ইসলামের আধ্যাত্নবাদ
ইসলামের আত্নিক নীতি কি ? জীবনের পরিপূর্ণ ব্যবস্থার সংগেই বা তার সম্পর্ক কি ? এ বিষয়টি ভাল করে বুঝার জন্য আধ্যাত্নবাদ সম্পর্কে ইসলামের ধারণা এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও দার্শনিক ধারণার পারস্পরিক পার্থক্য সর্বপ্রথম বুঝে নিতে হবে। এ পার্থক্য ভাল করে না বুঝার দরুন ইসলামের আধ্যাত্নবাদ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে মানুষের মগযে অনিচ্ছাকৃতভাবে এমন সব ধারণা ঘুরপাক খেতে থাকে যা সাধারণত এ ‘আধ্যাত্ন’ শব্দটির সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। এ সমস্যায় পড়ে মানুষ ইসলামের সঠিক আধ্যাত্নবাদকে খুব সহজে বুঝে উঠতে পারে না-যা ‘আত্নার’ জানা শুনা পরিসীমাকে অতিক্রম করে জড় এবং দেহের রাজ্যেও আধিপত্য বিস্তার করে, শুধু আধিপত্য বিস্তারই নয় তার উপর প্রভুত্বও করতে চায়।
পার্থিব জীবন ও আধ্যাত্ববাদের দ্বৈততা
দর্শন ও ধর্ম জগতে সাধারণ প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী আত্না এবং দেহ দু’টি পরস্পর বিরোধী জিনিস, উভয়ের ক্ষেত্র ও পরিবেশ আলাদা, উভয়ের দাবী বিভিন্ন বরং পরস্পর বিরোধী এবং এই উভয় ক্ষেত্রেই একই সংগে উন্নতি লাভ কখনো সম্ভব নয়। দেহ এবং বস্তুজগত ‘আত্নার’ কারাগার বিশেষ, পার্থিব জীবনের সম্পর্ক-সম্বন্ধ এবং মনের ইচ্ছা-বাসনার হাতকড়ীতে আত্না বন্দী হয়ে পড়ে। দুনিয়ার কাজ-কারবার ও লেন-দেনের লৌহনিগড়ে আবদ্ধ হয়ে ‘আত্নার উন্নতি’ শেষ হয়ে যায়। এ ধারণার অবশ্যাম্ভাবী ফলে আধ্যাত্নবাদ এবং পার্থিব জীবনের পথ সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন হয়ে গিয়েছে। যারা পার্থিব জীবন অবলম্বন করল, তারা প্রথম পদক্ষেপেই নিরাশ হয়ে পড়ল এবং মনে করতে লাগল যে, এখানে আধ্যাত্নবাদ তাদের সংগে কোনক্রমেই চলতে পারবে না। হতাশাই তাদেরকে শেষ পর্যন্ত জড়বাদের পংকিল আবর্তে নিমজ্জিত করেছে।
সমাজ, তামাদ্দুন, রাজনীতি, অর্থনীতি-মানুষের জীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগ আধ্যাত্নবাদের নির্মল আলোক জ্যোতি হতে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হয়ে গেল। আর সর্বশেষে বিশাল পৃথিবী যুলুল-নিপীড়নের সয়লাব শ্রোতের রসাতলে চলে গেল। অন্যদিকে যারা আধ্যাত্নিকতার অনুসন্ধানে আত্ননিয়োগ করল, তারা নিজ নিজ ‘আত্নার’ উন্নতির জন্য এমন সব পথ খূজে বের করল, এ দুনিয়ার সঙ্গে যার কোনই সম্পর্ক নেই। কারণ তাদের দৃষ্টিতে আধ্যাত্নিক উন্নতির এমন কোন পথ নেই, যা দুনিয়ার মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে। তাদের মতে আত্নার উন্নতি সাধনের জন্য দেহের নিপীড়ন বা নির্যাতন অত্যন্ত জরুরী। এ কারণেই তারা এমন সব অত্যধিক কৃচ্ছ্রসাধনের নিয়ম উদ্ভাবন করল, যা ‘নফসকে’ নিসন্দেহে ধ্বংস করে দেয় এবং দেহকে করে দেয় অবশ্য ও পংগু। আধ্যাত্নিক দীক্ষার জন্য নিবিড় অরণ্য, পর্বত গুহা এবং এ ধরনের নির্জন কুটির প্রাঙ্গণকেই উপযুক্ত স্থান বলে মনে করল, যেন সমাজের কর্ম-কোলাহল তাদের এ ধ্যান-তপস্যার গভীর একাগ্রতায় বিন্দুমাত্র ব্যাঘ্যাত সৃষ্টি করতে না পারে। আত্নার ক্রমবিকাশ সাধনের জন্য তারা দুনিয়া ও দুনিয়ার এ বিপুল কর্মমুখরতা হতে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিল এবং পার্থিব জগতের সংস্পর্শে আসার সম্পস্ত সম্পর্ক ও সম্বন্ধকে সম্পূর্ণ ছিন্ন করে ফেলল। আত্নার উন্নতির জন্য এটা ভিন্ন অন্য কোন পথই তারা সম্ভব বলে মনে করল না।
পূর্ণতার দু’টি মত
দেহ ও আত্নার এ দ্বৈততা এবং ভিন্নতা মানুষের পূর্ণতা লাভের দু’টি ভিন্ন মত ও লক্ষ্য সৃষ্টি করেছে। একদিকে হচ্ছে পার্থিব জীবনের পূর্ণতা ও সার্থকতা-অর্থাৎ শুধু জড় ও বাস্তব সম্পদে পরিপূর্ণ হওয়া। মানুষ যখন একটা উত্তম পাথী, একটা উৎকৃষ্ট কুমীর, একটা ভাল ঘোড়া এবং একটা সার্থক শৃগাল হতে পারেব, তখনই সে পূর্ণতার একেবারে চরমতম স্তরে উন্নীত হয়েছে বলে মনে করতে হবে। অন্যদিকে হচ্ছে আধ্যাত্নিক জীবনের পরিপূর্ণতা। মানুষ কিছু অতি মানবিক ও অস্বাভাবিক শক্তির মালিক হলেই তা লাভ হলো বলে মনে করা হয়। আর মানুষের একটা ভাল রেডিও সেট, একটা শক্তিমান দূরবীণ এবং একটা সূক্ষ্ণদর্শী যন্ত্রে পরিণত হওয়া কিংবা তার দৃষ্টি এবং তার কণ্ঠ নি:সৃত শব্দের একটা পরিপুর্ণ ঔষধালয়ের কাজ দিতে শুরু করাই হয়েছে এ পথে পূর্ণতা লাভের একেবারে সর্বশেষ স্তর।
মানব সম্পর্কে ইসলামের ধারণা
মানব সম্পর্কে ইসলামের ধারণা
এ ব্যাপারে ইসলামের আদর্শ দুনিয়ার অন্যান্য সমগ্র ধর্মীয় ও দার্শনিক নীতি হতে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। ইসলাম বলে যে, আল্লাহ তায়ালা মানবাত্নাকে এ পৃথিবীতে তার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন। কিছু ইখতিয়ার ও স্বাধীনতা, কিছু কর্তব্য, কিছু দায়িত্ব তার উপর অর্পণ করেছেন এবং এসব পালন করার জন্য সর্বোত্তম ও সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি দেহও তাকে দান করেছেন। এ দেহ তাকে দেয়া হয়েছে এ উদ্দেশ্যে যে, তার স্বাধীনতার প্রয়োগ এবং তার সমস্ত দায়িত্ব পালন করার জন্য তার দেহকে ব্যবহার করবে। অতএব এ দেহ তার আত্নার কারবার নয়, এটা তার কারখানা। এ আত্নার কোন উন্নতি যদি সম্ভবই নয়, যোগ্যতার বাস্তব পরিচয় দেয়ার ভিতর দিয়েই সম্ভব হতে পারে। এ ছাড়া এ দুনিয়া কোন শক্তির ক্ষেত্রও নয়-মাবাত্না এখানে কোন রকমে বন্দী হয়ে পড়েছে এরূপ মনে করা যেতে পারে না। বরং এটি একটি কর্মক্ষেত্র, কাজ করার জন্যই আল্লাহ তায়ালা তাকে এখানে পাঠিয়েছেন। এখানকার অসংখ্য জিনিস তার অধীন করে দেয়া হয়েছে।
এখানে আরো অনেক মানুষকে এ খিলাফতের বিরাট দায়িত্ব পালন করার জন্য তার সঙ্গে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে প্রকৃতির সাধারণ দাবী অনুযায়ী তামাদ্দুন, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি এবং জীবনের অন্যান্য শাখা-প্রশাখাকে তারই জন্য তৈরী করা হয়েছে। এখানে কোন আধ্যাত্নিক উন্নতি যদি সম্ভব হয় তবে তা দুনিয়ার এ বিপুল কর্মক্ষেত্রে কাজ করে মানুষ তার অন্তর্নিহিত যোগ্যতার পরিচয় দিলেই তা সম্ভব। এটা তার জন্য একটা পরীক্ষাগার। জীবনের প্রত্যেকটা দিক ও প্রত্যেকটা বিভাগ সেই পরীক্ষার একেকটা ‘প্রশ্নপত্র’ বিশেষ। ঘর, মহল্লা, হাট-বাজার, অফিস, কারখানা, শিক্ষাগার, থানা, আদালত, সৈন্য শিবির, পার্লামেন্ট, সন্ধি সম্মেলন এবং যুদ্ধ ক্ষেত্র-সবকিছুই ভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নপত্র। এটা পূর্ণরূপে লিখে দেবার জন্যই তাকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মানুষ যদি এদের মধ্যে কোন বিষয়ে পূর্ণ সময় তার এবং তার উত্তর না দেয় কিংবা অধিকাংশ প্রশ্নপত্রের কোন উত্তরই যদি সে না লিখে তবে তার ফলে শূণ্য ছাড়া সে আর কি-ইবা পেতে পারে ? সে যদি তার সমস্ত লক্ষ্যকেই এ পরীক্ষা দেয়ার কাজে নিযুক্ত করে আর যত প্রশ্নপত্রই তাকে দেয়া হয়েছে, তার প্রত্যেকটার সে কিছু না কিছু উত্তর লিখে দেয়, তবেই যে সফলতা এবং উন্নতি লাভ করতে পারে, অন্যথায় তা কিছুতেই সম্ভব নয়।
বৈরাগ্যবাদের প্রতিবাদ
ইসলাম এভাবে জীবনের বৈরাগ্যবাদী ধারণাকে বাতিল করে দিয়েছে এবং মানুষের আধ্যাত্নিক উন্নতির পথ দুনিয়ায় বাহির হতে নয়, এর মধ্য হতেই বের করেছে। আত্নার ক্রমবিকাশ ও উৎকর্ষ এবং সাফল্য সার্থকতা লাভ করার আসল উপায় ইসলামের দৃষ্টিতে জীবন সমুদ্রের মাঝখানেই অবস্থিত-তার কিনারে নয়। ইসলাম আমাদের আত্নার উন্নতি ও অবনতির মাপকাঠি কি উপস্থিত করে তাই বিচার্য। বস্তুত এ প্রশ্নের জবাব খিলাফতের পূর্ব বর্ণিত ধারণার মধ্যেই বর্তমান রয়েছে। ‘খলিফা’ হওয়ার কারণে আল্লাহ তায়ালার সামনে মানুষ তার পরিপূর্ণ জীবনের কার্যাবলীর জবাবদিহি করতে বাধ্য। পৃথিবীতে যে স্বাধীনতা ও বিবিধ উপায়-উপাদান তাকে দান করা হয়েছে, সে সবগুলোকে আল্লাহর মর্জি অনুসারে ব্যবহার করাই তার কর্তব্য। যে শক্তি ও যোগ্যতা তাকে দেয়া হয়েছে, তা সে আল্লাহ তায়ালার অধিক হতে অধিকতর সন্তোষ লাভের জন্য ব্যয় করবে। অন্য মানুষের সঙ্গে তাকে যেসব সম্পর্ক সম্বন্ধ দ্বারা যুক্ত করা হয়েছে, তাতে সে আল্লাহর মনোনীত নীতি অবলম্বন করবে। মোটকথা নিজে সমগ্র চেষ্টা-সাধনা ও শ্রম-মেহনত ব্যয় করে পৃথিবী এবং তার মধ্যস্থিত মানুষের জীবনকে এত সুন্দর ও সুশৃংখল করবে, যত সুন্দর ও শৃংখলাপূর্ণ অবস্থায় তাকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দেখতে চান। মানুষ যত বেশী দায়িত্ব জ্ঞানের অনুভূতি, কর্তব্যপরায়ণতা, আনুগত্য এবং মালিকের সন্তুষ্টি লাভের আগ্রহ সহকারে এ কর্তব্য পালন করবে, আল্লাহ তায়ালার ততখানি নৈকট্য সে লাভ করতে পারবে। বস্তুত ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভই হচ্ছে আধ্যাত্নিক উন্নতি। ঠিক এর বিপরীত সে যতখানি অলস, কর্মবিমুখ কর্তব্যজ্ঞানহীন হবে, অথবা দুর্বিনীতি, বিদ্রোহী এবং অবাধ্য হবে, আল্লাহর নৈকট্য লাভ হতে সে ততখানি বঞ্চিত হবে। আর আল্লাহর নিকট হতে দূরে পড়ে থাকলেই ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় আধ্যাত্নিক অধপতন।
পার্থিব জীবনেই আত্নার উন্নতি
উপরের ব্যাখ্যায় একথা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, ইসলামের আদর্শ অনুযায়ী ধার্মিক ও দুনিয়াদার-উভয় ব্যক্তিরই কর্মক্ষেত্র এক, এরা উভয়ে একই কর্মক্ষেত্রে কাজ করবে। এবং সত্য বলতে গেলে দ্বীনদার ব্যক্তি দুনিয়াদার অপেক্ষাও অনেক বেশী কর্মব্যস্ত থাকবে। ঘরের চার প্রাচীর হতে শুরু করে আন্তর্জাতিক কন্ফারেন্স পর্যন্ত জীবনের যত ক্ষেত্র এবং ব্যাপারই হোক না কেন, এর যাবতীয় দায়িত্ব দ্বীনদার ব্যক্তি দুনিয়াদার ব্যক্তির শুধু সমান নয় বরং বেশী পরিমাণে নিজের উপর চাপিয়ে নিবে। তবে এ জিনিস এ উভয় ব্যক্তির পথকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তা হচ্ছে আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্কের স্বরূপ। দ্বীনদার ব্যক্তি যাই করবে তা ঠিক এ অনুভূতি নিয়েই করবে যে, আল্লাহর নিকট হতেই তার উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার উদ্দেশ্যই সে কাজ করবে এবং আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত আইন অনুসারেই তা করবে। পক্ষান্তরে দুনিয়াদার ব্যক্তি সমস্ত কাজই করবে দায়িত্বহীনভাবে এবং নিজের ইচ্ছামত। এ পার্থ্যকই দ্বীনদার ব্যক্তির সমগ্র পার্থিব জীবনকে সম্পূর্ণরূপে আধ্যাত্নিক জীবনে পরিণত করে এবং দুনিয়াদার ব্যক্তির সমগ্র জীবনকে আধ্যাত্নিকতার আলো হতে বঞ্চিত করে।
আধ্যাত্নিক উন্নতির চার স্তর
আধ্যাত্নিক উন্নতির চার স্তর
ইসলাম পার্থিব জীবনের মাঝ দরিয়ায় মানুষের বৈষয়িক উন্নতির যে পথ তৈরী করেছে এখন সংক্ষেপে তার আলোচনা করব। এ পথের প্রথম স্তর হচ্ছে ‘ঈমান’। অর্থাৎ মানুষের মন ও মগযে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হওয়া যে, আল্লাহ-ই তার মালিক, আইন রচয়িতা এবং উপাস্য। আল্লাহর সন্তোষ লাভই তার সমস্ত চেষ্টা-সাধনার একমাত্র উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর আইন-ই তার জীবনের একমাত্র আইন। এ বিশ্বাস যতদূর গভীর এবং দৃঢ় হবে, মানুষের মন ততই পরিপূর্ণ ইসলামী হবে। আর ততবেশী দৃঢ়তার সাথে মানুষ আধ্যাত্নিক উন্নতির পথে চলতে পারবে।
এ পথের দ্বিতীয় মনযিল হচ্ছে ‘এতায়াত’-আনুগত্য, অর্থাৎ কার্যত মানুষের নিজের স্বাধীনতা পরিত্যাগ করা এবং কর্মজীবনে সেই আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্ব কবুল করা যাকে সে নিজের রব বলে মেনে নিয়েছে। কুরআনের পরিভাষায় এ এতায়াতের নাম হচ্ছে- ‘ইসলাম’।
তৃতীয় অধ্যায় হচ্ছে ‘তাকওয়া’। সহজ ভাষায় যাকে আমরা বলতে পারি কর্তব্যজ্ঞান ও দায়িত্ববোধ। মানুষ নিজের জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই একথা স্মরণ রেখে কাজ করবে যে, আল্লাহর সমীপে তার চিন্তা, কথা ও কাজের পরিপূর্ণ হিসেব দিতে হবে এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ প্রত্যেক কাজ হতে সে বিরত থাকবে। আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী প্রত্যেকটি খেদমতের জন্য কোমর বেধে লেগে যাবে এবং পরিপূর্ণ সাবধানতার সাথে হালাল-হারাম, সত্য-মিথ্যা এবং ভাল-মন্দের বিচার করে পথ চলবে-বস্তুত এটাই হচ্ছে ‘তাকওয়া’।
সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ মনযিল হচ্ছে ‘ইহসান’। ইহসানের অর্থ আল্লহর মর্জির সাথে মানুষের মর্জির একাত্নতা। আল্লাহ যা পসন্দ করেন, মানষও ঠিক তা-ই পসন্দ করবে। আর আল্লাহ যা পসন্দ করেন না, মানুষের মনও ঠিক তাকে অপসন্দ করবে। আল্লাহ তার নিজের পৃথিবীতে যেসব পাপের অস্তিত্ব দেখতে ভালবাসেন না, মানুষ নিজেও তা হতে দূরে সরে থাকবে। বরং তাকে বিলুপ্ত করার জন্য মানুষ সমগ্র শক্তি এবং সকল প্রকার উপায়কে নিয়োজিত করবে। আর আল্লাহ তার দুনিয়াকে যেসব কল্যাণ ব্যবস্থায় সুসজ্জিত দেখতে চাহেন মানুষ শুধু তার নিজেকে তা দ্বারা সজ্জিত করেই ক্ষান্ত হবে না, বরং মরণপন সংগ্রাম করে সারা দুনিয়াতে তাকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চেষ্টা করবে। এ স্তরে পৌছলেই মানুষের ভাগ্যে আল্লাহর সর্বাধিক নৈকট্য লাভ ঘটে। এ জন্যই এটা মানুষের আধ্যাত্নিক উন্নতির সর্বোচ্চ অধ্যায়।
জাতি ও রাষ্ট্রীয় তাকওয়া এবং ইহসান
আধ্যাত্নিক উন্নতির এ পথ আলাদাভাবে কেবল ব্যক্তিদের চলার জন্যই নয়, সমগ্র সমাজ ও জাতির জন্য এটাই একমাত্র পথ। স্বতন্ত্র ব্যক্তির ন্যায় একটি জাতিও ঈমান, এতায়াত এবং তাকওয়ার বিভিন্ন মনযিল অতিক্রম করে ইহ্সানের সর্বশেষ স্তর পর্যন্ত পৌছতে পারে। একটা রাষ্ট্রও এর সমগ্র ব্যবস্থা সহকারে ‘মু’মিন’, ‘মুসলিম’, ‘মুত্তাকী’ এবং ‘মুহসীন’ হতে পারে। বরং প্রকৃতপক্ষে ইসলামের উদ্দেশ্য ঠিক তখনি পূর্ণতা লাভ করতে পারে, যখন একটা জাতিই এ পথে চলতে শুরু করে এবং দুনিয়ার বুকে মুত্তাকী ও মুহসিন-তাকওয়াপূর্ণ ও ইহ্সানওয়ালা-রাষ্ট্র কায়েম হবে।
আধ্যাত্নিকতার জন্য ইসলামের দীক্ষা পদ্ধতি
ব্যক্তি ও সমাজের আধ্যাত্নিক দীক্ষা পালনের জন্য এবং এটাকে উচ্চতম আদর্শের উপযোগী করে তৈয়ার করার জন্য ইসলাম যে পন্থা অবলম্বন করেছে সর্বশেষে তার বিশ্লেষণ করব। ইসলামের এ দীক্ষা পদ্ধতির বুনিয়াদী পন্থা চারটি।
প্রথম পন্থা হচ্ছে-সালাত।
ইহা দৈনিক পাচবার মানুষকে নতুন করে আল্লহকে স্মরণ করিয়ে দেয়, আল্লাহর ভয়কে বারবার সতেজ করে দেয়। এতে আল্লাহর প্রেম ও ভালবাসা মানুষের নিত্য নতুন করে জেগে উঠে। তার আদর্শ ও বিধি-নিষেধ পুন: পুন: মানুষের সামনে উপস্থিত করে। এবং তা অনুসরণ করে চলার কথা বারবার স্মৃতিপটে জাগ্রত করে। সালাত শুধু একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারই নয়, তা জামায়াতের সাথেই আদায় করার জন্য ফরয করা হয়েছে, যেন গোটা সমাজেই সমষ্টিগতভাবেই এ আধ্যাত্নিক উন্নতির পথে চলার জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
দ্বিতীয় পন্থা হচ্ছে-সওম।
এটা প্রত্যেক বছরই পূর্ণ এক মাসকাল ধরে স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেকটি মুসলিম ব্যক্তিকে এবং সমষ্টিগতভাবে গোটা মুসলিম সমাজকে তাকওয়ার দীক্ষা দেয়।
তৃতীয় পন্থা হচ্ছে-যাকাত।
এটা মুসলিম ব্যক্তিদের মধ্যে অর্থ দান, পারস্পরিক সহানুভুতি এবং সহযোগিতার ভাব সৃষ্টি করে। আজকালকার মানুষ ভুলবশত যাকাতকে ট্যাক্স বলে মনে করছে। অথচ যাকাতের মূল ভাবধারা ট্যাক্সের ভাবধারা হতে সম্পূর্ণ পৃথক। যাকাতের আসল অর্থ হচ্ছে ক্রমবিকাশ ও পবিত্রতা দান। এ শব্দটি দ্বারা ইসলাম মানুষের মনে এই নিগূঢ় তত্ত্বের অনুভূতি জাগিয়ে দিতে চায় যে, আল্লাহর প্রেমে তুমি তোমার ভাইদেরকে যে আর্থিক সাহায্য করবে, তাতে তোমার আত্না উন্নতি লাভ করবে এবং তোমার চরিত্র পূত ও পবিত্র হবে।
চতুর্থ পন্থা হচ্ছে-হজ্জ।
এটা আল্লাহর ইবাদাতের কেন্দ্রস্থল। ঈমানদার ব্যক্তিদেরকে একত্র করে এক বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের সৃষ্টি করে। এবং এটা এমন আন্তর্জাতিক আন্দোলন পরিচালিত করে, যা দুনিয়ার কয়েক শতাব্দী কাল ধরে সত্যের প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ইনশআল্লাহ ভবিষ্যতেও অনন্তকাল পর্যন্ত তা সত্যেরই প্রতিষ্ঠা করতে থাকবে।
0 comments: