানের দিগন্ত প্রসারিত করার চেষ্টা করা হতো। এটা ছিলো ব্যাপক (EXTENSIVE) অধ্যয়ন পদ্ধতি।
৩১. দারসে নিযামি মাদ্রাসা
মোল্লা কুতুবুদ্দীন নামে একজন বিখ্যাত আলিম মাদ্রাসাসমূহের তৎকালীন সিলেবাস সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে একটা নতুন সিলেবাস তৈরী করে যান। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র মোল্লা নিযামুদ্দীন {মৃত্যু ১৭৪৭ খৃ:} পিতার পদ্ধতিতে আরো অধিক চিন্তা ভাবনা করে প্রত্যেক বিষয়ে দুদুটি কিতাব নির্বাচন করে নতুন সিলেবাস চালু করেন। তার নাম অনুযায়ী এ সিলেবাসের মাদ্রাসাগুলো দারসে নিযামি মাদ্রাসা নামে অভিহিত ছিলো।
৩২. নারী শিক্ষা
মুসলিম শাসনামলে নারী শিক্ষার প্রতি খুবই গুরুত্বারোপ করা হতো। মুসলমানগণ ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের কন্যা সন্তানদের পড়া লেখা করাতেন। মেয়েরা ব্যাপকহারে মকতবে কুরআন শিক্ষা করতো। দিল্লীর এক সময়ের একজন শাসক ছিলেন একজন নারী, সুলতানা রাজিয়া। তিনি ছিলেন একজন বিদূষী মহিলা। তিনি কয়েকটি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। ইবনে বতুতা [১৩০৩-১৩৭৭] তার ঐতিহাসিক সফরে এদেশে তিনটি মহিলা মাদ্রাসা দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। সুলতান গিয়াসুদ্দীন খরজীর মহলে দশ হাজার মহিলা ছিলো। মুহাম্মদ কাসিম ফেরেশতার ইতিহাস থেকে জানা যায়, এদের মধ্যে হাজার হাজার হাফেযা, কারিরা,দীনের আলেমা ও শিক্ষিকা ছিলেন।মুসলিম আমলে শিক্ষার দিক থেকে এ দেশে নারীদের খুবই খ্যাতি ছিলো।
৩৩. চিকিৎসা ও কারিগরি শিক্ষা
মুসলিম আমলে চিকিৎসা ও কারিগরি শিক্ষার জন্যে স্বতন্ত্র কোনো ব্যবস্থা ছিলো বলে জানা যায়না। তবে এসব বিদ্যায় বহু দক্ষ মুসলমানের নাম জানা যায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, হয়তোবা কোনো কোনো মাদ্রাসায় এসব বিষয়েও শিক্ষাদান করা হতো। এসব শাস্ত্রের বিশষজ্ঞগণ ব্যক্তিগত উদ্যোগেও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতেন। মুসলিম আমলের ব্যাপক স্থাপত্য নিদর্শন থেকে বুঝা যায় যে, তখন সুদক্ষ কারিগর তৈরি হতো।
৩৪. উপসংহার
মুসলিম শাসনামলে এদেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, যে শিক্ষা ব্যবস্থার কথা এতোক্ষণ আমরা অতি সংক্ষেপে আলোচনা করলাম, যে শিক্ষা ব্যবস্থা শত শত বছর ধরে এদেশে প্রচলিত ছিলো, তার বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত ছিলো আল্লাহর একত্ব এবং আখিরাতে তাঁর সম্মুখে জবাবদিহির সুদৃঢ় দৃষ্টি ভংগির সীমা পরিসীমা অতিক্রম করে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। এ শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো দক্ষ মানুষ তৈরির কারখানা। গোটা ইসলামী হুকুমাত পরিচালনার জন্যে সর্ব প্রকার দক্ষ মানুষ এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই তৈরি হতো। উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন:
আমরা এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হবার পূর্বে মুসলমানরা কেবল রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারীই ছিলোনা, বরং জ্ঞান বিজ্ঞান এবং বুদ্ধি ও মেধাগত দিক থেকেও তারা ছিলোনা, বরং জ্ঞান বিজ্ঞান এবং বুদ্ধি ও মেধাগত দিক থেকেও তারা ছিলো শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।...... তাদের হাতে ছিলো এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা যাকে কোনো অবস্থাতেই খাটো করে দেখা যায়না। এতে ছিলো উন্নত নৈতিক ও মানসিক প্রশিক্ষণের সু ব্যবস্থা।
মাওলানা মওদূদী (রা) মুসলিম শাসনামলে শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে এক পর্যালোচনায় বলেন:
তখন আমাদের দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো, তা সময়ের দাবি ও প্রয়োজন পূরণে যেতেষ্ট ছিলো। এ ব্যবস্থার এমন সকল বিষয়ই পড়ানো হতো, যা তখনকার রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ছিলো। তাতে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই প্রদান করা হতোনা বরং সে শিক্ষা ব্যবস্থায় দর্শন, মানতিক, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি, সাহিত্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়েও শিক্ষা দেয়া হতো। কিন্তু যখন সে রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত হয়, যার প্রেক্ষিতে আমরা গোলামে পরিণত হলাম, তখন এ গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাই তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম