[ স্থান---প্রহরী বেষ্টিত অন্ধকার কারাগৃহ, কনষ্ট্যান্টিনোপল্ |
কাল---অমাবস্যার নিশীথ রাত্রি | ]
চারিদেক নিস্তব্ধ নির্ব্বাক | সেই মৌনা নিশীথিনীকে ব্যথা দিতেছিল শুধু কাফ্রি--সান্ত্রীর পায়চারীর
বিশ্রী খট্ খট্ শব্দ | ঐ জিন্দান খানায় মহাবাহু আনোয়ারের জাতীয় সৈন্যদলের সহকারী এক তরুণ সেনানী বন্দী |তাহার কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশ, ডাগর চোখ, সুন্দর গঠন---সমস্ত কিছুতে যেন একটা ব্যথিত -বিদ্রোহের তিক্ত-ক্রন্দন ছলছল করিতেছিল | তুরুণ প্রদীপ্ত মুখমন্ডলে চিন্তার রেখাপাতে তাহাকে তাহার বয়স অপেক্ষা অনেকটা বেশী বয়স্ক বোধ হইতেছিল|
সেই দিনই ধামা-ধরা সরকারের কোর্ট-মার্শালের বিচারে নির্দ্ধারিত হইয়া গিয়াছে যে, পরদিন নিশিভোরে তুরুণ সেনানীকে তোপের মুখে উড়াইয়া দেওয়া হইবে |
আজ হতভাগ্যের সেই মুক্তি-নিশীথ, জীবনের সেই শেষরাত্রি | তাহার হাতে পায়ে, কটিদেশে গর্দ্দানে উত্পীড়নের লৌহ- শৃঙ্খল | শৃঙ্খল-ভারাতুর তরুণ সেনানীর স্বপ্নে তাহার ‘মা’কে দেখিতেছিল | সহসা চীত্কার করিয়া সে জাগিয়া উঠিল | তাহার পর চারিদিকে কাতর নয়নে একবার চাহিয়া দেখিল, কোথাও কেহ নাই | শুধু হিমানী সিক্ত বায়ু হা হা স্বরে কাঁদিয়া গেল, “হায় মতৃহারা |”
স্বদেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা স্মরণ করিয়া তুরুণ সেনানী ব্যর্থ-রোষে নিজের বামবাহু নিজে দংশন করিয়া ক্ষত-বিক্ষত করিতে লাগিল | কারাগৃহের লৌহশলাকায় তাহার শৃঙ্খলিত দেহভার বারেবারে নিপাতিত হইয়া কারা-গৃহ কাঁপাইয়া তুলিতেছিল |
এখন তাহার অস্ত্র-গুরু আনোয়ারকে মনে পড়িল | তুরুণ বন্দী চীত্কার করিয়া উঠিল,----
“আনোয়ার !”
আনোয়ার ! আনোয়ার !
দিলওয়ার তুমি, জোর তলওয়ার হানো , আর
নেস্ত্-ও-নাবুদ কর, মারো যত জানোয়ার !
আনোয়ার ! আফ্ সোস্ !
বখ্ তেরই সাফ্ দোষ্,
রক্তেরও নাই ভাই আর সে যে তাপ জোশ
ভেঙে গেছে শম্ শের-----পড়ে আছে খাপ কোষ !
আনোয়ার ! আফ্ সোস্ !
আনোয়ার ! আনোয়ার !
সব যদি সুম্ সাম্ , তুমি কেন কাঁদ আর ?
দুনিয়াতে মুসলিম আজ পোষা জানোয়ার !
আনোয়ার ! আর না !------
দিল্ কাঁপে কার না ?
তলওয়ারে তেজ নাই !---- তুচ্ছ স্মার্ণা,
ঐ কাঁপে থরথর মদিনার দ্বার না ?
আনোয়ার ! আর না !
আনোয়ার ! আনোয়ার !
বুক ফেড়ে আমাদের কলিজাটা টানো, আর
খুন কর----খুন কর ভীরু যত জানোয়ার !
আনোয়ার ! জিঞ্জির-
পরা মোর খিঞ্জির !
শৃঙ্খলে বাজে-শোনো রোণা রিণ-ঝিণ্ কির,----
নিবু নিবু ফোয়ারা বহ্নির ফিন্ কির !
গর্দ্দান জিঞ্জির !
আনোয়ার ! আনোয়ার !
দুর্ব্বল এ গিদ্ধড়ে কেন তড়্পানো আর ?
জোর্ ওয়ার শের কই ? জোর্ বার জানোয়ার !
আনোয়ার ! মুশ্ কিল
জাগা কঞ্জুশ-দিল,
ঘিরে আসে দাবানল তবু নাই হুঁশ তিল !
ভাই আজ শয়তান ভাই-এ মারে ঘুষ কিল !
আনোয়ার ! মুশ্ কিল !
আনোয়ার ! আনোয়ার !
বেইমান মোরা, নাই জান আধ-খানও আর !
কোথা খোঁজা মুসলিম ? শুধু বুনো ঝানোয়ার !
আনোয়ার ! সব শেষ !------
দেহে খুন অবশেষ !--------
ঝুটা তেরি তল্ ওয়ার ছিন্ লিয়া যব্ দেশ !
আওরত সম ছি ছি ক্রন্দন রব পেশ !!
আনোয়ার ! সব শেষ !
আনোয়ার ! আনোয়ার !
জনহীন এ বিয়াবানে মিছে পস্ত্ নো আর !
আজো যারা বেঁচে আছে তারা ক্ষ্যাপা জানোয়ার !
আনোয়ার !--------কেউ নাই !
হাতিয়ার ? ----- সেও নাই !
দরিয়াও থম্ থম্ নাই তাতে ঢেউ, ছাই !
জিঞ্জির গলে আজ বেদুঈন-দে’ও ভাই !
আনোয়ার ! কেউ নাই !
আনোয়ার ! আনোয়ার !
যে বলে সে মুসলিম -----জিভ ধরে টানো তার’ !
বেইমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার !
আনোয়ার ! ধিক্কার !!
কাঁধে ঝুলি ভিক্ষার-----
তল্ ওয়ারে শুরু যার স্বাধীনতা শিক্ষার !
যারা ছিল দুর্দ্দম আজ তারা দিক্ দার !
আনোয়ার ! ধিক্কার !!
আনোয়ার ! আনোয়ার !
দুনিয়াটা খুনিয়ার, তবে কেন মানো আর
রুধিরের লোহু আঁখি ? -----শয়তানী জানো সার !
আনোয়ার ! পঞ্জায়
বৃথা লোকে সম্ ঝায়,
ব্যথা-হত বিদ্রোহী দিল্ নাচে ঝঞ্ঝায়,
খুন-খেগো তল্ ওয়ার আজ শুধু রণ্ চায়,
আনোয়ার ! পঞ্জায় !
আনোয়ার ! আনোয়ার !
পাশা তুমি নাশা হও মুস্ লিম জানোয়ার,
ঘরে যত দুষ্ মন, পরে কেন হানো মার ?
আনোয়ার ! এসো ভাই !
আজ সব শেষ-ও যাই !------
ইসলামও ডুবে গেল, মুক্ত স্ব-দেশও নাই !
তেগ ত্যজি বরিয়াছি ভিখারীর বেশও তাই !
আনোয়ার ! এসো ভাই !!
সহসা কাফ্রী সান্ত্রীর ভীম চ্যালেঞ্জ্ প্রলয়-ডম্বরু-ধ্বনির মত হুঙ্কার দিয়া উঠিল-----“এয় নৌজওয়ান, হুঁশিয়ার !” অধীর ক্ষোভে তিক্তরোষে তরুণের দেহের রক্ত টগ্ বগ্ করিয়া ফুটিয়া উঠিল | তাহার কটিদেশের, গর্দ্দানের, পায়ের শৃঙ্খল খান্ খান্ হইয়া টুটিয়া গেল , শুধু হাতের শৃঙ্খল টুটিল না | সে সিংহ শাবকের মত গর্জন করিয়া উঠিল-----
এয়্ খোদা ! এয়্ আলী ! লাও মেরী তল্ ওয়ার !
সহসা তাহার ক্লান্ত আঁখির চাওয়ায় তুরস্কের বন্দিনী মাতৃ-মূর্ত্তি ভাসিয়া উঠিল | ঐ মাতৃ-মূর্ত্তির পার্শ্বেই তাহার মায়েরও শৃঙ্খলিতা ভিখারিণী বেশ | তাঁদের দুজনেরই চোখের কোণে দুই বিন্দু করিয়া করুণ অশ্রু |
অভিমানী পুত্র অন্য দিকে
মুখ ফিরাইয়া লইয়া কাঁদিয়া উঠিল------
ও কে ? ও কে ছল আর ?
না-----মা, মরা জানকে এ মিছে তর্ সানো আর !
আনোয়ার ! আনোয়ার !!
কাপুরুষ প্রহরীর ভীম প্রহরণ বিনিদ্র বন্দী তরুণ সেনানীর পৃষ্ঠের উপর পড়িল | অন্ধ কারাগারের বন্ধ রন্ধ্রে তাহারই আর্ত্ত প্রতিধ্বনি গুমরিয়া গুমরিয়া ফিরিতে লাগিল-----
“আঃ আঃ আঃ !!
আজ নিখিল বন্দী--গৃহে ঐ মাতৃ-মুক্তি-কামী তরুণেই অতৃপ্ত কাঁদন ফরিয়াদ করিয়া ফিরিতেছে ! যে দিন এ ক্রন্দন থামিবে, সেদিন সে কোন্ অচিন্ দেশে থাকিয়া গভীর তৃপ্তির হাসি হাসিবে জানি না ! তখন হয়তো হারা-মা আমায় “তারার পানে চেয়ে চেয়ে” ডাকিবেন ! আমিও হয়তো আবার আসিব | মা কি আমায় তখন নূতন ডাকে ডাকিবেন ? আমার প্রিয়জন কি আমায় নূতন বাহুর ডোরে বাঁধিবে ? আমার চোখ জলে ভরিয়া উঠিতেছে, আর কেন যেন মনে হইতেছে, “----আসিবে সেদিন আসিবে |”
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম
0 comments: