দ্বিতীয় অধ্যায় : চারিত্রিক ভাল-মন্দের মাপকাঠি

চরিত্রের আদর্শ বিভিন্ন কেন?

কিন্তু এখন প্রশ্ন এই যে, চরিত্রের ভাল-মন্দ যখন সর্বজন জ্ঞাত ও পরিচিত এবং মানুষের এক প্রকারের গুণকে ভাল ও অন্য এক প্রকারের গুণকে মন্দ মনে করার ক্ষেত্রে সমগ্র দুনিয়া চিরদিন অভিন্ন মত পোষণ করেছে, এখন চরিত্র সম্পর্কে এরূপ বিভিন্ন আদর্শের সৃষ্টি হলো কেন? দুনিয়ার এ বিভিন্ন চরিত্র নীতির মধ্যে এরূপ পার্থ্ক্য হবারইবা কারণ কি? চরিত্র সম্পর্কে ইসলামের আদর্শ সম্পূর্ণ আলাদা; একথা কোন্ কারণে বলা হয় এবং চরিত্রের ব্যাপারে ইসলামের এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে দাবী করার মূলে এর বিশেষ অবদানই বা (Contribution) কি? এ বিষয়টি বুঝার জন্য যখন আমরা দুনিয়ার বিভিন্ন চরিত্রনীতির উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, তখন প্রথম দৃষ্টিতেই আমরা এ পার্থক্য দেখতে পাই যে, জীবনের সমগ্র ক্ষেত্রে বিভিন্ন নৈতিক গুণকে প্রযুক্ত করা এবং তাদের সীমা ও তাদের পরস্পরের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করার ব্যাপারে দুনিয়ার চরিত্রনীতিগুলোর একটির সাথে অন্যটির মিল নেই।

আরো একটু গভীর দৃষ্টিতে দেখলে এ পার্থক্যের কারণ জানা যায় এবং তা এই যে, মূলত চরিত্রের ভাল-মন্দের মাপকাঠি নির্বাচন এবং ন্যায়-অন্যায় সংক্রান্ত জ্ঞানলাভের মাধ্যম নির্দিষ্ট করার ব্যাপারেই এদের একটির সাথে আর একটির সাদৃশ্য নেই। উপরন্তু আইনের পশ্চাতে কোন্ কার্যকরী শক্তি (Sanction) বর্তমান থাকবে যার চাপে এটা প্রবর্তিত হবে এবং কিসের প্রেরণাইবা মানুষ তা পালন করতে উদ্বুদ্ধ হবে ; এ মৌলিক প্রশ্নেও চরিত্রনীতিগুলোর মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। কিন্তু এই পার্থক্য ও গরমিলের মূল কারণ যখন আমরা খুজে দেখতে চেষ্টা করি, তখন শেষ পর্যন্ত এ নিগূঢ় তত্ত্ব আমাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, বিশ্ব প্রকৃতি, বিশ্ব প্রকৃতির অভ্যন্তরে মানুষের মর্যাদা এবং সেই দুনিয়ার মানুষের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকারের ধারণা থাকার দরুনই চরিত্রনীতিগুলো বিভিন্ন পথে পরিচালিত হয়েছে এবং ধারণার এ বিভিন্নতাই মূল হতে শুরু করে শাখা পর্যন্ত এদের মূল ভাবধারা, এদের মেযায ও প্রকৃতি এবং এদের রূপ কাঠামোকে পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে বিভিন্ন করে দিয়েছে। মানুষের জীবন আসল সিদ্ধান্তমূলক প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, এ বিশ্ব প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা কেউ আছে কিনা? থাকলে তা বহু না এক ? সৃষ্টিকর্তা যাকেই স্বীকার করা হবে তার গুণাবলী কি? আমাদের সাথে তার কিসের সম্পর্ক ? তিনি আমাদের পথপ্রদর্শনের কোন ব্যবস্থা করেছেন কি ? আমরা তার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য হবো কি ? জবাবদিহি করতে হলে কিসের জবাবদিহি করতে হবে ? আমাদের জীবনের পরিণতি কি ? কোন্ উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে আমাদেরকে কাজ করতে হবে ? বস্তুত এ সকল প্রশ্নের জবাব যে ধরনের হবে তদনুযায়ীই জীবন ব্যবস্থা রচিত হবে এবং এর সাথে সংগতি রেখে চরিত্রনীতি নির্ধারিত হবে।


এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় দুনিয়ার বিভিন্ন জীবন পদ্ধতি পর্যালোচনা করা, উল্লেখিত প্রশ্নগুলো সম্পর্কে এদেরকে কি জবাব দিয়েছে এবং সেই জবাব তার স্বরূপ ও পথ নির্ধারণের কি প্রভাব বিস্তার করেছে, তা এখানে বিস্তারিত প্রকাশ করে বলা আমার পক্ষে কঠিন। কাজেই উল্লেখিত প্রশ্নগুলো সম্পর্কে ইসলামের জবাব এবং সেই অনুযায়ী রচিত বিশেষ ধরনের চরিত্র বিধান সম্পর্কেই আমি আলোচনা করব।

ইসলামের জবাব

ইসলামের জবাব এই যে, এ বিশ্ব প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা আছেন এবং তিনি এক ও একক। তিনি নিখিল দুনিয়াকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই এর একচ্ছত্র মালিক, একমাত্র আইন রচয়িতা, পালনকর্তা ও প্রভু। তারই আনুগত্য ও দাসত্বের ভিত্তিতে এ বিশ্ব প্রকৃতি সুশৃংখলার সাথে চলছে। তিনি সর্বজ্ঞ, বৃদ্ধিমান ও প্রতিভাশালী। তিনি সকল শক্তির আধার। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবকিছুই তার জ্ঞাত। তিনি দোষ-ত্রুটি, দুর্বলতা ও অভাব-অভিযোগের কলংক হতে পবিত্র। নিখিল জাহানের প্রত্যেকটি অণু-পরমাণুর উপর তার প্রভুত্ব ও আধিপত্য নিরংকুশ ও অপ্রতিদ্বন্দী। মানুষ তার জন্মগত দাস - সৃষ্টিকর্তার দাসত্ব ও আনুগত্যর পন্থা ও রীতিনীতি নির্ধারণ করা মানুষের কাজ নয়, এ সেই আল্লাহ তায়ালা তার পথ দেখাবার জন্য পয়গাম্বর পাঠিয়েছেন এবং কিতাব নাযিল করেছেন। জীবন যাপনের পরিপূর্ণ বিধান - সৎপথ লাভ করার পন্থা এহেন উৎস হতেই গ্রহণ করা মানুষের আবশ্য কর্তব্য। জীবনের সমগ্র কাজ-কারবারের জন্য আল্লাহ তায়ালার সামনে মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে এবং এ জবাবদিহি তাকে এ দুনিয়ায় করতে হবে না - করতে হবে পরকালের জীবনে। দুনিয়ার বর্তমান জীবন মূলত একটা পরীক্ষার সময় এবং পরকালে আল্লাহ তায়ালার সামনে এ জবাবদিহির ব্যাপারে সফলতা লাভ করার উদ্দেশ্যেই মানুষের জীবনের সমস্ত চেষ্টা-সাধনাকে কেন্দ্রিভূত করা আবশ্যক। মানুষ তার সমগ্র সত্তাকে নিয়েই এ পরীক্ষার ক্ষেত্রে অবতীর্ণ। এটা তার সমগ্র শক্তি ও যোগত্যার পরীক্ষা। জীবনের সকল দিক ও বিভাগ ব্যাপিয়াই তার এ পরীক্ষা। সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতির বুকে মানুষের যেসব জিনিসের সম্মুখীন হতে হয় সে তার সাথে কি রকম ব্যবহার করল, তা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে যাচাই করে দেখা আবশ্যক। এ যাচাই করার কাজ শুধু সেই শক্তিমান সত্তাই নিখুতরূপে করবেন যিনি পৃথিবীর প্রত্যেকটি অণু-পরমাণু, বাতাস ও পানি, প্রকৃতির আবর্তন এবং স্বয়ং মানুষের মন ও মগয হাত ও পায়ের শুধু নড়াচড়া গতিবিধিরই নয়, তার চিন্তা ও আকাংখার পর্যন্ত রেকর্ড সুরক্ষিত করে রেখেছেন।

ইসলাম মানব জীবনের বুনিয়াদী জিজ্ঞাসাগুলোর এ জবাবই দিয়েছে। বিশ্ব প্রকৃতিও মানব সম্পর্কে ইসলামের এ ধারণাই সেই আসল ও সর্বশেষ কল্যাণকে নির্দিষ্ট করে দেয় যা লাভ করা মানুষের সমস্ত চেষ্টা-সাধনার একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এবং তা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ। ইসলামের চরিত্র বিধানে কোন্ প্রকারের কার্যকলাপ ভাল নয় তা মাপকাঠি দ্বারাই পরিমাপ করে ঠিক করা যায়। উপরন্তু মানব জীবনের সর্বশেষ উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট হওয়ার পর মানুষের চরিত্র এমন একটা কেন্দ্রবিন্দু লাভ করতে পারে, যাকে কেন্দ্র করে সমগ্র চারিদিক জীবন আবর্তিত হতে পারে এবং ঠিক তখনি মানব চরিত্র এর নিজস্ব কেন্দ্রবিন্দুতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও মযবুত হতে পারে। তখন তার অবস্থা কোন নোঙরহীন জাহাজের মত হতে পারে না-যা সামান্য দমকা হাওয়ায় কিংবা সমুদ্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গের আঘাতে একদিক হতে অন্যদিকে চলে যায়। এভাবে মানব জীবনের উদ্দেশ্য সুনির্ধারিত হওয়ার ফলে মানুষের সামনে একটা কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য উপস্থিত হয় এবং সেই অনুসারেই মানব জীবনের চরিত্রগত সমস্ত গুণের উপযুক্ত সীমা, উপযুক্ত অবস্থান এবং উপযুক্ত কর্মপন্থা নির্ধারিত হয়।

এভাবে আমরা এমন এক শ্বাশত ও চিরন্তন নৈতিক মূল্যায়ন (Values) লাভ করতে পারি, যা সমস্ত পরিবর্তনশীল অবস্থার মধ্যেও নিজ কেন্দ্রবিন্দুতে সুদৃঢ় ও স্থায়ী হয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারে। এ ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা এই যে, আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ লাভ করাই মানব জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নির্ধারিত হওয়ার ফলে মানব চরিত্র একটা সর্বোচ্চ লক্ষ্য লাভ করে, এর দরুন চারিত্রিক ক্রমবিকাশের সম্ভাবনা সীমাহীন হতে পারে। অতপর জীবনের কোন ক্ষেত্রেই স্বার্থপরতা ও স্বার্থ পূজার পংকিলতা মানুষকে কলংকিত করতে পারে না।


চারিত্রিক ভাল-মন্দের মাপকাঠি

ইসলাম একদিকে যেমন আমাদের চরিত্রের ভাল-মন্দের মাপকাঠি দিয়েছে অন্যদিকে তেমনি তার বিশ্ব প্রকৃতি ও মানব সম্পর্কীয় ধারণার সাহায্যে নৈতিক ভাল-মন্দ সংক্রান্ত জ্ঞান লাভের একটি পূর্ণাংগ মাধ্যমও দান করেছে। এবং আমাদের ভাল-মন্দ আমাদের চরিত্র সম্বন্ধীয় জ্ঞান লাভ করার জন্য শুধু মানব বুদ্ধি কিংবা প্রবৃত্তি নিছক অভিজ্ঞতা অথবা মানুষের অর্জিত বিদ্যার উপরই একান্তভাবে নির্ভর করতে বলেনি। কারণ তাহলে এ সবের পরিবর্তনশীল সিদ্ধান্ত অনুসারে আমাদের নৈতিক বিধি-নিষেধগুলোও চিনদিনই পরিবর্তিত হয়ে যেত এবং কোন একটি কেন্দ্রে স্থায়ী দাড়ানো এর পক্ষে কখনই সম্ভব হতো না। বস্তুত ইসলাম আমাদের একটা সুনির্দিষ্ট উৎস দান করেছে, এটা হতে আমরা প্রত্যেক যুগেই এবং প্রত্যেক অবস্থাতেই প্রয়োজনীয় নৈতিক বিধান লাভ করতে পারি - সেই উৎস হচ্ছে আল্লাহর কুরআন এবং রাসূলের হাদীস। এটা দ্বারা আমরা এমন একটা ব্যাপক বিধান লাভ করতে পারি যা মানুষের পারিবারিক জীবনের খুটিনাটি ব্যাপার হতে শুরু করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিরাট বিরাট সমস্যা সহ জীবনের প্রত্যেকটা দিক ও প্রত্যেকটা শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট নির্দেশ দিতে পারে। মানব জীবনের বিপুল কাজ-কর্মের ব্যাপারে ইসলামের এ নৈতিক বিধানকে সমাজে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করতে (Widest Application) দিলে কোনা অবস্থায়ই আমাদের অন্য কোন উৎসের মুখাপেক্ষী হবার প্রয়োজন হয় না।

তাছাড়া বিশ্ব প্রকৃতি ও মানব সম্পর্কে ইসলামের এ ধারণার এমন একটা উদ্বোধক ও প্রেরণাদায়ক শক্তিও বর্তমান রয়েছে, যা চরিত্র সম্পর্কীয় আইনের পশ্চাতে বিদ্যমান থাকা একান্ত আবশ্যক। সেই শক্তি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার ভয়, পরকালের জবাবদিহির আশংকা এবং চিরকালীন ধ্বংসের মধ্যে পড়ার ভয়াবহ আকঙ্ক। যদিও ইসলাম এমন একটা শক্তিশালী জনমতো গঠন করতে চায়, যা সমাজ জীবনে ব্যক্তি এবং দলগুলোকে চারিত্রিক নিয়ম-কানুন পালন করে চলতে বাধ্য করতে পারে এবং এমন একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেও স্থাপন করতে চায়, যার ক্ষমতা দুনিয়ার চারিত্রিক আইনগুলোকে শক্তির বলে জারী করতে পারে। কিন্তু এ বাহ্যিক চাপের উপর ইসলামের প্রকৃত কোন নির্ভরতা নেই। এর পরিপূর্ণ নির্ভরতা হচ্ছে মানুষের আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাসের অন্তর্নিহিত চাপের উপর। চরিত্রের বিধিনিষেধ জারী করার পূর্বে ইসলাম মানুষের মনে একথা বিশেষভাবে বদ্ধমূল করে দিতে চায় যে, সর্বদ্রষ্টা ও সর্বত্র বিরাজমান আল্লাহর সংগেই মানুষের প্রকৃত সম্পর্ক। দুনিয়াবাসীর চোখ হতে মানুষ আত্নগোপন করতে পারে ; কিন্তু আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টি হতে সে কিছুতেই আত্নগোপন করতে পারে না। সারা দুনিয়াকে মানুষ ধোকা দিতে পারে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালাকে ধোকা দেয়ার সাধ্য কারো নেই। দুনিয়া ত্যাগ করে মানুষ অন্যত্র চলে যেতে পারে কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কঠিন মুষ্ঠির বাইরে সে কিছুতেই যেতে পারে না। দুনিয়া দেখতে পারে শুধু বাইরের দিক ; কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মানব মনের গোপন ইচ্ছা-বাসনা পর্যন্ত জানতে পারেন। দুনিয়ার এ সংক্ষিপ্ত জীবনে তোমরা যা ইচ্ছা করতে পার, কিন্তু একথা মনে রেখ যে, একদিন তোমাকে অবশ্যই মরতে হবে। তখন সেখানে উকিল নিযুক্ত করা, ঘুষ দেয়া, যামিন সুপারিশ পেশ করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, ধোকা দেয়া ও প্রতারণা করা কিছুই চলবে না। সেখানে তোমার ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্ভুল ও শেষ সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে।

এ বিশ্বাস বদ্ধমূল করে দিয়ে ইসলাম যেন প্রত্যেকটি মানুষের মনে একটা পুলিশ বাহিনীর কড়া পাহারা নিযুক্ত করে দিয়েছে। চরিত্রের বিধি-নিষেধ পালন করার জন্য এটা মনের অভ্যন্তর হতে মানুষকে নিরন্তর বাধ্য করতে থাকে। এ আইন পালন করতে বাধ্য করার জন্য বাইরের কোন পুলিশ, কোন আদালত এবং কারাগার বর্তমান থাকুক আর না-ই থাকুক তাতে কিছুই আসে যায় না। ইসলামের নৈতিক আইনের পশ্চাতে এটাই হচ্ছে আসল শক্তি যা এটাকে বাস্তব ক্ষেত্রে নিরন্তর জারী করে থাকে। তারপর জনমত এবং রাষ্ট্রশক্তি এর সাহায্যে ও সহযোগিতা করলে তা সোনায় সোহাগা, নতুবা শুধু এ ‘ঈমান’ই মুসলমান ব্যক্তি ও জাতিকে সৎপথে পরিচালিত করার জন্য যথেষ্ট। অবশ্য সেই ঈমান এতদূর প্রবল হওয়া আবশ্যক, যেন তা মানব হৃদয়ের গভীর মর্মমূলকে পরিব্যপ্ত করে নিতে পারে।

সৎকাজের প্রেরণা

বিশ্ব প্রকৃতি ও মানব সম্পর্কে ইসলামের এ ধারণা মানব হৃদয়ে এমন এক দুর্নিবার আবেগ সৃষ্টি করে যা চারিত্রিক আইন-কানুন পালন করার জন্য মানুষকে নিরন্তর অনুপ্রাণিত করতে থাকে। মানুষ যখন নিজ ইচ্ছাতেই আল্লাহকে আল্লাহ বলে এবং তার দাসত্ব করাকে জীবনের একমাত্র পথ বলে স্বীকার করে আর আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ লাভ করাকেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে তখনই সে নিজে অন্তরের আবেদনই আল্লাহ তায়ালার হুকুম-আহকাম ও বিধি-নিষেধগুলো পালন করবে। এই সঙ্গে পরকাল বিশ্বাসও একটা উদ্বোধক শক্তি, কারণ সে নিসন্দেহে বিশ্বাস করে যে, যে ব্যক্তিই আল্লাহ তায়ালার হুকুম-আহকাম অনুসরণ করবে, দুনিয়ার এ অস্থায়ী জীবনে তাকে যতই দু:খ-কষ্ট ভোগ করেত এবং অভাব-অভিযোগ ও নির্যাতন-নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হোক না কেন। পরকালে তার চিরস্থায়ী জীবনে এক উজ্জল ভবিষ্যত লাভ সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এ দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালার অবাধ্য হবে, দুনিয়ায় এ সংক্ষিপ্ত জীবনে সে যতই আনন্দ স্ফূর্তি ও আয়েশ-আরাম করুক না কেন পরকালে তাকে চিরস্থায়ী শাস্তি ভোগ করতে হবে, তাতে সন্দেহ নেই। বস্তুত এ আশা, এ ভয় এবং বিশ্বাস কোনা মানুষের মনে যদি বদ্ধমূল হতে পারে, তবে তার অন্তর্নিহিত এ বিরাট উদ্বোধক শক্তি তাকে এমন সব স্থানে পুণ্যের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারে যেখানে পুণ্যের পার্থিব ফল মারাত্নক ক্ষতির কারণ হবে এবং এমন সময়ও তাকে পাপ ও অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখতে পারে, যখন এ পাপের কাজ খুবই লাভজনক ও লোভনীয় হয়ে দাড়াবে।

ইসলামের চারিত্রিক আদর্শের বৈশিষ্ট্য

উপরের বিস্তারিত আলোচনায় একথা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, ইসলামের বিশ্ব প্রকৃতি সংক্রান্ত ধারণা, এর ভাল-মন্দের মাপকাঠি, এর চরিত্র সম্পর্কীয় জ্ঞানের উৎস এবং এর উদ্বোধক ও প্রেরণা শক্তি সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন জিনিস। এদেরই সাহায্যে ইসলাম এর সুপরিচিত চরিত্রনীতির উপাদানগুলোকে নিজের মূল্যায়ন অনুসারে সজ্জিত করে মানব জীবনের সমগ্র বিভাগে পর্যায়ক্রমে জারী করে। এরই উপর ভিত্তি করে অনায়াসেই বলা যেতে পারে যে, ইসলামের চরিত্র বিধান পরিপূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সতন্ত্র জিনিস। এ বিধানের বৈশিষ্ট্য যদিও অসংখ্য কিন্তু এর মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যেগুলোকে এ বিধানের অভিনব অবদান বলা যেতে পারে।

আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ

এর প্রথম বৈশিষ্ট্য এই যে, এটা আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ লাভকে মানব জীবনের সর্বশেষ উদ্দেশ্য নির্ধারিত করে চরিত্রের জন্য এমন একটা উন্নত মাপকাঠি ঠিক করেছে যার দরুণ মানব চরিত্রের উন্নতি ও ক্রমবিকাশের সীমাহীন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চরিত্র সম্পর্কীয় জ্ঞান লাভ করার জন্য একটি মাত্র উৎসকে নির্দিষ্ট করে দেয়ার ফলে ইসলামী চরিত্র এতখানি স্থায়িত্ব ও দৃঢ়তা লাভ করেছে যে, তাতে উন্নতির সম্ভাবনা তো পুরোপুরিই বর্তমান, কিন্তু বিভিন্ন ব্যাপারে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে বহুরূপী সাজার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। আল্লাহ তায়ালার ভয় মানব হৃদয়ের এমন একটি বিরাট শক্তি, যা বাইরের কোন চাপ ছাড়া মানুষকে চরিত্রের নিয়ম-কানুন পালন করতে ভিতর হতেই উদ্বুদ্ধ করতে থাকে এবং আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাস এমন এক শক্তি দান করে, যার দরুন মানুষ নিজেই মনের আগ্রহেই চরিত্রের বিধি-নিষেধ পালন করতে প্রস্তুত হয়।

ভাল-মন্দের পরিচয়

এর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, এটা শুধু অবাস্তব কল্পনার সাহায্যে কতগুলো আশ্চর্য ধরনের চরিত্রনীতি ঠিক করেনি এবং মানুষের সর্ববাদী সমর্থিত চরিত্রনীতির এক অংশের মূল্য কম এবং অপর অংশের মূল্য বেশী দেখাবার চেষ্টাও এটা করেনি। ইসলাম এমন সব জিনিসকে চরিত্রের অন্তর্ভূক্ত করেছে, যা দুনিয়ার সকল মানুষের দ্বারাই সমর্থিত এবং কিছুটা অংশ নিয়েই যথেষ্ট মনে করা হয়নি বরং এর সবটুকুকেই সে নিজের নীতি বলে গ্রহণ করেছে। তারপর একটা পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য ও পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার সাথে মানুষের জীবনে তার একটা স্থান, একটা মর্যাদা এবং একটা সুস্পষ্ট ব্যবহার ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করেছে। ইসলাম এর ব্যাপক চরিত্রনীতিকে মানব জীবনে এমন সামঞ্জস্যের সাথে প্রযুক্ত করেছে যে, ব্যক্তিগত কাজ-কারবার, পারিবারিক সম্পর্ক, নাগরিক জীবন, আভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনৈতিক আদান-প্রদান, বাজার-বন্দর-শিক্ষাগার, আদালাত ফৌজদারী, পুলিশ লাইন, সেনানিবাস, যুদ্ধের ময়দান, স্বস্তি পরিষদ - মোটকথা মানব জীবনের প্রত্যেকটি দিক ও বিভাগের উপর ইসলামের ব্যাপক চরিত্রনীতির সুস্পষ্ট প্রভাব বর্তমান। মানব জীবনের প্রত্যেকটি দিক ও বিভাগের উপর ইসলাম স্বীয় চরিত্রনীতিকেই একমাত্র ‘শাসক’ নিযৃক্ত করেছে এবং জীবনের যাবতীয় কাজ-কারবারের চাবিকাঠি প্রবৃত্তি, স্বার্থবাদ এবং সুবিধাবাদের পরিবর্তে, চরিত্রের হাতে ন্যস্ত করাই ইসলামের ঐকান্তিক চেষ্টা।

মুসলিম জাতির প্রতিষ্ঠা

তৃতীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, ইসলাম মানবতার কাছে এমন এক জীবন যাপন পদ্ধতি গ্রহণ করার দাবী উপস্থিত করেছে, যা স্থাপিত হবে সর্ববাদী সমর্থীত চরিত্রনীতির উপর এবং সেই চরিত্রনীতির বিরোধী কোনা জিনিসের বিন্দুমাত্র প্রভাবও তাতে থাকবে না। তার দাওয়াত হচ্ছে এই যে, যেসব মংগলময় কাজকে মানব প্রকৃতি চিরদিনই ভাল বলে মনে করেছে-এসো, আমরা তা বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করি। আর যেসব পাপ ও অন্যায় কাজকে মানুষ চিরকালই খারাপ মনে করেছে, অন্যায় বলে ঘৃণা করেছে-এসো আমরা সেসসবকে পরাজিত করি, দুনিয়ার বুক হতে চিরতরে বিলিন করে দেই। ইসলামের এ আহবানে সাড়া দিয়েছে, তাদেরকে একত্রিত করে ইসলাম এক নবজাতির প্রতিষ্ঠা করেছে, এ জাতির নামই মুসলিম। এ নবজাতির প্রতিষ্ঠা দ্বারা ইসলামের একমাত্র উদ্দেশ্য এই যে, তারা সমস্ত ভাল ও কাজকে দুনিয়ায় জারি ও কায়েম করবে এবং সমস্ত পাপ ও অন্যায় কাজকে পৃথিবীর বুক হতে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে সাধনা করবে-সংগ্রাম করবে। কিন্তু আজ যদি সেই জাতিরই হাতে সত্য ও পুণ্য পরাজিত হয় এবং পাপের নগ্ন অনুষ্ঠান নিত্য নতুন উপায়ে উৎকর্ষ লাভ করে, তবে তা বড়ই দু:খের কথা সন্দেহ নাই। সেই দু:খ সমগ্র মুসলিম জাতির এবং সেই দু:খ দুনিয়ার নিখিল মানুষের।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম