ইসলামের সমাজ ব্যবস্থা
সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি
“দুনিয়ার সমস্ত মানুষ একই বংশোদ্ভুত”-এ মতের উপরই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার বুনিয়াদ স্থাপিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম একজোড়া মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তারপরে সেই জোড়া হতে দুনিয়ার সকল মানুষের জন্ম হয়েছে। প্রথম দিক দিয়ে একজোড়া মানুষের সন্তানগণ দীর্ঘকাল পর্যন্ত একই দল ও একই সমাজের অন্তর্ভূক্ত ছিল ; তাদের ভাষাও ছিল এক। কোন প্রকার বিরোধ-বৈষম্য তাদের মধ্যে ছিল না। কিন্তু তাদের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পেতে লাগল ততই তারা পৃথিবীর নানাদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং এ বিস্তৃতির ফলে তারা অতি স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন বংশ, জাতি ও গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ল। তাদের ভাষা বিভিন্ন হয়ে গেল, পোশাক-পরিচ্ছদের দিক দিয়ে অনেক বৈষম্য ও বৈচিত্র দেখা দিল। দৈনন্দিন জীবন যাপনের রীতিনীতিও আলাদা হয়ে গেল এবং বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন আবহাওয়ায় তাদের রং, রূপ ও আকার-আকৃতি পর্যন্ত বদলিয়ে গেল। এসব পার্থক্য একেবারেই স্বাভাবিক, বাস্তব দুনিয়ায়ই এটা বর্তমান। কাজেই ইসলামও এসবকে ঠিক একটা বাস্তব ঘটনা হিসেবেই গ্রহণ করেছে। ইসলাম এসবকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেবারা পক্ষপাতি নয়, বরং এসবের দ্বারা মানব সমাজে পারস্পরিক পরিচয় লাভ করা যায় বলে ইসলাম এগুলোকে স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু পার্থক্য বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে মানব সমাজে বর্ণ, বংশ, ভাষা, জাতীয়তা এবং স্বাদেশীকতরা যে হিংসা-দ্বেষ উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, ইসলাম তা কিছুতেই সমর্থন করতে পারে না, এর দৃষ্টিতে এটা সম্পূর্ণরূপেই ভুল। মানুষ এবং মানুষের মধ্যে শুধু জন্মের ভিত্তিতে উচ্চ-নীচ, আশারফ-আতরফ এবং আপন পরের যে পার্থক্য করা হয়েছে, ইসলামের দৃষ্টিতে তা একেবারেই জাহেলিয়াত একেবারেই মূর্খতাব্যঞ্জক। ইসলাম সমস্ত দুনিয়ার মানুষকে সম্বোধন করে বলে যে, তোমরা সকলেই এক মাতা ও এক পিতার সন্তান, তোমরা পরস্পর ভাই ভাই এবং মানুষ হওয়ার দিক দিয়ে তোমরা সকলেই সমান।
পার্থক্য ও তার কারণ
মানুষ সম্পর্কে এ ধারণা গ্রহণ করার পর ইসলাম বলে যে, মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য যদি হতে পারে, তবে তা বংশ, বর্ণ, ভৌ্গলিক সীমা এবং ভাষার ভিত্তিতে নয়, তা হতে পারে মনোভাব, চরিত্র ও জীবনার্দশের দিক দিয়ে। এক মায়ের দুই সন্তান বংশের দিক দিয়ে যতই এক হোক না কেন, তাদের মনোভাব, চিন্তাধারা এবং চরিত্র যদি বিভিন্ন রকমের হয়, জীবনের কর্মক্ষেত্রে তাদের পথও সম্পূর্ণরূপে বিভিন্ন হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই দূর সীমান্তের অধিবাসী প্রকাশ্যে যতই দূরবর্তী হোক না কেন, তাদের মত ও চিন্তাধারা যদি এক রকমের হয়, তাদের চরিত্র যদি এক প্রকারের হয়, তবে তাদের জীবনের পথও সম্পূর্ণ এক হবে, সন্দেহ নেই। এ মতের ভিত্তিতে ইসলাম দুনিয়ার সমগ্র বংশ এবং আঞ্চলিক ও জাতীয়তার বুনিয়াদে গঠিত সমাজের সম্পূর্ণ বিপরীত এক অভিনব সমাজ গঠন করে, যার চিন্তাধারা, মত, চরিত্র ও আদর্শ সম্পূর্ণ আলাদা। এ সমাজে মানুষ ও মানুষের মিলনের ভিত্তি শুধু জন্মগত নয় বরং তা হচ্ছে নির্দিষ্ট একটা বিশ্বাস এবং জীবনের একটা আদর্শ। যে ব্যক্তিই আল্লাহ তায়ালাকে নিজের মালিক ও প্রভু বলে স্বীকার করবে এবং নবীর প্রচারিত বিধানকে নিজ জীবনের একমাত্র আইন বলে গ্রহণ করেব, সেই ব্যক্তিই এহেন সমাজের অন্তর্ভূক্ত হতে পারবে, হোক সে আফ্রিকার অধিবাসী কিংবা আমেরিকার, আর্য হোক কিংবা অনার্য, কালো হোক কিংবা গোরা হিন্দি ভাষাভাষি হোক কিংবা আরবী ভাষাভাষি। আর যেসব মানুষ এ সমাজে প্রবেশ করবে তাদের সকলের অধিকার ও সামাজিক মর্যাদাও সম্পূর্ণ সমান হবে। তাদের মধ্যে বংশীয়, জাতীয় অথবা শ্রেনীগত বৈষম্যের কোন স্থানই থাকবে না। সেখানে কেউ উচ্চ আর কেউ নীচু নয়, কোন প্রকারের ছুৎমার্গ তাদের মধ্যে থাকবে না। কারো হাতের স্পর্শে কারো অপবিত্র হয়ে যাবারা আশংকা থাকবে না। বিবাহ-শাদী, খানা-পিনা, বৈঠকী মেলামেশার ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন বাধা-বিপত্তি থাকবে না। কেউ নিজ জন্ম কিংবা পেশার দিক দিয়ে নীচ কিংবা ছোট জাত বলে পরিগণিত হবে না। কেউ নিজ জাত কিংবা পরিবারের ভিত্তিতে কোন বিশেষ অধিকার লাভ করতে পারবে না। যার চরিত্র অধিকতর ভাল এবং অন্যান্য লোক অপেক্ষা যার মনে আল্লাহর ভয় অনেক বেশী মানব সমাজে একমাত্র তারই শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হবে।
বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব
এ সমাজের বৈশিষ্ট্য এই যে, এটা বংশ ও ভাষার সমস্ত বৈষম্য এবং ভৌগলিক সীমারেখা চূর্ণ করে পৃথিবীর কোণে কোণে বিস্তৃত হতে পারে এবং এর ভিত্তিতে দুনিয়ার নিখিল মানুষের এক বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হতে পারে। বংশীয় এবং আঞ্চলিকতার বুনিয়াদে স্থাপিত সমাজগুলোতে শুধু সেই লোকেরাই শামিল হতে পারে, যারা নির্দিষ্ট একটি বংশে কিংবা নির্দিষ্ট কোন এক দেশে জন্মলাভ করে, তার বাইরের লোকদের পক্ষে এ ধরেনর সমাজের দুয়ার চিরতরে বন্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামের এ চিন্তা ও আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত সমাজে এ মত ও চরিত্রনীতির সমর্থক প্রত্যেকটি মানুষই প্রবেশ লাভ করতে পারে। আরা যারা সেই বিশ্বাস ও চরিত্রনীতিকে সমর্থন করে না, ইসলামী সমাজ তাদের নিজের মধ্যে শামিল করে নিতে পারে না বটে কিন্তু তাদের সাথে মানবোচিত ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে এবং তাদেরকে মানবোচিত অধিকার দান করতে এটা সর্বদা প্রস্তুত থাকে। এটা সুস্পষ্ট কথা যে, এক মায়ের দুই সন্তান যদি মত ও চিন্তাধারার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়, তবে অবশ্য তাদের জীবন যাপন পদ্ধতিও ভিন্ন ভিন্ন হবে। কিন্তু তার অর্থ নিশ্চয়ই এটা নয় যে, তারা একে অপরের ভাই-ই নয়। এভাবে সমগ্র মানব বংশের দু’টি দল কিংবা এক দেশের অধিবাসী লোকদের দু’টি দলও যদি ধর্মমত এবং চরিত্রনীতির দিক দিয়ে তারা অবশ্যই সম্পূর্ণ এক-অভিন্ন। সম্মিলিত মানবতার ভিত্তিতে সে সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক অধিকার দেয়ায় ধারণা করা যেতে পারে ইসলামী সমাজ তা সবই অমুসলিম সমাজকে দিতে প্রস্তুত।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার এ মৌলিক কথাগুলো বুঝে নেয়ার পর আমরা মানবীয় মিলন-প্রীতির বিভিন্ন ব্যাপারের জন্য ইসলাম নির্ধারিত যাবতীয় নিয়ম ও রীতিনীতির আলোচনা করব।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার বুনিয়াদ
মানব সমাজের প্রাথমিক ও বুনিয়াদী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পরিবার। একজন পুরুষ ও একজন নারী। পারস্পরিক মিলনের ফলেই হয় এ পরিবারের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা। এ মিলনের ফল স্বরূপ এক নতুন বংশের সৃষ্টি হয়। তারপর সেসব সন্তানের দিক দিয়ে নতুন আত্নীয়তা, সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্বের একটা স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি হয়। আর সব শেষে এ জিনিসই ছড়িয়ে বিস্তৃত হয়ে একটি বিরাট সমাজের আকারে আত্নপ্রকাশ করে। বস্তুত পরিবার এমন একটি প্রতিষ্ঠান যাকে কেন্দ্র করে একটি বংশ এর অধস্তন পুরুষকে মানব সভ্যতার বিপুল দায়িত্ব পালন করার জন্য বিশেষ স্নেহ, ত্যাগ, হৃদয়ের গভীর ভালবাসা ও দরদ এবং হিতাকাংখা সহকারে তৈরী করতে পারে। এ প্রতিষ্ঠান মানব সভ্যতার স্থায়িত্ব এবং ক্রমোন্নতির জন্য নতুন লোকের কেবল জন্ম দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, বরং এর কর্মচারীগণ যে মনে প্রাণে এটাই কামনা করে যে, তাদের স্থান দখল করার জন্য যে নতুন মানুষের জন্ম হচ্ছে তারা তাদের চেয়েও উপযুক্ত হোক। এ দিক দিয়ে এ তত্ত্ব কথায় কোন সংশয় থাকে না যে, পরিবারই হচ্ছে মানব সভ্যতার মূল ভিত্তি। আর এ মূল ভিত্তির সুস্থতা ও শক্তির উপর স্বয়ং তামাদ্দুনের সুস্থতা ও শক্তি একান্তভাবে নির্ভর করে। এ জন্যেই ইসলাম সর্বপ্রথম এ পরিবার প্রতিষ্ঠানকে অধিকতর শুদ্ধ ও মযবুত বুনিয়াদের উপর স্থাপন করার দিকে বিশেষ লক্ষ্য আরোপ করেছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে একটি নারী ও পুরুষের মিলন তখনই বিশুদ্ধ ও সংগত হতে পারে যখন এ মিলনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি থাকবে এবং তার ফলে একটি নতুন পরিবার সৃষ্টি হতে পারবে। নারী-পুরুষের স্বাধীন ও দায়িত্বহীন মিলনকে ইসলাম শুধু একটি নিষ্পাপ স্ফূর্তী কিংবা একটি সাধারণ পদস্খলন মনে করেই উপেক্ষা করতে পারে না। এর দৃষ্টিতে এটা সভ্যতার মূল বুনিয়াদকেই একেবারে ধ্বংস করে দেয়। এ কারণেই ইসলাম এ ধরনের সম্পর্ককে সম্পূর্ণ হারাম ও আইনগত অপরাধ বলে মনে করে। এ ধরনের অপরাধের জন্য ইসলাম কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করেছে, যেন মানব সমাজে এরূপ সভ্যতা ধ্বংসকারী সম্পর্ক স্থাপনের সমস্ত কারণ ও সুযোগের ছিদ্র পথ হতে রক্ষা করতে চায়।
পর্দার হুকুম, নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশায় নিষেধ, নাচগান ও ছবির উপর কঠিন নিয়ন্ত্রণ, সংগত ও নৈতিক চরিত্রের নিয়ন্ত্রণ এবং অশ্লীলতা প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ঠিক সেই উদ্দেশ্যই করা হয়। আর এ বাধা-নিষেধের কেন্দ্রীয় ও মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবার প্রতিষ্ঠানকে অধিকতর সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় করে তোলা। অন্যদিকে নারা-পুরুষের দায়িত্বপূর্ণ মিলন অর্থাৎ বিবাহকে ইসলাম শুধু সংগত বলেই ঘোষণা করেনি বরং তাকে মংগলময়, পুণ্যের কাজ এবং একটি ইবাদাত বলে মনে করে। বয়:প্রাপ্তির পর নারী-পুরুষের অবিবাহিত থাকা ইসলাম একেবারেই সমর্থন করে না। সমাজের প্রত্যেক যুবককে সে এ জন্য উৎসাহিত করে যে, তার মাতাপিতা তামাদ্দুনের যে দায়িত্বপূর্ণ করেছেন, তাদের পালা আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও সেই দায়িত্ব পালন করেত প্রস্তুত হওয়া উচিত। ইসলামে সন্ন্যাসবাদ আদৌ সমর্থীত নয়। উপরন্তু এটাকে মনে করে আল্লাহর নির্ধারিত স্বভাব-নিয়মের সম্পূর্ণ পরিপন্থী একটি বেদায়াত। যেসব ‘বদ রসম’ ও কুসংস্কারের দরুন বিবাহ একটা কঠিন দুরূহ কাজ হয়ে পড়ে, ইসলাম সে সবের তীব্র প্রতিবাদ করে। এর একান্ত ইচ্ছা এই যে, মানব সমাজে বিবাহ যেন অতীব সহজসাধ্য এবং ব্যভিচার যেন খুবই কঠিন কাজ হয়ে পড়ে। আর এর বিপরীত বিবাহ কঠিন এবং ব্যভিচার খুবই সহজসাধ্য যেন কখনও হতে পারে না।
এ জন্যই ইসলাম কয়েকটি বিশেষ সম্পর্কের মধ্যে বিবাহ বন্ধন হারাম করে দেয়ার পর অন্যান্য সমস্ত দূর ও নিকটাত্নীয়দের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করা জায়েজ করে দিয়েছে। আশরাফ-আতরাফদের সমস্ত ভেদাভেদ চিরতরে চূর্ণ করে দিয়ে সমস্ত মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে বিবাহ-শাদীর অবাধ অনুমতি দিয়েছে। ‘মোহর’ ও দান যৌতুক খুবই সংক্ষিপ্ত ও সুবিধাজনক করার হুকুম দিয়েছে, যেন উভয় পক্ষই তা খুব সহজেই বহন করতে সমর্থ হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ অনুষ্ঠান উদযাপন করার জন্য কোন কাযী, পন্ডিত, পুরোহিত কিংবা অফিস ও রেজিষ্টারের কোনই আবশ্যকতা নেই। ইসলামী সমাজে বিবাহ খুবই সহজ, সাদাসিদে ও অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান। যে কোন স্থান দু’জন সাক্ষীর সামনে বয:প্রাপ্ত নারী-পুরুষের ইজাব-কবুলের দ্বারা অনায়াসেই এ কাজ সম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু তার জন্য এ শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, এ ইজাব-কবুল গোপনে হলে চলবে না এটা মহল্লা বা গ্রামের লোকজনকে জানিয়ে-শুনিয়ে করতে হবে।
পারিবারিক জীবনের পদ্ধতি
পারিবারিক জীবনে ইসলাম পুরুষকে পরিবারের কর্তা ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপক নিযুক্ত করেছে। ঘরের শৃংখলা রক্ষা করার সমস্ত দায়িত্ব পুরুষের উপর অর্পণ করা হয়েছে। স্ত্রীকে স্বামীর এবং সন্তানকে পিতামাতা উভয়েরই আনুগত্য করার জন্য আদেশ করা হয়েছে। যে পরিবারে কোন শৃংখলা ব্যবস্থা নেই এবং ঘরের লোকদের চরিত্র ও কাজ-কারবার সুস্থ রাখার জন্য দায়িত্বশীল কেউ নেই, ইসলাম এ ধরনের শিথিল পারিবারিক ব্যবস্থা মোটেই পসন্দ করে না। শৃংখলা রক্ষা করার জন্য একজন শৃংখলাকারীর একান্ত প্রয়োজন। ইসলাম এ দায়িত্ব পালন করার জন্য পরিবারের পিতাকেই স্বাভাবিক কর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেছে। কিন্তু তার অর্থ কখনই এটা নয় যে, পুরুষকে ঘরের একজন সেচ্ছাচারী ও অত্যাচারী স্বাধীন-শাসনকর্তা করে দেয়া হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রেম ভালবাসাই হচ্ছে দাম্পত্য জীবনের মূল ভাবধারা। একদিকে স্বামী আনুগত্য করা যেমন কর্তব্য অন্যদিকে স্বামীরও কর্তব্য এই যে, সে তার ক্ষমতা অন্যায়, যুলুম ও বেইনসাফীর কাজে প্রয়োগ না করে পারিবারিক জীবনকে সুন্দর সুশৃংখল ও শান্তিপূর্ণ করে তুলার জন্য ব্যবহার করবে। দাম্পত্য সম্পর্ককে ইসলাম ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত বাচিয়ে রাখতে চায়, যতক্ষণ পর্যন্ত তাতে প্রেম-ভালবাসার মাধুর্য কিংবা অন্তত নিরবিচ্ছিন মিলন-প্রীতির সম্ভাবনা বর্তমান থাকবে। কিন্তু এ সম্ভাবনা যখন একেবারেই থাকবে না, তখন স্বামীকে তালাক দেয়ার এবং স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে নিবার অধিকার দেয়, আর যেসব অবস্থায় বিবাহ স্বামী-স্ত্রীর মিলন প্রেমের পরিবর্তে শুধু অশান্তিরই কারণ হয়ে পড়ে, সেখানে ইসলামী আদালতকে বিবাহ ভেঙ্গে দেবার আদেশ দিয়ে থাকে।
আত্নীয়তার সীমা
পরিবারের সংকীর্ণ পরিধির বাইরে আত্নীয়তাই হচ্ছে নিকটবর্তী সীমান্ত। এর পরিধি বহু প্রশস্ত হয়ে থাকে। যারা মা-বাপের সম্পর্ক কিংবা ভাই-ভগ্নির সম্পর্ক, অথবা বৈবাহিক সম্পর্কের দিক দিয়ে একে অন্যের আত্নীয় হবে ইসলাম তাদের পরস্পরকে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন, সাহায্যকারী ও দয়াশীল দেখতে চায়। কুরআন শরীফের বিভিন্ন জায়গায় নিকটাত্নীয়দের সাথে ভাল ব্যবহার করার আদেশ দেয়া হয়েছে। হাদীস শরীফে আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ও এর ‘হক’ আদায় করার জন্য বার বার তাকীদ এসেছে এবং এটাকে একটা বড় পুণ্যের কাজ বলে গণ্য করেছে।
যে ব্যক্তি নিজ আত্নীয়দের সাথে মনোমালিন্য, কপটতা ও তিক্ততাপূর্ণ ব্যবহার করবে, ইসলাম তাকে মোটেই ভাল চোখে দেখতে পারে না। কিন্তু তাই বলে আত্নী-স্বজনদের অনাহুত পক্ষপাতিত্ব করাও ইসলামের দৃষ্টিতে কোন সৎকাজ নয়, নিজ পরিবার ও গোত্রের লোকদের অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করা ইসলামের দৃষ্টিতে অমার্জনীয় অপরাধ। এরূপ কোন সরকারী অফিসার যদি জনগণের অর্থ দ্বারা নিজ লোকদের প্রতিপালন করতে শুরু করে, কিংবা কোন বিষয়ের বিচারের বেলায় তাদের প্রতি অকারণে পক্ষপাতিত্ব করে তবে মনে রাখতে হবে যে, এটা একটি শয়তানী অপরাধ। ইসলাম যে আত্নীয়তা রক্ষা করার আদেশ দেয়, তা নিজের দিক দিয়ে এবং হক ও ইনসাফের সীমার মধ্যে হওয়া চাই।
সমাজ জীবনের প্রধান নিয়মাবলী
এসব নিকটবর্তী আত্নীয়তা ও সম্বন্ধের বাইরে সম্পর্কের যে এক বিশাল ক্ষেত্র সামনে এসে পড়ে গোটা মুসলিম সমাজই তার অন্তর্ভূক্ত। এ বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র ইসলাম আমাদের সামগ্রিক জীবনকে যেসব বড় বড় নিয়ম পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত করে, সংক্ষেপে তা নিম্নে প্রদত্ত হলো :
এক : নেক ও পরহেযগারীর কাজে পরস্পর সহযোগিতা কর, পাপ ও অন্যায় অনুষ্ঠানে কোন প্রকার সাহায্য করো না। (কুরআন)
দুই : তোমাদের বন্ধুতা ও শত্রুতা সবই আল্লাহর উদ্দেশ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। দান করবে এ জন্য যে, দান করা আল্লাহ তায়ালা
ভালবাসেন, আর কাউকে কিছু দেয়া বন্ধ করলে তা এ জন্য করবে যে, তাকে কিছু দেয়া আল্লাহ পসন্দ করেন না (হাদীস)
তিন: তোমরা এক অতীব উৎকৃষ্ট জাতি, মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্যই তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। পুণ্যের আদেশ করা এবং অন্যায় কাজের নিষেধ করাই তোমাদের জীবনের একমাত্র কাজ। (কুরআন)
চার : পরস্পর পরস্পপরের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করো না একজন অপরজনের কাজ-কারবারের খুত বের করতে চেষ্টা করো না। পারস্পরিক হিংসা-দ্বেষ হতে আত্নরক্ষা করো। কারো শত্রুতা করো না। আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত বান্দাহ এবং পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থাকো। (হাদীস)
পাচ : জেনে-শুনে কোন যালেমের সাহায্য করো না। (হাদীস)
ছয় : অন্যায় কাজে নিজ জাতির সাহায্য করার উদাহরণ এই যে, তোমার উট কূপে পড়ে যাচ্ছিল, আর তার লেজ ধরে তুমিও তার সঙ্গে সঙ্গে কূপে পড়ে গেলে। (হাদীস)
সাত : তুমি নিজের জন্য যা পসন্দ কর, অপরের জন্যও ঠিক তাই পসন্দ করো। (হাদীস)
প্রতিবেশীর অধিকার
আত্নীয়তার সম্পর্কের পর দ্বিতীয় নিকটবর্তী হচ্ছে প্রতিবেশীর সম্পর্ক। কুরআনের দৃষ্টিতে প্রতিবেশী তিন প্রকার। প্রথমত, আত্নীয় প্রতিবেশী, দ্বিতীয়, অনাত্নীয় প্রতিবেশী এবং তৃতীয়, অস্থায়ী প্রতিবেশী - অল্পকালের জন্য যার সাথে উঠা-বসা ও চলা-ফেরা করার সুযোগ হয়েছে, ইসলামের সমাজ-বিধান অনুযায়ী এরা প্রত্যেকেই বন্ধুত্ব সহানুভূতি এবং ভাল ব্যবহার পাবার অধিকারী। হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা) বলেছেন, প্রতিবেশীর অধিকারী রক্ষা করার জন্য আমাকে এতদূর তাকীদ দেয়া হয়েছে যে, ভবিষ্যতে প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকার দেয়া যেতে পারে বলে আমার ধারণা হচ্ছিল। একটি হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে যে, হযরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন : প্রতিবেশীর সাথে যে ব্যক্তি ভাল ব্যবহার করবে না, সে প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার নয়। অন্য একটি হাদীসে নবী মুস্তফা (সা) বলেছেন : যে ব্যক্তি পেট ভরে আহার করেব এবং তারই পাশে তার প্রতিবেশী উপবাস থাকবে, মনে করতে হবে সে ব্যক্তির ঈমান নেই। একবার হযরত (সা)-এর নিকট নিবেদন করা হয়েছিল যে, একটি মেয়েলোক খুব বেশী নফল সালাত আদায় করে, প্রায়ই সাওম রেখে থাকে এবং প্রচুর পরিমাণে দান-খয়রাত করে থাকে ; কিন্তু তার কটুক্তিতে তার প্রতিবেশী ভয়ানক নাজেহাল। তিনি বললেন, সে জাহান্নামী। উপস্থিত লোকেরা নিবেদন করল, অন্য একটি মেয়েলোক এমন আছে, যার মধ্যে এ ধরনের ভাল গুণ অবশ্য নেই ; কিন্তু প্রতিবেশীকে সে কষ্ট দেয় না। হযরত (সা) বললেন : সে বেহশতী হবে।
নবী মুস্তফা (সা) লোকদের বিশেষ তাকীদ করে বলেছেন যে, নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য কোন ফল কিনে আনলে তার কিছু অংশ তোমার প্রতিবেশীর ঘরে অবশ্যই পাঠিও, নতুবা ফলের খোসা বাইরে নিক্ষেপ করো না, কারণ এটা দেখে গরবী প্রতিবেশীর মনে দু:খ জাগতে পারে। নবী মুস্তফা (সা) বলেছেন : তোমার প্রতিবেশী যদি তোমাকে ভাল বলে, তবে তুমি নিশ্চয়ই ভাল। কিন্তু তোমার সম্পর্কে তোমার প্রতিবেশীর মত যদি খারাপ হয়, তবে তুমি একজন খারাপ লোক তাতে কোনই সন্দেহ নেই। মোটকথা, যারা একে অপরের প্রতিবেশী হয়ে বসবাস করেছে, ইসলাম সেসব লোককে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল, সাহায্যকারী ও সুখ-দু:খের সাথী হিসেবে দেখতে চায়। ইসলাম তাদের মধ্যে এমন সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় যে, তারা যে একজন অপরজনের উপর নির্ভর করতে পারে এবং একজন অপরজনের সাহায্যে নিজের জান-মাল ও সম্মানকে নিরাপদ বলে মনে করতে পারে। কিন্তু যেসব সমাজে একটা দেয়ালের দু’দিকে অবস্থিত দু’ঘরের অধিবাসী দু’জন মানুষ পরস্পর চিরদিন অপরিচিত থাকে এবং যে সমাজে এক গ্রামের অধিবাসীর মধ্যে পারস্পরিক কোন সহানুভূতি, কোন সহৃদয়তা ও নির্ভরতা নেই সেসব সমাজ কখনো ইসলামী সমাজ বলে বিবেচিত হতে পারে না।
0 comments: